আৰ্যরা যখন পঞ্চনদের উপত্যকায় এসে বসতি স্থাপন করেছিল, তখন উত্তরভারত এক জনহীন শূন্যদেশ ছিল না। সেখানেও লোকের বসতি ছিল। তারা কারা? আগেই উল্লেখ করেছি যে বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ হ্যাডনের উপলব্ধি অনুযায়ী ‘অষ্ট্ৰিক’ ভাষাভাষী জাতিসমূহই পঞ্জাব থেকে ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বস্তুত আৰ্যরা যখন পঞ্চনদের উপত্যকাকে পাদমঞ্চ করে পূর্বদিকে তাদের জয়যাত্রা শুরু করেছিল, তখন তাদের এই ‘অষ্ট্ৰিক’ ভাষাভাষী গোষ্ঠীরই সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তখন ‘অষ্ট্ৰিক’ গোষ্ঠীসমূহের সঙ্গে অসুররা ছিল না। _______ আবয়বিক নৃতত্বের পরিমাপ অনুযায়ী অসুর বা আলপীয় গোষ্ঠী বিহারের পশ্চিম সীমানা পর্যন্তই বিস্তৃত ছিল। সে কারণেই একাকী ‘অষ্ট্ৰিক’ গোষ্ঠীসমূহের পক্ষে অসম্ভব ছিল আৰ্যদের অশ্ববাহিত জঙ্গীরথকে প্ৰতিহত করা। কেননা, অশ্ব ভারতের জন্তু নয়। সিন্ধুসভ্যতার কোন কেন্দ্ৰেই অশ্বের কঙ্কালাস্থি পাওয়া যায়নি। পণ্ডিতমহলে আজ এটা সর্ববাদিসম্মতরূপে স্বীকৃত হয়েছে যে, আৰ্যরাই মধ্য এশিয়ায় ঘোড়াকে পোষ মানিয়েছিল, এবং অশ্ববাহিত জঙ্গীরথে করেই তারা ভারতে প্ৰবেশ করেছিল। ভারতে পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত হত বলীবর্দ। বলীবর্দকে এদেশের লোক শ্রদ্ধার চক্ষে দেখত, কেননা বলীবর্দ ছিল শিবের বাহন; অপর পক্ষে আৰ্যরা বলীবর্দকে হত্যা করত ও তার মাংস ভক্ষণ করত। যাই হোক, অশ্ববাহিত জঙ্গীরথের সুবিধা থাকার দরুনই আৰ্যরা তাদের বিজয় অভিযানে সাফল্য অর্জন করেছিল। এই সাফল্য মিথিলা বা বিদেহ পৰ্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। সেখানে এসেই আৰ্যদের পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল ‘অসুর’ জাতি এবং অপর এক জন্তুর নিকট। সে জন্তু হচ্ছে হস্তী। হস্তীকে প্ৰথম পোষ মানিয়েছিল–প্ৰাচ্যদেশের এক মুনি, নাম পালকাপ্য (পৃষ্ঠা ৬৮ দেখুন)। বাঙলার রণহস্তী যে মাত্ৰ আৰ্যদেরই ঠেকিয়ে রেখেছিল তা নয়। এই রণহস্তীর সমাবেশের কথা শুনেই গ্রীক বীর আলেকজাণ্ডার বিপাশা নদীর তাঁর থেকে স্বদেশে প্ৰত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্ৰাচ্যভারতে আৰ্যদের বিজয় অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল, আর এক কারণে। সে কারণ বিবৃত হয়েছে ঐতরেয় ব্রাহ্মণে। সেখানে বলা হয়েছে—‘অসুরগণের সঙ্গে দেবগণের (আর্যদের) লড়াই চলছিল। প্রতিবারেই অসুররা আৰ্যদের পরাহুত করছিল। তখন দেবগণ বলল, অসুরদের মত আমাদের রাজা নেই (অরাজতয়), সেই কারণেই আমরা হেরে যাচ্ছি। অতএব আমাদের একজন রাজা নির্বাচন করা হউক। (‘রাজানম্ করবহম ইতি তথেতি’)। অথর্ববেদেও বলা হয়েছে ‘একরাট’ মাত্ৰ প্ৰাচ্যদেশেই আছে। ‘একরাট’ মানে সার্বভৌম নৃপতি। ইতিহাসও তাই বলে।
****
প্ৰাচ্যদেশেই প্ৰথম সাম্রাজ্য গঠিত হয়েছিল। এটা প্ৰতিষ্ঠিত করেছিলেন। মৌৰ্যসম্রাট চন্দ্ৰগুপ্ত। কিন্তু তিনি উত্তর ভারতের ‘নর্ডিক’ নরগোষ্ঠীভুক্ত বৈদিক _____র কাছে নতি স্বীকার করেননি। মৌৰ্যরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। গুপ্ত-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময়কাল পর্যন্ত বাঙলায় বৌদ্ধ-ধর্মেরই প্ৰাধান্য ছিল। গুপ্তসম্রাটগণের আমলেই বাঙলায় প্ৰথম ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্ৰবেশ ঘটে। কিন্তু সে ব্ৰাহ্মণ্যধৰ্ম আৰ্য-ঐতিহ্যমণ্ডিত ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম নয়। যে সকল ব্ৰাহ্মণ দলে দলে বাঙলায় এসেছিল, তারা নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল, আৰ্যেতর সমাজের কাহিনীসমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত পুরাণাশ্রিত ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের স্রোতে। সে ধর্ম বৈদিক ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সে ধর্মে ইন্দ্ৰ, বরুণ প্ৰভৃতি বৈদিক দেবতাসমূহের প্রাধান্য ছিল না। তারা সম্পূর্ণ পশ্চাদপটে অপসারিত হয়েছিল। তৎপরিবর্তে এক নতুন দেবতাশ্রেণী সৃষ্ট হয়েছিল, যার শীর্ষে অবস্থিত ছিলেন ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। আবার তাঁদেরও শীর্ষে ছিলেন এক নারী দেবতা, শিবজায়া দুৰ্গা। শিব অনাৰ্য দেবতা। ব্ৰহ্মা অবৈদিক দেবতা। আর বিষ্ণু বৈদিক দেবতা হলেও, তাঁর রূপান্তর ঘটেছিল। আৰ্যেতর সমাজের কল্পনার দ্বারা। এটা প্ৰকাশ পেল যখন অবতারবাদের সৃষ্টি হল। অবতারমণ্ডলীতে বিন্যস্ত মৎস্য, কুৰ্ম, বরাহ, নৃসিংহ প্ৰভৃতি অষ্ট্রিক সমাজের টোটেম-ভিত্তিক কল্পনা থেকেই গৃহীত। আর বুদ্ধ তো বেদবিদ্বেষের প্রবক্তা। এঁরা সকলেই কল্পিত হলেন বৈদিক বিষ্ণুর অবতাররূপে। শুধু তাই নয়। বিষ্ণুর সহধর্মিণী হলেন অনাৰ্য দেবতা শিব-কন্যা লক্ষ্মী। পুরাণসমুহ রচনা করেছিলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। মহাভারতও তঁর রচনা। বেদসঙ্কলনের ভারও তার ওপর ন্যস্ত হয়েছিল। এ সম্পর্কে বহুদিন পূর্বে আমি একটা প্রশ্ন তুলেছিলাম, কিন্তু তার কোন সদুত্তর আজও পাইনি। প্রশ্নটা হচ্ছে—’তথাকথিত বৈদিক আৰ্যগণের মধ্যে বড় বড় পণ্ডিত থাকা সত্ত্বেও বেদ-সংকলন, মহাভারত ও পুরাণসমূহ রচনার ভার, কেন একজন অনাৰ্যরমণীর জারজ-সন্তানের ওপর ন্যস্ত হয়েছিল?’
গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের পর শশাঙ্ক বাঙলার রাজা হন। তিনিই বাঙলার প্রথম স্বাধীন নৃপতি যিনি দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে কান্যকুব্জ থেকে গঞ্জাম পৰ্যন্ত জয় করেছিলেন। তিনি শিব উপাসক ছিলেন। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই জনমানসে প্রশ্ন উঠেছিল-‘শিব বড়, না বিষ্ণু বড়?’ এই প্রশ্নের সমাধানের জন্যই হরিহর মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাঙলায় মাৎস্যন্যায়ের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। দেশকে মাৎস্যন্যায় থেকে উদ্ধার করেন পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল। তিনিই প্ৰথম বাঙলার লোককে বৃত্তিগত জাতিতে বিন্যস্ত করবার চেষ্টা করেছিলেন। ভারতের ইতিহাসে পালবংশই একমাত্র রাজবংশ, যে বংশের রাজারা ৪০০ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। পালবংশের রাজত্বকালই হচ্ছে বাঙলার ইতিহাসের গৌরবময় যুগ। তাঁরা যে সাম্রাজিক অভিযান চালিয়েছিলেন, তাতে তাঁরা গান্ধার থেকে সমুদ্র পর্যন্ত সমস্ত ভুখণ্ড জয় করেছিলেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জসমূহের সঙ্গেও তাঁরা সৌহার্দপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের আমলেই বজ্ৰযান বৌদ্ধধর্ম বিশেষ প্রসারলাভ করে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, স্থাপত্য ও ভাস্কৰ্য তাদের আমলে বিশেষ উৎকর্ষতা লাভ করে। বাঙালীর প্রতিভা বিকাশের এটাই ছিল এক বিস্ময়কর যুগ।