আগেই বলা হয়েছে যে অন্তিম প্রত্নোপলীয় যুগের মানুষ হয় নদীর ধারে, আর তা নয়তো পাহাড়ের ওপরে বা পাহাড়ের ছাউনির মধ্যে মাটির ঘর তৈরি করে বাস করত। এসব জায়গায় কোন কোন স্থানে আয়ুধ-নির্মাণের কারখানাও পাওয়া গিয়েছে। তা থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সে-যুগের মানুষ সম্পূর্ণভাবে যাযাবরের জীবন যাপন করত না। তার মানে, এ যুগের মানুষ সমাজবদ্ধ হবার চেষ্টা করছিল। সেট বুঝতে পারা যায় কয়েক জায়গায় পাহাড়ের গায়ে তাদের চিত্রাঙ্কন থেকে। এ চিত্রগুলি তারা খুব সম্ভবত ঐন্দ্রজালিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করত। অর্থাৎ তাদের মধ্যে ধর্মেরও উন্মেষ ঘটছিল।
এই স্থায়ী বসতিস্থাপনের প্রবণতা নবোপলীয় যুগেই বিশেষভাবে প্রকটিত হয়। তারা পশুপালন ও কৃষির উপযোগী স্থানেই বসতিস্থাপন করত। কৃষির উদ্ভব কিভাবে ঘটেছিল, সেটা এখানে বলতে চাই। ভূমিকৰ্ষণের সূচনা করেছিল মেয়েরা। পশুশিকারে বেরিয়ে পুরুষের যখন ফিরতে দেরি হত, তখন মেয়েরা ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ফল এবং ফলাভাবে বন্য অবস্থায় উৎপন্ন খাদ্যশস্ত খেয়ে প্রাণধারণ করত। তারপর তাদের ভাবনা-চিন্তায় স্থান পায় এক কল্পনা। সস্তানউৎপাদনের প্রক্রিয়া তাদের জানাই ছিল। যেহেতু ভূমি বন্ত অবস্থায় শস্য উৎপাদন করে, সেইহেতু তারা ভূমিকে মাতৃরূপে কল্পনা করে নেয়। যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তারা ভাবতে থাকে, পুরুষ যদি নারীরূপ ভূমি ( পরবর্তীকালে আমাদের সমস্ত ধর্মশাস্ত্রেই মেয়েদের ক্ষেত্র বা “ভূমি’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে ) কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করতে পারে তবে মাতৃরূপ পৃথিবীকে কর্ষণ করে শস্য উৎপাদন করা যাবে না কেন ? তখন তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক যষ্টি বানিয়ে নিয়ে ভূমি কর্ষণ করতে থাকে। (Przyluski তাঁর ‘Non-Aryan Loans in Indo-Aryan’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে ‘লিঙ্গ’, ‘লাঙ্গুল’ ও ‘লাঙ্গল’— এই তিনটি শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন )। মেয়েরা এইভাবে ভূমি কর্ষণ করে শস্য উৎপাদন করল। পুরুষরা তা দেখে অবাক হল। তারা লক্ষ্য করল লিঙ্গরূপী যষ্টি হচ্ছে passive, আর ভূমিরূপী পৃথিবী ও তাদের মেয়েরা হচ্ছে active | Active মানেই হচ্ছে শক্তির আধার। ফসল তোলার পর যে প্রথম ‘নবান্ন’ উৎসব হল, সেই উৎসবেই জন্ম নিল লিঙ্গপূজা ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা। ( অতুল সুর, হিন্দু সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য, পৃষ্ঠা ৮১ দ্রঃ)। লিঙ্গপূজার সূচনা যে নবোপলীয় যুগেই হয়েছিল, সে-সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা পাওয়া যাবে আমার ‘বিগিনিংস অভ লিঙ্গ কালটু ইন ইণ্ডিয়া’ প্রবন্ধে (অ্যানালস অভ দি ভাণ্ডারকার ওরিয়েণ্টাল ইনষ্টিট্যুট, ১৯২৯)।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে নবোপলীয় যুগের যে-সব নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, তাদের বয়স আজ পর্যন্ত নির্ণীত হয়নি। মাত্র ইদানীং কালে প্রাপ্ত যেগুলির রেডিয়ো-কারবন-১৪ পরীক্ষা হয়েছে, সেগুলির তারিখ নীচে দেওয়া হল। ( সবই খ্ৰীস্টপূর্ব তারিখ)
১. কাশ্মীরের বুরজহোম — ২৪১৮-১৫৯৩
২. অন্ধ্রপ্রদেশের উটনুর — ২১৭০-১৯২৫
৩. কালিবঙ্গানের প্রাক্-হরপ্পীয় — ২১৪৫-১৬০০
৪. মহীশূরের টেকলকোটা — ২৬৭৫-১৪৪৫
৫. মহীশূরের নরশিপুর তালুক — ১৬৯৫-১৩৯৫
৬. মহীশূরের সঙ্গমকল্লু — ১৪৯০-১৪৫০
৭. মহীশূরের হুল্লুর — ১৬১০-
৮. মাদ্রাজের পৈয়ামপল্লী — ১৩৯০-
( মাত্র এই তারিখগুলি থেকে ভারতে নবোপলীয় কৃষ্টির প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে সিদ্ধাস্ত করা ভুল হবে। )
কাশ্মীরের বুরজহোমের নবোপলীয় যুগের লোকেরা মাটির তলায় গুহাগৃহে বাস করত। গুহার প্রবেশদ্বারের নিকট রন্ধনের জন্য উজুন তৈরি করত। বৈষয়িক বস্তুর মধ্যে ধূসর ও কৃষ্ণবর্ণের পালিশ-করা মৃৎপাত্র, হাড়ের তৈরি স্বচাল স্থচ যন্ত্র, ও হারপুন, পাথরের তৈরি কুঠার, পাথরের তৈরি গোল বালা ও মাংস কাটবার ছুরি ও অস্ত্র পাওয়৷ গিয়েছে। তবে এখানে পাথরের তৈরি ছুরির ফলা ও জাতা-জাতীয় কোন পেষণ-যন্ত্র পাওয়া যায়নি। রেডিও-কার্বন-১৪ পরীক্ষা দ্বারা জানা গিয়েছে যে, এই কৃষ্টি খ্রীস্টপূর্ব ২৪১৮ অব্দ থেকে ১৫৯৩ অব্দ পর্যন্ত প্রাকুভূত ছিল। অন্তিমদশায় ধনুকে ব্যবহারের জন্য তামার তৈরি একটিমাত্র বাণমুখ পাওয়া গিয়েছে। এরা মৃতব্যক্তিকে ডিম্বাকার গর্তের মধ্যে কবর দিত এবং মৃতের সঙ্গে কুকুরকেও সমাধিস্থ করত।
দক্ষিণভারতে অনেককাল আগেই ব্রুস ফুট (R. Bruce Foote) কর্ণাটক অঞ্চলে কৃষ্ণা নদীর অববাহিকায় নবোপলীয় যুগের বহু কুঠার পেয়েছিলেন। ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দের পর স্যার মর্টিমার হুইলার (Sir Mortimer Wheeler ) ব্রহ্মগিরিতে খনন শুরু করবার পর থেকে সমনকল্প, পিকলিহাল, মাসকি, টেক্কলকোটা, হুলুর, উটমুর ও কুপগলে নবোপলীয় যুগের বসতি আবিষ্কৃত হয়েছে। উটমুর ও কুপগলে নবোপলীয় যুগের গরুর খাটালও পাওয়া গিয়েছে। এসকল স্থানে প্রাপ্ত বস্তুসমূহের রেডিয়ো-কার্বন-১৪ পরীক্ষাও হয়ে গিয়েছে (উপরে দেখুন )। সবচেয়ে পুরানো যে তারিখ পাওয়া গিয়েছে, তা হচ্ছে খ্রীস্টপূর্ব ২১৭০ অব্দ অন্ধ্রপ্রদেশের উটনুরে।
দক্ষিণভারতের নবোপলীয় যুগের কৃষ্টিসমূহকে তিনটি অবিচ্ছিন্ন অন্তর্দশায় বিভক্ত করা হয়। যারা সর্বপ্রথম বসতিস্থাপন করেছিল তারা গরু, ভেড়া ও ছাগল (তুলনা করুন বাংলা মঙ্গলকাব্যে বর্ণিত লহনা-ফুল্লরার কাহিনী ) পালন করত। তাদের বৈষয়িক সম্পদের মধ্যে ছিল পাথরের তৈরি মন্থণ কুঠার ও ছুরির ফলা, ধূসর বা বাদামী রঙের হাতে-গড়া মৃৎপাত্র ইত্যাদি। তাদের তৈরি মৃৎপাত্রের সঙ্গে আমরি ও কালিবঙ্গানের প্রাক্-হরপ্পীয় মৃৎপাত্রের কিছু সাদৃশ্য দৃষ্ট হয়। এদের বসতি ছিল পাহাড়ের ওপর বা দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী মালভূমিতে এবং খাটালগুলি নিকটস্থ বনে অবস্থিত ছিল। পাহাড়ের গায়ে তারা চিত্রাঙ্কন করত ও পোড়ামাটির ককুদ-বিশিষ্ট বলীবর্দ প্রভৃতির মূতি তৈরি করত। তাদের মধ্যে জাতার ব্যবহার ছিল ; সুতরাং তা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে তারা শস্য উৎপাদন করত। ধাতুর ব্যবহার তাদের মধ্যে মোটেই ছিল না।