দ্বিতীয় অন্তর্দশায় এই কৃষ্টির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ ঘটে। এযুগে তার ছ্যাচাবেড়ার মাটির ঘর তৈরি করত। মাটির ঘরগুলি চক্রাকারে নির্মিত হত ! এ যুগে প্রস্তরনির্মিত শিল্পের বহুমুখী বিকাশ ঘটে। এদের তৈরি মৃৎপাত্রসমূহের সঙ্গে তামা ও ব্রোঞ্জে নির্মিত কয়েকটা টুকরা বস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। রেডিয়ো-কারবন-১৪ পরীক্ষায় এ যুগের বয়স নির্ণীত হয়েছে খ্ৰীস্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৫০০ অব্দ।
তৃতীয় যুগে প্রস্তরনিমিত কুঠার ও ছুরির ফলাশিল্পের অবিচ্ছিন্ন ক্রমোন্নতি লক্ষ্য করা যায়। তামা ও ব্রোঞ্জ নিমিত বস্তু বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। তামার বড়শিও পাওয়া গিয়েছে, এবং তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তারা মৎস্তভোজী ছিল। এ যুগে মৃৎপাত্রগুলি চক্রে নির্মিত হত এবং সেগুলি আগেকার যুগের মৃৎপাত্রের চেয়েও কঠিন করা হত। তবে মহীশূরের হলুরের লোকেরা ঘোড়া (?) ব্যবহার করত। এসব বস্তুর রেডিয়ে-কার্বন-১৪ পরীক্ষা বিশেষভাবে করা হয়নি। তবে মহারাষ্ট্রের জোরওয়ের কৃষ্টির ভিত্তিতে এর বয়স নিরূপিত হয়েছে খ্রীস্টপূর্ব ১৪০ থেকে ১০৫০ অব্দ পর্যন্ত।
নবোপলীয় যুগের প্রাদুর্ভাব পূর্বভারতেও ছিল। এই সম্পর্কে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কিছুদিন আগে পর্যন্ত পণ্ডিতমহল মনে করতেন যে মধ্য-প্রাচীর জারমে, জেরিকো ও কাটাল হুয়ুক নামক স্থানসমূহেই নবোপলীয় সভ্যতার প্রথম উন্মেষ ঘটে, এবং তা বিকশিত হয়ে ক্রমশ ইরানীয় অধিত্যকা ও মধ্য-এশিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু পরবর্তী আবিষ্কারের ফলে জানা গিয়েছে যে, এরও আগে নবোপলীয় সভ্যতার প্রাতুর্ভাব ঘটেছিল থাইল্যাণ্ডে। এ সভ্যতার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন রোনালড শিলার। সি. ও. সয়ারও তার ‘এগ্রিকালচারেল অরিজিনস অ্যাণ্ড ডিসপারসেল গ্রন্থে বলেছেন যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই নবোপলীয় বিপ্লবের প্রাচীন লীলাভূমি ছিল বলে মনে হয়। প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ কারলটন এস. কুন তার ‘দি হিস্ট্রি অভ ম্যান’ বইয়ের ১৪৫ পৃষ্ঠায় নবোপলীয় সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ’-এর যে মানচিত্র দিয়েছেন, তাতেও তিনি নবোপলীয় সভ্যতার উৎপত্তি সম্বন্ধে পূর্ব-ভারতে এক স্বতন্ত্র উৎপত্তি-কেন্দ্র দেখিয়েছেন। কারলো চিপোলোও ( Cario Cipollo ) তার ‘দি ইকনমিক হিস্ট্রি অভ ওয়ার্লড পপুলেশন’ গ্রন্থে নানা তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন যে ‘বঙ্গোপসাগরের আশপাশের মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ অঞ্চলেই স্বাধীনভাবে ভূমিকৰ্ষণ ও পশুপালনের সূচনা হয়েছিল। তবে পূর্বভারতে নবোপলীয় যুগের যে-সব নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, তা উৎখননের ফলে পাওয়া যায়নি। সবই মাটির ওপর থেকে বা নদীর স্তরের মধ্য থেকে পাওয়া গিয়েছে। অধিকাংশই হচ্ছে নবোপলীয় যুগের রীতি অনুসারে নির্মিত পাথরের মন্থণ কুঠার। আসামের নানা স্থানে, গাঙ্গেয় উপত্যকায় মিরজাপুর ও বান্দা জেলায়, বিহারের সাওতাল পরগনায়, ওড়িষার ময়ুরভঞ্জে, ও বাঙলার বন-অসুরিয়া, কচিণ্ডা, জয়পাণ্ডা উপত্যক, অরগণ্ডী, কুকরাধুপি, তমলুক, শুশুনিয়া, তামাজুরি, চাতলা, আগাইবানি, হরিনারায়ণপুর প্রভৃতি স্থান থেকেও এরূপ কুঠার পাওয়া গিয়েছে।
নবোপলায় যুগেই কৃষি ও বয়নের উদ্ভব হয় এবং মানুষ পশুপালন করতে শুরু করে। এ যুগের ধর্মীয় আচার সম্বন্ধে আমাদের খুব বেশি কিছু জানা নেই। তবে প্রত্ন-প্রস্তর যুগের মানুষের মত তারা ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিত ও মৃতব্যক্তির সমাধির ওপর একখানা লম্বা পাথর খাড়াভাবে পুঁতে দিত। এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত পাথর আমরা মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, হুগলি প্রভৃতি জেলায় লক্ষ্য করি। সেগুলিকে ‘বীরকাঁড়’ বলা হয়।
এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত প্রস্তরফলক আমরা পশ্চিমবঙ্গের যেসব জায়গায় পেয়েছি, তার একটা বিবরণ দিচ্ছি। বাঁকুড়া শহর থেকে দশ মাইল পশ্চিমে ছাতনায় এক পুকুরের কাছে এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত স্মৃতিফলক আমরা দেখতে পাই ; এগুলি চার-পাঁচ ফুট উচু এবং এগুলির গায়ে অপরিণত শৈলীর ক্ষোদিত মূর্তি আছে। এগুলি সম্বন্ধে নানারূপ জনশ্রুতি বিদ্যমান। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, যে-সকল সাহসী বীর সৈনিক যুদ্ধে নিহত হতেন, এগুলি তাদেরই সমাধির ওপর প্রোথিত। মেদিনীপুরের কিয়ারার্চাদ গ্রামেও এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত বহু প্রস্তরফলক দেখতে পাওয়া যায়। এগুলির বর্ণনায় বলা হয়েছে–‘Rounded at the top, they seemed to have been deliberately chiselled and stand on the open field as rigid and uncommunicative sentinels which they certainly are, continuing to baffle his torians as to how they originated.’
এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত প্রস্তরফলক বাঁকুড়া জেলার ছাতনার ফু-মাইল দূরে মৌলবনায় ও হুগলি জেলাতেও পাওয়া গিয়েছে। হুগলি জেলাতে এগুলিকে ‘বীরকাড়’ বলা হয়। মনে হয়, এগুলি অনু-অস্ট্রেলীয় বা প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জাতির অবদান। কেননা, দক্ষিণ ভারতের আদিবাসীদের মধ্যেও আমরা এরূপ ঋজুভাবে প্রোথিত প্রস্তরফলক দেখি। নীলগিরি পাহাড়ের অধিবাসী কুডুম্বা উপজাতির লোকেরা এরূপ প্রস্তরফলককে বীরকন্তু নামে অভিহিত করে ও এগুলির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। কুডুম্বা ও ইরুল উপজাতিদের ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে বীরপুরুষের স্মৃতিফলক। এককথায়, এগুলি হচ্ছে সমাধির ওপর স্মৃতিফলক। সমাধির ওপর এরূপ স্মৃতিফলক ছোটনাগপুরের হো ও মুণ্ড জাতির গ্রামেও ডালটন ( Dalton ) দেখেছিলেন। নীলগিরি পাহাড়ের কুডুম্বাদের মত ছোটনাগপুরের হো ও মুণ্ডারাও এগুলির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ছোটনাগপুরের খেরিয়া উপজাতির মধ্যে প্রচলিত এরূপ স্মৃতিফলক সম্বন্ধে বলা হয়েছে—