তবে প্ৰত্নোপলীয় যুগের প্রথম দিকের মানুষের কঙ্কালাস্থি পাওয়া না গেলেও, _____ সেই প্রাচীন যুগ থেকেই বাঙলা দেশে বাস করে এসেছে, তার প্রমাণ আমরা _______ নানাস্থানে পাওয়া তার ব্যবহৃত আয়ুধসমূহ (tools) থেকে। (পৃষ্ঠা ৭০ দেখুন)। এগুলো সবই পশ্চিম-ইউরোপে প্ৰাপ্ত প্ৰত্নোপলীয় যুগের হাতকুঠারের অনুরূপ। প্ৰত্নোপলীয় (Paleolithic) যুগের পরিসমাপ্তির পরই সুচনা হয় নবোপলীয় (Neolithic) যুগের। এ যুগেই কৃষি ও বয়নের উদ্ভব হয়, এবং মানুষ পশুপালন করতে শুরু করে। তবে সবচেযে বৈপ্লবিক পরিবর্তন যা নবোপলীয় যুগে ঘটেছিল, তা হচ্ছে মানুষ তার যাযাবর জীবন পরিহার করে, স্থায়ীভাবে গ্রামে বাস করতে শুরু করেছিল। ধর্মেরও উদ্ভব ঘটেছিল। তাদের ধর্মীয় জীবন সম্বন্ধে আমি আমার ‘ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ গ্রন্থে আলোচনা করেছি, সেজন্য এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করছি না। নবোপলীয় যুগের কৃষ্টির নিদর্শন আমরা দাৰ্জিলিঙ থেকে মেদিনীপুর পৰ্যন্ত নানাস্থানে পেয়েছি। শুধু তাই নয়, নবোপলীয় যুগের অনেক কিছুই আমরা আজ পর্যন্ত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ধরে রেখেছি, যথা ধামা, চুবড়ি, কুলা, বাপি, বাটনা বাটবার শিল-নোড়া ও শস্য পেষাইয়ের জন্য যাতা ইত্যাদি। এগুলো সবই আজকের বাঙালী নবোপলীয় যুগের ‘টেকনোলজি’ অনুযায়ী তৈরি করে। তা ছাড়া, নবোপলীয় যুগের শস্যই, আজকের মানুষের প্রধান খাদ্য।
জীবনচৰ্যাকে সুখময় করবার জন্য মানুষের জয়যাত্রা নবোপলীয় যুগেই ত্বরান্বিত হয়। কেননা, মাত্র পাঁচ হাজার বৎসরের মধ্যেই নবোপলীয় যুগের গ্রামীণ সভ্যতা তাম্রাশ্মযুগের নগর সভ্যতায় বিকশিত হয়। তাম্রাশ্মযুগের নগর সভ্যতার নিদর্শন আমরা পেয়েছি। বর্ধমান জেলারা পাণ্ডুরাজার চিবি ও সন্নিহিত অঞ্চলে। এই বইয়ের অন্যত্র আমি বলেছি—‘তাম্রশ্মযুগের সভ্যতার অদ্ভ্যুদয়ে তামাই ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। মিশর বলুন, সুমের বলুন, সিন্ধু উপত্যকা বলুন, সর্বত্রই আমরা সভ্যতার প্রথম প্ৰভাতে তামার ব্যবহার দেখি। সুতরাং আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে তাম্রাশ্ম সভ্যতার উন্মেষ এমন কোন জায়গায় হয়েছিল, যেখানে তামা প্ৰভূত পরিমাণে পাওয়া যেত। এখানে সেখানে তামা অবশ্য সামান্য কিছু কিছু পরিমাণে পাওয়া যেত, কিন্তু তা নগণ্য। বাঙলাই ছিল সে-যুগের তামার প্রধান অন্যতম তামার সবচেয়ে বৃহত্তম খনি ছিল বাঙলা দেশে। বাঙলার বণিকরাই ‘সাত সমুদ্র তের নদী’ পার হয়ে, ওই তামা নিয়ে যেত সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্ৰসমূহে বিপণনের জন্য। এজন্যই বাঙলার বড় বন্দরের নাম ছিল তাম্রলিপ্তি। ওই তামা সংগৃহীত হত ধলভূমে অবস্থিত তৎকালীন ভারতের বৃহত্তম তাম্রখনি হতো।’ (পৃষ্ঠা ৭১) আমি আরও বলেছি যে এই তামার সঙ্গে বাঙালী অন্যত্র নিয়ে গিয়েছিল শিব ও শক্তিপূজার বীজ, যা বাঙলার নিজস্ব ধর্ম। বস্তুত বাঙলাদেশে যত শিবমন্দির দেখতে পাওয়া যায়, তত আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। এখানে একথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে বাঙালী এখনও তার ঠাকুরঘরে ব্যবহার করে তাম্রাশ্মযুগের সম্পদ, যথা পাথর ও তামার থালাবাসন, তামার কোষাকুষি ইত্যাদি। (৩৮৪ পৃষ্ঠায় ‘সংযোজন’ দেখুন)
তাছাড়া, নিম্নবাঙলার অনেক স্থানে যেমন মেদিনীপুর জেলার তমলুক (প্ৰাচীন তাম্রলিপ্তি), তিলদা (তমলুক থেকে ২৪ মাইল দূরে), পান্না (ঘাটাল থেকে ৪ মাইল দক্ষিণে), বাহিরি (কাঁথি মহকুমায়) ও রঘুনাথপুর (তমলুক থেকে ১২ মাইল দক্ষিণে), এবং চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপা বা চন্দ্ৰকেতুগড় (কলকাতার ২৩ মাইল উত্তরে), আটঘরা (কলকাতার ১২ মাইল দক্ষিণে), হরিহরপুর (মল্লিকপুর রেল স্টেশনের নিকটে), হরিনারায়ণপুর (ডায়মণ্ড হারবারের ৪ মাইল দক্ষিণে) প্ৰভৃতি স্থানে কীলকচিহ্নাঙ্কিত প্ৰাচীন মুদ্রা, কুশান ও গুপ্ত যুগের মুদ্রা, পোড়ামাটির নানারকম মূর্তি, মৃত্তিক নির্মিত সীলমোহরাদি আবিষ্কৃত হয়েছে। নানারকম প্ৰত্নবস্তু থেকে প্ৰমাণিত হয় যে গ্ৰীক ও রোমান জগতের সঙ্গে এ অঞ্চলের সমৃদ্ধিশালী বাণিজ্য ছিল।
****
বাঙালীকে মিশ্র জাতি বলা হয়। এ সম্পর্কে বলা প্ৰয়োজন যে অধুনা লুপ্তপ্ৰায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদিম অধিবাসিগণ ব্যতীত, জগতে এমন কোন জাতি নাই, যারা মিশ্র জাতি নয়। অন্তত নৃতত্ত্ববিদগণের কাছে এমন কোন জাতির নাম জানা নেই ধারা বিশুদ্ধ রক্ত বহন করে। তার মানে, পৃথিবীর অন্যান্য জাতিরা যেমন মিশ্র জাতি, বাঙালীও তাই। বাঙালীর আবয়বিক নৃতাত্বিক গঠনে যেসব জাতির রক্ত মিশ্রিত হয়েছে, তারা হচ্ছে অষ্ট্রিক ভাষাভাষী বাঙলার আদিম অধিবাসী, ও আগন্তুক দ্রাবিড় ভাষাভাষী ভূমধ্যসাগরীয় নরগোষ্ঠী ও আৰ্যভাষাভাষী আলপীয় (বা দিনারিক) জাতিসমূহ। তবে অষ্ট্রিক ভাষাভাষী বাঙলার আদিম অধিবাসী ও আলপীয় (বা দিনারিক) রক্তই প্ৰধান। এই শেষোক্ত জাতিই বাঙালীকে দিয়েছে তার প্রধান নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য হ্রস্বকপাল (brachycephalic)। এখানেই উত্তর ভারতের দীর্ঘ-কপাল (dolichocephalic) জাতিসমূহ থেকে বাঙালীর পার্থক্য। (এ সম্বন্ধে বিশদ আলো, না করা হয়েছে ‘বাঙালীর নৃতাত্বিক পরিচয়’ অধ্যায়ে)।
বাঙালীর জীবনচৰ্যায় ‘অষ্ট্ৰিক’ প্ৰভাব খুব বেশী। বাঙালীর ভাষা ও সাংস্কৃতিক জীবন এর বহু নিদর্শন বহন করে। বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ এ. সি. হাইেডন তার ‘রেসেস অভ ম্যান’ বইয়ে বলেছেন যে ‘অষ্ট্ৰিক’ ভাষাভাষীরা এক সময় পঞ্জাব থেকে প্ৰশান্ত মহাসাগরের সুদূরে অবস্থিত ইস্টার দ্বীপ পৰ্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাঙালী জীবনে ‘অস্ট্রিক’ প্ৰভাব বিশেষভাবে লক্ষিত হয় বাঙালীর লৌকিক জীবনে। সে জন্যই বাঙালীর লৌকিক জীবনের একটা পরিচয় আমি দিয়েছি। বইখানার গোড়ার দিকে। বস্তুত ‘অষ্ট্রিক’ জীবনচর্যার ওপরই গঠিত হয়েছে বাঙালীর জীবনচর্যার বনিয়াদ। সেই বনিয়াদের ওপরই স্তরীভূত হয়েছে দ্রাবিড় ও আলপীয় উপাদান। তবে আলপীয়রা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বলেই, এই তিনজাতির মহাসম্মিলনে যে জীবনচৰ্যা গড়ে উঠেছিল, তা আলপীয় ‘অসুর’দের (পৃষ্ঠা ৪৪-৪৫ ও ৮১-৮২ দেখুন) নাম অনুসারে অসুর জাতির জীবনচর্যা নামে পরিচিত হয়েছিল। আমাদের প্রাচীন সাহিত্য এটাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে। মহাভারতের আদিপর্ব অনুযায়ী অসুররাজ বলির পাঁচ পুত্রের নাম থেকেই অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড, ও সুহ্ম রাজ্যের নামকরণ হয়েছে। ‘আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প’ নামে এক প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থেও বাঙলা দেশের ভাষাকে ‘অসুর’ জাতির ভাষা বলা হয়েছে। (‘অসুরানাম ভবেৎ বাচ গৌড়পুণ্ড্রোদ্ভব সদা’)। মাত্র আবয়বিক গঠন ও ভাষার দিক দিয়েই নয়, অসুরজাতির সমগ্র জীবনচর্যাটাই উত্তরভারতের ‘নর্ডিক’ নরগোষ্ঠীভুক্ত বৈদিক আৰ্যগণের জীবনচর্যা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। এই জীবনচর্যার পার্থক্যের জন্যই বৈদিক আর্যরা বাঙলাদেশের ‘অসুর’ জাতি-ভুক্ত লোকদের তির্যকদৃষ্টিতে দেখতেন। আর্যদের সঙ্গে অসুরদের বিরোধের এটাই ছিল কারণ। (লেখকের ‘ভারতের নৃতাত্বিক পরিচয়’ দ্র:)।