পাশ্চাত্য দেশে বিবাহের অব্যবহিত পরেই যৌনসঙ্গম দ্বারা সিদ্ধ-বিবাহকে পূর্ণাঙ্গতা দেওয়া হয়। ভারতে বাল্যবিবাহ প্রচলিত থাকার দরুন এটা স্থগিত রাখা হতে। এই কারণে কন্যা বিবাহের পর পিতৃগৃহেই থাকতো এবং আর একটা অনুষ্ঠান নিম্পন্ন করে তবে তাকে স্বামীগৃহে পাঠানো হতো। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে এই অনুষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন নাম ছিল। যেমন, গৌণ, গর্ভাধান, দ্বিরাগমন, ডোলি, রূকষতি ইত্যাদি। সাধারণতঃ প্রথম ঋতুসঞ্চারের সময়ই এই অনুষ্ঠান নিম্পন্ন হতো। অনেক জায়গায় একে দ্বিতীয় বিবাহ বা “ফলবিয়া” ( ফল বিবাহ ) বলা হতো। সাধারণতঃ প্রথম রজদর্শনের ষোল দিনের মধ্যে প্রথম চারদিন বাদ দিয়ে যে কোন যুগ্মদিনে এই অনুষ্ঠানটি নিম্পন্ন হতো। আগেকার দিনে এই উপলক্ষে বৃদ্ধিশ্রদ্ধাদিরও ব্যবস্থা ছিল। তবে তার প্রচলন এখন আর নেই। বস্তুত বর্তমান সময়ে সমগ্র অনুষ্ঠানটিই বঙ্গদেশ থেকে তিরোহিত হয়েছে। কিন্তু ৫০/৬০ বছর আগে পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে উৎসবের আড়ম্বর দেখা যেতো। স্বামী-স্ত্রী মিলিত হয়ে “নব পুষ্পোৎসবে” সূর্যকে অৰ্ঘদান করতেন। স্বামী পুত্রলাভের উদ্দেশ্যে গর্ভের মঙ্গল কামনা করে বৈদিক মন্ত্রপাঠও করতেন। বধূকে রজদর্শনের দিন থেকে নানারকম নিয়মনিষ্ঠ ও সংযত হয়ে গৃহের নিভৃতস্থানে থাকতে হতো ও নির্দিষ্ট দিনে একটি পুটলিতে নানারকম ফল বেঁধে তাকে দেওয়া হতো একটি প্রস্তর খণ্ডকে সন্তান কল্পনা করে। প্রসবের অভিনয়ও করা হতো। মেয়েরাই সাধারণতঃ এই উৎসবে যোগদান করতেন । এই উপলক্ষে নাচগানও অনুষ্ঠিত হতো এবং তার মধ্যে অনেক সময় শালীনতার অভাবও দেখতে পাওয়া যেতো। বঙ্গদেশ থেকে যদিও এই প্রথার তিরোভাব ঘটেছে তা হলেও বিহারের নিম্নশ্রেণীর মধ্যে “গৌণা” এখনও প্রচলিত আছে। বিহারে এটা ব্যয়-সাপেক্ষ অনুষ্ঠান। তবে মনে হয় বাল্যবিবাহের প্রচলন উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গৌণ প্রথারও অবসান ঘটবে।
গত ৫০ বছরের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রচলন ভারতে অনেক পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। ১৯২১ সালের আদমসুমারী অনুসারে ভারতে ১০ বছরের কম বয়স্ক ৮৫৮,০৮৯ জন বিবাহিত বালক ও ২,২৩৫,১৫০ জন বিবাহিত বালিকা ছিল । আর ১০ থেকে ১৫ বৎসর বয়স্ক ২,৩৪৪,০৬৬ জন বিবাহিত বালক ও ৬,৩৩০,২০৭ জন বিবাহিতা বালিকা ছিল কিন্তু ১৯৫১ সালে ১০ বৎসরের কম বয়স্ক একজনও বিবাহিত বা বালিকা ছিল না এবং ১০ থেকে ১৫ বৎসর বয়স্ক বিবান্ত্রিত বালকের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে দাড়িয়েছিল ১,৭৩৪,০০০ জন ও বালিকার সংখ্যা ৪,৪২৬,০০০ জন। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, গত ৫০ বছরের মধ্যে বাল্যবিবাহ অনেক পরিমাণে কমে গিয়েছে। একথা এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, বাল্যবিবাহ কোনদিন মালাবার উপকুলে প্রচলিত ছিল না। উত্তর প্রদেশ, বিহার, ওড়িষ্যা ও বঙ্গদেশে এর যেরূপ প্রচলন ছিল, সেরূপভাবে দাক্ষিণাত্যের অন্যত্র প্রচলন ছিল না। বাল্যবিবাহের কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে রিসলী বলেছিলেন যে কৌলীন্যপ্রথা থেকে এটা উদ্ভূত হয়েছিল। র্তার মতে কৌলীন্যপ্রথা যে সমাজে প্রচলিত ছিল সে সমাজে যোগ্য পাত্রের তুষ্প্রাপ্যতার জন্য কন্যার পিতামাতা যত অল্পবয়সে পারতো কন্যার বিবাহ দিত। তবে আসামের কোন কোন উপজাতির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় যে এর কারণ হচ্ছে কন্যার তুষ্প্রাপ্যতা। যে সমাজে নারী অপেক্ষা পুরুষের সংখ্যা বেশী সে সমাজে সকলেই চেষ্টা করে বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি পারে শেষ করে ফেলতে, পাছে কন্যার অভাবে বিয়েটা ফসকে যায়। তবে হিন্দুসমাজে সাধারণভাবে বাল্যবিবাহের ব্যাপকতার কারণ মনে হয় এ সম্বন্ধে স্মৃতির অনুশাসন ।
বাল্যবিবাহ এখন আইনদ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ১৯২৯ সালে প্রণীত বাল্যবিবাহ নিয়ন্ত্রণ আইন দ্বারা, বিবাহের নূ্যনতম বয়স মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৫ ও ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৮ বৎসর নির্দিষ্ট হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আদমসুমারীর পরিসংখ্যান থেকে প্রকাশ পায় যে বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয় নি। এ ছাড়া আর একদিকেও আইনদ্বারা বিবাহের সংস্কার করা হয়েছে। সেটা হচ্ছে উচ্চশ্রেণীর মধ্যে বিধবাবিবাহ বৈধকরণ ।
নিম্নশ্রেণীর মধ্যে বিধবাবিবাহ অবশ্য বরাবরই প্রচলিত আছে। উত্তর ভারত ও বিহারে এরূপ বিবাহকে সাগাই, খরাও, করেওয়া, সাঙ্গা ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। } ছাড়া, আগেই বলা হয়েছে যে উত্তর ভারতের অনেক জায়গায়ংiবরণ প্রথাও প্রচলিত আছে। এসব ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠভ্রাতার মৃত্যুর পর কনিষ্ঠভ্রাতা বিধবা ভ্রাতৃজায়াকে বিবাহ করে। অবশ্য উচ্চবর্ণের মধ্যে কোথাও দেবরণ প্রচলন নেই। এর প্রচলন আছে নিম্নশ্রেণীর মধ্যে। স্মৃতিশাস্ত্রে এর নিষেধ থাকা হেতু উচ্চবর্ণের হিন্দুর এর অনুমোদন করেন না। উত্তর ভারত ছাড়া ওড়িষ্যা, গুজরাট ও কাথিয়াবারে অনেক নিমজাতির মধ্যে দেবরণ প্রথা প্রচলিত আছে। সেই কারণে, গুজরাটের উচ্চজাতি সমূহের মধ্যে “দেবর” শব্দ অতি অশ্লীল গালি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। মহারাষ্ট্রেও কুন্ৰীগোষ্ঠীর কোন কোন জাতির মধ্যে দেবরণ-এর প্রচলন দেখা যায় ।
উত্তর ভারতে গাড়বালদেব মধ্যে দু’রকমের দেবরণ প্রথার প্রচলন দেখতে পাওয়া যায়। এক ক্ষেত্রে বিধবা তার মৃত স্বামীর গৃহেই বসবাস চালিয়ে যেতে থাকে এবং তাব সম্মতি নিয়ে দেবর যৌনমিলনেব জন্য তার গৃহে আগমন করে। অপর ক্ষেত্রে, বিধবা তার দেবরের গৃহে গিয়ে তাব অন্ততব স্ত্রীরূপে চিবস্থায়ীভাবে বাস করে। একাপ মিলনের ফলে যে সন্তান হয় তা বৈধ বলেই বিবেচিত হয় । এই প্রথা নিম্নগোষ্ঠীর ব্রাহ্মণ, বাজপুত ও খসদের মধ্যেও প্রচলিত আছে। খসদের মধ্যে বিধবাকে বিবাহ কবে বিধবার গৃহেই দেবরের বাস করার রীতি প্রচলিত আছে। খস্দের মধ্যে এরূপ ব্যক্তিকে “কঠেলা” বা “টাকওয়া” বলা হয়। এরূপ মিলনের ফলে যে সস্তান উৎপন্ন হয়, তাকে “ঝটেলা” বলা হয়। যে ক্ষেত্রে বিধবা তার দ্বিতীয় স্বামীর গৃহে বাস করে সে ক্ষেত্রে প্রথম স্বামীর ঔরসজাত সন্তান যদি বিপিতার গৃহে গিয়ে মাতার সঙ্গে একত্র বাস করে তাহলে সে তার প্রকৃত পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয় কিন্তু তার বৈমাত্রেয় ভ্রাতাদের সঙ্গে সমানভাবে বিপিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়।