শেষোক্তটি সবচেয়ে প্রাচীন কঙ্কালাস্থি বলে মনে হয়। এ ছাড়া ‘মেগালিথিক’ যুগের ( প্রধানত লৌহযুগের ) যে-সকল সমাধিস্তৃপ আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলির উল্লেখও এখানে করা যেতে পারে :
১. ১৮৯৯ থেকে ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে আলেকজাণ্ডার রিয়া ( Alexander Rea ) কর্তৃক আবিষ্কৃত তিনেভেলি জেলার আদিচানালুরের সমাধিসমূহ।
২. ১৯১৬ থেকে ১৯২৪ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ডক্টর হাণ্ট (E. H. Hunt) কর্তৃক আবিষ্কৃত হায়দারাবাদের পূর্বদিকে রায়গির ও ভঙ্গির সমাধিসমূহ।
৩. ১৯৪৫ খ্রীস্টাব্দের পরে ব্রহ্মগিরিতে চিংগিলপুট জেলার সামুরিলে, ত্রিচুর জেলার পরকালামে, অন্ধ্রপ্রদেশের নাগাজুনাকুও ও ইল্লেশ্বরমে, কর্ণাটকের মাসকিতে, মহীশূরের জদিগেহল্লি, ও পণ্ডিচেরিতে সৌটেইকেলি ও মাওস্তরপেলের সমাধিসমূহ।
উল্লিখিত এই কঙ্কালসমূহকে আমরা পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত করতে পারি—(১) নবোপলীয় যুগের, (২) হরপ্পা যুগের, (৩) দাক্ষিণাত্যের তাম্রাশ্ম যুগের, (৪) মেগালিথিক ( প্রধানত লৌহ ) যুগের ও (৫) আদি ঐতিহাসিক যুগের। তবে মেদিনীপুরের সিজুয়ায় প্রাপ্ত অশ্মীভূত চোয়ালটির বয়স ১০,০০০ বৎসর বলে দাবি করা হয়েছে। সেটা যদি যথার্থ হয়, তা হলে ওটি অন্তিম প্রত্নোপলীয় যুগের।
কঙ্কালগুলির আবয়বিক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে পণ্ডিতগণ সিদ্ধান্ত করেছেন—(১) হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো ও লোথালের লোকেরা অধিকাংশই দীর্ঘশিরস্ক এবং বিস্তৃতনাসা ছিল, তবে মহেঞ্জোদারোর লোকদের নাক হরপ্পা-লোথালের লোকদের মত অত বিস্তৃত ছিল না। (২) হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর লোকদের তুলনায় লোথালের লোকদের মাথা চওড়া ছিল। (৩) এইসকল পার্থক্য, যথা—মাথার খুলির আকার, নাকের গঠন, ও আকারের দিক থেকে বোঝা যায় তারা সকলে একই নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। (৪) তার দীর্ঘশিরস্ক, প্রশস্তনাসা ও আকারে লম্ব ছিল বটে, কিন্তু হরপ্পা যুগে গুজরাটে ও সিন্ধুপ্রদেশে এক বিস্তৃতশিরস্ক জাতিরও অস্তিত্ব ছিল। (৫) ব্রহ্মগিরি, নাগাজুনাকুণ্ড, পিকলিহাল, মাসক ও ইল্লেশ্বরম থেকে মেগালিথিক যুগের প্রাপ্ত কঙ্কালসমূহ থেকে বুঝতে পারা যায় যে মেগালিথ (সমাধিস্তুপের উপর স্মৃতিফলক ) নির্মাণকারীরা অধিকাংশই বিস্তৃতশিরস্ক, আকারে লম্বা ও দৃঢ়-দেহ বিশিষ্ট লোক ছিল। (৬) কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশের আদিচান্নালুরের ও দক্ষিণ ভারতের সমাধি-স্তৃপগুলিতে যে-সকল নরকঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে,তারা দীর্ঘশিরস্ক ও নাতিদীর্ঘশিরস্ক ছিল। (৭) উজ্জয়িনী, কৌশাম্বী ও তক্ষশিলা হতে প্রাপ্ত কঙ্কালসমূহ থেকে বুঝতে পারা যায় যে ওইসকল স্থানে দীর্ঘশিরঙ্ক জাতির লোকেরাই প্রথমে বাস করত, এবং পরে সেখানে এক বিস্তৃতশিরস্ক জাতির অনুপ্রবেশ ঘটে।
সুতরাং এইসকল সিদ্ধান্ত থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে, (১) নবোপলীয় যুগের লোকের দীর্ঘশিরস্ক ছিল। (২) হরপ্পা ও অন্যান্য তাম্রাশ্ম যুগের লোকেরা দীর্ঘশিরস্ক ও নাতিদীর্ঘশিরস্ক ছিল। কিন্তু গুজরাট ও সিন্ধুপ্রদেশে বিস্তৃতশিরস্ক জাতিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। (৩) মেগালিথিক যুগের লোকেরা বিস্তৃতশিরস্ক ছিল। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে বিস্তৃতশিরস্ক জাতিসমূহের আগমন পরে ঘটেছিল। এখানে বক্তব্য যে বাঙলার পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে যে কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে তা দীর্ঘশিরস্ক। তারা যে ভূমধ্যসাগরীয় গোষ্ঠীর লোক, ত৷ ওখানে প্রাপ্ত ক্রীটদেশীয় এক সীলমোহর দ্বারা সমর্থিত হয়।
খুব বিপদসঙ্কুল ছিল প্রথম মানবের জীবন। একদিকে যেমন তাকে অতিকায় এবং হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হত, অপরদিকে তেমনই খাদ্য আহরণের জন্য তাকে পশুশিকারে বেরতে হত। এককথায় প্রাণের ও পেটের দায়ই ছিল তার সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাছাড়া কোন এক বিশেষ জায়গাতেও সে বহুদিন অবস্থান করতে পারত না। কেননা কোন এক জায়গায় পশুর সংখ্যা হাস পেলে তাকে অপর জায়গায় সরে যেতে হত। তার মানে তাকে যাযাবরের জীবন যাপন করতে হত। এভাবে জীবনের প্রথম অধ্যায়ে তাকে ৪৯০,০০০ বৎসর কাটাতে হয়েছিল। তার জীবনের এই প্রথম অধ্যায়টাকে আমরা প্রত্নোপলীয় (palaeolithic) যুগ বলি। কেননা এ যুগের মানুষ মাত্র পাথর দিয়েই তার আয়ুধ ও অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিস তৈরি করত। এই দীর্ঘকালের মধ্যে মানুষ কৃষির উদ্ভব ঘটাতে পারেনি এবং কোনরূপ ধাতুর ব্যবহারও জানত না। তবে এই সময়ের মধ্যে মানুষ পাথর দিয়ে তৈরি শিল্পের একটা ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছিল। এই ক্রমবিকাশের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রত্নোপলীয় যুগকে তিনটি দশায় ভাগ করা হয় : (ক) early বা আদিম দশা, (খ) middle বা মধ্য দশা, ও (গ) late বা অন্তিম দশা। অন্তিম প্রত্নোপলীয় যুগের অপর নাম mesolithic period বা সন্ধিকালের যুগ। সন্ধিকালের যুগ বলবার উদ্দেশ্য এই যে, এটাই ছিল প্রত্নোপলীয় (palaeolithic) নবোপলীয় (neolithic) যুগের মধ্যে সেতুবন্ধন।
আগেই বলেছি যে ইউরোপে প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধসমূহ চকমকি পাথর (flint) দিয়ে তৈরি করা হত ; আর ভারতে এগুলি তৈরি করা হত নদীর ধারে পাওয়া মুড়ি (pebbles) ও কোয়ার্টজাইট পাথর দিয়ে। আদিম (early) প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধসমূহ ছিল পাথরের কেন্দ্রগ আয়ুধ (core tools)। একটা মুড়িকে অপর একটা মুড়ি দিয়ে সজোরে আঘাত করে, তা থেকে চাকলা তুলে পাথরের পিণ্ডট দিয়ে এগুলি তৈরি করা হত। এ-যুগের বৈশিষ্ট্যমূলক আয়ুধ ছিল হাত-কুঠার (hand-axes), মাংস কাটবার অস্ত্র (choppers), মাংস ছেদন করবার আয়ুধ (cleavers) ইত্যাদি। তবে মূল নুড়ি থেকে যে চাকলাগুলি বেরত, সেগুলিও কোন কোন ক্ষেত্রে ছুরি হিসাবে ব্যবহার করা হত। প্রত্নোপলীয় যুগের মধ্যম দশার বৈশিষ্ট্যমূলক আয়ুধগুলি পাথরের চাকলা দিয়েই তৈরি করা হত। এ যুগের মানুষরা এই শ্রেণীর আয়ুধ নির্মাণেই বিশেষ দক্ষতা লাভ করেছিল। মাংস চাচবার জন্য এইসকল আয়ুধ (scrapers) ব্যবহৃত হত। এরকম আয়ুধসমূহকে ‘flake tools’ বলা হয়। আগেকার যুগের আয়ুধসমূহও এ-যুগের মানুষ ব্যবহার করত, তবে সেগুলির নির্মাণরীতি আগেকার যুগের নির্মাণরীতি অপেক্ষা অনেক পরিমাণে উন্নত ধরনের ছিল। অস্তিম প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধসমূহকে ‘mesoliths’ বলা হয়। এগুলি নানা ধরনের অতি-ক্ষুদ্রকায় আয়ুধ। এ-যুগের মানুষ পর্বতগুহায় ও পাহাড়ের ছাউনির তলায় (rock-shelters) বাস করত। এবং পর্বতগাত্রে নানারকম চিত্রাঙ্কন করত। বোধহয়, এসকল চিত্রাঙ্কন ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হত। ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়াই ছিল আদিম মানুষের সর্বজনীন ধর্ম।