গৌড়চন্দ্ৰিকা – বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন
প্রাচীন বাঙলার অপর নাম ছিল ‘গৌড়’। সেজন্য বইখানার ভূমিকার নাম দেওয়া হয়েছে ‘গৌড়চন্দ্ৰিকা’। আর বইখানার শিরোনামে গৃহীত ‘বিবর্তন’ শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে আভিধানিক অর্থে। ‘বিবর্তন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘পরিবর্তন’। ‘বিবর্তন’ শব্দের সঙ্গে অবনতি বা উন্নতির কোন সম্পর্ক নেই। একমাত্র সম্পর্ক হচ্ছে রূপান্তরের সম্পর্ক। সেজন্য কালের ঘূর্ণনে বিভিন্ন যুগে বাঙালী জীবনে যে রূপান্তর ঘটেছে, তারই ইতিহাস দেওয়া হয়েছে এই বইতে। তবে এ ইতিহাস কোন ‘পোশাকী’ বা ‘ফরম্যাল’ ইতিহাস নয়। সম্পূর্ণ ভাবে এটা ‘আটপৌরে’ বা ‘ইনফরম্যাল’ ইতিহাস। এটা বিষয়-বিন্যাসের পদ্ধতি থেকেই বুঝতে পারা যাবে। এককথায় বইখানাতে পাওয়া যাবে বাঙালী জীবনের সৃজন, বিকাশ ও বিপৰ্যয়ের ইতিহাস। বইখানা লেখা হয়েছে রবীন্দ্ৰনাথের উক্তিকে স্মরণ করে। রবীন্দ্ৰনাথ বলেছিলেন–‘আমরা ইতিহাস পড়ি–কিন্তু যে ইতিহাস দেশের জনপ্রবাহকে অবলম্বন করিয়া প্ৰস্তুত হইয়া উঠিয়াছে, যাহার নানা লক্ষণ, নানা স্মৃতি আমাদের ঘরে বাইরে নানা স্থানে প্ৰত্যক্ষ হইয়া আছে, তাহা আমরা আলোচনা করি না বলিয়া ইতিহাস যে কী জিনিষ, তাহার উজ্জ্বল ধারণা আমাদের হইতে পারে না।’
বাঙালীর জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল মানুষের আবির্ভাবের দিন থেকে। ভূতাত্ত্বিক আলোড়ন ও চঞ্চলতার ফলে বাঙলা দেশ গঠিত হয়ে গিয়েছিল প্লীওসিন যুগে। ভূতত্ত্ববিদগণের হিসাব অনুযায়ী সেটা ঘটেছিল প্ৰায় দশ থেকে পঁচিশ লক্ষ বৎসর পূর্বে। মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল আরও পরে, আজ থেকে পাঁচ লক্ষ বৎসর আগে। তার আগেই ঘটেছিল জীবজগতে ক্ৰমবিকাশের এক কর্মকাণ্ড। বানরজাতীয় জীবগণ চেষ্টা করছিল বিভিন্ন লক্ষণযুক্ত হয়ে নানা বৈশিষ্ট্যমূলক শাখা-প্ৰশাখায় বিভক্ত হতে। এরূপ এক শাখা থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল নরাকার জীবসমূহ (primates)। এরূপ নরাকার জীবসমূহের কঙ্কালাস্থি আমরা পেয়েছি ভারতের উত্তর-পশ্চিমে শিবালিক শৈলমালা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে। বিবর্তনের ছকে তাদের আমরা মাম দিয়েছি। শিবপিথেকাস, রামপিথেকাস, সুগ্ৰীবপিথেকাস ইত্যাদি। আরও উন্নত ধরনের নরকার জীবের কঙ্কালাস্থি পাওয়া গিয়েছে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বে জাভা-দ্বীপে ও চীন দেশের চুংকিং-এ। এখন এই তিনটি জায়গায় তিনটি বিন্দু বসিয়ে যদি সরলরেখা দ্বারা সংযুক্ত করা হয়, তা হলে যে ত্রিভুজ সৃষ্ট হবে, তারই মধ্যস্থলে পড়বে বাঙলা দেশ। সুতরাং এরূপ নরাকার জীবসমূহ যে বাঙলা দেশের ওপর দিয়ে যাতায়াত করত, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এসব নরাকার জীব থেকেই মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল।
মানুষের প্রথম সমস্যা ছিল আত্মরক্ষা ও খাদ্য আহরণ। জীবন-সংগ্রামের এই সমস্যা সমাধানের জন্য, তাকে তৈরি করতে হয়েছিল আয়ুধ। আয়ুধগুলো একখণ্ড পাথর অপর একখণ্ড পাথরের সাহায্যে তার চাকলা তুলে হাতকুঠার ও অন্য আকারে নির্মিত হত। এগুলোকে আমরা প্ৰত্নোপলীয় যুগের আয়ুধ বলি। গঠনপ্রণালী ও চারিত্রিক বিশিষ্টতার দিক দিয়ে এগুলো _____ অনুক্রমিক সাতটা যুগে ফেলি। যথা (১) আবেভিলিয়ান, (২) অ্যাশুলিয়ান, (৩) লোভালয়সিয়ান, (৪) মুস্টেরিয়ান, (৫) অরিগনেসিয়ান, (৬) সলুট্রিয়ান ও (৭) ম্যাগডেলেনিয়ান। এগুলো সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশী অনুসন্ধান ও অনুশীলন হয়েছে পশ্চিম হউরোপে। সেজন্যই এহ সকল আয়ুধের ‘টাইপ’-এর নাম পশ্চিমইউরোপের অঞ্চলবিশেষের নাম অনুসারে করা হয়েছে। তবে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদগণ তাদের কাজের স্বাবধার জন্য প্ৰত্নোপলীয় যুগকে তিন ভাগে ভাগ করেন, যথা–আদি, মধ্য ও আপ্তিম। আয়ুধ নির্মাণ ছাড়া, প্ৰত্নোপলীয় যুগের মানুষের আরও কয়েকটা বৈশিষ্ট্য ছিল, যথা ভাবপ্ৰকাশের জন্য ভাষার ব্যবহার, পারিবার গঠন, পশু-শিকার সুগম করবার জন্য পৰ্বত-গুহায় বা পর্বতগাত্ৰে পশুর চিত্রাঙ্কল দ্বারা ঐন্দ্ৰজালিক প্রক্রিয়ার আশ্ৰয় গ্ৰহণ, ও আগুনের ব্যবহার।
মুসেন্টারিয়ান যুগের আগেকার যুগের মানুষের কোন কাঙ্কালাস্থি আমরা পাইনি। মুস্টেরিয়ান যুগে যে জাতির মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল, তাদের আমরা নিয়ানডারথাল মানুষ বলি। তবে সে জাতির মানুষ এখন লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। যে জাতির মানুষ থেকে আধুনিক জাতিসমূহ উদ্ভূত হয়েছে, তাদের আবির্ভাব ঘটে আনুমানিক ৪০,০০০ বৎসর পূর্বে। তাদের আমরা ক্ৰোম্যানয়ন (CroMagnon) জাতির মানুষ বলি।
খুব প্ৰাচীনকালের মানুষের কঙ্কালাস্থি ভারতে পাওয়া যায়নি। বিখ্যাত প্ৰত্নাস্থিতত্ত্ববিদ স্যার আর্থার কীথ ১৯১৮ খ্ৰীস্টাব্দে যখন তার ‘অ্যানটিকুইটি অত্ ম্যান’ নামক বই লেখেন, তখন তিনি বলেছিলেন—‘প্রাচীন মানুষের সম্বন্ধে ধারা অনুসন্ধান করেন, তারা ভারতের দিকেই আশার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন, কিন্তু এ পৰ্যন্ত তাদের নিরাশ হতে হয়েছে।’ অনুসন্ধানের উদ্যোগের অভাবই এর একমাত্র কারণ। সম্প্রতি (১৯৭৮ খ্ৰীস্টাব্দে) মেদিনীপুর জেলার রামগড়ের অদূরে সিজুয়ায় পাওয়া গিয়েছে এক জীবাশ্মীভূত ভগ্ন মানব-চোয়াল। রেডিয়ো-কারবন-১৪ পরীক্ষায় এর বয়স নির্ণীত হয়েছে ১০,৫০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ। তার মানে প্ৰত্নোপলীয় যুগের একেবারে অন্তিম পর্বে, কেননা নবোপলীয় যুগ শুরু হয়েছিল ৮,০০০ খ্ৰীস্টপূর্বাব্দে বা তার কিছু পূর্বে।