এ বিষয়ে নৃতত্ত্ববিদগণ একমত যে পৃথিবীতে বর্তমানে যত জাতি বিদ্যমান আছে, তারা সকলে একই বর্গ (genus ) ও প্রজাতি ( species) হতে উদ্ভূত। তবে তাদের মধ্যে যে-সকল বৈশিষ্ট্যমূলক আবয়বিক পার্থক্য আছে, তার জন্য তাদের বিভিন্ন জাতিপর্যায়ের ( races ) লোক বলা হয়। যে-কারণে এইসকল নর-গোষ্ঠীর মধ্যে পর্যায়গত পার্থক্য ঘটেছে, তা হচ্ছে—(১) gene mutation বা জনঘটিত পরিব্যক্তি, (২) natural selection বা প্রাকৃতিক নির্বাচন, (8) genetic drift qi to fissol, (8) environmental influence qi offo olef”, 3 (4) population mixture বা জন-মিশ্রণ।
আবির্ভাবের দিন থেকেই মানুষের প্রধান সমস্যা ছিল আত্মরক্ষা ও খাদ্য আহরণ। যে যুগে মানুষের প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল, সে যুগে সে চতুর্দিকে পরিবেষ্টিত ছিল অতিকায় হস্তী ( mammoth ), বন্যমহিষ ( bison ) ও অন্যান্ত হিংস্র জন্তু দ্বারা ; আর তার খাদ্য ছিল বন্ত ফলমূল ও পশুমাংস। মাংসই ছিল তার প্রধান খাদ্য। সেজন্য তাকে পশুশিকারে বেরতে হত। আত্মরক্ষা ও পশুশিকারের জন্য তাকে নানারকম আয়ুধ তৈরি করতে হত। এই আয়ুধগুলিই হচ্ছে প্রাচীন মানবের একমাত্র কৃষ্টির নিদর্শন। মানুষ ছিল বুদ্ধির ধারক ( homo sapiens )। সেজন্য বুদ্ধি খাটিয়ে ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে, সে প্রস্তরনির্মিত নানারূপ আয়ুধ তৈরি করে ফেলেছিল। তার মানে, মানুষ যে কেবল বুদ্ধির ধারক বা homo sapiens মাত্র ছিল, তা নয়। সে প্রাগৈতিহাসিক প্রেক্ষাপটকারিগর বা homo faber-ও ছিল। তার নির্মিত আয়ুধসমূহ আমরা পৃথিবীর নানা স্থান থেকে পেয়েছি। পশ্চিম ইউরোপে এইসকল আয়ুৰ চকমকি পাথর বা flint দিয়ে তৈরি করা হত। আর ভারতে এগুলি তৈরি করা হত নদীর ধারে পাওয়া মুড়ি ( pebbles ) ও কোয়ার্টজাইট পাথর দিয়ে।
ইউরোপে যারা এরূপ আয়ুধ তৈরি করত, তারাই হচ্ছে নিয়ানডারথাল মানুষ। এইজাতীয় মানুষের কঙ্কালাস্থির সঙ্গেই আমরা তাদের তৈরি আয়ুধসমূহ পেয়েছি। ভারতে কিন্তু সে-যুগের মানুষের কোন কঙ্কালাস্থি পাওয়া যায়নি। মাত্র তার নির্মিত আয়ুধসমূহই পেয়েছি। বস্তুত ভারতে প্রাচীন মানবের জীবাশ্ম পাওয়া না গেলেও, আমরা তার কৃষ্টির নিদর্শন বহুল পরিমাণে পেয়েছি এবং এখনও পাঁচ্ছি। সুতরাং আদিম মানব যে ভারতে বহুবিস্তৃতভাবে বাস করত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ওই যুগের নানা বর্গের আয়ুধ ও ব্যবহার্য বস্তুর নিদর্শন যেমন পশ্চিম ইউরোপে পাওয়া গিয়েছে, তেমনই বঙ্গদেশ, মাদ্রাজ, গোদাবরী, নর্মদা ও কৃষ্ণার অববাহিকায়, মধ্যভারতে, কর্ণাটকে, ছোটনাগপুরে, বিহারের কোন কোন স্থানে, আসাম, পঞ্জাব ও সীমান্তপ্রদেশে পাওয়া গিয়েছে। ওই যুগের আয়ুধসমূহকে প্রত্নোপলীয় যুগের আয়ুধ (palaeoliths) বলা হয়। ওর পরবর্তী নবোপলীয় যুগেরও আয়ুধ ভারতের নানা অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে। তবে মাত্র নবোপলীয় (neolithic) ও তৎপরবর্তী তাম্রাশ্ম ও লৌহ যুগের (chalcolithic and megalithic ages) মানবেরই জীবাশ্ম আমরা ভারতে পেয়েছি। i
ভারতের যে-সব জায়গা থেকে এরূপ কঙ্কালাস্থি পাওয়া গিয়েছে, তার বিবরণ নীচে দেওয়া হচ্ছে : –
১. ১৯২৮-২৯ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত ৪১টি কঙ্কাল।
২. ১৯৩৮-৩৯ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের হরপ্পায় প্রাপ্ত ২৬০টি কঙ্কাল।
৩. ১৯৩০-৩১ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের তক্ষশিলার ধর্মরাজিক মঠে প্রাপ্ত ৬টি কঙ্কাল।
৪. ১৯৩৫-৩৬ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তানের চামু-ধারোয় প্রাপ্ত ১টি কঙ্কাল।
৫. ১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীর নিকট কুমহারটেকরিতে প্রাপ্ত ৪২টি কঙ্কাল।
৬. ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দে তামিলনাডুর কোদাইকানালে প্রাপ্ত ৫টি সমাধিপাত্রপূর্ণ কঙ্কাল।
৭. ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে কর্ণাটকের ব্রহ্মগিরিতে প্রাপ্ত ১৪টি কঙ্কাল।
৮. ১৯৫১-৫২ খ্রীস্টাব্দে কর্ণাটকের পিকলিহালে প্রাপ্ত ৩টি সম্পূর্ণ কঙ্কাল ও একটি চিবুকাস্থি।
৯, ১৯৫৪ খ্রীস্টাব্দে কর্ণাটকের মাসকীতে প্রাপ্ত কঙ্কাল।
১০. ১৯৫৪-৫৬ খ্রীস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের নেভাসায় প্রাপ্ত ৩০টি কঙ্কাল।
১১. ১৯৫৬-৬০ খ্রীস্টাব্দে অন্ধ্রপ্রদেশের নাগাজুনাকুণ্ডের উপকণ্ঠে প্রাপ্ত ১৩টি নবোপলীয় যুগের কঙ্কাল ও ১৪টি মেগালিথিক যুগের সমাধি-কঙ্কাল।
১২. ১৯৫৪-৫৫ খ্রীস্টাব্দে পঞ্জাবের রূপারে প্রাপ্ত ২১টি কঙ্কাল।
১৩. ১৯৫৫ খ্রীস্টাব্দে তামিলনাডুর অরিথমঙ্গলে প্রাপ্ত ১০টি সমাধিপাত্র পূর্ণ কঙ্কাল।
১৪. ১৯৫৭-৫৯ খ্রীস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের কৌশাম্বীতে প্রাপ্ত ৮টি পুরুষ ও ৪টি নারীর কঙ্কাল।
১৫. ১৯৫৮-৬০ খ্রীস্টাব্দে গুজরাটের লোথালে প্রাপ্ত ২১টি কঙ্কাল।
১৬. ১৯৫৮-৫৯ খ্রীস্টাব্দে অন্ধ্রপ্রদেশের নাগাজুনাকুণ্ডের ঠিক বিপরীত দিকে কৃষ্ণা নদীর ওপর ইল্লেশ্বরমে প্রাপ্ত ৬টি কঙ্কাল।
১৭. ১৯৬১ খ্রীস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের পুনে শহরের নিকট চণ্ডোলি গ্রামে প্রাপ্ত ২৪টি কঙ্কাল।
১৮. ১৯৬২-৬৩ খ্রীস্টাব্দে রাজস্থানের কালিবঙ্গানে প্রাপ্ত কয়েকটি কঙ্কাল।
১৯. ১৯৬৩-৬৪ খ্রীস্টাব্দে কর্ণাটকের টেক্কলকোটায় প্রাপ্ত ৯টি কঙ্কাল।
২০. ১৯৬৩-৬৫ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত ১৪টি সমাধি-কঙ্কাল।
২১. ১৯৬০-৬৫ খ্রীস্টাব্দে কাশ্মীরের শ্রীনগরে নবোপলীয় যুগের সমাধিতে প্রাপ্ত কঙ্কাল।
২২. ১৯৭০ খ্রীস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়ে প্রাপ্ত কঙ্কাল।
২৩. ১৯৭৮ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের রামগড়ের অদূরে সিজুয়ায় প্রাপ্ত প্রাক্-হরপ্পীয় যুগের জীবাশ্মীভূত এক ভগ্ন চোয়াল।