অনেক জায়গায় আবার বিবাহ ব্যাপারে একটা গ্রাম-ক্রমও দেখতে পাওয়া যায়। যথা “ক” গ্রামের মেয়ের বিয়ে হয় “খ” গ্রামের ছেলের সঙ্গে আবার “খ” গ্রামের মেয়ের বিয়ে হয় “গ” গ্রামের ছেলের সঙ্গে—এরূপভাবে যেখানে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীগুলি গ্রামভিত্তিক সেখানে এরূপ গোষ্ঠীগুলিকে আদিবাসীদের ভাষায় “খেরা”, ‘গোচী’, “খেল” ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। যেখানে আদিবাসী জীবনের উপর হিন্দু প্রভাব বিস্তারিত হয়েছে সেখানে এগুলিকে গোত’ বা ‘গোত্র’ বলা হয়। বলা বাহুল্য, এই গোত’ বা “গোত্র”গুলি টটেমভিত্তিক। যেমন—মধ্যভারতের গোণ্ডসমাজে বিশেষভাবে প্রচলিত গোত্রগুলি হচ্ছে ‘মারকাম’, ‘টেকম’, ‘নৈতাম’ ইত্যাদি। মারকাম শব্দের অর্থ হচ্ছে আম, টেকম-এর অর্থ হচ্ছে সেগুন ও নৈতাম-এর অর্থ হচ্ছে কুকুর। গোত্রের সাধারণ নিয়ম অকুযায়ী এই সকল সমাজে সগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ। সগোত্রে বিবাহ করলে দণ্ড পেতে হয়। হিন্দুদের মত এই সকল সমাজে বিবাহের পর পুরুষদের গোত্র অপরিবর্তিত থাকে, কেবল বিবাহের পর মেয়েদের গোত্রেরই পরিবর্তন ঘটে। হিন্দুসমাজের সপিণ্ডবিধানের অনুসরণে আদিবাসীদের মধ্যেও অনেকস্থানে আবার পিতৃকুলে বা মাতৃকুলে নির্দিষ্ট পুরুষ পর্যন্ত বিবাহ নিষিদ্ধ আছে। যেমন—উত্তর প্রদেশের ভানটুদের মধ্যে বিবাহের জন্য মাতামহীর কুলে ছুই পুরুষ বর্জন করার বিধি আছে। মধ্যপ্রদেশের ভালজাতির মধ্যেও মাতৃকুলে দুইপুরুষ বর্জন করার রীতি আছে। এছাড়া তারা পিতামহীর ও মাতামহীর কুলেও তিন পুরুষ বর্জন করে।
ভৗলের ৪১টি বহির্বিবাহের দলে বিভক্ত এবং সেগুলি সবই টটেমভিত্তিক। মধ্যপ্রদেশের বালাঘাট ও মাণ্ডালা অঞ্চলের বাইগার অনেকগুলি অন্তর্বিবাহের শাখায় বিভক্ত। প্রতি শাখা আবার অনেকগুলি বহির্বিবাহের দলে বিভক্ত। এখানে প্রত্যেক লোককেই নিজ শাখার মধ্যে বিবাহ করতে হয় ; কিন্তু নিজ দলে বিবাহ করতে পারে না, অপর দলে বিবাহ করতে হয়। কেবল তাই নয়, তাদের এমন দলে বিবাহ করতে হয় যে-দল তাদের মত একই দেবদেবীর পূজা করে। অনেক স্থলে আবার কৌলীন্যপ্রথাও প্রচলিত আছে। যেমন মধ্যপ্রদেশের গোগুজাতির মধ্যে দুটি বিভাগ আছে—রাজগোও ও ধরগোও । ধরগোণ্ডের পিতার রাজগোণ্ডে কন্যা দান করে। কিন্তু রাজগোণ্ডের পিতারা কখনও ধরগোণ্ডে মেয়ে দান করে না।
বস্তার জেলার মারিয়াদের মধ্যে দলের যে সমস্ত লোক পরস্পরের সহিত দাদাভাই” সূত্রে আবদ্ধ তাদের মধ্যে বিবাহ হয় না। কিন্তু অপর যে দল তাদের সহিত “মামাভাই” সূত্রে আবদ্ধ মাত্র তাদের সঙ্গেই বিবাহ হয়।
মধ্যপ্রদেশের কোলজাতির অনেকগুলি শাখায় বিভক্ত। এই সকল শাখাগুলিকে “কুরি” বলা হয়। এদের মধ্যেও কৌলীন্যপ্রথা প্রচলিত আছে। কুরিগুলির মধ্যে সবচেয়ে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কুরি হচ্ছে রাউতিয়া। রাউতিয়ারা কখনও পরবর্তী (কুরি ) ঠাকুরিয়া কুরিতে কন্যা দান করে না কিন্তু ঠাকুরিয়া কুরি থেকে মেয়ে নিতে তাদের কোন আপত্তি নেই। রাউতিয়ার রাউনতেল কুরি থেকেও মেয়ে নেয়। কিন্তু তাদের কখনও মেয়ে দেয় না। কাঠাওটিয়া নামে আর একটি কুরি ঠাকুরিয়াদের কুরি থেকে মেয়ে নেয়। কিন্তু কখনও মেয়ে দেয় না। তবে এক্ষেত্রে কাঠাওটিয়ারা মেয়েটিকে সাধারণত “রক্ষিতা” হিসাবে রাখে, “পরিণীতা” হিসাবে নয়। তবে একথা এখানে বলা প্রয়োজন যে, কোলেদের মধ্যে কুরিগুলি হচ্ছে অন্তর্বিবাহের গোষ্ঠী, বহির্বিবাহের গোষ্ঠী নয়। মাত্র কৌলীন্যপ্রথার জন্য এগুলি কোন কোন স্থলে বহির্বিবাহের গোষ্ঠীর রূপ পেয়েছে। যেহেতু কুরিগুলির মধ্যে কোন গোত্রবিভাগ নেই সেহেতু অনুমান করা যেতে পারে যে কোলেদের মধ্যে বিবাহ সগোত্রেই হয়। তবে যেখানে কৌলীন্তপ্রথা অবলম্বিত হয়, মাত্র সেখানেই সক্ষেত্র বিবাহ বজিত হয়। তবে কোলেদের মধ্যে এমন অনেক স্মারক চিহ্ন আছে যা থেকে পরিষ্কার প্রকাশ পায় যে, কোলেদের মধ্যে বিবাহ এক সময় গ্রামভিত্তিক ছিল।
সাঁওতালদের মধ্যে এক সময় ১২টি বহির্বিবাহের গোষ্ঠী ছিল। এর মধ্যে একটি এখন লুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে মাত্র ১১টি গোষ্ঠী আছে। এগুলি সবই বহির্বিবাহের গোষ্ঠী। তবে এদের মধ্যে কিসকু বা মুরমূগোষ্ঠীর মর্যাদা অন্য গোষ্ঠীর তুলনায় অনেক উচ্চ। এছাড়া মানভূমে কোন কোন জায়গায় ধর্মের ভিত্তিতে সাঁওতালরা দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত। এ দুটির নাম—দেশওয়ালী ও থেীরা। দেশওয়ালীর নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দেয়। আর থেীরার জড়োপাসনার উপর বিশ্বাস রাখে। দেশওয়ালীদের সঙ্গে থেীরাদের কখনও বিবাহ হয় না ।
রাঁচী জেলার ওরাঁওদের মধ্যে বহির্বিবাহের জন্ত যে গোত্রবিভাগ আছে সেগুলিকে “পরী” বলা হয়। পরীগুলি টটেম-ভিত্তিক । এক পরীর ছেলেকে অপর কোন পরীতে বিবাহ করতে হয়। গডাব৷ উপজাতির মধ্যেও গোত্রবিভাগকে পরী বলা হয়। একই পরীর মধ্যে তারা কখনও বিবাহ করে না । এমন কি পরীর ভেতর ব্যভিচারও গুরুতরভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হয়।
মানভূমের সাঁওতালদের মত খরিয়ারাও দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত—শবর খরিয়া ও পাহাড়ীয়া খরিয়া। একের সঙ্গে অপরের কখনও বিবাহ হয় না। তবে এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোন মূর্যাদামূলক বিভেদ নেই। খরিয়াদের বিশ্বাস তারা রামায়ণ-বর্ণিত বানররাজ অঙ্গদের বংশধর ।