পালেদের (Pala dynasty) পর সেন বংশের আমলে ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমানে প্রচলিত জাতিভেদ প্ৰথা সেনযুগেই প্ৰথম দৃঢ় রূপ ধারণ করে। পালযুগের ন্যায় সেনযুগেও স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের বিশেষ উন্নতি ঘটে। এ যুগের বিষ্ণুমূৰ্তিসমূহ এক অপূর্ব নান্দনিক সুষমায় বিভূষিত। সেন বংশের লক্ষণসেনের আমলেই বাঙলা মুসলমানগণ কর্তৃক বিজিত হয়। তারই সঙ্গে আরম্ভ হয় বাঙলায় বিপৰ্যয়ের যুগ। মূর্তি ও মঠ-মন্দির ভাঙা হয়। হিন্দুদের ব্যাপকভাবে ধর্মান্তরিত করা হয়। আর শুরু হয় ব্যাপকভাবে নারীধর্ষণ। এটাই ছিল ধর্মান্তরকরণের প্রশস্ত রাস্তা, কেননা ধর্ষিতা নারীকে আর হিন্দুসমাজে স্থান দেওয়া হত না। হিন্দুসমাজ এ সময় প্রায় অবলুপ্তির পথেই চলেছিল। এই অবলুপ্তির হাত থেকে হিন্দুসমাজকে রক্ষা করেন স্মার্ত রঘুনন্দন ও শ্ৰীচৈতন্য। (পৃষ্ঠা ২৪৫)।
তবে ইতিহাসের পাতায় বাঙলার মধ্যযুগ স্মরণীয় হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের স্বতঃস্ফূরণের জন্য। আৰ্যেতয় সমাজের দেবতাগণের এই সময় আত্মপ্রকাশ ঘটে। এবং তাদের অবলম্বন করে এক বিরাট ‘মঙ্গলসাহিত্য’ সৃষ্ট হয়। এছাড়া, অনুবাদ সাহিত্য, পদাবলী সাহিত্য ও চৈতন্য জীবনচরিতসমূহ এ যুগের সাহিত্যকে সমৃদ্ধকরে। তবে এ যুগে নতুন করে একটা সমাজবিন্যাস ঘটে, সে সমাজে উদ্ভুত কৌলীন্যপ্ৰথা সমাজে এক যৌনবিশৃঙ্খলতা আনে। রামনারায়ণ তর্করত্ন ও ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর বলেছেন যে কৌলীন্যপ্রথার ফলে বাঙলার কুলীন ব্ৰাহ্মণসমাজে এভাবে দূষিত রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। উনবিংশ শতাব্দীতে, রামনারায়ণ তর্করত্ব ও বিন্যাসাগর মহাশয়ের প্রচেষ্টার ফলেই বাঙলার কুলীন ব্ৰাহ্মণসমাজ এই কালিমার কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়।
বাঙালী সমাজকে আরও বিশৃঙ্খল করে তুলেছিল যখন এদেশে বিদেশী আসতে শুরু করে। ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজরাই প্রথম এদেশে আসে। তাদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই নতুন পৰ্যায়ে শুরু হয় নারীধর্ষণ ও অবৈধ যৌনমিলন। বাঙালী মেয়েদের রক্ষিতা হিসাবে রাখবার ফারমান (firman) পর্তুগীজরা পায় মুঘল দরবার থেকে। কিন্তু পর্তুগীজদের পরে ইংরেজরা যখন এদেশে আসে তখন তারা বিনা ফারমানেই বাঙালী মেয়েদের রক্ষিতা হিসাবে রাখতে শুরু করে। এসব মেয়েদের তারা ‘বিবিজান’ বলত। পুরানো কবরখানাসমূহের স্মৃতিফলকে এরূপ অনেক বিবিজানের উল্লেখ আছে। এক কথায় সমাজ ক্রমশ অবক্ষয়ের পথেই চলেছিল।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে উনবিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত হয় নবজাগৃতি (Renaissance)। নবজাগৃতির ফলে সমাজ খানিকটা সুসংহত হয়েছিল বটে, কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর যুগের সমাজে আবার প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈতিক শৈথিল্য। বাঙালীর যে প্ৰতিভা একদিন মহামতি গোপালকৃষ্ণ গোখেলকে উদ্বুদ্ধ করেছিল উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করতে যে ‘What Bengal thinks today, India thinks tomorrow’, তা আজ কালান্তরের গর্ভে চলে গিয়েছে। বাঙালী আজ তার নিজ সংস্কৃতির স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছে। অশনে-বসনে আজ সে হয়েছে বহুরূপী। আজ সে এক বর্ণচোরা জারজ সংস্কৃতির ধারক হয়েছে। বাঙালীর বিবর্তনের এটাই শেষ কথা। আজকের প্রশ্ন-বাঙালী কোন্ পথে? এই প্রশ্ন রেখেই এই ‘গৌড়চন্দ্ৰিকা’ শেষ করছি।
****
বইখানিই প্রথম প্রকাশের পথ, বাঙলার ইতিহাস সম্বন্ধে যে সকল প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে ও নতুন ঐতিহাসিক তথ্য জানা গিয়েছে, তা মীল পাঠের মধ্যেই সংযুক্ত করা হয়েছে। আর বই ছাপা হয়ে যাবার পরে যা জানা গিয়েছে সে সম্বন্ধে ৩৮৪ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ‘সংযোজন’-এ। উল্লেখিত হয়েছে।
পরিশেষে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই ‘সাহিত্যলোক’ প্ৰকাশন-সংস্থায় স্বত্বাধিকারী শ্ৰীনেপালচন্দ্ৰ ঘোষকে, উদ্যম ও উৎসাহের সঙ্গে বইখানা প্ৰকাশ করার জন্য। শ্ৰীঅশোক উপাধ্যায় প্রুফ সংশোধনে সহায়তা করেছেন এবং শ্ৰীঅরুণচাঁদ দত্ত বর্তমান সংস্করণের নির্ঘণ্ট তৈরি করেছেন। সেজন্য তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।