লক্ষ্মীর কথা আগেই বলেছি। লক্ষ্মীর অপর নাম ‘শ্রী’। ‘শ্রী’ প্রাচীন ভারতের এক লোকায়ত দেবী ছিলেন। ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এ আমরা তার প্রথম উল্লেখ পাই। সেখানে তাকে প্রণয় ও উর্বরতার দেবী বলা হয়েছে। এবং খুব অর্থবহভাবে তার নৈবেদ্য শয্যার মাথার দিকে রাখার কথা বলা হয়েছে। বৈদিকযুগের একেবারে অন্তিমকালের পূর্ব পর্যন্ত কোথাও বিষ্ণুর সঙ্গে তারসম্পর্কের উল্লেখ নেই। ‘সিরি কাল-কন্নিজাতক’ অনুযায়ী ‘সিরিদেবী’ হচ্ছেন চারজন লোকপালের অন্যতম ধৃতরাষ্ট্রের কন্যা। সেখানে ‘সিরিদেবী’কে আমরা বলতে শুনি : ‘মানবজাতির ওপর আধিপত্য দেবার অধিষ্ঠাত্রী দেবী আমি ; আমি জ্ঞান, সম্পদ ও সৌন্দর্যের দেবী।’ মহাভারত অনুযায়ী ‘শ্রী’ দেবী প্রথমে দানবদের সঙ্গে বাস করতেন, পরে দেবগণের ও ইন্দ্রের সঙ্গে। মনে হয় এর মধ্যেই ইঙ্গিত অাছে তিনি গোড়ায় প্রাগার্যগণ কর্তৃক পূজিত হতেন, এবং পরে ব্রাহ্মণ্যদেবতামণ্ডলীতে স্থান পেয়েছিলেন।
সিন্ধু-সভ্যতার অনুরূপ সভ্যতা হচ্ছে সুমেরীয় সভ্যতা। সুমেরের কিংবদন্তী অনুযায়ী সুমেরের লোকেরা পূর্বদিকের কোন পার্বত্য অঞ্চল থেকে এসেছিল। সে জায়গাটা কোথায় ? সিন্ধু-সভ্যতা আবিষ্কারের পূর্বেই নিকট-প্রাচীর বিখ্যাত ইতিহাসকার হল (Hall) বলেছিলেন যে সুমেরের লোকেরা ভারত থেকে গিয়েছিল। বহু পূর্বে আমিও দেখিয়েছিলাম যে এসম্বন্ধে যোগিনীতন্ত্র’-এ উল্লিখিত সেীমার দেশের সঙ্গে ‘মুমের’-এর এক শব্দগত সাদৃশ্য আছে। যোগিনীতন্ত্র’-এ বলা হয়েছে : পূর্বে স্বর্ণনদী যাবৎ করতোয় চ পশ্চিমে দক্ষিণে মন্দশৈলশ্চ উত্তরে বিহগচল/অষ্টকোণম চ সৌমারম্যত্র দিকরবাসিনী।’ তার মানে দিক্করবাসিনীর আবাসস্থল ‘সৌমার’ নামে অষ্টকোণাকৃতি দেশ, যার সীমারেখা হচ্ছে পূর্বে স্বর্ণনদী ( শোনকুশী), পশ্চিমে করতোয় নদী, দক্ষিণে মন্দপর্বতসমূহ (মুণ্ডাজাতি-আধুষিত পর্বতমালা) ও উত্তরে বিহগচল (হিমালয় )। এ থেকে বুঝতে পারা যায় যে সৌমারী দেশ প্রাচ্যভারতে অবস্থিত ছিল। সুমেরের লোকেরা যে প্রাচ্যভারত থেকে গিয়েছিল এবং তাদের নূতন উপনিবেশের নাম আগন্তকদের দেশের নাম অনুযায়ী করেছিল ( এরূপ নামকরণ পদ্ধতি অতি প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত আছে ) ও মাতৃপূজার কল্পনার সাদৃশু থেকে তাই মনে হয়। (ইণ্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল কোয়ার্টারলি, ১৯৩৪, পৃষ্ঠা ১৪—২৪, পত্রিকায় প্রকাশিত লেখকের প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য )।
সিন্ধু উপত্যকার প্রাগার্য অধিবাসিগণ যে মাত্র মাতৃদেবীর পূজা করতেন, তা নয়। সুমের ও মধ্য-প্রাচীর প্রাচীন অধিবাসীদের ও বর্তমানকালের ভারতীয় হিন্দুদের মত তাঁর স্বজন-শক্তির আধার হিসাবে এক পুরুষ দেবতারও উপাসনা করতেন। মহেঞ্জোদারো থেকে যে তিন-মুখবিশিষ্ট এক দেবতার উৎকীর্ণ মূর্তি এক সীলের ওপর পাওয়া গিয়েছে, তার দ্বারা এটা প্রমাণিত হচ্ছে। এই দেবতা সিংহাসনের উপর আসীন। তার বক্ষ, কণ্ঠ ও মস্তক উন্নত। তার এক পা অপর পায়ের উপর আড়াআড়িভাবে স্থাপিত, তার দুটি হাত বিস্তৃতভাবে হাটুর উপর স্থাপিত। তিনি পর্যঙ্ক-আসনে উপবিষ্ট হয়ে, ধ্যানস্থ ও উধবলিঙ্গ। তাঁর উভয়পাশ্বে চার প্রধান দিক-নির্দেশক হিসাবে হাতি, বাঘ, গণ্ডার ও মহিষের প্রতিমূর্তি অঙ্কিত। তার সিংহাসনের নীচে দুটি মৃগকে পশ্চাদদিকে মুখ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখতে পাওয়া যায়। এখানেই যে আমাদের আদি-শিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বস্তুত পরবর্তীকালের শিবের তিনটি মূলগত ধারণা, আমরা এখানে দেখতে পাই—তিনি (১) যোগীশ্বর বা মহাযোগী, (২) পশুপতি, ও (৩) ত্রিমুখ। আমি আমার ‘প্রি-আরিয়ান এলিমেণ্টস্ ইন ইণ্ডিয়ান কালচার’ গ্রন্থে দেখিয়েছি যে, বৈদিক রুদ্রদেবতা যে এই আদিশিবের প্রতিরূপেই কল্পিত হয়েছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
হিন্দুধর্মে শিব ও শক্তি যে মাত্র নরাকারে পূজিত হন, তা নয় ; লিঙ্গ ও যোনি হিসাবেও পূজিত হন। সিন্ধু উপত্যকার প্রাচীন অধিবাসীরা যে লিঙ্গ-যোনি উপাসক ছিলেন তা সেখানে প্রাপ্ত মণ্ডলাকারে গঠিত প্রতীকসমূহ থেকে বুঝতে পারা যায়। এছাড়া, আমরা সেখানে প্রস্তরনির্মিত পুরুষলিঙ্গের এক বাস্তবানুগ প্রতিরূপ পেয়েছি। সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীরাই যে ঋগ্বেদে বর্ণিত সমৃদ্ধিশালী নগরসমূহের আর্য-বৈরী ‘শিশ্নোপাসক’ সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
১৯২৯ খ্রীস্টাব্দে ‘অ্যানালস অভ দি ভাণ্ডারকার ওরিয়েণ্টাল ইনস্ট্রিটু্যট’ পত্রিকায় লিখিত ‘বিগিনিংস অভ লিঙ্গ কালট ইন ইণ্ডিয়া’ প্রবন্ধে আমি দেখিয়েছিলাম যে লিঙ্গ-উপাসনা ভারতে তাম্রাশ্ম যুগের পূর্ব থেকেই প্রচলিত ছিল। বস্তুত ভারতের অধিবাসিগণের ঐন্দ্রজালিক ধ্যানধারণায় এর বিশেষ ভূমিকা ছিল। মাদ্রাজ মিউজিয়ামের ফুট কালেকশন’-এ নবোপলীয় যুগের লিঙ্গের একটি সুন্দর প্রতিরূপ আছে। এটা মাদ্রাজের সালেম জেলার শিবারয় পাহাড়ে পাওয়া গিয়েছিল। এটা খুবই বাস্তবানুগ ও নীস’ (gneiss) পাথরের তৈরি। সালেম জেলার শিবারয় পাহাড়ই একমাত্র স্থান নয়, যেখান থেকে নবোপলীয় যুগের লিঙ্গের প্রতিরূপ পাওয়া গিয়েছে। বরোদার নানা জায়গা থেকেও নবোপলীয় যুগের লিঙ্গের প্রতিরূপ পাওয়া গিয়েছে। এগুলি যে সবই স্বজন-শক্তি-উৎপাদক ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আগেই বলেছি যে প্রৎসিলুসকি (Przyluski ) দেখিয়েছেন যে ‘লিঙ্গ’ ও ‘লাঙ্গল’ শব্দদ্বয় অস্ট্রিক ভাষার অন্তর্ভুক্ত শব্দ, এবং ব্যুৎপত্তির দিক থেকে উভয় শব্দের অর্থ একই। তিনি বলেছেন যে পুরুষাঙ্গের সমার্থবোধক শব্দ হিসাবে ‘লিঙ্গ’ শব্দটি অস্ট্রো-এসিয়াটিক জগতের সর্বত্রই বিদ্যমান, কিন্তু প্রতীচ্যের ইন্দোইউরোপীয় ভাষাসমূহে এর অভাব পরিলক্ষিত হয়। তিনি আরও বলেছেন যে সংস্কৃত ভাষায় যখন শব্দ দুটি প্রবিষ্ট হল, তখন একই ধাতুরূপ ( ‘লনগ্’ ) থেকে লাঙ্গুল, লাঙ্গল ও লিঙ্গ শব্দ উদ্ভূত হয়েছিল। অনেক সূত্রগ্রস্থ ও মহাভারত-এ ‘লাঙ্গুল’ শব্দের মানে লিঙ্গ বা কোন প্রাণীর লেজ। যদি ‘লাঙ্গল = লাঙ্গুল’, এই সমীকরণ স্বীকৃত হয়, তা হলে এই তিনটি শব্দের (লাঙ্গল, লাঙ্গুল ও লিঙ্গ ) অর্থ-বিবর্তন (semantic evolution) বোঝা কঠিন হয় না। কেননা, স্বষ্টি প্রকল্পে লিঙ্গের ব্যবহার ও শস্য-উৎপাদনে লাঙ্গল দ্বারা ভূমিকৰ্ষণের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সাদৃশ্য আছে। অষ্ট্রিকভাষাভাষী অনেক জাতির লোক ভূমিকৰ্ষণের জন্য লাঙ্গলের পরিবর্তে লিঙ্গ-সদৃশ খনন-যষ্টি ব্যবহার করে। এ সম্পর্কে অধ্যাপক হিউবার্ট ও. ময়েস বলেছেন যে মেলেনেসিয়া ও পলিনেসিয়ার অনেক জাতি কর্তৃক ব্যবহৃত খননযষ্টি লিঙ্গাকারেই নির্মিত হয়। মনে হয়, ভারতের আদিম অধিবাসীরাও নবোপলীয় যুগে বা তার কিছু পূর্বে এইরূপ যষ্টিই ব্যবহার করত, এবং পরে যখন তারা লাঙ্গল উদ্ভাবন করল, তখন তারা একই শব্দের ধাতুরূপ থেকে তার নামকরণ করল।