৪. আর্যরা মৃতব্যক্তিকে দাহ করত। সিন্ধু সভ্যতার ধারকরা মৃতকে সমাধিস্থ করত।
৫. আর্যদের মধ্যে লিখন-প্রণালীর প্রচলন ছিল না। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার ধারকদের মধ্যে লিখন-প্রণালী সুপ্রচলিত ছিল।
৬. সিন্ধু সভ্যতা যে আর্য সভ্যতা নয়, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে মৃৎপাত্র। কুরু-পাঞ্চাল দেশ অর্থাৎ যেখানে আর্য সভ্যতা বিস্তারলাভ করেছিল, সেখানকার বৈশিষ্ট্যমূলক মৃৎপাত্রের রঙ ছিল ধূসর বর্ণ। সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রসমূহ থেকে যে-সব মৃৎপাত্র পাওয়া গিয়েছে সেগুলির রঙ ‘কালো-লাল’।
৭. সিন্ধু সভ্যতা ছিল কৃষিভিত্তিক সভ্যতা। আর্যর প্রথমে কৃষিকার্য জানত না। এটা আমরা শতপথব্রাহ্মণের এক উক্তি থেকে জানতে পারি। ( এ সম্বন্ধে বিশদ বিবরণের জন্য আমার ‘হিন্দু সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য’ দ্রষ্টব্য )
৮. সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা হাতির সঙ্গে বেশ সুপরিচিত ছিল। আর্যদের কাছে হাতি এক নূতন জীববিশেষ ছিল। সেজন্য তারা হাতিকে ‘হস্তবিশিষ্ট মৃগ’ বলে অভিহিত করত। বস্তুত হাতিকে প্রাচ্য ভারতের পালকাপ্য নামে এক মুনিই প্রথম পোষ মানিয়েছিলেন।
এসব প্রমাণ থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, আর্য সভ্যতা ও সিন্ধু সভ্যতা এক নয়।
গোড়ার দিকে আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার বাহকদের সঙ্গে তুমুল সংগ্রাম চালিয়েছিল। কিন্তু তাদের এই গোড়ার দিকের বৈরিত পরবর্তীকালে আর স্থায়ী হয়নি। পঞ্চনদ থেকে তারা যতই পূর্বদিকে অগ্রসর হল, ততই তারা এদেশের লোকের সংস্পর্শে এল। তারা এদেশের মেয়েদেরও বিয়ে করল। যখন অনার্য রমণী গৃহিণী হল, তখন আর্যদের ধর্মকর্মের ওপর তার প্রতিঘাত পড়ল। ক্রমশ তারা বৈদিক যজ্ঞাদি ও বৈদিক দেবতাগণকে পশ্চাদভূমিতে অপসারণ করল। আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির সংশ্লেষণে পৌরাণিক দেবতামণ্ডলীর সৃষ্টি হল।
আর্য ও অনার্য সভ্যতার সংশ্লেষ ঘটেছিল সেখানে, যেটাকে আগে আমরা ‘কুরু-পঞ্চাল’ দেশ বলতাম যা গঙ্গা ও যমুনার অন্তর্বর্তী অঞ্চল। সেখানে আর্যদের আপস করতে হয়েছিল অনার্যদের ভাষা, সভ্যতা ও লোকযাত্রার সঙ্গে। এটা বিবর্তনের ক্রমিক ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে সম্পূর্ণতালাভ করেছিল পৌরাণিক যুগে। এই সংশ্লেষণের পর আমরা ভারতীয় সভ্যতার সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ দেখি, যা বৈদিক সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। লোকে আর ইন্দ্র, বরুণ প্রভৃতি বৈদিক দেবতার স্তুতিগান করে না ; বৈদিক যজ্ঞ সম্পাদন করে না। নূতন দেবতামণ্ডলীর পত্তন ঘটে। যজ্ঞের পরিবর্তে আসে পূজা ও উপাসনা। বৈদিক আত্মকেন্দ্রিক স্তুতিগানের পরিবর্তে আসে ভক্তি। এর ওপর প্রাগার্য তান্ত্রিক ধর্মেরও প্রভাব পড়ে। বৈদিক যুগের আর্যরা যাদের ঘৃণার চক্ষে দেখতেন ও যাদের সঙ্গে অবিরাম সংগ্রাম করতেন, শেষ পর্যন্ত সেই অনার্য নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসমূহেরই জয় হল। বেদ সংকলন ও মহাভারত-পুরাণ ইত্যাদি রচনার ভার ন্যস্ত হল এক অনার্য রমণীর জারজ সন্তানের ওপর !
তাম্রাশ্ম যুগের সভ্যতার অভ্যুদয়ে তাম-ই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। মিশর, সুমের, সিন্ধু উপত্যকা সর্বত্রই আমরা সভ্যতার প্রথম প্রভাতে তামার ব্যবহার দেখি। সুতরাং আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, তাম্রাশ্ম সভ্যতার উন্মেষ এমন কোন জায়গায় হয়েছিল, যেখানে তাম প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এখানে-সেখানে অবশ্য তামা সামান্য কিছু কিছু পাওয়া যেত, কিন্তু তা নগণ্য। বাঙলাই ছিল সে-যুগের তামার প্রধান আড়ত। তামার বৃহত্তম খনি ছিল বাঙলাদেশে। বাঙলার বণিকরাই ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’ পার হয়ে, ওই তামা নিয়ে যেত সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রসমূহে বিপণনের জন্য। এজন্তই বাঙলার সবচেয়ে বড় বন্দরের নাম ছিল ‘তাম্রলিপ্তি’। এই তাম সংগৃহীত হত ধলভূমে অবস্থিত তৎকালীন ভারতের বৃহত্তম তাম্রখনি থেকে।
বাঙলায় যে এক বিশাল তাম্রাশ্ম সভ্যতার অভ্যুদয় ঘটেছিল, তা আমরা খণ্ড খণ্ড আবিষ্কারের ফলে জানতে পারি। ১৯৭৬ খ্রীস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা থানার অন্তর্গত আগাইবানিতে ৪০ ফুট গভীর মাটির তলা থেকে আমরা পেয়েছি তামার একখানা সম্পূর্ণ পরশু ও অপর একখানা প্রমাণ-আকারের পরশুর ভাঙা মাথা, ছোট আকারের আর একখানা পরশু, এগারোখানা তামার বালা এবং খনকতক ক্ষুদ্রকায় তামার চাঙারি। পুরাতাত্ত্বিক দেবকুমার চক্রবর্তীর মতে, এগুলি হরপ্পার পূর্ববর্তী বা সমসাময়িক কোন মানবগোষ্ঠীর। ১৮৮৩ খ্রীস্টাব্দে মেদিনীপুরের বিনপুর থানার অন্তর্গত তামাজুড়ি গ্রামে তাম্রপ্রস্তর যুগের অনুরূপ নিদর্শনসমূহ পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৬৫ খ্রীস্টাব্দে ওই জেলারই এগরা থান৷র চাতলা গ্রামে ওই ধরনের আরও কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। ১৯৬৮ খ্রীস্টাব্দে পাশ্ববর্তী জেলা পুরুলিয়ার কুলগড়া থানার হাড়া গ্রামেও কিছু কিছু ওই ধরনের নিদর্শন পাওয়া যায়। অনুরূপ পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আজ থেকে ত্রিশ বছর পূর্বে মধ্যপ্রদেশের রেওয়া জেলার পাণ্ডিগায়েও পাওয়া গিয়েছিল। তার অন্তর্ভুক্ত ছিল আগাইবানির ধরনের ৪৭টি তামার বালা ও পরশু। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, তাম্রাশ্ম সভ্যতার পরিযান ( migration ) পূর্বদিক থেকে পশ্চিমদিকে ঘটেছিল।
বাঙলায় তাম্রাশ্ম সভ্যতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে বর্ধমান জেলার অজয় নদীর তীরে অবস্থিত পাণ্ডুরাজার ঢিবি থেকে। অজয়, কুন্নুর ও কোপাই নদীর উপত্যকার অন্যত্রও আমরা এই সভ্যতার পরিচয় পাই। পাণ্ডুরাজার ঢিবির দ্বিতীয় যুগের লোকরাই তাম্রাশ্ম সভ্যতার ধারক ছিল। তারা সুপরিকল্পিত নগর ও রাস্তাঘাট তৈরি করত। তারা গৃহ ও দুর্গ—এই উভয়ই নির্মাণ করতে জানত। কৃষি ও বৈদেশিক বাণিজ্য তাদের অর্থনীতির প্রধান সহায়ক ছিল। তারা ধান্য ও অন্যান্য শস্য উৎপাদন করত এবং পশুপালন ও কুলালের কাজও জানত। পূর্ব-পশ্চিম দিকে শয়ন করিয়ে তারা মৃতব্যক্তিকে সমাধিস্থ করত এবং মাতৃকাদেবীর পূজা করত।