আগেই আমরা বলেছি যে লিঙ্গের যেসব প্রতিরূপ পেয়েছি, তা দাক্ষিণাত্য থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছে। এটা খুবই বিচিত্র ব্যাপার যে একপ্রকার লিঙ্গ-উপাসনা, আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে নিবদ্ধ কিংবদন্তী অনুযায়ী দাক্ষিণাত্যের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। সূত্রসংহিতায় বলা হয়েছে যে দৈত্যরাজ বাণ মহাদেবের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি প্রতিদিন স্বহস্তে একটি শিবলিঙ্গ তৈরি করে, তার অর্চনা করতেন। শতবর্ষ এইরূপ পূজা করবার পর মহাদেব তার প্রতি বিশেষ প্রীত হয়ে তাকে এক বর দিয়ে বলেন—‘আমি তোমাকে চৌদ্দ কোটি বিশেষ গুণ-সম্পন্ন লিঙ্গ দিতেছি।. এইসকল লিঙ্গ নর্মদা ও অন্যান্য পুণ্যসলিলা নদীতে পাওয়া যাবে। ভক্তগণকে এইসকল লিঙ্গ মোক্ষদান করবে।’ হিমাদ্রি যাজ্ঞবল্ক্যকে উদ্ধৃত করে তাঁর ‘চতুর্বর্গচিন্তামণি’ গ্রন্থে বলেছেন : ‘এইসকল লিঙ্গ অনন্তকাল ধরে অবিরাম নর্মদা নদীর স্রোতে আবর্তিত হবে। প্রাচীনকালে নৃপতি বাণ ধ্যানস্থ হয়ে মহাদেবের আরাধনা করলে, মহাদেব প্রীত হয়ে লিঙ্গরূপ ধারণ করে পর্বতের উপরে অবস্থান করেন। সেই কারণে এই লিঙ্গকে বাণলিঙ্গ বলা হয়। এক কোটি লিঙ্গের অর্চনা করে উপাসক যে ফল পাবেন, একটি বাণলিঙ্গ অর্চনা করলেও সেই ফলই পাবেন। নর্মদা নদীর তীরে প্রাপ্ত বাণলিঙ্গের অৰ্চনা করলে মোক্ষলাভ উপাসকের করায়ত্ত হয়।’
বাণলিঙ্গের উপাসনার সঙ্গে বাণের নাম সংযুক্ত থাকাটা খুবই অর্থবহ। কেননা বাণ বঙ্গদেশের রাজা ছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ বলেন যে বর্তমান বাণগড়-ই বাণরাজার রাজধানী ছিল। বাণের পিতা ছিলেন অস্থররাজ বলি। মহাভারত অনুযায়ী অসুররাজ বলির মহিষী স্বদেষ্ণার গর্ভেই অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সুহ্ম, পুণ্ড প্রভূতি জাতিগুলির আদিপুরুষদের জন্ম হয়েছিল। বলি শিবেরই উপাসক ছিলেন। সুতরাং শিবপূজার সঙ্গে সঙ্গদেশের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। বস্তুত বর্তমানে লিঙ্গরূপী শিবের মন্দির বাঙলাদেশে যত দেখা যায়, ভারতের আর কোথাও তত দেখা যায় না। শিব যে প্রাগার্য দেবতা তা এখন পণ্ডিতমহলে সর্বজনস্বীকৃত। এটা মহেঞ্জোদারোয় আদি-শিবের প্রতিরূপ পাওয়া থেকেই বুঝতে পারা যায়। শিব মাতৃদেবীর ভর্তা। মাতৃদেবীর পূজার উদ্ভব বাঙলাদেশেই ঘটেছিল। বস্তুত যেরূপ জাকজমকের সঙ্গে বাঙলাদেশে মাতৃদেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়, ভারতের আর কোথাও তা হয় না। আবার বাঙলাদেশে মাতৃদেবীর পূজা যেরূপ জনপ্রিয়, শিবের গাজন উৎসবও (বিশেষ করে নিম্নকোটির লোকদের মধ্যে ) সেরূপ জনপ্রিয়। এবং প্রাগার্যকাল থেকেই এটা চলে আসছে। ঋগ্বেদে লিঙ্গউপাসকদের প্রতি ঘৃণা-প্রকাশ ও কটক্তি থেকেই বুঝতে পারা যায় যে লিঙ্গ-উপাসনা প্রাগার্য সভ্যতার অবদান।
আগেই বলেছি যে মাতৃদেবীর পূজা ও লিঙ্গ-উপাসনা ভূমিকৰ্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ভূমিকৰ্ষণের ওপর সৌরশক্তির প্রভাব মানুষ বরাবরই লক্ষ্য করেছে। এ-কারণেই কৃষির প্রাচীন কেন্দ্রসমূহে (যথা বঙ্গদেশ ) আমরা মাতৃকাদেবীর পূজার সঙ্গে সূর্যপূজার সংযোগ লক্ষ্য করি। যেহেতু সিন্ধু উপত্যকায় মাতৃপূজার প্রচলন ছিল, এটা খুবই স্বাভাবিক যে সেখানে সূর্যপূজারও অস্তিত্ব ছিল। মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত কয়েকটি সীলমোহরের ওপর আমরা চক্র ও স্বস্তিকচিহ্ন লক্ষ্য করি , এগুলি সূর্যেরই প্রতীকচিহ্ন, কেননা প্রাচীনকালে সূর্য নরাকারে পূজিত হতেন না, তার চিহ্ন দ্বারাই উপাসিত হতেন। চক্র ও স্বস্তিক ছাড়া সূর্যের অপর যা প্রতীকচিহ্ন ছিল, তা হচ্ছে মণ্ডলাকার চাকতি ও বলদ। সিন্ধু উপত্যক ছাড়া, সূর্যের এসব প্রতীকচিহ্ন আমরা পেয়েছি মধ্যপ্রদেশের বালাঘাট মহকুমার গুঙ্গেরিয়া নামক স্থান থেকে। এখানে তামার কুঠারের সঙ্গে আমরা রূপার চাকতি ও বলদের মাথারূপে পরিকল্পিত চাকতি পেয়েছি। এই শেষোক্ত জিনিসগুলি সূর্যপূজার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এখনও মধ্যপ্রদেশের মুরিয়া জাতি ধর্মীয় নৃত্যের সময় বৃষের মস্তকের চিহ্ন পরিধান করে।
সূর্যপূজা অবশ্য বৈদিক আর্যগণের মধ্যেও প্রচলিত ছিল। কিন্তু আর্যগণ কর্তৃক সূর্য নরাকারে কল্পিত হতেন। বৈদিক সূর্যপূজা যে প্রাগার্য ধর্মকে কোনরূপে প্রভাবান্বিত করেছিল, তার কোন প্রমাণ নেই। বরং পরবর্তীকালে আর্যদের সূর্যপূজা যে আগন্তুক মগ-ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক আনীত সূর্যপূজা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিল, তার প্রমাণ আছে। তবে প্রাগার্য সূর্যপূজা এখনও হিন্দুর লোকায়ত ধর্মের মধ্যে জীবিত আছে। বিহারের ছটপূজা ও বাঙলার ইতুপূজা ও রালদুর্গার ব্রত তার প্রমাণ।
গুঙ্গেরিয়ায় প্রাপ্ত তামার কুঠারের সঙ্গে রূপার চাকতি ও বলদের মাথারূপে পরিকল্পিত চাকতি বিশেষ অর্থবহ। পশ্চিম এশিয়ার দেবতাগণ প্রায়ই কৃষরূপে কল্পিত হতেন এবং সেখানকার প্রাচীন সীলমোহরসমূহে নরাকার দেবতাগণকে বৃষ-শৃঙ্গের কিৰীট ধারণ করতে দেখা যায়। সুমেরীয়রা তাদের সর্বোচ্চ দেবতাকে ‘স্বর্গের বৃষ’ বলে অভিহিত করত। সুমেরের প্রাচীন সীলমোহরের ওপর তাকে বৃষ-শৃঙ্গের কিরীটপর অবস্থায় ও তাকে বৃষ কর্তৃক অনুষঙ্গী হতে দেখা যায়। অম্বর জাতির সর্বোচ্চ দেবতা ‘অমুর’ও বৃষরূপে কল্পিত হত। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা এখানে শিবকে স্মরণ করি। মহেঞ্জোদারোয় আমরা আদি-শিবের যে মূর্তি পেয়েছি, সেখানে আদি-শিবকেও আমরা বৃষ শৃঙ্গের কিরীট পরিহিত অবস্থাতে দেখি।