এ-সব নিদর্শন থেকে বুঝতে পারা যায় যে, সুদূর অতীতে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া-বর্ধমান-মেদিনীপুর অঞ্চল জুড়ে এক সমৃদ্ধিশালী তাম্রাশ্ম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। খণ্ড খণ্ড আবিষ্কারের ফলে আমরা সেই লুপ্ত সভ্যতার মাত্র সামান্ত কিছু আভাস পাই। আজ যদি আমরা হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, লোথাল, কালিবঙ্গান প্রভৃতি স্থানের ন্যায় বাঙলায় প্রণালীবদ্ধভাবে রীতিমত খননকার্য চালাই, তা হলে আমরা নিশ্চয়ই জানতে পারব যে, তাম্রাশ্ম সভ্যতার উন্মেষ বাঙলাদেশেই ঘটেছিল এবং বাঙলাদেশই সভ্যতার জন্মভূমি ছিল।
বাঙলাই যে তাম্রাশ্ম সভ্যতার জন্মভূমি, তার সপক্ষে আরও অনেক প্রমাণ আছে। শুধু তাই নয়। আজও বাঙালী তাম্রাশ্ম যুগের অনেক কিছু দ্রব্য ব্যবহার করে। প্রথমে, রক্ষণশীল পরিবারের ঠাকুরঘরের কথা ধরা যাক। এ-সব পরিবারের পরিবেশ আগেও যা ছিল, এখনও তাই আছে। যুগ যুগ ধরে এ-সব পরিবারের ঠাকুরঘরের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। এ-সব পরিবারের ঠাকুরঘরে ঢুকলেই দেখতে পাওয়া যাবে যে ঠাকুরঘরের সব বাসন-কোসন পাথর ও তামা দিয়ে তৈরি ; যথা,— পাথরের থালা-বাটি-গেলাস, তামার কোষাকুষি ইত্যাদি। এগুলো বাঙ্গালী তাম্রাশ্ম যুগ থেকে একনাগাড়ে ব্যবহার করে আসছে। কেননা তামার কোষাকুযি আমরা মহিষদল থেকেও পেয়েছি। মহিষদলের যে স্তর থেকে আমরা ওই কোষাকুষি পেয়েছি, তা তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতার। আগেই বলেছি যে তাম্রাশ্ম সভ্যতার পরিযান (migration) পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে ঘটেছিল। সম্প্রতি পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্বের অধ্যাপক গ্রেগরী পয়সেলও বলেছেন যে ভারতের তাম্রাশ্ম সভ্যতার অভুত্থানের মূলে ছিল তামার ব্যবহার। বাঙালীরাই সেই তামা তাম্রাশ্ম সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে নিয়ে যেত। বাঙালীরা যে সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রসমূহে উপস্থিত ছিল, তার প্রমাণ আমরা পাঁচটি সূত্র থেকে পাই—(১) মাতৃদেবীর উপাসনা, (২) মৎস্যভক্ষণ, (৩) হস্তীর সহিত পরিচয়, (৪) ধান্যের ব্যবহার এবং (৫) শিব ও শিবলিঙ্গের আরাধনা ৷
মৎস্যভক্ষণ বাঙালীরই বৈশিষ্ট্য। মহেঞ্জোদারোতে যে বড়শি পাওয়া গিয়েছে তা থেকে স্বতই প্রমাণিত হয় যে সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে এমন এক শ্রেণী ছিল যারা মৎস্য ভক্ষণ করত। মহেঞ্জোদারোতে আমরা হস্তীর প্রতিকৃতি পেয়েছি। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে নিবদ্ধ কিংবদন্তী অনুযায়ী হস্তী প্রাচ্যভারতের পালকাপ্য মুনি কর্তৃক পালিত জন্তু। তিনিই প্রথম হস্তীকে বশ করেন ও হস্তীবিদ্যা সম্বন্ধে একখান গ্রন্থ রচনা করেন। বাঙলাদেশই হাতির আদিম নিবাস। মহেঞ্জোদারোতে হাতির উপস্থিতি বাঙলাদেশের সঙ্গে ওই সভ্যতার সম্পর্ক সূচিত করে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মহেঞ্জোদারোর সৗলসমূহে উৎকীর্ণ হাতির প্রতিকৃতির সঙ্গে প্রাচীন বাঙলার উৎকীর্ণ পাঞ্চ-মার্ক মুদ্রায় প্রদর্শিত হাতির বিশেষ মিল আছে।
বাঙলার সঙ্গে সিন্ধুসভ্যতার ঘনিষ্ঠতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে লোথালে ধান্যের ব্যবহার। চাউল বাঙালীর প্রিয় ও প্রধান খাদ্য। ধান্যের চাষ ষে বঙ্গোপসাগরের আশপাশের কোন স্থানে উদ্ভূত হয়েছিল, এ সম্বন্ধে পণ্ডিতমহলে কোন দ্বিমত নেই। কারলো চিপোলো তাঁর ‘দি ইকনমিক হিস্টরি অভ ওয়ার্লড পপুলেশন’ গ্রন্থে এই মতই প্রকাশ করেছেন এবং বাঙলাদেশকে নির্দেশ করেছেন।
মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা প্রভূতি নগরে মাতৃদেবীর পূজার যে ব্যাপক প্রচলন ছিল তা মৃন্ময়ী মাতৃকাদেবীর মূৰ্তিসমূহ থেকে প্রকাশ পায়। বাঙলাই মাতৃদেবীর পুজার লীলাকেন্দ্র। আগেই বলেছি যে, মাতৃদেবীর পূজার উদ্ভব নবোপলীয় যুগে কৃষির সূচনার সঙ্গে ঘটেছিল। বাঙলায় নবোপলীয় বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল ধান্যের চাষ নিয়ে। মনে হয়, ধান্যের চাষের সঙ্গে মাতৃদেবীর পূজা বাঙলাতেই গুরু হয়েছিল। ধান্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হচ্ছেন লক্ষ্মী। লক্ষ্মীপূজার অপর নাম খন্দপূজা। খন্দ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ফসলাদি। লক্ষ্মীপূজা যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই অনুসৃত হয়ে আসছে, তা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি থেকেই প্রকাশ পায়। সূচনায় মাতৃদেবীর পূজা যে ফসলাদির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিল তা সিন্ধুসভ্যতার কেন্দ্রে (হরপ্পায় ) প্রাপ্ত এক সালের ওপর খোদিত নারীমূর্তি থেকে প্রকাশ পায়। এই নারীমূর্তির যোনি-মুখ থেকে নির্গত হয়েছে পল্লবিত ছোট চারা-গাছ, লতা-পাত, গুল্ম ইত্যাদি। ষাট বৎসর পূর্বে আমি আমার ‘প্রি-আরিয়ান এলিমেণ্টস্ ইন ইণ্ডিয়ান কালচার’ গ্রন্থে বলেছিলাম যে মাতৃদেবী আদিতে যে শস্যাদির সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তা তার অন্নপূর্ণ, শাকম্ভরী ইত্যাদি অভিধা থেকেই প্রকাশ পায়। অবশ্য অন্নপূর্ণা নামটি সংস্কৃত। কিন্তু আদিতে এই শব্দটির কী রূপ ছিল, তা আমরা জানি না। তবে প্রাচীন সুমেরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ‘এ-নান্না’ নামের সঙ্গে এর যথেষ্ট নৈকট্য আছে। (তুলনা করুন হিংলাজের অধিষ্ঠাত্রী ‘নানা’ দেবী )।
মাত্র নামের সাদৃশ্য নয়। সুমের ও ভারতের মাতৃদেবীর কল্পনার মধ্যে এক অসাধারণ সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। এই উভয় দেশের মাতৃদেবীর মূলগত সাদৃশ্য হচ্ছে—(১) উভয়দেশেই মাতৃদেবী ‘কুমারী হিসাবে কল্পিত হয়েছিলেন, অথচ তাদের ভর্তা ছিল। বোধ হয়, মহাষ্টমীর দিন বাঙলাদেশে ‘কুমারী পূজা তারই স্মারক। (২) উভয়দেশেই মাতৃদেবীর বাহন ‘সিংহ ও তাঁর ভর্তার বাহন ‘বলীবর্দ’। (৩) উভয়দেশেই মাতৃদেবীর নারীসুলভ গুণ থকা সত্ত্বেও তিনি পুরুষোচিত কর্ম, যথা যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। (৪) প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার লিপিসমূহে তাকে বারম্বার সৈন্যবাহিনীর নেত্রী’ বলা হয়েছে। আমাদের দেশের “মার্কণ্ডেয় পুরাণ’-এর ‘দেবীমাহাত্ম্য বিভাগেও বলা হয়েছে যে দেবতারা যখন অসুরগণ কর্তৃক পরাহত হয়েছিলেন, তখন তারা মহিষাসুরকে বধ করবার জন্য দুর্গার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। (৫) মেসোপটেমিয়ার মাতৃদেবী পর্বতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট সেজন্য তাঁকে পর্বতের দেবী বলা হত। ভারতে মাতৃদেবীর পার্বতী, হৈমবতী, বিন্ধ্যবাসিনী প্রভৃতি নাম তাই সূচিত করে। (৬) সুমেরে মাতৃদেবীর নাম ছিল “এ-নান্না’ ; সে নাম হিংলাজে ‘নানা’দেবীর নামে এখনও বর্তমান। (৭) সুমেরীয়দের পরিধেয় বসন কৌনক’ তালপাতা দিয়ে তৈরী করা হত ; প্রাচীন ভারতে দেশজ লোকদের পাতা ও বল্কল’ পরিধান ও পণশবরীর ( দেবীর এক নাম ) নাম আমাদের তাই স্মরণ করিয়ে দেয়। (৮) দু’দেশেই ধর্মীয় গণিকাবৃত্তি ( বা সাময়িকভাবে সতীত্বের বিসর্জন দেওয়া ) প্রথা প্রচলিত ছিল। পশ্চিম এসিয়ায় এটার উদ্ভব হয়েছিল ঐন্দ্রজালিক ( mimetic or homoeopathic ) পদ্ধতি থেকে। সধবা ও অনূঢ়া উভয়শ্রেণীর মেয়েরাই দেবীর প্রসন্নতালাভের জন্য সাময়িকভাবে তাদের সতীত্বের বিসর্জন দিত। বলা বাহুল্য, ভারতে এটা বামাচারী তন্ত্রধর্মের বৈশিষ্ট্য। সব তন্ত্রেই বলা হয়েছে মৈথুন ছাড়া কুলপূজা ( তন্ত্র অনুযায়ী দেবীর পূজা ) হয় না। যেমন, ‘গুপ্তসংহিতা’য় বলা হয়েছে, ‘কুলশক্তিম বিনা দেবী যো যপেত স তু পামর’ ! আবার ‘নিরুত্তরতন্ত্র’-এ বলা হয়েছে ‘বিবাহিতা পতিত্যাগে দুষণম্ ন কুলার্চনে’। তার মানে কুলপূজার জন্য সধবা স্ত্রীলোক যদি তার পতি ত্যাগ করে, তবে তার কোন দোষ হয় না। (৯) উভয়দেশেই দেবীপূজার সঙ্গে নরবলি প্রচলিত ছিল। (কালিকাপুরাণ, ৭ অধ্যায়)।