Site icon BnBoi.Com

গথ – অৎসুইশি

গথ - অৎসুইশি

গথ

১. মোরিনার সাথে শেষ দেখা

গথ – অৎসুইশি / অনুবাদ: কৌশিক জামান / প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অনুবাদকের বক্তব্য :

‘অৎসুইশি’ নামটাতেই কেমন জানি অশুভ অশুভ একটা ভাব আছে। সেরা

জাপানি গৃলার লেখকদের তালিকায় অদ্ভুত নামটা তাই আলাদাভাবে আমার মনোযোগ কেড়েছিল। ইন্টারনেটে দেখলাম লেখকের সবকয়টি বইয়েরই রিভিউ ভালো কিন্তু বইগুলো সম্পর্কে সেভাবে বিস্তারিত কিছু পাওয়া গেল না। তারপর নানা কারনে এই লেখকের প্রতি আমার কৌতূহল বাড়তেই লাগল। মনে হচ্ছিল যেন ব্ল্যাকহোলের মত টানছে। পরিচিত সবখানে খুঁজলাম, কোথাও কোন বইও পেলাম না। ই-বুক পর্যন্ত পাচ্ছিলাম না! বাইরে থেকে বই আনাতে গিয়েও নানা রকমের কুফা লাগল। সেসব কাহিনী আর না বলি। সোজা কথা হলো, আমার জিদ চেপে গেল-যেভাবেই হোক এই লেখকের বই আমাকে পেতেই হবে। কী এত রহস্য তা জানতে হবে। অবশেষে অনেক ঝামেলা পর ‘গথ’-এর একটা ই-বুক পাওয়া গেল। কষ্ট কাজে দিল, খুবই ভালো লাগল বইটা পড়ে। হাতের অন্য কাজ ফেলে আগে ‘গথ’ অনুবাদ করলাম। আশা করি পাঠকদেরও ভাল লাগবে।

আর প্রেমপুকে ধন্যবাদ বইটি সম্পাদনা করার জন্য। খালামনিকে বলেছিলাম একটা বই শুধু তার জন্য লেখা হবে, এই সেই বই (জানি না আদৌ পড়বে কিনা!)। সেঁজুতি কিছুদিন আগে মালয়শিয়া থেকে অৎসুইশির ‘জু’ বইটাও এনে দিলেন। শপ টু বিডি গ্রুপের ফয়সাল ভাই কানাডা থেকে এনে দিলেন ‘সামার, ফায়ারওয়ার্কস অ্যান্ড মাই কর। তাদের দুজনকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

অবশেষে প্রকাশককে ধন্যবাদ সবসময় হাসিমুখে সব যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য।

কৌশিক জামান
ঢাকা, ২০১৮

তিন সপ্তাহ আগে মোরিনার সাথে আমার শেষ দেখা হয়। গরমের ছুটি চললেও সেদিন আমাদেরকে স্কুলে যেতে হয়েছিল।

হোমরুম শুরু হওয়ার আগেই ক্লাসে ঢুকে সাথে সাথেই আমার ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়াল।

আমরা কখনোই হাই-হ্যালোর ধার ধারি না। মোরিনো পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করে আমার ডেস্কের উপর রাখল। নোটবুকটা আমি আগে কখনো দেখিনি।

জিনিসটা বেশ ছোট, হাতের তালুতে ভরে ফেলা যায়। বাদামি রঙের সিন্থেটিক লেদারে মোড়ানো-স্টেশনারির দোকানে এরকম নোটবুক সবসময়ই দেখা যায়।

“দেখ কি খুঁজে পেয়েছি,” সে বলল। “এটা আমার না।”

“জানি।” কথা শুনে মনে হলো ও মজা পাচ্ছিল।

নোটবুকটা হাতে নিয়ে এর নকল চামড়ার মসৃণ কাভারের স্পর্শ অনুভব করলাম আমি। খুলে দেখতে লাগলাম ভেতরে কী আছে। নোটবুকের অর্ধেকটার মত ক্ষুদে অক্ষরে লেখা দিয়ে ভর্তি। শেষের অর্ধেকটা খালি।

“গুরু থেকে পড়।”

ওর কথা অনুসারে আমি পড়া শুরু করলাম। অপরিচিত হাতের লেখা। অনেকগুলো প্যারাগ্রাফ, দেখে মনে হচ্ছিল লিস্ট ধরে সাজানো।

***

মে ১০

স্টেশনের সামনে কুসুদা মিতসুই নামের একটা মেয়ের সাথে দেখা হলো। বয়স ষোল। ওর সাথে কথা বললাম। কিছুক্ষণ পরে ও আমার গাড়িতে চড়ে বসল।

ওকে নিয়ে ট****উন্টেনে গেলাম।

ও জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমাকে বলল ওর মা নাকি খবরের কাগজের এডিটর কলামের চিঠিগুলোর জন্য পাগল।

ট****ম্মাউন্টেনের একদম উপরে নিয়ে গাড়ি থামিয়ে ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে ছুরি, পেরেক ভর্তি ব্যাগটা বের করলাম। ও হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল ব্যাগে কী আছে।

***

এভাবে ডায়েরির শুরু।

কুসুদা মিতসুই নামটা আমি আগে দেখেছি…তিন মাস আগে, একটা পরিবার, স্বামী-স্ত্রী আর তাদের ছেলে, ট****ম্মাউন্টেনে হাইকিং করতে গিয়েছিল। ছেলেটার বাবা অনেকদিন পর ছুটি পাওয়ায় চূড়ায় পৌঁছেই চিৎপটাং হয়ে বিশ্রাম নিতে থাকে। ছেলেটা অনেক চেষ্টা করল বাবাকে তার সাথে খেলার জন্য কিন্তু লোকটা নড়লই না। সুতরাং লাঞ্চের পর ছেলেটা একা একাই বনের দিকটা ঘুরে দেখতে গেল।

ছেলেটার মা প্রথম খেয়াল করলেন, সে আশেপাশে নেই। তারপর বন থেকে ভেসে আসা ভয়ার্ত চিৎকার শুনতে পেলেন।

স্বামী-স্ত্রী দু-জনে ছুটে গেলেন বনের দিকে ছুটে গেলে ছেলেকে খুঁজে পেলেন সেখানে। সেখানে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে, দৃষ্টি সামনে, একটু উপরে কিছু একটার দিকে নিবদ্ধ।

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে স্বামী-স্ত্রী দেখতে পেলেন একটা গাছের গায়ে লালচে কালো রঙের নোংরা কিছু লেগে আছে। ছোটখাট কিন্তু অশুভ ধরনের কিছু, পেরেক দিয়ে গাছে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। তারপর চারপাশে তাকিয়ে

তারা দেখলেন আশেপাশের প্রায় সব গাছেই কিছু না কিছু ৫ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে…

কুসুদা মিতসুইর শরীরের বিভিন্ন অংশ। কেউ তাকে বনে এনে টুকরো টুকরো করেছে। তারপর তার চোখ, জিহ্বা, কান দুটো, আঙুল, কাকি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একটা একটা করে গাছগুলোতে পেরেক ঠুকে লাগিয়ে দিয়েছে।

একটা গাছের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত মেয়েটার বাম-পায়ের বুড়ো আঙুল, উপরের ঠোঁট, নাক আর পাকস্থলি লাগানো। আরেকটা, ক্রিসমাস ট্রি’র মত করে সাজানো ছিল।

সাথে সাথেই এই বিভৎস খুনের ঘটনা সারা দেশের মূল আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল।

মোরিনোর পাওয়া নোটবুকে বিস্তারিত লেখা ছিল-কিভাবে কুসুদা মিতসুইকে খুন করা হয়েছিল, কোন অঙ্গ কোন গাছে পেরেক মেরে লাগানো হয়েছিল, কী ধরনের পেরেক ব্যবহার করা হয়েছিল ইত্যাদি। কিন্তু লেখার মধ্যে লেখকের মানবিক অনুভুতির কোন বহিঃপ্রকাশ ছিল না।

কেসটার যাবতিয় সব খোঁজ খবর সংগ্রহে রাখছিলাম আমি। সেটা টিভিতে, খবরের কাগজ কিংবা ম্যাগাজিন, অথবা ইন্টারনেটে যেখানেই হোক। তাই প্রায় সবকিছুই আমার জানা ছিল। কিন্তু এই নোটবুকে যেভাবে বর্ণনা দেয়া সেটা আর কোথাও দেখিনি।

“আমার ধারণা মেয়েটাকে যে খুন করেছে, নোটবুকটা তার।”

পাশের বিভাগের একটা হাই স্কুলের ছাত্র ছিল কুসুদা মিতসুই। তাকে শেষ দেখা গিয়েছে স্টেশনের সামনে বন্ধুদের গুডবাই জানাতে। আর ও ছিল লোমহর্ষক খুনগুলোর মধ্যে প্রথম শিকার। এরকম আরো একটা কেস আছে, সেটার সাথে প্রচুর মিল আছে এটার। অনেকে বলে দুটোই একই সিরিয়াল কিলারের কাজ।

“ও দ্বিতীয় খুনটা সম্পর্কেও লিখেছে।”

***

জুন ২১

শপিং ব্যাগ হাতে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা এক মেয়ের সাথে কথা বললাম। সে জানাল তার নাম নাকানিসি কাসুমি।

আমি তাকে বাসায় লিফট দিতে চাইলাম।

হ***মাউন্টেনে যাওয়ার পথে সে খেয়াল করল আমরা ওর বাসায় যাওয়ার রাস্তা থেকে সরে এসেছি। তারপরই চিল্লাচিল্লি শুরু করল।

গাড়ি থামিয়ে ও চুপ না করা পর্যন্ত হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারতে থাকলাম আমি।

হ*** মাউন্টেনের একটা কুঁড়ে ঘ রে রেখে আসলাম ওকে।

***

গত মাসে দেশের সবাই নাকানিসি কাসুমি নামে কারিগরি স্কুল পড়ুয়া একজন ছাত্রির কথা জানতে পারে। খবরের কাগজ আর চ্যানেলগুলো সাথে সাথে খবরটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। ঐ দিন এমনকি স্কুল থেকে ফেরার আগেই আমি এই দ্বিতীয় শিকারের খবর পেয়ে যাই।

হ***মাউন্টেনের উপর একটা কুঁড়ে ঘরে মেয়েটাকে পাওয়া যায়। অনেকদিন ধরেই জায়গাটা পরিত্যাক্ত ছিল, মালিক কে তা জানা যায়নি। বৃষ্টিতে কুঁড়ে ঘরটার বারোটা বেজে গিয়েছিল। প্রায় দশ ফুট চওড়া ঘরটার দেয়াল আর মেঝেটা কাঠ দিয়ে তৈরি।

একজন বুড়ো লোক পাহাড়ে গিয়েছিল খাবার সংগ্রহ করতে। সে খেয়াল করল কুঁড়ে ঘরের দরজাটা খোলা। সবসময় সেটাকে বন্ধ দেখেছে। তাই অবাক হয়ে কাছে যেতেই বিকট এক দুর্গন্ধ এসে লাগে তার নাকে।

কুঁড়ের ভেতরে উঁকি দিয়ে প্রথমে সে বুঝতে পারেনি আসলে কী দেখেছে। আগের শিকারের মতই নাকানিসি কাসুমির শরীরকে কেটে টুকরো টুকরো করে যত্নের সাথে কাঠের মেঝেতে দশ বাই দশ ছকে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল সারি সারি করে। প্রতিটি টুকরোর মধ্যে দূরত্ব ছিল দশ সেন্টিমিটারের মত। মেয়েটাকে প্রায় একশ টুকরোতে রূপান্তর করা হয়েছিল।

এই নোটবুকে সেটার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া আছে।

দুটো খুনেরই কোন প্রত্যক্ষদর্শি পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত খুনিও ধরা পড়েনি। মিডিয়া আজো খুন দুটো নিয়ে নিউজ করে যাচ্ছে। কোনো সিরিয়াল কিলারের বিভৎস কার্যকলাপ বলে চালানো হচ্ছে এগুলোকে।

“এই কেসের খবর দেখতে আমার ভালো লাগে।”

“কেন?”

“অদ্ভুত একটা কেস,” মোরিনো নীরস গলায় বলল।

আমিও একই কারনে খবর দেখতাম, তাই মোরিনো কি বোঝাতে চেয়েছিল তা পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম।

কিছু মানুষ খুন হয়েছে-কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে তাদের। যাদেরকে করা হয়েছে আর যারা তাদেরকে এরকম করেছে উভয়েই সত্যিকারের রক্তমাংসের মানুষ।

মোরিনো আর আমার এসব উভট বিভৎস বিষয়ের প্রতি অন্যরকম একটা আগ্রহ রয়েছে। আমরা সবসময় এমন কিছু খুঁজি যার মধ্যে জঘন্য খারাপ কিছু পাওয়া যায়, এমন কিছু যা জানার পর গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তে ইচ্ছা হয়। অবশ্য এরকম অদ্ভুত আগ্রহ নিয়ে আমরা কখনো খোলাখুলি কথা বলিনি। কোন কিছু না বলেই আমরা একজন আরেকজনের মধ্যে অস্বাভাবিক ব্যাপারটার উপস্থিতি টের পেয়েছি।

আমি জানি আমাদের এসব কথা সাধারণ মানুষ জানলে আতংকিত হয়ে পড়বে। এধরনের আচরণ অনেকটাই অস্বাভাবিক। তাই আমরা যখন কোন টর্চার প্রক্রিয়া বা খুনের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করি তখন গলার স্বর নিচু রাখি।

নোটবুক থেকে মুখ তুলে দেখি মোরিনো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আমি নিশ্চিত ও নির্ঘাত নাকানিসি কাসুমির শরীরের অংশ মেঝেতে পড়ে থাকার দৃশ্য কল্পনা করছিল।

“কোথায় পেয়েছে এই জিনিস?” আমি জানতে চাইলাম। বিস্তারিত জানাল সে।

আগের দিন বিকেলে মোরিনো ওর প্রিয় কফি শপে বসেছিল। জায়গাটা অন্ধকার, চুপচাপ আর কফি মাস্টারও কখনো টু শব্দ করে না।

মোরিনো কফি খেতে খেতে ‘পৃথিবীর নিষ্ঠুর গল্প সমগ্র’-এর পাতা ওল্টাচ্ছিল। এমন সময় শব্দ শুনে বাইরে তাকিয়ে দেখে জোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।

কয়েকজন কাস্টমার বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল কিন্তু বৃষ্টি দেখে আবার বসে পড়ল তারা। বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষায় থাকা এইসব লোজনসহ ওকে নিয়ে সেখানে মোট পাঁচজন কাস্টমার ছিল।

মোরিনো বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠলে পায়ের তলায় অদ্ভুত কিছুর একটা উপস্থিতি অনুভব করে তাকিয়ে দেখে দোকানের কাঠের মেঝের উপর একটা নোটবুক পড়ে আছে। নোটবুকটা তুলে ও পকেটে ভরে ফেলে। একবারও নোটবুকটা কার হতে পারে সেটা খোঁজ নেয়ার কথা ওর মাথায় আসেনি।

বাথরুম থেকে ফিরে দেখে অন্য কাস্টমাররা কেউই বের হয়নি, বসে বসে বৃষ্টি দেখছে।

বৃষ্টি থামলে আবার দেখা পাওয়া গেল সূর্যের। সূর্যের উষ্ণ আলোয় শিগগিরি রাস্তাঘাট শুকিয়ে গেল। কয়েকজন কাস্টমার বেরিয়ে গেল কফিশপ থেকে।

বাসায় ফেরার পর মারিনোর মনে পড়ল নোটবুকটার কথা। পকেট থেকে বের করে পড়তে শুরু করল সে।

“আমি দুবার বাথরুমে গিয়েছিলাম। প্রথমবার নোটবুকটা ওখানে ছিল। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর কাস্টমাররা ভেতরে আটকা পড়ে। দ্বিতীয়বার বাথরুমে যাওয়ার সময় নোটবুকটা পাই। এর অর্থ হলো, খুনি তখন কফি শপের ভেতর ছিল। ধারে কাছেই কোথাও থাকে সে।” বুকের সামনে দুহাত ভাঁজ করে বলল।

আমরা যেখানে থাকি তার থেকে দু-তিন ঘন্টার দূরত্বে লাশ দুটো পাওয়া গিয়েছে। সুতরাং এখানে খুনির বাস করা অসম্ভব কিছু নয়। তবু কেন জানি ব্যাপারটা মেনে নিতে ইচ্ছা হচ্ছিল না।

এই কেস নিয়ে হয়তো বছরের পর বছর কথা চলবে। রহস্যের সমাধান হলেও ভয়াবহ বিভৎসতার কারনে ব্যাপারটা পরিস্কার। পুরো দেশের সবাই এই নিয়ে কথা বলছে-এমনকি বাচ্চারাও এই কাহিনী জানে। যে কারনে খুনি ধারে কাছে কোথাও থাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।

“এমনও তো হতে পারে খবর দেখে কেউ কল্পনা করে লিখেছে?”

“বাকিটা পড়, মোরিনো আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল।

***

আগস্ট ৫

মিজুগুশি নানামি নামে একটা মেয়েকে রাইড দিলাম। স**** মাউন্টেনের কাছে একটা সোবা শপে তার সাথে পরিচয়।

পাহাড়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে উঠে আমরা বনের ভেতরের মঠে গেলাম। সে আমার সাথে বনের ভেতর গেল।

***

নোটবুকের মালিক বনের ভেতর মিজুগুশি নানামি নামের একজনকে ছুরি দিয়ে পেটে কুপিয়েছে।

নোটবুকে সে গিজগিজ হাতের লেখায় লিখেছে, কিভাবে শিকারের শরীর কাটা হয়েছে। কিভাবে সে তার চোখগুলো টেনে বের করে এনেছে, পেটের ভেতরের রঙ কিরকম ছিল, যাবতিয় বর্ণনা দেয়া আছে।

সে মিজুগুশি নানামিকে বনের ভেতর ফেলে এসেছে।

“তুমি কি এই মিজুগুশি নানামির নাম শুনেছ?” মোরিনো বলল।

আমি মাথা নাড়লাম।

মেয়েটার লাশ আবিস্কারের কোন খবর পাওয়া যায়নি এখনো।

মোরিনোকে আমি খেয়াল করি দ্বিতীয় বর্ষ শুরুর পর। আমরা একই ক্লাসে ছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম ও বোধহয় আমার মতই কারো সাথে মিশতে চায়না, একাকি জীবন নিয়ে চলতে চায়। এমনকি বিরতির সময় কিংবা হল দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ও সে লোকজনকে এড়িয়ে চলে। কখনো কোন আড্ডায় ঢোকে না।

আমাদের ক্লাসে শুধু আমরা দুজন এমন ছিলাম। অবশ্য এটা বলা যাবে না যে, আমি যেভাবে আমার ক্লাসমেটদের উৎসাহ নিয়ে বিরক্ত, সেও সেরকম। আমার সাথে কেউ কথা বলতে আসলে কথা বলি। হালকা মজা করে ব্যাপারটাকে বন্ধুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রাখি। সাধারণ জীবনযাপনের জন্য নমূনতম যতটুকু করা দরকার করি। কিন্তু এসব কিছুই করি উপরে উপরে, আমার হাসির পুরোটাই আসলে মিথ্যে, পুরোপুর বানোয়াট।

প্রথমবার আমরা যখন কথা বলি, মোরিনো সোজা আমার ভেতরের রূপটা দেখে ফেলেছিল।

“আমাকে ওরকম হাসি দেয়া শেখাবে?” স্কুলের পর আমার সামনে এসে ও সরাসরি বলেছিল, মুখে কোন রকম কোন অভিব্যক্তি ছাড়াই। সে নিশ্চয়ই আমাকে ভেতরে ভেতরে ঘৃণা করত।

এটা ছিল মে মাসের শেষের দিকের কথা। এরপর থেকে আমরা মাঝে মাঝে কথা বলতাম।

মোরিনো স্রেফ কালো রঙের পোশাক পরত-পায়ের জুতো থেকে মাথার লম্বা একদম সোজা কালো চুল পর্যন্ত সব গাঢ় রঙ। উল্টোদিকে ওর চামড়ার মত ফ্যাকাসে সাদা রঙ আমি আর কারো দেখিনি। দেখে মনে হত সিরামিকের তৈরি। ওর বাম চোখের নিচে একটা ছোট্ট তিল ছিল, অনেকটা ক্লাউনের মুখের মত দেখতে। এতে চেহারায় একটা রহস্যময়ি ভাব এসেছিল।

সাধারণ মানুষের তুলনায় ওর চেহারায় অভিব্যক্তি খুবই কম বদলাত, কিন্তু বদলাত। যেমন, সে হয়তো একজন খুনির উপর একটা বই পড়ছে, যে কিনা রাশিয়াতে বায়ান্ন জন নারী-শিশুকে হত্যা করেছে। বোঝা যেত ও বইটা পড়ে মজা পাচ্ছে। এই অভিব্যক্তির সাথে ক্লাসে বসে থাকা অবস্থায় বিষণ্ণ সুইসাইডাল অভিব্যক্তির মিল নেই। ওর চোখগুলো তখন জ্বলজ্বল করত।

একমাত্র ওর সাথে কথা বলার সময় আমি কোন ভান করতাম না। অন্য কারো সাথে যদি এভাবে কথা বলতাম তাহলে তারা অবাক হত-কেন আমার চেহারায় কোন অভিব্যক্তি নেই, কেন আমি হাসি না। কিন্তু মোরিনোর সাথে কথা বলার সময় এসবের কোন প্রয়োজন নেই। আমার ধারণা ও আমার সাথে একই কারনে কথা বলত।

আমাদের দুজনের কেউই লোকজনের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পছন্দ করতাম না। আমরা আমাদের প্রাণবন্ত ক্লাসমেটদের ছায়ায় লুকিয়ে নিজেদের নিশ্চুপ জীবন যাপন করতাম।

তারপর এল গরমের ছুটি। আর সাথে এই নোটবুক।

***

যেদিন ও আমাকে নোটবুকটা দেখাল, সেদিনই পরে আমরা স্টেশনে দেখা করলাম আর স**** মাউন্টেনে যাওয়ার ট্রেনে চড়ে বসলাম।

আগে আমরা কখনো স্কুলের বাইরে দেখা করিনি। তাই এবারই প্রথম ওকে ইউনিফর্ম ছাড়া দেখলাম। সে যথারীতি কালো পোশাকই পরে ছিল। আমিও কালো পোশাক পরেছি। আর ওর মুখ দেখে বুঝলাম ও তা খেয়ালও করেছে।

ট্রেনে লোকজন প্রায় ছিলই না, যারা ছিল তারাও চুপচাপ। আমরাও কোন কথা বলিনি, যার যার বইয়ে নাক ডুবিয়ে বসেছিলাম। ও পড়ছিল শিশু নির্যাতনের উপর একটা বই, আর আমি পড়ছিলাম বিখ্যাত এক শিশু অপরাধির পরিবারের লেখা একটা বই।

ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের কাছের সিগারেটের দোকানে বসে থাকা এক বুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম স****মাউন্টেনের কাছে কয়টা সোবা শপ আছে। তিনি বললেন একটাই আছে, আর আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে কাছেই সেটা।

এই সময় মোরিনো একটা দুর্দান্ত কথা বলল। “তামাকের কারনে অনেক মানুষ মারা যায়, কিন্তু সিগারেটের ভেন্ডিং মেশিন এই বুড়ির কাজ কেড়ে নিয়ে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।”

ও আমার থেকে কোন প্রতিক্রিয়া আশা করছিল না, তাই আমিও কিছু বললাম না।

আমরা রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে সোবা শপের দিকে গেলাম। রাস্তাটা পাহাড় ঘিরে উপরের দিকে উঠে গিয়েছে।

স**** মাউন্টেনের গোড়ায় সোবা শপটা দাঁড়িয়ে। পাশে সারি দিয়ে কয়েকটা রেস্টুরেন্ট আর বার। তেমন একটা ভিড় ছিল না, অল্প কয়েকটা গাড়ি আর লোকজন দেখা গেল। সোবা শপের পার্কিং লটে কোন গাড়ি ছিল না। অবশ্য দোকানটা ভোলাই ছিল, দরজায় ‘ওপেন দেখে আমরা ভেতরে গেলাম।

“খুনির সাথে মিজুগুশি নানামির এখানেই দেখা হয়েছিল,” মোরিনো বলল। দোকানের ভেতরে এমনভাবে চোখ বোলাল, যেন আমরা জনপ্রিয় কোন টুরিস্ট স্পটে এসেছি। “সরি-এটা আসলে একটা সম্ভাবনা, সে হয়তো এখানে মেয়েটার সাথে দেখা করেছিল। আমরা এখানে এসেছি সত্যিটা কি তা জানতে।”

আমি ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে নোটবুক পড়তে লাগলাম। নীল বল পয়েন্ট কলমে লেখা। নোটবুকে শুধু যে তৃতীয় মেয়েটার কথা ছিল, তা নয়। আরও কিছু মাউন্টেনের নাম লেখা ছিল। প্রথম পৃষ্ঠায় সেগুলো লেখা ছিল খুনের কাহিনীগুলোর আগে।

মাউন্টেনগুলোর নামের সাথে এরকম চিহ্ন দেয়া ছিল : ⃣,O,⃤ /, আর X। যে মাউন্টেনগুলোতে লাশ তিনটা রাখা হয়েছে সেগুলোর সবগুলোতে • দেয়া। হয়তো এর মানে হল এই মাউন্টেনগুলো খুন করার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা।

নোটবুকে এমন কিছু ছিল না যা থেকে লেখক সম্পর্কে কিছু জানা যায়। আর আমাদের দুজনের কেউই এটা পুলিশের হাতে তুলে দেয়ার কথা চিন্তাও করিনি। আমরা কিছু করি না করি পুলিশ আজকে হোক কালকে হোক খুনিকে একদিন ধরবেই। নোটবুক ওদের দিলে হয়তো কাজটা একটু দ্রুত হতে পারে, ভিক্টিমের সংখ্যা কমতে পারে। সুতরাং আমাদের দায়িত্ত নোটবুকটা পুলিশের হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের সেসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথা ছিল না। আমরা নিষ্ঠুর, সরীসৃপের মত হিংস্র, হাই স্কুলের শিক্ষার্থী।

“যদি চতুর্থ কোন ভিক্টিম পাওয়া যায়, তাহলে ধরে নিতে হবে আমরাই তাকে খুন করেছি।”

“কী দুঃখজনক।”

সোবা খেতে খেতে আমরা এইসব আলাপ করলাম। মোরিনোকে দেখে মনে হচ্ছিল না ওর কাছে ব্যাপারটাকে দুঃখজনক কিছু মনে হচ্ছে, ওর কথায় অনুভূতির কোন রেশ ছিল না, সমস্ত মনোযোগ ছিল সামনে বাটি ভর্তি সোবার উপর।

দোকানের মালিকের কাছে আমরা মঠে যাওয়ার রাস্তা জানতে চাইলাম।

আমরা যখন হাঁটছিলাম, মোরিনো তখন নোটবুকের দিকে তাকিয়ে ছিল, কাভারে স্পর্শ করছিল, যেখানে কিনা খুনিও স্পর্শ করেছে। ওর

ভাবসাবে মনে হল খুনির প্রতি ওর যথেষ্ট পরিমান ভক্তিও আছে।

আমার নিজেরও আছে। জানি ব্যাপারটা সঠিক নয়। খুনি এমন একজন ব্যক্তি যার শাস্তি হওয়া উচিত। তাকে এমন মর্যাদা দেয়া উচিত না যেভাবে একজন বিপ্লবী কিংবা শিল্পীকে মর্যাদা দেয়া হয়। একই সাথে এও জানি যে কিছু মানুষ আছে যারা কুখ্যাত খুনিদের রীতিমত পুজা করে-আর সেরকম কোন একজনে পরিণত হওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় কোন ব্যাপার না।

নোটবুকের মালিকের বিভৎস কৃতকর্ম আমাদের পুরোপুরি আয়ত্ত করে ফেলেছিল। এই খুনি সাধারণ জীবনের সীমা অতিক্রম করে কিছু মানুষকে শারীরিকভাবে ধ্বংস করে ফেলেছে। তাদের পরিচয়, তাদের সম্মান নষ্ট করে ফেলেছে। দুঃস্বপ্নের মাঝে আটকে পড়া অবস্থা হয়েছিল আমাদের, অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিলাম না।

সোবা শপ থেকে মঠে যেতে পাহাড় বেয়ে কিছুদূর উঠতে হলো আমাদের, তারপর বিশাল এক সিঁড়ি বেয়ে আরো উপরে যেতে হলো।

যে কোন ধরনের ব্যায়ামের প্রতি আমাদের দুজনেরই অন্যরকম এক ঘৃণা রয়েছে। নিচে নামা কিংবা উপরে ওঠা কোনটাই আমাদের পছন্দ ছিল না। যেকারনে মঠ পর্যন্ত পৌঁছতে গিয়ে আমরা হাঁপিয়ে গেলাম।

মঠের মূর্তিগুলোর নিচে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলাম। আশেপাশে খালি গাছ আর গাছ। গাছগুলোর ডালপালা আমাদের মাথার উপর ছড়িয়ে ছিল, পাতার ফাঁক দিয়ে গ্রীষ্মের সূর্য উঁকি দিচ্ছিল।

আমরা দু-জন পাশাপাশি বসে ছিলাম, চারপাশ থেকে পোকার ঝিঁঝি শব্দ কানে আসছিল।

মোরিনোর কপালে ঘাম জমে গেছে।

একসময় সে ঘাম মুছে উঠে দাঁড়াল, মিজুগুশি নানামির লাশ খুঁজতে লাগল।

“খুনি আর মিজুগুশি নানামি এদিক দিয়ে একসাথে হেঁটে গিয়েছিল,” পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ও বলল।

আমরা মঠ পেরিয়ে পিছনের বনে গিয়ে ঢুকলাম। কোনদিকে যেতে হবে, কতদুর যেতে হবে কিছুই আমাদের জানা ছিল না তাই আমরা এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলাম।

“হয়তো ওইদিকে হবে,” মোরিনো আমার দিক থেকে অন্যদিকে যেতে যেতে বলল।

কয়েক মিনিট পর শুনতে পেলাম ও আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি ওর গলা লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে দেখি ও একটা ক্লিফের গোরায় দাঁড়িয়ে। আমার দিকে পেছন ফিরে আছে। শরীর শক্ত হয়ে আছে, দু হাত পাশে ঝুলছে। আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ও যেদিকে তাকিয়ে ছিল সেদিকে তাকালাম : ঐ যে মিজুগুশি নানামি।

বন আর ক্লিফের মাঝখানে, একটা বড় গাছের ছায়ায়, গ্রীষ্মের হালকা আলোতে একটা নগ্ন মেয়ে বসে আছে। মিজুশি নানামি মাটিতে বসে ছিল, ওর পিঠ গাছের উপর হেলান দেয়া, হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ঘাড়ের উপরে কিছু নেই। পেট কেটে গর্ত করা হয়েছে। মাথাটা সেই গর্তে ঢুকানো।

চোখগুলো উপড়ে এনে দু-হাতের তালুর উপর রাখা। চোখের কোটরগুলো কাদা দিয়ে ভরাট করা হয়েছে, মুখ ভরাট করা হয়েছে পচা গলা পাতা দিয়ে। পেট থেকে বের করা নাড়ি ভুড়ি পেছনের গাছের সাথে রাখা। মাটিতে পড়ে থাকা রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটার কাপড় চোপড়গুলো ফেলে রাখা ছিল কাছেই।

আমরা হা করে সেখানে দাঁড়িয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমাদের দুজনের কারোরই কিছু বলার মত অবস্থা ছিল না, স্রেফ নিভাবে তাকিয়ে ছিলাম লাশটার দিকে।

***

পরেরদিন মোরিনো আমার সেল ফোনে মেসেজ পাঠালো : “নোটবুকটা ফেরত দাও।”

ওর মেসেজ সবসময়ই এরকম ঘোট আর সোজা ভাষার, কখনোই দরকারের অতিরিক্ত কোন কথা থাকে না। একইভাবে ওর ফোনের সাথে অন্য মেয়েদের মত আজাইরা কোন চাবির রিং কিংবা স্ট্রাপও লাগানো থাকে না।

নোটবুকটা আমি বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। মিজুগুশি নানামির ওখান থেকে ফেরার পর মোরিনোকে ফেরত দেয়া হয়নি।

ফেরার পথে ট্রেনে মোরিনো দূরে তাকিয়ে ছিল, তখনো শক কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

ফিরে আসার আগে ও মাটি থেকে মিজুশি নানামির জামা কাপড় আর জিনিসপত্র তুলে নিজের ব্যাগে ভরে নিয়ে আসে। জামা কাপড়গুলো কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু মেয়েটার হ্যাট আর ব্যাগ, ব্যাগের ভেতরের জিনিসপত্র ছুঁয়েও দেখা হয়নি।

ব্যাগের ভেতর ছিল মেয়েটার মেকআপ, ওয়ালেট আর রুমাল। ফেরার পথে ট্রেনে আমরা সব বের করে হাতিয়ে দেখেছি।

ওয়ালেটের ভেতরের স্টুডেন্ট আইডি দেখে আমরা জানতে পারলাম মিজুগুশি নানামি আমাদের পাশের বিভাগের একটা হাই স্কুলের ছাত্রি ছিল। ব্যাগের ভেতর একটা ছোট বুক ছিল ‘পুরিকুরা রাখার জন্য। পুরিকুরার ছবিগুলোতে আর আইডি কার্ড থেকে আমরা বুঝতে পারছিলাম জীবিতকালে মেয়েটা কতখানি প্রাণবন্ত ছিল।

মেসেজ পাওয়ার পর আমি দুপুর বেলায় স্টেশনের কাছের ম্যাকডনাল্ডে গিয়ে মোরিনোর সাথে দেখা করলাম।

মোরিনো ওর স্বভাবসুলভ কালো পোশাক পরেনি। প্রথমে ওকে চিনতেই পারিনি আমি। ও যে হ্যাটটা পরেছিল সেটা আমরা মিজুগুশি নানামির লাশের কাছে পেয়েছিলাম। সুতরাং আমি অনুমান করলাম ও হয়তো মৃত মেয়েটার মত জামাকাপড় পরে সাজগোজ করেছে।

ওর চুল আর মেকআপ পুরোপুরি মিজুগুশি নানামির পুরিকুরাতে পাওয়া ছবির মত। মেয়েটার জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল, তাই ও শপিঙে গিয়ে একইরকম দেখতে জামাকাপড় কিনেছে।

নোটবুক ফেরত দিতে গিয়ে মনে হলো ও মজায় আছে। ব্যাপারটা উপভোগ করছে।

“আমাদের কি মিজুগুশি নানামির পরিবারকে জানানো উচিত ওর লাশ বনের মধ্যে পড়ে আছে?” বললাম তাকে।

মোরিনো এক মুহূর্ত চিন্তা করে মাথা নাড়ল, “দরকার নেই, পুলিশ একসময় ঠিকই খুঁজে পাবে।” মৃত্যুর আগে মিজুগুশি নানামি যেরকম পোশাক পরা ছিল ঠিক একইভাবে মোরিনো সাজুগুজু করেছে।

মিজুগুশি নানামির পরিবার কি করছে এখন? ওর নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনার কি তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আছে? ওর কি কোন বয়ফ্রেন্ড ছিল? ওর গেড কি রকম ছিল?

মোরিনোকে একটু অন্যরকম লাগছে। ও যেভাবে কথা বলছে, বা নড়াচড়া করছে, সেসব ওর অন্য সময়ের ব্যবহারের চেয়ে ভিন্ন। ওর ব্যাংগস কোথায় রেখেছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিল। আমাদের উল্টোদিকের বুথে বসে থাকা কপোত-কপোতির দিকে ইশারা করল। এসব মোরিনো আগে কখনো করেনি।

টেবিলের উপর কনুই দিয়ে বসে আছে। হাসিখুশি দেখাচ্ছে ওকে। ওর পাশে মিজুগুশি নানামির ব্যাগটা রাখা। ব্যাগের সাথে একটা চাবির রিং লাগানো, যেটায় একটা অ্যানিমে ক্যারেক্টার ঝুলছে।

“তুমি আরও কিছুদিন এরকম সাজগোজ করে চলবে নাকি?”

“হ্যাঁ, তাই ভাবছি…মজার না ব্যাপারটা?”

মোরিনোর জন্য ব্যাপারটা অন্য একজন হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু ও যেভাবে হাসছিল কিংবা আয়নায় তাকিয়ে ভুরু পরীক্ষা করছিল, কোন হাই স্কুলে পড়া সাধারণ গোছের মেয়ে হুবহু ওরকম করে

-মনে হচ্ছিল মিজুগুশি নানামি কোনভাবে ওর ভেতর ঢুকে পড়েছে।

ম্যাকডোনাল্ড থেকে বের হওয়ার পর, মোরিনো এমনভাবে আমার হাত ধরল যেন ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। এমনকি আমি না বলা পর্যন্ত ও নিজেও তা টের পায়নি। মিজুগুশি নানামি এখন মৃত, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল আমার হাত ধরেছিল মিজুগুশি নানামিই, মোরিনো নয়।

স্টেশনের কাছে গিয়ে যার যার পথে আলাদা হয়ে গেলাম আমরা।

বাসায় ফিরে টিভি চালালাম। সিরিয়াল কিলিং নিয়ে খবর দেখাচ্ছে। প্রথম দু-জন শিকারের উপর। সেই একই তথ্য আবারো বলা হচ্ছে। আগেও হাজারবার বলা হয়েছে। নতুন কিছু নেই খবরে। মিজুগুশি নানামির কোন উল্লেখ নেই।

ভিক্টিমদের পরিবার আর আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবদের ছবি দেখানো হলো। তাদেরকে দুঃখি দুঃখি দেখাচ্ছে। স্ক্রিন ভরাট করার জন্য ভিক্টিমদের ছবি বড় করে দেখানো হচ্ছে।

মোরিনোর কথা ভেবে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল-এরকম অনুভূতি আমার আগে কখনো হয়নি। মাথা ঝাঁকি দিয়ে চিন্তাটা সরাতে চাইলাম।

ছবিতে দেখা যাচ্ছে ভিক্টিমদের দুজনেরই মিজুগুশি নানামির মতই চুল আর পোশাক। এর মানে হলো, মোরিনো নিজেও এখন খুনির ‘পছন্দের ধরন’-এর মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।

ম্যাকডোনাল্ডস এ দেখা করার তিনদিন পর এক বিকেলে আমার ফোন বেজে উঠল। টোন শুনে বুঝলাম কারো কাছ থেকে মেসেজ এসেছে…মোরিনোর থেকে।

“হেল্প।”

শুধু একটা শব্দ, আর কিছু নেই।

আমি তাড়াতাড়ি উত্তরে লিখলাম : “কি হয়েছে?”

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেও কোনো উত্তর এল না। এরপর আমি ওকে ফোন করলাম। কল ঢুকছিল না-হয় ফোনটা বন্ধ নয়তো নষ্ট।

সন্ধ্যায় মোরিনোর বাসায় ফোন করলাম। অনেক আগে একবার ও আমাকে ওর বাসার ফোন নাম্বার দিয়েছিল। এমন না যে সে ভেবেছিল আমি ওকে কখনো ফোন করব, বরং দেখাতে চেয়েছিল যে নাম্বারটা ডায়াল করতে গেলে বাটনের অক্ষরগুলো দিয়ে কাকতালীয়ভাবে একটা অর্থ দাঁড়ায়, যে কারনে নাম্বারটা মনে রাখা সহজ ছিল।

ওর মা ধরলেন। মহিলার গলার স্বর বেশ উঁচু আর অনেক দ্রুত কথা বলেন।

আমি তাকে জানালাম যে আমি ওর সাথে পড়ি, ক্লাসের কিছু ব্যাপারে মোরিনোর সাথে কথা বলা দরকার, সেজন্য ফোন করেছি।

কিন্তু মোরিনো বাসায় ছিল না।

ওকে আক্রমণ করা হয়েছে এই চিন্তা বাদ দিলাম। কিন্তু নোটবুকের লেখাগুলো যেহেতু, সত্যি, সুতরাং সেদিন খুনি সম্ভবত মোরিনোর সাথে একই ক্যাফেতে উপস্থিত ছিল। আর সম্ভাবনা আছে, সে মোরিনোকে মিজুশুশি নানামির মত সাজগোজে দেখেছে। যে মেয়েকে কিছুদিন আগেই খুন করেছে, প্রায় তার মত হুবহু আরেকজনকে ঘোরাফেরা করতে দেখে খুনি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছে সে। হয়তো তার প্রলোভন…কিন্তু মোরিনোকে আসলে লক্ষ্যবস্তু করার সম্ভাবনা খুবই কম। হাজার হোক এরকম সাজগোজ করা মেয়ের সংখ্যা কম নয়।

খুনি ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছে এই সন্দেহ করার সবচেয়ে বড় কারন হলো, সম্ভবত খুনি আর মোরিনোর বাসা কাছাকাছি। তারা একই কফি শপে ছিল। যদি না শুধু ঐদিনের জন্য খুনি দূরের কোন কফি শপে এসে থাকে, তাহলে মোরিনোর সাথে তার প্রতিদিন দেখা হওয়ার সম্ভাবনা বেশ ভালই।

সে রাত পুরোটা সময় ধরে আমি এসব চিন্তা করলাম! হয়তো মোরিনো এর মধ্যেই খুন হয়ে গিয়েছে। হয়তো কোনো পাহাড়ের চূড়ার ওর টুকরো টুকরো করা শরীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।

এসব কল্পনা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম আমি।

***

পরদিন আবার ওর বাসায় ফোন করলাম।

মোরিনো তখনও বাসায় ফেরেনি। ওর মায়ের বক্তব্য অনুসারে, এই প্রথম সে সারা রাত বাইরে ছিল, তাও আবার বাসায় না জানিয়ে। মহিলা দুশ্চিন্তা করছিলেন।

“তা বাবা, তুমি কি ওর বয়ফ্রেন্ড?” মোরিনোর মা জিজ্ঞেস করলেন।

“জি না একদমই না,”

“ঠিক আছে, লজ্জার কিছু নেই, আমি সবই জানি।”

মোরিনোর মায়ের মনে কোন সন্দেহ নেই যে তার মেয়ের একজন বয়ফ্রেন্ড জুটেছে। মোরিনোর কখনোই কোন বন্ধু বান্ধব ছিল না। আর এলিমেন্টারি স্কুলের পর এই প্রথম কেউ ফোন করে ওর খোঁজ নিচ্ছে।

“ইদানিং ও উজ্জ্বল রঙের সব জামাকাপড় পরছে, তখনই বুঝলাম নিশ্চয়ই ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড হয়েছে।”

ফোনের বিল কত আসবে তা নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা হতে লাগল।

“আচ্ছা একটু দেখবেন ওর রুমে কোন ছোট বাদামি রঙের নোটবুক আছে কিনা?”

মহিলা ফোন রেখে গিয়ে দেখে আসলেন। একটু বিরতির পর আবার তার গলা শোনা গেল। “ওর ডেস্কের উপর ওরকম কিছু একটা আছে, ওটার কথাই তুমি বলছ কিনা বুঝছি না…।”

এর মানে হল নোটবুকটা মোরিনোর সাথে ছিল না। সাথে থাকলে আর খুনি যদি ওকে সেটা পড়া অবস্থায় দেখত তাহলে অবশ্যই মুখ বন্ধ করার জন্য আক্রমণ করত।

আমি মোরিনোর মাকে জানালাম, নোটবুকটা নিতে আসছি। মহিলার থেকে বাসার ঠিকানা নিলাম।

ফোন রেখেই সাথে সাথে বের হলাম। ওর বাসা স্টেশন থেকে খুব একটা দূরে না, কিন্তু আগে কখনো যাই নি।

স্টেশনের পেছনের একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের চারতলায় থাকত ও।

সেখানে গিয়ে বেল বাজালাম। মোরিনোর মা-ই দরজা খুললেন, কোনো সন্দেহ নেই, কারন গলার স্বর ফোনের মত একইরকম।

“আস আস, ভেতরে আস।”

ভদ্রমহিলা এপ্রন পরেছিলেন। তাকে দেখতে ঠিক সাধারণ গৃহিণীদের মতই লাগছিল। মোরিনোর থেকে একদম আলাদা। এরকম একজন মহিলার গর্ভে কী করে মোরিনোর মত সন্তান জন্মাল ভেবে আমি অবাক হলাম।

ভেতরে গেলাম না। নোটবুক নিয়েই বিদেয় হওয়ার ইচ্ছা আমার। উনি নোটবুকটা এনে আমার হাতে দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম ভেতরের লেখা পড়েছেন কিনা।

তিনি মাথা নাড়লেন। “এত ছোট হাতের লেখা পড়ার ধৈর্য আমার নেই।”

নোটবুকের চেয়ে তার আগ্রহ বেশি আমাকে নিয়েই।

“দ্বিতীয় বর্ষ শুরু হওয়ার পর মোরিনো হঠাৎ নিয়মিত ক্লাসে যেতে লাগল। এখন আমি বুঝতে পারছি কারণটা কি!”

আগের বছর নাকি মোরিনো বলত স্কুল খুবই বোরিং। আর প্রায়ই স্কুলে অনুপস্থিত থাকত। আমার এ তথ্য জানা ছিল না। ওর চিন্তাধারা সাধারণ মানুষের মত, ওর আগ্রহ অনাগ্রহও অস্বাভাবিক। আর ও কারো সাথে মিশতেও পারত না। বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হতো। খুবই স্বাভাবিক যে ও স্কুলে যেতে পছন্দ করত না।

আমি ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম শেষ কখন মোরিনোকে দেখেছেন। “গতকাল দুপুরে…যতদূর মনে পড়ে। বাসা থেকে বের হচ্ছিল তখন।”

“যাওয়ার আগে কিছু বলেছিল?”

মোরিনোর মা মাথা নাড়লেন। “তুমি কি ওকে খুঁজে দেখবে?” যখন চলে আসছিলাম তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, “যদি সে এখনো বেঁচে থাকে।”

ওর মা ভাবলেন আমি মজা করছি, হেসে ফেললেন তিনি।

***

স্টেশনের দিকে ফিরতে ফিরতে নোটবুকটা খুলে পাহাড়ের তালিকাটা বের করলাম। যেই তালিকাটা খুনি তৈরি করেছিল লাশ রাখার জন্য। এটা স্পষ্ট যেসব পাহাড়ের পাশে  ⃣  চিহ্ন দেয়া সেগুলো তার সবচেয়ে পছন্দ ছিল। মাত্র চারটার পাশে এই চিহ্ন ছিল। এখন পর্যন্ত এই চারটার তিনটাতেই লাশগুলো পাওয়া গিয়েছে।

তার মানে সে সম্ভবত মোরিনোকে চতুর্থটায় নিয়ে গিয়েছে–ন** মাউন্টেনে।

স্টেশনের টিকেট কাউন্টারে জানতে চাইলাম কোন ট্রেন ধরে সেখানে যাওয়া যাবে। তারপর টিকেট কেটে ট্রেনে উঠে পড়লাম।

ন** মাউন্টেনের কাছে স্টেশনে নেমে আবার বাস নিতে হলো। চারদিকে আঙুরের ক্ষেত। বাস থেকে ক্ষেতে লাগানো আঙ্গুরের বিজ্ঞাপন দেখতে পেলাম।

খুনি এখানে এলে অবশ্যই গাড়ি দিয়ে এসেছে। লাশ সে কোথায় ফেলতে পারে? নিশ্চয়ই পাহাড়ের গভীরে দুর্গম কোথাও হবে, যেখানে মোরিনোর চিৎকার কেউ শুনতে পারবে না। জায়গাটা কোথায় হতে পারে সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই নেই।

বাসে আমি আর ড্রাইভার ছাড়া কেউ ছিল না। বাসের ভেতর এলাকার একটা ম্যাপ লাগানো ছিল। ওটা দেখে আর ড্রাইভারের সাথে কথা বলে বের করার চেষ্টা করলাম খুনি কোথায় গিয়ে থাকতে পারে। সে জানাল আমি যেদিক থেকে এসেছি সেদিক থেকে যারা ন**মাউন্টেনে ঘুরতে আসে তারা সবসময়ই এই বড় রাস্তা দিয়েই আসে।

পাহাড়ের চূড়ায় যাওয়ার রাস্তার সামনে এসে আমি বাস থেকে নামলাম। রাস্তাটা যথেষ্ট প্রশস্ত। খুনি যদি গাড়ি নিয়ে এসে থাকে তাহলে অবশ্যই এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছে।

রাস্তা ধরে হেঁটে উঠতে লাগলাম। পাকা রাস্তা হলেও কোন ট্রাফিক ছিল না সেখানে।

বনের কাছে গিয়ে রাস্তা থেকে বিভিন্ন দিকে সরু সরু রাস্তা চলে গিয়েছে। খুনি এর যে কোনটা দিয়ে গিয়ে থাকতে পারে। যতদূর যাচ্ছি রাস্তা তত সরু হয়ে আসছে। উপর থেকে বনের মাঝে ছোট ছোট গ্রাম চোখে পড়ছিল। ছোট ছোট বাড়ি ঘর।

চূড়ার কাছাকাছি যেতেই একটা ছোট পার্কিং লট চোখে পড়ল। সাথে ছোট একটা বিল্ডিং, দেখে মনে হল অবজারভেটরি হবে। এর পর আর গাড়ি যেতে পারবে না। বেশি হাঁটা লাগেনি তাই সেদিনের মত কাহিল হইনি।

মোরিনোর মৃতদেহ খুঁজছিলাম।

গাছপালার ভেতর দিয়ে পথ চলে গেছে। আশেপাশের যে শাখা পথ ছিল সেগুলো দিয়ে হেঁটেও খুঁজলাম।

আকাশ মেঘলা ছিল বলে বনের মধ্যেও বেশ অন্ধকার। গাছের ডাল পালার ভেতর দিয়ে যতটুকু সম্ভব দূরে দেখার চেষ্টা করলাম। কোনো বাতাস নেই। চারপাশে খালি পোকামাকড়ের গুঞ্জন।

ন**মাউন্টেন বিশাল জায়গা। সেখানে একটা লাশের টুকরা টাকরা খুঁজে পাওয়া সহজ কাজ ছিল না। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে ব্যর্থ হলাম। হেঁটে আবার যখন বাস স্টপে ফেরত আসলাম তখন পুরো কাহিল, জামাকাপড় ঘামে ভিজে গিয়েছে।

রাস্তার সাথে অল্প কিছু বাড়িঘর ছিল। উপরে যাওয়ার রাস্তার পাশের এক বাগানের বুড়োকে জিজ্ঞেস করলাম আগেরদিন কোন গাড়ি যেতে দেখেছে কিনা। সে মাথা নাড়ল। তার বাসার লোকজনকে ডেকে একই প্রশ্ন করল। কিন্তু কেউ কোন গাড়ি দেখেনি।

তাহলে মোরিনো ঐ মেসেজটা কেন পাঠাল? খুনি কি ওকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল? ও তো বোকা মেয়ে না, অন্যদের মত এত সহজে ওকে ফাঁদে ফেলা সম্ভব নয়।

নাকি আমি একটু বেশিই কল্পনা করছি? হয়তো তাকে কেউ বন্দি করেনি?

বাস স্টপে বসে আবার নোটবুকটা খুলে পড়তে লাগলাম। খুনের বিবরণ থেকে খুনি সম্পর্কে জানার জন্য যে দক্ষতা আর ট্রেইনিং দরকার সেটা আমার নেই।

কপাল থেকে ঘাম বেয়ে নোটবুকের উপর পড়ে কালি মাখিয়ে গেল। লেখা পড়া যাচ্ছিল না। পানিতে নষ্ট হয় এমন কালি ব্যবহার করেছিল খুনি।

কোথায় বসে খুনি এই লেখাগুলো লিখত? খুন করে ফিরে বাসায় বসে? আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে সে খুনের সময় ওখানে বসে কিছু লিখত কিনা। নিশ্চয়ই সে তার স্মৃতি থেকে লিখত, কল্পনার রং মেখে।

বাস এলে উঠে দাঁড়ালাম। হাত ঘড়িতে তিনটার বেশি বাজে। পাহাড় ছেড়ে আবার শহরে ফিরে যাচ্ছি আমি।

মোরিনো সবসময় যে কফি শপটায় যায় সেটা ছিল স্টেশনের কাছে একটা আরকেডের মাঝামাঝি। আমাকে জায়গাটার কথা জানিয়েছিল আগে, কিন্তু কখনো যাওয়া হয়নি।

ও যেরকম বলেছিল, জায়গাটায় আলো খুব কম। আঁধারে বরং আমি সস্তি বোধ করছিলাম। হালকা মিউজিক বাজছিল, কেউ খেয়াল করছি মনে হচ্ছিল না।

আমি কাউন্টারে গিয়ে বসলাম।

শপের পেছন দিকে বাথরুমের সাইন দেখা যাচ্ছে। বাথরুমের সামনে ফ্লোরের দিকে তাকালাম, যেখানে মোরিনো নোটবুকটা পেয়েছে।

কফি শপে আমি ছাড়া মাত্র একজন কাস্টমার ছিল। স্যুট পরা একজন তরুণী। জানালার পাশে বসে কফি খেতে খেতে ম্যাগাজিন পড়ছিল।

দোকানের মালিক আমার অর্ডার নিতে এলে জানতে চাইলাম ঐ তরুণী এখানে প্রায়ই আসে কিনা।

সে মাথা ঝাঁকাল। মুখ শুকনো। বুঝতে পারছে না এই প্রশ্নের মানে কি।

“জরুরি কিছু না, এমনি। আপনার সাথে হ্যান্ড সেইক করলে কোন সমস্যা আছে?”

“হ্যান্ড সেইক..? কেন?”

“উপলক্ষটি চিহ্নিত করে রাখার জন্য।”

দোকানের মালিকের চেহারা নিরীহ ভদ্র গোছের। বয়স আছে, কিন্তু আবার মধ্যবয়স্ক বলার মত বয়সও না। মলিন ত্বক। কালো টিশার্ট পরা, যে কোন দোকানে যেমন পাওয়া যায়। চুলগুলো যত্ন করে আঁচড়ানো।

প্রথমে সে আমাকে একজন অদ্ভুত কাস্টমার ভেবেছিল। কারন সম্ভবত আমি সোজা তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম দেখে।

সে গিয়ে তাড়াতাড়ি আমার জন্য কফি নিয়ে এল।

“আমার একজন বান্ধবি আছে, নাম মোরিনো। আপনি কি ওকে চেনেন?”

“হ্যাঁ নিয়মিত আসে এখানে।”

আমি জানতে চাইলাম ও এখনো বেঁচে আছে কিনা।

লোকটা আমার কথা শুনেস্থির হয়ে গেল।

আস্তে করে কাপটা নামিয়ে রেখে আমার দিকে ভালো করে তাকাল। ওর চোখ ঘোলাটে দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আলোর ভেতর থেকে দুটো ব্ল্যাকহোল তাকিয়ে আছে।

আমার মনে হয়েছিল ঐদিন থাকা অন্য কাস্টমারদের চেয়ে এই লোকের খুনি হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি-এখন জানলাম আমার অনুমান সঠিক।

“কি বলতে চাও?” সে বোকা সাজার ভান করল।

আমি নোটবুকটা বের করলাম। সেটা দেখে হালকা ধূর্ত হাসি ফুটে উঠল তার মুখে।

“সেদিন মোরিনো এটা খুঁজে পেয়েছিল।”

নোটবুকটা নিয়ে খুলে দেখল সে।

“আমি আশ্চর্য হয়েছি, তুমি ধরতে পেরেছে জিনিসটা আমার।”

“অন্তত এর অর্ধেক আসলে স্রেফ জুয়া ছিল। আমি তাকে বললাম কিভাবে ন**মাউন্টেনে গিয়ে মোরিনোর লাশ খুঁজেছি, তারপর কী চিন্তা করে এখানে এসেছি।

***

নোটবুকটা হারানোর পর খুনি কি চিন্তা করছিল? আমি সেটা কল্পনা করার। চেষ্টা করছিলাম।

সে কেন এই নোটবুকটা লিখেছে? মনে রাখার জন্য? কোন রকম রেকর্ড রাখার জন্য আমি নিশ্চিত ছিলাম, সে এটা বার বার পড়েছে, আর ওর কাছে নোটবুকটার যথেষ্ট মূল্য ছিল। সুতরাং নোটবুকটা যে হারিয়ে গিয়েছে তা সে অবশ্যই খেয়াল করেছে।

নোটবুকটা সে কোথায় রেখেছিল হয় পকেটে না হয় কোন ব্যাগে। যেহেতু মেঝেতে পড়ে ছিল, সুতরাং পকেট থেকেই পড়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। হয়তো বাথরুমে হাত ধুতে গিয়েছিল সে, রুমাল বের করার সময় পকেট থেকে নোটবুকটা পড়ে যায়।

তারপর কখন সে টের পেল, নোটবুকটা তার পকেটে নেই? দশ মিনিট পর? কয়েক ঘন্টা পর? আমি নিশ্চিত ছিলাম, ঐদিন শেষ হওয়ার আগেই সে হারানোর ব্যাপারটা টের পেয়েছিল।

সে নিশ্চয়ই মনে করার চেষ্টা করেছে শেষ কখন নোটবুকটা দেখেছে। তারপর যেখানে পড়তে পারে সেখানে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করেছে।

আমি বাজি ধরতে রাজি আছি, সেরকম জায়গা আসলে কমই ছিল। কারন সে কিছুক্ষণ পর পরই নোটবুকটা খুলে পড়ত। সুতরাং শেষ যেখানে পড়েছে তার থেকে কাছাকাছি কোথাওই হারানোর কথা।

তারপর নিশ্চয়ই খুনি সেখানে খোঁজাখুঁজি করেছে, কিন্তু পায়নি। বুঝতে পেরেছে একজন নোটবুকটা পেয়ে নিয়ে গিয়েছে। এবং সে যদি পড়ে ফেলে তাহলেই শেষ! পুলিশ তৃতীয় ভিক্টিমের লাশ পেয়ে যাবে। লাশ পাওয়া সমস্যা না। সমস্যা হল যদি তারা নোটবুকে খুনির হাতের ছাপ পেয়ে যায়। কিংবা হাতের লেখা মিলিয়ে ধরে ফেলে।

আমার ক্ষেত্রে যদি এমন হত তাহলে আমি কি করতাম? অবশ্যই চতুর্থ আরেকজনকে খুন করতে যেতাম না। পুলিশ কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে। হাজার হোক নোটবুকটা পাওয়া গিয়েছে এমন জায়গায় যেখানে খুনির আসা যাওয়া রয়েছে। পুলিশ ধরে নেবে খুনি আশেপাশেই আছে। এমন অবস্থায় কোন রিস্ক নেয়া চলে না।

কিন্তু কয়েকদিন পার হয়ে গেল। মিজুগুশি নানামির লাশ উদ্ধার হল না। কারন আমি বা মোরিনো কেউই নোটবুকটা পেলেও পুলিশের হাতে দিইনি।

খুনি প্রতি রাতে খবর দেখেছে, লাশ উদ্ধার হয়েছে কিনা জানতে চেয়ে। নিরাপদ বোধ না করা পর্যন্ত সে আবার খুন করতে চায় না…কিন্তু এদিকে আবার মোরিনো উধাও।

মোরিনো লুকিয়ে থেকে মজা করছে এরকম চিন্তা বাদ দিয়ে আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম খুনি কি করছে। আমি যদি খুনি হতাম আমি চতুর্থ একজন ভিক্টিম কেন বেছে নিতাম?

* আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না

* আমি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসি। পুলিশ আমাকে ধরতে পারবে না, ওদের মাথায় এত ঘিলু নেই।

* ধরা পড়লেও আমার কিছু আসে যায় না

* কেউ নোটবুকটা পায়নি, পেলেও কেউ নোটবুকটা পড়েনি

* পড়লেও বিশ্বাস করেনি

কিংবা আরেকটা হতে পারে যে নোটবুক যে হারিয়েছে তা সে টের পায়নি। এই হলো সব সম্ভাবনা…কিন্তু আমি আরেকটা থিওরির পক্ষে বাজি ধরলাম। আমার মনে হচ্ছিল খুনি ভেবেছে :

* কেউ নোটবুকটা পেয়েছে কিন্তু পড়তে পারেনি, যে কারনে পুলিশের হাতে দেয়নি ওটা। আর সে কারনেই মিজুশি নানামির লাশ এখনো উদ্ধার হয়নি।

কফি শপের মালিক আগ্রহের সাথে আমার এসব কথা শুনলেন।

“তাহলে কি থেকে তোমার মনে হলো, আমিই খুনি?”

নোটবুকটা তার থেকে নিয়ে খুললাম আমি। যেখানে আমার ঘাম লেগে লেখা নষ্ট হয়ে গিয়েছে সে অংশটা দেখালাম। আপনি জানতেন আপনি কি কালি ব্যবহার করছেন। আপনি জানতেন, পানি লেগে ভিজে গেলে কেউ আর এর লেখা পড়তে পারবে না। আমি ধরে নিয়েছি খুনি ভেবেছে সে বাইরে কোথাও নোটবুকটা ফেলেছে, দোকানের ভেতর না। মোরিনো আমাকে বলেছিল সেদিন অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। আমার মনে হয়েছে খুনি জানত, সে বৃষ্টির সময়ে জিনিসটা হারিয়েছে।”

খুনি ভেবেছে নোটবুকটা যদি দোকানের মধ্যে পাওয়া যেত তাহলে সেটা পুলিশের হাতে পৌঁছত। কিন্তু মিজুগুশি নানামির লাশ পাওয়ার কোন খবর নেই। তার মানে খুনি ধরে নিয়েছে সে অবশ্যই বৃষ্টির মধ্যে বাইরে হারিয়েছে জিনিসটা। আমি ভাবলাম। সেক্ষেত্রে নোটবুকটা ভিজে যাবে, পড়ার অবস্থায় থাকবে না।

মোরিনো বলেছিল সেদিন বৃষ্টির মধ্যে একমাত্র যে বাইরে গিয়েছিল সে হল কফি শপের মালিক।

এত কিছু হিসাব করে আমি জুয়া খেলেছিলাম, সে-ই খুনি। আমি থামলে লোকটা বাঁকা হাসি দিল।

“আমি আসলেই ভেবেছিলাম বৃষ্টির মধ্যে বাইরে কোথাও ফেলেছি নোটবুকটা,” সে স্বীকার করল। “মোরিনো উপরের তলায় আছে।”

দোকানের দোতলা আর তিন তলায় তার বাসা।

নোটবুকটা যত্ন করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর হেঁটে দরজা খুলল লোকটা।

ততক্ষণে মেঘ কেটে গিয়েছে, সূর্য মামা দ্বিগুণ প্রতাপে ফিরে এসেছে। অন্ধকার দোকান থেকে বেরিয়ে সাদা আলোয় আমার চোখ মনে হচ্ছিল ঝলসে যাচ্ছিল। লোকটা দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে বাইরের আলোর মধ্যে হারিয়ে গেল।

নিয়মিত কাস্টমার তরুণীটি উঠে রেজিস্টারের কাছে এল বিল দিতে। আশেপাশে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল দোকান মালিক কোথায় গেছে। আমি আলতো করে মাথা নাড়ালাম। জানি না।

***

দোতালায় যাওয়ার সিঁড়ি বাইরের দিকে। দোকান থেকে বের হয়ে সেদিকে যেতে হবে।

তিন তলায় হাত পা বাধা অবস্থায় মেঝেতে পড়েছিল মোরিনো। তখনো ওর পরনে মিজুগুশি নানামির মত পোশাক। দেখে মনে হল না আহত।

আমাকে দেখে মোরিনো চোখ সরু করে তাকাল। এটা ওর হাসার ভঙ্গি। মুখে একটা ভোয়ালে ঢোকানো ছিল যে কারনে কিছু বলতে পারল না।

আমি তোয়ালেটা সরালে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

“কফি শপের মালিক ভান করেছিল যে ব্যথা পেয়েছে। আমাকে বলল কিছু জিনিস বহন করে দিতে পারব কিনা। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই..”

হাত-পায়ের দড়ি খোলা সহজ ছিল না। আমি ওকে ওখানেই ফেলে রেখে রুমের ভেতর চেক করলাম। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে লোকটা একাই বাস করে সেখানে।

ডেস্কের উপর একটা সাদা কাগজ রাখা ছিল। ছোট ছোট ক্রস চিহ্ন আঁকা।

শেষে এক সেট ছুরি পেলাম। সেগুলো কি কাজে ব্যবহৃত হত তা কল্পনা করার প্রয়োজন নেই, নোটবুকেই বিস্তারিত লেখা ছিল।

মোরিনো রাগি সুরে আমাকে ধমক দিল কেন ওর বাঁধন কেটে দিচ্ছি না।

আমি ছুরিগুলো থেকে একটা বেছে নিয়ে ওর দড়ি কাটলাম।

“আমাদের পালানো উচিত-ও টের পেয়ে যাবে।”

“না, পাবে না।”

সে আর ফিরে আসবে না এখানে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। হ্যাঁ, ছোট্ট একটা সম্ভাবনা আছে, সে ফিরে এসে আমাদের দুজনকে খুন করে ফেলতে পারে। কিন্তু কোনো বিচিত্র কারনে আমার মনে হচ্ছিল সে আর আসবে না।

কফি শপের কাউন্টারে বসে যখন আমরা কথা বলছিলাম তখন আমার মনে হয়েছে আমাদের দুজনের মধ্যে কোথাও যেন একটা মিল আছে। চুপচাপ দোকান থেকে বের হয়ে গিয়েছিল সে, কারন বুঝতে পেরেছিল আমি কাউকে কিছু বলব না।

খুনি ফিরে আসবে না এ কথা আমার মুখে শুনে মোরিনো একটু অবাক হয়েছিল। সে উঠে দাঁড়িয়ে পোশাক ঠিক করতে লাগল।

“আমি কোনরকমে তোমাকে একটা মেসেজ পাঠাতে পেরেছিলাম, কিন্তু সে বুঝে ফেলেছিল।”

ডেস্কের উপর ওর ফোনটা বন্ধ অবস্থায় রাখা ছিল। মিজুগুশি নানামির ব্যাগটাও সেখানে রাখা। হাজার হোক মোরিনো তো সেটা নিয়েই ঘুরছিল। খুনি কি টের পেয়েছিল যে চতুর্থ শিকারের ব্যাগ আর তৃতীয় শিকারের ব্যাগ একই ছিল? নাকি সে ওকে লক্ষ্যই করেছিল একইরকম ব্যাগের কারনে?

একটা পুরো দিন হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকায় সিঁড়ির দিকে যেতে মোরিনোর বেশ কষ্ট হলো।

রুম ছেড়ে যাওয়ার আগে আমি স্মৃতি স্মারক হিসেবে ডেস্কের সাদা কাগজ আর ছুরির সেটটা সাথে নিয়ে গেলাম। পুলিশ যখন সব জানতে পারবে আর এখানে এসে রুম সার্চ করবে, তখন ছুরিগুলো না পাওয়া গেলে একটু সমস্যা হতে পারে। কিন্তু তাতে আমার কি?

নিচে নেমে কফি শপের ভেতরে তাকালাম আমি। হালকা মিউজিক চলছিল তখনো। কেউ ছিল না। দরজার সাইনটা ঘুরিয়ে ‘ক্লোজড করে দিলাম।

মোরিনো আমার পেছনে দাঁড়িয়ে তার হাত মালিশ করছিল। দড়ির দাগ ওর হাতে স্পষ্ট বসে গিয়েছে।

“জঘন্য অভিজ্ঞতা ছিল,” সে বলল। “এখানে আমি আর কখনো আসছি না।”

“লোকটা কিন্তু অতটা খারাপ ছিল না, ওর সাথে তোমার পরিচয় হলে ভালো হতো।”

মোরিনোর মুখ শুকিয়ে গেল। “কার সাথে পরিচয় হলে ভালো হত? ঐ ব্যাটা আমার সাথে এমন করলই বা কেন?”

সে তখনো বুঝতে পারেনি, দোকানের মালিকই সেই সিরিয়াল কিলার।

আমি মুখ নামিয়ে আমার হাতে ধরা ছোট ছোট ক্রস আঁকা সাদা কাগজটার দিকে তাকালাম।

২. কাটা হাত

কাটা হাত

প্রস্তাবনা

স্কুলের পর বাসায় যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলাম। তখন খেয়াল হলো কেউ একজন আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুরে দেখি, মোরিনো। পুরো ক্লাসরুম খালি।

“তুমি বাসায় যাওয়ার আগে কিছু কথা বলতে চাইছিলাম,” বলল সে। সারাদিন আমরা কোন কথা বলিনি। সুতরাং বলা যায় প্রায় চব্বিশ ঘন্টা পর ওর গলার আওয়াজ শুনলাম। “গতকালকে আমি একটা অদ্ভুত মুভি ভাড়া করে এনেছি..”

মুভিটা নিয়ে কারো সাথে আলাপ করার জন্য ও মারা যাচ্ছিল। আর পুরো ক্লাসে একমাত্র আমিই আছি যার সাথে ও কথা বলে এবং সে আমার সাথে শুধু তখনই কথা বলে যখন আমি একা থাকি, অন্যদের সাথে কথা বলি না যখন। যেজন্যে বাসায় যাওয়ার আগে ছাড়া আমার সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিল না।

রুমের বাইরে দাঁড়ানো কিছু মেয়ে আমাদেরকে খেয়াল করে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিল। ওদের দেখে আমি বুঝতে পারলাম, ওরা আমাদের নিয়ে কথা বলছে। প্রথম প্রথম, সবাই চিন্তা করত আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা কিনা। কিন্তু আমাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে আমাদেরকে অন্তরঙ্গ মনে হয় না। আমাদের সব কথাবার্তার সময় মুখের অভিব্যক্তিও থাকে ঠাণ্ডা। সুতরাং আমাদের সম্পর্কটা কি ধরনের তা আমাদের ক্লাসমেটদের কাছে একটা বিশাল রহস্যজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তাদের মূল আগ্রহ হলো, আর যাই হোক মোরিনো যে কারো সাথে কথা বলছে এইটাই বিশাল কিছু। ক্লাসের মধ্যে সে রীতিমত লুকিয়ে থাকে। স্কুল ছুটি, তো উধাও। ওর জীবন যাপন সাবমেরিনের মত, সারাক্ষণ সাগরের তলায় পড়ে থাকে।

গ্রীষ্মকালীন ইউনিফর্ম বাদ দিলে, ও সবসময়ই কালো পরে থাকে। চুল থেকে জুতা পর্যন্ত সবকিছু কালো। মনে হয় যেন ও সর্বশক্তিতে চেষ্টা করে যাচ্ছে অন্ধকারের সাথে মিশে যেতে। আলো ওর কাছে যেন ঘৃণিত কোন বস্তু, সবসময় একশ হাত দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়।

আমি একবার মোরিনোর শিববা দোকি (আবেদন পত্র) দেখতে চেয়েছিলাম, জানতে, কেন যে ও এই স্কুলে ভর্তি হতে এল।

“এখানের ইউনিফর্ম একদম সাধারণ আর কালো রঙের, শুধু সে কারনে…তুমি যখন প্রথমে ‘শিবো দোকি’ বললে আমি অন্য অর্থ ভেবেছিলাম…”

ও ব্ল্যাক বোর্ডে গিয়ে চক দিয়ে কানজিতে লিখল “মরণ ইচ্ছা।” সে যখন হাত তুলে লিখছিল ইউনিফর্মের লম্বা হাতা নেমে গিয়ে ওর হাত বেরিয়ে এসেছিল। ওর ত্বক একদম ফ্যাকাসে সাদা। দেখে মনে হয় যেন কোনদিন সূর্যের আলোর সংস্পর্শে আসেনি।

মোরিনোর চেহারা সুন্দর ছিল। ছেলেরা আগে মাঝে মধ্যে ওর সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করত। অন্তত একটা ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত…এক শিক্ষক ওর সাথে এমন কিছু করার চেষ্টা করেছিল যেটা কিনা যৌন হয়রানির পর্যায়ে পড়ে। মোরিনো প্রথমে তার মুখে মরিচ পানি স্প্রে করে, তারপর ধীরে সুস্থে একটা ডেস্ক চেয়ার দিয়ে তাকে পিটিয়ে আধমরা করে ফ্লোরের উপর ফেলে রাখে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পুরো ঘটনাটা দেখেছিলাম। এই ঘটনার পর ছেলেরা আর ভয়ে ওর সাথে কথা বলতে আসে না।

যে ঘটনাটার কথা আমি এখানে বলব সেটা আমাদের সম্পর্ক কিভাবে হল তা নিয়ে নয়। বরং অন্য একটা ব্যাপার, ওর ফ্যাকাসে হাতের দিকে তাকালে যে ঘটনার কথা আমার বার বার মনে পড়ে।

ঐ বছর বসন্তে, সব টিভিতে একটা ইন্টারেস্টিং কেস দেখাচ্ছিল। কেসটা কাটা হাত নিয়ে। যে কেসের সাথে আমিও জড়িয়ে পড়েছিলাম…গোপনে।

সময়টা ছিল মে মাসের শেষের দিক। এর আগে মারিনোর সাথে আমার কখনো কথা হয়নি…

নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে সিনোহারা চিন্তা করছিল-হাত, স্তন্যপায়ী জীবের অগ্রপদের শেষ অংশ। হাতের বিকাশ হয়েছে এমনভাবে যাতে পাঁচ আঙুল দিয়ে কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে, যেমন কফি কাপ। কিংবা কিবোর্ডে টাইপ করতে পারে। ওর বিশ্বাস, মানুষের মনুষ্যত্বের পেছনে মূল অবদান এই হাতের। এজন্যই জ্যোতিষীরা হাতের রেখা পড়ার চেষ্টা করে। রেখাগুলো নাকি প্রত্যেকটা মানুষের ব্যক্তিত্ব আর ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। হাত হলো অনেকটা আয়নার মত, যা দিয়ে একজন মানুষের অতীত আর ভবিষ্যৎ দেখা যায়।

ছোটবেলা থেকেই সিনোহারী হাত পছন্দ করে। হাতের প্রতি ওর আকর্ষণ এতটাই বেশি ছিল যে ওর বাবা-মা যখন ওকে বাইরে নিয়ে যেতেন, তখন ও লোকজনের মুখের দিকে তাকাত না, তাকাত তাদের হাতের দিকে। হাত যেভাবে নড়াচড়া করে তা ওকে মুগ্ধ করে। হাতের পেশি, পাঁচটা আঙুল, আঙুলের মাথার নখ, নখের মাথার নতুন চাঁদের মত সাদা অংশ-সবকিছু। আর আঙুলের ছাপ তো আছেই, যা কিনা প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রে অনন্য।

এলিমেন্টারি স্কুলের ছোট ক্লাসে থাকতে সিনোহারা ওর বোনের ফেলে দেয়া পুতুলগুলোর হাত কাটতো। খেয়াল রাখত যেন কেউ আবার দেখে না ফেলে। পুতুলের ছোট ছোট হাতগুলোর নিজের হাতের তালুতে রেখে দেখত। পুতুল ফেলে দিয়ে শুধু হাতগুলো পকেটে নিয়ে ঘুরত। যখনই সুযোগ পেত ছোট ছোট হাতগুলো স্পর্শ করত পকেটে হাত দিয়ে। প্লাস্টিকের ছোট ছোট হাতগুলো ওকে যেসব গল্প বলত তা ওর মা আর শিক্ষকদের কথার চেয়ে অনেক বেশি ছিল।

এরপর ও বিড়াল আর কুকুরের সামনের পায়ের থাবা কাটা শুরু করে। গাছ ছাঁটার বড় কাঁচিগুলো থাবা কাটার জন্য চমৎকার যন্ত্র। কুকুর বিড়ালের থাবাগুলোও সিনোহারার কাছে দারুন লাগত। মানুষের হাতের তালুতে তুলতুলে প্যাড নেই, তাই ওগুলো ওর কাছে মজার মনে হতো। প্যাডে চাপ দিলে নখ বেরিয়ে আসে, ওগুলোর মধ্যে চুল জন্মায়। থাবা মানুষের হাতের মত কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে পারে না, ওগুলোর বিকাশ হয়েছে অন্যভাবে, অন্য কারনে।

সিনোহারা ভালো করেই জানত, বেশিরভাগ মানুষ ওর এই বিশ্বাস মানতে পারবে না যে, মানুষের হাতেই তাদের মনুষ্যত্বের সৃষ্টি। ওর আশেপাশের লোকজনকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পেরেছে ও, মানুষ স্রেফ তাদের মাথা আর মুখ থেকে বের হওয়া ফালতু কথা দিয়ে চলে। আস্তে আস্তে ও যখন বড় হলো, চাকরি করা শুরু করল, নিজের চিন্তা ভাবনা নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখতে শিখল। কিন্তু মাঝে মাঝে ও নিজেকে কেবল হাত নিয়ে চিন্তা করতে দেখতে পেত…পাঁচ আঙুলের ডিজাইন, যা কিনা কেবল ঈশ্বরের পক্ষেই তৈরি করা সম্ভব। এই চিন্তা ওর মাথা থেকে কিছুতেই বের হতে চাইত না।

তারপর এক বসন্তে ও প্রথমবারের মত একটা মানুষের হাত কাটল-একটা বাচ্চার হাত। বাচ্চাটা একটা স্ট্রলারে ঘুমাচ্ছিল। বাচ্চার মা একটু অন্যদিকে গিয়েছিল, আর ও গাছ ছাঁটার কাঁচি দিয়ে কচ করে বাচ্চাটার কব্জি থেকে হাতটা কেটে নেয়।

কী নরম আর উষ্ণ ছিল ছোট হাতটা! কাটার পর বাচ্চাটা জেগে উঠে চিৎকার করতে থাকে। সেই সাথে হাতটার উষ্ণতাও কমে যেতে থাকে। সিনোহারা বাচ্চার হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। ছোট হাতটা ওর রেফ্রিজারেটরে ভরে রাখে।

শুধু ঐ বাচ্চাটার হাতটাই একমাত্র নয়। একবার অন্ধকারের মধ্যে সিনোহারা আরেকটা শিশুকে বাড়ি দিয়ে অজ্ঞান করে তারপর তার হাত কেটে নেয়। হাই স্কুলের কিছু ছেলেপেলে আর কয়েকজন বয়স্ক মানুষের হাতও সে কেটেছে। পূর্ণ বয়স্ক মানুষের হাত বেশ মোটা হয়। গাছ ছাঁটার কাঁচি দিয়ে কচ করে কাটা সম্ভব নয়। কাটার জন্য করা খুবই কর্কশ, হাতের কাটা অংশ বিচ্ছিরি দেখাত। ব্যাপারটা সিনোহারার সৌন্দর্য বোধের সাথে একদম খাপ খেত না। কিন্তু সে তো আর হাত কাটার জন্য কাঁধে একটা কুড়াল নিয়ে ঘুরতে পারে না। শেষে মাংস কাটার চাপাতি দিয়ে কাজ চালাতে লাগল। শিকারকে অজ্ঞান করার পর ও নিখুঁত এক কোপে হাড়সহ হাত আলাদা করে ফেলত।

সিনোহারা কাউকে খুন করেনি। সে সবসময় শুধু ওদের হাতগুলো চাইত, কাউকে খুন করতে চাইত না। অবশ্য হাত ছাড়া বাকি অংশ বাঁচল কি বাঁচল না তাতে ওর কিছু এসে যেত না। ওকে কেউ দেখে না ফেললেই হলো। হাত কেটে নিয়ে সংজ্ঞাহীন দেহগুলো স্রেফ ফেলে রেখে ও চলে আসত।

খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলো জানিয়েছিল, হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে পাওয়া একজন ভিক্টিমও আক্রমণকারীর চেহারা দেখেনি। ব্যাপারটা সিনোহারার জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল। যদিও আঁধারের মধ্যে গোপনে কাজ সারত ও, কিন্তু ধরা পড়ে যায় কিনা এই নিয়ে সবসময়ই ভয়ে ভয়ে থাকত।

সিনোহারা হাত ভালবাসত। ওগুলো কেটে আলাদা করতেও ওর ভালো লাগত। শরীরের বাকি অংশ থেকে হাতগুলোকে আলাদা করার পর ওর অন্যরকম একটা নিশ্চিন্ত বোধ হতো। ওর মতে, হাত আলাদা করার ব্যাপারটা আসলেই বেশ সাহসী, নায়কোচিত একটা কাজ ছিল।

এমন কি ওর কর্মক্ষেত্রেও একটা পুতুলের হাত কেটে নিয়েছিল ও। একটা ছোট সস্তা তুলোর পুতুল। ছোট হওয়ার কারনে পুতুল্টার হাত নিখুঁতভাবে বানানো হয়নি-কোন আঙুল ছিল না, হাতের শেষ ভাগ ছিল মসৃণ, গোলাকার। কারখানায় বানানো পুতুলের হাতের বিকাশ এভাবেই হয়েছিল, আঙুল ছাড়া। ওগুলো কেটে সিনোহারা ওর আর দুনিয়ার মধ্যে তৈরি হওয়া টেনশনের চাপ কমাত। তারপর সবগুলো কাটা হাত নিয়ে রেফ্রিজারেটরের ভেতর সাজিয়ে রাখত। সেটা কাপড়ের পুতুলের হাত হোক আর বিড়াল কুকুরের থাবা হোক, কখনো সেগুলো ফেলত না।

সিনোহারা একাকি বসবাস করত, কিন্তু ওর বাসাই ওর জীবন ছিল। বাসায় গিয়ে ফ্রিজ খুলে সাজিয়ে রাখা হাতগুলো দেখত। যখন সেগুলো

স্পর্শ করত, ওর মনে হত সে ওগুলোর মালিকের অতীত দেখতে পাচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে, তাদের জীবনের সব ঘটনা যেন হাতগুলোর মধ্যে জমাট হয়ে আছে। ওগুলো স্পর্শ করার মাধ্যমে ও হাতগুলোর সাথে কথা বলত। হাতগুলো তাকে বলত তাদের মালিকেরা তাদের ব্যবহার করে কী করে প্রেম করেছে, কিভাবে অন্যকে কষ্ট দিয়েছে-সবকিছু।

খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলো প্রতিদিন সিনোহারার কৃতকর্ম নিয়ে কথা বলত। তারা এটাকে নাম দিয়েছিল-’কাটা হাতের কেস’। নামে সিনোহারার কিছু এসে যেত না। কিন্তু সবাই ওকে ঘৃণা করছে, ওকে একজন অপরাধি হিসেবে দেখছে, এই ব্যাপারটা ওর কাছে ভালো লাগছিল না। সমাজের ভালো খারাপের সংজ্ঞা ওর উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, যেটা ওর পছন্দ না।

সন্ধ্যার খবর দেখতে দেখতে সিনোহারা ব্যাপারটা নিয়ে একটা বাচ্চার হাতের সাথে কথা বলল। হাতটা ও রেফ্রিজারেটর থেকে বের করে নিজের হাতে ধরে রেখেছে।

“তুমি একদম ঠিক কথাই বলেছ,” হাতটার ভাঁজ, পেশি, আঙুলগুলো যেন ওর কথা শুনে এটাই বলল।

অমনি সিনোহারার রাগ, দুশ্চিন্তা পানি হয়ে গেল। ও টের পেল ভেতর থেকে আবার সাহস মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

সকালের ক্লাসে কেমিস্ট্রির টিচার বললেন, “লাঞ্চের সময়ে আমি কেমিস্ট্রি অফিস গোছগাছ করব। কারো হাতে যদি সময় থাকে, আমাকে এসে সাহায্য করলে খুশি হব।”

টিচারের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল না উনি আসলে আশা করছিলেন যে কেউ সত্যি সত্যি এসে তাকে গোছগাছের কাজে সাহায্য করবে। আসলেও বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রি উনার কথা কানেই তোলেনি। সুতরাং আমি যখন লাঞ্চের সময় উনার অফিসে গিয়ে হাজির হলাম, তখন স্বাভাবিকভাবেই উনি বেশ অবাক হলেন।

দিনটা ছিল চমৎকার, মনে হচ্ছিল যেন বসন্তের উষ্ণ আলো জানালার বাইরে গলে গলে পড়ছে। কিন্তু কেমিস্ট্রি অফিসের ভেতরটা ছিল বেশ অন্ধকার, আর খানিকটা ঠান্ডা। বাইরে থেকে আসা ছাত্রছাত্রিদের খেলাধুলা আর হাসাহাসির শব্দ পাচ্ছিলাম।

যাবতিয় কেমিক্যাল, মলিকিউলের মডেল আর ফরমাল্ডিহাইডে সংরক্ষন করা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভর্তি বয়ামের বাক্স দিয়ে কেমিস্ট্রি অফিস ভর্তি ছিল। জানালার পাশে কাঠের ডেস্কগুলোতে নানান ধরনের সাইন্টিফিক বই আর কাগজপত্র রাখা। একটা ডেস্কের উপর পুরাতন মডেলের একটা কম্পিউটার ছিল। বই খাতার আড়ালে লুকিয়ে থেকে উঁকি মারছিল একটা প্রিন্টার। ঘুলঘুলি থেকে আসা আলোতে বাতাসে ভেসে থাকা ধুলো পরিস্কার চোখে পড়ছিল।

“উমম…প্রথমে চল ময়লাগুলো লেকচার হলে সরিয়ে ফেলা যাক, একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের দিকে ইশারা করলেন। ওটার ভেতর দলামোচা করা কাগজের বলে ভর্তি। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে ময়লার ঝুড়িটা নিয়ে লেকচার হলের দিকে এগুলাম।

***

“কার এত ঠেকা পড়েছে লাঞ্চ বাদ দিয়ে এই কাজ করার?” কেউ একজন আমার পাশ থেকে বিড়বিড় করে বলল, যখন কেমিস্ট্রি টিচার সাহায্য চাইলেন। আমি কি বলেছিলাম মনে নেই, কিন্তু সে আমার উত্তর শুনে হেসেছিল এটুকু মনে আছে। নিশ্চয়ই বোকার মত কিছু একটা বলেছিলাম।

আমার হাসিখুশি ক্লাসমেটদের সাথে অভিনয় করা আমার জন্য সহজই ছিল। আমি যদি জনপ্রিয় টিভি শো আর অন্যান্য প্রোগ্রাম নিয়ে ঠিক মত কথা বলতে পারি তাহলে তাদের সাথে খাপ খাওয়ানো কোন ব্যাপারই না। সবাই ভাবত আমি মিশুক ধরনের একটা ছেলে। ফলে উটকো ঝামেলা এড়ানো আমার পক্ষে সহজ হতো।

উটকো ঝামেলাগুলো কি ধরনের? কিন্ডারগার্টেনে থাকতে, আমার মাথায় একবার ভুত চেপেছিল কালো মার্কার দিয়ে পুতুলের মুখ কালো করে দেয়া আর হাত-পা কেটে ফেলা। কিন্তু আশেপাশের মানুষজন এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। আমার মা আর শিক্ষকদের চেহারা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে।

এরপর থেকে আমি মিথ্যা কথা বলায় পারদর্শি হয়ে উঠলাম। যেমন ধরা যাক, আঁকাআঁকি করার ক্রেয়নের ক্ষেত্রে। কালো ক্রেয়নটা অন্যগুলোর চেয়ে ছোট ছিল, আমি সাবধানতার সাথে বাকি রংগুলোও ছোট করে এক সমানে নিয়ে আসতাম। আঁকাআঁকিতে আমার তেমন একটা আগ্রহ ছিল না, কিন্তু আঁকলে রংধনু, ফুল এইসব হয়তো আঁকতাম। আশেপাশের বড়রা এগুলো দেখে স্বস্তিবোধ করত।

দুনিয়া কী চায় তা একবার ধরে ফেলায় আমার জন্য সহজ ছিল অন্যদেরকে বোঝানো যে আমার কোন সমস্যা নেই। আমি আমার ক্লাসমেটদের ফালতু গল্পের মধ্যে নিজে থেকে গিয়ে যোগ দিতাম।

ঐদিন যে আমি কেমিস্ট্রি অফিসে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম তা আমার ক্লাসমেটদের বলিনি। ক্লাসে আমি যার চরিত্রে অভিনয় করি সে এরকম কিছু করবে না। ওরা ভাবতে পারে, গ্রেড বাড়ানোর জন্য এরকম কাজ করছি। আমি সেটা এড়াতে চেয়েছিলাম। তাছাড়া উদার মনে আমি কাজটা করিনি, আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল।

গুজব শুনেছি যে আমাদের কেমিস্ট্রি টিচার তার কেমিস্ট্রি অফিসের ডেস্কে বসে পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করেন। এমন হতে পারে আবর্জনার ঝুড়িতে তার নোটগুলো পাওয়া যেতে পারে। আমি সেগুলো হাতে পেতে চাইছিলাম।

প্রথম বর্ষ থেকেই আমি মাঝে মধ্যে এই টিচারকে অফিস পরিস্কারে সাহায্য করে আসছি। তাই আমার জানা আছে তিনি কিভাবে কাজ শুরু করেন-প্রথমে আমাকে বলবেন ময়লাগুলো নিয়ে পাশের লেকচার হলে রেখে আসতে। তারপর আমরা একসাথে অফিস গোছাব। এরপর আবার ময়লা সরানোর সময় তিনিও আমার সাথে হাত লাগাবেন (যে পরিমান আবর্জনা বের হয় তা বহন করতে দু-জনকে লাগে)। গত বছর অন্তত এমনই হয়েছিল।

তো এখানে সমস্যাটা হলো-ময়লার ঝুড়ি থেকে কাগজগুলো তুলে নেয়ার সময় নেই। তাই আমার একটা প্ল্যানের দরকার ছিল। প্রথমে অন্য ক্লাসরুম থেকে আমি আরেকটা ময়লার ঝুড়ি এনে কেমিস্ট্রি লেকচার হলে লুকিয়ে রাখলাম। তারপর কেমিস্ট্রি অফিসে গিয়ে টিচারকে সাহায্য করতে চাইলাম।

যদি সবকিছু গত বছরের মতই হয় তাহলে প্রথমে আমাকে ময়লার ঝুড়ি লেকচার হলে বহন করে নিয়ে যেতে হবে। যদি তা না হয় তাহলে কোন এক সময় তার দৃষ্টির আড়ালে আমাকে তা করতে হবে। স্কুলের সব ময়লার ঝুড়ি দেখতে একই রকম, সবগুলোই নীল রঙের। যে কারনে আমার লুকিয়ে রাখা ময়লার ঝুরির সাথে কেমিস্ট্রি অফিসের ময়লার ঝুড়ি গোপনে বদলে ফেলা যাবে।

আমাদের কাজ শেষ হলে সব ময়লা একসাথে নিয়ে টিচারের চোখের সামনে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হবে। কিন্তু পরীক্ষার নোট ওয়ালা ঝুড়ি কেমিস্ট্রি হলের ডেস্কের তলায় লুকানো থাকবে। পরে আমি সুযোগ মত সেখান থেকে নোটগুলো সরিয়ে নেব।

আগে যেরকম বলেছি, অফিসে ঢোকার আগেই অন্য ক্লাস রুম থেকে একটা ময়লার ঝুড়ি এনে লেকচার হলে লুকিয়ে রেখেছিলাম। যে রকম আশা করেছিলাম সেরকমই হলো, আগের বছরের মত এবারও টিচার আমাকে অফিসের ময়লার ঝুড়ি নিয়ে লেকচার হলে রাখতে বললেন। সবকিছু মসৃণভাবেই চলছিল।

আমার প্ল্যান যেন উনি টের না পান সেজন্য যতটা সম্ভব তার নির্দেশ মতই সব কাজ করছিলাম। লেকচার হল আর কেমিস্ট্রি অফিসের মধ্যেই একটা দরজা ছিল, আলাদা করে বাইরে থেকে ঘুরে ঢুকতে হত না।

এমন সময় প্ল্যানের বাইরে একটা ঘটনা ঘটল। একটু আগে লেকচার হল খালিই ছিল, কিন্তু আমি যখন ময়লা নিয়ে সেখানে গেলাম তখন দেখি রুমের এক কোণায় বসে একটা মেয়ে বই পড়ছে। মেয়েটার চুল লম্বা ঘন কালো। লেকচার হলের হালকা আলোতে তাকে ভুতুড়ে কোন ছায়ার মত লাগছিল দেখতে। ভালো করে তাকিয়ে মেয়েটাকে চিনতে পারলাম। মেয়েটার নাম মোরিনো, বসন্তের টার্মের শুরু থেকে আমার ক্লাসেই পড়ছে।

মুখ তুলে আমাকে দেখে আবার বইয়ে মনোযোগ দিল সে। দরজা থেকে সবচেয়ে দূরের ডেস্কটায় বসে ছিল। আমি কি করছি না করছি সে ব্যাপারে ওর কোন আগ্রহ ছিল না।

প্রথমে ভেবেছিলাম, সে-ও বোধহয় সাহায্য করতে এসেছে, কিন্তু না। আমার কেন যেন মনে হলো ও আমার প্ল্যানে কোন বাগড়া দেবে না।

মোরিনোর সাথে আমার কখনো কথা হয়নি ঠিকই, কিন্তু ওর অস্বাভাবিকতা আমার চোখে পড়েছে। সে কারো সাথে মিশত না। না মেশার কারনে বরং আরো বেশি বেশি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত। ক্লাসে কিছু ছেলেমেয়ে ছিল যারা কিনা হাসিখুশি, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। মোরিনো তাদের উল্টোপথে চলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাত। কেউ তার সাথে কথা বলতে আসলে সে না শোনার ভান করত। একা থাকতে চাইত। একা থাকতে ভালবাসত ও।

আর এখন সে লেকচার হলের কোনায় বসে বই পড়ছে। আমি ওকে উপেক্ষা করলাম। চুপচাপ লুকানো ময়লার ঝুড়ির সাথে অফিসের ঝুড়ি বদলে ফেললাম। মনে হল না মোরিনো কিছু খেয়াল করেছে।

তারপর অফিসে ফিরে এলাম, ভাবটা এমন যেন কিছুই হয়নি।

“ওখানে একটা মেয়ে বসে আছে না? প্রতিদিন লাঞ্চের সময় সে এসে ওখানে বসে থাকে,” কেমিস্ট্রি টিচার বললেন। লেকচার হলটা ছিল স্কুলের সবচেয়ে নিস্তব্ধ স্থান। আলোও কম ছিল সেখানে। আমি বুঝতে পারছিলাম কেন মোরিনো সেখানে যায়। জায়গাটার সাথে আমাদের ক্লাসরুমগুলোর একদমই কোন মিল নেই। জায়গাটা এত চুপচাপ যে মনে হত সময় এসে ওখানে থেমে গিয়েছে। জায়গাটার মধ্যে কেমন জানি একটা অস্বাভাবিকতা ছিল, অনেকটা লাশ কাটা ঘরের মত।

টিচারের নির্দেশমত আমি সেলফের উপর থেকে বাক্সগুলো নামিয়ে বোতলের ভেতরের কেমিক্যালগুলো পরীক্ষা করে দেখছিলাম।

অন্যদিকে তিনি কমেপ্রসড বাতাসের একটা ক্যান নিয়ে কম্পিউটারের কিবোর্ডের ধুলো পরিস্কার করছিলেন-লোকটা বেশ খুঁতখুঁতে।

ঝাড়পোঁছের পুরোটা সময় তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করছিলেন, ময়লার ঝুড়িতে উঁকি দেয়ার সুযোগ ছিল না।

কাজ শেষ হলে আমরা একগাদা ময়লা টেনে লেকচার হলে নিয়ে গেলাম।

“আজকাল এরকম লম্বা কালো চুলের মেয়ে দেখাই যায় না, সবাই এখন চুল রং করে,” মোরিনোর দিকে তাকিয়ে টিচার বললেন। মেয়েটার চুলগুলো আসলেই ঘন কালো আর খুবই সুন্দর ছিল। আমি তাকে বললাম যে আমার বোনের চুলও প্রায় একইরকম।

মোরিনো ওর শুকনো ফ্যাকাসে সাদা হাত দিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল। এত ফ্যাকাসে যে লেকচার হলের হালকা আলোতে মনে হচ্ছিল ওর হাতগুলো রীতিমত জ্বলজ্বল করছিল। দৃশ্যটা এখনো আমার চোখে

টিচার আর আমি আবর্জনাগুলো নিয়ে ইন্সিনারেটরে পুড়িয়ে ফেললাম। তারপর যে যার দিকে চলে গেলাম। আমি তাড়াতাড়ি লেকচার হলে ফিরে আসলাম। দুপুরের ক্লাস শুরু হওয়ার আগে মাত্র দশ মিনিট বাকি ছিল আমার হাতে।

হলে ঢুকে দেখি ততক্ষণে মোরিনো চলে গিয়েছে, সম্ভবত ক্লাসেই গিয়েছে। যাক ভালই হল আমার জন্য।

ডেস্কের নিচে লুকানো ময়লার ঝুড়িটা বের করে আমি ভেতরে হাতরালাম কি আছে দেখার জন্য। সাথে দরজার দিকে একটা চোখ রেখেছিলাম কেউ আসে কিনা দেখার জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যা খুঁজছিলাম সেরকম কিছু ছিল না।

বরং অদ্ভুত একটা জিনিস পেলাম সেখানে। যত্নের সাথে কাগজের পর কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে রাখা কিছু একটা। কাগজগুলো সরিয়ে আমি একটা পুতুল পেলাম, কবজি থেকে হাতগুলো কাটা।

ছোট পুতুলটা কাপড়ের তৈরি ছিল। এত ছোট যে হাতের তালুতে এঁটে যায়। পায়ের কোন ক্ষতি হয়নি। ডিজাইন দেখে যা মনে হচ্ছিল তা হল কাটা হাতগুলোতে কোন আঙুল ছিল না। একদম সাধারন ধরনের একটা পুতুল। কিন্তু জিনিসটা আমাকে যা মনে করিয়ে দিল তা হল টিভিতে দেখা কাটা হাতের কেস।

বিভিন্ন বয়সের শিশু-বুড়ো-নারী-পুরুষকে, যখন তারা রাস্তায় একা হাঁটে, কেউ একজন তাদের অজ্ঞান করে হাতগুলো কেটে নেয়। এমন কি কুকুর-বিড়ালদেরও সামনে থাবা কাটা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। খবরে বলা হচ্ছিল দুটোই একই লোকের কাজ। ঘটনাগুলো এখান থেকে খুব

একটা দূরে ঘটেনি।

কেমিস্ট্রি টিচার, মি. সিনোহারা কি পুতুলের হাতগুলো কেটেছেন? কোন রকম খেলা নাকি? না, আমার বিশ্বাস তিনিই এই কাটা হাতের ঘটনাগুলোর পেছনের লোক। যদিও হাত কাটা একটা পুতুল পাওয়া থেকে খুব বেশি অনুমান করা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে হাতগুলো সে কেটেছে সেগুলো ধারে কাছেই কোথাও রেখেছে বলে আমার মনে হয়। আর আমি চিন্তা করলাম, কেন কেমিস্ট্রি টিচার পুতুলের হাতগুলো কাটতে পারেন

মনে হচ্ছিল তা উড়িয়ে দেয়ার সম্ভাবনা কম। আমার ধারণা ব্যাপারটা স্রেফ তার উদ্যম শক্তির একটা অংশ।

***

হাতকাটা পুতুলটা পাওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই আমি ক্লাসে বসে কাটা হাতের কেসটা নিয়ে চিন্তা করি। মিডটার্ম সামনেই, কিন্তু সেদিকে আমার কোন খেয়াল ছিল না। টিভিতে যেসব ভয়াবহ খবর দেখায়, তার মধ্যে এটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। কালপ্রিটের মত একই কাজ আমিও করতে চাইতাম। আর আমার বিশ্বাস…ঐ মানুষটা ঠিক আমারই মত। কিছু তো পার্থক্য আছেই, কিন্তু তারপরেও কাটা হাতের এই অপরাধির সাথে কোথাও আমার নিজের একটা মিল টের পাচ্ছিলাম।

সেদিনের পর থেকে আমি প্রায়ই ক্লাসের মাঝের বিরতিতে লেকচার হলের সামনে যোরাঘুরি করতাম যাতে মি. সিনোহারার সাথে দেখা হয়। আমাকে তার মনে ছিল, দেখা হলে হাত নাড়তেন। অল্পবয়সি একজন যুবক, শুকনো ধরনের, মাথায় ছোট ছোট চুল। আমি অনেকবার চিন্তা করেছি কাটা হাতের রহস্যের পেছনে আসলেই এই লোকটা আছে কিনা।

একবার দেখলাম মি. সিনোহারা লেকচার হলের বাইরে মোরিনোর সাথে কথা বলছেন। মোরিনোর হাতে একটা বই দেখে তিনি বলছিলেন তার সংগ্রহে বইটার পরবর্তি খন্ড আছে। মানসিক ভারসাম্যহীনতার উপর লেখা একটা নন-ফিকশন বই। উত্তরে মোরিনো শুধু বলেছিল “তাই নাকি?” বরাবরের মত ওর চেহারায় কোন অভিব্যক্তি ছিল না।

ক্লাসে আমি আমার ভন্ডামি চালিয়ে যেতে লাগলাম। সাধারণ একজন হাইস্কুল কিশোর হিসেবে অভিনয় করা, লোকজনের চোখে না পড়া-আমার জন্য সহজ কাজ ছিল। কিন্তু মাথায় সারাক্ষণ কাটা হাতের কেস সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার ঘুরত। এরকম ইন্টারেস্টিং একটা বিষয় বাদ দিয়ে সবার সাথে হাসি খুশি চেহারা করে তারকাদের গুজব নিয়ে কথা বলা বেশ ক্লান্তিদায়ক ছিল। মাঝে মাঝে নিজেকে অপদার্থ মনে হত এত শ্ৰম ক্ষয় করার জন্য।

দেখা গেল মি. সিনোহারা যেমন বলেছিলেন, মোরিনো আসলেই লেকচার হলে বেশ ভালো সময় কাটায়। যতবার আমি সেখানে উঁকি দিয়েছি, দেখেছি অন্ধকার রুমে সে চুপচাপ বসে আছে।

ও সবসময় একা থাকত। এমন না যে, ওর সাথে কেউ ঝামেলা করত, কিংবা কোনো ধরনের হেনস্তা করত ওকে। ব্যাপারটা এরকম যে ও ইচ্ছা। করেই সবার সাথে সবরকমের দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করত। ওর পাথরের মত কঠিন নিরবতা দেখলে বোঝা যেত আর দশটা ছেলে মেয়ের আগ্রহের সাথে ওর আগ্রহের বিষয়ের কোনই মিল নেই।

“জানো নাকি? জুনিয়র হাই স্কুলে থাকতে মোরিনো আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল, একজন আমাকে বলেছিল। সেটা মাথায় আসতেই আমি ওর ফ্যাকাসে সাদা হাতগুলো আবার ভালো করে দেখলাম। ও কেন মরতে চেয়েছিল আমি জানি না, কিন্তু ওর জন্য এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা যে সহজ কাজ নয় তা বুঝতে পারছিলাম।

অভিনয় বন্ধ করে দিলে আমার অবস্থা হয়তো ওর মত গিয়ে দাঁড়াবে। যদি আমার আশেপাশের লোকজন বুঝতে পারে আমি কতটা নিষ্ঠুর আর অনুভূতিহীন তাহলে আমার জীবন কতখানি কঠিন হতে পারে? মনে মনে আমার বর্তমান অবস্থা আর যেটা হতে পারে সেটার তুলনা করলাম-খুব একটা পার্থক্য হবে মনে হলো না। সবদিকেই আমি একা।

পুতুলটা পাওয়ার তিন দিন পর একটা নতুন পরিকল্পনা দাঁড় করালাম।

মি, সিনোহারার বাসা ছিল একটা নির্জন এলাকায়। সাধারণ দোতলা বাড়ি। বাড়ির পাতলা সাদা দেয়াল সূর্যের আলো পড়ে হলদেটে দেখাত। আশেপাশে কেউ ছিল না, একমাত্র শব্দ যেটা পাওয়া যাচ্ছিল সেটা ছিল মাথার উপর দিয়ে প্লেন উড়ে যাওয়ার শব্দ।

দ্বিতীয় বর্ষের হোমরুম টিচার ছিলেন মি. সিনোহারা। ঐ ক্লাসের একজনকে আমি চিনতাম। সে আমাকে ঠিকানা দিয়ে জোর গলায় বলেছিল টিচার সেখানে একাই থাকেন।

হাতঘড়ি দেখলাম। মঙ্গলবার সব শিক্ষকদের মিটিঙে থাকার কথা। সুতরাং তিনি বাড়ি ফেরার আগে অনেকটা সময় হাতে পাচ্ছি।

কেউ দেখছে না নিশ্চিত হয়ে গেট দিয়ে ঢুকে বাড়ির পেছনের দিকে গেলাম। একটা ছোট উঠোনের মত জায়গা, কাপড় ঝুলানোর ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে। উঠোনের দিকে মুখ করা একটা বড় জানালা ছিল, কিন্তু ভেতর থেকে লক করা। হাতে একটা ভোয়ালে পেঁচিয়ে ঘুষি দিয়ে জানালা ভাঙলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম বোঝার জন্য কেউ কিছু শুনেছে কিনা, তারপর লক খুলে ঢুকলাম ভেতরে। পা থেকে জুতো আগেই খুলে নিয়েছি।

কাটা হাতের কেসের কালপ্রিটটা হাত কেটে সাথে করে নিয়ে যেত। কেউ জানে না হাতগুলোর কি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করে ওগুলো দেখে অপরাধি লোকটা আনন্দ পায়, আবার কেউ কেউ মনে করে সে ওগুলো রান্না করে খায়। সত্যিটা আসলে কি তা কেউই জানে না। যেটাই হোক, অপরাধির বাসায় কোন না কোন প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। আজ রাতে আমার কাজ হল মি. সিনোহারার বাসায় সেরকম কোন প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজে দেখা।

জানালা ভেঙে যে রুমে ঢুকেছি সেটা ছিল লিভিং রুম। মেঝেতে কাঁচের টুকরো পড়েছিল, তাই সাবধানে পা ফেললাম। বাসার সবকিছু সুন্দর করে গোছানো, এমনকি টেবিলের উপর ম্যাগাজিন আর রিমোটগুলোও পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা।

আমি যতটা সম্ভব কম শব্দ করার চেষ্টা করলাম। ভয় হচ্ছিল মি. সিনোহারা হয়তো তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে সামনের দরজায় চাবি ঢোকানোর শব্দ যেন আমার কান এড়িয়ে না যায়। আমাকে দেখে ফেলার আগেই দৌড়ে পালাতে হবে।

মেঝে পলিস করা ছিল। যদিও আলো নেভানো ছিল আর চারপাশে অন্ধকার, তারপরেও জানালা দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় ভালো মতই সব দেখতে পারছিলাম।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় খেয়াল রাখলাম দেয়াল কিংবা রেলিঙে যেন হাত না লাগে। মি. সিনোহারা যদি আসলেই অপরাধি হয়ে থাকেন, তাহলে হাতের ছাপ কোথাও পেলেও সম্ভবত পুলিশকে জানাবেন না। কিন্তু তারপরেও আমি যে এখানে এসেছিলাম তার কোন প্রমাণ রেখে যেতে চাই না।

দোতালার বেডরুমে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার আর কিছু বুকশেলফ ছিল। বইগুলো সাইজ অনুসারে সাজানো। কোথাও এক বিন্দু ধুলোও পড়ে নেই।

মি. সিনোহারা যে হাত কাটা অপরাধি তার কোথাও কোন সূত্র নেই।

আমি আমার ডান হাতে আঙুল চেপে পালস পরীক্ষা করলাম। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু দ্রুত ছিল। এর অর্থ আমার টেনশন হচ্ছিল। আচ্ছা, ডাক্তাররা হাত কাটা লোকজনের পালস কিভাবে পরীক্ষা করেন?

ঘড়ি দেখলাম। মিটিং এতক্ষণে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। মি, সিনোহারা যদি স্কুল থেকে বের হয়ে সরাসরি বাসায় ফেরেন, তাহলে আমার উচিত হবে এখনই বেরিয়ে যাওয়া।

দোতালার অন্য রুমগুলি চেক করলাম, দুটো তাতামি ফ্লোরের রুমে খালি শেলফ আর ওয়ারড্রব। মি. সিনোহারা কাউকে আক্রমণ করেছেন তার কোন চিহ্ন নেই কোথাও।

প্রত্যেকটা রুম চেক করার পর আমি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছি কোন কিছু ভুল করিনি কোথাও, স্টুডেন্ট আইডি, ইউনিফর্মের বোতাম, টেক্সটবুক কিংবা কোন মোজা। আমাকে চিনে ফেলতে পারে এরকম কিছু ফেলে যাওয়া হবে বিশাল রকমের ভুল। ঠিকমত মনোযোগ দিলে সেরকম ভুল হওয়ার সুযোগ কম।

কোন কিছু ফেলে যাইনি নিশ্চিত হয়ে আমি আবার নিচে নেমে এসে কিচেনে ঢুকলাম।

মি. সিনোহারা কি নিজে রান্না করেন? খুব বেশি থালাবাসন ছিল না, যা ছিল তা সুন্দর করে সাজানো। সিঙ্কে কিছু রাখা নেই। দেখে মনে হচ্ছিল কেনার পর থেকেই কাপ আর রান্নার জিনিসপত্র এনে কিচেনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, কখনো ব্যবহার করা হয়নি।

টেবিলের উপর একটা রাইস কুকার ছিল, একা একজন মানুষের জন্য সাইজটা একটু বড়ই বলা যায়। উনার পরিবার কিংবা অতীত সম্পর্কে কোন কিছু আমার জানা নেই। আগে কি আরো কোন আত্মীয় সাথে থাকত? না হলে এরকম বড় রাইস কুকার কেনার অর্থ কি?

জানালা দিয়ে আসা আলোতে স্টেইনলেস স্টিলের সিঙ্ক একদম চকচক করছিল। একমাত্র শব্দ যেটা কানে আসছিল তা হল রেফ্রিজারেটর থেকে আসা গুনগুন শব্দ। নয়তো চারদিকে একদম কেমিস্ট্রি লেকচার হলের মত নিরবতা বিরাজ করছে। আমার সে রকমই অনুভূতি হচ্ছিল।

কিচেনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি আবার আমার পালস পরীক্ষা করলাম। কব্জির চামড়ার নিচে রক্তের শিরাগুলো অবিচল রক্ত বহন করছে। পালস এখন স্বাভাবিক। তারপর আবার হঠাৎ দ্রুত হয়ে গেল, যেন যে কোন সময় ফেটে যাবে।

নাকে একটা বাজে গন্ধ আসছিল। মনে হচ্ছে কোন কিছুতে পচন ধরেছে, ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করেছে। গন্ধটা পেয়েই আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।

গন্ধটা কোত্থেকে আসছে তা খুঁজতে লাগলাম। কাপ বোর্ড কিংবা ড্রয়ারে কিছু ছিল না। রেফ্রিজারেটরের উপর দৃষ্টি গিয়ে স্থির হল আমার।

হাতের ছাপ যেন না পড়ে সেজন্য রুমাল দিয়ে রেফ্রিজারেটরের হাতল ধরে টানলাম। বাজে গন্ধটা বেড়ে গেল। আমার অনুমানই সঠিক-মি, সিনোহারাই কাটা হাতের অধি।

ফ্রিজের আলোতে দেখা গেল ভেতরে সেলফের উপর সারি সারি কাটা হাত। আঙুল আর নখ সমান করে সেগুলো পিয়ানোর কি-এর মত করে পাশাপাশি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পেছন দিকে কিছু ছোট বাটিতে ককর আর বিড়ালের সামনের পায়ের থাবাগুলো রাখা। লেকচার হলের ময়লার ঝুড়িতে পাওয়া পুতুলের হাতগুলো ফ্রিজের দরজায় খুঁজে পেলাম। ওগুলো দেখে মনে হচ্ছিল কাপড়ের বল, কিন্তু রং পুতুলের মত হওয়ায় চিনতে অসুবিধা হয়নি।

অনেক আগে থেকেই আমার ধারণা ছিল অপরাধি নিশ্চয়ই হাতগুলো সংরক্ষন করছে। এই ধারনার পেছনে কোন ভিত্তি না থাকলেও আমার মনে হয়েছিল, কারন আমি হলেও একই কাজ করতাম। আর দেখা গেল আমার ধারনাই সঠিক।

একটা হাত তুলে নিলাম, একজন নারীর হাত। হাতের লাল নেইলপলিশ জায়গায় জায়গায় উঠে গিয়েছিল, আর ঠান্ডায় জমে বেশ ভারিও লাগছিল হাতটাকে।

মৃত ত্বকের স্পর্শ…না ঠিক মৃত বলা যাবে না, সব ভিক্টিমই বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে, শুধু তাদের হাতগুলো নেই…কিন্তু এটাও ঠিক যে তাদের কাটা হাত তো মৃতই..

ওখানে ডান-বাম সব রকমের হাতই ছিল। কিছু হাতের নখ কালো হয়ে গেছে। কিছু হাতের ত্বক তখনো সুন্দর মসৃণ।

হাতগুলোর উপর নিজের হাত বোলালাম। মনে হচ্ছিল আমি যেন মি. সিনোহারার ভেতরটা ফুটো করে দেখতে পাচ্ছি। সাধারন মানুষ বিষয়টা বুঝতে পারবে না, আমি নিশ্চিত মি. সিনোহারা নিজেও জানেন কেউ যে তাকে বুঝতে পারবে না। কিন্তু আমার জন্য কল্পনা করা সহজ ছিল, তিনি একা এই কিচেনে দাঁড়িয়ে তার হাতের সংগ্রহের উপর হাত বোলাচ্ছেন।

হাতগুলো যেহেতু তার রেফ্রিজারেটরে রাখা, তিনিই হাত কাটার অপরাধি। পুলিশকে খবরটা জানানোর কোন ইচ্ছা আমার নেই। হয়তো আমার উচিত তাদের জানানো, কিন্তু সেরকম কোন আগ্রহ আমার ছিল না। বরং আমার অন্য একটা পরিকল্পনা ছিল।

আমি নিজেও কারো হাত কাটতে চাইছিলাম। মি. সিনোহারার সংগ্রহ দেখার পর ইচ্ছেটা এখন আরো বেড়ে গেল।

ফ্রিজের ভেতর তাকালাম। কত ধরনের হাত সেখানে রাখা। যে কোনটা আমি নিতে পারতাম, কিন্তু যে কোন একটা নিলেই হবে না, বিশেষ একজনের হাত আমি চাই। সাথে আনা ব্যাগে হাতগুলো সব ভরে নিলাম।

***

স্কুলের কাজ শেষে সিনোহারা যখন বাসায় ফিরল তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বাসায় ঢুকে লিভিং রুমের দিকে যেতে গিয়ে সে টের পেল কিছু একটা ঠিক নেই। জানালাটা ভাঙা। মেঝেতে কাঁচের গুঁড়ো পড়ে আছে। জানালাটা খোলা থাকায় ঘরের ভেতর ঠান্ডা বাতাস ঢুকছিল। কেউ একজন চুরি করে ওর বাসায় ঢুকেছে!

প্রথম যে জিনিসটা সিনোহারার মাথায় এল তা হল রেফ্রিজারেটরের ভেতর রাখা হাতগুলো। সোজা কিচেনে গিয়ে রেফ্রিজারেটর খুলল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সব হাত উধাও। সেদিন সকালেও সে সব হাত সেখানে দেখে গিয়েছে। মানুষের হাত, পুতুলের হাত, পশুর থাবা সব উধাও! ফ্রিজ একদম খালি। শুধু হাতের সাথে রাখা অল্প কিছু খাবার পড়ে ছিল।

কিছু একটা ওকে খোঁচাচ্ছিল, কিন্তু বুঝতে পারছিল না সেটা কি। লিভিং রুমের কাঁচের টুকরাগুলো পরিস্কার করা দরকার। হাত হারানোর শোকে ওর মাথা তখন ঠিকমত কাজ করছিল না।

দোতলায় গিয়ে কম্পিউটার অন করে সামনে বসল।

কেউ একজন জানালা ভেঙে ঢুকে সব হাত চুরি করে নিয়ে গেছে, সবগুলো হাত।

এক ফোঁটা পানি কম্পিউটারের ডেস্কের উপর পড়ল। সিনোহারা হঠাৎ উপলদ্ধি করল সে কাঁদছে।

তার পুরো জীবনে সে কখনো কোন মানুষের সাথে এতটা অন্তরঙ্গ হতে পারেনি যতটা এই হাতগুলোর সাথে হয়েছিল। কেউ যদি তাকে হাতগুলোর সাথে দেখত তাহলে মনে করত সে সেফ চুপচাপ বসে আছে, কিন্তু না, সিনোহারা আসলে ঐ ঠান্ডা নির্বাক হাতগুলোর সাথে কথোপকথন করত, ওগুলোকে স্পর্শ করার মাধ্যমে।

সারা শরীর জুড়ে এমনভাবে ক্রোধের ঢেউ উঠে এল যে সিনোহারার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। পুলিশকে এই চুরির খবর জানানো সম্ভব নয়। কিন্তু হাতগুলো যে-ই নিয়ে থাক সিনোহারা অবশ্যই তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে।

সে কখনো কাউকে খুন করেনি, কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম ঘটবে। যেভাবেই হোক সে এই চোরকে ধরবেই। ওর হাতগুলোও সে কেটে নেবে, তারপর গলা টিপে মারবে। কিংবা বুকে ছুরি বসিয়ে দেবে।

কিন্তু কথা হলো, চোরকে সে কিভাবে খুঁজে পাবে? সিনোহারা ডেস্কে কনুই রেখে চিন্তা করতে লাগল।

কিবোর্ডটা নোংরা হয়ে ছিল। পাশে রাখা কমপ্রেসড বাতাসের ক্যানের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল সিনোহারা। ওর চোখ জোড়া কিবোর্ডের উপর আটকে গেল।

কোন সন্দেহ নেই চোর জিনিসটা ফেলে গিয়েছে। আর কোন ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। জিনিসটা খুবই ছোট, সহজে চোখ এড়িয়ে যায়। ভাগ্য ভালো সিনোহারা সেটা খেয়াল করেছে।

এখন সে বুঝতে পারল রেফ্রিজারেটরের সামনে কি কারনে মনটা খুতখুত করছিল তখন। কারণটা একদম পরিস্কার। অবহেলা করে হাত চোর একটা ভুল করেছে আর সেই ছোট্ট ভুলই চোরের পরিচয় ফাস করে দিয়েছে…

পরদিন সকালে কাজে যাওয়ার সময় সিনোহারা সাথে একটা চাপাতি নিল। এই চাপাতি সে হাত কাটার কাজে ব্যবহার করে। জিনিসটা বেশি বড় না, ব্যাগে সহজে লুকিয়ে রাখা যায়। অন্য শিক্ষকদের সাথে কুশল বিনিময়ের সময় তারা টেরও পেল না সিনোহারার ব্যাগে কি আছে।

সকালবেলাটা সবসময়ই দৌড়ের উপর থাকতে হয়। টিচারদের রুমের বাইরে ছাত্রছাত্রিরা দ্রুত চলাফেরা করছিল। প্রথম সেমিস্টারের মিডটার্ম প্রায় চলে এসেছে, যার যার ডেস্কে বসে শিক্ষকরা প্রশ্নপত্র তৈরি করতে ব্যস্ত।

শিক্ষকদের একজন সিনোহারাকে জিজ্ঞেস করলেন ওর প্রশ্নপত্রের কি অবস্থা। ও হেসে উত্তর দিল। জীবনটা সে এইরকম হেসেই পার করছে। লোকগুলোকে আসলে ওর অসহ্য লাগে।

হাত, হাত, হাত।

হাতগুলো ওর কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমে হাত, তারপর মানুষ। মানুষের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার কোন মানে নেই।

সকালে সিনোহারার ক্লাস ছিল, তাই হাত চোরের সাথে দেখা করার সময় পায়নি। কিন্তু সে জানে কে চোর। চোরকে ধরে আগে জানতে হবে হাতগুলো কোথায় আছে।

মাত্র এক রাত পার হয়েছে, সিনোহারা নিজেকে শান্ত করতে চাইছে। এই ভেবে যে হাতগুলো এখনো নিরাপদে আছে। কোথায় আছে জানার পর সে চাপাতি দিয়ে চোরের হাতগুলো কেটে নেবে। শরীরের সাথে হাতগুলোর মারা যাওয়ার কোন মানে নেই। তাই আগে হাতগুলো কেটে নিতে হবে।

সকালের শেষ ক্লাস ছিল হোম রুম ক্লাস। সবাই দ্রুত হাতে ব্ল্যাক বোর্ড থেকে তার লেখা খাতায় তুলে নিচ্ছিল। ক্লাসের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বিয়াল্লিশ। হাতের সংখ্যা আটচল্লিশ।১১১১১

সিনোহারা বুঝিয়ে বলল মিডটার্মে কী কী থাকবে, কিন্তু ওর মাথায় খালি চুরি যাওয়া হাতগুলোর চিন্তা ঘুরছিল। চোর খাবার রেখে ওর হাতগুলো নিয়ে গিয়েছে। সিনোহারা সাথে সাথে ব্যাপারটা খেয়াল করলেও তখন এর অর্থ বুঝেতে পারেনি।

অবশেষে ঘন্টা বাজল, ক্লাস শেষ হলো। সকালের সব ক্লাস শেষ। লাঞ্চের সময় এখন।

সিনোহারা রুম ছেড়ে বের হলো। ব্যাগ থেকে চাপাতিটা আনতে যাচ্ছে। টিচারদের অফিসে ওর ব্যাগটা রাখা। হলওয়েতে ভিড় আর চিৎকার চেঁচামেচি, কিন্তু এসবের কিছুই সিনোহারার কানে ঢুকছিল না।

সে কয়েক মিনিট টিচারদের রুমে অপেক্ষা করে কেমিস্ট্রি হলের দিকে পা বাড়াল।

***

লাঞ্চের সময় শুরু হতেই আমি কেমিস্ট্রি লেকচার হলের দিকে পা বাড়ালাম। দরজা খুলে দেখি ভেতরে কেউ নেই, ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সাথে সাথে বাইরের সব আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল, ভেতরের বাতাস মনে হয় স্থির হয়ে আছে। যেন সময় এখানে এসে থেমে গিয়েছে।

পালস মাপলাম, অনেক দ্রুত চলছে। চামড়া শরীরের উপর চেপে বসেছে মনে হচ্ছিল। অনেক টেনশন হচ্ছিল।

গতকাল রাতে বাসায় ফেরার পর মি, সিনোহারা কি করলেন? যখন দেখলেন হাতগুলো নেই তখন তার মনের অবস্থা কি দাঁড়িয়েছিল? তিনি কি অনেক রেগে গিয়েছিলেন? অনুমান করা ছাড়া আমার কিছু করার নেই।

সকালে তাকে আমি দেখিনি-দেখলেও ভান করতাম যেন কিছু জানি। তিনি আমাকে ধরতে পারবেন না, যদিনা আমি কোন ভুল করে থাকি। ভুল করে থাকলে খবর আছে। কিন্তু আমি প্রায় নিশ্চিত, তিনি জানেন না হাতগুলো আমি চুরি করেছি। কিন্তু আপাতত প্রার্থনা করা ছাড়া পুরোপুরি নিশ্চিত হবার কোন উপায় নেই।

হতে পারে আমি হয়তো কোন ভুল করেছি, খেয়াল করিনি-কিন্তু সেটা করে থাকলেও এখন জানার কোন উপায় নেই। যদি করেই থাকি তাহলে মি, সিনোহারা অবশ্যই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ছুটে আসবেন। সেক্ষেত্রে আমার জীবন এখন হুমকির সম্মুখীন।

নির্জন লেকচার হলে, অন্ধকারের ভেতর দাঁড়িয়ে আমি যখন এসব আকাশ পাতাল ভাবছিলাম তখন শুনতে পেলাম কেউ একজন দরজার ঠিক বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে।

***

দরজা খুলে সিনোহারা লেকচার হলে ঢুকল। ভেতরে একজনকে দেখা যাচ্ছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সিনোহারার রাগ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।

ইচ্ছা হচ্ছিল গিয়ে ওর গলা চেপে ধরে, কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করল। মুখে হাসি ফুটিয়ে সামনে গেল। ওর অন্য পরিকল্পনা আছে। ভান করতে হবে যেন ও কিছু জানে না।

“হ্যালো মি. সিনোহারা,” কথাটা শুনে সিনোহারা মনে মনে হাসল, বাহ বাহ দারুন অভিনয়। নিশ্চয়ই সিনোহারাকে দেখে মনে মনে হাসছে। হয়তো হাত হারিয়ে সিনোহারা কেমন কষ্ট পাচ্ছে তা দেখার জন্যই এখানে বসে আছে। রাগ লুকিয়ে সিনোহারা ওর কাছাকাছি এগিয়ে গেল। প্ল্যানটা সফল করতে ওর শিকারের কাছাকাছি যেতে হবে। কোনভাবে টের পেতে দেয়া যাবে না যে ও চোরকে চিনে ফেলেছে।

বোকাটা বুঝতে পারেনি, বুঝলে এতক্ষণে উঠে দৌড় দিত। সিনোহারা কোন সন্দেহ না জাগিয়ে ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। চোর পুতুলের হাতগুলোও সাথে করে নিয়ে গিয়েছে। ওগুলো যে হাত তা কারোর বুঝতে পারার কথা না। কারন ওগুলোতে কোন আঙুল ছিল না, স্রেফ কাপড় দিয়ে পেঁচানো তুলোর বল। কিন্তু তারপরেও চোর সেগুলো হাতগুলোর সাথে নিয়ে গিয়েছে।

শুধুমাত্র একজনের পক্ষেই জানা সম্ভব, ওগুলো হাত…এমন একজন যে ঘটনাক্রমে হাত কাটা পুতুলটা খুঁজে পেয়েছে। পুতুলটা পাওয়ামাত্র নিশ্চয়ই সে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে বুঝে ফেলেছে যে, সিনোহারাই কাটা হাতের কেসের কালপ্রিট।

সিনোহারা ওর কাঁধে হাত রাখল। মেয়েটা আস্তে করে ওর দিকে ফিরল। “কি ব্যাপার?”

ভালো অভিনয় করতে পারে, সিনোহারা ভাবল।

সে কেমিস্ট্রি অফিসের ময়লার ঝুড়িতে পুতুলটা ফেলে দিয়েছিল। মোরিনো ছাড়া আর কারো সেটা হাতে পাওয়ার কথা নয়। ল্যাব পরিস্কার করার পুরোটা সময় সে লেকচার হলে ছিল। অন্য যে ছেলেটা পরিস্কার করার কাজে সাহায্য করছিল তার সময় ছিল না ময়লার ঝুড়ি ঘেঁটে দেখার।

“মি. সিনোহারা আপনার হাতটা সরান প্লিজ। আমার পড়ায় সমস্যা হচ্ছে।”

এই মেয়েটা সবসময় লেকচার হলের কোণায় বসে বই পড়ে। ও ভুরু কুচকাল-মেয়েটার চেহারায় এতটা অভিব্যক্তিও সিনোহারা আগে দেখেনি।

আগেরদিন সিনোহারা কিবোর্ড পরিস্কার করতে গিয়ে একটা লম্বা কালো চুল পেয়েছিল। সারা বাড়ির সব জায়গা বাদ দিয়ে চুলটাকে উড়ে এসে কিবোর্ডের উপরই পড়তে হল? ব্যাপারটা কি কাকতালীয় কিছু হওয়া সম্ভব? সিনোহারার নিজের চুল ছোট। সুতরাং চুলটা তার নিজের হতে পারে না। তার মানে অনুপ্রবেশকারী যেই ছিল তার ছিল লম্বা চুল।

আর বইয়ের সেলফে…মেয়েটা যেই বইটা পড়ছে তার পরবর্তি খন্ড ওর সেলফে ছিল। কিন্তু সেলফে একটু বেরিয়ে ছিল বইটা। ভালো করে খেয়াল না করলে চোখে পড়বে না। সিনোহারা সবসময়ই ওর বইগুলো একদম নিখুঁতভাবে গুছিয়ে রাখে, কোন বই পাঁচ মিলিমিটার বেরিয়ে থাকবে তা হতেই পারে না। নিশ্চয়ই মেয়েটা বইটা দেখতে পেয়ে বের করে হাতে নিয়েছিল।

ওর মনে কোন সন্দেহ নেই মোরিনোই ওর হাতগুলো চুরি করেছে।

সিনোহারা মোরিনোর কাঁধে ওর মুষ্টি আরো জোরালো করল, যেন ভেঙেই ফেলবে।

মোরিনো সঙ্কুচিত হয়ে গেল।

“হাতগুলো কোথায় রেখেছ বল আমাকে,” যতটা সম্ভব ভদ্র গলায় সিনোহারা হুকুম দিল।

কিন্তু মোরিনো তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গেল, বলল ব্যথা পাচ্ছে সে। যে বইটা পড়ছিল সেটা মাটিতে পড়ে গেল।

“হাতগুলো কোথায়?” সে আবার প্রশ্ন করল, চাপ একটু কমাল যাতে মেয়েটার কানে কথা যায়। মেয়েটা এমনভাবে মাথা নাড়ল যেন ও কি নিয়ে কথা বলছে বুঝতে পারছে না।

না জানার ভান করছে, ভাবল সিনোহারা। সাথে সাথে হাত দিয়ে মেয়েটার সরু গলাটা টিপে ধরল সে।

মোরিনোর চোখগুলো মনে হচ্ছিল বেরিয়ে আসবে, অবাক হয়ে গেছে ঘটনার আকস্মিকতায়। সিনোহারা ওকে খুন করতে যাচ্ছে, কেউ বাঁচাতে পারবে না। ও হাতের চাপ বাড়াল। মিনিট খানেকের মধ্যেই মেয়েটার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসবে-ব্যাপারটা চিন্তা করে ও একটু উৎফুল্ল বোধ করছিল। এমন সময় মেয়েটার হাতে একটা ছোট সিলিন্ডার চোখে পড়ল, কোন ধরনের স্পে। কিন্তু যখন সে খেয়াল করল তখন যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে, মোরিনো ওর চোখের দিকে তাক করে স্প্রে করে দিয়েছে। হিস হিস শব্দের সাথে মনে হল ওর চোখগুলোতে আগুন ধরে গেল।

***

মোরিনোর সাথে সবসময় একটা মরিচের পানির স্প্রে ক্যান থাকে। সে সেটা মি. সিনোহারার মুখের উপর স্প্রে করে দিল। তারপর সাহায্য চাওয়ার আগে একটা চেয়ার তুলে তার মাথায় বাড়ি লাগাল। কোন চিৎকার করেনি-স্রেফ শান্তভাবে জোর গলায় সাহায্য চেয়েছে।

এক মিনিট পর কিছু শিক্ষার্থী আর শিক্ষকেরা দৌড়ে এল। ভিড়ের মাঝখানে পড়ে মি. সিনোহারা তার চোখ ডলছিলেন।

পোডিয়ামের নিচের লুকানো জায়গা থেকে বের হতে আমাকে ভিড় সরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো।

উপসংহার

মি. সিনোহারা গ্রেফতার হলেন। কিন্তু কাটা হাতের কেসের অপরাধি হিসেবে নয়। বরং এরচেয়ে অনেক কম একটা অপরাধি জন্য শাস্তি দেয়া হল তাকে। কেউ তার আসল অপরাধ টের পায়নি, অন্তত এখন পর্যন্ত নয়।

তিনি আর আমাদের শিক্ষক নেই, স্কুল ছাড়তে হয়েছে তাকে। এখন পর্যন্ত নতুন কোন হাত কাটা ভিক্টিম পাওয়া যায়নি।

সে হাতগুলো আমি চুরি করেছিলাম সেগুলো বাড়ির পেছনের উঠোনের মাটি খুঁড়ে চাপা দিয়েছি। ওগুলোর কোন প্রয়োজন নেই আমার। হাতগুলোর প্রতি উনার যেরকম ভালবাসা ছিল, আমার সেরকম কিছু ছিল না।

আমি তাকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলাম যে মোরিনো তার হাতগুলো চুরি করেছে।

যখন আমি রেফ্রিজারেটরে হাতগুলো দেখলাম তখন নিশ্চিত হয়েছিলাম আমার ধারণা মতই তিনি হাত কেটে সংগ্রহে রাখেন। তার বাসায় ঢোকার আগেই আমার পরিকল্পনা ছিল পুতুলের হাতগুলো ব্যবহার করে তার সন্দেহ মোরিনোর উপর ফেলার। আমি খুশি যে তিনি বুদ্ধিমানের মত (?) পুতুলের হাতের সূত্র ধরতে পেরেছিলেন। আমি যে ময়লার ঝুড়ি অদল বদল করতাম সেটা তার জানা ছিল না।

কালো চুলটাও আমি ফেলে এসেছিলাম-মোরিনোর চুল যেরকম দেখতে। আসলে সেটা ছিল আমার বোনের চুল। আমার মনে আছে মি, সিনোহারা তার অফিসের কম্পিউটার কমপ্রেসড বাতাসের ক্যান দিয়ে পরিস্কার করছিলেন। সুতরাং আমি আশা করছিলাম বাসার কম্পিউটারের কিবোর্ডের উপর থাকা চুলটা তার চোখে পড়বে।

সেটা যদি চোখে নাও পড়ে সেজন্য বাড়তি ব্যবস্থা ছিল বইটা একটু এগিয়ে রাখা।

আমার ইচ্ছা ছিল মি. সিনোহারাকে নিশ্চিত করা যে মোরিনো তার হাতগুলো চুরি করেছে, যাতে তিনি ওর হাতগুলো কেটে ওকে খুন করে ফেলেন। তাহলেই পরিকল্পনাটা সম্পূর্ণ হতো। তারপর তিনি কাটা হাতগুলো ফ্রিজে নিয়ে রাখতেন আর আমি সেগুলো চুরি করতাম। অবশ্য এই পরিকল্পনায় কিছু ফুটো ছিল। এমন কোন গ্যারান্টি ছিল না যে, তিনি ওকে খুন করলেও হাতগুলো বাসায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু ভালো সম্ভাবনা ছিল।

মোরিনোর সুন্দর সাদা ফ্যাকাসে হাতগুলো শুধু পেতে চাইছিলাম আমি।

“তুমি কি আমাকে শেখাবে কি করে এরকম হাসি দাও?” পরেরদিন সে আমাকে প্রশ্ন করল। সেবারই প্রথম মোরিনো আমার সাথে কথা বলে।

কারো সাথে কথা বলার সময় হাসি আমি। কিন্তু ভেতরে আমার কোন অভিব্যক্তি থাকে না-মোরিনো কোনভাবে সেটা ধরতে পেরেছিল। যে। অভিনয় আর কেউ বুঝতে পারেনি সেটা ওর চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি।

এরপর থেকে আমরা দুজনই কথা বলার জন্য কোন সঙ্গি পেলাম। আমাদের সম্পর্ক অনেকটাই শীতল ধরনের, বন্ধুত্ব বললে ভুল বলা হবে-কিন্তু ওর সাথে কথা বলার সময় আমার কোন অভিনয় করার প্রয়োজন পড়ত না। অভিব্যক্তিহীন চেহারায় থাকতে পারতাম। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে একটা তৃপ্তিকর অনাগ্রহ ধরনের ব্যাপার ছিল, যে কারনে আমি আমার অমানুষিক আর অনুভূতিহীন চেহারা প্রকাশ করতে পারতাম।

***

গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হতে না হতেই সবাই কাটা হাতের কেসের কথা বেমালুম ভুলে গেল। এদিকে আমাদের দ্বিতীয় সেমি. শুরু হলো।

সূর্যাস্তের আলোয় ক্লাসের ভেতরটা হলুদ হয়ে আছে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস এসে আমার সামনে বসা মোরিনোর কালো লম্বা চুলগুলো নিয়ে খেলছে।

“তো এই মুভিটায় সত্যিকারের বিকলাঙ্গদের অভিনয় করানো হয়েছে। কাহিনিটাও অদ্ভুত, ওরা একটা দেহাবশেষ বহন করছিল, “

ও যখন বলছিল, আমি তখন বিড়বিড় করে মুভিটার নাম বললাম। মোরিনোকে একটু অবাক দেখাল। ওর অভিব্যক্তিতে তেমন কোন বদল না হলেও আমি ঠিকই ধরতে পেরেছিলাম।

“একদম ঠিক।”

একজন জার্মান মহিলা মুভিটা বানিয়েছেন। আমি যত মানুষকে চিনি তার মধ্যে খালি মোরিনো আর আমারই এই ধরনের অস্বাভাবিক ব্যাপার স্যাপারে আগ্রহ রয়েছে।

“তোমার কি কাটা হাতের কেসের কথা মনে আছে?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“গত বসন্তের সময়ে যেটা ঘটেছিল?”

“সেসময় তুমি যদি ভিক্টিমদের একজন হতে তাহলে এখন কী করতে?”

মোরিনো ওর হাতগুলোর দিকে তাকাল। “ঘড়ি পরা অনেক কঠিন হয়ে যেত। কেন জিজ্ঞেস করছ?” বলল সে, একটু দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল ওকে।

ওর কোন ধারণা নেই যে লোকটাকে ও ধরাশায়ী করেছিল কাটা হাতের কেসের অপরাধি সে-ই ছিল। আমি মাঝে মাঝে ওর হাতগুলোর দিকে নজর দেই। হয়তো ভালই হয়েছে মি. সিনোহারা ওগুলো কাটতে পারেননি বলে। ওগুলোকে হয়তো জ্যান্তই বেশি ভালো দেখায়-কে জানে মি, সিনোহারা হয়তো কাটতে গিয়ে ওগুলোকে ভুল জায়গায় কেটে ফেলতেন।

“এমনি,” আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম।

ওর হাতগুলো আমি চাইছিলাম, কারন ওগুলোতে সুন্দর একটা দাগ আছে। ও যখন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সেসময়ের ক্ষত থেকে সৃষ্ট দাগ।

৩. সারমেয়

সারমেয়

আমার প্রতিপক্ষ রক্তক্ষরণ নিয়ে ঘাসের আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ওর চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরে আসা আমার জন্য কোন ব্যাপারই ছিল না। চতুষ্পদ জন্তুটি আঘাতের পর আঘাতে বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল, দ্রুত নড়াচড়া করার কোন অবস্থা ওর ছিল না।

আমার মনে হল ওর কষ্টের পরিণতি টানার সময় হয়ে এসেছে। পাল্টা আঘাত করার ক্ষমতা আর নেই।

জটার গলা আমার দুই চোয়ালের মধ্যে নিলাম। ঘাড় ভাঙার শব্দ মুখ বেয়ে উঠে এসে সারা শরীরে শিহরণ জাগাল। জন্তুটা স্থির হয়ে দলার মত আমার মুখ থেকে ঝুলতে লাগল।

আমি কোন দয়া প্রদর্শন করিনি। যদিও এসব কিছু করতে চাইনি, একদমই না-কিন্তু ইয়ুকা চেয়েছে আমি করি, সুতরাং আমাকে আমার প্রতিপক্ষকে খুন করতেই হলো।

চোয়াল হাঁ করলাম, জন্তুটার মৃতদেহ ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। একদম নিখুপ, চোখ দুটোয় আলো নিভে গিয়েছে।

জোরে হুংকার ছাড়লাম।

ইয়ুকা আর আমি চারপেয়ে জন্তুটাকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম, এই ব্রিজের নিচে। আমরা যাচ্ছিলাম, তখন একটা বাড়ির সামনে থেকে ইয়ুকা চুপচাপ ওটাকে তুলে এনেছিল। কেউ দেখেনি। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি জন্তুটা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

ইয়ুকা বলেছিল, “আজকের রাতের শিকার হবে এটা।”

এমন না যে, আমি ইয়ুকার শব্দগুলো বুঝতে পারি, কিন্তু তারপরেও জানতাম ও কী বলছিল আমাকে।

এসব ঘটনা সবসময় রাতের বেলায় হয়। প্রতিদিন না, মাঝে মাঝে। এখন পর্যন্ত কতবার হয়েছে আমার মনে নেই। শহর থেকে আমরা কোন একটা শিকার জোগাড় করি, তারপর ব্রিজের নিচের এই গোপন জায়গায় নিয়ে আসি। এই জায়গার কথা আমি আর ইয়ুকা ছাড়া কেউ জানে না। তারপর ইয়ুকা চায় জন্তুটার সাথে আমি লড়াই করি।

আমি ওর আদেশমত কাজ করি। প্রতিপক্ষের দিকে ছুটে যাই, আঘাত করে শুইয়ে ফেলি। যেসব চারপেয়ে প্রাণীর সাথে আমি লড়াই করেছি সবগুলোই আমার চেয়ে আকারে ছোট ছিল, সুতরাং ওদেরকে কাবু করতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। আমার আঘাতে ওগুলোর হাড় ভেঙে যায়, রক্ত ছিটকে পড়ে।

যখন আমি জিতি, ইয়ুকা হাসে। ওকে অনেক খুশি দেখায়। শব্দ দিয়ে হয়তো যোগাযোগ হয় না আমাদের মধ্যে, কিন্তু ওর অনুভূতিগুলো ঠিকই নদীর পানির মত আমার মধ্যে দিয়ে বয়ে যায়। যে কারনে ও খুশি হলে আমি সবসময়ই বুঝতে পারি।

যখন অনেক ছোট ছিলাম তখন থেকেই ইয়ুকা আমার বন্ধু। ওর সাথে। যখন প্রথম দেখা হল তখন আমি আমার মায়ের গা ঘেসে ঘুমাচ্ছিলাম। ইয়ুকা আগ্রহের সাথে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা।

আমার হুংকারের অর্ধেকটা রাতের আকাশে মিলিয়ে গেল। বাকি অর্ধেক ব্রিজের নিচে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল। উপরের দিকে তাকিয়ে আমি খালি রাতের কালি ঘোলা আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না।

নদীটা বেশ চওড়া ছিল। ব্রিজটাও বিশাল। নদীর তীরে ব্রিজের আশেপাশে লম্বা লম্বা ঘাসের সমুদ। কোথাও যেতে হলে সেগুলো ঠেলে যেতে হয়। কিন্তু ব্রিজের নিচে জায়গাটা খোলা, গোলাকৃতির, কোন ঘাস নেই। কারন সূর্যের আলো সেখানে পৌঁছতে পারে না। আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি এখানে।

গ্রীষ্মের একদিনে আমি আর ইয়ুকা জায়গাটা খুঁজে পেয়েছিলাম। খোলা একটা জায়গা, চারপাশে লম্বা ঘাসের দেয়াল। সেই থেকে জায়গাটা আমাদের খেলার গোপন জায়গা।

কিন্তু এখন এখানে ইয়ুকা আমাকে লড়াই করতে বলে।

আমি কোন প্রাণীকে আঘাত করতে কিংবা খুন করতে চাই না, কিন্তু ইয়কা চায় আমি করি। ও যখন আমাকে আদেশ দেয় তখন ওর চোখগুলো রাতের মত গাঢ় হয়ে যায়, সেখানে কোন আলো থাকে না।

ইয়কা গোলাকৃতি জায়গাটার কোণায় বসে এতক্ষন ধরে সবকিছু দেখছিল। এখন সে উঠে দাঁড়াল। বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। ও কি ভাবছে আমি বুঝতে পারছিলাম। আমাদের মধ্যে অন্যরকম একটা যোগাযোগ রয়েছে যা কিনা সকল ভাষার বাইরে।

মৃতদেহটা তুলে নিয়ে ভোলা জায়গাটার বাইরে একটা গর্তে ফেললাম আমি। ছোট শরীরটা গড়াতে গড়াতে নিচে নেমে গেল। গর্তটা তেমন গভীর না কিন্তু তলাটা ছিল অন্ধকার, উপর থেকে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। লাশটা নিচে পড়ার শব্দ কানে ভেসে এল।

জায়গাটা যখন আমরা খুঁজে পেয়েছি তখন থেকেই গর্তটা এখানে ছিল। কেউ হয়তো কোন কারনে খুঁড়েছিল, হয়তো কোন কিছু পুঁতে রাখার জন্য। অন্ধকারের কারনে কিছু দেখা না গেলেও গর্তটা এখন মৃত জন্তুর লাশে পূর্ণ, যেগুলোকে খুন করতে আমাকে বাধ্য করেছে ইয়ুকা! গর্তের কাছাকাছি গেলে জঘন্য দুর্গন্ধ নাকে এসে বাড়ি মারে।

প্রথমবার যখন ব্রিজের নিচে আমরা এরকম কাজ করেছিল, ইয়ুকা আমাকে আদেশ করেছিল লাশ নিয়ে গর্তে ফেলতে। তখন আমি ঠিকমত লড়তে জানতাম না, প্রতিপক্ষের মতই বেশ আঘাত পেয়েছিলাম। প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়ে মাথার ভেতরটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল, বুঝতে পারছিলাম না কি করব। কিন্তু এখন আমি লড়াইয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছি। শান্তভাবে এখন আমার প্রতিপক্ষের জান কবচ করতে পারি। আমাকে দক্ষ হয়ে উঠতে দেখে ইয়ুকাও খুশি।

কামড়াকামড়ির সময় প্রতিপক্ষের শরীরের নোম আমার মুখে রয়ে গিয়েছিল। আমি সেটা গিলে ফেলে ঘাস ঠেলে পানির দিকে এগুলাম। পানির রং কালো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে নদী নয় বরং অন্ধকার ভেসে যাচ্ছে। ব্রিজের আলো অপর পাড়ের পানিতে আলো ফেলছিল।

পানি দিয়ে মুখে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে নিয়ে ইয়ুকার কাছে ফিরে গেলাম।

“যাওয়ার সময় হয়েছে,” ইয়ুকা সিঁড়ির দিকে এগুতে এগুতে এরকম কিছু একটাই বলল।

সিঁড়িটা আড়াআড়িভাবে ব্রিজের দিকে উঠে গিয়েছে। খোলা জায়গাটা থেকে সিঁড়ির কাছে যেতে লম্বা ঘাসগুলো ঠেলে সরিয়ে যেতে হয়। আমি দৌড়ে ওর পাশে গেলাম। আমরা একসাথে হাটি।

সিঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছুতেই আমার মনে হল কিছু ঘাস নড়তে দেখলাম-ঘাসের মাথা হালকা দুলছে। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। চিন্তিত হয়ে উঠলাম। ভালো করে কান পেতে শুনলাম। কিন্তু না। মনে হয় বাতাসের জন্য।

ইয়ুকা ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে উপরে পৌঁছে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওর কাছে গেলাম, আমাদের গোপন জায়গাটা পেছনে পড়ে রইল।

***

স্কুলের পর স্টেশনের সামনে গিয়ে আমার ক্লাসমেট মোরিনোর সাথে দেখা করলাম। টারমিনালের কাছে একটা বড় বাস দাঁড়ানো। পাশেই ফোয়ারা আর কিছু ফুল গাছ। কয়েকটা বেঞ্চও আছে, কিছু লোকজন সেখানে বসে অলস সময় ব্যয় করছিল।

মোরিনো ঐ বেঞ্চগুলোর একটায় বসে ছিল। রাস্তা থেকে সবচেয়ে দূরে ছিল যেটা, সেটা গাছপালার ছায়ায় ঢাকা। হাতে সময় থাকলেই ও বই নিয়ে বসে থাকে। আজকে অবশ্য কোন বই পড়ছে না। বইটা বন্ধ করে পাশে রাখা।

মোরিনো সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। মাথা নামানো। ঘন কালো চুলগুলোর পেছনে ওর চেহারা ঢাকা পড়ে গেছে, পর্দার মত।

কাছাকাছি যেতেই ও মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। ওর ত্বক পোরসেলিনের মত ফ্যাকাসে সাদা, যেন কোনদিন সূর্যের আলো পড়েনি। বাম চোখের নিচে ছোট্ট একটা তিল। ওর অঙ্গভঙ্গি পুতুলের মত, মনে হয় যেন কোন জীবন নেই। নড়াচড়া না করলে দোকানে রাখা ম্যানিকুইন বলে চালিয়ে দেয়া যাবে ওকে।

ও চুপচাপ নিচের দিকে ইশারা করল। ওর পায়ে কিছু কাদা লেগে ছিল। ভালো করে তাকাতে মনে হল কিছু একটা নড়ছে।

একটা প্রজাপতির দেহাবশেষ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কিছু পিপড়া। পাথরের ছায়ার ভেতর মনে হচ্ছিল কোন ইয়ট ভেসে যাচ্ছে। মোরিনো একদৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে।

এই জায়গায় আমাদের দেখা করার পেছনে বিশেষ কোন কারন নেই। হয়তো সুবিধা হত যদি আমরা একসাথে স্কুলের পর বের হতাম। কিন্তু মোরিনো আবার একটু বেশি বিখ্যাত মানুষ। ও যেরকম দেখতে আর ওর যে ভাবভঙ্গি, ওকে নিয়ে সবসময় গুজব ঘুরপাক খায়। ও হেঁটে গেলে লোকজন ঘুরে ওর দিকে তাকায়। আমি চাই না কেউ আমাকে ওর সাথে দেখুক।

মোরিনোর অবশ্য এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। ও সবার সাথেই একই রকম আবেগহীন, অভিব্যক্তিহীন ব্যবহার করত। মনে হত মানুষের যে নার্ভগুলো দুশ্চিন্তা করে, ওর সেগুলো অনেক আগেই কোনভাবে পুড়ে টুরে গিয়েছে বা এরকম কিছু। অথবা এমনও হতে পারে ও হয়তো কখনো খেয়ালও করেনি লোজন ওরদিকে তাকিয়ে থাকে। ও কখনো কখনো এরকম উদাসই থাকে।

“চল,” বলেই হাঁটা শুরু করল ও।

আমিও হাঁটতে লাগলাম ওর সাথে সাথে। ও যেই বইয়ের দোকানে। নিয়মিত যায় সেটা আজকে আমাকে চিনিয়ে দেয়ার কথা।

আমি যখন ওকে দোকানের নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, তখন ও বলেছিল-”খুবই ছোট দোকান, আমি ছাড়া কোন ক্রেতা নাই।” দোকানটা কোথায় হতে পারে তার একটা সাধারণ ধারণা দিয়েছিল আমাকে, কিন্তু কাজ হয়নি। তারপর আমি ওকে বললাম একটা ম্যাপ এঁকে দিতে। ও এমন এক ম্যাপ আঁকল যেটার সাথে এই পৃথিবীর কোন জায়গার কোন মিল পাওয়া গেল না, খুঁজে পাওয়া তো পরের কথা। আরো আঁকাআঁকির পর দোকানটা গিয়ে নদীর মাঝখানে দাঁড়াল। সেটা কিভাবে সম্ভব তার কোন ব্যাখ্যাও দিতে পারল না ও। শেষে আমরা ঠিক করলাম ও নিজেই আমাকে সরাসরি সেখানে নিয়ে যাবে।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে দোকান ছাড়িয়ে ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে যেতে লাগলাম। সেদিন আকাশ একদম পরিস্কার ছিল, পিঠে সূর্যের তাপ টের পাচ্ছিলাম। রাস্তাটা সোজা চলে গেছে। দুই ধারে মধ্যম আয়ের লোকজনের ঘরবাড়ি সারিসারি দাঁড়ানো। মোরিনোর হাঁটা দেখে মনে হল সে প্রায়ই এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করে।

“তুমি কি কুকুর কিডন্যাপিং সম্পর্কে কিছু শুনেছ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“কুকুর কিডন্যাপিং?” সে প্রতিধ্বনি তুলল। কিছু শোনেনি।

আমি ওকে বিস্তারিত জানালাম। আমাদের এলাকা থেকে বেশ কিছুদিন ধরে অনেকগুলো পোষা কুকুর নিখোঁজ হয়েছে। সকালে বাসায় বাবা-মাকে এই নিয়ে আলাপ করতে শুনেছি।

“এইবারই তো প্রথম না,” মা বিড়বিড় করছিল। আমি সবসময় খবরের দিকে নজর রাখি, কোন আজব কিছু ঘটলে মনোযোগ দিয়ে শুনি। কিন্তু এলাকার গুজব-টুজৰ আমার মায়ের চেয়ে ভালো কেউ জানে না।

তার বক্তব্য অনুসারে, সপ্তাহে দুইদিন-বুধবার আর শনিবার সকালে-যেসব লোকজন ঘরের বাইরে তাদের পোষ প্রানীগুলো রাখে তাদের অনেকেরই পোষা প্রাণী নিখোঁজ হচ্ছে। তার মানে সেগুলো মঙ্গলবার আর শুক্রবার চুরি যায়। এখন পর্যন্ত চুরি যাওয়া সবগুলো পোষাপ্রাণীই হচ্ছে কুকুর। যে কারনে লোকজন এখন ভয়ে তাদের কুকুরগুলোকে রাতেরবেলা ঘরের ভেতর রাখছে।

মোরিনো আগ্রহসহকারে আমার কথা শুনল। পুরোটা বলা শেষ হওয়ার পর জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু?” আমি মাথা নাড়লাম। ও মনে হল ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে।

কুকুর কিডন্যাপিংয়ের ব্যপারে ওর আগ্রহ দেখে একটু অবাকই হলাম। ওর মুখে কখনো কোন পোষা প্রাণীর নাম নিতে শুনিনি। না কুকুর, না বিড়াল, হ্যামস্টার পর্যন্ত না। জন্তু-জানোয়ারের প্রতি ওর কোন মায়া মমতা আছে বলে আমার মনে হয়নি।

“কিডন্যাপার ঐ জিনিসগুলোকে কিডন্যাপ করে কি করে?”

“জিনিস মানে?”

“ঐ যে, ওইসব আর কি, চার পা ওয়ালা নোংরা জিনিস, অনেক চেঁচামেচি করে যে।”

ও কি কুকুর বোঝাতে চাইল?

মোরিনো দূরে তাকিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করল, “আমার মাথায় আসে না কেন কেউ এতগুলো জিনিসকে একসাথে জড়ো করবে? ওগুলো নিয়ে সে কি করতে চায়? কোন ধরনের সৈন্যদল বানানোর ইচ্ছা নাকি? গোলমেলে ব্যাপার।”

ও নিজের মনে কথা বলছিল বলে আমি কোন উত্তর দিলাম না।

“দাঁড়াও,” ও হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল।

আমিও থামলাম।

বাঁক নেয়ার আগে তখনো আমাদের সামনে বেশ খানিকটা রাস্তা পড়ে আছে। কী সমস্যা বোঝার জন্য ওর দিকে তাকালাম আমি।

“চুপ,” ঠোঁটে এক আঙুল তুলে বলল সে।

ওর সমস্ত ইন্দ্রিয় এতটাই সজাগ যে, মনে হল যেকোন পরিস্থিতির জন্য তৈরি। আমার মনে হলো ওর কানগুলো মনে হয় কিছু শোনার চেষ্টা করছে।

আমিও শোনার চেষ্টা করলাম, অস্বাভাবিক কোন কিছু কানে ধরা পড়ল না। দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে। সাধারণ এক নিস্তব্ধ দুপুর। সূর্যের গরম আলো পিঠে এসে পড়ছিল।

“না আমরা এই দিক দিয়ে আর যেতে পারব না,” অবশেষে ও ঘোষণা দিল।

আমি সামনে তাকালাম। কোন রকম বাঁধা দেখা গেল না, কোন কন্সট্রাক্সনের কাজ চলছে বা কিছু, এমনকি আমাদের পাশ কাটিয়ে এক বুড়ো লোক সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।

“বুকস্টোরের জন্য বেশি হয়ে যাচ্ছে। এই রাস্তা দিয়ে…”

আমি ওর কাছে কারন জানতে চাইলাম। কিন্তু স্রেফ মাথা নাড়ল সে। তারপর যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকেই হাঁটা শুরু করল।

নিজের মনের কথা মত চলার অদ্ভুত এক প্রবণতা আছে মোরিনোর মধে। কে কী ভাবল তাতে ওর কিছুই আসে যায় না। ক্লাসের আর কারো সাথে মেশে না, ওকে নিয়ে কে কী বলল তাতে কান দেয় না। অবসর সময়টা ও একাকি কাটায়, মুখে কোন অভিব্যক্তি ছাড়া। কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে বিপর্যস্ত দেখাল…নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়েছে।

আমি চারপাশে আরেকবার ভালো করে তাকালাম। রাস্তার দুধারে ঘরবাড়ি। একটা বাড়ির গেটের ভেতর একটা ডগ হাউজ দেখলাম। একদম নতুন। নতুন কুকুর এনেছে নাকি? কুকুরের কোন শব্দ পেলাম না। ভালোমতো শোনার চেষ্টা করলাম।

অনেকক্ষণ সময় লাগল আমার বুঝতে।

ইতিমধ্যে মোরিনো অনেকখানি সামনে চলে গিয়েছে। আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম কিন্তু ও আবারো থামল। এক হাত তুলে আমাকে সংকেত দিল।

“বিপদ! আমরা আর সামনে এগুতে পারব না।” সে সোজা সামনে তাকিয়ে আছে, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। আমাদেরকে ঘিরে ফেলা হয়েছে,” গোঙানির মত শব্দ করল ও। টেনশন টের পাওয়া যাচ্ছিল ওর কথা বলার মধ্যে।

একটা বাচ্চা মেয়ে আর বড় একটা কুকুর আমাদের দিকে হেঁটে আসছিল।

কুকুরটা গোল্ডেন বিট্রাইভার প্রজাতির। শরীরে সুন্দর পশম। গলায় ফিতে লাগিয়ে মেয়েটা ওকে নিয়ে যাচ্ছিল। ছোট, শুকনো ধরনের একটা মেয়ে, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল। চুলগুলো প্রতি পদক্ষেপে দুলছিল। মেয়েটা মনে হচ্ছে মাত্র থার্ড গ্রেডে পড়ে।

আমাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটার কুকুরের সাথে আমার চোখাচোখি হল-বড়, কালো গভীর চোখ। নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম সেখানে। মনে হচ্ছিল আমাকে ঐ চোখগুলো টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে নেবে, ব্ল্যাকহোলের মত।

মেয়েটা আর কুকুরটা আমাদের পেছনে ফেলে কাছের একটা লাল চালার একতলা বাড়িতে গিয়ে ঢুকল।

“আমি এসেছি,” মেয়েটার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম আমি। গোল্ডেন বিট্রাইভারটাও মেয়েটার সাথে সাথে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সামনের উঠোনে কোন ডগ হাউজ নেই, তার মানে কুকুরটা ঘরের ভেতরেই থাকে।

মেয়েটা আর তার কুকুরটা অদৃশ্য হয়ে গেলে মোরিনো দেয়াল থেকে সরে (এতক্ষন ও দেয়ালের সাথে লেপ্টে ছিল) হাঁটা শুরু করল, যেন কিছুই হয়নি। আমার মনে হচ্ছিল কিছু বলবে, কিন্তু কিছু বলল না। ও এরকমই, দৈনন্দিন জীবনের সাথে খাপ খাওয়ানো ওর জন্য বিশাল সমস্যা।

“আমার কোন ধারনাই ছিল না এই রাস্তায় এত বিপদ,” মোরিনো গজগজ করতে করতে বলল।

আমি জানতে চাইলাম অন্য কোন রাস্তা দিয়ে ঐ বইয়ের দোকানে যাওয়া সম্ভব কিনা, কিন্তু জানা গেল অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হলে অনেক ঘুরে যেতে হবে। মোরিনো ইতিমধ্যে আমাকে সেখানে নেয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে।

ওর পিছু যেতে যেতে আমি আবার নিখোঁজ কুকুরগুলোর কথা চিন্তা করলাম। কেন সপ্তাহে দু-বার? আর কেনই বা শুধু শুক্র আর মঙ্গলবার রাতে? নিখোঁজ কুকুরগুলোর পরিণতি কি?

মোরিনো আর আমি অদ্ভুত সব কেস খুঁজে বের করি, যেগুলোয় জড়িত ব্যক্তিরাও অদ্ভুত-ডার্ক। দুঃখজনক মৃত্যু যা মানুষের হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়, যেসব মৃত্যু এতটাই নিষ্ঠুর যে শুনলে লোকজন চিৎকার করে উঠতে চায়-সেরকম যে কোন ঘটনার প্রতি আমাদের সীমাহীন আগ্রহ। আমরা খবরের কাগজ থেকে এসব আর্টিকেল কেটে রাখি। মানুষের মনের গভীরের অন্ধকার কুয়ায় ডুব দিতে ভালো লাগে আমাদের।

বেশিরভাগ মানুষ এধরনের আগ্রহ হজম করতে পারে না-কিন্তু আমাদের কাছে ব্যাপারটা যাদুবিদ্যার মত আকর্ষণীয় মনে হয়।

এইবার অবশ্য কোন অস্বাভাবিক কেস বলা যাবে না, কুকুর হারানোর সাধারণ কেস। কিন্তু ঘটনাগুলো ঘটেছে আমাদের বাসার খুব কাছে। ঘরের পাশের ছোট ঝামেলা বরং অন্য দেশের বড় ঝামেলার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়।

“তুমি কি জাতে আগ্রহি, কে এই কুকুরগুলোকে চুরি করছে?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“যদি জানতে পার, আমাকে জানিয়ে, সে তার অভিব্যক্তিহীন চেহারা নিয়ে বলল। আমি ধরে নিলাম সে এর মধ্যে জড়িত হতে চায় না…বিশেষ করে যেখানে কুকুর জড়িত।

***

ইয়কা আর আমি আম্মুর সাথে থাকি। কিন্তু আম্মু কখনো বাসায় থাকে না। সকালে বেরিয়ে যায়, ফেরে গভীর রাতে। সারাদিন আমি আর ইয়কা বাসায় থাকি।

আমি যখন একদম ছোট, তখন থেকে ইয়ুকার সাথে আছি। আমার ভাইদেরকে আমার জন্মের পরই সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। তারপর থেকেই আমি ইয়কার সাথে আছি।

বেশিরভাগ সময়ই টিভির সামনে সময় কাটায় ইয়কা। আমি ওর পাশে গিয়ে ওর পিঠে মাথা দিয়ে খবরের কাগজের উপর শুয়ে থাকি।

টিভি দেখতে দেখতে আমরা বিরক্ত হয়ে গেলে উঠে হাত-পা টানটান করি। ইয়ুকা কিচেন আর বাথরুমে ঘোরাঘুরি করে, আমি পিছে পিছে থাকি।

তারপর আমরা বাইরে হাঁটতে যাই। বাইরে হাঁটতে আমার ভালো লাগে-ইয়ুকা আর আমি একসাথে হাঁটি। হাঁটার সময় আমাদের মধ্যে একটা দড়ি থাকে। আমি অন্য দিকে যেতে থাকলে ইয়ুকা আমাকে টেনে ঠিক পথে নিয়ে আসে।

মাঝে মাঝে আরেকজন আমাদের বাসায় আসে, একজন বড় মানুষ। আম্মু সাথে করে নিয়ে আসে তাকে। সে যখন বাসায় থাকে তখন বাতাস কেমন যেন গুমোট লাগে। যে আরামদায়ক বাসায় আমি আর ইয়কা থাকি সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

সে যতবারই আসে, সবসময়ই আমার মাথায় হাত বুলায়, আম্মুর দিকে তাকিয়ে হাসে-কিন্তু কখনো সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকায় না। আমার মাথায় তার হাতের স্পর্শ পেলেই তাকে আমার কামড়াতে ইচ্ছা করে।

ইয়ুকা আর আমি দু-জনেই তাকে ঘৃণা করি। কারন আম্মু যখন থাকে তখন সে সবসময় ইয়ুকাকে আঘাত করে।

প্রথমবার যখন ব্যাপারটা ঘটল, আমি ভেবেছিলাম আমি হয়তো কল্পনা করছি। আম্মু আমাকে আর ইয়ুকাকে লোকটার সাথে এক রুমে রেখে গিয়েছিল কিচেনে গিয়েছিল।

ইয়ুকা লোকটার পাশে বসে ছিল। এমন সময় হঠাৎ লোকটা কনুই দিয়ে ইয়ুকাকে গুতা মারল। ইয়ুকা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।

লোকটা হাসল, মাথা নামিয়ে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল ইয়ুকাকে।

আমি ঘরের আরেক কোণায় ছিলাম, কথাগুলো শুনতে না পেলেও দেখতে পারছিলাম ইয়ুকার চেহারা বদলে যাচ্ছে।

ভয়ের একটা স্রোত আমার শরীর দিয়ে বয়ে গেল। ইয়ুকার কাছ থেকে আমি দূরে বসে ছিলাম ঠিকই কিন্তু আমাদের মন সবসময়ই একজন আরেকজনের সাথে যুক্ত। আমি ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

আম্মু রুমে ফিরে এলে লোকটা থামল। ইয়ুকা ভীত চেহারায় আম্মুর দিকে তাকালেও আম্মু কিছু খেয়াল করল না।

ইয়ুকা সাহায্যের জন্য আমার দিকে তাকাল, কিন্তু আমি সামনে পেছনে আগপিছ করা ছাড়া আর কিছু করতে পারছিলাম না।

এরপর প্রতিবার যখন সে আসত, ইয়ুকার প্রতি তার ব্যবহার খারাপ থেকে খারাপতর হতে লাগল। এমন কি সে কয়েকবার ইয়ুকার পেটে লাথিও মেরেছিল! ব্যথায় মেঝেতে শুয়ে পড়ে কাশছিল ইয়ুকা। দৌড়ে গিয়ে ওর আর লোকটার মাঝে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। লোকটা খুবই বিরক্ত হয়েছিল।

প্রতি সপ্তাহে একই রাত্রে লোকটা বাসায় আসত। ঐ রাতগুলোতে ইয়ুকা আর আমাকে এক কোণায় লুকিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে হতো। সে বাসায় থাকলে চারপাশে কেমন এক অশুভ পরিবেশের সৃষ্টি হতো। ইয়ুকা ভয়ে ঘুমাতে পারত না।

শেষে আমরা আর থাকতে না পেরে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতাম।

লোকটা আসার পর থেকে ইয়ুকা আমাকে জম্ভগুলো খুন করতে বাধ্য করতে লাগল। ও অনেক কান্নাকাটি করত। ওর চোখে অন্যরকম এক আঁধার ভর করেছিল তখন, যা দেখলে অনেক কষ্ট লাগত আমার।

“আমরা বিষয়টা খেয়াল করেছি রাত এগারোটার দিকে,” কোলে থাকা ঘুমন্ত বাচ্চা দোলাতে দোলাতে অল্পবয়সি গৃহিণীটা বললেন। আমরা প্রথমে কিছু ভদ্রতাসূচক সামাজিক কথা-বার্তা দিয়ে শুরু করি। তিনি জানালেন, তাদের বাচ্চার বয়স মাত্র তিন মাস।

“ঘুমাতে যাওয়ার আগে, আমার স্বামী দেখতে গিয়েছিল পাভলভ ঠিক আছে কিনা, তখন খেয়াল করল সে বাড়িতে নেই…” পাভলভ তাদের কুকুরের নাম। দুই সপ্তাহ আগের মঙ্গলবার রাত থেকে সে নিখোঁজ। পিওরব্রিড প্রজাতির কুকুর, যে প্রজাতির নাম আমি আগে কখনো শুনিনি।

ভদ্রমহিলা আর আমি বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। পশ্চিম এলাকার ছোট একটা বাড়ি। আমার বাসা থেকে দূরত্ব এক মাইলের বেশি হবে না।

স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যেসব বাড়ি থেকে কুকুরগুলো নিখোঁজ হয়েছে সেগুলোতে গিয়ে একটু খোঁজ খবর নিব।

মহিলাকে বললাম আমি স্কুলের খবরের কাগজে কাজ করি। আর আশেপাশের এলাকার কুকুর নিখোঁজের ঘটনার উপর তদন্ত করছি। যখন তাকে জানালাম, আমার তদন্ত থেকে অপরাধির ধরা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন তিনি আমাকে সাহায্য করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন।

“এখন মনে পড়ছে, রাত দশটার সিকে পাভলভ কিছুক্ষণ চিৎকার করেছিল। কিন্তু আমরা পাত্তা দিইনি, কারন লোকজন আশপাশ দিয়ে গেলেই ও চিৎকার করে।”

“তাহলে তখনই শেষবার আপনি ওর চিৎকার শুনেছেন?” আমি নিশ্চিত হতে চাইলাম।

মহিলা মাথা ঝাঁকালেন।

দরজার ওখানে দাঁড়িয়ে একটা ছোট উঠোনমত দেখতে পেলাম। এক কোণায় একটা ডগ হাউজ রাখা–মোটামুটি বেশ বড়। কুকুরের ফিতে লাগানোর জন্য বাইরে একটা মেটাল হুক লাগানো আছে।

“কিডন্যাপার তাহলে ফিতে খুলে কুকুরটাকে নিয়ে গিয়েছে?” আমি বললাম।

মহিলা আবারো মাথা ঝাঁকালেন। “তারা ফিতেটা ফেলে গিয়েছে-আর একটা আধখাওয়া চিকেন নাগেট।”

নিশ্চয়ই কিডন্যাপার নাগেটটা ফেলে গিয়েছে, তিনি ব্যাখ্যা করলেন।

যখন আমি জানতে চাইলাম, নাগেটটা কি দোকানের কেনাগুলোর কিনা, তিনি অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বললেন সম্ভবত বাসায় বানানো।

কুকুরটাকে শান্ত করার জন্য কিডন্যাপার বাসা থেকে কিছু একটা নিয়ে এসেছিল, তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আধ খাওয়া চিকেন নাগেট পুরো ব্যাপারটার চেহারা বদলে খুবই সাধারণ রূপ দিচ্ছে। পেশাদার চোররা এরকম কোন ভুল করবে না।

আমি মাথা ঝুঁকিয়ে সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিলাম।

তিনি দুঃখিত চোখে ডগ হাউজের দিকে তাকালেন, “আশা করছি যে কাজটা করেছে তাকে তুমি খুঁজে পাবে।” তার স্বর নিচু থাকলও কথার মধ্যে কোথায় যেন একটা খুনি ক্রোধ লুকানো ছিল।

কোলের বাচ্চাটা হাঁচি দিতে শুরু করলে আমি গুডবাই বলে চলে আসলাম। বের হওয়ার সময় খেয়াল করলাম রাস্তার অপর দিকের বাসাতেও একটা কুকুর আছে। যদিও দরজা লাগানো, তারপরেও কুকুরটা দেখা যাচ্ছিল। একটা বড় কালো কুকুর, আমার অর্ধেক সমান উচ্চতা হবে।

“ওর নাম চকলেট,” তিনি পেছন থেকে বললেন।

আমি বললাম যে ওটা ওখানে ছিল এতক্ষন একদম টের পাইনি।

“হ্যাঁ, ও প্রায় কখনোই চিৎকার করে না।”

পাভলভের চেয়ে চকলেটের ঘর আরও পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। হয়তো কুকুরটা চুপচাপ বলে কিডন্যাপার সেটাকে খেয়াল করেনি।

বাসায় গিয়ে দেখি মা আর আমার বোন সাকুরা, দুজনে মিলে ডিনার তৈরি করছে। মা একটা পাতিলে কিছু নাড়ছে আর বোন সবজি কাটছে।

আমার বোন আমার চেয়ে দু বছরের ছোট, হাই স্কুল ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনিতে সে সারাদিন ক্রাম স্কুলে থাকে, কিন্তু আজকে স্কুল বন্ধ ছিল। গত বসন্ত পর্যন্ত ওর চুল অনেক লম্বা ছিল, কিন্তু এই গ্রীষ্মে কেটে ছেলেদের মত ছোট করে ফেলেছে।

ওর ব্যক্তিত্ব আমার পুরোপুরি উল্টো, বাসার কাজে অনেক সাহায্য করে। কোন কিছুতে সাহায্য করতে বললে কখনো ও ফেলতে পারে না। যেমন, হয়তো আমার মা টিভির সামনে বসে স্নাক্স খাচ্ছে, সাকুরার দিকে তাকিয়ে দু-হাত এক করে বলল, “সাকুরা মা, একটু থালা-বাসনগুলো ধুয়ে দাও না?” সাকুরা প্রথমে রাজি হবে না।

“পারব না! তুমি নিজে কর গিয়ে!”

কিন্তু আমার মা দুঃখি দুঃখি চেহারা করবে, যেন দুনিয়া যেকোন মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সাকুরা তা দেখা মাত্র লাফ দিয়ে উঠবে, “ঠিক আছে। ঠিক আছে! কান্নাকাটি কোরো না,” তারপর গিয়ে থালা বাসন ধুবে। ওদিকে মা আবার টিভি দেখায় ব্যস্ত। আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি সাকুরা কি জানে মা অভিনয় করছে? আমার তো মনে হয় সারাজীবন ওকে বুড়ো বাপ-মা পালতে হবে।

সাকুরার একটা বড় গুণ ছিল, অন্তত আমার কাছে তা মনে হলেও ওর কাছে এটাকে অভিশাপ মনে হতো, সেটা হল বেশিরভাগ সময় ওকে একজন সাধারণ মানুষ মনে হতো।

“তুমি কি আবার গেইম সেন্টারে গিয়েছিলে নাকি?” আমাকে দেখে মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানতে চাইল। ভিডিও গেমস আমার তেমন পছন্দ না, কিন্তু বাসায় দেরি করে ফেরার অজুহাত হিসেবে আমি সেটাকে ব্যবহার করি।

কিচেনে একটা চেয়ার টেনে বসে ওদের রান্নাবান্না দেখতে লাগলাম। ওরা চুপচাপ তাল মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছিল। আমার মা তখন সবজি ফ্রাই করছিলেন, কোন কথা না বলে খালি হাতটা সাকুরার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমার বোন ঠিক জানত মা কি চাইছিলেন, সে লবণ এগিয়ে দিল। মা একটু চেখে দেখলেন ফ্রাই ঠিক আছে কিনা। এরপর তিনি মিরিন (রাইস ওয়াইন) চাওয়ার আগেই সাকরা সেটা এনে দিল।

ওরা দুজনেই আমার সাথে কথা বলছিল, আমিও উত্তর দিচ্ছিলাম। ওরা হাসছিল। সাকুরা একটু জোরেই হাসে, হাসতে হাসতে খাবি খায়।

“আমাদের আর হাসিয়ো না, টেবিলটা গোছও। তো তারপর টিচার কি করলেন?” সাকুরা বলল।

আমি তখন স্কুল নিয়ে বলছিলাম। মাঝে মাঝে আমি খেয়াল হারিয়ে ফেলি কী নয়ে কথা বলছি আর কেনই বা আমার আশেপাশের সবাই হাসাহাসি করছে। যেসব গল্প বলি সেগুলো সেই জায়গায় বসে তখনই বানানো। কিন্তু কখনো ধরা পড়িনি বা কোন সমস্যা হয়নি।

দেখে হয়তো মনে হবে আমি চমৎকার একটা হাসিখুশি পরিবারের সদস্য। বাসার লোকজন মনে করে আমি খুবই মিশুক ধরনের একটা ছেলে-যে কিনা পড়াশোনায় তেমন ভালো না কিন্তু লোকজনকে ভালো হাসাতে পারে।

কিন্তু আমার কাছে যা মনে হয় তা হলো, আমার মা-বোনের সাথে আমার আসলে কোন কথা হয় না। কিছুক্ষণ পরেই আমি ভুলে যাই কি বলছিলাম। মনে হয় যেন আমি সেখানে পাথরের মত বসেছিলাম, কোন কথা ছাড়া, আর আশেপাশের সবাই নড়াচড়া করছে, ফেটে পড়ছে, কোন অদ্ভুত পরাবাস্তব স্বপ্নের মত।

“কিরির কুকুর এখনো নিখোঁজ, থালাবাসন ধুতে ধুতে সাকুরা বলল। আমার কান নড়ে উঠল, এতক্ষন কিছু শুনছিলাম না, হঠাৎ মনে হল কানে কিছু ঢুকছে। “ও ভেবেছিল কুকুরটা নিজে নিজে বাড়ি ফিরে আসবে কিন্তু…”

আমি বিস্তারিত জানতে চাইলাম।

সাকুরা জানাল ওর ক্লাসমেটের কুকুর গত সপ্তাহের বুধবার থেকে নিখোঁজ। সবাই ধারণা করছে কিডন্যাপার তুলে নিয়ে গিয়েছে ওটাকে।

“কিডন্যাপার সম্ভবত এক টুকরো সসেজের লোভ দেখিয়ে ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।”

“ওহ হো,” মা বিড়বিড় করলেন, দোকান থেকে সসেজ কিনতে ভুলে গিয়েছেন তিনি।

“কি কুকুর ছিল? সাইজ কি ছিল?” আমি জানতে চাইলাম।

সাকুরা ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। আমি ভুলে এমন একটা চেহারা করে ছিলাম যেটা সাধারণত পরিবারের সামনে আমার লুকানো থাকে।

“ক-কি হল?” আমি তোতলাচ্ছিল, চাপা দেয়ার চেষ্টা।

“কুকুরটা ছিল একটা মাট, কিন্তু খুবই ছোট ধরনের।”

হঠাৎ মনে হলো, পাভলভের মালিককে এই প্রশ্নটা করতে আমি ভুলে গিয়েছি। কথা শেষ হতেই দৌড়ে দরজার দিকে ছুটে গেলাম। তখনো স্কুলের ইউনিফর্ম আমার পরনে। মা পেছনে থেকে ডাকতে লাগলেন, ডিনারের সময় প্রায় হয়ে গিয়েছে।

পাভলভের বাসায় যখন পৌঁছলাম তখন চারদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। বেল বাজাতে একই ভদ্রমহিলা আবার দরজা খুললেন। এখন অবশ্য কোলে বাচ্চাটা নেই। আমাকে দেখে তিনি বেশ অবাক হলেন।

“আপনাকে আবার বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু একটা প্রশ্ন করতে ভুলে গিয়েছিলাম। পাভলভের সাইজ কেমন ছিল?”

“এটা জানার জন্য আবার এতদুর এসেছো?” হতবুদ্ধি হয়ে বললেন। তারপর জানালেন পাভলভ পূর্ণ বয়স্ক কুকুর ছিল না, ছোটখাটই ছিল।

“তার মানে কুকুরছানার চেয়ে একটু বড়?”

“হ্যাঁ। যদিও ওর প্রজাতির কুকুর অনেক বড় হয়। যেকারনে ডগ হাউজটা বড় কেনা হয়েছে।”

আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম। কিডন্যাপার যখন কুকুরগুলো চুরি করছিল, ফিতেগুলো নেয়নি। তাহলে কুকুরগুলো কিভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কিডন্যাপার নিজের ফিতে নিয়ে এসেছিল? ডগ হাউজ থেকে ফিতেটা খুলে টেনে নিয়ে গেলে ব্যাপারটা কি সহজ হত না? তার মানে কিডন্যাপার কুকুরের গলা থেকে ফিতেটা খুলে কোলে করে নিয়ে গিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল, কেন পাভলভকে চুরি করা হলো, কিন্তু রাস্তার ওপারের চুপচাপ কুকুরটাকে করা হলো না? আমি চোর হলে তো যে কুকুর শব্দ করে তাকেই চুরি করতাম। ব্যাপারটা সবদিক থেকে সহজ হত না?

আমার ধারণা পাভলভকে চুরি করা হয়েছে কারন ও সাইজে ছোট। কোলে করে নিয়ে যাওয়া সহজ ছিল। আমার বোনের বান্ধবির যে কুকুর চুরি হয়েছে সেটাও ছোট ধাঁচের কুকুর। মনে হচ্ছে কিডন্যাপার তাহলে শুধু ছোট ধরনের কুকুরই চুরি করছে।

কিন্তু কেন যেসব কুকুর বহন করা সহজ সেগুলোই চুরি করতে হবে? একটা সম্ভাবনা হলো, কিডন্যাপারের কাছে কোন গাড়ি বা অন্য কোন যানবাহন নেই বড় কুকুর বহন করার মত। হ্যাঁ, ব্যাপারটা খাপ খাচ্ছে। সেজন্যই বড় কুকুর এড়িয়ে যাচ্ছে কিডন্যাপার।

এখন পর্যন্ত যা যা তথ্য জোগাড় করতে পেরেছি তাতে যেসব এলাকার কুকুর চুরি গিয়েছে কোনটাই বড় কুকুর নয়। গাড়িওয়ালা চোর হলে এলাকা বদল করত। এক এলাকায় এত চুরি করে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বাড়াত না।

একটা আর্টিকেলের কথা মনে পড়ল আমার, একটা অ্যানালাইসিস দেখিয়েছিল কারন ছাড়া খুনের উপর। মজা করতে গিয়ে খুন’-আর্টিকেলে খুনির শিকার খোঁজার ধরন নিয়ে বলেছিল। খুনি নিজের অজান্তেই এমন সব শিকার নির্বাচন করত যারা কিনা শারীরিকভাবে তারচেয়ে দূর্বল। যেমন, তার সব শিকার ছিল লম্বায় পাঁচ ফুটের কম। একজনও পাঁচ ফুট তিনের ধারে কাছে ছিল না। সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যায় খুনির উচ্চতা পাঁচ থেকে পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির মধ্যে। নিখোঁজ কুকরের কেসেও একই সম্ভাবনা কাজে লাগতে পারে।

বাসায় ফিরে দেখি, বাবা ফিরেছে অফিস থেকে, সবাই ইতিমধ্যে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। আমি তাদেরকে বললাম যে শপিং মলে গিয়েছিলাম। তারপর গল্পে যোগ দিলাম। গল্পের মাঝে সাবধানে অন্য টপিকে গেলাম যেন কেউ কিছু সন্দেহ না করে। আশেপাশের বাসাগুলোতে কারা কারা কি কুকুর রাখে জানতে চাইলাম।

“ঐ বাড়িতে একটা কুকুর আছে খুবই কিউট। আমি জানি না কেন ওরা কুকুরটাকে ঘরের বাইরে রাখে। কুকুরটা একদমই ছোট,” সাকুরা বলল।

“হয়তো অনেক চেঁচামেচি করে,” বাবা বললেন।

আমি ঠিকানা নিলাম। আজকে মঙ্গলবার রাত। সুতরাং কিডন্যাপার হয়তো আজকে ঐ বাড়িতে হামলা করলেও করতে পারে, কে জানে?

***

যে বাড়িটা নিয়ে কথা হচ্ছিল সেটা ছিল একটা জাপানি কন্সট্রাকশনের পুরনো বাড়ি। দেয়ালের উপর দিয়ে চারদিকে তাকালাম। একটা বড় বাগানের শেষ মাথায় ডগ হাউজটা রাখা। দেখে মনে হলো হাতে বানানো, কাঠের বাক্সর মত দেখতে। বাইরে একটা খুঁটি পোঁতা আছে যেখানে ফিতে দিয়ে কুকুরটা বাঁধা।

কুকুরটার চোখগুলো ছিল বড় বড়। যে মুহূর্তে সে আমাকে দেখল, গলা ফাঁটিয়ে চেঁচামেচি লাফালাফি শুরু করে দিল। একদম ছোট কুকুর, যে কোন বাচ্চাও কোলে করে নিয়ে যেতে পারবে।

আমি বাড়িটা থেকে সরে গিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ালাম। এখানে আশেপাশে কোন আলো নেই, অন্ধকারের মধ্যে কেউ আমাকে দেখতে পাবে না।

ঘড়ি দেখলাম, অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তবে একটা সুইচে চাপ দিতে ডায়ালের ভেতর আলো জ্বলে উঠল। রাত দশটা। দুই সপ্তাহ আগে এরকম সময়েই পাভলভ চুরি হয়েছিল। কিডন্যাপার যদি আজকে এই কুকুরটাকেও চুরির প্ল্যান করে থাকে তাহলে এরকম সময়েই আসার কথা।

পায়ের নিচের মাটি পাতায় ঢেকে আছে, একটু নড়লেই ডালপালায় লেগে কাছের ঝোপগুলো নড়ে উঠছে। হেমন্তের শুরু হলেও দিনের বেলায় গরম থাকে। রাতে একটু ঠান্ডা পড়ে।

পকেটে হাত ঢুকিয়ে চুরির স্পর্শ নিলাম, যদি কোন প্রয়োজন হয় সেজন্য সাথে করে এনেছি।

কিডন্যাপারটার চেহারা যদি দেখতে পাই, পুলিশকে জানানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমি শুধু স্রেফ দূর থেকে অদৃশ্য হয়ে দেখতে চাই সে কী করে। সুতরাং অস্ত্রের কোন প্রয়োজন পড়বে বলে মনে হয় না। কিন্তু তারপরেও কোন কিছু চিন্তা না করেই আমার ছুরির সেট থেকে একটা ছুরি পকেটে করে নিয়ে এসেছি। খোলা ব্লেডে নিজেকেই আহত করে ফেলতে পারি, সেজন্য একটা লেদার কেসে ঢুকিয়ে রেখেছি ওটা।

কোন মানুষকে অস্বাভাবিক কোন অপরাধ করতে দেখতে আমার ভালো লাগে। এই শখের কারনে আমার এমন একজন লোকের মুখোমুখি হতে হয়েছিল যে কিনা একাধিক নারীকে হত্যা করেছিল। আমি তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তেইশটা ছুরির একটা সেট চুরি করেছিলাম। যেগুলো এই মুহূর্তে আমার রুমের বইয়ের সেলফের পেছনে লুকানো আছে। বাসায় থাকলে আমি ওগুলো বের করে দেখি। সিলিংয়ের লাইটের আলো ধাতব ব্লেডের উপর পড়ে চকচক করে ওঠে। সাদা আলোতে মনে হয় যেন ওগুলো ভিজে আছে।

মাঝে মাঝে ব্লেডের উপর আমার প্রতিচ্ছবি বদলে ঐ মেয়েগুলোর চেহারা ভেসে ওঠে, যাদেরকে এই ছুরিগুলো দিয়ে খুন করা হয়েছে। আমি জানি ব্যাপারটা চোখের ধাঁধা মাত্র, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় ওদের সমস্ত ব্যথা আর কষ্টগুলো যেন ছুরিগুলোর ভেতর অনন্তকালের জন্য আটকা পড়ে গিয়েছে।

আবার ঘড়ি দেখলাম। বুধবার হয়ে গিয়েছে। একজন লোকও এদিকে আসেনি। কে জানে কিডন্যাপার কোথায় থাকে। বাসস্থানটা জানলে সম্ভাব্য শিকারের তালিকাটাও ছোট করে আনা যেত। যাই হোক, মনে হচ্ছে না। আজকে আর কিডন্যাপারের দেখা পাবো।

আরো দশ মিনিট অপেক্ষা করে বাসায় ফিরে এলাম।

বাবা-মা তখন ঘুমে। সাকুরা পরীক্ষার জন্য পড়ছে। সে টের পেয়েছে আমি বাসায় ফিরেছি। নিচে এসে জিজ্ঞেস করল কই গিয়েছিলাম। তাক জানালাম, শপিং মলে গিয়েছিলাম।

***

আমার জানা ছিল লোকটা আজকে আসবে, ঘুমিয়ে পড়া একদম উচিত হয়নি। ইয়ুকার চিৎকারে লাফিয়ে উঠলাম। লিভিং রুম থেকে ওর গলার শব্দ ভেসে আসছে। দৌড়ে গেলাম ওর কাছে।

ও আমার পেছনে লুকিয়ে ছিল। লোকটা নিশ্চয়ই ওকে টেনে লিভিং রুমে নিয়ে গিয়েছে। আম্মু বাসায় নেই। লোকটা ইয়ুকাকে একা পেয়ে গেছে।

ইয়ুকা দলামোচা হয়ে পড়ে গোঙাচ্ছে, শব্দ শুনে মনে হলো ব্যথার সাথে যুদ্ধ করছে ও।

লোকটা ওর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ওর দিকে ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছে। তাকে বিশাল দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে মাথাটা গিয়ে সিলিঙে ঠেকেবে। আর ইয়ুকাকে একদম ক্ষুদ্র লাগছে তার সামনে। মাটিতে পড়ে অসহায়ের মত ব্যথায় গোঙাচ্ছে সে।

আমার মাথার ভেতরটা ক্রোধে জ্বলে উঠল। গলার পুরো জোর দিয়ে আমি একটা হুংকার ছাড়লাম।

লোকটা আমার দিকে ঘুরল, চোখে তার বিস্ময়। এক পা পিছিয়ে ইয়ুকা থেকে সরে গেল সে।

ইয়ুকা ওখানে পড়ে কাতরাচ্ছে, কিন্তু ওর দৃষ্টি আমার উপর। সে দৃষ্টিতে আমি পরিস্কার আমার প্রতি ওর ভালবাসা দেখতে পাচ্ছি। মনের গভীর থেকে টের পাচ্ছি ওকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার।

সামনের দরজা খোলার শব্দ কানে এল, কেউ ডাকছে। আম্মু শপিং থেকে ফিরে এসেছে। এই লোককে এখানে রেখে সে শপিঙে গিয়েছিল!

আমি লোকটার হাতে কাপড় দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আম্মু আমাকে পেছন থেকে ধরে ফেলল। এক ইঞ্চির জন্য হাতটা ফসকে গেল।

কিন্তু ওটুকু সময় ইয়ুকার জন্য যথেষ্ট ছিল উঠে দাঁড়ানোর জন্য। আম্মু যখন রাগি গলায় কিছু একটা বলছে, ইয়ুকা তখন দৌড়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমিও ওর পিছুপিছু দৌড়ে গেলাম। দু-জনেই আমরা দৌড়ে বাসা থেকে পালালাম।

যত জোরে সম্ভব আমরা দৌড়ালাম। আম্মু পেছন থেকে আমাদের ডাকছে শুনতে পাচ্ছি কিন্তু ফিরে তাকালাম না। রাতের অন্ধকারের মধ্যে আমরা দৌড়ে মিশে গেলাম।

অন্ধকার রাস্তা, দু-ধারে নিস্তব্ধ ল্যাম্প পোস্টের সারি। শুধুমাত্র আমাদের পায়ের তলার মাটি উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমাদের দুজনের ছোট ছায়াগুলো এক ল্যাম্প পোস্ট থেকে আরেক ল্যাম্প পোস্টে ছুটে যাচ্ছে। যতদূর দৃষ্টি যায় চারদিকে শুধু বিস্তৃত রাত। ইয়ুকা সাথে থাকায় কোন ভয় পাচ্ছি না। কিন্তু ওর কথা ভাবলেই আমার কষ্ট হচ্ছে।

ইয়ুকা কাঁদছে না কিন্তু আমি জানি ও ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে। আমিও অনুভব করতে পারছিলাম। মাঝে মাঝে ব্যথা এত বের যাচ্ছে যে, ওকে থেমে থেমে বিরতি নিতে হচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু ওর পাশে থাকা ছাড়া আমার পক্ষে আর কিছু করার নেই।

বিকেলে আমরা যে জন্তুটাকে দেখেছিলাম সেটাই হবে রাতের প্রতিপক্ষ-ইয়ুকা বলেছিল। সেদিন আমরা হাঁটতে বেরিয়ে ওটাকে দেখতে পেয়েছিলাম, সহজে তুলে আনা যাবে। আমরা ঐ বাড়ির দিকে এগুতে লাগলাম।

আমি নিশ্চিত ইয়ুকাও ব্যাপারটা খেয়াল করেছে-জন্তু চুরি করা আর আগের মত সহজ নেই। এখন সবাই তাদের জন্তুকে ঘরের ভেতর রাখে। আমাদেরকে ঠেকানোর চেষ্টা করছে আর কি।

আমার এখন অনেক দুশ্চিন্তা হয়, কেউ যদি দেখে ফেলে আমরা কি করছি?…সেজন্য সবসময় সতর্ক থাকি, কোন ছায়া নড়তে দেখলেও চমকে

ইয়ুকাকে ভয় নেই আমার, আম্মুকেও না। এমনকি ঐ খারাপ লোকটাকেও ভয় পাই না। আমি ভয় পাই অচেনা মানুষকে। আমরা যখন জম্ভগুলি চুরি করে নিয়ে যাই, কেউ একজন আমাদের পেছন পেছন আসে। সে হয়তো একসময় জেনে যাবে, ব্রিজের নিচে আমরা কি করি। তারপর কি হবে অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। সবাই জেনে গেলে ইয়ুকা আর আমাকে আলাদা করে ফেলা হবে। আমি না থাকলে ইয়ুকাকে রক্ষা করার জন্য কেউ থাকবে না আর। আমি সেটা হতে দিতে পারি না।

আজকের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি আমরা। রাস্তার আলো বাড়ির ছাদে পড়ায় আশপাশ পুরো অন্ধকারে ডুবে আছে। বিকেলে যাওয়ার সময় আমরা দেখেছিলাম বাড়িটা এক কোণায়, উঠোনের আরেকদিকে, একটা ছোট কুকুর আছে।

“চল,” ইয়ুকা বলল। আমরা সামনে পা বাড়ালাম।

কিন্তু সে মুহূর্তে কিছু একটা চোখে পড়ল আমার, সাথে সাথে মৃদু স্বরে ইয়ুকাকে ডাকলাম। আমরা দুজনেই বরফের মত শক্ত হয়ে গেলাম তখন। ইয়ুকা হতবুদ্ধি হয়ে আমার দিকে তাকাল।

এক মুহূর্ত আগে বাড়িটার বাইরের অন্ধকার অংশে একটা হালকা আলো দেখেছি আমি। খুবই হালকা আলো, অল্প সময়ের জন্য ছিল, কিন্তু ওখানে কেউ আছে নিশ্চিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় ঐ নির্দিষ্ট জায়গাটার দিকে কেন্দ্রিভুত। দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে বাড়িটার উপর নজর রাখছিল। আমার কি ভুল হতে পারে? নাহ, আমি নিশ্চিত কোন ভুল হয়নি।

আজকে বাদ, আমি চোখের দৃষ্টি দিয়ে ইয়ুকাকে বললাম। সে আরেকবার বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আমার কথায় রাজি হলো।

সে রাতে আমরা কোন জন্তু চুরি করিনি। ব্রিজের নিচে কিছু সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। ইয়ুকা চাচ্ছিল আমি খুন করি কিন্তু আমাকে তা করতে হয়নি বলে হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম।

তারপরেও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। যে ছায়া আমাদের পিছু নিয়েছে তা এখন আকার ধারন করেছে, নিজের উপস্থিতি প্রদর্শন করেছে। ব্যাপারটা তার মানে আমার কল্পনা ছিল না, একদম বাস্তব ছিল।

মঙ্গলবার রাতে কিডন্যাপারকে ধরার প্ল্যান আমার বৃথা গেল। পরেরদিন, বুধবার, গল্পেরছলে আমি আমার পরিবারের লোকজন আর ক্লাসমেটদের প্রশ্ন করে বের করার চেষ্টা করলাম নতুন কোন কুকুর নিখোঁজ হয়েছে কিনা। কিন্তু সব খোঁজ খবরের পর মনে হলো সে-রাতে কিডন্যাপার কিছু চুরি করেনি। কিংবা চুরি হলেও হয়তো এমন কোথাও হয়েছে যার খবর আমার কাছে আসেনি।

“তোমার কোন ধারণা আছে, কী ধরনের মানুষ এর পেছনে আছে?” লাঞ্চ ব্রেকে কেমিস্ট্রি লেকচার হলের কোণায় বসে মোরিনো আমাকে প্রশ্ন করল, তার হাতে বই।

আমি মাথা নাড়লাম, কোন ধারণা নেই।

“প্রথমত, কেউ কেন ঐ প্রাণীটাকেই চুরি করবে? পশুপাখি বিক্রির দোকানে বিক্রি করার জন্য?” মোরিনো এমনভাবে প্রশ্ন করল যেন ওর মাথায় আসছে না কেন এই বিশেষ প্রাণীটা চুরি করতে যাবে কেউ!

“আমার সন্দেহ আছে কিডন্যাপার টাকা চায় কিনা-পেট শপে যে সব পিওরব্রিড বিক্রি হয় সেগুলো সেখানে থাকতে থাকতে বড় হয়ে যায়। প্রায় কেউই ওগুলো কেনে না।”

কেউ মার্কেট থেকে নিলে গবেষণার জন্য নেয়, পোষার জন্য নয়। পোষা কুকুর মানুষদের বিশ্বাস করে, যে কারনে সেগুলোর দেখাশোনা করা বন্য কুকুরের চেয়ে সহজ। ব্ল্যাক মার্কেটে ভালো দাম পাওয়া যায় বলে আমি শুনেছি। . “কুকুর কিডন্যাপিঙের একমাত্র কারন যেটা হতে পারে বলে আমার মনে হয়, সেটা হলো, ওগুলোকে নিয়ে নির্যাতন করা। কিছু মানুষ আছে যারা ইন্টারনেট থেকে পরিত্যক্ত কুকুর-বিড়াল সংগ্রহ করে এসব করার জন্য।”

“তার মানে বলতে চাইছে, কিডন্যাপার মজা করার জন্য প্রাণীগুলোকে চুরি করে খুন করছে? সাংঘাতিক তো।” মোরিনো বলল।

কিন্তু এখানে একটা ঝামেলা আছে। ব্যাপারটা যদি তা-ই হয় তাহলে নির্যাতনটা করা হচ্ছে কোথায়? বাসায় তো অবশ্যই না। যখন খবরে মাঝে মাঝে পার্কে পোষা প্রাণীর লাশ পাওয়ার খবর পাওয়া যায় তখন প্রাণী নির্যাতন সংক্রান্ত অনেক কথাবার্তা হয়। কিন্তু ইদানিংকালের মধ্যে এরকম কোন খবর আমার কানে আসেনি।

***

সেই বুধবার আর বৃহস্পতিবার, স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে, যেসব বাড়ি থেকে পোষা কুকুর নিখোঁজ গিয়েছে সেগুলোতে গিয়ে খোঁজ নিলাম। প্রতিদিন একটা করে। বাড়ির লোকজন একটুও সন্দেহ করেনি, আমি আসলেই স্কুলের পত্রিকায় কাজ করি কিনা। সবাই যতটুকু সম্ভব সাহায্য করেছে।

কিন্তু অপরাধির ব্যাপারে আমি নতুন কোন ভালো তথ্য খুঁজে পেলাম না। দুই বাড়িতেই চুরি যাওয়া কুকুরগুলো ছিলো মাট, আর একদম ছোট। একজনের মালিক আধ খাওয়া খাবার পড়ে পেয়েছে, আরেকজন পায়নি।

শুক্রবার আমি আরেকটা বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাসে চরলাম। যে তথ্য পেয়েছি তাতে এই বাসা থেকেই সবার আগে চুরি গিয়েছিল, আর আমার বাসা আর স্কুল থেকেও জায়গাটা সবচেয়ে দূরে। নদীর পাশের বাড়িগুলোর একটা।

ম্যাপের ঠিকানারগুলোর সাথে মিলিয়ে সহজেই বাড়িটা খুঁজে পেলাম। নতুন বাড়ি। বেল বাজালাম। কেউ মনে হলো নেই ভেতরে।

বাড়ির সাথে ছোট একটা টিউলিপের বাগান, আর একটা খালি ডগ হাউজের সামনে খাবারের থালা রাখা। প্লাস্টিকের থালা। খানিকটা নোংরা। উপরে বাচ্চাদের মত আঁকাবাঁকা করে লেখা মার্বেলের থালা।

সেখান থেকে বের হয়ে আবার বাস নিয়ে ফেরত চলে এসে বাসার সামনে বাস স্টপে নামলাম।

আজকে শুক্রবার, আরেকটা কুকুর আজকে চুরি হওয়ার কথা। এসব যখন ভাবছিলাম, কে জানি আমাকে ডাক দিল। ঘুরে দেখি সাকুরা, জুনিয়র হাই স্কুলের ইউনিফর্ম পরে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার সাথে তাল মেলাতে সাইকেল নিয়ে জোরে জোরে হাঁটতে লাগল।

সে সবসময় বাসায় ফেরার আগে ক্রাম স্কুলে যায়, সেখানে কয়েক ঘন্টা পড়াশোনা করে। তাই আমি জিজ্ঞেস করলাম এত তাড়াতাড়ি এসে সে কী করছে।

“কাহিনী হয়েছে, ক্রাম স্কুলে যেতে পারিনি আজকে,” বলল সে। ওকে কিছুটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। সাইকেল সোজাসুজি টানতেও পারছে না।

“আবার কিছু দেখেছো?” আমি ওর থেকে সাইকেল নিয়ে বললাম।

মাথা ঝাঁকাল সে।

সাকুরার শনির সমস্যা আছে। আমি বলব এটা ওর গুণ কিন্তু ও এটাকে অভিশাপ হিসেবেই দেখে। সেটা হলো, ও প্রায়ই মৃত লাশ খুঁজে পায়।

প্রথমবার এমন হলো যখন ও এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ত। স্কুল থেকে পাহাড়ে একটা টিপে নিয়ে গিয়েছিল। ফার্স্ট গ্রেডে ছিল ও, অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়েছিল। তো একসময় ও একটা ডোবার কাছে গিয়ে হাজির হয় আর দেখে পানিতে একজন মানুষের লাশ ভাসছে।

দ্বিতীয়বারের ঘটনা এর চারবছর পর। সাকুরা ওর এক বন্ধুর পরিবারের সাথে সমুদ্র দেখতে গিয়েছিল। এবারও সে কিভাবে যেন আলাদা হয়ে পড়ে। সাগরে ভেসে এসে পাথরে আটকে থাকা একটা লাশ খুঁজে পায়।

তৃতীয়বারের ঘটনা আরো তিনবছর পরের, জুনিয়র হাইস্কুলের দ্বিতীয় বর্ষের ঘটনা। ওর ভলিবল ক্লাব ক্যাম্পে গিয়েছিল। জগিংয়ের সময় রাস্তা ভুলে অন্যদিকে চলে যায়। একটা নির্জন এলাকায় গিয়ে হাজির হয়। পায়ের নিচে মড়মড় শব্দ হতেই দেখে একটা মানুষের মাথার খুলির উপর পা পড়েছে ওর।

প্রতিবার লাশ পাওয়ার পর ওর মুখ শুকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। পরের এক সপ্তাহ জ্বর নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকে।

“কেন আমার সাথেই এমন হতে হবে?” কাঁদতে শুরু করল সে।

ওর লাশ খুঁজে পাওয়ার চক্রের মধ্যে সময় ধীরে ধীরে কমে আসছে। চতুর্থ বার লাশ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা এই বছরে কিংবা আগামি বছরে ছিল। ওর যখন আরো বয়স হবে তখন হয়তো প্রতি দুই-তিন মিনিটে একটা করে লাশ চোখে পড়বে কে জানে!

“তো, আজকে কি খুঁজে পেলে?” আমি ওকে প্রশ্ন করলাম।

“ক্রাম স্কুলে যাওয়ার পথে আমি কিছু একটা দেখেছি…তারপর শরীর খারাপ লাগছিল তাই ক্লাস না করে চলে এসেছি।”

ওর জুনিয়র স্কুল আর ক্রাম স্কুলের মধ্যে একটা নদী পড়ে। নদীর উপর কংক্রিটের তৈরি একটা বড় ব্রিজ আছে, গাড়ি চলাচল করে। পথচারি আর সাইকেলের জন্য আলাদা লেন আছে।

“সাইকেলের ঝুড়িতে আমার ভোয়ালে আর ব্যাগ রাখা আছে।”

নীল-সাদা রঙের একটা ভোয়ালে যেটা সে নিয়মিত ব্যবহার করে। পাশ দিয়ে একটা ট্রাক যাওয়ার সময় বাতাসের তোড়ে ভোয়ালেটা উড়ে গিয়ে নিচে পড়ল। ও রেইলিং দিয়ে তাকিয়ে দেখে তোয়ালেটা নদীতে পড়েনি, তীরের কাছে ঘাসের উপর আটকে আছে।

“আমি নিচে গেলাম ভোয়ালেটা তুলে আনতে।”

ব্রিজের শেষ মাথায় একটা সিঁড়ি আছে যেটা দিয়ে নদীর তীরে নামা যায়। সাকুরা নিচে নেমে দেখে চারপাশে লম্বা সুচালো সবুজ ঘাস। প্রায় ওর সমান লম্বা। ও সেগুলো সরিয়ে সামনে গেল। ঘাসের বন ঘন হলেও সরিয়ে সামনে যাওয়া যাবে না তা নয়।

“উপর থেকে বোঝা যাচ্ছিল না কিন্তু ব্রিজের নিচে একটা খোলা জায়গা আছে যেখানে ঘাস নেই।” একটা গোলাকৃতির শুকনো জায়গা, চারপাশে ঘাসের দেয়াল। অনেকটা খাঁচার মত।

বিশাল ব্রিজটা ছাদ হিসেবে কাজ করছে। সাকুরা উপরে তাকালে আকাশের অর্ধেকটা দেখতে পেল।

“আমি আমার তোয়ালে খুঁজছিলাম, কিন্তু…” ও পোকামাকরের গুনগুন শব্দ শুনতে পেল-মাছির একটা ঝাঁক। কাছাকাছি যেতে দেখতে পেল মাছিগুলো একটা জায়গা ঘিরে রেখেছে।

“আমি ওদিকেই যাচ্ছিলাম কারন তোয়ালেটা ওদিকেই পড়েছিল..”

যেতে গিয়ে সাকুরা নাকে পচা একটা গন্ধ পেল। মাছির ঝাকের কাছের ঘাস সরিয়ে দেখে পায়ের কাছে একটা গর্ত। গর্ত না বলে বরং ঢালু একটা জায়গা বলাই ভালো। তিন ফুটের মত চওড়া আর তিন ফুটের মত গভীর। আরেকটু হলে ও প্রায় পড়েই যাচ্ছিল সেটার ভেতর। নিচে তাকিয়ে বুঝতে পারল দুর্গন্ধটা কোত্থেকে আসছে…

***

গর্তটা অসংখ্য মাংসের স্তূপ দিয়ে ভর্তি। কোন আকার আকৃতি নেই, টুকরো টাকরা দেখে আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি ওগুলো কি ছিল, স্রেফ কালো আর লাল মাংসের স্তূপ।

দুর্গন্ধ উপেক্ষা করে উপুড় হয়ে কাছ থেকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম।

চোয়াল, লেজ, ধর-সব কুকুরের। কেঁচোর মত পোকা কিলবিল করছে। ওগুলোর উপর। মাংসের স্তূপের উপর স্তূপ জমে আছে গর্তের ভেতর। ওগুলোর সবগুলোর শরীরে একসময় প্রাণ ছিল। সূর্যের আলোর নিচে কুকুরগুলো একসময় হয়তো তিরিং বিরিং করত। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি, মৃত্যু আর ধ্বংস দিয়ে গাঁথা।

গর্তটা থেকে পচা দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কিছু ছবির কথা মনে পড়ল। গর্তটার দৃশ্যর সাথে ঐ ছবিগুলোর বেশ মিল আছে।

আশেপাশে খেয়াল করলাম। সাকুরা যেমন বলেছিল, চারপাশে ঘাস ছাড়া আর কিছু নেই। সূঁচালো ঘাসগুলো উপর দিকে মুখ করে আছে আর ওগুলোর উপর দিয়ে মাছি ভন ভন করছে। মাছিগুলো মনে হয় আমাকে তাদের বন্ধু ভেবেছিল, বার বার মুখে আর গায়ে এসে বসছিল। সূর্যাস্তের আলোয় সব কিছু লালচে দেখাচ্ছে।

সাকুরা যখন ওর আবিস্কারের কথা আমাকে বলল, আমি সাথে সাথে অনুমান করলাম কুকুর কিডন্যাপিং আর গর্তটার মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে। যে জায়গাটা খুঁজছিলাম সেটাই এই জায়গা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

আমি ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে ব্রিজের দিকে চলে এলাম। সিঁড়ি বেয়ে নদীর তীরে নেমে ঘাসের ভেতর খোলা জায়গাটা খুঁজে পেতে কোন বেগ পেতে হলো না। একটু দূরেই মাছির মেঘ দেখা যাচ্ছে।

গর্তের ভেতর মার্বেল আর পাভলভের লাশও আছে।

তারপর সেখান থেকে বাসায় চলে এলাম। এখন শুধু রাত নামার অপেক্ষা।

ঘড়িতে যখন রাত দশটা বাজলে পকেটে ছুরিটা নিয়ে রুম থেকে বের হলাম আমি। সাকরা তখনো লাশগুলো দেখার শক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। লিভিং রুমের সোফায় শুয়ে মায়ের সাথে টিভি দেখছে। আমি যখন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি মা জিজ্ঞেস করল কই যাই। বললাম শপিং মলে যাচ্ছি। সাকুরা বিড়বিড় করল, “শপিং মলের মাঝরাতের প্রহরি!”

ব্রিজের নিচের খোলা জায়গাটায় ফিরে এলাম। শুক্রবার, সুতরাং ভালো সম্ভাবনা আছে কিডন্যাপারের দেখা পাওয়ার।

হাঁটতে হাঁটতে আমি কল্পনা করার চেষ্টা করলাম এরকম প্রাণী হত্যা করতে কী রকম আনন্দ হতে পারে। কিডন্যাপার যে মরা কুকুরগুলোকে নিয়ে গর্তে ফেলছে তা যেন আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।

সম্ভব হলে আমি লোকটার কাজ দেখতে চাই। লাশগুলো ফেলার আগে কি রকম আনুষ্ঠানিকতা হয় না হয় তা জানতে আমার কৌতূহল হচ্ছে।

ইর, নির্মম ব্যাপার সবসময় আমাকে আকর্ষণ করে। আমার ক্লাসমেটদের সাথে যেসব আলোচনা হয় কিংবা পরিবারের লোকজনের সাথে যেরকম উষ্ণ আচরণ করি তা আসলে আমার সাথে খাপ খায় না। ওরা কেমন যেন স্থিতিশীল ধরনের। অনেকটা একটা রেডিওর মত, যেটা কিনা ঠিকমত টিউন করা হয়নি।

রাতের বেলায় নদীটা অন্ধকারে একদম কালো হয়ে আছে। যেন তারা শূন্য মহাবিশ্ব এসে ছড়িয়ে শুয়ে আছে এখানে। ব্রিজের আলোতে নদীর পানি খুব কমই আলোকিত হতে পেরেছে। এখন পর্যন্ত কারো উপস্থিতির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না, তার মানে কিডন্যাপার এখনো এসে পৌঁছায়নি এখানে।

আমি সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ঘাসের ভেতর গিয়ে ঢুকলাম। ঢোকার সময় আসার আগে মোরিনোর সাথে হওয়া টেলিফোনে কথা মনে পড়ল।

“কুকুর পছন্দ করে এমন একজনের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, তুমি আসতে চাও?”

“যেতে পারলে ভালো হত কিন্তু আমাকে হোমওয়ার্ক করতে হবে।”

“কিন্তু আজকে তো কোন হোমওয়ার্ক নেই।”

“হোমওয়ার্ক মানে বাসায় কাজ আছে। আম্মুর অসুস্থতা আরো বেড়েছে। উনি মৃত্যু শয্যায়।”

“ঠিক আছে, কোন অজুহাতের দরকার নেই। তুমি যদি কুকুর ভয় পাও, তাহলে আমি জোরাজুরি করব না,” বললাম আমি, আর কল্পনার বাইরে একটা প্রতিক্রিয়া পেলাম।

“কি বএছা তৃ-তুমি? কুকুর ভয় পাই মানে? বাজে কথা বোল না! আমি মোটেও ওইসব জিনিস ভয় পাই না!”

ওর কথা শুনে মনে হলো ওকে খেপানো ঠিক হবে না। ওকে শান্ত করার জন্য ক্ষমা চেয়ে ফোন রেখে দিলাম।

আর এখন ঘাসের ভেতর লুকিয়ে আছি আমি।

মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পকেট থেকে ডিজিটাল ক্যামেরাটা বের করলাম। যা আলো আসছে তা আসছে ব্রিজের উপর থেকে। এই আলোতে কোন ছবি তোলা যাবে বলে মনে হয় না। ক্যামেরার অ্যাপারচার ওপেন করে শাটার স্পিড একদম কমিয়ে দিয়ে ফ্ল্যাশ অফ করে দিলাম। ফ্ল্যাশ ব্যবহার করলে কিডন্যাপার আমার উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে, সেটা আমি চাই না।

খুনিকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই। কিডন্যাপার আমার উপস্থিতি না জানাই ভালো। আমার নিয়ম হলো কোন কিছুতে জড়িয়ে না পড়া। তৃতীয় পক্ষ হিসেবে পাশ থেকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা। আমি রিপোর্ট না করলে আরো কুকুর কিডন্যাপড হবে, আরো লোকজনের মন খারাপ হবে, কান্নাকাটি করবে। কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি এরকমই।

যেখানে লুকিয়ে আছি সেখান থেকে ব্রিজ থেকে নেমে আসা সিঁড়ি আর খোলা জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হয় গর্তের কাছে যাওয়ার জন্য কিডন্যাপার খোলা জায়গাটার উপর দিয়েই যাবে, আর সে সময় আমি একটা ছবি তোলার চেষ্টা করব।

নদী দিয়ে বিপুল স্রোতে পানি বয়ে যাচ্ছে। ঘাসের আড়াল থেকে পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। একটু আগে দেখা কালো নদীর চেহারা মনে পড়ল আমার। ঠান্ডা বাতাস বইছিল, আশেপাশের ঘাস দুলছিল। একটা ধারালো ঘাস খোঁচা লাগাল আমার গালে।

ঘড়িতে যখন বারোটা বাজে তখন ব্রিজের উপর একটা ছায়া দেখা গেল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল ছায়াটা। আমি মাথা নামিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলছিলাম নিজের উপস্থিতি আড়াল করার জন্য।

ছায়াটা সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে ঘাসের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় লোকটা ছায়ার মধ্যে থাকায় দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু খোলা জায়গাটায় আসার পর ব্রিজের আলোয় তাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম।

একটা মেয়ে আর একটা কুকুর। মেয়েটা খুবই শুকনো আর ছোট খাট, কাঁধ পর্যন্ত চুল। কুকুরটা একটা গোল্ডেন বিট্রাইভার। সেদিন মোরিনোর সাথে যাওয়ার সময় যাদেরকে দেখেছিলাম সেই মেয়ে আর কুকুরটাই।

মেয়েটার কোলে আরেকটা ছোট কুকুর। কুকুরটা কুকু করে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়েটার কুকুর কোলে নেয়ার অভ্যাস আছে, মোচড়ামুচড়িতে হাত থেকে ফেলে দিল।

ক্যামেরা রেডি।

***

আমি আর ইয়ুকা প্রথম যেদিন ব্রিজের নিচের খোলা জায়গাটা খুঁজে পাই, সেদিন ছিল গ্রীষ্মের অত্যন্ত গরম একটা দিন। আকাশে এক ফোঁটাও মেঘ ছিল না।

ইয়কা আর আমি হাঁটতে বের হয়েছিলাম। সবসময়ের মত খেলাধুলা করছিলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত হাঁফ না উঠে যায় ততক্ষন পর্যন্ত দৌড়াচ্ছিলাম। তারপর নদীর পাশের রাস্তায় থেমেছিলাম বিশ্রাম নেয়ার জন্য।

কংক্রিটের রেলিঙ্গে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করছিলাম আর নিচের বাসের সমুদ্র দেখছিলাম। হালকা বাতাস বইছিল, মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কোন হাত এসে ঘাসগুলো নাড়াচ্ছে।

ইয়ুকা আমাকে ডাকল। আমি ওর দিকে ঘুরে দেখি ও ব্রিজের শেষ মাথায় লাগানো সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।

আমরা যখন নিচে নামছি তখন ওর মনে অ্যাডভেঞ্চারের অনুভূতি টের পাচ্ছিলাম। সিঁড়ির শেষে সবুজের দুনিয়া শুরু। আমরা যত ভেতরে যেতে লাগলাম ঘাসের গন্ধে নাক ভরে উঠল আমাদের।

সাধারনভাবে হাঁটতে ইয়ুকার হয়তো বিরক্ত লাগছিল, যে কারনে ও আমার দিকে একবার তাকিয়ে হঠাৎ সামনে দৌড় দিল। বুঝলাম, ও চাচ্ছে ওর পিছু নিই। আমরা যে হাঁপিয়ে গিয়েছি তা ভুলে গিয়ে বাসের ভেতর দিয়ে আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করলাম।

গরমের দিন, একসময় আমি ঘেমে সেদ্ধ হয়ে গেলাম। তারপরেও ঘাসের ভেতর ইয়ুকার পিছুপিছু দৌড়াচ্ছিলাম। ওর হাসি শোনা যাচ্ছিল, আমি শব্দের দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম, ও আরেকদিকে পালাচ্ছিল।

হঠাৎ আমরা একটা খোলা জায়গায় এসে পড়ি। মনে হয় একটা নতুন দুনিয়া। ঘাসের গন্ধ কম, চারপাশে হালকা বাতাস বইছে। খোলা জায়গাটায় কোন ঘাস নেই।

ইয়ুকাই প্রথম জায়গাটা খুঁজে পেল। খোলা জায়গাটার মাঝখানে ও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এরপর আশেপাশে তাকাতে গিয়ে ও দেখল আমি ঘাসের দেয়ালের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসছি। প্রথমে জায়গাটা পেয়ে আমাদের দুজনেরই বোকা বোকা লাগছিল। পরে মনে হলো যেন বিশেষ কিছু একটা খুঁজে পেয়েছি। আমি ওর চোখে আনন্দের ঝলক দেখতে পাচ্ছিলাম।

কতদিন আগের ঘটনা এটা? মনে হচ্ছে যেন কত আগে ঘটেছে।

খোলা জায়গাটা খুঁজে পাওয়ার কিছুদিন পরেই লোকটা নিয়মিত আসতে লাগল। সেই সাথে ইয়ুকা আর আমিও আমাদের মাঝরাতের হাঁটাহাঁটি শুরু করলাম। দিন দিন বাতাস ঠান্ডার দিকে যাচ্ছিল। সেদিনের মত গ্রীষ্মের উষ্ণতা আর অনুভব করতে পারছিলাম না।

এমনকি দিনে হাঁটতে বের হলেও আমরা আর আগের মত ছোটাছুটি করতাম না। খেলাধুলা করতাম না আগের মত। শুধু কুকুরওয়ালা ঘরগুলো খুঁজতাম। রাতের বেলা শিকার করা সহজ ছিল।

ইয়ুকা আমাকে নির্দেশ দিয়েছিল কী করতে হবে। আমি জানি না এর পেছনে কারণ কি ছিল, যাই থাকুক তা অন্তত মজার কিছু ছিল না। ইয়ুকার চোখগুলো আর হাসত না। ওর দুঃখ আর ঘৃণা বাকি সব অনুভূতিগুলোকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। ওর নির্দেশ অমান্য করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

আগেরবারের চেয়ে এবার বাতাস একটু বেশি ঠান্ডা। ব্রিজের উপর বেশ ভালো গাড়ির ভিড়। গাড়িগুলোর আলো আমাদের দিকে ছুটে আসছে, আমাদের ছায়াগুলো বারবার সরে গিয়ে সরু হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।

উপর থেকে আমরা ঘাসের দিকে তাকালাম। ওগুলোও অন্ধকারে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। বাতাসে ঘাসগুলো দুলছে, অন্ধকারের দিকে স্রোতের মত বয়ে যাচ্ছে। ব্রিজের উপরের স্ট্রিট লাইট থেকে আসা মলিন আলোতে আমরা অল্প কিছু দেখতে পাচ্ছি।

ইয়ুকা আর আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে খোলা জায়গাটার দিকে গেলাম। ভালো করে চারপাশের ঘাসের দেয়াল লক্ষ্য করলাম আমি। কেউ কি ওখানে লুকিয়ে আছে? মনে হলো যেন বাতাসে কোন আগন্তুকের গন্ধ পাচ্ছি?

সমস্ত ইন্দ্রিয় খাড়া হয়ে গেল আমার। এমন সময় ইয়ুকা আমাকে ডাকল। সময় হয়েছে।

যে কুকুরটাকে আমরা সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম ওটাকে ভোলা জায়গাটার মাঝখানে রাখা হলো। এবারেরটা কুকুরছানার মত ছোট না, আবার পূর্ণ বয়স্ক কুকুরের মত বড় না। শৈশব মাত্র শেষ হতে যাচ্ছে ওটার। কুকুরটা মুখ তুলে অবাক হয়ে আমাদের দেখল। আসার পথে কুকুরটাকে আমরা চুরি করেছিলাম।

আমরা যখন কুকুরগুলোকে চুরি করি ওরা তখন চিৎকার করে ওদের মালিকদের ডাকডাকি শুরু করে। তখন খাবার দিয়ে আমরা সেগুলোকে শান্ত করি।

ইয়ুকা এক কোনায় সরে গেল। ও সবসময় ওখানে বসে পুরো দৃশ্যটা দেখে।

আমি আমার প্রতিপক্ষর চোখে চোখ রাখলাম, ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি। কুকুরটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কুঁকড়ে গিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। আমার ইন্দ্রিয়গুলো সম্পূর্ণ সজাগ, ইয়ুকার আদেশের জন্য অপেক্ষা করছে।

আমার প্রতিপক্ষের কোন ধারণা নেই ওর জন্য সামনে কী অপেক্ষা করছে। ভয় পেয়ে কু-কু করছিল-নিজের মালিককে খুঁজছিল সে।

এক দফা ঠান্ডা বাতাস শব্দ করে বয়ে গেল ঘাসের মধ্যে দিয়ে। তারপর নিরবতা নেমে এল। ব্রিজের উপরে গাড়ির স্রোতও থেমে গেল মনে হয়, আমার কানে কোন শব্দ আসছে না। সমস্ত নিস্তব্ধতার মাঝেও আমি উত্তেজিত বোধ করছি। বাতাসে চড়চড় শব্দ করে উঠল। ছোট গর্তটা ধ্বংস আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে আর আমি আমার স্নায়ু টানটান করে শুরু করার জন্য অপেক্ষা করছি।

আমার সামনের কুকুরটা নার্ভাস হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। বাতাসের টানটান উত্তেজনা টের পেয়ে সে গুটিয়ে গেছে। আবারো করুণভাবে কুউকুউ করছে।

ইয়ুকা ছোট কিন্তু স্পষ্ট করে নির্দেশ দিল : “আক্রমণ করো!”

আমি ছুটে সামনে গেলাম। অপ্রস্তুত কুকুর আর আমার মধ্যে দূরত্ব মুহূর্তেই কমে গেল। আমাদের কাঁধের মধ্যে সংঘর্ষ হলে কুকুরটা ধাক্কা খেয়ে একদিকে গড়িয়ে পড়ল। আমি হুঙ্কার দিলাম। আমার প্রতিপক্ষ দাঁত বের করে দেখাল, কিন্তু তখনো সে বিভ্রান্ত, বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। ওর চোখে সেটা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে।

আমার হৃদপিণ্ড জোরে জোরে বাড়ি খেতে লাগল। পায়ের নিচের মাটি আর বয়ে যাওয়া বাতাস আমি স্পষ্ট অনুভব করছি। আমার মনে শুধু খেলা কাছে প্রতিপক্ষ আর আমার মধ্যের দূরত্বটা পার হতে আমার কতক্ষন লাগতে পারে।

কুকুরটা ছোটখাট নড়াচড়া থেকে আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম ওর পরবর্তি পদক্ষেপ কোনদিকে হতে পারে। এখন পর্যন্ত অনেকগুলো লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা হওয়ায় আমি এ ব্যাপারে দক্ষ হয়ে উঠেছি।

কিন্তু মনে মনে আমার খারাপ লাগছে। আর কতদিন ইয়ুকা আমাকে এসব করতে বাধ্য করবে? আমি সত্যি সত্যি কোন খুন করতে চাই না। সারা জীবনে কখনো ভাবতেও পারিনি আমার চোয়াল কখনো এই কাজে ব্যবহৃত হবে।

করটা ডানে সরল। কিন্তু আমি সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিলাম সুতরাং আমিও ওর সামনেই চলে এলাম। বাতাসে ওর লোম ছড়িয়ে পড়ল। ছিটকে পড়ল রক্ত। টলতে লাগল ওটা। অন্ধকার আমাদের ঘিরে ধরুল যেন।

আরো কিছুক্ষণ লড়াই করলাম আমরা। তারপর ইয়ুকা উঠে দাঁড়াল।

“শেষ করে দাও!” ঘৃণাভরা নির্দেশ দিল সে। ঐ অনুভুতিগুলো আসলে ঐ লোকটার জন্য, আর সে আসার পর থেকেই ইয়ুকা আমাকে এসব করতে বাধ্য করছে। তার সব কষ্ট সে এভাবে আমাকে খুন করতে বাধ্য করার মাধ্যমে মুক্ত করছে।

রক্তাক্ত কুকুরটার দিকে এগুতে এগুতে আমি ইয়ুকার দিকে তাকালাম, তারপর হুঙ্কার ছাড়লাম। আমার হুঙ্কার ব্রিজের নিচে প্রতিধ্বনি তুলল। আমার মাথা গরম হয়ে উঠেছে। এরকম কেন হচ্ছে? কেন আমরা আগের মত হাসিখুশিভাবে খেলাধুলা করতে পারছি না?

কুকুরটা কেঁপে উঠে অন্ধকারের ভেতর নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করল। বাঁধা দেয়ার কোন ক্ষমতা আর নেই। কোনমতে দাঁড়াতে পারছে, মৃত্যুভয়ে খরখর করে কাঁপছে ওটা।

আমার এখন এর সমাপ্তি টানতে হবে, নিজের মনে বলতে বলতে আমি গরপেয়ে প্রাণীটার দিকে এগিয়ে চোয়াল হা করে ওর ঘাড়ে কামড় বসালাম। আমার দাঁত চামড়া ভেদ করে গভীরে ঢুকে গেল। গরম রক্ত ছিটকে এসে মুখ ভরে গেল আমার।

সেই গ্রীষ্মের দিনে আনন্দ চারদিকে খেলা করছে। ইয়ুকা আর আমি ঘাসের মধ্যে দৌড়ে খেলতে গিয়ে খালি জায়গাটা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি ইয়ুকার উপর লাফ দেয়ায় ও পড়ে গিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য আমার দুশ্চিন্তা হয়েছিল ব্যথা পেল কিনা। কিন্তু ওকে হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। আমি ওর পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। একসাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম দু-জনে। সূর্যের আলো আমাদের শরীর গরম করে তুলছিল, আমাদের ঘামের গন্ধ আর আশেপাশের ঘাসের গন্ধ আমাদের নাক ভরে তুলছিল…

চোয়ালের মধ্যে ঝুলে থাকা জন্তুটার নড়াচড়া ততক্ষণে থেমে গেছে। আমার মুখ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। জটার শরীর শীতল হয়ে আসছে সব শব্দ কমে যাচ্ছে আমাদের চারপাশে।

আমি খুন করায় পারদর্শি হয়ে উঠেছি। জানি না এটা কোন ভালো কাজ কিনা কিন্তু ইয়কা আমাকে শিখিয়েছে কী করে আমার চোয়ালটাকে একটা অস্ত্রে পরিণত করা যায়।

মৃত জিনিসটা থেকে সমস্ত উষ্ণতা বেরিয়ে গেছে, শুধু পড়ে আছে এক দলা ঠান্ডা মাংস।

ও আমাকে শিখিয়েছে, আমি আবারো ভাবলাম।

কুকুরটাকে নিয়ে ইয়ুকের সামনে রেখে ওর মুখের দিকে তাকালাম। ও আমার চোখে তাকিয়ে আছে।

আমি বুঝতে পারছিলাম ও কী চাইছে। ওর শক্তি আমার ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মনে হয়।

ও কেন আমাকে দিয়ে এই প্রাণীগুলোকে খুন করাল?

আগে এর কারণ বুঝিনি-কিন্তু এখন বুঝতে পারছি। এতদিন আসলে ইয়ুকা আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সে আমাকে এসব প্রাণী খুন করতে বাধ্য করেছে যাতে আমার অনেকবার মৃত্যু-অভিজ্ঞতা হয়। আর এই অভির কারনেই যখন প্রয়োজন হবে তখন সঠিক পদক্ষেপ নিতে আমার মধ্যে যেন কোন দ্বিধা না হয়।

ইয়ুকা ঐ লোকটার সাথে লড়াই করতে পারবে না। কিন্তু আমি আমার ধারালো দাঁত দিয়ে ওকে রক্ষা করতে পারব।

ইয়ুকা মাথা ঝাঁকাল। সে বুঝেছে, আমি এখন বুঝতে পেরেছি। সে আমার কাজ দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমার আর কোন প্রশিক্ষনের প্রয়োজন নেই, ওকে বললাম আমি।

লোকটা রাতে ঘুমাতে আসবে। আমরা সকালে ব্যাপারটা ফয়সালা করব। ইয়ুকা ফিসফিস করে সেটা আমাকে বলল।

আমি মৃত জন্তুটাকে নিয়ে গর্তটায় ফেলে নদীর পানিতে রক্ত আর লোম ধুয়ে ফেললাম। এখন আমরা বাসায় যাব-অপেক্ষা করব সকালের জন্য।

ইয়কা আর আমি ব্রিজের নিচের খোলা জায়গাটা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। ঠিক যে মুহূর্তে আমরা ঘাসে দেয়াল ঠেলে ঢুকতে যাব তখন থমকে দাঁড়ালাম। ইয়ুকা ততক্ষনে ঘাসের ভেতর ঢুকে গেছে। থেমে ঘুরে দাঁড়াল ও।

“কি হলো?” আমি টের পাচ্ছি ও জানতে চাইছে।

আমি ওর দিকে তাকালাম, তারপর আমার পেছনের ঘাসের ভেতর খুঁজলাম। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল কিছু একটা অদ্ভুতভাবে নড়তে দেখেছি।

কিছু না, আমি ভাবলাম। চল, যাওয়া যাক। আমি ইয়ুকার দিকে ফিরে দৌড়ে ওর পাশে গেলাম।

হয়তো ওখানে কেউ একজন ছিল। আমি নিশ্চিত কেউ একজন সেখানে ছিল-ঐ একই লোক, যে আমাদের পিছু নিয়েছিল, আমাদেরকে ধরার চেষ্টা করছে। আর এখন সে লুকিয়ে দেখে ফেলেছে আমরা কী করছিলাম।

এতদিন আমি ধরা পড়া নিয়ে ভয়ে ভয়ে ছিলাম। এখন আর সেই ভয় নেই। আমি জানি আমাকে কী করতে হবে, এসব নিয়ে আমার আর কোন দুশ্চিন্তা নেই। আমাদের আর কোন প্রাণী হত্যা করতে হবে না। আমার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের আর পিছু নেয়া ছায়াকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।

আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম। আমি আরেকবার পিছু ফিরে ঘাসের সমুদ্রের দিকে তাকালাম, অন্ধকারে ডুবে আছে ওটা। যে ওখানে লুকিয়ে আছে তাকে বলতে চাইছি, আমি আর ইয়ুকা কী করতে যাচ্ছি। আমি তাকে বলতে চাইছি ইয়ুকার সাথে কী হয়েছে আর কেন সে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আমিও এখন তা চাই।

***

“হ্যালো..?” সেলফোনের অপর পাশ থেকে মোরিনোর ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ওর গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে কিভাবে কেউ অন্য কাউকে এই ভোরবেলায় ফোন করতে পারে তা ওর ধারনার বাইরে।

জানালা দিয়ে বাইরে আলো ফুটছে এখন। আমি মাত্র তিন ঘন্টা ঘুমিয়েছি, কিন্তু আমার ঘুমের অভ্যাসকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, যে কারনে ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হলে আমার কোন সমস্যা হয় না।

আমি ওকে জানালাম, কিডন্যাপারকে খুঁজে পেয়েছি।

“ওহ্, আচ্ছা,” বলে সে ফোন রেখে দিল। ওকে ঐদিনে রাস্তায় দেখা ছোট মেয়েটা আর তার গোল্ডেন রিট্রিভার কুকুরটার কথা বলার কোন সুযোগই পেলাম না। কিডন্যাপার কে সেটার চেয়ে ঘুমানো অনেক বেশি জরুরি মোরিনোর কাছে।

আমার ফোন বাজল। মোরিনো। কলটা ধরতেই সরাসরি মূল কথায় চলে গেল সে।

“ছবি তুলেছো?”

আমি বললাম, ডিজিটাল ক্যামেরা নিয়েছিলাম কিন্তু অন্ধকারে কোন ছবি তোলার মত অবস্থা ছিল না। ব্রিজের নিচে যথেষ্ট আলো পাইনি, তাই ছবিতে কিছুই ওঠেনি।

“ওহ, আচ্ছা,” বলে আবার ফোন রেখে দিল সে।

আমি পোশাক বদলে রুম থেকে বের হলাম। বাসার লোকজন তখনো গভীর ঘুমে, পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। জুতা পরে বের হয়ে দেখি পুবের আকাশ লাল হয়ে আছে। কালো আকৃতি ধারন করেছে ল্যাম্পপোস্টগুলো।

“কাল সকালে,” গত রাতে ব্রিজের নিচে মেয়েটাকে ফিসফিসিয়ে বলতে শুনেছিলাম। ছোট কুকুরটা হত্যা করার পর গোল্ডেন রিট্রিভারের কানে কানে বলছিল সে।

আমি যেখানে লুকিয়ে ছিলাম সেখান থেকে পুরো লাইনটা শুনতে পাইনি। কাল, শনিবার সকালে কি কিছু হতে চলেছে?

তারা কি আবার একই জিনিস করবে?

আমি মেয়েটার বাসার দিকে গেলাম, হাতে ক্যামেরা। ওর বাসা কোথায় তা আমার জানা আছে। সেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখেছি কোন বাসায় ও আর কুকুরটা ঢুকেছিল। ওইটাই নিশ্চয়ই ওর বাসা। আমার প্ল্যান হল চুপচাপ ওদেরকে ফলো করা আর ওরা কী করে তা দেখা।

ঘর থেকে বের হওয়ার পর পরই খেয়াল করলাম কিছু একটা ভুলে গিয়েছি। আমার সাথে ওয়ালেট আর ক্যামেরা আছে। পকেট হাতড়ে উপরে আমার রুমের জানালার দিকে তাকালাম। ছুরিটা ভুল করে রুমে ফেলে এসেছি।

ছুরিটা আনতে আবার উপরে যাব? কোন কাজে তো লাগে না। নাকি সোজা মেয়েটার বাড়ি যাব?

সময় নষ্ট করতে চাইছিলাম না। না ফিরে যাওয়াই সহজ হতো। কিন্তু এসব ভাবলেও ফিরে গিয়ে বুককেসের পেছন থেকে লুকানো ছুরিটা বের করলাম। ছুরির ফলার সাদা উজ্জ্বলতা দেখে নিজের হাত কাটার ঝোঁকটা অনেক কষ্টে দমালাম। লেদারের খাপে ছুরিটা ভরে পকেটে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এলাম আমি। প্রচণ্ড পিপাসা বোধ হচ্ছে। ছুরির ফলাটা যেন শুকনো মরুভূমির মত আমার ভেতর থেকে সব পানি শুষে নিয়েছে।

পুবদিকে তাকিয়ে দেখি রক্ত বর্ণ ধারন করেছে আকাশ।

***

সকাল হয়ে গিয়েছে।

চোখে আলো পড়তেই আমি আর ইয়ুকা জেগে উঠলাম। পর্দার ফাঁক দিয়ে সরু একটা আলোক রশ্মি এসে কার্পেট, বিছানা, ফুটোন পার হয়ে আমাদের মুখের উপর পড়ছে। এক মুহূর্তের জন্য আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম।

আগে ইয়কার সাথে একসাথে ঘুম থেকে উঠতে মজা লাগত। একজন আরেকজনকে গুতোগুতি করতে করতে ভাবতাম আজকে কি কি খেলা যায়। সেই সময়টা আমি কখনো ভুলতে চাই না। যদি আমাদেরকে আলাদা করে ফেলা হয় তবুও আমি ওকে সবসময় এভাবে মনে রাখতে চাই।

সূর্যের আলোয় ভেসে থাকা ধুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা নিজেদের মনস্থির করে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। দরজা খুলে বাইরে তাকালাম আমি।

আম্মুর রুম থেকে লোকটার নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাসায় এলে সে সবসময় ঐ রুমে ঘুমাত। ভোরবেলা উঠে কাজে চলে যেত আম্মু। আর লোকটা একা একা সারা সকাল নাক ডেকে ঘুমাত।

ইয়ুকা আর আমি আস্তে আস্তে পা ফেলে হলওয়ে পার হয়ে বেডরুমের সামনে গেলাম। আম্মুর রুমটা বাড়ির একদম পেছন দিকে, হল আর রুমের মধ্যে একটা স্লাইডিং ডোর আছে। কিন্তু দরজাটা সকালে লাগাতে আম্মু ভুলে গিয়েছিল। যেটুকু খোলা আছে তা দিয়ে ভেতরে ঢোকা আমার জন্য কোন ব্যাপারই না।

ফাঁক দিয়ে নাক ঢুকিয়ে আমি পুরো রুমটা লক্ষ্য করলাম।

তাতামির উপর একটা ফুটোন বিছানো ছিল। সেখানে লোকটা চিত হয়ে ঘুমাচ্ছে। মুখ অর্ধেক হা করা, গলার অংশটা পুরো উন্মুক্ত। দাঁড়ানো অবস্থায় লোকটাকে দেখতে দৈত্যর মত লাগে, ঐ অবস্থায় আমি কখনো ওর গলা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতাম না। কিন্তু এখন ঘুমে বিভোর বলে ওর গলা আমার নাকের ডগায় চলে এল।

কোন শব্দ না করে আমি দরজা দিয়ে পিছলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। হাঁটার সময় কাঠের তাতামি একটু ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করল। ইয়ুকা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখছে। ওকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লাগছে আমার।

আমি লোকটার মাথার কাছে পৌঁছে গেলাম। সে তখনো কিছু টের পায়নি। ঘুম ভাঙার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। চোখ বন্ধ। ফুটোনের অর্ধেকটা পেটের উপর উঠে আছে। নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ফুলে উঠে আবার নেমে যাচ্ছে।

চোখের কোনা দিয়ে কিছু একটা নড়তে দেখলাম। জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি পর্দার পেছন থেকে একটা ছায়া সরে গেল।

আমার চেহারা খেয়াল করল ইয়ুকা। ওকে হতভম্ব দেখাল, মুখ শুকিয়ে গেছে।

জানালার বাইরে কি কেউ ছিল? নাকি পর্দা নিজে নিজে নড়েছে? হতে পারে গাছের ছায়া ছিল? যাই হোক আমি চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। সামনে শোয়া মানুষটাকে নিয়েই আমার সমস্ত চিন্তা এখন।

লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই আমার মনে পড়ল সে কিভাবে ইয়কাকে কষ্ট দিচ্ছিল। ক্রোধে আমার মন বিষিয়ে উঠল এবার।

ঘুরে ইয়ুকার দিকে তাকালাম।

শব্দের কোন প্রয়োজন নেই আমাদের মধ্যে। আমি জানতাম সে কী চায়, ওর চোখে সবকিছু স্পষ্ট পড়তে পাচ্ছি।

আস্তে করে আমার চোয়াল হা করলাম। কোন ইতস্তত করলাম না। এই কাজ আমি আগে অনেকবার করেছি ব্রিজের নিচে।

কামড় বসালাম।

আমার দাঁতগুলো লোকটার গলায় ঢুকে গেল। চামড়া কেটে রক্ত বেরিয়ে এল। আমি আরো গভীর কামড় দিয়ে ওর টুটি ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম কিন্তু দেখা গেল মানুষের গলা আমার ধারনার চেয়ে অনেক বেশি শক্ত। শক্ত কিছুতে দাঁত আটকে গেল, বেশি গভীরে ঢুকল না।

লোকটা চোখ খুলে উঠে বসল, আমার দাঁত তখনো তার গলায় বিধে আছে। উঠে বসাতে আমি কামড় দেয়া অবস্থায় ঝুলতে লাগলাম। লোকটা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করল। গলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারনে, তেমন একটা আওয়াজ বের হল না। সে আমার মুখে ঘুষি মারল কিন্তু তাও আমি ঝুলে থাকলাম।

লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁকি দিয়ে আমাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। তখন আমি ছিটকে তাতামির উপর পড়ে ডিগবাজি খেলাম।

সেই মুহূর্তে মনে হল যেন চারপাশের সময় থেমে গিয়েছে।

রক্তের লাল ফোঁটা টপ টপ করে লোকটার পায়ের কাছে ঝরে পড়ছে। আমি লোকটার পায়ের কাছে থেকে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম। সে তখন গলায় হাত দিয়ে আছে, হতভম্ব। গলার একটা অংশ ছিঁড়ে আলাদা হয়ে ঝুলে আছে। সেদিক দিয়ে রক্ত ছিটকে বের হচ্ছে। লোকটা হাত দিয়ে চেপে থাকলেও আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসছে।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে মুখের ভেতর যেই জিনিসটা ছিল সেটা থু করে ফেললাম ফুটোনের উপর। এক দলা মাংস, যেটা লোকটার গলা থেকে ছিঁড়ে নিয়েছিলাম।

সে যখন মাংসের টুকরোটা দেখল, তার চোখ প্রশস্ত হয়ে গেল, হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে মাংসের টুকটা তুলে চেপে গলায় লাগানোর চেষ্টা করল। কিন্তু রক্তের সোতে সেটা খুলে আসছিল। তার হাত কাঁপছিল, মাংসের টুকরাটা হাত গলে নিচে পড়ে গেল। লোকটা আবার সেটা ভোলার চেষ্টা করল না। বরং মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। তার মুখ ভয়াবহ দেখাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যে কোন সময় কেঁদে ফেলবে। হা করে সে হুংকার ছাড়ল। হুংকারের সাথে গলা থেকে অদ্ভুত একটা হিসহিস শব্দ হলো। তারপরেও হুংকারটা যথেষ্ট জোরাল ছিল, ঘরের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলল।

তারপর সে আমাকে আক্রমণ করল। লোকটা অত্যন্ত শক্তিশালী। পেটে লাথি খেয়ে আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম।

ইয়ুকা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করল। ও সেখানে জমে গিয়েছে, কী করবে বুঝতে পারছে না।

“পালাও!” আমি চিৎকার করলাম, কিন্তু সে আমাকে ফেলে কোথাও গেল না। দাঁড়িয়েই থাকল।

লোকটা হাত দিয়ে তার গলা ধরে আমাকে রক্তাক্ত তাতামির উপর লাখি মারতে লাগল। সেই সাথে অশ্রাব্য গালিগালাজ। কথা বলার সময় তার মুখ থেকে থুথু আর রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আমার গায়ে পড়ছিল।

আমি লোকটার হাত কামড়ে ধরলাম। সে সাথে সাথে হাত টেনে নিল। ইক সময়ই আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। আমি আর ইয়কা এক সাথে দৌড় লাগালাম।

নোটার প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল কিন্তু এই রক্তক্ষরণে মরবে মনে হচ্ছে না। কোন কুকুর হলে হয়তো এতক্ষণে হার মেনে নিত কিন্তু মানুষের কথা আলাদা। লোকটা ক্রোধে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, পাল্টা আক্রমন করেছিল।

আমি আর ইয়ুকা যখন দৌড়ে হলওয়ে পার হচ্ছিলাম তখন পেছনে বজ্রপাতের মত জোরালো শব্দ হলো। লোকটা স্লাইডিং ডোর দিয়ে এমনভাবে উড়ে বেরিয়ে এসেছে যে একটুর জন্য দরজাটা ভেঙে পড়েনি।

আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কোনভাবেই একে খুন করা আমার ক্ষমতার মধ্যে নেই। সে আমার চেয়ে অনেক অনেক গুণ শক্তিশালী। আমি হয়তো তাকে বারবার কামড় দিতে পারতাম কিন্তু সে সেফ দাঁড়িয়ে আমাকে লাখি মারলেই হতো। আর সে যদি আমাকে মেরে ফেলতে পারে তাহলে এরপর ইয়কাকে মারবে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করব।

আমরা মূল দরজার দিকে ছুটতে লাগলাম। লোকটার পায়ের শব্দ কানে আসছিল, সে আমাদের পেছন পেছন দৌড়ে আসছে। শব্দটা ক্রমেই নিকটতর হচ্ছে।

আম্মুর ঘর থেকে বেরিয়ে একটা বাঁক নিলেই সোজা হলওয়ে। মূল দরজা একদম কাছে হলেও আমাদের মনে হচ্ছিল অনন্তকাল লাগছে।

দরজার প্রায় কাছে পৌঁছে যেতেই ইয়ুকা পা পিছলে মেঝের উপর উলটে পড়ল।

“ইয়ুকা!” আমি চিৎকার করলাম। থামার চেষ্টা করলাম, কিন্তু অনেক জোরে দৌড়াচ্ছিলাম, সহজে থামতে পারলাম না। দরজার কাছে রাখা জুতায় লেগে বাড়ি খেলাম দরজায়, তারপর পড়ে গিয়ে থেমে গেলাম।

আমি ঘুরে উঠে ইয়ুকার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চাইলাম। কিন্তু আমার পাগুলো যেন ভয়ে জমে গেছে।

লোকটা ইয়ুকার সামনে দাঁড়িয়েছিল, গলা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে ভয়াবহ লাগছিল। সে কিছু একটা বলছিল কিন্তু কথাগুলো বোঝার অবস্থায় ছিল না।

সে আমার দিকে এগিয়ে এল, দু-হাত সামনে বাড়ানো যেন আমি পালিয়ে যেতে না পারি।

আমি নড়তে পারছিলাম না। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইয়ুকাকে একা ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।

এখন আমি কি করব? চিন্তা করে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। ক্রোধ আর হতাশা আমাকে পেয়ে বসেছিল। লোকটা আমাকে আরেকবার তাকে আক্রমণ করার কোন সুযোগই দেবে না।

আমি পরাজয় মেনে নেয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলাম।

লোকটা ইয়ুকাকে ঘৃণা করত, ওর সাথে খারাপ অনেক কিছু করেছিল, অথচ আমি এতটাই দূর্বল ছিলাম যে ওকে রক্ষা করতে পারলাম না। যত কিছুই চেষ্টা করি না কেন আমি আসলে দূর্বল। যদি আরেকটু শক্তিশালী হতাম তাহলে হয়তো ইয়ুকাকে রক্ষা করতে পারতাম লোকটার কাছ থেকে…

হাতগুলো প্রায় আমার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল।

মেঝেতে পড়ে থাকা অবস্থা ইয়ুকা তাকাল আমার দিকে।

“দুঃখিত, আমি পারলাম না,” ফিসফিসিয়ে বললাম তাকে। ওর থেকে চোখ সরিয়ে ফেললাম। মাথা নামিয়ে অন্তিম মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

আলো নেভানো থাকলেও জানালা দিয়ে বাইরের আলো এসে ঘরটা আলোকিত করে তুলেছিল। মাথা নিচু করে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম লোকটার হাতের ছায়া আমার দিকে এগিয়ে আসছে। হলওয়ে থেকে দরজার কাছে ছায়াটা খালি লম্বাই হচ্ছে।

দুঃখিত, আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারলাম না… ছায়ার সাথে সাথে গলা থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের ফোঁটাও সামনে এগিয়ে আসছিল। সামনে পড়ে থাকা জুতার উপরও কয়েক ফোঁটা পড়ল।

যদি আমরা আগের মত আবার খেলতে যেতে পারতাম…

লোকটার ছায়া আমার ছায়ার কাছে পৌঁছে গেল। আমি মাথা নিচু করেই থাকলাম, নড়ছিলাম না। লোকটার দু হাত আমার মুখের দুপাশে পৌঁছে গেল। চোখের কোনা দিয়ে আমি রক্তাক্ত লাল হাতগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। তার ছায়া আমাকে এমনভাবে ঢেকে ফেলল যেমনভাবে সূর্য অস্ত গেলে চারদিক আঁধারে ঢেকে যায়।

ইয়ুকা…

আমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

সেই মুহূর্তে আমার পেছনে কিছু একটা শুনতে পেলাম। আমার পেছনে দরজার বাইরে জুতার শব্দ। একটা কাঁচকোঁচ শব্দ হলো তারপর আমার পায়ের কাছে ধাতব কিছু একটা এসে পড়ল।

মাথা নিচু করে ছিলাম বলে জিনিসটাকে ঝনঝন করে পড়তে দেখলাম। লোকটার ছায়া পড়ার পরও জিনিসটা চকচক করছিল।

ঝনঝন শব্দের কারনে আমার দুপাশে হাত দুটো থেমে গেল। এক মুহূর্তের জন্য সব শব্দ থেমে গেল। যেন সময়ই থেমে গিয়েছিল।

আবার জুতার শব্দ শোনা গেল। কিন্তু সেগুলো এবার দূরে সরে যাচ্ছিল। খবরের কাগজ দেয়ার জন্য দরজায় একটা সুট লাগানো ছিল। ক্যাঁচকোঁচ শব্দটা ওটার থেকে এসেছে।

আমি জানতাম আমাদের যে পিছু নিয়েছিল এটা সেই লোকটা। যার ছায়া আমি একটু আগে জানালায় দেখেছিলাম।

ছায়ার উপস্থিতি আগে থেকে আমার জানা থাকার কারনে লোকটা আবার তৈরি হওয়ার আগেই আমি সরে যেতে পারলাম। এক মুহূর্তের সুযোগ আমাদের ভাগ্য তৈরি করে দিল…

***

মেয়েটা আর তার কুকুর দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি অন্যদিকে এক কোনায় লুকিয়ে ছিলাম। ওরা আমাকে খেয়াল করেনি।

ওরা দৃষ্টির আড়াল হওয়ার পর আমি বাড়িতে গিয়ে ঢুকলাম। সামনের দরজা লক করা ছিল না। ভেতরে লোকটার মৃতদেহ চিত হয়ে পড়ে আছে। পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম ছুরিটার হাতল পর্যন্ত সরাসরি লোকটার হৃদপিণ্ডে ঢুকে আছে। রক্তের একটা পুকুর সৃষ্ট হয়েছে লোকটার চারপাশে। হল থেকে রক্তের একটা ধারাও চলে এসেছে দরজা পর্যন্ত। ভালো করে সবকিছু লক্ষ্য করলাম। খেয়াল রাখলাম যেন কোন কিছু স্পর্শ না করি। লোকটা কে তা আমার জানা ছিল না। অনুমান করছি মেয়েটার বাবা হবে। ওর কোন মা নেই? আমি একটা ছবি তুলে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। আসার সময় ভাবছিলাম ছুরিটা নিয়ে আসব কিনা, পড়ে ভাবলাম থাক-দেখে মনে হচ্ছিল ছুরিটা তার প্রকৃত জায়গা খুঁজে পেয়েছে।

চলে আসার আগে জামার হাতা দিয়ে দরজার নব ভালো করে মুছে এলাম। আমার হাতের ছাপ কোথাও পাওয়া যাক তা অবশ্যই চাই না।

বাসায় ফিরে দেখি সাকুরা টিভি দেখতে দেখতে হোমওয়ার্ক করছে।

“কোথায় গিয়েছিলে?” সে জানতে চাইল।

ওকে বললাম শপিং মলের কথা। তারপর নাস্তা করলাম।

নাস্তার পর আবার মেয়েটার বাসার দিকে গেলাম। দূর থেকেই হৈচৈ কানে আসছিল। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলাম লোকজনের ভিড়। পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই কেউ ফোন করে পুলিশে খবর দিয়েছে।

পেট্রোল কারের লাল আলো বাড়ির দেয়ালে ঘুরে ঘুরে পড়ছিল। রাস্তায় দাঁড়ানো লোকগুলো ফিসফিস করছিল। তারা সম্ভবত প্রতিবেশি হবে-এপ্রন পরা গৃহিণী আর পাজামা পরা মধ্যবয়স্ক লোকজন সব। আমি ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকালাম, আর ওদের কথা শোনার চেষ্টা করলাম।

যা শুনলাম তাতে মনে হল যে মহিলা এই বাড়িতে থাকে, সে বাসায় ফিরে দেখতে পায় লোকটা বুকে ছুরি নিয়ে মূল দরজার কাছে পড়ে আছে।

তার মানে লোকটা মেয়েটার বাবা ছিল না।

আমি আস্তে ধীরে এপ্রন পরা এক মহিলার সাথে খাতির জমিয়ে ফেললাম। বাড়িটার বাসিন্দাদের সম্পর্কে তার কাছে জানতে চাইলাম। সে যদিও আমাকে চিনত না, কিন্তু খুশি মনে আমার প্রশ্নের উত্তর দিল। উত্তেজনার চোটে কোন সন্দেহ করল না।

বাড়িতে এক মহিলা, তার মেয়ে আর একটা কুকুর থাকত। ডিভোর্সের কারনে মেয়েটার বাবা ছিল না। মেয়েটা স্কুলে যেতে চাইত না। তার বদলে সে সারাদিন কুকুরটাকে নিয়ে ঘরেই থাকত।

এপ্রন পরা মহিলার দেয়া তথ্য অনুযায়ি মেয়েটা আর কুকুরটা নিখোঁজ। কেউ জানে না তারা এখন কোথায়।

আমি ভিড় থেকে সরে এসে হাঁটতে লাগলাম। এক ব্লক দূরে এসে দেখলাম কিছু বাচ্চাকাচ্চা সাইকেল চালিয়ে ক্রাইম সিন দেখতে যাচ্ছে, যেন কোন উৎসব হচ্ছে সেখানে।

***

এক সারি কংক্রিটের সিঁড়ি ব্রিজ থেকে নদীর তীর পর্যন্ত নেমে গিয়েছে, যে জায়গাটা সবুজ ঘাসের সমুদ্রে ঢাকা।

দিনটা সুন্দর ছিল। সিঁড়ির উপর পরিস্কারভাবে আমার ছায়া পড়ছিল। সূর্যের আলোয় সবুজ ঘাসগুলো ঝকমকিয়ে উঠছে, আর বাতাসে সেগুলোর উপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে যেন।

সিঁড়ির শেষে পৌঁছে আমি দেখলাম চারদিকে শুধু ঘাস আর ঘাস, লম্বায় আমার সমান। উপরে তাকালে বিশাল ব্রিজটা দেখা যায়, সাথে মেঘহীন আকাশ।

ঘাস ঠেলে আমি সামনের খোলা জায়গাটায় গেলাম। একটা গোল্ডেন রিট্রিভার চুপচাপ খোলা জায়গাটার মাঝখানে বসে আছে। মেয়েটার কোন চিহ্ন নেই।

কুকুরটা কোথাও বেঁধে রাখা ছিল না। তারপরেও ঘাসের দেয়াল দিয়ে ঘিরে থাকা জায়গাটায় সে মূর্তির মত বসে ছিল। যেন সে জানত কেউ একজন তার খোঁজে কোন এক সময় সেখানে আসবে। কী সুন্দর একটা কুকুর, আমি ভাবলাম। চোখগুলোতে বুদ্ধির ছটা।

আমি ভেবেছিলাম কুকুর আর মেয়েটা, দু-জনকেই সেখানে পাব। কিন্তু আমার অনুমান অর্ধেক সত্যি হলো।

কাছে গিয়ে কুকুরটার মাথায় হাত বোলালাম। কুকুরটাকে ভীত মনে হলো না, আমাকে স্পর্শ করতে দিল।

ওর কলারের সাথে একটা কাগজ গোঁজা ছিল। সেটা বের করে নিলাম।

“যে আমাকে ছুরিটা দিয়েছে তার জন্য,” উপরে লেখা।

মেয়েটা আমাকে একটা চিঠি লিখেছে। সে অনুমান করেছে আমি তাকে খুঁজতে এখানে আসব।

চিঠির কাগজটা একটা নোটবুক থেকে ছেঁড়া, আর পেন্সিল দিয়ে লেখা। সম্ভবত সিঁড়িতে বসে লেখা, ভাঙাচোরা লেখা দেখে তাই মনে হলো।

যদিও লেখা উলোটপালট ছিল কিন্তু তাও আমি মোটামুটি এর অর্থ বুঝতে পারলাম। সে লিখেছে কেন সে কুকুরগুলোকে চুরি করত আর সেগুলোকে ব্রিজের নিচে এনে কি করত। সে লোকটার হিংস্রতার বর্ণনা দিয়েছে আর আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছে ছুরিটা তাকে দেয়ার জন্য। একদম শিশুসুলভ লেখা, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম সে তার মত করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।

শেষে লিখেছে কুকুরটাকে আমি যেন গ্রহণ করি। এটা লিখতে নিশ্চয়ই তার অনেক সময় লেগেছে। অনেকবার লিখে মোছা হয়েছে আবার লেখা হয়েছে। নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট করে লিখেছে। আমার ধারণা ও বুঝতে পেরেছিল কুকুরটাকে ওর সাথে পাওয়া গেলে হয়তো সেটাকে মেরে ফেলা হতে পারে।

আমি চিঠিটা পকেটে রেখে ধৈর্য ধরে বসে থাকা কুকুরটার দিকে তাকালাম। কুকুরটার গলায় শুধু কলার পরানো ছিল, কোন ফিতা ছিল না। কিভাবে এটাকে নিয়ে যাব ভাবছিলাম। নাকি এখানেই ফেলে যাব?

গতকাল দেখেছিলাম মেয়েটা ইশারা করতেই কুকুরটা পিছু পিছু গিয়েছিল, আমিও সেরকম চেষ্টা করলাম। কুকুরটা সুন্দর মত আমার পিছু পিছু আসতে থাকল।

বাড়ি ফেরা পর্যন্ত পুরো রাস্তা কুকুরটা আমার পেছন পেছন হেঁটে এল। আমি ভেবেছিলাম যদি অন্যদিকে যায় তাহলে আর ডাকব না। কিন্তু সে তা করেনি।

বাবা-মা বাসায় ছিল না, কিন্তু সাকুরা টিভির সামনে বসে ওর হোমওয়ার্ক করছিল। কুকুর দেখে ও চমকে গেল। আমি ওকে বললাম এটা এখন থেকে আমাদের কুকুর। সাকুরা চমকে গেলেও তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিল। লাশ দেখার চেয়ে কুকুর অনেক ভাল। ও চিন্তা করতে শুরু করে দিল কুকুরটার নাম কি রাখবে। আমি ওকে সেখানেই থামিয়ে দিলাম। ব্রিজের নিচে আমি কুকুরটার প্রাক্তন মনিবকে ওর নাম ধরে ডাকতে শুনেছিলাম। চিঠিতেও নামটা লেখা ছিল। সাকুরাকে বললাম, কুকুরটার নাম ইয়ুকা।

সকালে জানালা দিয়ে মেয়েটার ঘরে কি দেখেছিলাম মনে পড়ল। মেয়েটা তখন লোকটার গলায় কামড় বসাচ্ছিল। প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি কি হচ্ছিল-চিঠিটা পড়ার পর বুঝতে পেরেছি। মেয়েটা অন্য কুকুরগুলোর সাথে ব্রিজের নিচে লড়াই করে নিজেকে প্রস্তুত করছিল ঐ লোকটাকে খুন করার জন্য।

ইয়ুকাকে সাকুরার হাতে ছেড়ে দিয়ে আমি সোফায় বসে চিঠিটা বের করে আবার পড়লাম। পেন্সিলে লেখা চিঠিটা পড়ে বোঝা যাচ্ছিল অন্য অনেক বাচ্চার মত সেও কঠিন সময় পার করছিল। বুঝতে পারছিলাম ও ওর কুকুরের উপাসনা করত।

আগের রাতের কথা মনে পড়ল আমার। লড়াইয়ের আগে মেয়েটা রিট্রিভারটার দিকে তাকাত। জামাকাপড় যাতে নোংরা না হয় সেজন্য সেগুলো আগে খুলে নিত।

মেয়েটা কুকুরের সাথে এমনভাবে কথা বলছিল যেন ঐশী বানী শুনতে পারছিল। চিঠিতেও সে স্পষ্ট লিখেছে যে সে কুকুরটার কথা বুঝতে পারত।

“এই কুকুরটা আমাদের কী করে হলো?” সাকুরা জানতে চাইল।

আমি বললাম কুকুরটা আমার এক বন্ধুর ছিল। কিন্তু ওর সৎ বাবা কুকুর ঘণা করে আর কুকুরটার উপর অত্যাচার করত। তাই বন্ধু আমাকে বলেছে এটার দায়িত্ব নিতে। কথাটা সত্যির থেকে খুব একটা দূরে নয়। চিঠিতে লেখা ছিল মেয়েটার মায়ের বয়ফ্রেন্ড কিভাবে কুকুরটার উপর অত্যাচার করত। যে কারনে সে লোকটাকে খুন করার প্ল্যান করতে বাধ্য হয়।

“কে এরকম একটা সুন্দর কুকুরের উপর অত্যাচার করতে পারে?” সাকুরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। ইয়কা মাথা ঘুরিয়ে ওর গভীর কালো চোখগুলো দিয়ে সাকুরার দিকে তাকাল। আমি জানি না মেয়েটা যা বলেছে কুকুরটা সম্পর্কে, সেটা আসলেই সত্যি কিনা, কুকুরটা আসলেই এত কিছু জানত কিনা। মেয়েটা হয়তো স্রেফ কুকুরটার চোখে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখত।

আমার সেল ফোন বাজল। মোরিনো ফোন করেছে। আমি ইয়ুকা আর সাকুরাকে রেখে উপরের তলায় গেলাম। মোরিনো আমাকে আমাদের পাশের এলাকায় হওয়া একটা খুনের খবর দিল।

“আমরা সেদিন যে রাস্তা দিয়ে গেলাম না? ওদিকেই হয়েছে খুনটা! মহিলাটা তার বাড়ির দরজার সামনে লোকটাকে পড়ে থাকতে পেয়েছে।”

“আচ্ছা,” আমি বললাম। তারপর লোকটার গলায় কিভাবে দাঁতের দাগ এল, বেডরুম থেকে দরজা পর্যন্ত রক্তের দাগ, আর কিভাবে আরেকজনের এগিয়ে দেয়া ছুরিটা দিয়ে লোকটা খুন হলো সব ওকে ব্যাখ্যা করলাম।

“তুমি এত কিছু জানো কী করে?”

“আমরা সেদিন যে পিচ্চি মেয়েটাকে হেঁটে যেতে দেখেছিলাম সেই আসলে খুনি,” বলে ফোন রেখে দিলাম।

অপরাধিদের কর্মকাণ্ড দেখতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। আমি সবসময়ই একজন তৃতীয় পক্ষ, কখনো ঘটনার সাথে নিজেকে জড়াই না। এইবার আমি সেই শর্ত ভঙ্গ করেছি। মেয়েটাকে আর কুকুরটাকে দরজার দিকে দৌড়ে যেতে দেখলাম, পিছু পিছু লোকটাও ছুটে গেল। আমি নিজে কিছু বোঝার আগেই কখন যেন মেয়েটার দিকে ছুরিটা ছুঁড়ে দিলাম।

কাজটা খারাপ করেছি বলে আমার মনে হয় না। ন্যায়-অন্যায় নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। হয়তো আমার মনে হয়েছিল ছুরিটা তার ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছে। ছুরিটা চেয়েছে এই ঘটনার মধ্যে অংশগ্রহণ করতে।

***

কয়েক ঘন্টা পর মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। উড্রান্তের মত ঘোরাঘুরি করছিল। তাকে নিরাপত্তা কাস্টডিতে নেয়া হয়। ওর মুখে আর কাপড়ে রক্ত লেগে ছিল।

মোরিনোর থেকে পাওয়া মেসেজে আমি এই তথ্য জানতে পারলাম। আমার রুম অন্ধকার আর নিস্তব্ধ হয়ে ছিল। আমি কখনোই মিউজিক শুনি না। নিচের তলা থেকে আসা শব্দ থেকে বুঝতে পারছিলাম সাকুরা কুকুরটার সাথে খেলছে।

আমি চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতে লাগলাম গ্রীষ্মের কোন গরমের দিনে মেয়েটা আর কুকুরটা ব্রিজের নিচে খেলছে। আর সবুজ লম্বা ঘাসগুলো ওদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।

৪. স্মৃতি/ যমজ

স্মৃতি/ যমজ

আমার একজন ক্লাসমেট আছে যার বংশের পদবি মোরিনো। আমাদের মধ্যে মাঝে মাঝে কথা হয়। ওর আসল নাম ইয়োরু। পুরো নাম-মোরিনো ইয়োরু, যার অর্থ “রাতের অরণ্য।” ওর চোখ চুল সব ঘন কালো। আমাদের স্কুলের ইউনিফর্মও কালো, আর মোরিনো সবসময় কালো জুতা পড়ত। কালোর বাইরে একমাত্র অন্য রং বলতে ওর পোষাকে যেটা ছিল সেটা হল ইউনিফর্মের লাল স্কার্ফ।

মোরিনোর কালো পোশাক-পরিচ্ছদের সাথে ইয়োৰু নামটা ভালো যায়। কালোর প্রতি ওর ভালবাসা এত বেশি যে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যদি রাতের আঁধারকে মানুষের রূপ দেয়া হয় তাহলে সেটা দেখতে ওর মতই লাগবে।

এত সব কালোর বিপরীতে ওর ত্বকের রং ছিল চাঁদের মত ফ্যাকাসে সাদা। মনে হত জীবনে কোনদিন সূর্যের মুখ দেখেনি। ওকে রক্ত মাংসের মানুষও মনে হত না, যেন পোরসেলিন দিয়ে বানানো। ওর বাম চোখের নিচে ছোট্ট একটা তিল ছিল, যে কারনে ওকে আরো রহস্যময়ি লাগত। মনে হত যেন একজন ভবিষ্যৎ বক্তা।

এরকম একটা মেয়েকে আমি একবার একটা সিনেমাতে দেখেছিলাম। সিনেমার শুরুতে এক দম্পতিকে পানিতে ডুবে মরতে দেখিয়েছিল। পুরো সিনেমার বাকিটা ছিল মৃত্যুর পর তাদের জীবন নিয়ে। মূল চরিত্রগুলো ভূত ছিল, সাধারণ মানুষরা তাদের চোখে দেখতে পারত না। কিন্তু একজন মেয়েকে পাওয়া গেল যে তাদের দেখতে পেত। সেই মেয়েটাই সিনেমাটার নায়িকা, নাম ছিল নিডিয়া।

“আমাকে আসলে অর্ধমৃত বলা যায়,” নিডিয়া ব্যাখ্যা করেছিল কেন সে ভূত দেখতে পায়। “আমার হৃদয় আঁধারে পরিপূর্ণ।”

নিডিয়ারও সব পোশাক ছিল কালো আর তুকের রং ছিল ফ্যাকাসে। সে ঘরের বাইরে বের হত না। বাইরে যাওয়ার বদলে বাসায় বসে বই পড়তে পছন্দ করত। আর ওকে দেখে মনে হত পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।

লোকজন ওর মত মানুষদেরকে “গ” বলে ডাকত। গথ বলতে আসলে একটা সংস্কৃতি, একটা ফ্যাশন, আর একটা স্টাইলকে বুঝায়। অনলাইনে ‘গথ’ কিংবা ‘গসু সার্চ দিলে হাজার হাজার পেইজ পাওয়া যাবে। ‘গথিক’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ‘গথ’, কিন্তু এই নামের ইউরোপিয়ান স্থাপত্য স্টাইলের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বরং ভিক্টোরিয়ান লন্ডনের জনপ্রিয় গথিক হরর উপন্যাসের সাথেই এর মূল সম্পর্ক। যেমন ‘ফ্রাঙ্কেন্সটাইন’ কিংবা ‘ড্রাকুলা।’

মোরিনোকে চোখ বন্ধ করে গথ বলা চলে। অত্যাচারের প্রক্রিয়া কিংবা হত্যা করার যন্ত্রপাতির প্রতি ওর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। মানুষের অন্ধকার দিক নিয়েও ওর আগ্রহ প্রচুর যা গথদের মধ্যে কমন।

মোরিনো প্রায় কখনোই কারো সাথে কথা বলে না। আমাদের স্বাস্থ্যবান, হাউকাউ করা ক্লাসমেটদের সাথে ওর বিন্দুমাত্র কোন মিল নেই। কোন ক্লাসমেট যদি হেসে ওর সাথে কথা বলে তাহলে মোরিনো সেফ ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে, ওর শূন্য অভিব্যক্তি অপরিবর্তিত রেখে শুধু বলবে “ওহ আচ্ছা।” তারপরেও কেউ যদি ওর কাছ থেকে কোন উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে তাহলে তাকে ব্যর্থ মনে ফেরত যেতে হবে কারণ মোরিনো আর কিছুই বলবে না।

বশির ভাগ মানুষই ওর সাথে কথা বলতে এলে এরকম উপেক্ষার শিকার হয়। ক্লাসের মেয়েরা কথা বলার অনেক চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে।

ওর এই হাবভাব ওর চারপাশে একটা দেয়াল তৈরি করে, সবাইকে দূরে সরিয়ে রাখে। সবাই যখন গল্প করছে কিংবা হাসাহাসি করছে, তখন দেখা যায় মোরিনো কোথাও চুপচাপ একাকি বসে আছে। তখন ওকে দেখে মনে হয় যেন অন্য কোন জগতে চলে গিয়েছে, কিংবা ও যেখানে বসে আছে সেখানে কোন কিছুর ছায়া পড়েছে।

কিন্তু মোরিনো আসলে ইচ্ছা করে কাউকে উপেক্ষা করত না। ওর সাথে কিছুদিন কথা বলার পর আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি। ও আসলে হাসিখুশিভাবে কথা বলতে পারত না, মানুষটাই ওরকম ছিল। অন্যদের সাথে ওর কোন সমস্যা নেই। ও সবার থেকেই সমান দূরত্ব বজায় রেখে চলত।

ভালোভাবে ওকে পর্যবেক্ষণ করার পর আমি সমস্যাটা বুঝতে পারলাম। মোরিনো যখন কারো সাথে কথা বলত তখন সে আসলে বুঝতে পারত না কি প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে, উত্তর দেয়ার মত কিছু সে খুঁজে পেত না। কিন্তু এর পুরোটাই স্রেফ আমার অনুমান ছিল, সত্যি সত্যি সে কী ভাবত তা আসলে আমি জানতাম না। বেশিরভাগ সময়ে তার কোন অভিব্যক্তি দেখা যেত না। যে কারনে ও কী ভাবছে তা কল্পনা করা দুরূহ ছিল।

আমাদের প্রথম আলাপ হওয়ার কিছুক্ষণ পরে আমার মনে হয়েছিল ও হয়তো কোন ধরনের পুতুল-টুতুল হবে। ওর প্রতিক্রিয়া মানুষের চেয়ে কোন জড়বস্তুর সাথেই বেশি মিলে।

***

অক্টোবরের এক বুধবার। গাছের পাতাগুলো তখন সবুজ থেকে লাল হতে শুরু করেছে। মোরিনো মাথা নিচু করে এসে ক্লাসে ঢুকল। ক্লাসের উপস্থিত সবাই সাথে সাথে থেমে গেল। ওর লম্বা ঘন কালো চুলগুলো মুখ ঢেকে রেখেছিল। ওর ধীর গতির পা টেনে টেনে হাঁটা দেখতে কেমন জানি ভূতুড়ে লাগত। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই হয়তো ভাবত ওকে দেখতে ভুতের মত লাগে-কিন্তু ওর আশেপাশের পরিবেশ অন্য রকম, আরো বিপজ্জনক কিছু মনে হয়। যেন কোন বন্য প্রাণী।

ওর চারপাশের দেয়াল যেন স্বচ্ছ কোন গোলক যেটায় সুচালো পেরেক লাগানো আছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল কেউ ওর কাছাকাছি এলে ও তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। বরাবরের মতই ও নির্বাক ছিল, আর কেউই ওর সাথে যেচে পড়ে কথাও বলতে গেল না। কিন্তু তারপরেও ওর মুড সেদিন অন্যরকম লাগছিল। ওর কাছাকাছি যারা বসে ছিল তাদের মুখেও টেনশনের ছায়া দেখা যাচ্ছিল।

আমার অতটা কৌতূহল হচ্ছিল না। আমি ধরে নিয়েছিলাম কোন কারনে হয়তো ওর মেজাজ খারাপ। সেদিন আর পরে আমাদের কথা বলার সুযোগ হয়নি। সুতরাং কারনটাও আর জানা সম্ভব হয়নি (আমি যখন আমার ক্লাসমেটদের সাথে কথা বলি তখন মোরিনো আমার সাথে কথা বলে না। কারণটা জানা গেল পরেরদিন, স্কুল ছুটির পর।

হোমরুম শেষ হওয়ার পর সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। ক্লাস এত নিরব হয়ে গেল যে বিশ্বাসই হচ্ছিল না একটু আগে এখানে কি রকম হাউকাউ হচ্ছিল। শুধু খালি ডেস্কগুলো, মোরিনো আর আমি রুমে থেকে গিয়েছিলাম।

জানালা দিয়ে আরামদায়ক ঠান্ডা বাতাস এসে ঢুকল। আমাদের পাশের ক্লাস তখনো ছুটি হয়নি। হলের অন্য মাথা থেকে টিচারের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।

মোরিনো ওর সিটে বসা, হাতগুলো পাশে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঝুলছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ ক্লান্ত।

“আমার ঘুম হচ্ছে না,” হাই তুলতে তুলতে বলল সে। ওর চোখের নিচে কালি জমেছিল। চোখগুলো আধবোজা হয়ে ছিল, এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যেন দূরে কিছু একটা দেখছে।

আমি আমার সিটে বসে ছিলাম, বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। ওর সিট রুমের একদম অন্য কোণায়। রুমে আর কেউ ছিল না বলে ওর কথা ভালো মতই শুনতে পেলাম, কাছাকাছি যেতে হলো না।

“এ কারনেই কি তুমি কালকে অদ্ভুত আচরণ করছিলে?”

“এরকম হয় মাঝে মাঝে। যত চেষ্টা করি না কেন ঘুম আসে না। ইনসমনিয়া হয়তো।”

সে উঠে দাঁড়াল। মনে হচ্ছিল ঘুমে পড়ে যাচ্ছে, টলতে টলতে ব্ল্যাক বোর্ডের দিকে এগুলো।

রুমের সামনে একটা আউটলেট ছিল। একটা কর্ড দিয়ে সেটার সাথে ইরেজার ক্লিনার লাগানো। মোরিনো সেই কর্ডটা নিয়ে গলায় পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

“নাহ ঠিক লাগছে না,” সে মাথা নাড়তে নাড়তে কর্ডটা খুলে রাখল। “আমি যখন ঘুমাতে পারি না তখন গলায় কিছু একটা পেঁচিয়ে চোখ বন্ধ করি। কল্পনা করি গলায় ফাঁস দিয়ে আমাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। তখন ঘুম আসে-গভীর পানিতে ডুবে যাওয়ার মত অনুভূতি হয়।”

আমার বিরক্ত লাগছিল। ও কি অনিদ্রার চোটে পাগল হয়ে গেল নাকি? “এতে যদি উপকার হয় তাহলে করছো না কেন?”

“যেকোন দড়ি পেঁচালেই হবে না।”

মোরিনো একটা বিশেষ ধরনের দড়ি খুঁজছিল, ইরেজার ক্লিনারের সাথের কর্ডটা দিয়ে সে কাজ হবে না।

“আমি যেটা ব্যবহার করতাম সেটা হারিয়ে ফেলেছি। নতুন একটা খুঁজছি কিন্তু..” সে হাই তুলল। “আমি জানি না আসলে কি খুঁজছি। খুঁজে পেলে ইনসমনিয়াকে গুডবাই দিতাম।”

“আগে কি ব্যবহার করতে?”

“জানি না। এমনি খুঁজে পেয়েছিলাম। ওটা ছাড়া ঘুমাতে পারার পর কোথায় রেখেছিলাম ভুলে গিয়েছি।”

চোখ বন্ধ করে গলায় হাত বুলালো। “আমার শুধু মনে আছে জিনিসটা কেমন লাগত..” ঝট করে চোখ খুলল যেন হঠাৎ কোন আইডিয়া এসেছে মাথায়। “চল দড়ি কিনতে যাই। তুমিও কিছু দড়ি কিংবা কর্ড কিনে রাখতে পার, কোন একদিন কাজে লাগতে পারে। কোনদিন আত্মহত্যা করতে চাইলে ব্যবহার করতে পারবে।”

অন্য ক্লাসটার ছুটি হলো। চেয়ার সরানোর শব্দ কানে আসছিল আমার।

***

স্কুল থেকে বেরিয়ে শহরের শেষ মাথার এক জেনারেল স্টোরের দিকে পা বাড়ালাম আমরা। জায়গাটা বেশ দূরে। কিন্তু বড় রাস্তায় অনেক বাস থাকায় সেখানে যেতে আমাদের খুব একটা সময় লাগল না। বাসটা অর্ধেকের মত খালিই ছিল। মোরিনো সিটে বসল আর আমি দাঁড়িয়ে স্ট্র্যাপে ঝুলতে ঝুলতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ও মাথা নিচু করে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু বাসের দুলুনিতে ঘুমানো সম্ভব ছিল না। এক ফোঁটা ঘুমও আসার আগে আমরা জায়গা মত পৌঁছে গেলাম।

বিশাল দোকানটা কন্সট্রাকশনের কাঠ আর ধাতব উপাদান, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে ভর্তি ছিল। আমরা সারি সারি সেলফের ভেতরের পথগুলো দিয়ে ঘোরাফেরা করলাম, দড়ির মত কিছু দেখলেই থেমে পরীক্ষা করলাম। টিভি কিংবা ভিডিও প্লেয়ার কানেক্ট করার এভি কেবল, কাপড় ঝুলানোর দড়ি, ঘুরি উড়ানোর সুতা…সব কিছু ওখানে ছিল।

মোরিনো সেগুলো একটা একটা করে তুলে প্রথমে আঙুল বুলিয়ে কিছু একটা অনুভব করার চেষ্টা করল-যেন সাবধানতার সাথে কোন পোশাক পরীক্ষা করে দেখছে।

ওর মতামতগুলো শুনে মনে হল আত্মহত্যার জন্য আদর্শ দড়ি কিরকম হওয়া উচিত সে ব্যাপারে ও একজন বিশেষজ্ঞ। “এরকম চিকন তার হলে গলা কেটে যাবে। ইলেকট্রিক কর্ড বেশ শক্ত, কিন্তু দেখতে ভালো না।”

“প্লাস্টিকেরগুলো কেমন?” নিচের সেলফে রাখা প্লাস্টিকের তারগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলাম, শুধু ও কী বলে তা দেখতে।

অভিব্যক্তিহীন চেহারা নিয়ে ও মাথা নাড়ল। “ওগুলো প্রসারিত হয়। সমস্যা সৃষ্টি করে। এখানে আর কিছু দেখার নেই।”

দোকানের অন্য অংশে বিভিন্ন ধরনের চেইন পাওয়া গেল। একদম দুই সেন্টিমিটার পুরু মোটা ভারি চেইন থেকে এক কি দুই মিলিমিটারের সুক্ষ্ম চেইন পর্যন্ত সব। টয়লেট পেপারের মত রোল করে সেলফে রাখা ছিল। কাছাকাছি একটা মেশিন ছিল যেখান থেকে প্রয়োজন মত চেইন কেটে নেয়া যেত।

“এটা দেখ-খুবই পাতলা, কিন্তু এখানে লেখা এটা নাকি একশ পাউন্ড পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে, সে বলল, আঙুলের ফাঁকে একটা চিকন রুপার চেইন ধরে রেখেছে। গলায় পেঁচিয়ে দেখল। ধাতব চেইনটা আলো পড়ে চকমক করে উঠল। “দারুন দেখতে, এটা পড়লে একটা লাশকেও দেখতে ভালো লাগবে…কিন্তু এটা দিয়ে আত্মহত্যা করতে গেলে গলা কেটে মাংসে ঢুকে যাবে।”

চেইনটা আগের জায়গায় রেখে দিল। ওর প্রয়োজনের সাথে সেটা যায় না।

আত্মহত্যা করতে গেলে কিরকম দড়ি লাগবে সেই চিন্তা ভাবনার পেছনে সে অনেকটা সময় ব্যয় করল।

আমি যদি কাউকে গলায় পেঁচিয়ে মারতে চাই তাহলে কিরকম দড়ি খুঁজব? দোকানের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে আমিও এই চিন্তা করতে লাগলাম।

“গলায় সুড়সুড়ি লাগুক তা আমি চাই না,” আমি যখন ওকে হাতে বোনা খসখসে দড়ি দেখালাম তখন সে বলল। “পুরনো ফ্যাশনের দড়িগুলো দরকার, যেগুলো গ্রামের ফার্মগুলোতে ব্যবহার করে।”

ও যখন ফোর্থ গ্রেডে পড়ত তখন শহরের বাইরে এক জায়গায় থাকত, পাহাড়ি এলাকায়। এখান থেকে দুই ঘণ্টার ড্রাইভ।

“আমার মা যেখানে জন্মেছিল আর বড় হয়েছে, সেখানে আমার নানা নানির একটা ছোট ফার্ম আছে। আমার বাবা প্রতিদিন দু-ঘন্টা ড্রইভ করে কাজে যেত আর দুই ঘন্টা ড্রাইভ করে ফিরত।”

পরে ওরা সেখান থেকে চলে আসে ওর বাবার এই ডাইভিঙের ঝামেলা এড়াতে। এসব আমার কাছে নতুন খবর।

“আমি সবসময় ভেবেছি আত্মহত্যা করতে হলে তুমি হাতের রগ কাটবে, দড়িতে যে ঝুলতে চাইবে তা ভাবিনি,” আমি বললাম।

ও ওর হাত দুটো তুলে ধরল। এগুলোর কথা বলছ?”

ওর হাতগুলো একদম সাদা লাইনের মত দেখতে। একটা পরিস্কার কাটা দাগ দেখা যাচ্ছে। আমি কখনো এই দাগুগুলো সম্পর্কে জানতে চাইনি তাই জানি না কেন সে হাত কাটতে গিয়েছিল।

“এগুলো আত্মহত্যা করতে গিয়ে হয়নি, সেফ হঠাৎ ইচ্ছা হলো…”

ওর জীবন অনুভূতিহীন মনে হলেও আসলে কিছু অনুভূতি অবশিষ্ট ছিল। আর সেগুলো এতটাই শক্তিশালী ছিল যে এরকম ভয়াবহ কিছু ঘটাতে পারে। ওর বাইরের অভিব্যক্তিহিন অবস্থাটা অনেকটা থারমোফ্লাস্কের মত, বাইরে থেকে স্পর্শ করলে ভেতরের তাপ বোঝা যায় না। ভেতরে যাই ঘটুক ্না কেন তা বাইরের পৃষ্ঠ পর্যন্ত আসে না।

কিন্তু এরকম অনুভূতি যখন খুব শক্তিশালী হয়ে পড়ে তখন কিছু একটা করতে হয়। কেউ কেউ খেলাধুলা কিংবা ব্যায়াম করে, অন্যরা নিজেদের শান্ত করতে জিনিসপত্র ভাঙে। কিন্তু মোরিনো এই দুই দলের কোনটাতেই পড়ে না, সে তার নিজের উপরই নিজের অনুভূতিগুলোর প্রয়োগ ঘটায়।

হঠাৎ একটা পরিচিত গলায় আমার নাম শুনলাম।

ঘুরে দেখি আমার বোন, সাকুরা, একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে অবাক দৃষ্টি। ওর হাতে ডগ ফুডের ব্যাগ। শপিঙে বেরিয়েছে।

মোরিনো ঘুম ঘুম চোখ করে ছিল। ব্যাগের উপর কুকুরের ছবি দেখে সে কেঁপে উঠল।

সাকুরা আমাকে জানাল সে আমাকে এখানে দেখে কতটা অবাক হয়েছে, তারপর মোরিনোর দিকে তাকাল।

মোরিনো অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। সে যে সাকুরাকে এড়াতে চাইছিল তা নয়। ব্যাগের উপর কুকুরের ছবি এড়াতে অন্যদিকে তাকিয়েছিল। কোন সেলফে “কুকুর” লেখা থাকলে সেটার ধারে কাছেও ওকে টেনে নেয়া যাবে না।

“আর তোমার সুন্দরি বন্ধুটি কে?” সাকুরা জিজ্ঞেস করল, কৌতূহলি। আমি দ্রভাবে ওকে বুঝিয়ে বললাম সাকুরা ওকে যা ভাবছে সে সেরকম কেউ নয়। সে আমার কথা বিশ্বাস করল বলে মনে হলো না।

“ওকে। আম্মু আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। কুকুরের খাবার কিনলাম আর যাওয়ার সময় ড্রাই ক্লিনারস থেকে কাপড় তুলতে হবে।”

সাকুরা ওর পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে পড়ল। ওর হাতের লেখা আমার চেয়ে হাজার গুণ ভাল। ওর সামনে পরীক্ষা, পড়াশোনা নিয়ে দৌড়ের উপর থাকার কথা, কিন্তু তারপরেও কেউ কোন কাজের অনুরোধ করলে সেটা ফেলতে পারে না।

“তারপর পাশের বাসা থেকে কিছু টোফু আর পিচ্চি কমলা নিতে হবে। আর বাসায় ফেরার পর কুকুরটাকে হাটাতে নিয়ে যেতে হবে।”

সে মোরিনোর দিকে হাসিমুখ করে হাত নাড়ল।

মোরিনো ব্যস্ত ছিল কুকুরের ছবি যাতে চোখে না পড়ে সেই নিয়ে। এক হাতে সেলফে ভর দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে রেখেছিল।

সাকুরা চলে যাওয়ার পর আমি বললাম, “এখন তাকাতে পার।”

মোরিনো সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর যেন কিছুই হয়নি ভাব করে সেলফের ভেতর এক রোল তার পরীক্ষা করতে লাগল।

“তোমার বোন ছিল নাকি মেয়েটা?”

আমি মাথা ঝাঁকালাম।

“আমারো একটা বোন ছিল। যমজ বোন। অনেক আগে মারা গিয়েছে।”

এই কাহিনীও আমার জানা ছিল না।

“ওর নাম ছিল ইয়ু। ইয়ু…”

যখন ও এই কথাগুলো বলছিল তখন একই সাথে রুপালি তারের উপর আঙুল বোলাচ্ছিল। ওর নীলচে ঠোঁটগুলোর ফাঁক দিয়ে সুন্দর সাদা দাঁত চোখে পড়ছিল। নিচু স্বরে উচ্চারিত কথাগুলো যেন ঠোঁট আর দাঁত দুই জায়গা থেকে বের হচ্ছিল।

ইয়ু গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, মোরিনো ইয়োরু আমাকে বলল।

একগাদা তার-দড়ি গলায় পেঁচিয়ে দেখার পরেও মোরিনো ওর অনিদ্রার সমস্যা দূর করার মত কোন কিছু খুঁজে পেল না। আমিও কিছু কিনলাম না।

সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা পার্কিং লট পার হয়ে রাস্তার দিকে গেলাম। চোখের নিচের গভীর কালো দাগসহ মোরিনোকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন জোরে বাতাস শুরু হলেই ও উড়ে যাবে।

বিশাল জেনারেল স্টোরের আশেপাশে একদমই কিছু ছিল না। শুধু খোলা মাঠ আর শুকনো ঘাসে ঢাকা খালি জায়গা। সেগুলোর মাঝ দিয়ে নতুন পিচ ঢালা পথ এগিয়ে গিয়েছে। একসময় হয়তো এখানে অনেক কিছু হবে, সময় লাগবে তার জন্য।

রাস্তার এক পাশে বেঞ্চ বসানো বাসস্টপ ছিল, মোরিনো গিয়ে সেখানে বসল। যেসব বাস এখানে থামে তার একটা ওর বাসার দিকে যায়।

সূর্য নিচের দিকে নামছিল। আকাশ তখনো নীল। খালি মেঘগুলো গোলাপি রং ধারন করেছে।”তোমার বোন সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?” আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম। সে চুপচাপ বসে থাকল। কোন উত্তর দিল না।

রাস্তায় খুব একটা গাড়ি ছিল না। মাঝে মধ্যে দু-একটা শশা শো করে চলে যাচ্ছিল। বেশিরভাগ সময়ই খালি চওড়া পিচঢালা রাস্তা আর গার্ড রেইলের পরে শুকনো মরা ঘাসসহ ধুধু প্রান্তর। অনেক দূরে একটা আয়রন টাওয়ার, দিগন্তে বিন্দুর মত ফুটে আছে।

“কী জানতে চাও?” সে একসময় বলল।

“ইয়ু মারা গিয়েছিল যখন আমরা সেকেন্ড গ্রেডে পড়ি। তাই আমার খালি ওকে ছোট অবস্থাতেই মনে আছে। এমনকি যখন ওর বয়স আট বছরও নয়…সে সময় আমরা গ্রামে থাকতাম। সেখানে চারপাশে খামারের পর খামার ছাড়া আর কিছু ছিল না।”

ওদের বাড়ি ছিল এক পর্বতের ঢালে। পেছন দিকে বন, বাড়ি থেকে বনে পাখিদের ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যেত।

“ইয়ু আর আমি একই রুমে এক বিছানায় ঘুমাতাম। যখন রাত হত আর আমরা ঘুমাতে যেতাম তখন বিছানায় শুয়ে বাইরে অন্ধকারে প্যাঁচার ডাক শুনতে পেতাম।”

বাড়িটা ছিল পুরনো, কাঠের তৈরি। মেঝে, পিলার সব কিছু বয়সের ভারে কালো হয়ে গিয়েছিল। আগাছা জন্মেছিল ছাদের টাইলসের ফাঁকে। বাড়ির আশেপাশে ভাঙা টাইল্স পড়ে থাকত। অবশ্য বাড়িটা বেশ বড় আর আরামদায়ক ছিল। তাতামি ফ্লোর ছিল-সব রুমে, শুধু কিচেন বাদে। কিচেনে পরে লাগানো হয়েছিল। যমজ মেয়ে দুটো, ইয়োরু আর ইয়ু ঐ বাড়িতে তাদের বাবা-মা আর নানা-নানির সাথে বাস করত।

মোরিনোর বাবা প্রতিদিন দুই ঘন্টা ড্রইভ করে শহরে যেতেন কাজের জন্য। ওর নানা-নানিও বেশিরভাগ সময় বাইরেই থাকতেন। ধানক্ষেতে পানি দিতেন কিংবা ছাউনি থেকে কৃষিকাজের জিনিসপত্র আনা-নেয়া করতেন। মাঠ আর ধানক্ষেতগুলো বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের মত হাঁটা দূরত্বে ছিল। ওরা যেসব ডায়কন আর বাঁধাকপি খেত সেগুলো এই ক্ষেতেই চাষ হতো।

“কিন্তু আমাদের ক্ষেতের ডায়কন দোকানের ডায়কনের মত দেখতে এত সুন্দর হত না। আর একটু হলদেটে ধরনের ছিল।”

উঠোনে অনেক গাছ ছিল। উঠোনের খোলা মাটি বৃষ্টি হলে কাদার পুকুরে পরিণত হতো। বৃষ্টির সময় বাইরে গেলে মনে হত মাটি জোর করে টেনে আছাড় খাওয়াতে চায়।

বাড়ির বামদিকে ছিল ছোট্ট একটা ছাউনি, বাড়ির দেয়াল ঘেঁসে দাঁড় করানো। কৃষিকাজের সব যন্ত্রপাতি ওখানে রাখা হতো। ছাউনির ছাদটা এক টাইফুনের সময় উড়ে গিয়েছিল। সেটা ঠিক না করে বরং উপরে শ্রেফ একটা নীল রঙের তারপুলিন বিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেটার ফুটো দিয়ে পানি পড়ত কিন্তু ছাউনির ভেতর যন্ত্রপাতি ছাড়া আর কিছু না থাকায় কোন সমস্যা হয়নি।

“আমি আর আমার বোন সারাক্ষণ খেলাধুলা করতাম।”

যখন ওরা এলিমেন্টারি স্কুলে ঢুকল তখন হাত ধরাধরি করে পাহাড়ি পথ দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেত। পাহাড়ি পথটা ছিল সরু আর প্রচুর বাতাস। পথের একধারে ঢাল খাড়া উপরে উঠে গিয়েছিল, সেইসাথে গাছপালায় ভর্তি। অন্য দিকেও গাছপালা ছিল কিন্তু সেগুলোর পাতার ফাঁক দিয়ে দূরের দৃশ্য দেখা যেত। পথের উপর মরা বাদামি পাতা পড়ে থাকত, বৃষ্টির সময় পেছল করে তুলত। লম্বা গাছগুলোর ডালপালা সূর্যের আলো আসতে বাঁধা দিত। যে কারনে পথটা সবসময়ই কেমন ভ্যাপসা আর গুমোট হয়ে থাকত।

“পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে স্কুলে যেতে হতো, সেটা আমাদের জন্য সহজই ছিল। কিন্তু বাসায় ফেরার সময় আমরা হাঁপিয়ে কাহিল হয়ে যেতাম।”

ইয়োরু আর ইয়ুর চেহারা ছিল হুবহু একইরকম। চোখের নিচের তিল পর্যন্ত একই জায়গায়, দু-জনেরই একইরকম কোমর পর্যন্ত লম্বা ঘন চুল। আর ওরা প্রায় সময়ই একইরকম পোশাক পড়ত। আমার কল্পনা করতে কষ্ট হচ্ছিল না যে, একই রকম দেখতে দুটো মেয়ে হাত ধরাধরি করে সবুজে ঢাকা পাহাড়ি পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

“আমরা দেখতে একইরকম ছিলাম। এমনকি আমাদের মা পর্যন্ত আমাদেরকে আলাদা করে চিনতে পারত না। মাঝে মাঝে গোসল করার সময় আমরা পোশাক খুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতাম।”

সেসময় ওদের মা ঠাহর করতে পারতেন না কে বড় আর কে ছোট।

“কিন্তু আমাদের অভিব্যক্তি আর স্বভাবে পার্থক্য ছিল। তাই আমরা কথা বললেই সবাই বুঝে ফেলত।”

ছোটবেলায় ওদের মা ওদেরকে আলাদা করে চিনতে না পেরে হা করে তাকিয়ে থাকলে ইয়ুর খুব মজা লাগত। আর ঠিক যখনই বোঝা যেত ইয়ু মজা পাচ্ছে তখনই ওদের মা ধরে ফেলে বলতেন, “এই যে এটা ইয়োর, আর ওটা ইয়ু।”

ইয়ু সবসময়ই তার বড় বোনের চেয়ে সহজে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করত। ও যখন ওর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলত, সবসময় হাসিমুখ করে রাখত।

“সেসময় আমাদের প্রিয় খেলা ছিল ছবি আঁকা আর মরার ভান করা।”

গ্রীষ্মের ছুটিতে এলিমেন্টারি স্কুলের সুইমিং পুল খোলা ছিল আর ওরা সেখানে যতক্ষণ চাইত সাঁতার কাটতে পারত।

“একদম ছোট একটা স্কুল, সবমিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল একশ জনের মত। প্রত্যেক গ্রেডে বিশ জনেরও কম। কিন্তু গ্রীষ্মের ছুটিতে পুলে সবসময় ভিড় থাকত।”

সূর্যের সাদা আলোকরশ্মির ভেতর বাচ্চারা সারাক্ষণ পুলে দাপাদাপি করত। পুলে শুয়ে কান পানির নিচে দিয়ে রাখলে পাহাড় থেকে ভেসে আসা পোকামাকড়ের ঝিঁঝি শব্দ শুনে মনে হত যেন দেয়াল টেয়াল ভেঙে পড়ছে।

“পুলের আশেপাশে সবসময় দুই-চারজন বয়স্ক মানুষ থাকত যারা খেয়াল রাখত যেন কোন বিপদ না ঘটে। কখনো শিক্ষকেরা, কখনো কখনো অভিভাবকেরা এই দায়িত্ব পালন করত। বেশিরভাগ সময়ই কিছু ঘটত না। তারা স্রেফ পাশের ছাউনির বেঞ্চে বসে একজন আরেকজনের সাথে গল্পে মশগুল হয়ে থাকত।

একদিন দুই বোন ঠিক করল পানিতে ডোবার ভান করে বড়দের চমকে দেবে। তারা উপুড় হয়ে দমবন্ধ করে পানিতে ভেসে থাকল, দেখে যেন মনে হয় মরে ভেসে আছে।

আশেপাশের হৈচৈ করা ছেলেমেয়েদের মধ্যে নিশ্চয়ই ওদেরকে আলাদা করে চোখে পড়ছিল। দুটো মেয়ে উপুড় হয়ে পানিতে ভাসছে, তাদের লম্বা কালো চুল সামুদ্রিক আগাছার মত চারপাশে ছড়িয়ে আছে। কোন নড়াচড়া নেই। দম শেষ হয়ে এলে ওরা মাথাটা অল্প তুলে দম নিয়ে আবার মরে যেত।

“আমরা যা আশা করেছিলাম তারচেয়ে প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি ছিল।”

পাহারায় ছিল ওদের কয়েকজন ক্লাসমেটদের মা। ওনারা যখন ওদেরকে অনড় ভাসতে দেখলেন তখন একজন লাফিয়ে উঠে চিৎকার শুরু করলেন। সব ছেলেমেয়ে চমকে বেঞ্চের দিকে তাকাল। ছোট বাচ্চারা যারা দাপাদাপি করছিল, একটু বড়রা যারা সাঁতার প্র্যাকটিস করছিল সবাই বুঝতে পারল কোন অঘটন ঘটেছে। আরেকজন মহিলা যিনি চিৎকার করেননি তিনি ওদের বাঁচাতে দৌড় দিলেন। কিন্তু পুলের পাশে দৌড়ানো বিপজ্জনক।

“মহিলা পিছলে পড়ে মাথায় বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। যে মহিলা চিৎকার করেছিলেন তিনি গেলেন এ্যাম্বুলেন্স ডাকতে। ইয়ু আর আমি দম শেষে উঠে দেখি আশেপাশের সবাই আতঙ্কে আছে। মনে হচ্ছিল যেন নরক নেমে এসেছে। ছোট বাচ্চারা ভয় পেয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল। অজ্ঞান মহিলার পাশে একটা ছেলে তার মায়ের কাঁধ ধরে মা মা করে ঝাঁকাচ্ছিল। ছেলেটা আমাদেরই একজন ক্লাসমেট ছিল।”

যমজ দু-জন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল তারপর টু শব্দ না করে তাড়াতাড়ি পুল থেকে উঠে পালিয়ে গেল। পরনের ভেজা পোশাকও বদলালো না।

“আমরা পেছনের দরজা দিয়ে বের হলাম। আমাদের এক হাতে ব্যাগ, ভেতরে কাপড় আর ভোয়ালে। আরেক হাতে জুতো। সুইমস্যুট পরা অবস্থায় ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে দৌড় লাগালাম আমরা। দূর থেকে শুনতে পেলাম এ্যাম্বুলেন্সের পর এ্যাম্বুলেন্স আসছে। ঐ মহিলা কয়জনকে ডুবতে দেখেছিল কে জানে? অন্তত পাঁচটা অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল সেদিন।”

স্কুলটা ছিল পর্বতের গোড়ায়, পাশ দিয়ে যতদূর চোখ যায় খালি ধান ক্ষেত। সবুজ চারাগুলো পুরো এলাকার উঁচু নিচু মাটি ঢেকে রেখেছিল। মনে হত যেন সমতল ভুমি। যমজ মেয়ে দুটো সেই ধানক্ষেতের পাশের পথ ধরে হেঁটে গেল।

“ধারালো ঘাসে আমাদের পা কেটে গিয়েছিল।”

অ্যাম্বুলেন্স স্কুলে পৌঁছানোর পরে কি হয়েছিল সে ব্যাপারে ওদের কোন ধারণা ছিল না। ওরা সেটা নিয়ে তেমন একটা চিন্তাও করেনি। বাড়ি ফিরে খেয়ে ঘুম দিয়েছিল।

“সেবারই যে শুধু আমরা মরা মরা খেলেছিলাম তা নয়। আমরা একজন আরেকজনের মুখে কেচাপ ছিটিয়ে ভান করতাম যেন সেটা রক্ত।”

ওরা রেফ্রিজারেটরের সামনে দাঁড়িয়ে আঙুলে কেচাপ নিয়ে একজন আরেকজনের মুখে মাখিয়ে দিত। ওদের ফ্যাকাসে সাদা ত্বক কেচাপে লাল হয়ে যেত।

“কেচাপ গড়িয়ে পড়তে লাগলে আমরা তা চেটে চেটে খেতাম। তারপর এক সময় বিরক্ত হয়ে গেলে সসেজ দিয়ে মাখিয়ে খেয়ে ফেলতাম।”

আরেকবার তারা ঘর থেকে একটা মিট সসের ক্যান নিয়ে এসেছিল।

ওদের বাড়ি থেকে অল্প খানিকটা দূরে একবার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। কিন্ডারগার্টেন পড়ুয়া একটা ছেলে গাড়ি চাপা পড়ে সেখানে মারা যায়। ইয়ু সেই জায়গায় গিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।

‘শুরু কর,” সে বলল। আর আমি ওর মুখের উপর ক্যানের পুরো মিট সস ঢেলে দিলাম। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে এসেছে। আমি ইয়কে বললাম যাই ঘটুক না কেন ও যেন একদম নড়াচড়া করে। ও আস্তে করে মাথা নেড়ে সায় দিল। চোখ বন্ধ করে ছিল যেন সস চোখে না ঢোকে।”

ইয়োরু গিয়ে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে থাকল। কখন কে এসে দেখে চিৎকার করে উঠে সে অপেক্ষায় থাকল। বাচ্চারা যখন দেখল, বড়দের মত অতটা অবাক হলো না। তারা কাছে এসে দেখে ধরে নিয়েছিল কোন ধরনের খেলা হবে বা কিছু।

“এমনকি বড়রাও দেখে প্রথমে চিৎকার করলেও একটু পরেই ধরে ফেলেছিল যে জিনিসটা মিট সস। তারপর তারা হেসে ফেলত। আমরা এরকম কান্ডকারখানা অনেক করেছি আগে, প্রতিবেশিরা সবাই জানত আমাদের শয়তানি।”

“কোন গাড়ি যায়নি?”

যেহেতু ওখানে আগে ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, তার মানে কোন না কোন সময় তো সেখান দিয়ে গাড়ি যাওয়ার কথা। আর ইয়ু রাস্তায় পড়েছিল, বিপদ হতে পারত।

আমি যখন প্রশ্নটা করলাম, মোরিনো কোন অনুভূতি না প্রকাশ করে বলল, “একটা গাড়ি এসেছিল। ইয়ু চোখ বন্ধ করে ছিল তাই টের পায়নি। গাড়িটা ওর সামনে এসে কষে ব্রেক করে থেমেছিল। গাড়ি থামার শব্দে ইয়ু উঠে বসেছিল। মুখ থেকে সস মুছে তাকিয়ে দেখে মুখের সামনে গাড়ির বাম্পার। বাম্পারটা সিলভার পলিস করা ছিল, ওর চেহারার প্রতিফলন সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল..”

“তুমি ওকে ডেকে সাবধান করে দাওনি?”

“না। দেখতে চাইছিলাম কি হয়।” আমি ওর কথার সুরে অপরাধবোধের চিহ্ন খুঁজলাম, কোন চিহ্ন পেলাম। ওর এরকম কোন বৈশিষ্ট্য নেই। একদিক থেকে বললে সে এই ক্ষেত্রেও আমার মতই অনেকটা।

“আমরা যমজ, তাই দেখতে একইরকম ছিলাম। আমাদের চিন্তাভাবনায়ও অনেক মিল ছিল। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য ছিল। আমার বোন ছিল দূর্বল প্রকৃতির।”

আমরা যেখানে বসে ছিলাম তার সামনে একটা বাস এসে থামল। আমাদের জন্য অপেক্ষা করে চলে গেল আর পেছনে ফেলে গেল ধোঁয়ার একটা গন্ধ।

সূর্য দিগন্তের কাছে নেমে গেলে পুব আকাশ অন্ধকার হতে শুরু করেছিল। বাতাসে গার্ডরেইলের ওপারের শুকনো ঘাসগুলো কাঁপছিল।

মোরিনো বেঞ্চে নিচু হয়ে বসেছিল। ওহ হাতগুলো হাঁটুর উপর রাখা।

“আমরা অনেকটা সময় ধরে মৃত্যুর কথা চিন্তা করতাম। মৃত্যুর পর আমরা কোথায় যাব? তখন কি হবে আমাদের? এইসব চিন্তা-ভাবনা আমাদের কাছে খুব আকর্ষণীয় লাগত তখন। কিন্তু আমার মনে হয় ইয়ুর চেয়ে আমি মৃত্যু সম্পর্কে বেশি জানতাম। আর আমি ওরচেয়ে একটু বেশি নিষ্ঠুর ছিলাম।”

কোন অনুভূতি প্রকাশ না করে মোরিনো আমাকে বলল কিভাবে সে ইয়ুকে বিভিন্ন কাজ করতে আদেশ করত।

“সে সময় আমাদের ছাউনিতে একটা প্রাণী ছিল। চারপেয়ে, মুখ দিয়ে লালা ঝরত, দুর্গন্ধওয়ালা-বুঝতেই পারছ কিসের কথা বলছি।”

আমি ধরে নিলাম ও কুকুরের কথা বলছে। ওর একটা পোষা কুকুর ছিল শুনে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

“আমি ইয়ুকে আদেশ করলাম ওটার খাবারে ব্লিচ মিশিয়ে দিতে। এমন যে আমি ভাবছিলাম ওটার গায়ের রং সাদা হয়ে যাবে বা সেরকম বোকা ধরনের কিছু। আমি স্রেফ ওটাকে কষ্ট পেতে দেখতে চাইছিলাম।”

ইয়ু ইয়োরুকে থামতে অনুরোধ করেছে।

“কিন্তু আমি শুনিনি, আমি ওকে দিয়ে জোর করে কুকুরের খাবারে ব্লিচ মেশালাম। সে চায়নি কিন্তু আমি ওকে এড়িয়ে যেতে দেইনি।”

ব্লিচ খেয়ে কুকুরটা মরল না। কিন্তু দুদিন সাতিক অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকল। মোরিণোর বাবা-মা আর নানা-নানি কুকুরটার যত্ন নিল। সারাটা দিন আর সারারাত কুকুরটা যন্ত্রণায় মোচড়াল আর আর্তনাদ করল। ওর চিৎকার পর্বতে প্রতিধ্বনি তুলত।

ইয়োরু পুরো ব্যাপারটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করল। কিন্তু ইয়ু খুব ভয় পেয়েছিল। সে সারাদিন ঘরের ভেতর থাকল, দু-হাত দিয়ে কান চেপে।

“ইয়ু অনেক কেঁদেছিল।”

ইয়োরু কুকুরের সাথে সাথে তার বোনকেও ভালোমত লক্ষ্য করল। নিজে সরাসরি কুকুরটাকে ব্লিচ না খাইয়ে সে সমস্ত অপরাধবোধ তার বোনের উপর চাপিয়েছিল। ইয়োরুর পরীক্ষায় কুকুর আর তার বোন দু জনেই যন্ত্রণা পেয়েছিল।

ইয়োরু আর ইয়ু নিজেরাও গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা আত্মহত্যা খেলত, একবারই খেলেছিল।

“ঠিক করে বললে, এক কদমের জন্য আমাদের আত্মহত্যা আটকে গিয়েছিল। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। যে কারনে বাইরে খেলতে যেতে পারিনি, ছাউনিতে খেলছিলাম। ইয়ু মারা যাওয়ার এক কি দুই মাস আগের ঘটনা এটা।”

যমজ বোন দু-জন প্রত্যেকে মেঝের উপর একটা করে কাঠের বাক্স রেখে তার উপর দ্বিতীয় আরেকটা বাক্স রেখে দাঁড়াল। ছাউনির বিম থেকে ঝুলানো দড়ি গলায় দিল। এরপর স্রেফ বাক্স থেকে লাফ দিয়ে ফাঁস খেয়ে মরা বাকি।

“আমি বললাম তিন পর্যন্ত গুনে আমরা লাফ দিব। মিথ্যে বলেছিলাম আমি, লাফ দিতাম না। ইয়ু ফাঁস খেয়ে মরত আর আমি দেখতাম।”

এক…দুই…তিন। তিন গোনার পর দু-জনের কেউই লাফ দিল না। দু জনেই চুপ করে ছিল।

“ইয়ু বুঝতে পেরেছিল আমি কি ভাবছিলাম, যে কারনে সে লাফ দেয়নি। আমি যখন ওকে জজ্ঞেস করলাম কেন লাফ দেয়নি, ও স্রেফ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ভয়ে কাঁপছিল।”

ইয়ু মুখ খুলে বলতে পারেনি কেন পুরো ব্যাপারটা অন্যায় ছিল, সে শুধু দাঁড়িয়ে থেকে ইয়োরুর অপমানের বন্যায় ভেসে গেল।

“তুমি ইয়ুকে বুলি করতে?”

“সেটা বলা যেতে পারে। কিন্তু সে সময় আমার কোন হুশ ছিল না। বেশিরভাগ সময়ই আমাদের মধ্যে কোন সমস্যা হত না। আর ইয়ু ওর ভাগের খারাপ কাজগুলোও ঠিকমত করত। আমার চেয়ে ও আরো ভালো মত মরার অভিনয় করে লোকজনকে আতংকিত করতে পারত।”

“তোমার পরিবারের অন্যরা জানত তোমাদের দুই বোনের মধ্যে সম্পর্ক যে এরকম ছিল?”

“না।”

মোরিনো নিরব হয়ে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল। শাঁ করে একটা গাড়ি ছুটে গেল। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসায় গাড়িটার হেড লাইট জ্বালানো ছিল। বাতাসে মোরিনোর চুল উড়ছে, কয়েকটা চুল আবার গালের সাথে লেপ্টে আছে।

“ইয়ু মারা গিয়েছিল গ্রীষ্মের ছুটির সময়। আমরা তখন সেকেন্ড গ্রেডে পড়তাম। সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল একটা সকাল ছিল। কিন্তু শিগগিরি আকাশ কালো হয়ে গেল। আর দুপুরের দিকে শুরু হল বৃষ্টি..”

দুপুরের কিছু পর ওদের মা শপিঙে গেলেন। বাবা বাসায় ছিলেন না। নানা-নানিও বাইরে। শুধু যমজ দুই বোন বাসায় একা।

প্রথমে কুয়াশার মত ঝিরঝির বৃষ্টি ছিল। টুপটাপ ফোঁটা পড়ছিল জানালায়। আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়তে লাগল।

“সাড়ে বারোটার দিকে আমি দেখলাম ইয়ু ছাউনির দিকে যাচ্ছে। আমাকে কিছু বলেনি, তাই আমি ধরে নিলাম সে হয়তো একা কিছু সময় কাটাতে চাইছে। আমিও আর ওর পিছু পিছু গেলাম না।”

ইয়োরু একা বসে বই পড়তে লাগল।

প্রায় ঘন্টা খানেক পর, সে সামনের দরজা খোলার শব্দ পেল। গিয়ে। দেখে ওর নানি ফিরেছেন, হাতে এক ব্যাগ নাশপাতি।

ওর নানি ছাতি বন্ধ করতে করতে বললেন, “পাশের বাসা থেকে এগুলো দিয়েছে। তোমাকে একটা ছিলে দেব?”

“আমি বললাম, ইয়ুকে ডেকে আনি। নানিকে দরজার ওখানে রেখে দৌড়ে ছাউনিতে গেলাম।”

ইয়োক ছাউনির দরজা খুলল-আর দৃশ্যটা দেখল। সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল।

“ইয়ু সিলিং থেকে ঝুলছিল। গলায় দড়ি পেঁচানো ছিল। আমি সামনের দরজায় ফিরে গেলাম, যেখানে নানি নাশপাতি হাতে দাঁড়ানো ছিলেন। আমাকে ভয়ে কাঁপতে দেখে অবাক হলেন।”

সে নানিকে বলল ইয়ু বেঁচে নেই।

ইয়ু নিজের গলায় ফাঁস নিয়েছে। আত্মহত্যা ছিল না, অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। শুধু যে ওর গলায় দড়ি ছিল তা নয়, ওর বগলের নিচে বুকে দ্বিতীয় আরেকটা দড়ি বাঁধা ছিল-একটা খসখসে ভারি দড়ি, খামারে যে ধরনের দড়ি ব্যবহার করা হয়। একদিক ওর বুকে বাঁধা ছিল, আরেক দিক লেজের মত ঝুলছিল। গলার দড়িটাও একই ধরনেরই ছিল। পুরোটাই একটা দড়ি ছিল কিন্তু ছিঁড়ে গিয়েছিল।

“আমার বোনের মরার কোন ইচ্ছা ছিল না। ও চেয়েছিল বুকের দড়িটা দিয়ে ঝুলবে আর আত্মহত্যার ভান করে সবাইকে ভয় দেখাবে। কিন্তু যে

মুহূর্তে ও লাফ দিয়েছিল, ওজন নিতে না পেরে দড়িটা ছিঁড়ে যায়।”

খুব কম লোকজনের মধ্যে ইয়ুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। আর এই গল্পের শেষ এখানেই।

আমার একটা প্রশ্ন ছিল কিন্তু জিজ্ঞেস করলাম না। মোরিনোর ক্লান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস শুনলাম।

সূর্য ততক্ষণে পুরোপুরি ডুবে গেছে। রাস্তার ধারের বাতিগুলো জ্বলছিল। বাসস্টপের সাথের বাতির আলোয় বাসের শিডিউল জ্বলজ্বল করছিল। আমরা বাস-স্টপের উজ্জ্বল সাদা আলোর মধ্যে বেঞ্চে বসে রইলাম।

দূরে এক জোড়া হেড লাইট দেখা যাচ্ছে। সাথের চারকোনা ছায়ার পেছনে নিশ্চয়ই একটা বাস আছে। কিছুক্ষণ পরেই ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল। আর বাসটা আমাদের সামনে এসে থামল।

মোরিনো উঠে খোলা দরজা দিয়ে বাসে ঢুকে গেল। আমিও বেঞ্চ ছেড়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম।

কেউ কাউকে গুডবাই বললাম না আমরা। একজন আরেকজনের দিকে তাকালামও না।

দিনটা ছিল শনিবার। মোরিনো ইয়োৰু ওর বোনের মৃত্যুর কাহিনী বলার দু দিন পর। আকাশে মেঘ করেছিল।

স্কুল ছিল না বলে আমি বেশ সকালে উঠে ট্রেনে চড়লাম। ট্রেনটা আমাকে নিয়ে গেল শহরের বাইরে, গ্রাম এলাকার দিকে যেখানে লোকজন কম। যতদূর যেতে থাকলাম ট্রেনের যাত্রি তত কমতে লাগল। ট্রেনে একসময় আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম। মেঘের কারনে সূর্য নেই। গাঢ় সবুজ ক্ষেতগুলো শাঁ করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।

একদম জনমানবহীন ক্ষেত খামারের কাছে এক স্টেশনে পৌঁছে আমি ট্রেন থেকে নামলাম। স্টেশনের বাইরে একটা বাস দাঁড়িয়ে ছিল। সেটায় চড়ে কিছুদূর গেলাম, যতক্ষণ না উঁচু এলাকা শুরু হলো আর গাছপালাও ঘন হতে শুরু করেছে। উপর থেকে আমরা নিচের গ্রাম দেখতে পাচ্ছিলাম। রাস্তাটা তেমন একটা চওড়া ছিল না। কোনভাবে একটা বাস যাওয়ার মত জায়গা ছিল। রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ, বাসের জানালায় টোকা দিচ্ছিল।

বনের মাঝে এক স্টপে গিয়ে বাস থেকে নামলাম। রাস্তায় আর কোন যানবাহন ছিল না। শিডিউল দেখলাম। এক ঘন্টা পর একটা বাস আছে শুধু। সন্ধ্যায় কোন বাস নেই। তার মানে এক ঘন্টা পরের বাসেই আমাকে চড়তে হবে। চারপাশে গাছপালা ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিছুদূর হাঁটার পর কয়েকটা বাড়ি দেখতে পেলাম।

এই বাড়িতে মোরিনের জন্ম হয়েছিল, এখানেই সে তার ছোটবেলা কাটিয়েছে।

আমি বাড়ির সামনে থেমে একবার চারপাশ ভালো করে দেখলাম। রোদ থাকলে হেমন্তকালে পুরো এলাকা লাল দেখানোর কথা। কিন্তু মেঘের জন্য সবকিছু কেমন ম্যাড়মেড়ে দেখাচ্ছিল।

বাড়িটার দিকে এগুনোর সময় গতকাল স্কুলে মোরিনোর সাথে হওয়া আলাপের কথা মনে করলাম।

শুক্রবার লাঞ্চের সময়, লাইব্রেরি প্রায় জনশূন্য ছিল। দেয়াল ধরে বইয়ের সেলফ লাগানো। বাকি অংশে ডেস্ক আর চেয়ার রাখা পড়াশোনা করার জন্য। রুমের সবচেয়ে নির্জন কোনায় মোরিনো বসেছিল। ওর সাথে গিয়ে কথা বললাম।

“গ্রামে তুমি যে বাড়িতে থাকতে সেটা আমি দেখতে চাই।”

সে বই পড়ছিল। মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“তুমি কি ভুলে গিয়েছ নাকি যে লোকজন যেসব জায়গায় মারা যায় সেসব জায়গা পরিদর্শন করতে আমার ভালো লাগে?”

মোরিনো অন্যদিকে তাকাল তারপর বই পড়ায় ফিরে গেল। আমি ওর পাশে বসে পড়লাম। ওর গলার অংশবিশেষ দেখতে পাচ্ছিলাম খালি। ও আমাকে উপেক্ষা করে বই পড়ার চেষ্টা করছিল।

আমি উঁকি দিয়ে বইয়ের নামটা দেখার চেষ্টা করলাম। পৃষ্ঠার কোণায় লেখা, “চ্যাপ্টার তিনঃ তুমি একা নও…কিভাবে পজিটিভ জীবন যাপন করা যায়।” দেখে ধাক্কা খেলাম।

মোরিনোর মাথা তখনো নিচু করা। আমাকে বলল, “আমি ভেবেছিলাম বইটা পড়তে গেলে ঘুম পাবে।”

তারপর লম্বা একটা নিরবতা। একসময় সে মুখ তুলল। “তোমাকে ইয়র কথা বলার জন্য আমার আফসোস হচ্ছে। তুমি যদি যেতেই চাও, তাহলে একলা যেতে হবে।”

বাড়িটা আর ছাউনিটা তখনো আছে। ওর নানা-নানি তখনো সেখানে বসবাস করে। কৃষিকাজ করে।

আমি জানতে চাইলাম কেন সে যেতে চায় না। সে বলল ঘুম না হওয়ার কারনে সে খুবই ক্লান্ত।

পরদিন শনিবার, স্কুল ছুটি। তাই আমি ঠিক করলাম সেদিনই গ্রামে যাব। মোরিনো আমাকে ঠিকানা আর যাওয়ার রাস্তা বাতলে দিল। দেখে মনে হচ্ছিল দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আশা যাবে। মোরিনো আমার নোটবুকে একটা ম্যাপ একে দিয়েছিল।

“কথা নাই বার্তা নাই একজন স্কুল ছাত্র যদি হঠাৎ সেখানে হাজির হয় তাহলে সবাই অবাক হবে।” আমি বললাম। সে মাথা ঝাঁকাল। বলল ফোন করে নানা-নানিকে জানিয়ে রাখবে। তাদেরকে বলা হলো গ্রামের প্রকৃতির ছবি তুলতে আমি সেখানে যাচ্ছি।

“আর কিছু?” মোরিনো বরাবরের মত অনুভূতিহীন সুরে বলল।

আমি ওর আঁকা ম্যাপের দিকে তাকালাম। “তোমার ম্যাপ দেখলেই আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়।” বলে আমি উলটো ঘুরে চলে আসলাম। লাইব্রেরির দরজায় পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো রাস্তা আমার পিঠে ওর দৃষ্টি অনুভব করতে পারছিলাম। মনে হচ্ছিল ও কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু কথাগুলো গলা পর্যন্ত এসে আটকে গিয়েছে।

ধূসর মেঘ, একঝাঁক কালো পাখি নিচু দিয়ে উড়ে গেল। আমি নোটবুকে আঁকা মোরিনোর ম্যাপটার দিকে তাকালাম। ম্যাপের বক্তব্য অনুসারে রাস্তাটা কিন্ডারগার্টেনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার কথা। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল পৃথিবীর কোন বাবা-মা কিভাবে তাদের সন্তানদের এরকম একটা স্কুলে পাঠাতে পারেন।

অর্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করতে করতে আমি মোরিনোদের পুরনো খামার বাড়ির দিকে এগুলাম। বাড়ির নাম্বার আর ল্যান্ডমার্ক জানা ছিল, সুতরাং ম্যাপ না বুঝলেও খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না বলেই আমার ধারণা।

হাঁটতে হাঁটতে বাসস্টপের বেঞ্চে বসে মোরিনোর বলা কাহিনী আবার চিন্তা করলাম, এক নিষ্ঠুর মেয়ে আর তার যমজ বোনের কাহিনী।

ইয়ুকে দড়িতে ঝোলা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।

কিন্তু মোরিনোর গল্পে একটা অংশ ছিল যার কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না–যে অংশে সে তার বোনের মৃত দেহ খুঁজে পায়।

ইয়োরু ছাউনির দরজা খুলে দৃশ্যটা দেখে চিৎকার দেয়। তারপর দৌড়ে তার নানিকে গিয়ে জানায় যে ইয়ু মৃত।

মোরিনো কি করে দৃশ্যটা দেখার সাথে সাথে জানল যে ইয়ু মৃত? তারা তো সবসময় মৃত সাজার ভান করত আর লোকজনকে চমকে দিত তাই না? তাহলে সে কেন ভাবেনি যে ওর বোন স্রেফ অভিনয় করছে?

হতে পারে যে সাধারণ মৃতদেহ হয়তো দেখতে অভিনয়ের চেয়ে অনেক আলাদা, অনেক ভয়ঙ্কর কিছু…কিন্তু ব্যাপারটা হল যে সে কখনো ভাবেনি যে এটা অভিনয়, সে সাথে সাথে দৌড়ে তার নানিকে বলতে গিয়েছিল…ব্যাপারটা আমার কাছে গোলমেলে লাগছে।

আমি ম্যাপ আর রাস্তা অবার মিলিয়ে দেখলাম। সামনে দিয়ে গভীর একটা পাহাড়ি নদী চলে গিয়েছে। ম্যাপ অনুযায়ি এখানে একটা ড্রাই ক্লিনার থাকার কথা। কাপড় চোপড় তো পরিস্কার করার পর আর শুকাতে পারবে না, আমি ভাবলাম।

ব্রিজ পার হওয়ার সময় আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘগুলো নিচু হয়ে পর্বত চূড়ার কাছে ঝুলে আছে। আশেপাশের গাছগুলোকে অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে।

আরো কিছুক্ষণ হাটার পর আমি মোরিনোদের খামার বাড়ি খুঁজে পেলাম। পর্বত ঘেঁসে পুরোনো একটা বিল্ডিং। মস জাতীয় আগাছায় ঢেকে আছে ছাদটা, যে রকমটা মোরিনো বলেছিল। আশেপাশে গাছপালা আর ক্ষেত ছাড়া কিছু নেই, রাতে নিশ্চয়ই কালিঘোলা অন্ধকারে ঢেকে যায় সবকিছু। কোন গেট কিংবা দেয়াল নেই, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি হঠাৎ আবিস্কার করলাম ওদের উঠোনে পৌঁছে গিয়েছি।

সামনের দরজার দিকে যাওয়ার সময় বামদিকের ছাউনিটা চোখে পড়ল। এই ছাউনিতেই নিশ্চয় ইয়ুর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল? ছাউনির দেয়াল শুষ্ক সাদা কাঠ দিয়ে তৈরি। উপরে নীল রঙের তারপুলিন দেয়া, প্লাস্টিকের তার দিয়ে বাঁধা। অনেক পুরনো, একদিকে কাত হয়ে আছে।

সামনের দরজাটা কাঠ আর কাঁচ দিয়ে তৈরি, খোলা ছিল। আমি ডোরবেল বাজালাম। পেছন থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকল।

ঘুরে তাকিয়ে দেখি একজন বুড়ি মহিলা নিড়ানি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।

তার পিঠ বাঁকানো, পরনে ঢোলা ওয়ার্ক ট্রাউজার, গলায় একটা গামছা পেঁচানো। আমি ধরে নিলাম বুড়ি নিশ্চয়ই মোরিনোর নানি হবেন।

“ইয়োক গত রাতে ফোন করেছিল। আমি তো দুশ্চিন্তা শুরু করে দিয়েছিলাম যে তুমি বোধহয় আসছ না।” তিনি বললেন। তার ঝুলে যাওয়া কুঁচকানো মুখের সাথে মোরিনোর চেহারার কোন মিল পেলাম না। মোরিনোর চেহারা দেখলে মনে হয় ইতিমধ্যে মৃত, ওর নানির রোদে পোড়া চেহারার কিছুই ওর মধ্যে নেই।

আমি মাথা বো করে বললাম কয়েকটা ভালো ছবি তোলা হলেই আমি চলে যাব। কিন্তু মোরিনোর নানি আমার কথা উপেক্ষা করে আমাকে ধাক্কিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন।

দরজা দিয়ে ঢুকতেই শু বক্স রাখা। উপরে কিছু জিনিস রাখা যা দেখে মনে হল সুভিনর ধরনের কিছু হবে। তারপর হলওয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছে। এয়ার ফ্রেসনার আর অপরিচিত মানুষের গন্ধ ভেসে আছে বাতাসে।

“তোমার নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেয়েছে?”

“তেমন একটা না।”

উনি আমার কথা পাত্তা দিলেন না, ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে ডিশ ভর্তি খাবার সামনে এনে রাখলেন। মোরিনোর নান এলেন একটু পর। লম্বা, সাদা চুল ওয়ালা এক বুড়ো।

উনাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো আমাকে মোরিনোর বয়ফ্রেন্ড ধরে নিয়েছেন।

“তোমাকে তো একদিন ইয়োরুকে বিয়ে করতে হবে,” আমি খাব না বলাতে, নানা মাথা ঝাঁকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ছাউনিটা দেখে বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই বাসের কাছে পৌঁছাতে পারব কিনা ভাবছিলাম।

কিচেন কেবিনেটের এক পাশে একটা ছবি ছিল। ছবিতে পুতুলের মত দেখতে দুটো বাচ্চা মেয়ে। দু-জনেরই লম্বা কালো চুল। দু-জনেই সোজা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে কোন হাসি নেই। দু-জনেরই পরনে কালো পোশাক। একজন আরেকজনের হাত ধরে রেখেছে। দেখে মনে হচ্ছে সামনের উঠানে ভোলা, কারণ ওদের পেছনে বাড়িটার সামনের দরজা দেখা যাচ্ছে।

“ইয়োরু আর ইয়ু,” আমার দৃষ্টি খেয়াল করে নানি বললেন। “তুমি কি ওর যমজ বোনের কথা শুনেছ?”

আমি মাথা ঝাঁকালাম।

“এটা ওদের ছয় বছর বয়সের সময়ে ভোলা, নানা বললেন। দু জনের কেউই ছবিটা সম্পর্কে আর কিছু বললেন না।

খাওয়ার পর বাড়ির প্রার্থনা বেদীর সামনে যেতে দেয়া হলো আমাকে। আমি জানতাম সামনে এগুতে হলে আমাকে এসব ভদ্রতা দেখানো ছাড়া উপায় নেই।

প্রার্থনা বেদীর সামনে রাখা ইয়ুর ছবি দেখে আমার মনে হল ওর মৃত্যু হয়তো ওর নানা-নানির কাছে মাত্র গতকালকের কোন ঘটনা মনে হয়। যদিও ঘটনাটা ঘটেছে নয় বছর আগে। আমার কিংবা মোরিনোর কাছে নয় বছর হল আমাদের অর্ধেক জীবনের চেয়েও বেশি–কিন্তু ওর নানা-নানির বয়সের কাছে নয় বছর কোন বছরই নয় হয়তো।

হাত জোর করে শ্রদ্ধা জানানোর পর মোরিনোর নানা-নানি আমাকে লিভিং রুমে নিয়ে বসালেন আর তাদের নাতনি স্কুলে কিরকম করছে সে ব্যাপারে জানতে চাইলেন। আমি উত্তর শুরু করার আগেই তারা নিজেরাই মোরিনো ছোটবেলায় কিরকম ছিল সে নিয়ে গল্প জুড়ে দিলেন। আমি ধরে নিলাম আমার বক্তব্য নিয়ে তাদের আসলে কোন আগ্রহ নেই।

“ওই তাই তো, ওর এলিমেন্টারি স্কুলে আঁকা কিছু ছবি আমাদের কাছে আছে!” নানি আনন্দে লাফিয়ে উঠে উধাও হয়ে গেলেন কোথাও।

নানা তার স্ত্রী যাওয়ার পর ক্ষমা প্রার্থনার সুরে আমাকে বললেন “ইদানিং আমার স্ত্রীর মাথায় অল্প একটু সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে আমার।”

উত্তরে আমি শুধু মাথা ঝাঁকালাম। কিছু বলার চেয়ে মাথা ঝাঁকানোই আমার কাছে সঠিক প্রতিক্রিয়া হবে বলে মনে হলো।

“আসলে ইয়োরু কখনো ওর কোন বন্ধুকে বাসায় নিয়ে আসেনি, বুঝেছ? তাই তুমি আসছ শুনে ওর নানি আজকে একটু বেশিই উত্তেজিত।”

মোরিনোর নানি একটা কাগজের ব্যাগ নিয়ে ফিরে এলেন। ব্যাগের ভেতর থেকে এক গাদা পুরোনো ড্রয়িং পেপার বের হলো, মোরিনো ওর এলিমেন্টারি স্কুলে থাকার সময়ে রং আর ক্রেয়ন দিয়ে ওগুলো এঁকেছিল। মোরিনোর ম্যাপ আঁকা দেখে আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, এখন নিশ্চিত হওয়া গেল ওর মধ্যে আর্টের মেধা বলতে কিছু নেই।

কাগজগুলোর পিছে নাম আর গ্রেড লেখা ছিল।

এর মধ্যে কয়েকটা ইয়ুর আঁকা ছিল। দু-জনের ড্রইংই একসাথে রাখা ছিল। ইয়োরুর ড্রয়িং ছিল একদম ফার্স্ট গ্রেড থেকে সিক্সথ গ্রেড পর্যন্ত। কিন্তু ইয়ুরগুলো খালি ফার্স্ট আর সেকেন্ড গ্রেডের। ব্যাপারটা যেন বাস্তবতাকেই স্পষ্ট করে তুলছিল যে ইয়ু নামের মেয়েটা আর নেই।

আমি দু-জনের সেকেন্ড গ্রেডের ড্রয়িং পাশাপাশি রেখে তুলনা করলাম।

“কারো পক্ষে আসলে বলা মুশকিল ওরা কি আঁকতে চাইছিল, তাইনা?” নানি উজ্জ্বল মুখ করে বললেন। যমজ দু-জনের আঁকার ক্ষমতার মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। কিন্তু দু-জনেই একই বিষয় নিয়ে এঁকেছে আর একইরকম ড্রয়িং করেছে।

দুটো ছবিতেই বাড়ির একটা অংশ দেখা যাচ্ছে আর মাঝের অংশে লম্বা চুলের দু-জন মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে মেয়ে দুটো আসলে ওরাই।

“খোদাই জানেন ওরা কি করছে,” নানি বললেন।

“বাড়ির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে?” নানা উত্তর দিলেন।

“তাই তো মনে হচ্ছে, নানি উত্তর শুনে হাসলেন।

আমি কিছু বললাম না, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম ওরা কি এঁকেছে। মেয়ে দুজনেরই গলার উপর লাল দাগ টানা যেটা সিলিঙের সাথে লাগানো। তারা ছাউনিতে আত্মহত্যা আত্মহত্যা খেলার ছবি এঁকেছিল।

“ওরা এই ছবিগুলো গ্রীষ্মের ছুটিতে এঁকেছিল, স্কুলের হোমওয়ার্ক ছিল। ছুটির পর ইয়ুর ড্রয়িংটা স্কুলে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু…ইয়ু মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে আঁকা এটা।” পুরনো স্মৃতি মনে করে নানি মলিনভাবে হাসলেন।

দুটো ছবির মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না। ইয়ুর আঁকা ছবিটায় ডিটেইলিং একটু ভালো ছিল। ওরটায় লাল দাগ ছাদের বিমের সাথে লাগানো ছিল, আর বাক্সগুলো একটার উপর একটা সাজানো ছিল। বাড়ির উপরে আকাশে সূর্য ছিল। আর মেয়েদের জুতাগুলো পাশে রাখা ছিল।

আর ইয়োরুর ছবিতে এইসব ডিটেইলিং কিছু ছিল না, খুব সাধারনভাবে রং করা। পুরো পা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রং করা, জুতার জন্য আলাদা কোন রং করা হয়নি! ব্যাকগ্রাউন্ড পুরোটা ছাই রং করা।

ইয়ুর ছবির জুতাগুলো আমার মনোযোগ কাড়ল। একটা মেয়ের জুতা কালো, আরেকজনটায় কোন রঙ নেই। এর অর্থ কি হতে পারে আমি নিশ্চিত ছিলাম না কিন্তু নোট করে রাখা প্রয়োজন মনে করলাম।

ছবিগুলো টেবিলের উপর রেখে দিলাম।

“আমার মনে হয় ছবিগুলো তুলে ফেলা উচিত,” বলে আমার ক্যামেরা নিয়ে বাইরে গেলাম।

দরজা খুলতেই বাইরে সবকিছু সাদা দেখাল। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল কুয়াশা, কিন্তু আসলে ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিল। এমন বৃষ্টি যেটায় ছাতা ব্যবহার করার কোন মানে হয় না। সুতরাং আমি চারপাশে ঘুরে ইচ্ছামত ছবি তুলে নিলাম। কিছুক্ষণ পর জোরে বৃষ্টি শুরু হলো।

আমি ভাব করলাম যেন হঠাৎ কোনভাবে ছাউনির সামনে পড়ে গিয়েছি।

ছাউনির দরজা কাঠের তৈরি ছিল। বন্ধ ছিল কিন্তু হাতল ধরে টান দিতে খুলে গেল। ভেতরে অন্ধকার, প্রথমে কিছু দেখা যাচ্ছিল না।

দরজা দিয়ে যতটুকু আলো ঢুকছিল তাতে হালকাভাবে কিছু দেখা গেল। ভেতরে শুকনো গাছের গন্ধ।

ছাউনিটা ছিল প্রায় সাড়ে ছয় ফুটের মত উঁচু আর দশ বাই তের ফুট সাইজের। মেঝে কাদা দিয়ে নোংরা হয়ে ছিল।

আধ ভাঙা সিলিঙের নিচে একটা বিল দেয়া। অনেকগুলো ফুটো ছিল, নিল তারপুলিন দেখা যাচ্ছে। একটা বাতি ঝুলে আছে।

মোরিনোর কাহিনী অনুযায়ি এখানে একটা কুকুর রাখা হতো। এখন আর নেই যেহেতু তার মানে হয়তো বেঁচে নেই। দরজার পাশে ছোট করে আরেকটা গর্ত কাটা, সম্ভবত কুকুরটার জন্যই। কুকুরটাকে নিশ্চয়ই ওটার আশেপাশেই কোথাও বেঁধে রাখা হতো।

আমি ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরটা ঠান্ডা আর খানিকটা ভ্যাপসা।

একসময় ইয়ু এখানে ছিল, সিলিঙের বিম থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছিল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল মৃত মেয়েটা এখনো সেখানে ঝুলছে।

দরজার পাশেই একটা সুইচ ছিল। সুইচ চাপতেই বাতি জ্বলে উঠল। খুবই কম পাওয়ারের বাতি, খুব অল্পই আলোকিত হলো।

ইয়োর বলা কাহিনী মনে পড়ল আমার-দুইটা বাক্স মেঝেতে রেখে ওরা উপরে উঠে দাঁড়িয়েছিল, গলায় দড়ি দিয়ে ঝাঁপ দেয়ার জন্য তৈরি…এখানে রাখা কুকুরটার খাবারে ব্লিচ মিশিয়ে দেয়া।

ইয়ুর মারা যাওয়া নিয়ে ইয়োরুর কাহিনীর উপর আমার সন্দেহ হচ্ছিল।

ইয়োৰু ছাউনির দরজা খোলার আগেই জানত ওর বোন মৃত। ও শুধু অভিনয় করেছিল যে ঐ মুহূর্তে সে সেটা আবিস্কার করেছে।

কেন সে ওরকম করতে গেল? সে কি লুকাতে চাইছিল? ব্যাপারটা নিয়ে আমি যতই চিন্তা করছিলাম ততই মনে হচ্ছিল ওর বোনের মৃত্যুর পেছনে নিশ্চয়ই ওর কোন হাত আছে।

“আমরা এখানেই ইয়ুকে খুঁজে পেয়েছিলাম।”

ঘুরে দেখি দরজার কাছে মোরিনোর নানি দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি সিলিঙের দিকে।

“আমি শুনেছি সবাইকে চমকে দিতে গিয়ে ও মারা গিয়েছিল।”

উনি যেখানে তাকিয়ে ছিলেন সেদিকে তাকালাম। ওখানেই নিশ্চয়ই ইয়ুকে পাওয়া গিয়েছিল।

বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। উঠোনে ছিটকে পড়ার শব্দ শুনতে পারছিলাম। কিন্তু ছাউনির ভেতর বাইরের সব শব্দ যেন মিইয়ে গিয়েছিল। এমন কি তারপুলিনের উপর পড়া বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দও।

ছাদের ফুটো দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছিল, ঝড়ে যেটা ভেঙে গিয়েছিল কিন্তু ঠিক করা হয়নি। তাতে কোন সমস্যা হয়নি কারণ ছাউনির ভেতর তেমন কিছু ছিল না।

ছাউনির এক পাশে দেয়ালে ঠেশ দিয়ে নারানি, কোদাল, কাস্তে ইত্যাদি রাখা ছিল। পাশে কাঁচি আর মোটা দড়ি রাখা।

কুকুরের দরজার পাশে অনেকরকমের দড়ি রাখা ছিল, যদিও কুকুর আর নেই। দড়িগুলো বিভিন্ন রঙের ছিল কিন্তু লাল রঙের একটা দড়ি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

“আমার সবকিছু একদম পরিস্কার মনে আছে,” মোরিনোর নানি আস্তে করে বললেন। আমি প্রতিবেশির বাসা থেকে এসে ছাতা ঠিক করে রাখছিলাম। ইয়োরু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল..”

ইয়োক ওর কাহিনী যেরকম বলেছিল তার সাথে ওর নানির কাহিনীর কোন পার্থক্য নেই। ইয়োরু নাশপাতির ব্যাগ দেখে ওর বোনকে ডাকতে ছুটে গেল। তারপর ছাউনির দরজা খুলে চিৎকার করল। পুরো গল্পে একটা মাত্র জিনিস আমার মনে খটকা লাগাচ্ছিল, সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার আগেই পায়ের নিচে অদ্ভুত কিছু একটা অনুভব করলাম।

পা মাটির সাথে আটকে যাচ্ছিল। মাটির মেঝে, ছাদের ফুটো দিয়ে আসা বৃষ্টিতে ভিজে নরম আর আঠালো হয়ে গিয়েছিল।

পা তুলতেই মাটিতে আমার জুতোর ছাপ দেখা গেল।

ইয়ু যেদিন মারা গেল সেদিনও বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিনও ছাউনির মেঝের অবস্থা নিশ্চয়ই এরকমই ছিল। কিন্তু আমার পায়ের ছাপ তেমন একটা গভীর ছিল না, আর যমজেরা তত বাচ্চা ছিল। ওদের ওজন আমার চেয়ে অনেক কম ছিল। ওদের কি এরকম পায়ের ছাপ পড়েছিল?

খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকালাম, কঠিন বৃষ্টি হচ্ছে। আজকের চেয়ে ঐদিন যদি বেশি বৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে মেঝেও অনেক ভেজা থাকার কথা, আর মেয়েদের পায়ের ছাপ পড়ার কথা।

ইয়ুর মারা যাওয়ার দিন দুপুরের দিকে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বৃষ্টি শুরু হওয়ার একটু পরই ইয়ু ছাউনিতে গিয়েছিল। আর ইয়োরু বলেছিল ও বাড়ির ভেতরই ছিল। মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ার সময় ইয়োৰু দরজার কাছে ছিল।

যদি মোরিনোর নানি ছাউনির ভেতর ইয়োরুর পায়ের ছাপ দেখে থাকেন তাহলে আমাকে যে গল্প শোনানো হয়েছে তা পুরোপুরি মিথ্যা। যদি ইয়োরুর পায়ের ছাপ ছাউনির ভেতর দেখা গিয়ে থাকে তার অর্থ ও আগেই সেখানে গিয়েছিল আর মৃতদেহ তখন আবিস্কার করেছিল।

“আপনি যখন ইয়ুকে পেলেন, তখন কি মেঝেতে কোন পায়ের ছাপ ছিল?”

যদিও আমার মনে হচ্ছিল না মোরিনোর নানি এরকম সূক্ষ্ম কোন কিছু মনে রাখবেন কিন্তু তারপরেও জিজ্ঞেস করার জন্য করলাম।

“হ্যাঁ, ইয়ুর পায়ের ছাপ ছিল,” মোরিনোর নানি বললেন। যে বাক্সর উপর ইয়ু দাঁড়িয়েছিল সেটা উলটে একদিকে পড়েছিল। নানি যখন সেটা ঠিক করতে গেলেন তখন ছোট পায়ের ছাপ দেখেছিলেন মেঝেতে।

যাক ভালো,আমি ভাবলাম। মাটিতে ইয়ুর পায়ের ছাপ পাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।

“আপনি দেখেই বুঝতে পারলেন যে ওগুলো ইয়ুর পায়ের ছাপ?”

“মেয়ে দুটো দেখতে একই রকম, তাই আমরা ওদের আলাদা রকমের জুতো পরাতাম। ইয়োরু পড়ত কালো জুতো, ইয়ু পরত সাদা জুতো। ওদের জুতোর সোলও ভিন্ন ছিল, আর মেঝেতে যে ছাপ ছিল তা যে ইয়ুর জুতোর ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।”

ইয়ুর আঁকা ছবিটা মনে পড়ল আমার। এখন রঙহীন জুতোর অর্থ বুঝতে পারলাম। তার মানে ওগুলো ইয়ুর জুতো ছিল। ইয়ু সিলিং থেকে ঝুলছিল। ওর পা ছিল খালি, ওর সাদা জুতোগুলো মেঝেতে রাখা ছিল। অন্য অনেক আত্মহত্যাকারীদের মত জুতোগুলো পাশে গুছিয়ে রাখা ছিল।

“ইয়োরুর পায়ের কোন ছাপ ছিল না?” আমি জানতে চাইলাম, সেফ নিশ্চিত হওয়ার জন্য।

মোরিনোর নানি মাথা নাড়লেন, আমি নিজেকেই লাখি লাগালাম মনে মনে, কেন প্রশ্নটা করতে গেলাম। ইয়োর মৃতদেহ দেখার সময় ভেতরে ঢোকেনি। ওর পায়ের ছাপ না পাওয়া যাওয়ারই কথা। ছাউনিতে একজনেরই পায়ের ছাপ থাকার কথা।

“ইয়ুর বুকে বাঁধা দড়িটা কি এখনো আছে?”

মোরিনোর নানি মাথা নাড়লেন। দেখে মনে হলো তার মনে নেই। “যাইহোক, তোমার মনে হয় আজকে রাতে এখানে থেকে যাওয়াই ভালো হবে, বাইরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে।”

আমি একটু চিন্তা করে রাজি হয়ে গেলাম।

ছাউনি থেকে বেরিয়ে আমরা বাড়িতে ফিরে গেলাম। মোরিনোর নানি আমাকে কয়েকটা জায়গার কথা বললেন যেখানে ভোলার জন্য ভালো ছবি পাওয়া যাবে।

“আসা করছি কালকে আবহাওয়া ভালো থাকবে,” তিনি বললেন।

জুতো খোলার সময় জুতার বাক্সের উপর রাখা জিনিসগুলোর মধ্যে ছোট একটা প্লাস্টিকের খেলনা আমার নজর কাড়ল। হাতে নিয়ে দেখলাম। একটা ছোট ফ্লাওয়ার ব্ৰচ। চকলেটের প্যাকেটে উপহার হিসেবে যেমন থাকে, সস্তা রঙ আর ডিজাইনের।

যমজ দু-জনের কার ছিল এটা? জিনিসটা দেখে আমার আবার মনে হলো ওরা যখন ছোট ছিল তখন এখানে থাকত।

ব্রুচটা হাতে নিয়ে হলওয়ের দিকে তাকালাম। মোরিনোর নানি ততক্ষণে লিভিং রুমে চলে গিয়েছেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম।

মনে মনে কল্পনা করছিলাম পুতুলের মত দেখতে দুটো যমজ বাচ্চা মেয়ে হলওয়ে দিয়ে হেঁটে আমার দিকে আসছে। ফিসফিস করে একজন আরেকজনের কানে কিছু বলছে, কি করে মৃত সাজা যায় সে নিয়ে নতুন কোন পরিকল্পনা করছে। আমার কল্পনায় ওরা হলের শেষ মাথায় গিয়ে বাঁকে হারিয়ে গেল। জুতো খুলে রেখে আমি তাদের ফলো করার চেষ্টা করলাম। যে বাঁকে তারা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সেখানে গেলাম, অবশ্যই কেউ ছিল না সেখানে নিরব একটা অন্ধকার জায়গা, করিডোরের মলিন আলো জায়গাটা আলোকিত করতে পারেনি।

সোমবারে মোরিনো পাশ থেকে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। সে নিশ্চয়ই কৌতূহলবোধ করছিল, গ্রামে গিয়ে আমি কি কি করলাম তা জানতে চাইছিল। কিন্তু পুরো দিন আমি ওর দৃষ্টি উপেক্ষা করে গেলাম, ভান করলাম যেন খেয়ালই করিনি।

সেদিন শেষ ক্লাসের পর সব ছাত্রছাত্রি চলে না যাওয়া পর্যন্ত ওর সাথে কথা বললাম না। কয়েকজন আমাকে তাদের সাথে বাসায় যেতে বলেছিল, কিন্তু পাত্তা দেইনি-তার মানে এই না যে আমি কোন উত্তর দেইনি। আমার মন কোন কিছু চিন্তা না করেই বিশ্বাসযোগ্য অজুহাত তৈরি করতে সক্ষম। আমার কোন ধারণা নেই কি অজুহাত বানিয়েছিলাম, ওগুলো নিজে নিজে তৈরি হয়ে তাদের কাছে পৌঁছে যায়, আমাকে স্পর্শ করে না।

অবশেষে আমার ক্লাসমেটদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল, রুমের বাইরের হলে নিরবতা নেমে এল। ক্লাসে শুধু আমি আর মোরিনো ছিলাম। সে ওর সিটে কাত হয়ে বসেছিল, জাহাজ ডুবতে থাকলে যেমন দেখায়। আর পাশ থেকে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।

ধীরে-সুস্থে ওর সিটের দিকে গেলাম। জানালা থেকে তিন সারি দুরে সে বসে ছিল, পেছন থেকেও তিন সারি।

“শুনলাম তুমি নাকি গ্রামে রাতটা কাটিয়েছ। নানি ফোন করে বলল আমাকে।” ঘুমন্ত সুরে বলল মোরিনো। ওর চোখের নিচের দাগগুলোর অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে।

“উনি ভালো রাঁধুনি।”

আমি ওর সামনের সিটে বসলাম, জানালার পাশের সারিতে। বাইরে তখনো আলো ছিল। আকাশের রঙ খানিকটা হলদেটে বর্ণ ধারন করেছে। দূরে স্পোর্টস টিমের হৈচৈ এর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। রুমের আলো নেভানো ছিল, আলো যা ছিল তার পুরোটাই জানালা দিয়ে আসছে।

“তুমি এক সময় যে বাড়িতে থাকতে সেখানের কিছু কাহিনী শুনলাম।”

“যেমন?”

“যেমন তুমি আর তোমার বোন ছোট থাকতে যেসব মজা করতে। তারপর ইয়োরুকে যত বকা দেয়া হোক সে কখনোই কাঁদত না, কিন্তু ইয়ু সাথে সাথে কেঁদে ফেলত, বোনের পেছনে গিয়ে লুকাত।”

“ও সব সময় আমার উপর নির্ভর করত।”

আমরা লম্বা এক মুহূর্ত চুপ করে বসে থাকলাম। বাতাসে অদ্ভুত একটা টানটান ব্যাপার ছিল। আমি আবার ওর দিকে তাকালাম।

“মোরিনো ইয়ুর ব্যাপারে আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আমি সব খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে নিশ্চিত নই কিন্তু..”

মোরিনো আমার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে দূরে তাকাল, তারপর চোখ বন্ধ করে ফেলল। ওর চোখের গাঢ় দাগগুলোর উপর চোখের পাতাগুলো কাঁপছিল।

“আমি ধরে নিয়েছিলাম তুমি জানবে,” সে কর্কশ কন্ঠে বলল। সে জানতে চাইল কি কি জেনেছি আমি।

“ইয়ু মারা গিয়েছিল আট বছর বয়সে, এখন থেকে নয় বছর আগে, আমি বললাম। মোরিনো ওর চোখ খুলল না। “নয় বছর আগে সেই দিনে, ছাউনির ভেতর তুমি ওর দেহ ঝুলতে থাকা অবস্থায় পেয়েছিলে তারপর তোমার নানিকে গিয়ে বলেছিলে। কিন্তু তুমি আগেই জানতে যে মৃতদেহটা সেখানে ছিল। তুমি বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে কারো আসার অপেক্ষায় ছিলে যাতে তুমি অভিনয় করতে পার যে তার চোখের সামনেই তুমি মৃতদেহটা আবিস্কার করেছ।”

আমি চুপ করলাম, ওর প্রতিক্রিয়া খেয়াল করছিলাম। সে এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল তারপর বলল আর কিছু বলার আছে কিনা।

“তুমি এর আগেই জানতে যে তোমার বোন মৃত। কিন্তু তুমি অভিনয় করছিলে, সত্য লুকাতে চাইছিলে। আমি চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করছিলাম কেন তুমি এরকম কিছু একটা করতে পার। তারপর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, তোমার বোনের মৃত্যুর সাথে তোমার কোনভাবে সম্পর্ক ছিল।”

মোরিনো মাথা ঝাঁকাল।

আমি বলে চললাম, “ইয়ু সিলিঙের বিম থেকে দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। একটা ছিল ওর গলায় প্যাঁচানো, আরেকটা বুকে, যাতে শরীরের ভার নিতে পারে।”

আট বছর বয়সি মেয়েটা কাঠের বাক্সের উপর থেকে লাফ দিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য হয়তো মনে হচ্ছিল যে ও গলার দড়িটা দিয়ে ঝুলছে। কিন্তু আসলে সে তার বুকের দড়িটা দিয়ে ঝুলছিল যাতে পড়ে না যায়।

এরপর আরেকজন মেয়ে এল, যার চেহারাও একই রকম। সেই মেয়েটা দেয়ালের পাশ থেকে একটা কাঁচি তুলে নিল। তারপর ঝুলতে থাকা মেয়েটার কাছে গিয়ে বুকের সাথে দড়িটা কেটে দিল।

দড়িটা কেটে ফেলায়, মেয়েটা শুধু গলার দড়িটা দিয়ে ঝুলছিল।

“তুমি ওকে খুন করেছিলে।”

মোরিনো অল্প খানিকটা চোখ খুলল, আমার দিকে তাকাচ্ছিল না কোন কিছুর দিকেই তাকাচ্ছিল না।

“পায়ের ছাপের কথা কিছু শুনোনি? ছাউনির কোথাও আমার পায়ের ছাপ ছিল না।”

আমি কল্পনা করলাম মেয়েটা খালি পায়ে ঝুলে আছে। বৃষ্টিতে মাটি ভিজে নরম হয়ে ছিল।

“না, ছাউনির সবখানে তোমার পায়ের ছাপ ছিল। কিন্তু কেউ সত্যটা বুঝতে পারেনি। দড়ি কেটে ওকে খুন করার পর তুমি মাটিতে সবখানে তোমার পায়ের ছাপ দেখতে পেলে। আর তুমি বুঝতে পারলে যে কেউ ওগুলো দেখলে সন্দেহ জাগবেই। সুতরাং তোমাকে কিছু একটা করতেহবে..”

মোরিনো ঝুলন্ত লাশ আর মাটিতে পায়ের ছাপ দেখে বুঝল ঝামেলায় পড়ে গিয়েছে। তারপর সে দেখল জুতোগুলো মাটিতে সাজিয়ে রাখা। তখন সে একটা বুদ্ধি বের করল।

সে নিজের জুতো জোড়া খুলে, একটা বাক্সর উপর উঠে গেল। খেয়াল রাখল যেন নতুন করে কোন পায়ের ছাপ পড়ে। তারপর ঝুলন্ত লাশের নিচে রাখা জুতোজোড়া নিয়ে পড়ল, আর নিজেরগুলো সে জায়গায় রেখে দিল।

এখন পায়ের ছাপগুলো মৃত মেয়েটার হয়ে গেল।

“তারপর তোমার একমাত্র কাজ ছিল কুকুরের দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। ঐ জায়গার মাটি তখনো শুকনো ছিল, তাই কোন ছাপ পড়েনি মাটিতে।”

অবশেষে মোরিনো ওর চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল। “কিন্তু আমার মোটিভ কি?”

“ঘৃণা।” আমি বললাম।

মোরিনোকে খুবই দুঃখি দেখাল। “তুমি যখন বললে ‘মোরিনো ইয়ুর ব্যাপারে আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছি,’ আমি বুঝতে পেরেছিলাম ধরা পড়ে গিয়েছি।”

আমি মাথা ঝাঁকালাম।

ব্যাপারটা আমাকে হতবাক করেছিল-কেন ওর নানি এত নিশ্চিত ছিলেন যে সামনে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা ইয়োরু ছিল? ওরা তো যমজ, একদম একইরকম দেখতে-কেউ আলাদা করে চিনতে পারত না ওদেরকে।

কিন্তু ও যদি কালো জুতা পড়ে থাকে তাহলে সন্দেহ করার কোন সুযোগ ছিল না।

“এই নয় বছর নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট করে লুকিয়ে রাখতে হয়েছে যে তুমি আসলে মোরিনো ইয়ু।”

মোরিনো আসলে মোরিনো ইয়োরু না, ও হল মোরিনো ইয়ু।

***

একদল মেয়ে হল দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল।

মোরিনো ইয় চুপ করে তাদের হাসাহাসি শুনল কিছুক্ষনের জন্য, ওদের কণ্ঠস্বর কমে কমে আবার নিরব হয়ে যাওয়া পর্যন্ত।

“তুমি ঠিকই ধরেছ,” সে বলল। “আমিই ছোট বোনটা। আমিই সবসময় কান্নাকাটি করতাম, আমার উপরই সব আদেশ করা হতো।” তারপর ভুরু কুঁচকে আমাকে প্রশ্ন করল। কিন্তু তুমি কিভাবে জানলে?”

“ইয়ু জানত না, লোকজন আত্মহত্যা করার আগে জুতো খুলে নেয়। ঐ ব্যাপারটাই সবকিছু পরিস্কার করে দিয়েছে। তোমরা যখন আত্মহত্যা আত্মহত্যা খেলতে তখন হয়তো ইয়োরু তোমাকে বলেছিল কিন্তু আমার ধারণা তুমি ভুলে গিয়েছিলে।”

আমি ওকে বললাম ওদের বাড়িতে যেসব ড্রয়িং দেখেছি। যে ড্রয়িংগুলোতে তারা নিজেদের আত্মহত্যা খেলার ছবি এঁকেছিল।

“ঐ ডুয়িংগুলো করা হয়েছিল নয় বছর আগের গ্রীষ্মের ছুটির সময়, ইয়োরুর মৃত্যুর ঠিক আগে আগে। তার মানে হলো ড্রয়িংগুলো ঐ সময়ে, মৃত্যুর আগে ইয়োরুর ব্যক্তিত্ব কেমন ছিল তাও তুলে ধরে।”

ইয়োরু আর ইয়ু একই জিনিস এঁকেছিল, কিন্তু তারপরেও ওদের আঁকার মধ্যে কিছু পার্থক্য ছিল। ইয়ুর আঁকা ছবিতে, দুই মেয়েই জুতো পড়েছিল। কিন্তু ইয়োরুর ছবিতে দুই মেয়েরই পুরো পা রঙ করা ছিল। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম ইয়ু বোধহয় ডিটেইলিং বেশি করেছে, কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত বদলেছি।

আমার মনে হতে লাগল ইয়োরুই আসলে ঠিক মত এঁকেছে, তার স্মৃতি থেকে। ইয়ুর ছবিতে সূর্য ছিল, কিন্তু ইয়োরুর ছবিতে ছিল ধূসর ব্যাকগ্রাউন্ড-আরেকটা সূত্র। বাস স্টপে বসে সেদিন মোরিনো আমাকে তাদের আত্মহত্যা খেলার কথা যখন বলেছিল, তখন বলেছিল দিনটা ছিল বৃষ্টির দিন। ব্যাপারটা এমন না যে ইয়োৰু জুতো আঁকতে ভুলে গিয়েছিল-আসলে তারা দুজনেই খালি পায়ে ছিল।

“তুমি নিজেই বাস স্টপে বলেছিলে যে তুমি মৃত্যু সম্পর্কে ইয়ুর চেয়ে বেশি জানো, তুমি ওর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর ছিলে। তুমি ইয়োরু হিসেবে বলেছিলে কথাটা, তার মানে একজন শিশু হলেও ইয়োৰু নিশ্চয়ই এই অদ্ভুত নিয়ম জানত যে লোকজন আত্মহত্যা করার আগে তাদের জুতো খুলে নেয়।”

যমজ দু-জন যখন আত্মহত্যা আত্মহত্যা খেলেছিল তখন নিশ্চয়ই তাদের জুতো খুলে পাশে রেখে দিয়েছিল। ইয়োরু জানত তাই তোমাকে তাই করতে বলেছিল। ওর জ্ঞান ওর ড্রয়িঙে প্রতিফলিত হয়েছিল।

কিন্তু ইয়ুর ক্ষেত্রে তা হয়নি। খেলার সময় ইয়ু জুতো খুললেও পরে ভুলে গিয়েছিল। কারণ ও এই অদ্ভুত নিয়মের কথা জানত না। যে কারনে ওর ড্রয়িঙে জুতো পরে আত্মহত্যা আঁকা ছিল।

অথচ ছাউনির লাশটা খালি পায়ে ছিল। ইয়ু যদি খেলতে খেলতে দুর্ঘটনাবশত আত্মহত্যা করে ফেলে তাহলে তার পায়ে জুতো থাকার কথা।

ইয়ু চুপ করে শুনছিল, তারপর ওর ঠোঁটজোড়া অল্প খানিকটা ফাঁকা হলো কথা বলার জন্য। আমার কালো জুতো পরা বোন মারা গিয়েছিল। হয়তো আমি ওকে একটু আধটু ঘৃণা করতাম ঠিকই। কিন্তু তোমার অনুমান পুরোপুরি সঠিক নয়।” ওর স্বর একদম শান্ত ছিল। “তুমি ওর বুকে জড়ানো দড়িটা দেখনি তাই না? আমি কাটিনি, ওটা নিজেই ছিঁড়ে গিয়েছিল।”

সেদিন দুপুরে, ওর বড় বোন ইয়োরু প্রস্তাব দিল তারা আত্মহত্যা করার ভান করে সবাইকে চমকে দেবে।

ইয়ু রাজি হলো। তারা যেই ছাউনিতে কাজ শুরু করল তখনই বৃষ্টি শুরু হলো।

কুকুরটা তখনো বেঁচে ছিল। অবাক হয়ে ওদের কাজ কারবার দেখছিল।

“আমার বোন বাক্সগুলো জড়ো করল, বিম থেকে দড়ি লাগাল। আমি নিচে ছিলাম, খেয়াল রাখছিলাম বাক্সগুলো যাতে নড়াচড়া করে পড়ে না যায়।”

বৃষ্টিতে মেঝে নরম হওয়ার আগেই ইয়োৰু বাক্সগুলোর উপরে ছিল, তাই মাটিতে ওর পায়ের কোন ছাপ ছিল না।

ইয়োৰু একা আত্মহত্যার ভান করবে, আর ইয়ুর কাজ ছিল কাউকে সেখানে দেখাতে নিয়ে যাওয়া। ওদের প্রস্তুতি চলছিল, ইয়োরু দুটো দড়িই জায়গামত বেঁধে ফেলল।

“তারপর আমার বোন লাফ দিল।

ইয়োরু লাথি দিয়ে বাক্সগুলো সরিয়ে দিয়ে পড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য দেখে মনে হচ্ছিল যে ও গলা থেকেই ঝুলছে, যদিও ও আসলে বুকের সাথে লাগানো দড়ি থেকে ঝুলছিল।

সে নিচে ইয়ুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল। “লোকজনকে বোকা বানানোর সময় ও সবসময় একটু মুচকি দিয়ে হাসত। বাসার কারো সাথে কথা বলার সময় কোন অভিব্যক্তি দেখাত না, শুধু কাউকে বোকা বানানোর সময় মনে হত ও আনন্দ পেত।”

কিন্তু এক মুহূর্ত পর ওর বুকের দড়িটা ছিঁড়ে গেল।

“আমি কিছুই করিনি। দড়িটা আমার বোনের ভার সহ্য করার মত শক্ত ছিল না। সিলিঙের কাছ থেকে ছিঁড়ে গিয়েছিল। তুমি যদি দড়িটা দেখতে তাহলে ঠিকভাবে অনুমানটা করতে পারতে। ওটা এত উঁচুতে ছিঁড়েছিল যেখানে আমার পক্ষে কাটা সম্ভব ছিল না।”

ইয়োরু এক মুহূর্ত সেখানে ঝুলে থাকল।

“আমি দ্রুত সাহায্য করতে চেষ্টা করলাম। আমি আমার হাত দিয়ে ওর শরীর জড়িয়ে ওকে উঁচু করে ধরার চেষ্টা করলাম। ওকে শূন্যে ধরে রেখেছিলাম, চেষ্টা করছিলাম যেন ঝুলে না পড়ে।”

ছাউনির ভেতর একটা মেয়ে সিলিং থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে, আরেকজন হুবহু একইরকম দেখতে একটা মেয়ে তাকে ধরে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। ঝুলন্ত মেয়েটা ধস্তাধস্তি করছিল, ওর পা বাতাসে লাখি ছুঁড়ছিল। পাশে বাঁধা কুকুরটা ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করছিল। মেয়েটার সংগ্রাম আর কুকুরের চিৎকার একসাথে ছোট ঘরটায় কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সময় অনন্তকালের জন্য এক জায়গায় এসে থেমে গিয়েছে।

“আমি আমার বোনকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করেছিলাম। আমার গায়ে তেমন একটা শক্তি ছিল না কিন্তু তারপরেও আমি ওকে তুলে ধরে রেখেছিলাম। ও চিৎকার করছিল, ওর লাথি ছুটে এসে আমার গায়ে লাগছিল।”

মোরিনো ওর চেয়ারে বাঁকা হয়ে বসল। রুমের অন্যপাশের দেয়ালের দিকে তাকিয়েছিল, যেন সেদিনের সব দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। স্মৃতিগুলো ওর কাছে এখন দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।

ইয়ু ছেড়ে দিলে ওর বোন পড়ে যাবে আর গলায় দড়ি শক্ত করে বসে যাবে।

ইয়োরুর চোখ আতংকে বেরিয়ে আসছিল, বোনকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করছিল-কিন্তু ওর চিৎকারে কোন উৎসাহ ছিল না।

“ও বলছিল, ‘ভাল করে ধর, শক্ত করে ধর গাধা কোথাকার..” মোরিনো চোখ চেপে বন্ধ করে ছিল, আবেগ আটকানোর চেষ্টা করছিল। “এটা যখন আমার কানে গেল আমি ওকে ছেড়ে দিলাম, আর বাঁচানোর চেষ্টা করলাম না।”

ইয়োরুর দেহ ঝুলে পড়ল।

মাটি থেকে একটু উপরে ওর পা থেমে গেল। ইয়োক জুতো পড়ে ছিল না, খালি পায়ে ছিল। ওর পায়ের আঙুলগুলো ছড়িয়ে গিয়ে পেশিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। কুকুরটা গলা ছেড়ে চিৎকার করতে থাকলে সেই শব্দে ইয়ুর কান ব্যথা করছিল। এই খিচুনির দৃশ্য আর কুকুরের চিৎকার ওর মনের গভীরে গেঁথে যায়।

“অবশেষে এক সময় ওর দেহ নিস্তেজ হয়ে আসে, পা নড়াচড়া থামিয়ে দিল।”

ইয়ু পেছনে যেতে গিয়ে টের পেল মাটি ওর জুতো টেনে ধরেছে। পায়ের ছাপ পড়ল মেঝেতে।

“শুধু আমার একার ওজন হলে হয়তো কোন ছাপ পড়ত না।” ওর বোনের জুতো জোড়া পাশেই মাটিতে রাখা ছিল।

“ওগুলো চোখে পড়তেই আমি ঠিক করলাম সবার কাছে মিথ্যা বলব। আমার সব স্পষ্ট মনে আছে…ছোট ছাউনিটাতে…আমার বোনের মৃতদেহ হালকা দুলছিল, ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত।”

ছোট মেয়েটার ছোট মাথাটা দ্রুত চিন্তা করল আর নিজের সামনে একটা রাস্তা দেখতে পেল। নিজের সাদা জুতো খুলে কালো জুতো জোড়া পড়ল। তারপর জায়গা মত রেখে দিল। তারপর শুকনো মাটির উপর দিয়ে হেঁটে কুকুরের গর্ত দিয়ে বেরিয়ে গেল। কালো জুতোর কারনে সবাই ওকে ইয়োরু বলে ধরে নিল। যে কারনে ও নিজেকে ইয়োৰু পরিচয় দিতে লাগল আর ইয়োরুর মত ব্যবহার করতে লাগল।

“আমি আগের মত আর হাসতে পারতাম না। আমার বোনের মত শ্য মুখ করে রাখতে হত আমাকে। আমরা সবসময় একসাথে থাকতাম বলে ও কেমন ছিল তা আমার ভালো মত জানা ছিল। সহজেই ওর মত অভিনয় করতে পারতাম। গত নয় বছরে কেউ সন্দেহ করেনি যে আমি ইয়।”

সে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

আট বছর বয়সে সে নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখল। জীবনের বেশিরভাগ সময় ওর নিজের আসল নাম ছাড়াই পার হয়ে গেল। কেউ জানতে পারল না ওর ভেতরে কি চলছিল, অনুভূতিগুলো পুঞ্জিভুত হয়ে একসময় ফেটে বেরিয়ে এল। ও নিজের হাত কেটে ফেলল…আর এ সবকিছু ঘটল ওর বোনের কারনে, আর বোনের সাথে চাপা দেয়া ওর নামটার কারনে। বাচ্চা মেয়েটা যে পথ বেছে নিয়েছিল, যার উপর ওর জীবন নির্ভর করছিল, তা ছিল কষ্ট আর একাকিত্বে ভরপুর।

জানালা দিয়ে আসা আলো কমে আসছে, সোনালি দেখাচ্ছে। মলিন হলুদ পর্দাগুলো অর্ধেক টানা থাকায় সূর্যের আলো কমে গিয়েছে। মাঠ থেকে আসা বেজবল প্র্যাকটিসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি, বাতাসে প্রতিধ্বনি তুলছে। শূন্য ক্লাসরুমের ঘড়িটা নিরবে টিকটিক করে যাচ্ছে।

একসময় মোরিনো ওর মুখ খুলল, যদিও নিশ্চিত ছিল না কি বলবে। “তোমার কি মনে আছে আমাদের কোথায় আর কিভাবে প্রথম দেখা হয়েছিল?”

আমার বিশ্বাস সেটা এই ক্লাসরুমেই হয়েছিল, হাই স্কুলের সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতে। শুনে ও একটু আশাহত হলো মনে হয়।

“হয়নি, জুনিয়র হাই তে থাকতে। তোমাকে মিউজিয়ামে দেখেছিলাম আমি, একটা মানবদেহের টুকরো অংশগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখছিলে। তারপরের বসন্তে যখন আমরা হাই স্কুলে উঠলাম তখন তোমাকে দেখলাম লাইব্রেরিতে বসে ময়নাতদন্তের উপর একটা মেডিক্যাল বই পড়ছ। দেখা মাত্র তোমাকে চিনেছিলাম আমি।”

সেকারনেই সে জানত আমি ক্লাসে অভিনয় করছি সবার সাথে। এখন বুঝতে পারলাম। আমরা একজন আরেকজনের লুকিয়ে রাখা রূপ ঠিকই ধরতে পেরেছি, আর কেউ না পারলেও।

“আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তুমি যখন ইয়ু ছিলে তখন আসলেই হাসতে।”

“আসলেই। একসময় আমি ওরকম ছিলাম। কিন্তু ছাউনি থেকে বেরিয়ে আসার পর ভাবলাম যদি আমি হেসে ফেলি তাহলে লোকজন বুঝে ফেলবে আমি ইয়। নয় বছর আমি চেষ্টা করেছি কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ না করতে, আমার বোনে পরিণত হতে। আর এখন আমি হাসতে পারি না, চেষ্টা করলেও পারব না।”

ওকে খানিকটা হতাশ দেখাল। আমার থেকে অন্যদিকে তাকিয়ে সে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমিই প্রথম আমাকে আমার নাম ধরে ডাকবে।”

আমি উঠে দাঁড়ালাম। “তোমার জন্য আমার কাছে একটা জিনিস আছে, গ্রাম থেকে ফেরার সময় আমি এটা তোমার বাড়ি থেকে সাথে করে নিয়ে এসেছি।”

ডেস্কের উপর রাখা আমার ব্যাগ থেকে জিনিসটা বের করলাম। “কি জিনিস?” না দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল সে

“যে দড়িটা তুমি খুঁজছিলে। আমার ধারণা এটা নিখুঁতভাবে মিলে যাবে, চোখ বন্ধ কর-আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।”

মোরিনো তখনও বসে ছিল, চোখ বন্ধ করল। আমি ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওর ছোট কাঁধগুলো শক্ত হয়ে গেল, টেনশনে।

আমি লাল দড়িটা ওর গলায় পেচালাম। দড়িটা নোংরা হয়ে ছিল। ছাউনির ভেতর ছিল এটা, যেখানে কুকুরটা বাঁধা থাকত।

“আমি এখন এও জানি কেন তুমি এত কুকুর ঘৃণা কর।”

আমি আস্তে করে দড়িটা টাইট করলাম।

চাপ বাড়তে ওর কাঁধ কেঁপে উঠল। এক মুহূর্ত আমি থেমে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর গেরোটা দিয়ে ছেড়ে দিলাম। দড়ির বাকি অংশ ওর কাঁধে ঝুলতে থাকল।

“হ্যাঁ…এটাই দরকার ছিল..” সে শ্বাস ছাড়ল। সেই সাথে সমস্ত টেনশন যেন ওর ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল। ওর ভেতরটা যেন হালকা হয়ে গেল।

কুকুরের দড়িটা থেকে ইয়োরু মারা গিয়েছিল, মোরিনোর স্মৃতির গভীরে সেই তথ্য কোথাও লুকিয়ে ছিল। সে কখনো বুঝতে পারেনি যেই দড়িটা সে খুঁজছিল তা ওর বোনকে খুন করার জন্য দায়ি ছিল।

“আমি কখনো আমার বোনকে ঘণা করিনি। সে অনেক সময়ই অনেক জঘন্য কাজ করেছে, কিন্তু ওর জায়গা কখনো আর কেউ নিতে পারবে না…”

আমি আমার ব্যাগটা তুলে নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ওর সিটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একবারের জন্য ঘুরে ওর দিকে তাকালাম। ও ওর চেয়ারে বসেছে। পা সামনে ছড়ানো। হাত দুটো বুকের উপর রাখা। লাল দড়িটা গলা থেকে পিঠের উপর ঝুলছে।

ওর চোখ বন্ধ। ওর গাল সূর্যাস্তের আলোয় ঝলমল করছে, মনে হচ্ছে যেন আলো দিয়ে তৈরি।

এক বিন্দু অশ্রু ওর গাল বেয়ে নেমে ইউনিফর্মের উপর পড়ল।

ওকে সেখানে একা রেখে ক্লাসরুমের দরজা নিঃশব্দে বন্ধ করে বেরিয়ে গেলাম আমি।

স্মৃতি/ যমজ

আমার একজন ক্লাসমেট আছে যার বংশের পদবি মোরিনো। আমাদের মধ্যে মাঝে মাঝে কথা হয়। ওর আসল নাম ইয়োরু। পুরো নাম-মোরিনো ইয়োরু, যার অর্থ “রাতের অরণ্য।” ওর চোখ চুল সব ঘন কালো। আমাদের স্কুলের ইউনিফর্মও কালো, আর মোরিনো সবসময় কালো জুতা পড়ত। কালোর বাইরে একমাত্র অন্য রং বলতে ওর পোষাকে যেটা ছিল সেটা হল ইউনিফর্মের লাল স্কার্ফ।

মোরিনোর কালো পোশাক-পরিচ্ছদের সাথে ইয়োৰু নামটা ভালো যায়। কালোর প্রতি ওর ভালবাসা এত বেশি যে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যদি রাতের আঁধারকে মানুষের রূপ দেয়া হয় তাহলে সেটা দেখতে ওর মতই লাগবে।

এত সব কালোর বিপরীতে ওর ত্বকের রং ছিল চাঁদের মত ফ্যাকাসে সাদা। মনে হত জীবনে কোনদিন সূর্যের মুখ দেখেনি। ওকে রক্ত মাংসের মানুষও মনে হত না, যেন পোরসেলিন দিয়ে বানানো। ওর বাম চোখের নিচে ছোট্ট একটা তিল ছিল, যে কারনে ওকে আরো রহস্যময়ি লাগত। মনে হত যেন একজন ভবিষ্যৎ বক্তা।

এরকম একটা মেয়েকে আমি একবার একটা সিনেমাতে দেখেছিলাম। সিনেমার শুরুতে এক দম্পতিকে পানিতে ডুবে মরতে দেখিয়েছিল। পুরো সিনেমার বাকিটা ছিল মৃত্যুর পর তাদের জীবন নিয়ে। মূল চরিত্রগুলো ভূত ছিল, সাধারণ মানুষরা তাদের চোখে দেখতে পারত না। কিন্তু একজন মেয়েকে পাওয়া গেল যে তাদের দেখতে পেত। সেই মেয়েটাই সিনেমাটার নায়িকা, নাম ছিল নিডিয়া।

“আমাকে আসলে অর্ধমৃত বলা যায়,” নিডিয়া ব্যাখ্যা করেছিল কেন সে ভূত দেখতে পায়। “আমার হৃদয় আঁধারে পরিপূর্ণ।”

নিডিয়ারও সব পোশাক ছিল কালো আর তুকের রং ছিল ফ্যাকাসে। সে ঘরের বাইরে বের হত না। বাইরে যাওয়ার বদলে বাসায় বসে বই পড়তে পছন্দ করত। আর ওকে দেখে মনে হত পুষ্টিহীনতায় ভুগছে।

লোকজন ওর মত মানুষদেরকে “গ” বলে ডাকত। গথ বলতে আসলে একটা সংস্কৃতি, একটা ফ্যাশন, আর একটা স্টাইলকে বুঝায়। অনলাইনে ‘গথ’ কিংবা ‘গসু সার্চ দিলে হাজার হাজার পেইজ পাওয়া যাবে। ‘গথিক’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ হলো ‘গথ’, কিন্তু এই নামের ইউরোপিয়ান স্থাপত্য স্টাইলের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বরং ভিক্টোরিয়ান লন্ডনের জনপ্রিয় গথিক হরর উপন্যাসের সাথেই এর মূল সম্পর্ক। যেমন ‘ফ্রাঙ্কেন্সটাইন’ কিংবা ‘ড্রাকুলা।’

মোরিনোকে চোখ বন্ধ করে গথ বলা চলে। অত্যাচারের প্রক্রিয়া কিংবা হত্যা করার যন্ত্রপাতির প্রতি ওর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। মানুষের অন্ধকার দিক নিয়েও ওর আগ্রহ প্রচুর যা গথদের মধ্যে কমন।

মোরিনো প্রায় কখনোই কারো সাথে কথা বলে না। আমাদের স্বাস্থ্যবান, হাউকাউ করা ক্লাসমেটদের সাথে ওর বিন্দুমাত্র কোন মিল নেই। কোন ক্লাসমেট যদি হেসে ওর সাথে কথা বলে তাহলে মোরিনো সেফ ওর দিকে তাকিয়ে থাকবে, ওর শূন্য অভিব্যক্তি অপরিবর্তিত রেখে শুধু বলবে “ওহ আচ্ছা।” তারপরেও কেউ যদি ওর কাছ থেকে কোন উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে তাহলে তাকে ব্যর্থ মনে ফেরত যেতে হবে কারণ মোরিনো আর কিছুই বলবে না।

বশির ভাগ মানুষই ওর সাথে কথা বলতে এলে এরকম উপেক্ষার শিকার হয়। ক্লাসের মেয়েরা কথা বলার অনেক চেষ্টা করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে।

ওর এই হাবভাব ওর চারপাশে একটা দেয়াল তৈরি করে, সবাইকে দূরে সরিয়ে রাখে। সবাই যখন গল্প করছে কিংবা হাসাহাসি করছে, তখন দেখা যায় মোরিনো কোথাও চুপচাপ একাকি বসে আছে। তখন ওকে দেখে মনে হয় যেন অন্য কোন জগতে চলে গিয়েছে, কিংবা ও যেখানে বসে আছে সেখানে কোন কিছুর ছায়া পড়েছে।

কিন্তু মোরিনো আসলে ইচ্ছা করে কাউকে উপেক্ষা করত না। ওর সাথে কিছুদিন কথা বলার পর আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি। ও আসলে হাসিখুশিভাবে কথা বলতে পারত না, মানুষটাই ওরকম ছিল। অন্যদের সাথে ওর কোন সমস্যা নেই। ও সবার থেকেই সমান দূরত্ব বজায় রেখে চলত।

ভালোভাবে ওকে পর্যবেক্ষণ করার পর আমি সমস্যাটা বুঝতে পারলাম। মোরিনো যখন কারো সাথে কথা বলত তখন সে আসলে বুঝতে পারত না কি প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে, উত্তর দেয়ার মত কিছু সে খুঁজে পেত না। কিন্তু এর পুরোটাই স্রেফ আমার অনুমান ছিল, সত্যি সত্যি সে কী ভাবত তা আসলে আমি জানতাম না। বেশিরভাগ সময়ে তার কোন অভিব্যক্তি দেখা যেত না। যে কারনে ও কী ভাবছে তা কল্পনা করা দুরূহ ছিল।

আমাদের প্রথম আলাপ হওয়ার কিছুক্ষণ পরে আমার মনে হয়েছিল ও হয়তো কোন ধরনের পুতুল-টুতুল হবে। ওর প্রতিক্রিয়া মানুষের চেয়ে কোন জড়বস্তুর সাথেই বেশি মিলে।

***

অক্টোবরের এক বুধবার। গাছের পাতাগুলো তখন সবুজ থেকে লাল হতে শুরু করেছে। মোরিনো মাথা নিচু করে এসে ক্লাসে ঢুকল। ক্লাসের উপস্থিত সবাই সাথে সাথে থেমে গেল। ওর লম্বা ঘন কালো চুলগুলো মুখ ঢেকে রেখেছিল। ওর ধীর গতির পা টেনে টেনে হাঁটা দেখতে কেমন জানি ভূতুড়ে লাগত। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই হয়তো ভাবত ওকে দেখতে ভুতের মত লাগে-কিন্তু ওর আশেপাশের পরিবেশ অন্য রকম, আরো বিপজ্জনক কিছু মনে হয়। যেন কোন বন্য প্রাণী।

ওর চারপাশের দেয়াল যেন স্বচ্ছ কোন গোলক যেটায় সুচালো পেরেক লাগানো আছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল কেউ ওর কাছাকাছি এলে ও তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। বরাবরের মতই ও নির্বাক ছিল, আর কেউই ওর সাথে যেচে পড়ে কথাও বলতে গেল না। কিন্তু তারপরেও ওর মুড সেদিন অন্যরকম লাগছিল। ওর কাছাকাছি যারা বসে ছিল তাদের মুখেও টেনশনের ছায়া দেখা যাচ্ছিল।

আমার অতটা কৌতূহল হচ্ছিল না। আমি ধরে নিয়েছিলাম কোন কারনে হয়তো ওর মেজাজ খারাপ। সেদিন আর পরে আমাদের কথা বলার সুযোগ হয়নি। সুতরাং কারনটাও আর জানা সম্ভব হয়নি (আমি যখন আমার ক্লাসমেটদের সাথে কথা বলি তখন মোরিনো আমার সাথে কথা বলে না। কারণটা জানা গেল পরেরদিন, স্কুল ছুটির পর।

হোমরুম শেষ হওয়ার পর সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। ক্লাস এত নিরব হয়ে গেল যে বিশ্বাসই হচ্ছিল না একটু আগে এখানে কি রকম হাউকাউ হচ্ছিল। শুধু খালি ডেস্কগুলো, মোরিনো আর আমি রুমে থেকে গিয়েছিলাম।

জানালা দিয়ে আরামদায়ক ঠান্ডা বাতাস এসে ঢুকল। আমাদের পাশের ক্লাস তখনো ছুটি হয়নি। হলের অন্য মাথা থেকে টিচারের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।

মোরিনো ওর সিটে বসা, হাতগুলো পাশে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঝুলছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ ক্লান্ত।

“আমার ঘুম হচ্ছে না,” হাই তুলতে তুলতে বলল সে। ওর চোখের নিচে কালি জমেছিল। চোখগুলো আধবোজা হয়ে ছিল, এমনভাবে তাকিয়ে ছিল যেন দূরে কিছু একটা দেখছে।

আমি আমার সিটে বসে ছিলাম, বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। ওর সিট রুমের একদম অন্য কোণায়। রুমে আর কেউ ছিল না বলে ওর কথা ভালো মতই শুনতে পেলাম, কাছাকাছি যেতে হলো না।

“এ কারনেই কি তুমি কালকে অদ্ভুত আচরণ করছিলে?”

“এরকম হয় মাঝে মাঝে। যত চেষ্টা করি না কেন ঘুম আসে না। ইনসমনিয়া হয়তো।”

সে উঠে দাঁড়াল। মনে হচ্ছিল ঘুমে পড়ে যাচ্ছে, টলতে টলতে ব্ল্যাক বোর্ডের দিকে এগুলো।

রুমের সামনে একটা আউটলেট ছিল। একটা কর্ড দিয়ে সেটার সাথে ইরেজার ক্লিনার লাগানো। মোরিনো সেই কর্ডটা নিয়ে গলায় পেঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

“নাহ ঠিক লাগছে না,” সে মাথা নাড়তে নাড়তে কর্ডটা খুলে রাখল। “আমি যখন ঘুমাতে পারি না তখন গলায় কিছু একটা পেঁচিয়ে চোখ বন্ধ করি। কল্পনা করি গলায় ফাঁস দিয়ে আমাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। তখন ঘুম আসে-গভীর পানিতে ডুবে যাওয়ার মত অনুভূতি হয়।”

আমার বিরক্ত লাগছিল। ও কি অনিদ্রার চোটে পাগল হয়ে গেল নাকি? “এতে যদি উপকার হয় তাহলে করছো না কেন?”

“যেকোন দড়ি পেঁচালেই হবে না।”

মোরিনো একটা বিশেষ ধরনের দড়ি খুঁজছিল, ইরেজার ক্লিনারের সাথের কর্ডটা দিয়ে সে কাজ হবে না।

“আমি যেটা ব্যবহার করতাম সেটা হারিয়ে ফেলেছি। নতুন একটা খুঁজছি কিন্তু..” সে হাই তুলল। “আমি জানি না আসলে কি খুঁজছি। খুঁজে পেলে ইনসমনিয়াকে গুডবাই দিতাম।”

“আগে কি ব্যবহার করতে?”

“জানি না। এমনি খুঁজে পেয়েছিলাম। ওটা ছাড়া ঘুমাতে পারার পর কোথায় রেখেছিলাম ভুলে গিয়েছি।”

চোখ বন্ধ করে গলায় হাত বুলালো। “আমার শুধু মনে আছে জিনিসটা কেমন লাগত..” ঝট করে চোখ খুলল যেন হঠাৎ কোন আইডিয়া এসেছে মাথায়। “চল দড়ি কিনতে যাই। তুমিও কিছু দড়ি কিংবা কর্ড কিনে রাখতে পার, কোন একদিন কাজে লাগতে পারে। কোনদিন আত্মহত্যা করতে চাইলে ব্যবহার করতে পারবে।”

অন্য ক্লাসটার ছুটি হলো। চেয়ার সরানোর শব্দ কানে আসছিল আমার।

***

স্কুল থেকে বেরিয়ে শহরের শেষ মাথার এক জেনারেল স্টোরের দিকে পা বাড়ালাম আমরা। জায়গাটা বেশ দূরে। কিন্তু বড় রাস্তায় অনেক বাস থাকায় সেখানে যেতে আমাদের খুব একটা সময় লাগল না। বাসটা অর্ধেকের মত খালিই ছিল। মোরিনো সিটে বসল আর আমি দাঁড়িয়ে স্ট্র্যাপে ঝুলতে ঝুলতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ও মাথা নিচু করে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু বাসের দুলুনিতে ঘুমানো সম্ভব ছিল না। এক ফোঁটা ঘুমও আসার আগে আমরা জায়গা মত পৌঁছে গেলাম।

বিশাল দোকানটা কন্সট্রাকশনের কাঠ আর ধাতব উপাদান, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে ভর্তি ছিল। আমরা সারি সারি সেলফের ভেতরের পথগুলো দিয়ে ঘোরাফেরা করলাম, দড়ির মত কিছু দেখলেই থেমে পরীক্ষা করলাম। টিভি কিংবা ভিডিও প্লেয়ার কানেক্ট করার এভি কেবল, কাপড় ঝুলানোর দড়ি, ঘুরি উড়ানোর সুতা…সব কিছু ওখানে ছিল।

মোরিনো সেগুলো একটা একটা করে তুলে প্রথমে আঙুল বুলিয়ে কিছু একটা অনুভব করার চেষ্টা করল-যেন সাবধানতার সাথে কোন পোশাক পরীক্ষা করে দেখছে।

ওর মতামতগুলো শুনে মনে হল আত্মহত্যার জন্য আদর্শ দড়ি কিরকম হওয়া উচিত সে ব্যাপারে ও একজন বিশেষজ্ঞ। “এরকম চিকন তার হলে গলা কেটে যাবে। ইলেকট্রিক কর্ড বেশ শক্ত, কিন্তু দেখতে ভালো না।”

“প্লাস্টিকেরগুলো কেমন?” নিচের সেলফে রাখা প্লাস্টিকের তারগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলাম, শুধু ও কী বলে তা দেখতে।

অভিব্যক্তিহীন চেহারা নিয়ে ও মাথা নাড়ল। “ওগুলো প্রসারিত হয়। সমস্যা সৃষ্টি করে। এখানে আর কিছু দেখার নেই।”

দোকানের অন্য অংশে বিভিন্ন ধরনের চেইন পাওয়া গেল। একদম দুই সেন্টিমিটার পুরু মোটা ভারি চেইন থেকে এক কি দুই মিলিমিটারের সুক্ষ্ম চেইন পর্যন্ত সব। টয়লেট পেপারের মত রোল করে সেলফে রাখা ছিল। কাছাকাছি একটা মেশিন ছিল যেখান থেকে প্রয়োজন মত চেইন কেটে নেয়া যেত।

“এটা দেখ-খুবই পাতলা, কিন্তু এখানে লেখা এটা নাকি একশ পাউন্ড পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে, সে বলল, আঙুলের ফাঁকে একটা চিকন রুপার চেইন ধরে রেখেছে। গলায় পেঁচিয়ে দেখল। ধাতব চেইনটা আলো পড়ে চকমক করে উঠল। “দারুন দেখতে, এটা পড়লে একটা লাশকেও দেখতে ভালো লাগবে…কিন্তু এটা দিয়ে আত্মহত্যা করতে গেলে গলা কেটে মাংসে ঢুকে যাবে।”

চেইনটা আগের জায়গায় রেখে দিল। ওর প্রয়োজনের সাথে সেটা যায় না।

আত্মহত্যা করতে গেলে কিরকম দড়ি লাগবে সেই চিন্তা ভাবনার পেছনে সে অনেকটা সময় ব্যয় করল।

আমি যদি কাউকে গলায় পেঁচিয়ে মারতে চাই তাহলে কিরকম দড়ি খুঁজব? দোকানের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে আমিও এই চিন্তা করতে লাগলাম।

“গলায় সুড়সুড়ি লাগুক তা আমি চাই না,” আমি যখন ওকে হাতে বোনা খসখসে দড়ি দেখালাম তখন সে বলল। “পুরনো ফ্যাশনের দড়িগুলো দরকার, যেগুলো গ্রামের ফার্মগুলোতে ব্যবহার করে।”

ও যখন ফোর্থ গ্রেডে পড়ত তখন শহরের বাইরে এক জায়গায় থাকত, পাহাড়ি এলাকায়। এখান থেকে দুই ঘণ্টার ড্রাইভ।

“আমার মা যেখানে জন্মেছিল আর বড় হয়েছে, সেখানে আমার নানা নানির একটা ছোট ফার্ম আছে। আমার বাবা প্রতিদিন দু-ঘন্টা ড্রইভ করে কাজে যেত আর দুই ঘন্টা ড্রাইভ করে ফিরত।”

পরে ওরা সেখান থেকে চলে আসে ওর বাবার এই ডাইভিঙের ঝামেলা এড়াতে। এসব আমার কাছে নতুন খবর।

“আমি সবসময় ভেবেছি আত্মহত্যা করতে হলে তুমি হাতের রগ কাটবে, দড়িতে যে ঝুলতে চাইবে তা ভাবিনি,” আমি বললাম।

ও ওর হাত দুটো তুলে ধরল। এগুলোর কথা বলছ?”

ওর হাতগুলো একদম সাদা লাইনের মত দেখতে। একটা পরিস্কার কাটা দাগ দেখা যাচ্ছে। আমি কখনো এই দাগুগুলো সম্পর্কে জানতে চাইনি তাই জানি না কেন সে হাত কাটতে গিয়েছিল।

“এগুলো আত্মহত্যা করতে গিয়ে হয়নি, সেফ হঠাৎ ইচ্ছা হলো…”

ওর জীবন অনুভূতিহীন মনে হলেও আসলে কিছু অনুভূতি অবশিষ্ট ছিল। আর সেগুলো এতটাই শক্তিশালী ছিল যে এরকম ভয়াবহ কিছু ঘটাতে পারে। ওর বাইরের অভিব্যক্তিহিন অবস্থাটা অনেকটা থারমোফ্লাস্কের মত, বাইরে থেকে স্পর্শ করলে ভেতরের তাপ বোঝা যায় না। ভেতরে যাই ঘটুক ্না কেন তা বাইরের পৃষ্ঠ পর্যন্ত আসে না।

কিন্তু এরকম অনুভূতি যখন খুব শক্তিশালী হয়ে পড়ে তখন কিছু একটা করতে হয়। কেউ কেউ খেলাধুলা কিংবা ব্যায়াম করে, অন্যরা নিজেদের শান্ত করতে জিনিসপত্র ভাঙে। কিন্তু মোরিনো এই দুই দলের কোনটাতেই পড়ে না, সে তার নিজের উপরই নিজের অনুভূতিগুলোর প্রয়োগ ঘটায়।

হঠাৎ একটা পরিচিত গলায় আমার নাম শুনলাম।

ঘুরে দেখি আমার বোন, সাকুরা, একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে অবাক দৃষ্টি। ওর হাতে ডগ ফুডের ব্যাগ। শপিঙে বেরিয়েছে।

মোরিনো ঘুম ঘুম চোখ করে ছিল। ব্যাগের উপর কুকুরের ছবি দেখে সে কেঁপে উঠল।

সাকুরা আমাকে জানাল সে আমাকে এখানে দেখে কতটা অবাক হয়েছে, তারপর মোরিনোর দিকে তাকাল।

মোরিনো অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। সে যে সাকুরাকে এড়াতে চাইছিল তা নয়। ব্যাগের উপর কুকুরের ছবি এড়াতে অন্যদিকে তাকিয়েছিল। কোন সেলফে “কুকুর” লেখা থাকলে সেটার ধারে কাছেও ওকে টেনে নেয়া যাবে না।

“আর তোমার সুন্দরি বন্ধুটি কে?” সাকুরা জিজ্ঞেস করল, কৌতূহলি। আমি দ্রভাবে ওকে বুঝিয়ে বললাম সাকুরা ওকে যা ভাবছে সে সেরকম কেউ নয়। সে আমার কথা বিশ্বাস করল বলে মনে হলো না।

“ওকে। আম্মু আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। কুকুরের খাবার কিনলাম আর যাওয়ার সময় ড্রাই ক্লিনারস থেকে কাপড় তুলতে হবে।”

সাকুরা ওর পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে পড়ল। ওর হাতের লেখা আমার চেয়ে হাজার গুণ ভাল। ওর সামনে পরীক্ষা, পড়াশোনা নিয়ে দৌড়ের উপর থাকার কথা, কিন্তু তারপরেও কেউ কোন কাজের অনুরোধ করলে সেটা ফেলতে পারে না।

“তারপর পাশের বাসা থেকে কিছু টোফু আর পিচ্চি কমলা নিতে হবে। আর বাসায় ফেরার পর কুকুরটাকে হাটাতে নিয়ে যেতে হবে।”

সে মোরিনোর দিকে হাসিমুখ করে হাত নাড়ল।

মোরিনো ব্যস্ত ছিল কুকুরের ছবি যাতে চোখে না পড়ে সেই নিয়ে। এক হাতে সেলফে ভর দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে রেখেছিল।

সাকুরা চলে যাওয়ার পর আমি বললাম, “এখন তাকাতে পার।”

মোরিনো সোজা হয়ে দাঁড়াল, তারপর যেন কিছুই হয়নি ভাব করে সেলফের ভেতর এক রোল তার পরীক্ষা করতে লাগল।

“তোমার বোন ছিল নাকি মেয়েটা?”

আমি মাথা ঝাঁকালাম।

“আমারো একটা বোন ছিল। যমজ বোন। অনেক আগে মারা গিয়েছে।”

এই কাহিনীও আমার জানা ছিল না।

“ওর নাম ছিল ইয়ু। ইয়ু…”

যখন ও এই কথাগুলো বলছিল তখন একই সাথে রুপালি তারের উপর আঙুল বোলাচ্ছিল। ওর নীলচে ঠোঁটগুলোর ফাঁক দিয়ে সুন্দর সাদা দাঁত চোখে পড়ছিল। নিচু স্বরে উচ্চারিত কথাগুলো যেন ঠোঁট আর দাঁত দুই জায়গা থেকে বের হচ্ছিল।

ইয়ু গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, মোরিনো ইয়োরু আমাকে বলল।

একগাদা তার-দড়ি গলায় পেঁচিয়ে দেখার পরেও মোরিনো ওর অনিদ্রার সমস্যা দূর করার মত কোন কিছু খুঁজে পেল না। আমিও কিছু কিনলাম না।

সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা পার্কিং লট পার হয়ে রাস্তার দিকে গেলাম। চোখের নিচের গভীর কালো দাগসহ মোরিনোকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন জোরে বাতাস শুরু হলেই ও উড়ে যাবে।

বিশাল জেনারেল স্টোরের আশেপাশে একদমই কিছু ছিল না। শুধু খোলা মাঠ আর শুকনো ঘাসে ঢাকা খালি জায়গা। সেগুলোর মাঝ দিয়ে নতুন পিচ ঢালা পথ এগিয়ে গিয়েছে। একসময় হয়তো এখানে অনেক কিছু হবে, সময় লাগবে তার জন্য।

রাস্তার এক পাশে বেঞ্চ বসানো বাসস্টপ ছিল, মোরিনো গিয়ে সেখানে বসল। যেসব বাস এখানে থামে তার একটা ওর বাসার দিকে যায়।

সূর্য নিচের দিকে নামছিল। আকাশ তখনো নীল। খালি মেঘগুলো গোলাপি রং ধারন করেছে।”তোমার বোন সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে পারি?” আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম। সে চুপচাপ বসে থাকল। কোন উত্তর দিল না।

রাস্তায় খুব একটা গাড়ি ছিল না। মাঝে মধ্যে দু-একটা শশা শো করে চলে যাচ্ছিল। বেশিরভাগ সময়ই খালি চওড়া পিচঢালা রাস্তা আর গার্ড রেইলের পরে শুকনো মরা ঘাসসহ ধুধু প্রান্তর। অনেক দূরে একটা আয়রন টাওয়ার, দিগন্তে বিন্দুর মত ফুটে আছে।

“কী জানতে চাও?” সে একসময় বলল।

“ইয়ু মারা গিয়েছিল যখন আমরা সেকেন্ড গ্রেডে পড়ি। তাই আমার খালি ওকে ছোট অবস্থাতেই মনে আছে। এমনকি যখন ওর বয়স আট বছরও নয়…সে সময় আমরা গ্রামে থাকতাম। সেখানে চারপাশে খামারের পর খামার ছাড়া আর কিছু ছিল না।”

ওদের বাড়ি ছিল এক পর্বতের ঢালে। পেছন দিকে বন, বাড়ি থেকে বনে পাখিদের ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যেত।

“ইয়ু আর আমি একই রুমে এক বিছানায় ঘুমাতাম। যখন রাত হত আর আমরা ঘুমাতে যেতাম তখন বিছানায় শুয়ে বাইরে অন্ধকারে প্যাঁচার ডাক শুনতে পেতাম।”

বাড়িটা ছিল পুরনো, কাঠের তৈরি। মেঝে, পিলার সব কিছু বয়সের ভারে কালো হয়ে গিয়েছিল। আগাছা জন্মেছিল ছাদের টাইলসের ফাঁকে। বাড়ির আশেপাশে ভাঙা টাইল্স পড়ে থাকত। অবশ্য বাড়িটা বেশ বড় আর আরামদায়ক ছিল। তাতামি ফ্লোর ছিল-সব রুমে, শুধু কিচেন বাদে। কিচেনে পরে লাগানো হয়েছিল। যমজ মেয়ে দুটো, ইয়োরু আর ইয়ু ঐ বাড়িতে তাদের বাবা-মা আর নানা-নানির সাথে বাস করত।

মোরিনোর বাবা প্রতিদিন দুই ঘন্টা ড্রইভ করে শহরে যেতেন কাজের জন্য। ওর নানা-নানিও বেশিরভাগ সময় বাইরেই থাকতেন। ধানক্ষেতে পানি দিতেন কিংবা ছাউনি থেকে কৃষিকাজের জিনিসপত্র আনা-নেয়া করতেন। মাঠ আর ধানক্ষেতগুলো বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের মত হাঁটা দূরত্বে ছিল। ওরা যেসব ডায়কন আর বাঁধাকপি খেত সেগুলো এই ক্ষেতেই চাষ হতো।

“কিন্তু আমাদের ক্ষেতের ডায়কন দোকানের ডায়কনের মত দেখতে এত সুন্দর হত না। আর একটু হলদেটে ধরনের ছিল।”

উঠোনে অনেক গাছ ছিল। উঠোনের খোলা মাটি বৃষ্টি হলে কাদার পুকুরে পরিণত হতো। বৃষ্টির সময় বাইরে গেলে মনে হত মাটি জোর করে টেনে আছাড় খাওয়াতে চায়।

বাড়ির বামদিকে ছিল ছোট্ট একটা ছাউনি, বাড়ির দেয়াল ঘেঁসে দাঁড় করানো। কৃষিকাজের সব যন্ত্রপাতি ওখানে রাখা হতো। ছাউনির ছাদটা এক টাইফুনের সময় উড়ে গিয়েছিল। সেটা ঠিক না করে বরং উপরে শ্রেফ একটা নীল রঙের তারপুলিন বিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেটার ফুটো দিয়ে পানি পড়ত কিন্তু ছাউনির ভেতর যন্ত্রপাতি ছাড়া আর কিছু না থাকায় কোন সমস্যা হয়নি।

“আমি আর আমার বোন সারাক্ষণ খেলাধুলা করতাম।”

যখন ওরা এলিমেন্টারি স্কুলে ঢুকল তখন হাত ধরাধরি করে পাহাড়ি পথ দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেত। পাহাড়ি পথটা ছিল সরু আর প্রচুর বাতাস। পথের একধারে ঢাল খাড়া উপরে উঠে গিয়েছিল, সেইসাথে গাছপালায় ভর্তি। অন্য দিকেও গাছপালা ছিল কিন্তু সেগুলোর পাতার ফাঁক দিয়ে দূরের দৃশ্য দেখা যেত। পথের উপর মরা বাদামি পাতা পড়ে থাকত, বৃষ্টির সময় পেছল করে তুলত। লম্বা গাছগুলোর ডালপালা সূর্যের আলো আসতে বাঁধা দিত। যে কারনে পথটা সবসময়ই কেমন ভ্যাপসা আর গুমোট হয়ে থাকত।

“পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে স্কুলে যেতে হতো, সেটা আমাদের জন্য সহজই ছিল। কিন্তু বাসায় ফেরার সময় আমরা হাঁপিয়ে কাহিল হয়ে যেতাম।”

ইয়োরু আর ইয়ুর চেহারা ছিল হুবহু একইরকম। চোখের নিচের তিল পর্যন্ত একই জায়গায়, দু-জনেরই একইরকম কোমর পর্যন্ত লম্বা ঘন চুল। আর ওরা প্রায় সময়ই একইরকম পোশাক পড়ত। আমার কল্পনা করতে কষ্ট হচ্ছিল না যে, একই রকম দেখতে দুটো মেয়ে হাত ধরাধরি করে সবুজে ঢাকা পাহাড়ি পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

“আমরা দেখতে একইরকম ছিলাম। এমনকি আমাদের মা পর্যন্ত আমাদেরকে আলাদা করে চিনতে পারত না। মাঝে মাঝে গোসল করার সময় আমরা পোশাক খুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতাম।”

সেসময় ওদের মা ঠাহর করতে পারতেন না কে বড় আর কে ছোট।

“কিন্তু আমাদের অভিব্যক্তি আর স্বভাবে পার্থক্য ছিল। তাই আমরা কথা বললেই সবাই বুঝে ফেলত।”

ছোটবেলায় ওদের মা ওদেরকে আলাদা করে চিনতে না পেরে হা করে তাকিয়ে থাকলে ইয়ুর খুব মজা লাগত। আর ঠিক যখনই বোঝা যেত ইয়ু মজা পাচ্ছে তখনই ওদের মা ধরে ফেলে বলতেন, “এই যে এটা ইয়োর, আর ওটা ইয়ু।”

ইয়ু সবসময়ই তার বড় বোনের চেয়ে সহজে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করত। ও যখন ওর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলত, সবসময় হাসিমুখ করে রাখত।

“সেসময় আমাদের প্রিয় খেলা ছিল ছবি আঁকা আর মরার ভান করা।”

গ্রীষ্মের ছুটিতে এলিমেন্টারি স্কুলের সুইমিং পুল খোলা ছিল আর ওরা সেখানে যতক্ষণ চাইত সাঁতার কাটতে পারত।

“একদম ছোট একটা স্কুল, সবমিলিয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল একশ জনের মত। প্রত্যেক গ্রেডে বিশ জনেরও কম। কিন্তু গ্রীষ্মের ছুটিতে পুলে সবসময় ভিড় থাকত।”

সূর্যের সাদা আলোকরশ্মির ভেতর বাচ্চারা সারাক্ষণ পুলে দাপাদাপি করত। পুলে শুয়ে কান পানির নিচে দিয়ে রাখলে পাহাড় থেকে ভেসে আসা পোকামাকড়ের ঝিঁঝি শব্দ শুনে মনে হত যেন দেয়াল টেয়াল ভেঙে পড়ছে।

“পুলের আশেপাশে সবসময় দুই-চারজন বয়স্ক মানুষ থাকত যারা খেয়াল রাখত যেন কোন বিপদ না ঘটে। কখনো শিক্ষকেরা, কখনো কখনো অভিভাবকেরা এই দায়িত্ব পালন করত। বেশিরভাগ সময়ই কিছু ঘটত না। তারা স্রেফ পাশের ছাউনির বেঞ্চে বসে একজন আরেকজনের সাথে গল্পে মশগুল হয়ে থাকত।

একদিন দুই বোন ঠিক করল পানিতে ডোবার ভান করে বড়দের চমকে দেবে। তারা উপুড় হয়ে দমবন্ধ করে পানিতে ভেসে থাকল, দেখে যেন মনে হয় মরে ভেসে আছে।

আশেপাশের হৈচৈ করা ছেলেমেয়েদের মধ্যে নিশ্চয়ই ওদেরকে আলাদা করে চোখে পড়ছিল। দুটো মেয়ে উপুড় হয়ে পানিতে ভাসছে, তাদের লম্বা কালো চুল সামুদ্রিক আগাছার মত চারপাশে ছড়িয়ে আছে। কোন নড়াচড়া নেই। দম শেষ হয়ে এলে ওরা মাথাটা অল্প তুলে দম নিয়ে আবার মরে যেত।

“আমরা যা আশা করেছিলাম তারচেয়ে প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি ছিল।”

পাহারায় ছিল ওদের কয়েকজন ক্লাসমেটদের মা। ওনারা যখন ওদেরকে অনড় ভাসতে দেখলেন তখন একজন লাফিয়ে উঠে চিৎকার শুরু করলেন। সব ছেলেমেয়ে চমকে বেঞ্চের দিকে তাকাল। ছোট বাচ্চারা যারা দাপাদাপি করছিল, একটু বড়রা যারা সাঁতার প্র্যাকটিস করছিল সবাই বুঝতে পারল কোন অঘটন ঘটেছে। আরেকজন মহিলা যিনি চিৎকার করেননি তিনি ওদের বাঁচাতে দৌড় দিলেন। কিন্তু পুলের পাশে দৌড়ানো বিপজ্জনক।

“মহিলা পিছলে পড়ে মাথায় বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। যে মহিলা চিৎকার করেছিলেন তিনি গেলেন এ্যাম্বুলেন্স ডাকতে। ইয়ু আর আমি দম শেষে উঠে দেখি আশেপাশের সবাই আতঙ্কে আছে। মনে হচ্ছিল যেন নরক নেমে এসেছে। ছোট বাচ্চারা ভয় পেয়ে চিৎকার করে কাঁদছিল। অজ্ঞান মহিলার পাশে একটা ছেলে তার মায়ের কাঁধ ধরে মা মা করে ঝাঁকাচ্ছিল। ছেলেটা আমাদেরই একজন ক্লাসমেট ছিল।”

যমজ দু-জন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল তারপর টু শব্দ না করে তাড়াতাড়ি পুল থেকে উঠে পালিয়ে গেল। পরনের ভেজা পোশাকও বদলালো না।

“আমরা পেছনের দরজা দিয়ে বের হলাম। আমাদের এক হাতে ব্যাগ, ভেতরে কাপড় আর ভোয়ালে। আরেক হাতে জুতো। সুইমস্যুট পরা অবস্থায় ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে দৌড় লাগালাম আমরা। দূর থেকে শুনতে পেলাম এ্যাম্বুলেন্সের পর এ্যাম্বুলেন্স আসছে। ঐ মহিলা কয়জনকে ডুবতে দেখেছিল কে জানে? অন্তত পাঁচটা অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল সেদিন।”

স্কুলটা ছিল পর্বতের গোড়ায়, পাশ দিয়ে যতদূর চোখ যায় খালি ধান ক্ষেত। সবুজ চারাগুলো পুরো এলাকার উঁচু নিচু মাটি ঢেকে রেখেছিল। মনে হত যেন সমতল ভুমি। যমজ মেয়ে দুটো সেই ধানক্ষেতের পাশের পথ ধরে হেঁটে গেল।

“ধারালো ঘাসে আমাদের পা কেটে গিয়েছিল।”

অ্যাম্বুলেন্স স্কুলে পৌঁছানোর পরে কি হয়েছিল সে ব্যাপারে ওদের কোন ধারণা ছিল না। ওরা সেটা নিয়ে তেমন একটা চিন্তাও করেনি। বাড়ি ফিরে খেয়ে ঘুম দিয়েছিল।

“সেবারই যে শুধু আমরা মরা মরা খেলেছিলাম তা নয়। আমরা একজন আরেকজনের মুখে কেচাপ ছিটিয়ে ভান করতাম যেন সেটা রক্ত।”

ওরা রেফ্রিজারেটরের সামনে দাঁড়িয়ে আঙুলে কেচাপ নিয়ে একজন আরেকজনের মুখে মাখিয়ে দিত। ওদের ফ্যাকাসে সাদা ত্বক কেচাপে লাল হয়ে যেত।

“কেচাপ গড়িয়ে পড়তে লাগলে আমরা তা চেটে চেটে খেতাম। তারপর এক সময় বিরক্ত হয়ে গেলে সসেজ দিয়ে মাখিয়ে খেয়ে ফেলতাম।”

আরেকবার তারা ঘর থেকে একটা মিট সসের ক্যান নিয়ে এসেছিল।

ওদের বাড়ি থেকে অল্প খানিকটা দূরে একবার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। কিন্ডারগার্টেন পড়ুয়া একটা ছেলে গাড়ি চাপা পড়ে সেখানে মারা যায়। ইয়ু সেই জায়গায় গিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।

‘শুরু কর,” সে বলল। আর আমি ওর মুখের উপর ক্যানের পুরো মিট সস ঢেলে দিলাম। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে এসেছে। আমি ইয়কে বললাম যাই ঘটুক না কেন ও যেন একদম নড়াচড়া করে। ও আস্তে করে মাথা নেড়ে সায় দিল। চোখ বন্ধ করে ছিল যেন সস চোখে না ঢোকে।”

ইয়োরু গিয়ে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে থাকল। কখন কে এসে দেখে চিৎকার করে উঠে সে অপেক্ষায় থাকল। বাচ্চারা যখন দেখল, বড়দের মত অতটা অবাক হলো না। তারা কাছে এসে দেখে ধরে নিয়েছিল কোন ধরনের খেলা হবে বা কিছু।

“এমনকি বড়রাও দেখে প্রথমে চিৎকার করলেও একটু পরেই ধরে ফেলেছিল যে জিনিসটা মিট সস। তারপর তারা হেসে ফেলত। আমরা এরকম কান্ডকারখানা অনেক করেছি আগে, প্রতিবেশিরা সবাই জানত আমাদের শয়তানি।”

“কোন গাড়ি যায়নি?”

যেহেতু ওখানে আগে ট্রাফিক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, তার মানে কোন না কোন সময় তো সেখান দিয়ে গাড়ি যাওয়ার কথা। আর ইয়ু রাস্তায় পড়েছিল, বিপদ হতে পারত।

আমি যখন প্রশ্নটা করলাম, মোরিনো কোন অনুভূতি না প্রকাশ করে বলল, “একটা গাড়ি এসেছিল। ইয়ু চোখ বন্ধ করে ছিল তাই টের পায়নি। গাড়িটা ওর সামনে এসে কষে ব্রেক করে থেমেছিল। গাড়ি থামার শব্দে ইয়ু উঠে বসেছিল। মুখ থেকে সস মুছে তাকিয়ে দেখে মুখের সামনে গাড়ির বাম্পার। বাম্পারটা সিলভার পলিস করা ছিল, ওর চেহারার প্রতিফলন সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল..”

“তুমি ওকে ডেকে সাবধান করে দাওনি?”

“না। দেখতে চাইছিলাম কি হয়।” আমি ওর কথার সুরে অপরাধবোধের চিহ্ন খুঁজলাম, কোন চিহ্ন পেলাম। ওর এরকম কোন বৈশিষ্ট্য নেই। একদিক থেকে বললে সে এই ক্ষেত্রেও আমার মতই অনেকটা।

“আমরা যমজ, তাই দেখতে একইরকম ছিলাম। আমাদের চিন্তাভাবনায়ও অনেক মিল ছিল। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য ছিল। আমার বোন ছিল দূর্বল প্রকৃতির।”

আমরা যেখানে বসে ছিলাম তার সামনে একটা বাস এসে থামল। আমাদের জন্য অপেক্ষা করে চলে গেল আর পেছনে ফেলে গেল ধোঁয়ার একটা গন্ধ।

সূর্য দিগন্তের কাছে নেমে গেলে পুব আকাশ অন্ধকার হতে শুরু করেছিল। বাতাসে গার্ডরেইলের ওপারের শুকনো ঘাসগুলো কাঁপছিল।

মোরিনো বেঞ্চে নিচু হয়ে বসেছিল। ওহ হাতগুলো হাঁটুর উপর রাখা।

“আমরা অনেকটা সময় ধরে মৃত্যুর কথা চিন্তা করতাম। মৃত্যুর পর আমরা কোথায় যাব? তখন কি হবে আমাদের? এইসব চিন্তা-ভাবনা আমাদের কাছে খুব আকর্ষণীয় লাগত তখন। কিন্তু আমার মনে হয় ইয়ুর চেয়ে আমি মৃত্যু সম্পর্কে বেশি জানতাম। আর আমি ওরচেয়ে একটু বেশি নিষ্ঠুর ছিলাম।”

কোন অনুভূতি প্রকাশ না করে মোরিনো আমাকে বলল কিভাবে সে ইয়ুকে বিভিন্ন কাজ করতে আদেশ করত।

“সে সময় আমাদের ছাউনিতে একটা প্রাণী ছিল। চারপেয়ে, মুখ দিয়ে লালা ঝরত, দুর্গন্ধওয়ালা-বুঝতেই পারছ কিসের কথা বলছি।”

আমি ধরে নিলাম ও কুকুরের কথা বলছে। ওর একটা পোষা কুকুর ছিল শুনে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

“আমি ইয়ুকে আদেশ করলাম ওটার খাবারে ব্লিচ মিশিয়ে দিতে। এমন যে আমি ভাবছিলাম ওটার গায়ের রং সাদা হয়ে যাবে বা সেরকম বোকা ধরনের কিছু। আমি স্রেফ ওটাকে কষ্ট পেতে দেখতে চাইছিলাম।”

ইয়ু ইয়োরুকে থামতে অনুরোধ করেছে।

“কিন্তু আমি শুনিনি, আমি ওকে দিয়ে জোর করে কুকুরের খাবারে ব্লিচ মেশালাম। সে চায়নি কিন্তু আমি ওকে এড়িয়ে যেতে দেইনি।”

ব্লিচ খেয়ে কুকুরটা মরল না। কিন্তু দুদিন সাতিক অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকল। মোরিণোর বাবা-মা আর নানা-নানি কুকুরটার যত্ন নিল। সারাটা দিন আর সারারাত কুকুরটা যন্ত্রণায় মোচড়াল আর আর্তনাদ করল। ওর চিৎকার পর্বতে প্রতিধ্বনি তুলত।

ইয়োরু পুরো ব্যাপারটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করল। কিন্তু ইয়ু খুব ভয় পেয়েছিল। সে সারাদিন ঘরের ভেতর থাকল, দু-হাত দিয়ে কান চেপে।

“ইয়ু অনেক কেঁদেছিল।”

ইয়োরু কুকুরের সাথে সাথে তার বোনকেও ভালোমত লক্ষ্য করল। নিজে সরাসরি কুকুরটাকে ব্লিচ না খাইয়ে সে সমস্ত অপরাধবোধ তার বোনের উপর চাপিয়েছিল। ইয়োরুর পরীক্ষায় কুকুর আর তার বোন দু জনেই যন্ত্রণা পেয়েছিল।

ইয়োরু আর ইয়ু নিজেরাও গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা আত্মহত্যা খেলত, একবারই খেলেছিল।

“ঠিক করে বললে, এক কদমের জন্য আমাদের আত্মহত্যা আটকে গিয়েছিল। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। যে কারনে বাইরে খেলতে যেতে পারিনি, ছাউনিতে খেলছিলাম। ইয়ু মারা যাওয়ার এক কি দুই মাস আগের ঘটনা এটা।”

যমজ বোন দু-জন প্রত্যেকে মেঝের উপর একটা করে কাঠের বাক্স রেখে তার উপর দ্বিতীয় আরেকটা বাক্স রেখে দাঁড়াল। ছাউনির বিম থেকে ঝুলানো দড়ি গলায় দিল। এরপর স্রেফ বাক্স থেকে লাফ দিয়ে ফাঁস খেয়ে মরা বাকি।

“আমি বললাম তিন পর্যন্ত গুনে আমরা লাফ দিব। মিথ্যে বলেছিলাম আমি, লাফ দিতাম না। ইয়ু ফাঁস খেয়ে মরত আর আমি দেখতাম।”

এক…দুই…তিন। তিন গোনার পর দু-জনের কেউই লাফ দিল না। দু জনেই চুপ করে ছিল।

“ইয়ু বুঝতে পেরেছিল আমি কি ভাবছিলাম, যে কারনে সে লাফ দেয়নি। আমি যখন ওকে জজ্ঞেস করলাম কেন লাফ দেয়নি, ও স্রেফ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ভয়ে কাঁপছিল।”

ইয়ু মুখ খুলে বলতে পারেনি কেন পুরো ব্যাপারটা অন্যায় ছিল, সে শুধু দাঁড়িয়ে থেকে ইয়োরুর অপমানের বন্যায় ভেসে গেল।

“তুমি ইয়ুকে বুলি করতে?”

“সেটা বলা যেতে পারে। কিন্তু সে সময় আমার কোন হুশ ছিল না। বেশিরভাগ সময়ই আমাদের মধ্যে কোন সমস্যা হত না। আর ইয়ু ওর ভাগের খারাপ কাজগুলোও ঠিকমত করত। আমার চেয়ে ও আরো ভালো মত মরার অভিনয় করে লোকজনকে আতংকিত করতে পারত।”

“তোমার পরিবারের অন্যরা জানত তোমাদের দুই বোনের মধ্যে সম্পর্ক যে এরকম ছিল?”

“না।”

মোরিনো নিরব হয়ে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল। শাঁ করে একটা গাড়ি ছুটে গেল। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসায় গাড়িটার হেড লাইট জ্বালানো ছিল। বাতাসে মোরিনোর চুল উড়ছে, কয়েকটা চুল আবার গালের সাথে লেপ্টে আছে।

“ইয়ু মারা গিয়েছিল গ্রীষ্মের ছুটির সময়। আমরা তখন সেকেন্ড গ্রেডে পড়তাম। সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল একটা সকাল ছিল। কিন্তু শিগগিরি আকাশ কালো হয়ে গেল। আর দুপুরের দিকে শুরু হল বৃষ্টি..”

দুপুরের কিছু পর ওদের মা শপিঙে গেলেন। বাবা বাসায় ছিলেন না। নানা-নানিও বাইরে। শুধু যমজ দুই বোন বাসায় একা।

প্রথমে কুয়াশার মত ঝিরঝির বৃষ্টি ছিল। টুপটাপ ফোঁটা পড়ছিল জানালায়। আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়তে লাগল।

“সাড়ে বারোটার দিকে আমি দেখলাম ইয়ু ছাউনির দিকে যাচ্ছে। আমাকে কিছু বলেনি, তাই আমি ধরে নিলাম সে হয়তো একা কিছু সময় কাটাতে চাইছে। আমিও আর ওর পিছু পিছু গেলাম না।”

ইয়োরু একা বসে বই পড়তে লাগল।

প্রায় ঘন্টা খানেক পর, সে সামনের দরজা খোলার শব্দ পেল। গিয়ে। দেখে ওর নানি ফিরেছেন, হাতে এক ব্যাগ নাশপাতি।

ওর নানি ছাতি বন্ধ করতে করতে বললেন, “পাশের বাসা থেকে এগুলো দিয়েছে। তোমাকে একটা ছিলে দেব?”

“আমি বললাম, ইয়ুকে ডেকে আনি। নানিকে দরজার ওখানে রেখে দৌড়ে ছাউনিতে গেলাম।”

ইয়োক ছাউনির দরজা খুলল-আর দৃশ্যটা দেখল। সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল।

“ইয়ু সিলিং থেকে ঝুলছিল। গলায় দড়ি পেঁচানো ছিল। আমি সামনের দরজায় ফিরে গেলাম, যেখানে নানি নাশপাতি হাতে দাঁড়ানো ছিলেন। আমাকে ভয়ে কাঁপতে দেখে অবাক হলেন।”

সে নানিকে বলল ইয়ু বেঁচে নেই।

ইয়ু নিজের গলায় ফাঁস নিয়েছে। আত্মহত্যা ছিল না, অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। শুধু যে ওর গলায় দড়ি ছিল তা নয়, ওর বগলের নিচে বুকে দ্বিতীয় আরেকটা দড়ি বাঁধা ছিল-একটা খসখসে ভারি দড়ি, খামারে যে ধরনের দড়ি ব্যবহার করা হয়। একদিক ওর বুকে বাঁধা ছিল, আরেক দিক লেজের মত ঝুলছিল। গলার দড়িটাও একই ধরনেরই ছিল। পুরোটাই একটা দড়ি ছিল কিন্তু ছিঁড়ে গিয়েছিল।

“আমার বোনের মরার কোন ইচ্ছা ছিল না। ও চেয়েছিল বুকের দড়িটা দিয়ে ঝুলবে আর আত্মহত্যার ভান করে সবাইকে ভয় দেখাবে। কিন্তু যে

মুহূর্তে ও লাফ দিয়েছিল, ওজন নিতে না পেরে দড়িটা ছিঁড়ে যায়।”

খুব কম লোকজনের মধ্যে ইয়ুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। আর এই গল্পের শেষ এখানেই।

আমার একটা প্রশ্ন ছিল কিন্তু জিজ্ঞেস করলাম না। মোরিনোর ক্লান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস শুনলাম।

সূর্য ততক্ষণে পুরোপুরি ডুবে গেছে। রাস্তার ধারের বাতিগুলো জ্বলছিল। বাসস্টপের সাথের বাতির আলোয় বাসের শিডিউল জ্বলজ্বল করছিল। আমরা বাস-স্টপের উজ্জ্বল সাদা আলোর মধ্যে বেঞ্চে বসে রইলাম।

দূরে এক জোড়া হেড লাইট দেখা যাচ্ছে। সাথের চারকোনা ছায়ার পেছনে নিশ্চয়ই একটা বাস আছে। কিছুক্ষণ পরেই ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল। আর বাসটা আমাদের সামনে এসে থামল।

মোরিনো উঠে খোলা দরজা দিয়ে বাসে ঢুকে গেল। আমিও বেঞ্চ ছেড়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম।

কেউ কাউকে গুডবাই বললাম না আমরা। একজন আরেকজনের দিকে তাকালামও না।

দিনটা ছিল শনিবার। মোরিনো ইয়োৰু ওর বোনের মৃত্যুর কাহিনী বলার দু দিন পর। আকাশে মেঘ করেছিল।

স্কুল ছিল না বলে আমি বেশ সকালে উঠে ট্রেনে চড়লাম। ট্রেনটা আমাকে নিয়ে গেল শহরের বাইরে, গ্রাম এলাকার দিকে যেখানে লোকজন কম। যতদূর যেতে থাকলাম ট্রেনের যাত্রি তত কমতে লাগল। ট্রেনে একসময় আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম। মেঘের কারনে সূর্য নেই। গাঢ় সবুজ ক্ষেতগুলো শাঁ করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।

একদম জনমানবহীন ক্ষেত খামারের কাছে এক স্টেশনে পৌঁছে আমি ট্রেন থেকে নামলাম। স্টেশনের বাইরে একটা বাস দাঁড়িয়ে ছিল। সেটায় চড়ে কিছুদূর গেলাম, যতক্ষণ না উঁচু এলাকা শুরু হলো আর গাছপালাও ঘন হতে শুরু করেছে। উপর থেকে আমরা নিচের গ্রাম দেখতে পাচ্ছিলাম। রাস্তাটা তেমন একটা চওড়া ছিল না। কোনভাবে একটা বাস যাওয়ার মত জায়গা ছিল। রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ, বাসের জানালায় টোকা দিচ্ছিল।

বনের মাঝে এক স্টপে গিয়ে বাস থেকে নামলাম। রাস্তায় আর কোন যানবাহন ছিল না। শিডিউল দেখলাম। এক ঘন্টা পর একটা বাস আছে শুধু। সন্ধ্যায় কোন বাস নেই। তার মানে এক ঘন্টা পরের বাসেই আমাকে চড়তে হবে। চারপাশে গাছপালা ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিছুদূর হাঁটার পর কয়েকটা বাড়ি দেখতে পেলাম।

এই বাড়িতে মোরিনের জন্ম হয়েছিল, এখানেই সে তার ছোটবেলা কাটিয়েছে।

আমি বাড়ির সামনে থেমে একবার চারপাশ ভালো করে দেখলাম। রোদ থাকলে হেমন্তকালে পুরো এলাকা লাল দেখানোর কথা। কিন্তু মেঘের জন্য সবকিছু কেমন ম্যাড়মেড়ে দেখাচ্ছিল।

বাড়িটার দিকে এগুনোর সময় গতকাল স্কুলে মোরিনোর সাথে হওয়া আলাপের কথা মনে করলাম।

শুক্রবার লাঞ্চের সময়, লাইব্রেরি প্রায় জনশূন্য ছিল। দেয়াল ধরে বইয়ের সেলফ লাগানো। বাকি অংশে ডেস্ক আর চেয়ার রাখা পড়াশোনা করার জন্য। রুমের সবচেয়ে নির্জন কোনায় মোরিনো বসেছিল। ওর সাথে গিয়ে কথা বললাম।

“গ্রামে তুমি যে বাড়িতে থাকতে সেটা আমি দেখতে চাই।”

সে বই পড়ছিল। মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“তুমি কি ভুলে গিয়েছ নাকি যে লোকজন যেসব জায়গায় মারা যায় সেসব জায়গা পরিদর্শন করতে আমার ভালো লাগে?”

মোরিনো অন্যদিকে তাকাল তারপর বই পড়ায় ফিরে গেল। আমি ওর পাশে বসে পড়লাম। ওর গলার অংশবিশেষ দেখতে পাচ্ছিলাম খালি। ও আমাকে উপেক্ষা করে বই পড়ার চেষ্টা করছিল।

আমি উঁকি দিয়ে বইয়ের নামটা দেখার চেষ্টা করলাম। পৃষ্ঠার কোণায় লেখা, “চ্যাপ্টার তিনঃ তুমি একা নও…কিভাবে পজিটিভ জীবন যাপন করা যায়।” দেখে ধাক্কা খেলাম।

মোরিনোর মাথা তখনো নিচু করা। আমাকে বলল, “আমি ভেবেছিলাম বইটা পড়তে গেলে ঘুম পাবে।”

তারপর লম্বা একটা নিরবতা। একসময় সে মুখ তুলল। “তোমাকে ইয়র কথা বলার জন্য আমার আফসোস হচ্ছে। তুমি যদি যেতেই চাও, তাহলে একলা যেতে হবে।”

বাড়িটা আর ছাউনিটা তখনো আছে। ওর নানা-নানি তখনো সেখানে বসবাস করে। কৃষিকাজ করে।

আমি জানতে চাইলাম কেন সে যেতে চায় না। সে বলল ঘুম না হওয়ার কারনে সে খুবই ক্লান্ত।

পরদিন শনিবার, স্কুল ছুটি। তাই আমি ঠিক করলাম সেদিনই গ্রামে যাব। মোরিনো আমাকে ঠিকানা আর যাওয়ার রাস্তা বাতলে দিল। দেখে মনে হচ্ছিল দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আশা যাবে। মোরিনো আমার নোটবুকে একটা ম্যাপ একে দিয়েছিল।

“কথা নাই বার্তা নাই একজন স্কুল ছাত্র যদি হঠাৎ সেখানে হাজির হয় তাহলে সবাই অবাক হবে।” আমি বললাম। সে মাথা ঝাঁকাল। বলল ফোন করে নানা-নানিকে জানিয়ে রাখবে। তাদেরকে বলা হলো গ্রামের প্রকৃতির ছবি তুলতে আমি সেখানে যাচ্ছি।

“আর কিছু?” মোরিনো বরাবরের মত অনুভূতিহীন সুরে বলল।

আমি ওর আঁকা ম্যাপের দিকে তাকালাম। “তোমার ম্যাপ দেখলেই আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়।” বলে আমি উলটো ঘুরে চলে আসলাম। লাইব্রেরির দরজায় পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো রাস্তা আমার পিঠে ওর দৃষ্টি অনুভব করতে পারছিলাম। মনে হচ্ছিল ও কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু কথাগুলো গলা পর্যন্ত এসে আটকে গিয়েছে।

ধূসর মেঘ, একঝাঁক কালো পাখি নিচু দিয়ে উড়ে গেল। আমি নোটবুকে আঁকা মোরিনোর ম্যাপটার দিকে তাকালাম। ম্যাপের বক্তব্য অনুসারে রাস্তাটা কিন্ডারগার্টেনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার কথা। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল পৃথিবীর কোন বাবা-মা কিভাবে তাদের সন্তানদের এরকম একটা স্কুলে পাঠাতে পারেন।

অর্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করতে করতে আমি মোরিনোদের পুরনো খামার বাড়ির দিকে এগুলাম। বাড়ির নাম্বার আর ল্যান্ডমার্ক জানা ছিল, সুতরাং ম্যাপ না বুঝলেও খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না বলেই আমার ধারণা।

হাঁটতে হাঁটতে বাসস্টপের বেঞ্চে বসে মোরিনোর বলা কাহিনী আবার চিন্তা করলাম, এক নিষ্ঠুর মেয়ে আর তার যমজ বোনের কাহিনী।

ইয়ুকে দড়িতে ঝোলা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।

কিন্তু মোরিনোর গল্পে একটা অংশ ছিল যার কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না–যে অংশে সে তার বোনের মৃত দেহ খুঁজে পায়।

ইয়োরু ছাউনির দরজা খুলে দৃশ্যটা দেখে চিৎকার দেয়। তারপর দৌড়ে তার নানিকে গিয়ে জানায় যে ইয়ু মৃত।

মোরিনো কি করে দৃশ্যটা দেখার সাথে সাথে জানল যে ইয়ু মৃত? তারা তো সবসময় মৃত সাজার ভান করত আর লোকজনকে চমকে দিত তাই না? তাহলে সে কেন ভাবেনি যে ওর বোন স্রেফ অভিনয় করছে?

হতে পারে যে সাধারণ মৃতদেহ হয়তো দেখতে অভিনয়ের চেয়ে অনেক আলাদা, অনেক ভয়ঙ্কর কিছু…কিন্তু ব্যাপারটা হল যে সে কখনো ভাবেনি যে এটা অভিনয়, সে সাথে সাথে দৌড়ে তার নানিকে বলতে গিয়েছিল…ব্যাপারটা আমার কাছে গোলমেলে লাগছে।

আমি ম্যাপ আর রাস্তা অবার মিলিয়ে দেখলাম। সামনে দিয়ে গভীর একটা পাহাড়ি নদী চলে গিয়েছে। ম্যাপ অনুযায়ি এখানে একটা ড্রাই ক্লিনার থাকার কথা। কাপড় চোপড় তো পরিস্কার করার পর আর শুকাতে পারবে না, আমি ভাবলাম।

ব্রিজ পার হওয়ার সময় আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘগুলো নিচু হয়ে পর্বত চূড়ার কাছে ঝুলে আছে। আশেপাশের গাছগুলোকে অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে।

আরো কিছুক্ষণ হাটার পর আমি মোরিনোদের খামার বাড়ি খুঁজে পেলাম। পর্বত ঘেঁসে পুরোনো একটা বিল্ডিং। মস জাতীয় আগাছায় ঢেকে আছে ছাদটা, যে রকমটা মোরিনো বলেছিল। আশেপাশে গাছপালা আর ক্ষেত ছাড়া কিছু নেই, রাতে নিশ্চয়ই কালিঘোলা অন্ধকারে ঢেকে যায় সবকিছু। কোন গেট কিংবা দেয়াল নেই, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি হঠাৎ আবিস্কার করলাম ওদের উঠোনে পৌঁছে গিয়েছি।

সামনের দরজার দিকে যাওয়ার সময় বামদিকের ছাউনিটা চোখে পড়ল। এই ছাউনিতেই নিশ্চয় ইয়ুর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল? ছাউনির দেয়াল শুষ্ক সাদা কাঠ দিয়ে তৈরি। উপরে নীল রঙের তারপুলিন দেয়া, প্লাস্টিকের তার দিয়ে বাঁধা। অনেক পুরনো, একদিকে কাত হয়ে আছে।

সামনের দরজাটা কাঠ আর কাঁচ দিয়ে তৈরি, খোলা ছিল। আমি ডোরবেল বাজালাম। পেছন থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকল।

ঘুরে তাকিয়ে দেখি একজন বুড়ি মহিলা নিড়ানি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।

তার পিঠ বাঁকানো, পরনে ঢোলা ওয়ার্ক ট্রাউজার, গলায় একটা গামছা পেঁচানো। আমি ধরে নিলাম বুড়ি নিশ্চয়ই মোরিনোর নানি হবেন।

“ইয়োক গত রাতে ফোন করেছিল। আমি তো দুশ্চিন্তা শুরু করে দিয়েছিলাম যে তুমি বোধহয় আসছ না।” তিনি বললেন। তার ঝুলে যাওয়া কুঁচকানো মুখের সাথে মোরিনোর চেহারার কোন মিল পেলাম না। মোরিনোর চেহারা দেখলে মনে হয় ইতিমধ্যে মৃত, ওর নানির রোদে পোড়া চেহারার কিছুই ওর মধ্যে নেই।

আমি মাথা বো করে বললাম কয়েকটা ভালো ছবি তোলা হলেই আমি চলে যাব। কিন্তু মোরিনোর নানি আমার কথা উপেক্ষা করে আমাকে ধাক্কিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন।

দরজা দিয়ে ঢুকতেই শু বক্স রাখা। উপরে কিছু জিনিস রাখা যা দেখে মনে হল সুভিনর ধরনের কিছু হবে। তারপর হলওয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছে। এয়ার ফ্রেসনার আর অপরিচিত মানুষের গন্ধ ভেসে আছে বাতাসে।

“তোমার নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেয়েছে?”

“তেমন একটা না।”

উনি আমার কথা পাত্তা দিলেন না, ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে ডিশ ভর্তি খাবার সামনে এনে রাখলেন। মোরিনোর নান এলেন একটু পর। লম্বা, সাদা চুল ওয়ালা এক বুড়ো।

উনাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো আমাকে মোরিনোর বয়ফ্রেন্ড ধরে নিয়েছেন।

“তোমাকে তো একদিন ইয়োরুকে বিয়ে করতে হবে,” আমি খাব না বলাতে, নানা মাথা ঝাঁকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ছাউনিটা দেখে বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই বাসের কাছে পৌঁছাতে পারব কিনা ভাবছিলাম।

কিচেন কেবিনেটের এক পাশে একটা ছবি ছিল। ছবিতে পুতুলের মত দেখতে দুটো বাচ্চা মেয়ে। দু-জনেরই লম্বা কালো চুল। দু-জনেই সোজা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে কোন হাসি নেই। দু-জনেরই পরনে কালো পোশাক। একজন আরেকজনের হাত ধরে রেখেছে। দেখে মনে হচ্ছে সামনের উঠানে ভোলা, কারণ ওদের পেছনে বাড়িটার সামনের দরজা দেখা যাচ্ছে।

“ইয়োরু আর ইয়ু,” আমার দৃষ্টি খেয়াল করে নানি বললেন। “তুমি কি ওর যমজ বোনের কথা শুনেছ?”

আমি মাথা ঝাঁকালাম।

“এটা ওদের ছয় বছর বয়সের সময়ে ভোলা, নানা বললেন। দু জনের কেউই ছবিটা সম্পর্কে আর কিছু বললেন না।

খাওয়ার পর বাড়ির প্রার্থনা বেদীর সামনে যেতে দেয়া হলো আমাকে। আমি জানতাম সামনে এগুতে হলে আমাকে এসব ভদ্রতা দেখানো ছাড়া উপায় নেই।

প্রার্থনা বেদীর সামনে রাখা ইয়ুর ছবি দেখে আমার মনে হল ওর মৃত্যু হয়তো ওর নানা-নানির কাছে মাত্র গতকালকের কোন ঘটনা মনে হয়। যদিও ঘটনাটা ঘটেছে নয় বছর আগে। আমার কিংবা মোরিনোর কাছে নয় বছর হল আমাদের অর্ধেক জীবনের চেয়েও বেশি–কিন্তু ওর নানা-নানির বয়সের কাছে নয় বছর কোন বছরই নয় হয়তো।

হাত জোর করে শ্রদ্ধা জানানোর পর মোরিনোর নানা-নানি আমাকে লিভিং রুমে নিয়ে বসালেন আর তাদের নাতনি স্কুলে কিরকম করছে সে ব্যাপারে জানতে চাইলেন। আমি উত্তর শুরু করার আগেই তারা নিজেরাই মোরিনো ছোটবেলায় কিরকম ছিল সে নিয়ে গল্প জুড়ে দিলেন। আমি ধরে নিলাম আমার বক্তব্য নিয়ে তাদের আসলে কোন আগ্রহ নেই।

“ওই তাই তো, ওর এলিমেন্টারি স্কুলে আঁকা কিছু ছবি আমাদের কাছে আছে!” নানি আনন্দে লাফিয়ে উঠে উধাও হয়ে গেলেন কোথাও।

নানা তার স্ত্রী যাওয়ার পর ক্ষমা প্রার্থনার সুরে আমাকে বললেন “ইদানিং আমার স্ত্রীর মাথায় অল্প একটু সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে আমার।”

উত্তরে আমি শুধু মাথা ঝাঁকালাম। কিছু বলার চেয়ে মাথা ঝাঁকানোই আমার কাছে সঠিক প্রতিক্রিয়া হবে বলে মনে হলো।

“আসলে ইয়োরু কখনো ওর কোন বন্ধুকে বাসায় নিয়ে আসেনি, বুঝেছ? তাই তুমি আসছ শুনে ওর নানি আজকে একটু বেশিই উত্তেজিত।”

মোরিনোর নানি একটা কাগজের ব্যাগ নিয়ে ফিরে এলেন। ব্যাগের ভেতর থেকে এক গাদা পুরোনো ড্রয়িং পেপার বের হলো, মোরিনো ওর এলিমেন্টারি স্কুলে থাকার সময়ে রং আর ক্রেয়ন দিয়ে ওগুলো এঁকেছিল। মোরিনোর ম্যাপ আঁকা দেখে আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, এখন নিশ্চিত হওয়া গেল ওর মধ্যে আর্টের মেধা বলতে কিছু নেই।

কাগজগুলোর পিছে নাম আর গ্রেড লেখা ছিল।

এর মধ্যে কয়েকটা ইয়ুর আঁকা ছিল। দু-জনের ড্রইংই একসাথে রাখা ছিল। ইয়োরুর ড্রয়িং ছিল একদম ফার্স্ট গ্রেড থেকে সিক্সথ গ্রেড পর্যন্ত। কিন্তু ইয়ুরগুলো খালি ফার্স্ট আর সেকেন্ড গ্রেডের। ব্যাপারটা যেন বাস্তবতাকেই স্পষ্ট করে তুলছিল যে ইয়ু নামের মেয়েটা আর নেই।

আমি দু-জনের সেকেন্ড গ্রেডের ড্রয়িং পাশাপাশি রেখে তুলনা করলাম।

“কারো পক্ষে আসলে বলা মুশকিল ওরা কি আঁকতে চাইছিল, তাইনা?” নানি উজ্জ্বল মুখ করে বললেন। যমজ দু-জনের আঁকার ক্ষমতার মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। কিন্তু দু-জনেই একই বিষয় নিয়ে এঁকেছে আর একইরকম ড্রয়িং করেছে।

দুটো ছবিতেই বাড়ির একটা অংশ দেখা যাচ্ছে আর মাঝের অংশে লম্বা চুলের দু-জন মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে মেয়ে দুটো আসলে ওরাই।

“খোদাই জানেন ওরা কি করছে,” নানি বললেন।

“বাড়ির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে?” নানা উত্তর দিলেন।

“তাই তো মনে হচ্ছে, নানি উত্তর শুনে হাসলেন।

আমি কিছু বললাম না, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম ওরা কি এঁকেছে। মেয়ে দুজনেরই গলার উপর লাল দাগ টানা যেটা সিলিঙের সাথে লাগানো। তারা ছাউনিতে আত্মহত্যা আত্মহত্যা খেলার ছবি এঁকেছিল।

“ওরা এই ছবিগুলো গ্রীষ্মের ছুটিতে এঁকেছিল, স্কুলের হোমওয়ার্ক ছিল। ছুটির পর ইয়ুর ড্রয়িংটা স্কুলে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু…ইয়ু মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে আঁকা এটা।” পুরনো স্মৃতি মনে করে নানি মলিনভাবে হাসলেন।

দুটো ছবির মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না। ইয়ুর আঁকা ছবিটায় ডিটেইলিং একটু ভালো ছিল। ওরটায় লাল দাগ ছাদের বিমের সাথে লাগানো ছিল, আর বাক্সগুলো একটার উপর একটা সাজানো ছিল। বাড়ির উপরে আকাশে সূর্য ছিল। আর মেয়েদের জুতাগুলো পাশে রাখা ছিল।

আর ইয়োরুর ছবিতে এইসব ডিটেইলিং কিছু ছিল না, খুব সাধারনভাবে রং করা। পুরো পা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রং করা, জুতার জন্য আলাদা কোন রং করা হয়নি! ব্যাকগ্রাউন্ড পুরোটা ছাই রং করা।

ইয়ুর ছবির জুতাগুলো আমার মনোযোগ কাড়ল। একটা মেয়ের জুতা কালো, আরেকজনটায় কোন রঙ নেই। এর অর্থ কি হতে পারে আমি নিশ্চিত ছিলাম না কিন্তু নোট করে রাখা প্রয়োজন মনে করলাম।

ছবিগুলো টেবিলের উপর রেখে দিলাম।

“আমার মনে হয় ছবিগুলো তুলে ফেলা উচিত,” বলে আমার ক্যামেরা নিয়ে বাইরে গেলাম।

দরজা খুলতেই বাইরে সবকিছু সাদা দেখাল। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল কুয়াশা, কিন্তু আসলে ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিল। এমন বৃষ্টি যেটায় ছাতা ব্যবহার করার কোন মানে হয় না। সুতরাং আমি চারপাশে ঘুরে ইচ্ছামত ছবি তুলে নিলাম। কিছুক্ষণ পর জোরে বৃষ্টি শুরু হলো।

আমি ভাব করলাম যেন হঠাৎ কোনভাবে ছাউনির সামনে পড়ে গিয়েছি।

ছাউনির দরজা কাঠের তৈরি ছিল। বন্ধ ছিল কিন্তু হাতল ধরে টান দিতে খুলে গেল। ভেতরে অন্ধকার, প্রথমে কিছু দেখা যাচ্ছিল না।

দরজা দিয়ে যতটুকু আলো ঢুকছিল তাতে হালকাভাবে কিছু দেখা গেল। ভেতরে শুকনো গাছের গন্ধ।

ছাউনিটা ছিল প্রায় সাড়ে ছয় ফুটের মত উঁচু আর দশ বাই তের ফুট সাইজের। মেঝে কাদা দিয়ে নোংরা হয়ে ছিল।

আধ ভাঙা সিলিঙের নিচে একটা বিল দেয়া। অনেকগুলো ফুটো ছিল, নিল তারপুলিন দেখা যাচ্ছে। একটা বাতি ঝুলে আছে।

মোরিনোর কাহিনী অনুযায়ি এখানে একটা কুকুর রাখা হতো। এখন আর নেই যেহেতু তার মানে হয়তো বেঁচে নেই। দরজার পাশে ছোট করে আরেকটা গর্ত কাটা, সম্ভবত কুকুরটার জন্যই। কুকুরটাকে নিশ্চয়ই ওটার আশেপাশেই কোথাও বেঁধে রাখা হতো।

আমি ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরটা ঠান্ডা আর খানিকটা ভ্যাপসা।

একসময় ইয়ু এখানে ছিল, সিলিঙের বিম থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছিল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল মৃত মেয়েটা এখনো সেখানে ঝুলছে।

দরজার পাশেই একটা সুইচ ছিল। সুইচ চাপতেই বাতি জ্বলে উঠল। খুবই কম পাওয়ারের বাতি, খুব অল্পই আলোকিত হলো।

ইয়োর বলা কাহিনী মনে পড়ল আমার-দুইটা বাক্স মেঝেতে রেখে ওরা উপরে উঠে দাঁড়িয়েছিল, গলায় দড়ি দিয়ে ঝাঁপ দেয়ার জন্য তৈরি…এখানে রাখা কুকুরটার খাবারে ব্লিচ মিশিয়ে দেয়া।

ইয়ুর মারা যাওয়া নিয়ে ইয়োরুর কাহিনীর উপর আমার সন্দেহ হচ্ছিল।

ইয়োৰু ছাউনির দরজা খোলার আগেই জানত ওর বোন মৃত। ও শুধু অভিনয় করেছিল যে ঐ মুহূর্তে সে সেটা আবিস্কার করেছে।

কেন সে ওরকম করতে গেল? সে কি লুকাতে চাইছিল? ব্যাপারটা নিয়ে আমি যতই চিন্তা করছিলাম ততই মনে হচ্ছিল ওর বোনের মৃত্যুর পেছনে নিশ্চয়ই ওর কোন হাত আছে।

“আমরা এখানেই ইয়ুকে খুঁজে পেয়েছিলাম।”

ঘুরে দেখি দরজার কাছে মোরিনোর নানি দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি সিলিঙের দিকে।

“আমি শুনেছি সবাইকে চমকে দিতে গিয়ে ও মারা গিয়েছিল।”

উনি যেখানে তাকিয়ে ছিলেন সেদিকে তাকালাম। ওখানেই নিশ্চয়ই ইয়ুকে পাওয়া গিয়েছিল।

বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। উঠোনে ছিটকে পড়ার শব্দ শুনতে পারছিলাম। কিন্তু ছাউনির ভেতর বাইরের সব শব্দ যেন মিইয়ে গিয়েছিল। এমন কি তারপুলিনের উপর পড়া বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দও।

ছাদের ফুটো দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছিল, ঝড়ে যেটা ভেঙে গিয়েছিল কিন্তু ঠিক করা হয়নি। তাতে কোন সমস্যা হয়নি কারণ ছাউনির ভেতর তেমন কিছু ছিল না।

ছাউনির এক পাশে দেয়ালে ঠেশ দিয়ে নারানি, কোদাল, কাস্তে ইত্যাদি রাখা ছিল। পাশে কাঁচি আর মোটা দড়ি রাখা।

কুকুরের দরজার পাশে অনেকরকমের দড়ি রাখা ছিল, যদিও কুকুর আর নেই। দড়িগুলো বিভিন্ন রঙের ছিল কিন্তু লাল রঙের একটা দড়ি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

“আমার সবকিছু একদম পরিস্কার মনে আছে,” মোরিনোর নানি আস্তে করে বললেন। আমি প্রতিবেশির বাসা থেকে এসে ছাতা ঠিক করে রাখছিলাম। ইয়োরু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল..”

ইয়োক ওর কাহিনী যেরকম বলেছিল তার সাথে ওর নানির কাহিনীর কোন পার্থক্য নেই। ইয়োরু নাশপাতির ব্যাগ দেখে ওর বোনকে ডাকতে ছুটে গেল। তারপর ছাউনির দরজা খুলে চিৎকার করল। পুরো গল্পে একটা মাত্র জিনিস আমার মনে খটকা লাগাচ্ছিল, সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার আগেই পায়ের নিচে অদ্ভুত কিছু একটা অনুভব করলাম।

পা মাটির সাথে আটকে যাচ্ছিল। মাটির মেঝে, ছাদের ফুটো দিয়ে আসা বৃষ্টিতে ভিজে নরম আর আঠালো হয়ে গিয়েছিল।

পা তুলতেই মাটিতে আমার জুতোর ছাপ দেখা গেল।

ইয়ু যেদিন মারা গেল সেদিনও বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিনও ছাউনির মেঝের অবস্থা নিশ্চয়ই এরকমই ছিল। কিন্তু আমার পায়ের ছাপ তেমন একটা গভীর ছিল না, আর যমজেরা তত বাচ্চা ছিল। ওদের ওজন আমার চেয়ে অনেক কম ছিল। ওদের কি এরকম পায়ের ছাপ পড়েছিল?

খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকালাম, কঠিন বৃষ্টি হচ্ছে। আজকের চেয়ে ঐদিন যদি বেশি বৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে মেঝেও অনেক ভেজা থাকার কথা, আর মেয়েদের পায়ের ছাপ পড়ার কথা।

ইয়ুর মারা যাওয়ার দিন দুপুরের দিকে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বৃষ্টি শুরু হওয়ার একটু পরই ইয়ু ছাউনিতে গিয়েছিল। আর ইয়োরু বলেছিল ও বাড়ির ভেতরই ছিল। মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ার সময় ইয়োৰু দরজার কাছে ছিল।

যদি মোরিনোর নানি ছাউনির ভেতর ইয়োরুর পায়ের ছাপ দেখে থাকেন তাহলে আমাকে যে গল্প শোনানো হয়েছে তা পুরোপুরি মিথ্যা। যদি ইয়োরুর পায়ের ছাপ ছাউনির ভেতর দেখা গিয়ে থাকে তার অর্থ ও আগেই সেখানে গিয়েছিল আর মৃতদেহ তখন আবিস্কার করেছিল।

“আপনি যখন ইয়ুকে পেলেন, তখন কি মেঝেতে কোন পায়ের ছাপ ছিল?”

যদিও আমার মনে হচ্ছিল না মোরিনোর নানি এরকম সূক্ষ্ম কোন কিছু মনে রাখবেন কিন্তু তারপরেও জিজ্ঞেস করার জন্য করলাম।

“হ্যাঁ, ইয়ুর পায়ের ছাপ ছিল,” মোরিনোর নানি বললেন। যে বাক্সর উপর ইয়ু দাঁড়িয়েছিল সেটা উলটে একদিকে পড়েছিল। নানি যখন সেটা ঠিক করতে গেলেন তখন ছোট পায়ের ছাপ দেখেছিলেন মেঝেতে।

যাক ভালো,আমি ভাবলাম। মাটিতে ইয়ুর পায়ের ছাপ পাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।

“আপনি দেখেই বুঝতে পারলেন যে ওগুলো ইয়ুর পায়ের ছাপ?”

“মেয়ে দুটো দেখতে একই রকম, তাই আমরা ওদের আলাদা রকমের জুতো পরাতাম। ইয়োরু পড়ত কালো জুতো, ইয়ু পরত সাদা জুতো। ওদের জুতোর সোলও ভিন্ন ছিল, আর মেঝেতে যে ছাপ ছিল তা যে ইয়ুর জুতোর ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।”

ইয়ুর আঁকা ছবিটা মনে পড়ল আমার। এখন রঙহীন জুতোর অর্থ বুঝতে পারলাম। তার মানে ওগুলো ইয়ুর জুতো ছিল। ইয়ু সিলিং থেকে ঝুলছিল। ওর পা ছিল খালি, ওর সাদা জুতোগুলো মেঝেতে রাখা ছিল। অন্য অনেক আত্মহত্যাকারীদের মত জুতোগুলো পাশে গুছিয়ে রাখা ছিল।

“ইয়োরুর পায়ের কোন ছাপ ছিল না?” আমি জানতে চাইলাম, সেফ নিশ্চিত হওয়ার জন্য।

মোরিনোর নানি মাথা নাড়লেন, আমি নিজেকেই লাখি লাগালাম মনে মনে, কেন প্রশ্নটা করতে গেলাম। ইয়োর মৃতদেহ দেখার সময় ভেতরে ঢোকেনি। ওর পায়ের ছাপ না পাওয়া যাওয়ারই কথা। ছাউনিতে একজনেরই পায়ের ছাপ থাকার কথা।

“ইয়ুর বুকে বাঁধা দড়িটা কি এখনো আছে?”

মোরিনোর নানি মাথা নাড়লেন। দেখে মনে হলো তার মনে নেই। “যাইহোক, তোমার মনে হয় আজকে রাতে এখানে থেকে যাওয়াই ভালো হবে, বাইরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে।”

আমি একটু চিন্তা করে রাজি হয়ে গেলাম।

ছাউনি থেকে বেরিয়ে আমরা বাড়িতে ফিরে গেলাম। মোরিনোর নানি আমাকে কয়েকটা জায়গার কথা বললেন যেখানে ভোলার জন্য ভালো ছবি পাওয়া যাবে।

“আসা করছি কালকে আবহাওয়া ভালো থাকবে,” তিনি বললেন।

জুতো খোলার সময় জুতার বাক্সের উপর রাখা জিনিসগুলোর মধ্যে ছোট একটা প্লাস্টিকের খেলনা আমার নজর কাড়ল। হাতে নিয়ে দেখলাম। একটা ছোট ফ্লাওয়ার ব্ৰচ। চকলেটের প্যাকেটে উপহার হিসেবে যেমন থাকে, সস্তা রঙ আর ডিজাইনের।

যমজ দু-জনের কার ছিল এটা? জিনিসটা দেখে আমার আবার মনে হলো ওরা যখন ছোট ছিল তখন এখানে থাকত।

ব্রুচটা হাতে নিয়ে হলওয়ের দিকে তাকালাম। মোরিনোর নানি ততক্ষণে লিভিং রুমে চলে গিয়েছেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম।

মনে মনে কল্পনা করছিলাম পুতুলের মত দেখতে দুটো যমজ বাচ্চা মেয়ে হলওয়ে দিয়ে হেঁটে আমার দিকে আসছে। ফিসফিস করে একজন আরেকজনের কানে কিছু বলছে, কি করে মৃত সাজা যায় সে নিয়ে নতুন কোন পরিকল্পনা করছে। আমার কল্পনায় ওরা হলের শেষ মাথায় গিয়ে বাঁকে হারিয়ে গেল। জুতো খুলে রেখে আমি তাদের ফলো করার চেষ্টা করলাম। যে বাঁকে তারা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সেখানে গেলাম, অবশ্যই কেউ ছিল না সেখানে নিরব একটা অন্ধকার জায়গা, করিডোরের মলিন আলো জায়গাটা আলোকিত করতে পারেনি।

সোমবারে মোরিনো পাশ থেকে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। সে নিশ্চয়ই কৌতূহলবোধ করছিল, গ্রামে গিয়ে আমি কি কি করলাম তা জানতে চাইছিল। কিন্তু পুরো দিন আমি ওর দৃষ্টি উপেক্ষা করে গেলাম, ভান করলাম যেন খেয়ালই করিনি।

সেদিন শেষ ক্লাসের পর সব ছাত্রছাত্রি চলে না যাওয়া পর্যন্ত ওর সাথে কথা বললাম না। কয়েকজন আমাকে তাদের সাথে বাসায় যেতে বলেছিল, কিন্তু পাত্তা দেইনি-তার মানে এই না যে আমি কোন উত্তর দেইনি। আমার মন কোন কিছু চিন্তা না করেই বিশ্বাসযোগ্য অজুহাত তৈরি করতে সক্ষম। আমার কোন ধারণা নেই কি অজুহাত বানিয়েছিলাম, ওগুলো নিজে নিজে তৈরি হয়ে তাদের কাছে পৌঁছে যায়, আমাকে স্পর্শ করে না।

অবশেষে আমার ক্লাসমেটদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল, রুমের বাইরের হলে নিরবতা নেমে এল। ক্লাসে শুধু আমি আর মোরিনো ছিলাম। সে ওর সিটে কাত হয়ে বসেছিল, জাহাজ ডুবতে থাকলে যেমন দেখায়। আর পাশ থেকে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।

ধীরে-সুস্থে ওর সিটের দিকে গেলাম। জানালা থেকে তিন সারি দুরে সে বসে ছিল, পেছন থেকেও তিন সারি।

“শুনলাম তুমি নাকি গ্রামে রাতটা কাটিয়েছ। নানি ফোন করে বলল আমাকে।” ঘুমন্ত সুরে বলল মোরিনো। ওর চোখের নিচের দাগগুলোর অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে।

“উনি ভালো রাঁধুনি।”

আমি ওর সামনের সিটে বসলাম, জানালার পাশের সারিতে। বাইরে তখনো আলো ছিল। আকাশের রঙ খানিকটা হলদেটে বর্ণ ধারন করেছে। দূরে স্পোর্টস টিমের হৈচৈ এর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। রুমের আলো নেভানো ছিল, আলো যা ছিল তার পুরোটাই জানালা দিয়ে আসছে।

“তুমি এক সময় যে বাড়িতে থাকতে সেখানের কিছু কাহিনী শুনলাম।”

“যেমন?”

“যেমন তুমি আর তোমার বোন ছোট থাকতে যেসব মজা করতে। তারপর ইয়োরুকে যত বকা দেয়া হোক সে কখনোই কাঁদত না, কিন্তু ইয়ু সাথে সাথে কেঁদে ফেলত, বোনের পেছনে গিয়ে লুকাত।”

“ও সব সময় আমার উপর নির্ভর করত।”

আমরা লম্বা এক মুহূর্ত চুপ করে বসে থাকলাম। বাতাসে অদ্ভুত একটা টানটান ব্যাপার ছিল। আমি আবার ওর দিকে তাকালাম।

“মোরিনো ইয়ুর ব্যাপারে আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আমি সব খুঁটিনাটি ব্যাপার নিয়ে নিশ্চিত নই কিন্তু..”

মোরিনো আমার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে দূরে তাকাল, তারপর চোখ বন্ধ করে ফেলল। ওর চোখের গাঢ় দাগগুলোর উপর চোখের পাতাগুলো কাঁপছিল।

“আমি ধরে নিয়েছিলাম তুমি জানবে,” সে কর্কশ কন্ঠে বলল। সে জানতে চাইল কি কি জেনেছি আমি।

“ইয়ু মারা গিয়েছিল আট বছর বয়সে, এখন থেকে নয় বছর আগে, আমি বললাম। মোরিনো ওর চোখ খুলল না। “নয় বছর আগে সেই দিনে, ছাউনির ভেতর তুমি ওর দেহ ঝুলতে থাকা অবস্থায় পেয়েছিলে তারপর তোমার নানিকে গিয়ে বলেছিলে। কিন্তু তুমি আগেই জানতে যে মৃতদেহটা সেখানে ছিল। তুমি বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে কারো আসার অপেক্ষায় ছিলে যাতে তুমি অভিনয় করতে পার যে তার চোখের সামনেই তুমি মৃতদেহটা আবিস্কার করেছ।”

আমি চুপ করলাম, ওর প্রতিক্রিয়া খেয়াল করছিলাম। সে এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল তারপর বলল আর কিছু বলার আছে কিনা।

“তুমি এর আগেই জানতে যে তোমার বোন মৃত। কিন্তু তুমি অভিনয় করছিলে, সত্য লুকাতে চাইছিলে। আমি চিন্তা করে বের করার চেষ্টা করছিলাম কেন তুমি এরকম কিছু একটা করতে পার। তারপর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, তোমার বোনের মৃত্যুর সাথে তোমার কোনভাবে সম্পর্ক ছিল।”

মোরিনো মাথা ঝাঁকাল।

আমি বলে চললাম, “ইয়ু সিলিঙের বিম থেকে দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। একটা ছিল ওর গলায় প্যাঁচানো, আরেকটা বুকে, যাতে শরীরের ভার নিতে পারে।”

আট বছর বয়সি মেয়েটা কাঠের বাক্সের উপর থেকে লাফ দিয়েছিল। এক মুহূর্তের জন্য হয়তো মনে হচ্ছিল যে ও গলার দড়িটা দিয়ে ঝুলছে। কিন্তু আসলে সে তার বুকের দড়িটা দিয়ে ঝুলছিল যাতে পড়ে না যায়।

এরপর আরেকজন মেয়ে এল, যার চেহারাও একই রকম। সেই মেয়েটা দেয়ালের পাশ থেকে একটা কাঁচি তুলে নিল। তারপর ঝুলতে থাকা মেয়েটার কাছে গিয়ে বুকের সাথে দড়িটা কেটে দিল।

দড়িটা কেটে ফেলায়, মেয়েটা শুধু গলার দড়িটা দিয়ে ঝুলছিল।

“তুমি ওকে খুন করেছিলে।”

মোরিনো অল্প খানিকটা চোখ খুলল, আমার দিকে তাকাচ্ছিল না কোন কিছুর দিকেই তাকাচ্ছিল না।

“পায়ের ছাপের কথা কিছু শুনোনি? ছাউনির কোথাও আমার পায়ের ছাপ ছিল না।”

আমি কল্পনা করলাম মেয়েটা খালি পায়ে ঝুলে আছে। বৃষ্টিতে মাটি ভিজে নরম হয়ে ছিল।

“না, ছাউনির সবখানে তোমার পায়ের ছাপ ছিল। কিন্তু কেউ সত্যটা বুঝতে পারেনি। দড়ি কেটে ওকে খুন করার পর তুমি মাটিতে সবখানে তোমার পায়ের ছাপ দেখতে পেলে। আর তুমি বুঝতে পারলে যে কেউ ওগুলো দেখলে সন্দেহ জাগবেই। সুতরাং তোমাকে কিছু একটা করতেহবে..”

মোরিনো ঝুলন্ত লাশ আর মাটিতে পায়ের ছাপ দেখে বুঝল ঝামেলায় পড়ে গিয়েছে। তারপর সে দেখল জুতোগুলো মাটিতে সাজিয়ে রাখা। তখন সে একটা বুদ্ধি বের করল।

সে নিজের জুতো জোড়া খুলে, একটা বাক্সর উপর উঠে গেল। খেয়াল রাখল যেন নতুন করে কোন পায়ের ছাপ পড়ে। তারপর ঝুলন্ত লাশের নিচে রাখা জুতোজোড়া নিয়ে পড়ল, আর নিজেরগুলো সে জায়গায় রেখে দিল।

এখন পায়ের ছাপগুলো মৃত মেয়েটার হয়ে গেল।

“তারপর তোমার একমাত্র কাজ ছিল কুকুরের দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। ঐ জায়গার মাটি তখনো শুকনো ছিল, তাই কোন ছাপ পড়েনি মাটিতে।”

অবশেষে মোরিনো ওর চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল। “কিন্তু আমার মোটিভ কি?”

“ঘৃণা।” আমি বললাম।

মোরিনোকে খুবই দুঃখি দেখাল। “তুমি যখন বললে ‘মোরিনো ইয়ুর ব্যাপারে আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছি,’ আমি বুঝতে পেরেছিলাম ধরা পড়ে গিয়েছি।”

আমি মাথা ঝাঁকালাম।

ব্যাপারটা আমাকে হতবাক করেছিল-কেন ওর নানি এত নিশ্চিত ছিলেন যে সামনে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা ইয়োরু ছিল? ওরা তো যমজ, একদম একইরকম দেখতে-কেউ আলাদা করে চিনতে পারত না ওদেরকে।

কিন্তু ও যদি কালো জুতা পড়ে থাকে তাহলে সন্দেহ করার কোন সুযোগ ছিল না।

“এই নয় বছর নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট করে লুকিয়ে রাখতে হয়েছে যে তুমি আসলে মোরিনো ইয়ু।”

মোরিনো আসলে মোরিনো ইয়োরু না, ও হল মোরিনো ইয়ু।

***

একদল মেয়ে হল দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল।

মোরিনো ইয় চুপ করে তাদের হাসাহাসি শুনল কিছুক্ষনের জন্য, ওদের কণ্ঠস্বর কমে কমে আবার নিরব হয়ে যাওয়া পর্যন্ত।

“তুমি ঠিকই ধরেছ,” সে বলল। “আমিই ছোট বোনটা। আমিই সবসময় কান্নাকাটি করতাম, আমার উপরই সব আদেশ করা হতো।” তারপর ভুরু কুঁচকে আমাকে প্রশ্ন করল। কিন্তু তুমি কিভাবে জানলে?”

“ইয়ু জানত না, লোকজন আত্মহত্যা করার আগে জুতো খুলে নেয়। ঐ ব্যাপারটাই সবকিছু পরিস্কার করে দিয়েছে। তোমরা যখন আত্মহত্যা আত্মহত্যা খেলতে তখন হয়তো ইয়োরু তোমাকে বলেছিল কিন্তু আমার ধারণা তুমি ভুলে গিয়েছিলে।”

আমি ওকে বললাম ওদের বাড়িতে যেসব ড্রয়িং দেখেছি। যে ড্রয়িংগুলোতে তারা নিজেদের আত্মহত্যা খেলার ছবি এঁকেছিল।

“ঐ ডুয়িংগুলো করা হয়েছিল নয় বছর আগের গ্রীষ্মের ছুটির সময়, ইয়োরুর মৃত্যুর ঠিক আগে আগে। তার মানে হলো ড্রয়িংগুলো ঐ সময়ে, মৃত্যুর আগে ইয়োরুর ব্যক্তিত্ব কেমন ছিল তাও তুলে ধরে।”

ইয়োরু আর ইয়ু একই জিনিস এঁকেছিল, কিন্তু তারপরেও ওদের আঁকার মধ্যে কিছু পার্থক্য ছিল। ইয়ুর আঁকা ছবিতে, দুই মেয়েই জুতো পড়েছিল। কিন্তু ইয়োরুর ছবিতে দুই মেয়েরই পুরো পা রঙ করা ছিল। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম ইয়ু বোধহয় ডিটেইলিং বেশি করেছে, কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত বদলেছি।

আমার মনে হতে লাগল ইয়োরুই আসলে ঠিক মত এঁকেছে, তার স্মৃতি থেকে। ইয়ুর ছবিতে সূর্য ছিল, কিন্তু ইয়োরুর ছবিতে ছিল ধূসর ব্যাকগ্রাউন্ড-আরেকটা সূত্র। বাস স্টপে বসে সেদিন মোরিনো আমাকে তাদের আত্মহত্যা খেলার কথা যখন বলেছিল, তখন বলেছিল দিনটা ছিল বৃষ্টির দিন। ব্যাপারটা এমন না যে ইয়োৰু জুতো আঁকতে ভুলে গিয়েছিল-আসলে তারা দুজনেই খালি পায়ে ছিল।

“তুমি নিজেই বাস স্টপে বলেছিলে যে তুমি মৃত্যু সম্পর্কে ইয়ুর চেয়ে বেশি জানো, তুমি ওর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর ছিলে। তুমি ইয়োরু হিসেবে বলেছিলে কথাটা, তার মানে একজন শিশু হলেও ইয়োৰু নিশ্চয়ই এই অদ্ভুত নিয়ম জানত যে লোকজন আত্মহত্যা করার আগে তাদের জুতো খুলে নেয়।”

যমজ দু-জন যখন আত্মহত্যা আত্মহত্যা খেলেছিল তখন নিশ্চয়ই তাদের জুতো খুলে পাশে রেখে দিয়েছিল। ইয়োরু জানত তাই তোমাকে তাই করতে বলেছিল। ওর জ্ঞান ওর ড্রয়িঙে প্রতিফলিত হয়েছিল।

কিন্তু ইয়ুর ক্ষেত্রে তা হয়নি। খেলার সময় ইয়ু জুতো খুললেও পরে ভুলে গিয়েছিল। কারণ ও এই অদ্ভুত নিয়মের কথা জানত না। যে কারনে ওর ড্রয়িঙে জুতো পরে আত্মহত্যা আঁকা ছিল।

অথচ ছাউনির লাশটা খালি পায়ে ছিল। ইয়ু যদি খেলতে খেলতে দুর্ঘটনাবশত আত্মহত্যা করে ফেলে তাহলে তার পায়ে জুতো থাকার কথা।

ইয়ু চুপ করে শুনছিল, তারপর ওর ঠোঁটজোড়া অল্প খানিকটা ফাঁকা হলো কথা বলার জন্য। আমার কালো জুতো পরা বোন মারা গিয়েছিল। হয়তো আমি ওকে একটু আধটু ঘৃণা করতাম ঠিকই। কিন্তু তোমার অনুমান পুরোপুরি সঠিক নয়।” ওর স্বর একদম শান্ত ছিল। “তুমি ওর বুকে জড়ানো দড়িটা দেখনি তাই না? আমি কাটিনি, ওটা নিজেই ছিঁড়ে গিয়েছিল।”

সেদিন দুপুরে, ওর বড় বোন ইয়োরু প্রস্তাব দিল তারা আত্মহত্যা করার ভান করে সবাইকে চমকে দেবে।

ইয়ু রাজি হলো। তারা যেই ছাউনিতে কাজ শুরু করল তখনই বৃষ্টি শুরু হলো।

কুকুরটা তখনো বেঁচে ছিল। অবাক হয়ে ওদের কাজ কারবার দেখছিল।

“আমার বোন বাক্সগুলো জড়ো করল, বিম থেকে দড়ি লাগাল। আমি নিচে ছিলাম, খেয়াল রাখছিলাম বাক্সগুলো যাতে নড়াচড়া করে পড়ে না যায়।”

বৃষ্টিতে মেঝে নরম হওয়ার আগেই ইয়োৰু বাক্সগুলোর উপরে ছিল, তাই মাটিতে ওর পায়ের কোন ছাপ ছিল না।

ইয়োৰু একা আত্মহত্যার ভান করবে, আর ইয়ুর কাজ ছিল কাউকে সেখানে দেখাতে নিয়ে যাওয়া। ওদের প্রস্তুতি চলছিল, ইয়োরু দুটো দড়িই জায়গামত বেঁধে ফেলল।

“তারপর আমার বোন লাফ দিল।

ইয়োরু লাথি দিয়ে বাক্সগুলো সরিয়ে দিয়ে পড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য দেখে মনে হচ্ছিল যে ও গলা থেকেই ঝুলছে, যদিও ও আসলে বুকের সাথে লাগানো দড়ি থেকে ঝুলছিল।

সে নিচে ইয়ুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল। “লোকজনকে বোকা বানানোর সময় ও সবসময় একটু মুচকি দিয়ে হাসত। বাসার কারো সাথে কথা বলার সময় কোন অভিব্যক্তি দেখাত না, শুধু কাউকে বোকা বানানোর সময় মনে হত ও আনন্দ পেত।”

কিন্তু এক মুহূর্ত পর ওর বুকের দড়িটা ছিঁড়ে গেল।

“আমি কিছুই করিনি। দড়িটা আমার বোনের ভার সহ্য করার মত শক্ত ছিল না। সিলিঙের কাছ থেকে ছিঁড়ে গিয়েছিল। তুমি যদি দড়িটা দেখতে তাহলে ঠিকভাবে অনুমানটা করতে পারতে। ওটা এত উঁচুতে ছিঁড়েছিল যেখানে আমার পক্ষে কাটা সম্ভব ছিল না।”

ইয়োরু এক মুহূর্ত সেখানে ঝুলে থাকল।

“আমি দ্রুত সাহায্য করতে চেষ্টা করলাম। আমি আমার হাত দিয়ে ওর শরীর জড়িয়ে ওকে উঁচু করে ধরার চেষ্টা করলাম। ওকে শূন্যে ধরে রেখেছিলাম, চেষ্টা করছিলাম যেন ঝুলে না পড়ে।”

ছাউনির ভেতর একটা মেয়ে সিলিং থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে, আরেকজন হুবহু একইরকম দেখতে একটা মেয়ে তাকে ধরে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। ঝুলন্ত মেয়েটা ধস্তাধস্তি করছিল, ওর পা বাতাসে লাখি ছুঁড়ছিল। পাশে বাঁধা কুকুরটা ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করছিল। মেয়েটার সংগ্রাম আর কুকুরের চিৎকার একসাথে ছোট ঘরটায় কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সময় অনন্তকালের জন্য এক জায়গায় এসে থেমে গিয়েছে।

“আমি আমার বোনকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করেছিলাম। আমার গায়ে তেমন একটা শক্তি ছিল না কিন্তু তারপরেও আমি ওকে তুলে ধরে রেখেছিলাম। ও চিৎকার করছিল, ওর লাথি ছুটে এসে আমার গায়ে লাগছিল।”

মোরিনো ওর চেয়ারে বাঁকা হয়ে বসল। রুমের অন্যপাশের দেয়ালের দিকে তাকিয়েছিল, যেন সেদিনের সব দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। স্মৃতিগুলো ওর কাছে এখন দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।

ইয়ু ছেড়ে দিলে ওর বোন পড়ে যাবে আর গলায় দড়ি শক্ত করে বসে যাবে।

ইয়োরুর চোখ আতংকে বেরিয়ে আসছিল, বোনকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করছিল-কিন্তু ওর চিৎকারে কোন উৎসাহ ছিল না।

“ও বলছিল, ‘ভাল করে ধর, শক্ত করে ধর গাধা কোথাকার..” মোরিনো চোখ চেপে বন্ধ করে ছিল, আবেগ আটকানোর চেষ্টা করছিল। “এটা যখন আমার কানে গেল আমি ওকে ছেড়ে দিলাম, আর বাঁচানোর চেষ্টা করলাম না।”

ইয়োরুর দেহ ঝুলে পড়ল।

মাটি থেকে একটু উপরে ওর পা থেমে গেল। ইয়োক জুতো পড়ে ছিল না, খালি পায়ে ছিল। ওর পায়ের আঙুলগুলো ছড়িয়ে গিয়ে পেশিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। কুকুরটা গলা ছেড়ে চিৎকার করতে থাকলে সেই শব্দে ইয়ুর কান ব্যথা করছিল। এই খিচুনির দৃশ্য আর কুকুরের চিৎকার ওর মনের গভীরে গেঁথে যায়।

“অবশেষে এক সময় ওর দেহ নিস্তেজ হয়ে আসে, পা নড়াচড়া থামিয়ে দিল।”

ইয়ু পেছনে যেতে গিয়ে টের পেল মাটি ওর জুতো টেনে ধরেছে। পায়ের ছাপ পড়ল মেঝেতে।

“শুধু আমার একার ওজন হলে হয়তো কোন ছাপ পড়ত না।” ওর বোনের জুতো জোড়া পাশেই মাটিতে রাখা ছিল।

“ওগুলো চোখে পড়তেই আমি ঠিক করলাম সবার কাছে মিথ্যা বলব। আমার সব স্পষ্ট মনে আছে…ছোট ছাউনিটাতে…আমার বোনের মৃতদেহ হালকা দুলছিল, ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত।”

ছোট মেয়েটার ছোট মাথাটা দ্রুত চিন্তা করল আর নিজের সামনে একটা রাস্তা দেখতে পেল। নিজের সাদা জুতো খুলে কালো জুতো জোড়া পড়ল। তারপর জায়গা মত রেখে দিল। তারপর শুকনো মাটির উপর দিয়ে হেঁটে কুকুরের গর্ত দিয়ে বেরিয়ে গেল। কালো জুতোর কারনে সবাই ওকে ইয়োরু বলে ধরে নিল। যে কারনে ও নিজেকে ইয়োৰু পরিচয় দিতে লাগল আর ইয়োরুর মত ব্যবহার করতে লাগল।

“আমি আগের মত আর হাসতে পারতাম না। আমার বোনের মত শ্য মুখ করে রাখতে হত আমাকে। আমরা সবসময় একসাথে থাকতাম বলে ও কেমন ছিল তা আমার ভালো মত জানা ছিল। সহজেই ওর মত অভিনয় করতে পারতাম। গত নয় বছরে কেউ সন্দেহ করেনি যে আমি ইয়।”

সে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

আট বছর বয়সে সে নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখল। জীবনের বেশিরভাগ সময় ওর নিজের আসল নাম ছাড়াই পার হয়ে গেল। কেউ জানতে পারল না ওর ভেতরে কি চলছিল, অনুভূতিগুলো পুঞ্জিভুত হয়ে একসময় ফেটে বেরিয়ে এল। ও নিজের হাত কেটে ফেলল…আর এ সবকিছু ঘটল ওর বোনের কারনে, আর বোনের সাথে চাপা দেয়া ওর নামটার কারনে। বাচ্চা মেয়েটা যে পথ বেছে নিয়েছিল, যার উপর ওর জীবন নির্ভর করছিল, তা ছিল কষ্ট আর একাকিত্বে ভরপুর।

জানালা দিয়ে আসা আলো কমে আসছে, সোনালি দেখাচ্ছে। মলিন হলুদ পর্দাগুলো অর্ধেক টানা থাকায় সূর্যের আলো কমে গিয়েছে। মাঠ থেকে আসা বেজবল প্র্যাকটিসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি, বাতাসে প্রতিধ্বনি তুলছে। শূন্য ক্লাসরুমের ঘড়িটা নিরবে টিকটিক করে যাচ্ছে।

একসময় মোরিনো ওর মুখ খুলল, যদিও নিশ্চিত ছিল না কি বলবে। “তোমার কি মনে আছে আমাদের কোথায় আর কিভাবে প্রথম দেখা হয়েছিল?”

আমার বিশ্বাস সেটা এই ক্লাসরুমেই হয়েছিল, হাই স্কুলের সেকেন্ড ইয়ারের শুরুতে। শুনে ও একটু আশাহত হলো মনে হয়।

“হয়নি, জুনিয়র হাই তে থাকতে। তোমাকে মিউজিয়ামে দেখেছিলাম আমি, একটা মানবদেহের টুকরো অংশগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখছিলে। তারপরের বসন্তে যখন আমরা হাই স্কুলে উঠলাম তখন তোমাকে দেখলাম লাইব্রেরিতে বসে ময়নাতদন্তের উপর একটা মেডিক্যাল বই পড়ছ। দেখা মাত্র তোমাকে চিনেছিলাম আমি।”

সেকারনেই সে জানত আমি ক্লাসে অভিনয় করছি সবার সাথে। এখন বুঝতে পারলাম। আমরা একজন আরেকজনের লুকিয়ে রাখা রূপ ঠিকই ধরতে পেরেছি, আর কেউ না পারলেও।

“আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তুমি যখন ইয়ু ছিলে তখন আসলেই হাসতে।”

“আসলেই। একসময় আমি ওরকম ছিলাম। কিন্তু ছাউনি থেকে বেরিয়ে আসার পর ভাবলাম যদি আমি হেসে ফেলি তাহলে লোকজন বুঝে ফেলবে আমি ইয়। নয় বছর আমি চেষ্টা করেছি কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ না করতে, আমার বোনে পরিণত হতে। আর এখন আমি হাসতে পারি না, চেষ্টা করলেও পারব না।”

ওকে খানিকটা হতাশ দেখাল। আমার থেকে অন্যদিকে তাকিয়ে সে বলল, “আমি ভেবেছিলাম তুমিই প্রথম আমাকে আমার নাম ধরে ডাকবে।”

আমি উঠে দাঁড়ালাম। “তোমার জন্য আমার কাছে একটা জিনিস আছে, গ্রাম থেকে ফেরার সময় আমি এটা তোমার বাড়ি থেকে সাথে করে নিয়ে এসেছি।”

ডেস্কের উপর রাখা আমার ব্যাগ থেকে জিনিসটা বের করলাম। “কি জিনিস?” না দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল সে

“যে দড়িটা তুমি খুঁজছিলে। আমার ধারণা এটা নিখুঁতভাবে মিলে যাবে, চোখ বন্ধ কর-আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।”

মোরিনো তখনও বসে ছিল, চোখ বন্ধ করল। আমি ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওর ছোট কাঁধগুলো শক্ত হয়ে গেল, টেনশনে।

আমি লাল দড়িটা ওর গলায় পেচালাম। দড়িটা নোংরা হয়ে ছিল। ছাউনির ভেতর ছিল এটা, যেখানে কুকুরটা বাঁধা থাকত।

“আমি এখন এও জানি কেন তুমি এত কুকুর ঘৃণা কর।”

আমি আস্তে করে দড়িটা টাইট করলাম।

চাপ বাড়তে ওর কাঁধ কেঁপে উঠল। এক মুহূর্ত আমি থেমে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর গেরোটা দিয়ে ছেড়ে দিলাম। দড়ির বাকি অংশ ওর কাঁধে ঝুলতে থাকল।

“হ্যাঁ…এটাই দরকার ছিল..” সে শ্বাস ছাড়ল। সেই সাথে সমস্ত টেনশন যেন ওর ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল। ওর ভেতরটা যেন হালকা হয়ে গেল।

কুকুরের দড়িটা থেকে ইয়োরু মারা গিয়েছিল, মোরিনোর স্মৃতির গভীরে সেই তথ্য কোথাও লুকিয়ে ছিল। সে কখনো বুঝতে পারেনি যেই দড়িটা সে খুঁজছিল তা ওর বোনকে খুন করার জন্য দায়ি ছিল।

“আমি কখনো আমার বোনকে ঘণা করিনি। সে অনেক সময়ই অনেক জঘন্য কাজ করেছে, কিন্তু ওর জায়গা কখনো আর কেউ নিতে পারবে না…”

আমি আমার ব্যাগটা তুলে নিয়ে বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। ওর সিটের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একবারের জন্য ঘুরে ওর দিকে তাকালাম। ও ওর চেয়ারে বসেছে। পা সামনে ছড়ানো। হাত দুটো বুকের উপর রাখা। লাল দড়িটা গলা থেকে পিঠের উপর ঝুলছে।

ওর চোখ বন্ধ। ওর গাল সূর্যাস্তের আলোয় ঝলমল করছে, মনে হচ্ছে যেন আলো দিয়ে তৈরি।

এক বিন্দু অশ্রু ওর গাল বেয়ে নেমে ইউনিফর্মের উপর পড়ল।

ওকে সেখানে একা রেখে ক্লাসরুমের দরজা নিঃশব্দে বন্ধ করে বেরিয়ে গেলাম আমি।

৫. সমাধি

সমাধি

কৌসুকি ডাকছিল সেইকিকে। বাচ্চা ছেলেটা সবসময়ই নিষ্পাপ আর হাসিখুশি ধরনের। কিন্তু আজকে ওর গলা বিষণ্ণ শোনাল। কৌসুকি হলো পাশের বাসার ছোট ছেলেটা, যে কিনা সবেমাত্র কিন্ডারগার্টেনে ঢুকেছে।

“কি হয়েছে?”

সেইকি ওর বাগানে ছিল, মর্নিং গ্লোরির চারাতে নিড়ানি দিচ্ছিল। গ্রীষ্মের সময়, ভোরবেলা। বাগানের ভেতর হালকা একটা কুয়াশার মত ভেসে বেড়াচ্ছে, যে কারনে সবকিছু চকচক করছে। গ্রপ এক্সারসাইজের জন্য ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে ওর বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দেয়ালের কারনে সেইকি ওদের দেখতে পাচ্ছে না। দেয়ালটা ওর বুক পর্যন্ত উঁচু। কিন্তু ওদের পায়ের শব্দ আর হৈচৈ ওর কানে আসছে।

“আব্বু কি এখনো রেগে আছে?” কৌসুকি গত রাতে সেইকির বাসায় এসে হাজির হয়েছিল। কাঁদছিল ছেলেটা। এরপর আর বাসায় ফিরে যায়নি।

সেইকি যখন ওকে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে, কৌসুকি কাঁদতে কাঁদতে বলল ওর বাবার পুরস্কার জেতা একটা অ্যান্টিক ওর ধাক্কা লেগে ভেঙে গেল। কৌসুকিকে হাজারবার সাবধান করা হয়েছে যেন কোন অ্যান্টিকে হাত না দেয়, কিন্তু ও নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারেনি।

“না, আমার মনে হয় না সে আর তোমার উপর রেগে আছে।”

সেইকি ছেলেটাকে বলল কিভাবে ওর বাবা-মা গতরাতে ওকে খুঁজতে এসেছিল। সেইকি ওর দরজায় তাদের সাথে দেখা করে। তারা জানতে চায় সে কৌসুকিকে দেখেছে কিনা। ওদেরকে অনেক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল। সেইকি মাথা নাড়ল, এমন ভান করল যেন কিছু জানে না। তারপর সেইকিকে খুঁজতে ওদেরকে সাহায্য করল।

“সত্যি রেগে নেই তো?”

“সত্যি।”

সেইকির সামনে মাটিতে গেঁথে রাখা বাঁশের খুঁটির সাথে মর্নিং গ্লোরির চারা পেঁচিয়ে ছিল। বাঁশের খুঁটিটা শুকিয়ে বাদামি রঙের হয়ে গিয়েছিল।

সেইকি থাকত একটা পুরনো বাড়িতে। বাড়ির সাথে একটা বড় বাগান। বাগানটা আশেপাশের সবার বাড়ির চেয়ে বড়। জমিটা দেখতে প্রায় বর্গাকৃতির। বাড়ি আর গ্যারেজটা পুব দিকে। বাকি জমিটা পুরো খালি ছিল। সেইকি খালি জায়গাটা গাছ লাগিয়ে ভর্তি করে ফেলেছে। গ্রীষ্মে মাঝে মাঝে, যেমন আজকে, মাটি পাতা দিয়ে ঢেকে রাখা আছে।

বাগান করতে সেইকির সবসময়ই ভালো লাগে। ছোট থেকেই ভালো লাগত। বাগানের পুরো দেয়াল সে মর্নিং গ্লোরি লাগিয়ে ঢেকে ফেলেছে।

সেদিন আকাশ ছিল পরিস্কার। মেঘশূন্য আকাশে বরাবরের মত সূর্য উঠল। দেয়াল আর গাছগুলোর ভেতর দিয়ে পিছলে ঢুকে গেছে সূর্যালোক। বাঁশের খুঁটিগুলো আর মর্নিং গ্লোরি মাটিতে লম্বা ছায়া ফেলেছে।

ও শুনতে পাচ্ছিল কৌসুকি কাঁদছে।

আগের রাতে কৌসুকি যখন ওর দরজায় এসে নক করে সেইকিকে অনুরোধ করল ওকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে। সেইকি ওকে বাসার ভেতর ঢুকতে দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ দেখছে কিনা।

“তুমি নিশ্চিত কাউকে বলনি যে এখানে এসেছ?” সেইকি আবার জিজ্ঞেস করল। ছেলেটা চোখ মুছতে মুছতে মাথা ঝাঁকাল। একটা বাচ্চা ছেলের কথায় কতখানি ভরসা করা যায়? অবশ্য ব্যাপারটা নিয়ে এখন আর কোন চিন্তা করার কোন মানে হয় না বলে সেইকির কাছে মনে হলো।

আগে যখন ও কৌসুকির সাথে ঝিঁঝি পোকা ধরত কিংবা ওকে কার্ড বোর্ড বক্স নিয়ে খেলতে দেখত, তখন সেইকির মাথায় একটা চিন্তা উঁকি দিতে শুরু করেছিল। একটা ফ্যান্টাসি যেটাকে প্রশ্রয় দেয়া সম্ভব নয়। এরকম ভয়াবহ কিছু চিন্তা করার জন্য সে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছিল। কিন্তু গতকাল তার মাথা ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল, ঠিক মত কাজ করছিল না…

“তোমার কি মনে হয় আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত?”

ওর জন্য বুকের ভেতর কষ্ট হতে লাগল সেইকির। সে একাই বাস করে। অনেক আগেই মারা গেছে ওর পরিবারের সবাই, তাই ও কৌসুকিকে সবসময় নিজের ছোট ভাইয়ের মতই দেখত। কৌসুকির পরিবার যখন বাইরে কোথাও গিয়েছে তখন সে ওর জন্য বেবিসিট করেছে। দু-জনে একসাথে ঘোরাঘুরি করেছে। সেইকি নিশ্চিত ছিল যে ও কৌসুকিকে ওর বাবা-মায়ের মতই ভালোবাসত। তাহলে কেন সে এরকম কিছু করতে গেল? এখন অবশ্য ফিরে আসার আর কোন উপায় নেই।

“তুমি আর বাসায় ফিরে যেতে পারবে না, কৌ,” বলতে গিয়ে সেইকির গলা কাঁপছিল। ওর বাগানের মর্নিং গ্লোরিগুলো একটা বাঁশের খুঁটি জড়িয়ে বেড়ে উঠেছে। দুটো বাঁশের খুঁটি অন্য খুঁটিগুলোর চেয়ে খানিকটা লম্বা।

কৌসুকির গলাও কাঁপছে। সে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। বাসায় ফিরতে পারব না কেন?”

মাটিতে পুঁতে রাখা বাঁশের খুঁটি থেকে ওর গলা ভেসে এল। খুঁটিটার ভেতরটা ফাঁপা। যে কারনে মাটির নিচে পুঁতে রাখা কফিন থেকে শব্দ খুঁটির ভেতর দিয়ে এসে সেইকির কানে পৌঁছাতে পারছে। কৌসুকি জানত না যে ওকে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছে। কি দুঃখজনক ব্যাপার!

আগেরদিন যখন কৌসুকি ওর বাসায় এল, সেইকি তখন মনস্থির করে ফেলেছিল। সে ছেলেটাকে পেছনের একটা রুমে নিয়ে গিয়ে একটা বাক্স দেখিয়ে বলল, “বাক্সটার মধ্যে গিয়ে লুকিয়ে থাক।” রুমের মাঝামাঝি একটা বাক্স রাখা ছিল। কৌসুকির জন্য যথেষ্ট বড়, সহজেই ওটার ভেতর ঢুকে শুয়ে থাকতে পারবে।

কৌসুকি প্রায় সবসমই সেইকি যেরকম বলে সেরকমই করার চেষ্টা করে। তাছাড়া সে ওর বাবার ক্রোধ নিয়ে ভীত ছিল, সুতরাং কোন সন্দেহ না করেই বাক্সের ভেতর ঢুকে গেল।

সেইকি বাক্সের ঢাকনা বসিয়ে পেরেক মেরে আটকে দিল। কফিনে বাতাস চলাচলের জন্য দুটো ফুটো ছিল। একটা কৌসুকির মাথার কাছে আরেকটা পায়ের কাছে। যে কারনে ঢাকনা লাগিয়ে দিলেও ছেলেটা নিঃশ্বাস নিতে পারছিল।

কৌসুকির কফিন রুমে রেখে ও বাইরে বাগানে গেল। পোর্চের বিপরীতে দেয়ালের সামনে একটা গর্ত খোঁড়া ছিল। কৌসুকির কফিনটাকে মাটি চাপা দেয়ার জন্য ওকে শুধু গর্তটা একটু বড় করতে হবে।

গর্ত করা হলে সে রুমে ফিরে গিয়ে কফিনটা বয়ে নিয়ে এল। কৌসুকিকে বলল সে ওকে এমন এক জায়গায় লুকিয়ে রাখছে যেখানে ওর বাবা কখনো খুঁজে পাবে না। কফিনটাকে পোর্চ থেকে বাগানে নিয়ে যেতে ঘাম ছুটে গেলেও কাজটা হলো। আস্তে করে সেইকি কফিনটাকে গর্তে নামিয়ে দিল।

ফাঁপা বাঁশের খুঁটিগুলোকে সে কফিনের গর্তে ঢুকিয়ে দিল। তারপর মাটি ঢেলে কৌসুকিকে পুরোপুরি কবর দিয়ে দিল।

খালি জায়গার মধ্যে দুটো বাঁশ দাঁড়িয়ে আছে দেখতে অদ্ভুত আর সন্দেহজনক লাগতে পারে ভেবে সেইকি অন্য জায়গা থেকে কয়েকটা মর্নিং গ্লোরির চারা তুলে এনে ওখানে লাগালো। মর্নিং গ্লোরিগুলো সাবধানে খুঁটির সাথে পেঁচিয়ে দিল যেন দেখে মনে হয় বাঁশগুলো ঐ চারাগুলোর জন্যই ওখানে পোঁতা হয়েছে।

“কী বলছ এসব? আমি বাসায় যেতে চাই!” বাঁশের খুঁটি কেঁদে উঠল।

বেচারী কৌসকি, জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছে ওকে, সেইকি ভাবল। বাঁশের খুঁটির চারপাশে মাটি দিয়ে শক্ত করে দিল যেন সোজা হয়ে থাকে।

ওর সমস্যাটা কি? এই বাচ্চা ছেলেটাকে তো ও ভালবাসত। ও একবার দেখেছিল কৌসুকি একটা গাড়ির নিচে প্রায় চাপা পড়তে যাচ্ছিল। ছেলেটা একটা বলের পেছনে দৌড়াচ্ছিল, গাড়িটাকে আসতে দেখেনি। গাড়িটা শেষ মুহূর্তে ব্রেক কষায় ও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। উত্তেজনায় ওর পা কাঁপছিল তখন। আর এখন সেই ছেলেকে ও কিভাবে জ্যান্ত কবর দিতে পারল?

সেইকি এই বাড়িতেই বড় হয়েছে। প্রথমে ওর বাবা-মা আর দাদি এ বাড়িতে বাস করত। বেশিরভাগ সময়ই ওর বাবা-মা কাজের জন্য বাইরে থাকত, যে কারনে ওর পুরো সময় কাটত ওর দাদির সাথে। অন্য ছেলেমেয়েরা যখন বাস্কেটবল খেলা নিয়ে ব্যস্ত কিংবা মডেল বানাচ্ছে, সেখানে সেইকি দাদির সাথে বাগান করায় ব্যস্ত থাকত। টবগুলো কালো মাটি দিয়ে ভরাট করা, তার ভেতরে ফুলের বীজ বপন করা। সেইকির ক্লাসমেটরা এই নিয়ে প্রায়ই হাসাহাসি করত, ওকে মেয়ে বলে ক্ষ্যাপাত। সেইকি ছিল দূর্বল, শুকনো ধরনের। অপরিচিত লোকজন ওকে দেখে মেয়ে ভেবে ভুল করত। অবশ্যই সেটা ওর গায়ে লাগত। কিন্তু যখন ও ওর দাদির সাথে থাকত, ফুলগাছে পানি দিত, তিনি সবসময় ওকে লক্ষ্মী ছেলে বলতেন। কখনো মন খারাপ হলে ও ওর দাদির বলা কথাগুলো মনে করত, আর নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করত যে ওকে অবশ্যই একটা সুন্দর জীবন যাপন করতে হবে, দাদির সম্মান ধরে রাখতে হবে। কিন্তু এরপর কোনভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাউকে জ্যান্ত কবর দেয়ার ফ্যান্টাসি ওকে দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে।

বাগানে পানি দিতে ওর ভালো লাগত, উজ্জ্বল পরিস্কার দিনগুলোতে এক হাতে হোস পাইপ নিয়ে আরেক হাতের আঙুল মুখে ঢুকিয়ে বাগানে পানি দিত। হাতের চাপে পানি ছিটকে যেত বহুদুর। গাছের উপর গিয়ে পড়া পানি সূর্যের আলোয় চিকচিক করত। সেটা যখন ওর চোখে পড়ত কিংবা যখন ওর দাদি হাসতেন, তখন ওর অনেক আনন্দ হতো, মনে হত যেন চারপাশের আলোর উজ্জলতা আরো বেড়ে গিয়েছে।

আবার একই সাথে, ওর ভেতরে কোথাও একটা অন্ধকার জায়গা লুকিয়ে ছিল, যেখানে সেই আলো পৌঁছাতে পারত না। ওর দাদিকে বাক্সে ভরে মাটিতে কবর দেয়ার চিন্তা ওর মাথায় আসত। প্রতিবার চিন্তাটা মাথায় আসতেই ও আতঙ্কে কেঁপে উঠত।

কিভাবে এরকম জঘন্য কোন কিছু ও চিন্তা করতে পারল? এমন সময়ও ছিল যখন ও ওর দাদির দিকে তাকাতেও পারত না। মনে হত তিনি হয়তো ওর চিন্তা ধরে ফেলবেন।

এমন কি হতে পারে যে ওর ভেতরে কোথাও কোন গভীর ক্ষত লুকিয়ে ছিল যা ওকে এরকম বানিয়েছে? সেরকম কিছু ও চিন্তা করে পেল না, কিংবা থাকলেও হয়তো ভুলে গিয়েছে। কিংবা-যেটা ওর সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে ভাবতে-হয়তো ও জন্ম থেকেই এরকম।

বড় হওয়ার কয়েকবছর পর সেইকির বাবা-মা আর দাদি রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। ও তখন অফিসে ছিল।

এর আগ পর্যন্ত ওর বাসাকে ঘিরেই ওর পরিবার ছিল, তাদের সাথে ওর যোগাযোগ সবসময় ওকে সমাজে ওর অবস্থানের কথা মনে করিয়ে দিত। কিন্তু এক্সিডেন্টের পর পুরো বাড়িতে ও একা হয়ে পড়ল, ওর ফ্যান্টাসি আটকিয়ে রাখার মত কোন কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। প্রতিদিন সে কাজে যেত, কাজ থেকে বাসায় ফিরত; বাসায় কথা বলার কেউ ছিল না, একই জিনিস নিয়ে ও বার বার চিন্তা করত, সেই ছোট বেলা থেকে যে জিনিসগুলো ওর মাথায় ঢুকে আছে। ও সেগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টাও করেছে, নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে এসব ক্ষমার অতীত। তারপর নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য বাগানের পেছনে বেশি বেশি সময় দিতে শুরু করেছে।

যখন ওর পরিবার বেঁচে ছিল তখন ও শুধু কিছু চারা রোপন আর আগাছা পরিস্কার ছাড়া আর কিছুই করেনি। কিন্তু এখন ও উর্বর মাটি কিনে এনে বাগানে ফেলল, নিত্য নতুন গাছ লাগাতে লাগল।

একটা পুরো বছর সেইকি দেয়ালের পাশে গর্ত করে গাছ লাগালো। ওর অফিসের কাজের বাইরের পুরো সময় এই কাজে খরচ করল। ওর বয়সি অন্যদের মত কোন কিছুতে ওর কোন আগ্রহ ছিল না।

একসময় দেয়ালের ভেতর বাড়ির চারপাশ দিয়ে গাছ লাগানো হয়ে গেল। এক ইঞ্চি জমিও খালি ছিল না। কেউ যদি দেয়ালের ওপার থেকে উঁকি দেয় তাহলে গাছপালার ভেতর দিয়ে বাড়ি প্রায় চোখেই পড়বে না। পুরো বাগানের খালি একটা অংশে কোন গাছ ছিল না, যে অংশটা সে পোর্চ থেকে দেখতে পেত। দেয়াল থেকে ঐ পুরো অংশটা খালি ছিল। সেখানে সেইকি ফুলের চারা লাগাত, যেগুলোতে সারা বছর ফুল ফুটত।

প্রথমে সেইকির ধারণা ছিল ও শুধু গাছ লাগানোর জন্যই গর্ত খুঁড়ত। কিন্তু পরে ও অনুভব করল গর্তগুলোর উপযুক্ত ব্যবহারের জন্যই আসলে গাছ লাগাত। একসময় ও খালি গর্ত খুঁড়ত আর সেগুলো আবার ভরাট করত। বাগানের গাছগুলো এত কাছাকাছি ঘেঁসে বেড়ে উঠেছিল যে ওগুলো ডালপালা বিস্তারের জায়গা পর্যন্ত ছিল না, নতুন করে গর্ত খুঁড়ে গাছ লাগানো ছিল অসম্ভব। তারপরেও সেইকি গর্ত খুঁড়ে যেতে লাগল কারণ এই একটা কাজই ওকে ওর ফ্যান্টাসি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম ছিল তখন, কাউকে কবর দেয়ার ফ্যান্টাসি থেকে। গর্ত খোঁড়ার সময় সেইকি বাকি সবকিছু ভুলে যেত। কিন্তু সেটা গর্ত খোঁড়ার যন্ত্রপাতি নামিয়ে রাখার আগ পর্যন্তই।

গর্ত খুঁড়ে আবার ভরাট করার ব্যাপারটাও একসময় অর্থহীন আর শূন্য লাগতে লাগল। গর্ত খোঁড়ার সময় ওর মনের ঘোলাটে ভাবটা দূরে সরে যেত ঠিকই কিন্তু কাজ শেষ হওয়া মাত্র সেটা আবার ফিরে আসত। ফিরে আসত আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে, কিন্তু সেইকি ওর গর্ত খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়েই যেত, যে কারনে সে রাতে কৌসুকি আসার পরে একটা গর্ত তৈরিই ছিল।

ওর প্রতিবেশিদের কাছে ওর কর্মকাণ্ড কেন জানি অদ্ভুত কিংবা অস্বাভাবিক লাগেনি। এমনকি ও যখন রাতেও খোঁড়াখুঁড়ি করত, তখনো। ওর সাথে দেখা হলে সবাই প্রথমে মাথা নিচু করে বো করত, তারপর নিজেদের বাগানের জন্য ওর থেকে পরামর্শ নিত। সবাই জানত যে ও বাগান করতে পছন্দ করে, এর মধ্যে অস্বাভাবিক কোন কিছু তারা দেখতে পায়নি। সবাই ওর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, হাজার হোক বেচারা রোড এক্সিডেন্টে পরিবারের সবাইকে হারিয়েছে, বাগান করার শখটা ছাড়া ওর আর কী বাকি আছে।

একবছর আগে, ওর পরিবারের সবাই মারা যাওয়ার দু-বছর পর, কৌসুকির সাথে ওর খাতির হয়। ছেলেটা সেইকির বাগানে হারিয়ে গিয়েছিল। এরপর তারা বন্ধু হয়ে ওঠে। সেইকি অনেকবার কৌসুকির পরিবারের সাথে পিকনিকে বাইরে গিয়েছে।

কৌসুকির সাথে সম্পর্ক যখন নয়-দশ মাসের মত হলো, সেইকি তখন ওর গ্যারেজে কিছু কাঠ খুঁজে পেল যেগুলো কৌসুকির উচ্চতার মত হবে। সাথে সাথে ওর মাথায় এল যে এগুলো দিয়ে কৌসুকির জন্য চমৎকার একটা কফিন বানানো যেতে পারে।

চিন্তাটা আসার পরেই ও আতঙ্কের সাথে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। কিন্তু পরদিন থেকে সে কফিনের কাজ শুরু করল। কাজ করতে করতে নিজের বোকামির জন্য নিজেকে ধমক লাগালো। কফিন বানাচ্ছে ঠিকই কিন্তু কখনো এটা ব্যবহার করা হবে না, নিজেকে সে নিজে বলল। কিন্তু তারপরেও ওর হাতগুলো নিজে থেকে পেরেকে হাতুড়ি ঠুকে গেল কোন রকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই, স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে কাঠগুলো দিয়ে একটা কফিন তৈরি করে ফেলল।

“আমি বাসায় যেতে চাই। আমাকে এখান থেকে বের কর!” কৌসুকি কাঁদছিল। সেইকি ওর ফোঁপানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছিল বাঁশের খুঁটির ভেতর থেকে। গর্তের ভেতরটা অন্ধকার। বাচ্চার গলার স্বর এর ভেতর প্রতিধ্বনি তুলছিল, কেমন চাপা শোনাচ্ছিল।

কৌসুকিকে কি বলবে সেইকি বুঝতে পারছিল না। ছেলেটার জন্য ওর অনেক খারাপ লাগছিল। অনেক খারাপ। ছেলেটার প্রতি ওর অনেক মায়া হলেও বলার কিছু ছিল না।

সেইকি একটা হোস পাইপ ধরে আছে। পাইপের আরেক মাথা বাড়ির পাশের একটা কলের সাথে লাগানো।

গ্রীষ্মের গরম বাড়ছিল, চারপাশ থেকে পোকামাকড়ের শব্দ ভেসে আসছিল। সেইকির পিঠ থেকে তাপ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে।

এক ঝলক পানি এসে সেইকির স্যান্ডেলের মুখে পড়ল, কৌসুকির কবর থেকে একটা বাঁশের খুঁটি দিয়ে বেরিয়ে এসে মাটিতে পড়ছে। মর্নিং গ্লোরিগুলোকে ভিজিয়ে মাটিতে ছোটখাট পুকুরের মত সৃষ্টি করেছে। যেই বাঁশের খুঁটিটা নিঃশ্বাস চলাচলের জন্য ছিল সেটা থেকে পানি বের হচ্ছিল। আরেকটা খুঁটিতে হোস পাইপটা ঢুকানো ছিল। সেখানে সেইকির চোখ পড়তেই হঠাৎ খেয়াল হলো ও কি অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে। যদিও পুরো ব্যাপারটা অন্যমনস্কভাবে ঘটিয়েছে তা বলা যাবে না।

ও সজ্ঞানেই কলের চাবি খুলে হোস পাইপ দিয়ে পানি ঢুকতে দিয়েছে, মাটির নিচে চাপা দেয়া বাক্সটা পানি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। পুরোটা সময় ওর মনে হচ্ছিল যেন কোন স্বপ্ন দেখছে। যে সজ্ঞান অন্য কাউকে বাঁধা দিত তা ওর ক্ষেত্রে তখন কাজ করছিল না।

কফিনটা ভরে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা না পেয়ে অন্য বাঁশের খুঁটিটা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। খুঁটি থেকে ফোয়ারার মত ছিটকে পড়া পানি সূর্যের আলো পরে চকচক করে উঠল। সেইকির কাছে দৃশ্যটা অসাধারণ সুন্দর মনে হলো। সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল পোকামাকড়ের গান আর এক্সারসাইজ করে ফেরা ছেলেমেয়ের দলের কোলাহল। তারা এবার অন্যদিক থেকে আসছিল। ওর দেয়ালকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। কৌসুকির কাছ থেকে আর কোন সাড়া-শব্দ শোনা যাচ্ছে না। আর মর্নিং গ্লোরিগুলো মলিন হয়ে কুঁচকে যেতে শুরু করেছে।

***

কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিন বছর পার হয়ে গেল।

ওকে গ্রেফতার করার জন্য কোন পুলিশ আসেনি। কৌসুকির বাবা-মা এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেল। যাওয়ার সময় তাদেরকে অনেক দুঃখি দেখাচ্ছিল। সেইকি ছাড়া আর কেউ তাদেরকে যাওয়ার সময় দেখেনি। কেউ কল্পনাও করেনি কৌসুকিকে সে খুন করেছে, বরং সবাই ভেবেছে ছেলেটার নিখোঁজ সংবাদ ওকে কষ্টে ফেলে দিয়েছে।

সেইকি কোন অভিনয় করেনি, ওর সত্যি সত্যি ছেলেটার জন্য কষ্ট লাগছিল। কিন্তু ও চোখ তুলে সরাসরি ছেলেটার বাবা-মায়ের দিকে তাকাতে সাহস পায়নি। তাদের চোখের অশ্রু ওকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল কি ভয়াবহ জঘন্য একটা কাজ সে করেছে।

এই তিন বছর সেইকি সারাক্ষণ আতংকে ছিল যে কেউ একজন বের করে ফেলবে ও কি করেছে। এই পুরো সময় একবারের জন্য সেইকি ওর বাগানের সেই অংশে যায়নি, যেখানে কৌসুকিকে সে জ্যান্ত কবর দিয়েছিল। জায়গাটা এখন আগাছা ঝোপে ঢেকে আছে। কৌসুকিরা যে বাসায় থাকত সে বাসায় এখন নতুন একটা পরিবার এসে উঠেছে।

গ্রীষ্মের শুরুতে, প্রতিবেশি এক গৃহিণী এসে সেইকির বাড়িতে একটা নিউজলেটার দিয়ে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে মহিলাটা এক সিরিয়াল কিলারের কথা জানাল ওকে যে কিনা মেয়েদেরকে শিকার হিসেবে বেছে নিচ্ছে, সব টক শো-গুলোর আলোচনার বিষয়বস্তু এখন এই সিরিয়াল কিলিং। স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা একসময় কৌসুকিতে গড়াল।

“কৌসুকি নিখোঁজ হওয়ার পর তিন বছর হয়ে গেল…ওর সাথে তো তোমার খুব খাতির ছিল, তুমি নিশ্চয়ই অনেক মিস কর ওকে?”

সেইকির টেনশন হতে লাগল, কৌসুকির হাস্যরত ছোট মুখটার কথা ওর মনে পড়ল। এক রাশ দুঃখ এসে গ্রাস করল ওকে। নিজ হাতে মাটি চাপা দিয়ে ছেলেটাকে ও পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে, কিন্তু তারপরেও ওর গোলমেলে মাথা এখনো ব্যাপারটা নিয়ে দুঃখবোধ করতে সক্ষম। কি ভয়াবহ জঘন্য একটা ব্যাপার।

সেইকি দুঃখের সাথে মাথা ঝাঁকাল। কিন্তু এরপর মুখ তুলে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে ও অবাক হলো। অদ্ভুত একটা ব্যাপার সে খেয়াল করল। মহিলাটিকে মোটেও দুঃখিত দেখাচ্ছিল না। সে এরই মধ্যে প্রসঙ্গ বদলে ফেলেছে। গরম বাড়ার কারনে পোকামাকড়ের আওয়াজ অনেক বেড়ে গিয়েছে এই নিয়ে সেইকির কাছে অভিযোগ করছিল। পৃথিবী ইতিমধ্যে কৌসুকির মৃত্যুশোক পার করে ফেলেছে।

কিছুদিন পর সেইকি টের পেল সে নতুন করে আবার কাঠ আর পেরেক কিনছে। আরেকটা কফিন তৈরি করার জন্য। কফিনটা ঘরের মধ্যে বসে বানালে কেউ দেখবে না। তক্তাগুলোকে করাত দিয়ে কেটে মাপমত করতে গিয়ে কাঠের সুক্ষ্ম খুঁড়োগুলো তাতামি ফ্লোরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।

গ্রীষ্মকাল বয়ে চলছে। সেইকি টের পাচ্ছে ওর ভেতর শুভ আর অশুভের লড়াই চলছে। শুভ অংশটা চাইছে আবার কোন ভয়াবহ ঘটনা ঘটানোর থেকে ওকে বিরত রাখতে, আর অশুভ অংশটা নতুন শিকার খুঁজছে। কিন্তু ওর ভেতরের এই যুদ্ধ কখনো বাইরে তার চেহারা দেখায়নি। যে কারনে ওর আশেপাশের দুনিয়া ওকে আগের মতই দেখছে। স্বয়ংক্রিয় কোন যন্ত্রের মত ও কোন সমস্যা ছাড়াই দৈনন্দিন কাজগুলো করে যেতে লাগল।

তারপর একদিন, অক্টোবরের শেষের এক শুক্রবারে, সেইকি কাজ থেকে বেরিয়ে গাড়ি বের করতে পার্কিং লটে গেল। তারপর বাসার দিকে ড্রাইভ করতে লাগল। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হেডলাইট জ্বালানো গাড়ির সারি পার হতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ওর চোখ পড়ল রাস্তার পাশের দিকে। এক মুহূর্ত পর ও উপলদ্ধি করে কেঁপে উঠল যে ওর চোখ আসলে একজন মানুষকে লক্ষ্য করছিল, পরীক্ষা করছিল। রিয়ার ভিউ মিররে রিফ্লেক্সন দেখতে গিয়ে ওর মুখের অভিব্যক্তি সব যেন কোথাও হারিয়ে গেল, মনে হচ্ছিল চোখের কালো অংশগুলো যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গভীর গর্তে পরিণত হয়েছে।

অফিসে সবাই ওকে চুপচাপ মানুষ হিসেবেই ধরে নিয়েছে। ও বাসা থেকে ফুল নিয়ে যেত অফিসে সাজিয়ে রাখার জন্য, যা কাজ দেয়া হত কোন অভিযোগ ছাড়াই সম্পন্ন করত। সবাই ওকে ভালো মানুষ হিসেবেই জানত, পছন্দ করত, বিশ্বাস করত। তাদের কেউ ঘুণাক্ষরে কল্পনাও করতে পারবে না যে সেইকি একটা বাচ্চা ছেলেকে খুন করেছে।

বাসার কাছাকাছি গিয়ে ও বামে মোড় নিল। এই রাস্তায় ট্রাফিক কম।

আর সেখানে সেইকি মেয়েটাকে দেখল।

রাস্তার পাশ দিয়ে মেয়েটা হেঁটে যাচ্ছে। হেডলাইটের আলোয় সেইকি ওর শরীরের পেছন অংশটা দেখতে পাচ্ছিল। মেয়েটার পরনে কালো রঙের ইউনিফর্ম। লম্বা চুলগুলো কাঁধ বেয়ে নিচ পর্যন্ত নেমে গিয়েছে।

মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় সেইকি কোন কিছু না ভেবেই গাড়ির গতি কমিয়ে আনল। মেয়েটার চুল যেন ওর চোখগুলোকে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ওকে আহবান জানাচ্ছে।

সেইকি উইন্ডসিল্ড দিয়ে উপরে তাকিয়ে দেখল রাতের আকাশে পূর্ণ চাঁদ ঝুলে আছে। কোথাও কোন মেঘের ছিটে ফোঁটাও নেই। পুরো এলাকা চাঁদের আলোয় মলিনভাবে আলোকিত হয়ে আছে। জায়গাটা একটা আবাসিক এলাকা, এলাকার সামনেই একটা পার্ক। আশেপাশের গাছগুলো ইতিমধ্যেই তাদের অর্ধেক পাতা হারিয়েছে।

সেইকি সামনের চৌরাস্তায় গিয়ে ডানে মোড় ঘুরে গাড়ি থামাল। হেডলাইট নিভিয়ে মিররের দিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটার আসার জন্য অপেক্ষা করছে।

মেয়েটা যদি সোজা কিংবা বাম দিকে যায় তাহলে সেইকি গাড়ি চালিয়ে বাসায় চলে যাবে। কালকে অফিস ছুটি। সারাদিন বাসায় বসে আরাম করা যাবে।

কিন্তু মেয়েটা যদি এদিকে আসে…

একটা শুকনো পাতা খসে জানালার উপর টোকা দিয়ে পেভমেন্টের উপর পড়ল। আগেরদিন পড়া প্রতিবেশির নিউজলেটারটার কথা মনে পড়ল ওর। রাস্তায় পড়ে থাকা পাতা পরিস্কার করা নিয়ে একটা আর্টিকেল ছিল। সেখানে। আজকে বিকেলেই পরিস্কার করা হয়েছে। যে কারনে রাস্তায় পড়া পাতার সংখ্যা কম ছিল। সকালে পাতায় ঢেকে ছিল জায়গাটা। তার মানে তাদের পাতা পরিস্কারের কাজ আজকের মত শেষ। আরেকটা শুকনো পাতা খসে পড়ে ওর গাড়ির উইন্ডসিন্ডের ওয়াইপারের মধ্যে জায়গা করে নিল।

কোথাও কোন শব্দ নেই। সেইকি গাড়ির ভেতর বসে ছিল। ওর হাত দুটো শক্ত করে স্টীয়ারিং হুইল চেপে ধরে আছে। মিররে এইমাত্র পার হয়ে আসা মোড়টা দেখা যাচ্ছে। অবশেষে চাঁদের ফ্যাকাসে আলোর মধ্যে মেয়েটাকে দেখা গেল।

গ্যারেজে গাড়ি পার্ক করে সেইকি তাড়াতাড়ি বিশাল ধাতব দরজাটা লাগিয়ে দিল, ক্যাঁচকোঁচ শব্দ আশেপাশে নিস্তব্ধ এলাকার মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলল। গ্যারেজের বাইরে দাঁড়িয়ে ও পড়ে থাকা শুকনো পাতার দিকে চাইল।

গ্যারেজের পাশে লাগ্লো গাছগুলো বড় হয়ে উঠেছে। ওগুলো থেকে শুকনো পাতা পড়ে ওর গ্যারেজ প্রায় ঢেকে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ওগুলো ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করা দরকার।

ওর বাবা-মা আর দাদি মারা যাওয়ার পর থেকেই সেইকি বাসায় একা। সব পরিস্কার করা, লন্ড্রি সব কাজ ও একাই করে। আর প্রতিবার করতে গিয়ে ওর উপলদ্ধি হয় ও কতটা নিঃসঙ্গ।

ওর সদ্য বিবাহিত একজন কলিগ মাড় দেয়া শার্ট পড়ে আসে এখন, আর সেইকির বস টেবিলের উপর নিজের বাচ্চাদের ছবি সাজিয়ে রেখেছেন।

“তোমার কি কোনদিন বিয়ে-টিয়ে করার কোন ইচ্ছা আছে, সেইকি?” ওর এক নারী কলিগ একবার প্রশ্ন করেছিল।

কোন সম্ভাবনা নেই, সেইকি ভাবল। প্রেমিকা, বন্ধু, পরিবার,..এসব কিছু ওর কাছে দূরের কোন বস্তু মনে হয়। অফিসের কাজের পরিবেশের সাথে সেইকি খাপ খেয়ে নিতে পারলেও এরচেয়ে গভীর কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওর কেমন জানি অস্বস্তি বোধ হয়।

যেসব গোপন ব্যাপার আর সমস্যা ও নিজের ভেতর তলে তলে গড়ে তুলেছে তা ওর আর অন্যদের মাঝে এক দুর্ভেদ্য দেয়াল সৃষ্টি করেছে। এমন কেউ নেই যার কাছে ও নিজের ভয়াবহ কার্যকলাপ নিয়ে স্বীকারোক্তি করতে পারে।

একটা ঠান্ডা বাতাস ওর ঘাড়ের কাছ দিয়ে বয়ে গেল। আগেরদিনের চেয়ে আজকে একটু বেশি ঠান্ডা পড়েছে। উঠোনের পাতা উড়ে যেতে দেখে সেইকি একটু কেঁপে উঠল। কিন্তু আসন্ন শীতের পূর্বাভাস ওর কাঁপুনির জন্য পুরোপুরি দায়ি নয়। সেইকি টের পেল ওর স্যুট জ্যাকেট পরা নেই। ওর সাদা শার্টের অসংখ্য ভাঁজ ওকে মনে করিয়ে দিল ওর সদ্য বিবাহিত কলিগের সুখি জীবনের কথা। লোকটার শার্ট সবসময় ইস্ত্রি করা থাকে।

সেইকি ওর মাথা ঝাঁকাল। অন্যদের ব্যাপারে চিন্তা করার সময় এখন নয়। ও আবার গ্যারেজের ভেতর গিয়ে ঢুকল। গ্যারেজের এক দিকে একটা দরজা ছিল, সেটা দিয়ে ঢুকে ও গাড়ির পেছনের দরজা খুলল। স্যুট জ্যাকেট তুলতে গিয়ে দেখলে পেছনে দাগ লেগে আছে। রক্তের দাগ হবে সম্ভবত। ব্যাকসিটে শুয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকাল ও। মুখ আর নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। সেইকি চায়নি বাড়ি ফেরার সময় কেউ গাড়িতে মেয়েটাকে দেখে ফেলুক। তাই জ্যাকেট দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল ওকে।

মেয়েটা তখনও জ্ঞানহীন হয়ে পড়েছিল। নড়াচড়া করছিল না। গুটিসুটি মেরে পড়ে ছিল, লম্বা চুলগুলো পর্দার মত মুখের উপর পড়েছিল। মেয়েটা যদি বাধা না দিত তাহলে সেইকি ওকে আঘাত করত না, হাত ডলতে ডলতে ভাবল। মেয়েটার নখের আঁচড়ে লাল দাগ হয়ে আছে ওর তুকে।

মেয়েটাকে ধরার সময় চিৎকার করেছিল, নিস্তব্ধ রাতে সেই কম্পন তোলা চিত্তার নিশ্চয়ই সবাই শুনতে পেয়েছিল।

এরপর কি হলো তা সেইকির ঠিকমত মনে নেই। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও মেয়েটার মুখে কয়েকবার আঘাত করে। মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল, নড়ছিল না। কিন্তু তারপরেও সেইকির হাত মেয়েটার মুখের উপর চলছিল। সে মেয়েটাকে নিয়ে ব্যাকসিটে ঢুকালো, জ্যাকেট দিয়ে ঢেকে দিল। গাড়ি চালু করে উড়ে চলে এল।

সেইকি ওর জীবনে কখনো হিংস্র কোন কিছু করেনি, ছোট থাকতেও। টিভিতে শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত কোন খবর দেখলে বিতৃষ্ণায় ওর মাথা ঘুরাত। আর এখন কিনা সে একটা মেয়েকে মুখে ঘুষি মেরেছে। ও ওর হাতে এর প্রতিক্রিয়া টের পাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যেন কোন পোকা নড়াচড়া করছে হাতের উপর দিয়ে। আতংকিত হয়ে ও হাত ঝাড়ল, পোকাগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল, কিন্তু অনুভুতিটা রয়েই গেল।

ও মেয়েটাকে তুলল। ঘরের পেছনের রুমটায় বয়ে নিয়ে গেল। আলো নিভিয়ে রেখেছিল যেন ওদের ছায়া পর্দা কিংবা জানালায় না দেখা যায়। চাঁদের আলোতে মেয়েটার হাতগুলো আর চুল নিচে ঝুলে থাকল, হাঁটার সময় দুলছিল। কাজের রুমে নিয়ে গিয়ে ও মেয়েটাকে নতুন বানানো কফিনের ভেতর শুইয়ে দিল।

সুন্দর ফিট হলো, যেন মেয়েটার কথা ভেবেই কফিনটা বানানো হয়েছিল। কিন্তু সেইকি মেয়েটার চেহারার দিকে তাকাতে পারছিল না। কিভাবে তাকাবে? নাক আর ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে, ঘুষি খাওয়া জায়গাগুলো ফুলে রঙ বদলে গেছে। সেইকির ভেতর থেকে উঠে আসা অন্ধকার অশুভ ব্যাপার যে ছাপ রেখে গিয়েছিল সেগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সাহস সেইকির নেই। সে তাড়াতাড়ি কফিনের ঢাকনা লাগিয়ে পেরেক মেরে বন্ধ করতে লাগল। ঢাকনায় দুটো ফুটো ছিল বাতাস যাওয়া আসা করার জন্য।

কৌসুকির কবরের পাশে একটা গর্ত করা ছিল। গর্তটা হয়তো টের পেয়েছিল যে কিছু একটা হবে, তাই চাঁদের আলোয় অধীরভাবে অপেক্ষা করছিল। গর্ত থেকে তোলা মাটিতে একপাশে ছোটখাট একটা টিবি হয়ে আছে।

সেইকি টেনে কফিনটা ঘর থেকে বের করে সোজা গর্তের দিকে নিয়ে গেল। মেয়েসহ কফিনটা বেশ ভারি হয়ে আছে।

কফিনটা গর্তে ফেলে এক জোড়া বাঁশের খুঁটি কফিনের গর্তগুলোতে বসাল। তারপর মাটি ঢেলে গর্তটা ভরাট করে ফেলল। প্রথম দিকে শুকনো মাটি কফিনের কাঠের উপর পড়ে থপ থপ শব্দ সৃষ্টি করছিল, পরে কফিন ঢেকে গেলে শব্দ থেমে গেল। যতটা অনুমান করেছিল তার চেয়ে অনেক সময় লাগল গর্তটা ভরাট করতে। সেইকি ঘেমে পুরো গোসল হয়ে গিয়েছে। আর বাসায় ফেরার পর ও পোশাকও বদলায়নি, ওর ওয়ার্ক সুটের পা মাটি লেগে নোংরা হয়ে গেছে। কবরটা ভর্তি হয়ে যেতেই ও কোদাল দিয়ে মাটি সমান করে দিল।

কৌসুকিকে কবর দিয়েছিল গ্রীষ্মে, বাঁশের খুঁটিতে মর্নিং গ্লোরি ছড়িয়ে দিয়ে। কিন্তু বছরের এই সময়ে সেটা করা সম্ভব নয়। মর্নিং গ্লোরি মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফুল, শীত সহ্য করতে পারে না। দেয়ালের পাশের আগাছার মধ্যে খালি বাঁশ যেগুলো ছিল সেগুলো নিয়ে কারো কোন সন্দেহ হবে না, হলেও সে বলতে পারবে গ্রীষ্মের সময় মর্নিং গ্লোরির জন্য সেগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল।

কিন্তু নতুন ভরাট করা মাটির ক্ষেত্রে এই অজুহাত দেয়া যাবে না। তাই সে ফ্লাওয়ার বেড থেকে কিছু খড়কুটো তুলে এনে সেখানে বিছিয়ে দিল। কাজ শেষ করার পর জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছিল না যে এখানে কোন গর্ত খোঁড়া হয়েছিল।

সেইকি কোদাল সরিয়ে রেখে পোর্চে গিয়ে বসল। অনেকক্ষণ বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটাকে ওখানে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছে।

পোর্চ আর দেয়ালের মাঝখানের জায়গাটাতেই শুধু কোন গাছ লাগানো ছিল না। শুধু কিছু ফ্লাওয়ার বেড, কিছু বাঁশের খুঁটি আর কাপড় শুকানোর জন্য দড়ি টাঙানো ছিল। কিন্তু পোর্চের অন্য পাশগুলোতে গাছগুলো ঘন হয়ে ছিল। রাতের অন্ধকারে কালো দেয়ালের মত লাগছিল দেখতে। যখন বাতাস বইছিল তখন ছায়াগুলো এদিক ওদিক সরে যাচ্ছিল। মেয়েটার আঁচড় লাগা জায়গাটা ডলতে লাগল সেইকি। ঘুষি মারার পর হাতের অবশ অবস্থাটা প্রায় নেই আর। নিজের মুখে হাত বোলাতে গিয়ে টের পেল ও হাসছে।

বাড়ির ভেতর গিয়ে সে মেয়েটার ব্যাগ চেক করে দেখল, ভেতরে এক ক্যান মরিচ পানির স্প্রে আর একটা স্টুডেন্ট আইডি আছে। আইডিতে সুন্দর চেহারার একটা মেয়ের ছবি।

ছবির নিচে গ্রেড, ক্লাস, সিট নাম্বার, আর নাম লেখা। মোরিনো ইয়োরু। সেইকি আবার পোর্চে গিয়ে দাঁড়াল, বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে নামটা উচ্চারণ করল সে।

যেই মানুষটাকে ও মাত্র কবর দিয়ে এসেছে তার একটা নাম ছিল-সাধারণ একটা ব্যাপার, ও উপলদ্ধি করল। মাটির নিচে পড়ে থাকা মেয়েটার বাবা-মা ছিল, তারা তাকে এই নাম দিয়েছিল আর আদর-যত্নে বড় করে তুলেছিল। আর সেইকি কিনা সেই ভালবাসার মানুষটিকে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলল।

একটা অদ্ভুত উন্মাদনা সেইকির মন ভরে তুলল, যেভাবে চিনি দেয়া পানি ধীরে ধীরে তুলোর বলের ভেতর প্রবেশ করে। মাটির উপরে থাকতে যে মেয়েটাকে ও ঘুষি মেরেছিল, সে ছিল আতঙ্কজনক। কিন্তু মাটির নিচে, চোখের আড়াল হতে সেইকি টের পেল ওর আতংক বদলে গিয়ে আনন্দে রূপ নিচ্ছে।

সে মুহূর্তে সেইকির কানে একটা আওয়াজ ভেসে এল, দূর্বল-বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে কোনমতে।

সেইকি আবার বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকাল। চাঁদের ফ্যাকাসে আলোয় সেগুলোর ছায়া লম্বা হয়ে বাগান থেকে পোর্চ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, যেখানে সেইকি বসে আছে। চারটা খুঁটি অন্যগুলোর চেয়ে বেশি মোটা।

মোটা খুঁটিগুলোর দুটো থেকে ক্ষীণ শব্দটা আসছে। সেইকি উঠে দাঁড়িয়ে জুতো পরে সোজা সেদিকে গেল। হাঁটতে গিয়ে ওর মনে হচ্ছে ও বোধহয় কোন নড়াচড়া করছে না। ঘুমের ভেতর হাঁটার মত এক অবাস্তব দুনিয়ার ভেতর দিয়ে চলছে যেন। চাঁদের আলোয় বাগানে গাছগুলোর ছায়া যেন ওর দিকে চেয়ে আছে।

সে খড়কুটো পার হয়ে খুঁটিগুলোর কাছে পৌঁছাল, খুঁটিগুলো ওর বুক পর্যন্ত উঁচু। বুড়ো আঙুলের সমান চওড়া ফুটো দিয়ে ভেতরে তাকাল। ভেতরে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না, ওর শূন্য হৃদয়ের মত গহিন অন্ধকার। ভেতর থেকে মেয়েটার দূর্বল কাঁপাকাপা গলার শব্দ ভেসে আসছে। খুঁটি বেয়ে মাটির নিচে থেকে মাটির উপরে উঠে আসছে আর মাথায় পৌঁছাতেই বাতাস ছিনিয়ে নিচ্ছে, ধোঁয়ার মত।

একটা খুঁটিতে শব্দ অন্যটার চেয়ে বেশি ছিল। কফিনে দুটো খুঁটি লাগানো। একটা মুখের কাছে আরেকটা পায়ের দিকে। মুখের কাছেরটার খুঁটি দিয়ে অন্যটার চেয়ে ভালো শব্দ আসছে।

“হ্যালো?” দূর্বল গলায় মেয়েটা বলল। কেটে যাওয়া ঠোঁটের জন্য নিশ্চয়ই কথা উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছে। আমাকে বের হতে দাও…”

সেইকি হাঁটু গেড়ে বসল, হাতের তালু বাঁশের খুঁটির কাছের মাটিতে রাখা। কিছুক্ষণ আগে কবর দেয়া, যে কারনে মাটি নরম হয়ে আছে।

মেয়েটার গলা ওর হাতের নিচ থেকে ভেসে আসছে। ও বুঝতে পারছিল ওর কল্পনা কিন্তু তারপরেও ওর কাছে মাটিটা উষ্ণ মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কবর দেয়া মেয়েটার শরীরের উষ্ণতা ও টের পাচ্ছে উপর থেকে।

বেচারি। কি অসহায় হয়ে পড়ে আছে, বাঁশের খুঁটির ভেতর দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সেইকির খারাপ লাগতে লাগল মেয়েটার জন্য। জ্যান্ত কবর হয়ে আছে অথচ কিছু করার নেই। সেইকির নিজেকে অনেক ক্ষমতাশীল মনে হতে লাগল। কোন কুকুর কিংবা বিড়াল ছানার দিকে তাকালেও ওর এরকম লাগে।

“আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?” সেইকি দাঁড়িয়ে বলল। ওর কথাগুলো খুঁটির অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে মেয়েটার কাছে পৌঁছাল।

“কে…কে ওখানে?” সেইকি ওকে বলতে শুনল, কোন উত্তর দিল না। মেয়েটার গলা আরেকটু জোরে শোনা গেল। “তুমি আমাকে এখানে বন্দি করেছ তাই না? তারপর মাটির নিচে চাপা দিয়েছ।”

“তুমি জানো তোমাকে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে?” সেইকি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। মেয়েটা যদি মাত্র কফিনের মধ্যে জ্ঞান ফিরে পেয়ে থাকে তাহলে শুধু অন্ধকার, ছোট, বদ্ধ, একটা জায়গায় আটকে আছে ছাড়া তার কোনোভাবেই সেটা জানার কথা নয়।

মেয়েটা কয়েক মুহূর্ত কিছু বলল না। তারপর বলল, “আমি ঢাকনার উপর মাটি পড়ার শব্দ শুনেছি।”

“তুমি অজ্ঞান হয়ে থাকার ভান করেছিলে?”

সেইকি ভেবেছিল ঘুষি মারার পর থেকে মেয়েটা অজ্ঞান। জ্ঞান ফিরল কখন? ও মেয়েটাকে বাঁধার চেষ্টা করেনি। বাক্সে ঢোকানোর আগে যদি জ্ঞান ফিরে থাকত তাহলে নিশ্চয়ই পালানোর চেষ্টা করত?

“তোমার কি পা আহত হয়েছে? সে কারনে পালাওনি?” সেইকি জিজ্ঞেস করল। মেয়েটা কোন উত্তর দিল না। তার মানে ওর অনুমান সঠিক।

“আমাকে বের হতে দাও।” মেয়েটা রাগতস্বরে বলল।

ওর এই হঠাৎ রেগে যাওয়ায় সেইকি অবাক হলো। মেয়েটা কাঁদেনি কিংবা অনুনয় করেনি-সোজা আদেশ দিচ্ছে, মাটির নিচে সে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু অনুভব করতে পারছে মেয়েটার মনোবল কতখানি শক্ত। কিন্তু যতই শক্ত থাক, আসলে সে অসহায়।

“না। আমি দুঃখিত যে সেটা সম্ভব হচ্ছে না, সেইকি মাথা নেড়ে বলল। “তোমাকে বের হতে দিলে তুমি সবাইকে বলে দেবে আমি তোমাকে নিয়ে কি করেছি। আমি সেটা হতে দিতে পারি না।”

“ক্-কে তুমি? কেন এসব করছ?” মেয়েটার প্রশ্নগুলো সেইকির বুকে এসে প্রতিধ্বনি তুলল।

কেন সে মেয়েটাকে কবর দিল? এই প্রশ্ন থেকে পালাবার কোন উপায় ও খুঁজে পেল না। প্রশ্নটা যেন ওকে কোন এক কানাগলির সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। কিন্তু দেয়ার মত কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে ও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে গেল না,

“তাতে কিছু আসে যায় না।”

“আমি কোথায়? পার্বত্য এলাকায়?”

“না। তুমি আছ আমার বাগানে, তোমার কবরে শুয়ে আছ।”

মেয়েটা চুপ করে গেল। সেইকি অন্ধকারে তার চেহারা কিরকম হতে পারে তা কল্পনা করার চেষ্টা করল।

“কবর? মজা করছ নাকি? আমি এখনো জীবিত আছি।”

“মৃত মানুষদের কবর দেয়ার মধ্যে কোন মজা নেই, সেইকি বলল, যেন এরচেয়ে কঠিন কোন সত্য থাকতে পারে না।

শুনে মনে হলো মেয়েটা কিছুক্ষনের জন্য কথা হারিয়ে ফেলল। তারপর গরগর করে উঠল, “আমাকে বের হতে না দিলে তুমি বিপদে পড়বে।”

“তোমার ধারণা কেউ তোমাকে উদ্ধার করতে আসবে?”

“আমি জানি একজন আমার খোঁজে আসবেই!” সে হঠাৎ গর্জে উঠল। তারপর ব্যথায় কাতরে উঠে আবার চুপ করে গেল। সেইকি ওর জোরে জোরে দম নেয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। হয়তো ওর বুকের রিবস এ ইঞ্জুরি হয়েছে, প্রতিবার কথা বলার সময় ব্যথা হচ্ছে। সেইকির মনে হলো মেয়েটার কথা-বার্তার মধ্যে অন্যরকম একটা বিশ্বাসের জোর রয়েছে।

“তুমি তোমার এই বন্ধুটিকে অনেক বিশ্বাস কর মনে হচ্ছে…কোন ছেলে নাকি?”

“হ্যাঁ,” সে বলল, কিন্তু আত্মবিশ্বাসের সুর থেকে পরিস্কার বোঝা ছিল ছেলেটি ওর বয়ফ্রেন্ড হবে।

“ছেলেটার নাম জানতে পারি?”

“নাম দিয়ে কি করবে?”

“সেফ কৌতূহল।”

এরপর খানিকক্ষণ নিরবতা। তারপর মেয়েটা ওকে ছেলেটার নাম বলল। সেইকি নামটা ওর স্মৃতিতে গেঁথে নিল, কিন্তু ওর সন্দেহ হতে লাগল মেয়েটা আসলেই সত্যি বলছে কিনা। ছেলেটার হয়তো কোন অস্তিত্বই নেই, কিন্তু সেটা পরীক্ষা করে দেখার কোন উপায় সেইকির হাতে নেই।

“একটা বাইনোকুলার কিনতে হবে।”

আকাশে ছোট ছোট মেঘ চাঁদের সামনে দিয়ে দ্রুত উড়ে যাচ্ছিল। কাল পরশু ঝড় বৃষ্টি হতে পারে।

“কেন কিনব জানো?” সেইকি প্রশ্ন করল। মেয়েটা চুপ করে থাকল। “দূর থেকে দেখব তোমাকে হারিয়ে সে কিভাবে বিলাপ করে।”

ও নিশ্চিত কথাগুলো মেয়েটার কানে ঠিকই পৌঁছেছে, তারপরেও সে কোন উত্তর দিল না। সেইকি আরও কিছু কথা বলল, মেয়েটার কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই হল না। সে শুধু সেখানে অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে রইল।

মেয়েটাকে ও খেপিয়ে দিয়েছে ধরে নিয়ে সেইকি বাগান ছেড়ে চলে এল। সকালে হয়তো মেয়েটার মুড বদলাবে।

সে গ্যারেজে গিয়ে গাড়ির পেছনের সিট পরিস্কার করল। মেয়েটার উপস্থিতির কোন চিহ্ন রাখা যাবে না। গাড়িতে ও সবসময় একটা ছোট বালিশ রাখে, মেয়েটাকে শোয়ানোর সময় বালিশটা মাথার নিচে দিয়েছিল। সেটা রক্ত সব শুষে নিয়েছিল যে কারনে সিটের উপর কোন দাগ পড়েনি। সেইকি বালিশটা বের করে নিল আর মেঝে থেকে সব লম্বা কালো চুল তুলে জড় করল।

পরিস্কার করা শেষ হয়ে গেলে ও বাইরে গিয়ে দেয়ালে ঝুলানো ঘড়িতে সময় দেখল। দুটোর বেশি বেজে গিয়েছে। সেইকি ওর রুমে গিয়ে মেঝেতে ফুটোন বিছিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের রাজ্যের প্রবেশ পথ খুঁজতে লাগল, মেয়েটাকে নিয়ে ওর চিন্তা আলাদা একটা ছোট অন্ধকার অংশে আটকে রাখল।

***

পরদিন যখন সেইকির ঘুম ভাঙল তখন প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছে। দিনটা ছিল শনিবার। ও যেখানে কাজ করে সেখানে ছুটির দিন বলে আলাদা কিছু নেই যে কারনে ওকে প্রায়ই শনি-রবিবারে অফিস যেতে হয়। কিন্তু এই সপ্তাহে ভাগ্য ভালো বলা যেতে পারে, শনিবার ছুটি ছিল ওর।

জানালা খুলে বাইরে তাকাল। যখন ও ঘোট ছিল তখন এখান থেকে শহর পর্যন্ত দেখা যেত। কিন্তু এখন গাছের জন্য কিছু দেখা যায় না আর। গাছের উপর দিয়ে ধূসর আকাশ দেখা যাচ্ছে। একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝাপ্টা এসে গাছগুলোকে নাড়িয়ে সেইকির গাল ছুঁয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

মেয়েটার ব্যাপারটা কি আসল নাকি স্বপ্ন ছিল সেটা ভাবতে ভাবতে সেইকি নিচ তলায় গিয়ে পোর্চে দাঁড়াল। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ও নিশ্চিত হল ঘটনাটা আসলেই ঘটেছে।

সোজা দাঁড়িয়ে থাকা চিকন বাঁশের খুঁটিগুলোর মাঝে চারটা মোটা খুঁটি দাঁড়িয়েছিল। চারটা মানে দুটো কফিন। গত রাতে সে একটা মেয়েকে কবর দিয়েছে, কৌসুকির কবরের পাশে। নিশ্চিত হতে পেরে ওর দুশ্চিন্তা দূর। হলো।

পার্কের ওখানে কি হয়েছিল, যেখানে ও মেয়েটাকে গাড়ির ভেতর ঢোকানোর চেষ্টা করছিল?

মেয়েটা চিৎকার করেছিল। কেউ কি সেটার রিপোর্ট করেছে নাকি? মেয়েটার বাবা-মা কি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পুলিশকে খবর দিয়েছে? পুলিশ হয়তো এই দুই তথ্য একসাথে করে আন্দাজ করতে পারবে যে মেয়েটা পার্কের পাশের রাস্তা থেকে কিডন্যাপড় হয়েছে।

সেইকি স্যান্ডেলে পা গলিয়ে বাগানে নামল। ওর খিদে পেয়েছে, কিন্তু কিছু খাওয়ার আগে মেয়েটার সাথে একটু গল্প করে নিতে চায়। এরকম অস্বাভাবিক ঘটনায় সে সাধারনত কিছু মুখে তুলতে পারে না। কিন্তু কোন বিচিত্র কারনে ওর প্রচন্ড ক্ষুধা বোধ হচ্ছিল আর নিজেকে জীবিত মনে হচ্ছিল।

বাঁশের খুঁটির কাছে দাঁড়িয়ে ও প্রথমে কথা না বলে কিছু শোনা যায় কিনা সেটা খেয়াল করল। কোন শব্দ কানে এল না। সুতরাং সেইকি বলল, “সকাল হয়েছে, তুমি কি জেগে আছ?”

আগের রাতে মেয়েটা কোন উত্তর দেয়নি। সকালেও উত্তর দেবে কিনা সেই নিয়ে সেইকির দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু পর মুহূর্তেই ও উত্তর পেল।

“আমি জানি এখন সকাল। ভেতরে অন্ধকার হলেও..”

বাঁশের খুঁটির ভেতর থেকে গলার শব্দ খানিকটা কেঁপে কেঁপে আসছিল। বাঁশের গোঁড়ার মাটি নড়ে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই মেয়েটা খুঁটির ঐ মাথা নাড়াচাড়া করেছে, যে কারনে হয়তো কফিনের গর্ত থেকে খুঁটিটা সরে গিয়েছে বা কিছু।

“আমার মুখের কাছে একটা খুঁটি লেগে আছে। আমি নড়তে গিয়ে টের পেলাম। এটা দিয়েই কি নিঃশ্বাস নিচ্ছি? ভেতর দিয়ে তাকিয়ে দূরে সাদা আলো দেখতে পেলোম-তার মানে তাহলে সকাল?”

খুঁটিগুলো জোড়া লাগানো ছিল না, সেফ কফিনের গর্ত দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেইকি যদি সেগুলো তুলে ফেলতে চায় তাহলে সহজেই তুলে ফেলতে পারবে। আবার মেয়েটা যদি অন্য অংশটা নাড়ায় তাহলে বাইরেও খুঁটিটা নড়তে থাকবে।

“খুঁটিটা ছেড়ে দাও। ওগুলো নড়ার কথা না। কেউ দেখলে সন্দেহ করতে পারে। তুমি যদি ওগুলো আরেকবার নড়াও তাহলে আমি ওগুলো উঠিয়ে ফেলব। দম নিতে পারবে না তখন।”

খুঁটিগুলো নড়াচড়া বন্ধ করে দিল।

“তোমার নাম কি?” মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।

“সেইকি। আর তোমার নাম তো মোরিনো তাইনা?”

অনেকক্ষণ কোন উত্তর এল না। তারপর মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, কথায় মনে হচ্ছিল ঘৃণা ঝরে পড়ছে। “সেইকি, আমি জানি না কেন তুমি আমাকে এখানে আটকে রেখেছ, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। আমাকে বের হতে দাও নাহলে কালো পাখির দুর্ভাগ্য ভোমার ঘাড়ে চড়ে বসবে।”

মেয়েটা তো ওকে কোন ভয় পাচ্ছেই না বরং উল্টো ওর উপর অভিশাপ দিচ্ছে। সে কি তার অবস্থান ঠিকমত বুঝতে পারছে? সেইকি অনুভব করল ও রেগে যাচ্ছে।

“মাটির নিচ থেকে তুমি কি করবে আমার? আমি তোমাকে যেকোন মুহূর্তে পানিতে চুবিয়ে মারতে পারি।”

“চুবিয়ে..?”

সেইকি যথাসম্ভব বিস্তারিতভাবে মেয়েটাকে জানানোর চেষ্টা করল কিভাবে কফিনে পানি ঢুকিয়ে মেয়েটাকে সে মেরে ফেলতে পারে। মেয়েটাকে পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিতে চাইল যে ওর বাঁচার কোন আশা নেই। মেয়েটার মনোবল ভেঙে ফেলতে চাইল।

মেয়েটা তার দুর্ভাগ্যর কালো বাক্স থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারছিল। কিংবা হয়তো রাগ কন্ট্রোল করতে পারছিল না। যেটাই হোক না কেন ওর গলা কাঁপছিল। “তুমি আমাকে খুন করার আগে আমি নিজেই আমার জীবন শেষ করে দেব। তুমি আমার পকেট চেক করতে ভুলে গিয়েছ-বিশাল ভুল করেছ। আমি নিশ্চিত তুমি জানো না তুমি কতখানি উদাসীন। আমার পকেটে একটা মেকানিক্যাল পেন্সিল আছে। আমি সেটা আমার জগুলার ভেইনে ঢুকিয়ে দিব।”

“তুমি হয়তো ভাবছ খুন হওয়ার আগে আত্মহত্যা করলে তোমার সম্মান বাঁচবে, কিন্তু সেটা সত্যি নয়। সবই আসলে এক। তুমি আত্মহত্যা করলেও তোমার শরীর এখানেই পচে গলে মাটির সাথে মিশে যাবে। কেউ জানতেও পারবে না। তুমি একাই থেকে যাবে, মাটির নিচে চাপা থাকবে অনন্তকালে জন্য।”

“না থাকব না। আমাকে অনন্তকালের জন্য লুকানো যাবে না। কেউ না কেউ আমাকে খুঁজে বের করবেই। আর পুলিশ এত গাধা না, তোমাকে তারা একদিন ঠিকই ধরে ফেলবে। আজকে তোক আর কয়েক বছর পরে হোক, ধরা তোমাকে পড়তেই হবে। এটা আমি নিশ্চিত জানি। আর আরেকটা ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত-আমি একা মরব না।”

“একা মরবে না?”

“আমি একা পচে মরব না!”

“তুমি বলতে চাইছ, তোমার সাথে অন্য কেউও মরবে? যে ছেলের কথা কালকে বললে সে?”

“সে আমাকে একা মরতে দেবে না।”

মেয়েটা ওর কবরে শুয়ে কাঁদছে? ওর গলা একটু ভেজা ভেজা শোনাল। কিন্তু তারপরেও সেখানে একটা প্রতিজ্ঞার সুর ছিল।

সেইকি ওর বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কে জানতে চাইল, সেফ উপহাস করার জন্য। হাই স্কুলে পড়া বাচ্চা ছেলেমেয়ে, তাদের প্রেম হলো দুই দিনের প্রেম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওর নার্ভাস লাগছিল। ওর মাথার উপর একটা বড় কালো মেঘ ভেসে যাচ্ছে, যেকোন সময় বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার অপেক্ষায়।

“আমি বুঝতে পারছি না…তুমি এই অবস্থায় এমনভাবে কিভাবে কথা বলতে পারছ। মোরিনো…তুমি এখানে মাটির নিচে একা পচে মরবে…একা। আর কোন কিছু তোমার কপালে নেই।” সেইকি এ কথা বলে ওখান থেকে চলে এল।

মেয়েটার কথাগুলো শোনার সময় ওর মনে পড়ছিল অফিসে ওর অল্পবয়স্কা কলিগ ওকে যে প্রশ্ন করেছিল-ও কখনো বিয়ে করবে কিনা।

যেকোন গভীর সম্পর্ক থেকে ওকে কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে, যেরকম গভীর সম্পর্ক পরিবার কিংবা বন্ধুদের মধ্যে থেকে থাকে।

বেচে থাকার জন্য এছাড়া ওর সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না। অন্য মানুষদের দিকে ও হাসত আর ফালতু আলোচনায় যোগ দিত ঠিকই, কিন্তু ওর মন কখনো কারো সাথে যুক্ত হত না। মেয়েটার কথাগুলো ওকে নাড়িয়ে দিয়েছে।

সেইকি ঠিক করল কিছু একটা পেটে দিয়ে নিজেকে শান্ত করবে। যদিও ওর ক্ষুধা নষ্ট হয়ে গিয়েছে কিন্তু কিছু খেলে হয়তো ভালো লাগবে।

সে ঠিক করল বাইরে খেতে যাবে। স্যুটের পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে জ্যাকেটের পকেটে পুল। তারপর জুতা পরে দরজার দিকে যেতে গিয়ে একটা খটকা লাগল।

সেইকি সব সময় ওর অফিসের ব্যাজ সাথে রাখে। ব্যাজসহ আইডি কার্ডটা একটা বাদামি রঙের চামড়ার কেইসে রাখা ছিল। আর সেটা ওয়ালেটের সাথে একই পকেটে থাকত সবসময়। কিন্তু গত রাতের পর সেটা ওর চোখে পড়েনি আর।

সেইকি আবার জুতো খুলে রুমে ফিরে গেল, যেখানে স্যুটটা ঝুলছিল। যে পকেটে ওয়ালেটটা রাখা ছিল সেটায় হাত ঢুকাল। কিছু নেই ভেতরে। অন্য পকেটগুলোও চেক করল। আইডি কার্ডের কোন চিহ্ন নেই কোথাও। আশেপাশে তাকাল, ফ্লোরের কোথাও পড়েছে কিনা। ম্যাগাজিনগুলো তুলে টেবিলের উপর রাখল, ফুটোন তুলে নিচে দেখল। কোথাও নেই।

জিনিসটা ও শেষ কখন দেখেছিল? অফিসে ওর সাথে ছিল, পরিস্কার মনে আছে। অন্য কোথাও কি পড়েছে?

দ্রুতই সেইকি একটা উত্তর খুঁজে পেল, আর উত্তরটা পেয়ে ওর মাথা ঘোরাতে লাগল। যতই ও ব্যাপারটা উপেক্ষা করতে চাইল ততই আরো সন্দেহ বাড়তে লাগল।

আইডি কার্ডটা যদি কোথাও পড়ে গিয়ে থাকে তাহলে সেটা মেয়েটার সাথে মারামারি করার সময়ই পড়েছে…গত রাতে, পার্কটার কাছে। মেয়েটা যখন চিৎকার দিয়েছিল তখন ওর কনুই এর গুতা লেগেছিল সেইকির বুকে। তখন নিশ্চয়ই ধাক্কা লেগে পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল আইডি কার্ডটা।

বাগান থেকে পাখিদের ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ওর বাসার চারপাশের গাছগুলোতে অনেক পাখির বাসা। সকালে বাগানে হাঁটার সময় সে পাখির গান শুনতে পায়। কিন্তু আজকে পাখির গান ওর কানে অশুভ শোনাচ্ছিল, যেন আসন্ন কোন দুর্যোগের সংবাদ দিচ্ছে তারা।

আগেরদিন রাস্তার ঝরা পাতাগুলো পরিস্কার করা হয়েছিল। তখনও আইডি কার্ডটা সেখানে ছিল না। কিন্তু আজকে যদি সেটা সেখানে পাওয়া যায় তাহলে…লোকগুলো জানবে যে আইডি কার্ডটার মালিক গত রাতে কি ভোরে এদিক দিয়ে গিয়েছিল।

আইডি কার্ডটা কার তা জানা কোন সমস্যাই না, সেইকির নাম পরিস্কার করেই লেখা আছে। বলা মুশকিল কতজন লোক দুটো ব্যাপারকে একসাথে মিলিয়ে দেখবে মেয়েটার চিৎকার আর নিখোঁজ হওয়ার সাথে ওর আইডি কার্ডটা সেখানে পড়ে থাকার কোন সংযোগ আছে। ভালো হয় যদি কেউ পাওয়ার আগেই সেটা খুঁজে পাওয়া যায়।

সেইকি দ্রুত ওর জুতো পড়ে বাইরে গেল। পার্কটা খুবই কাছে, গাড়ি বের করার কোন মানে হয় না, দৌড়েই চলে যাওয়া যাবে।

কিন্তু বাইরে যাওয়ার আগে সে ঠিক করলে মেয়েটাকে কিছু কথা বলবে। গাছগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে পোর্চের সামনের অংশটায় গেল। দেয়ালের কাছে বাঁশের খুঁটিগুলোর সামনে গিয়ে থেমে গেল।

বাঁশের খুঁটিগুলোর ভেতর থেকে মেয়েটার হাসির শব্দ ভেসে আসছিল। ভাঙা রেকর্ডের মত সে অবিরাম হেসে চলছে।

ওদের সমস্ত আলোচনায় মেয়েটা কখনো নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করেনি। কখনো চিৎকার করেনি, বরং শান্তভাবে কথা বলেছে সেইকির সাথে, নিজের অনুভুতির উপর পুরোপুরি দখল বজায় রেখেছে, ভেঙে পড়েনি।

মাটির নিচের বাক্সের মধ্যে কি ভয় মেয়েটাকে পাগল করে ফেলল?

সে এতটা সময় এত চুপচাপ ছিল যে এখন এই হাসি ওর স্বভাবের সাথে মিলছে না। সেইকি কিছু বলার সাহস না পেয়ে সেখান থেকে সরে এল।

সেইকি যখন পার্কে পৌঁছাল ততক্ষণে দুপুর হয়ে গিয়েছে। পরিস্কার দিন হলে সূর্য এসময় মাথার উপর থাকত। কিন্তু আজকে ঘন মেঘগুলো সূর্য পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছে, সেই সাথে ঠান্ডা হাওয়া বইছে।

পার্কটা ছোট, ছিমছাম। আবাসিক এলাকাটার একদম মাঝখানে অবস্থিত।

পুরো জায়গাটা চেইন লিঙ্ক বেড়া দিয়ে ঘেরা যাতে বাচ্চা ছেলে পেলে দৌড়ে রাস্তায় গিয়ে না পড়ে। সেইকি সাইডওয়াক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পার্কের ভেতরে তাকাল। ভেতরে একটা ভোলা জায়গায় প্লে গ্রাউন্ড।

কেউ একজন দোলনায় বসে আছে। অন্যদিকে মুখ করে আছে বলে সেইকি ওর কালো পোশাকের পেছন দিক ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছে না।

আশেপাশে আর কোন জন মানুষ দেখতে না পাওয়ায় সেইকি স্বস্তি বোধ করল। ওর দুশ্চিন্তা হচ্ছিল যে পুলিশ হয়তো সেখানে হাজির হয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সেরকম কিছু দেখা গেল না। ওর আসল ভয় ছিল ওর আগে অন্য কেউ ওর আইডি কার্ডটা খুঁজে পাবে।

সাইডওয়াকের মাঝে মাঝে কিছুদূর পর পর গাছ লাগানো। রাস্তায় কোন গাড়ি ছিল না। একদম সুনসান, খালি রাস্তা।

বাতাস বইলেই শুকনো পাতাগুলো ঝরে পড়ছিল। উড়ে কোথাও যাচ্ছে, সেফ বৃষ্টির মত সোজা খসে পড়ছে। আগেরদিন পাতা পরিস্কার করা হলেও আজকেই সাইডওয়াকের প্রায় পুরোটা আবার ঝরা পাতায় ঢেকে গিয়েছে। রাস্তার উপর পাতা কম ছিল, কারণ গাড়ি গেলে পাতাগুলো বাতাসে উড়ে যায়। অবশ্য একখানে শুকনো পাতাগুলো স্তূপ করে রাখা ছিল।

গতরাতে যেখানে গাড়ি থামিয়েছিল সেখানে সেইকি খুঁজে দেখল। পাওয়া গেল না। হত পাতার নিচে কোথাও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। প্রচুর পাতা পড়ে ছিল সেখানে।

সেইকি হাঁটু গেড়ে বসে পাতা সরিয়ে খুঁজতে লাগল। পুরো সাইডওয়াক খোঁজার দরকার নেই, যেখানে ওর সাথে মেয়েটার ধস্তাধস্তি হয়েছিল সেটুকু জায়গা দেখলেই হবে। ওর মনে হচ্ছিল শিগগিরি আইডি কার্ডটা পাওয়া যাবে।

পাতাগুলো সরানোর সময় বাতাস এসে সেগুলোকে দূরে উড়িয়ে নিয়ে গেল। সেইকি সেদিকে চেয়ে মেয়েটার কথা ভাবতে লাগল।

বাক্সের ভেতরটা অন্ধকার। মেয়েটা যদি খুঁটির ফুটো দিয়ে তাকায় তাহলে একটা বিন্দুর মত আলো দেখতে পাবে। আর কোন আলো প্রবেশ করবে না। ঐ ছোট অন্ধকার বাক্সের ভেতর মেয়েটার শুয়ে শুয়ে নিজের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। অথচ সে দাবি করছে তার বয়ফ্রেন্ড তাকে একা মরতে দেবে না।

সেটা জেনে অবশ্য সেইকি কেঁপে উঠেছিল। ব্যাপারটা ওর মাথায় ঢুকছিল না, যে কারনে দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। মাটির নিচে একটা বাক্সে আটকা পড়ে থেকে কি করে তুমি কারো উপরে ভরসা করতে পার? কি করে আশা করতে পার কেউ তোমার সাথে অনন্তকাল সঙ্গ দেয়ার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবে?

গতকাল রাত পুরোটা সময় ওর মাথার ভেতর ঘোলাটে হয়ে ছিল। মাটির নিচে চাপা পড়া মেয়েটা কতখানি অসহায় হয়ে পড়ে আছে সেটা ভাবতেই ওর মনে আনন্দের ঢেউ জাগছিল। অনেকটা জিহ্বার উপর মধু ঢালার মত অনুভূতি। কিন্তু তারপর যখন এই কথাগুলো শুনল তখন মনে হল কেউ যেন এসে ওর গালে কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে।

মাথা ঘোরাচ্ছে, সেইকি হাঁটু গেড়ে শুকনো পাতাগুলোর উপর বসে পড়ল। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে, শুকনো পাতার স্তরগুলো দেখে ওর মনে হচ্ছিল যেন সাগরের বুকে জাগা ঢেউ। নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না, ফুসফুস যেন বাতাসের জন্য আকুলিবিকুলি করছে।

কবে থেকে সে এরকম জঘন্য সব কাজ করা শুরু করল যেন এগুলো ছেলের হাতের মোয়া?

একসময় তো সে একজন ভালো মানুষ, একজন সুনাগরিক ছিল। কঠোর পরিশ্রম করত, সবার সাথে ভালো ব্যবহার করত, দেখা হলে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাত, হাঁটতে গিয়ে কারো সাথে দেখা হলে থেমে কিছুক্ষণ আলাপ করত।

প্রতিবার কাউকে মাটিচাপা দেয়ার চিন্তা মাথায় এলেই সে যুদ্ধ করে চিন্তাটাকে তাড়িয়ে দিত। নিজেকে বলত, এরকম অন্যায় কাজ কারোরই করা উচিত নয়। আর ওর শুধু বাগানে গর্ত খুঁড়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। ও একজন মানুষ। কাউকে জ্যান্ত কবর দেয়ার মত জঘন্য নারকিয় কোন কিছু ও কখনো করতে পারে না…

কিন্তু যখন সে কৌসুকিকে জ্যান্ত কবর দিল আর পরে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলল, তখন যেন ওর ভেতরের কলকজাগুলোর কোন গুরুত্বপূর্ণ একটা নষ্ট হয়ে গেল। ভয়াবহ হলেও, অসহায় মেয়েটার উপর কর্তৃত্ব ফলানোয় ওকে নতুন এক অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এতদিন পর ওর নিজেকে জীবিত একজন মানুষ মনে হতে লাগল…কিন্তু এখনো কি ও নিজেকে মানুষ বলে দাবি করতে পারে?

মাখা ঘোরালেও সেইকি এক মুহূর্তের জন্যও পাতাগুলো সরিয়ে দেখার কাজে ক্ষান্ত দেয়নি, আইডি কার্ডটা খুঁজেই যাচ্ছিল। ওর মুখ থেকে ঘাম নাক বেয়ে টপ টপ করে শুকনো পাতাগুলোর উপর ঝরে পড়ছে।

হাজার খুঁজেও আইডি কার্ডটা কোথাও পাওয়া গেল না। মেয়েটার সাথে ধস্তাধস্তির জায়গাসহ আশেপাশে সব জায়গা খুঁজল, কোথাও নেই। সেইকি আবার প্যানিক করতে লাগল।

বাতাসে একটা খবরের কাগজ উড়ে এসে ওর পায়ে লাগল। ও উঠে দাঁড়িয়ে পা ঝাঁকিয়ে সেটা সরাল পা থেকে। সেই মুহূর্তে ওর খেয়াল হল কেউ একজন বেড়ায় মুখ লাগিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও আইডি কার্ডটা খোঁজায় এতটাই ব্যস্ত ছিল যে আগন্তুকের আগমন খেয়াল করেনি।

দূরের দোলনাটা খালি। ওখানে যে বসে ছিল সেই নিশ্চয়ই উঠে এসেছে।

বেড়ার ওপাশে যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে ছিল তাকে দেখে মনে হল হাইস্কুলের ছাত্র হবে। কালো ইউনিফর্ম পড়া, দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে সেইকির দিকে চেয়ে আছে। সেইকি অনুমান করল আজকে বোধহয় অর্ধদিবস স্কুল ছিল। স্কুলের পর ছেলেটা সম্ভবত এখানে এসেছে।

সেইকির সাথে ছেলেটার চোখাচোখি হলো, অস্বস্তিকর একটা নিরবতা। ছেলেটাই প্রথম কথা বলল, মাথা নিচে করে বো করে। “দুঃখিত, আমি শুধু,..ভাবছিলাম আপনি কি করছেন।”

সে নিশ্চয়ই দূর থেকে খেয়াল করেছে সেইকিকে।

“কিছু হারিয়েছেন বুঝি?” ছেলেটা প্রশ্ন করল।

“উমম,” সেইকি বিড়বিড় করল, কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। ও চাইছে ছেলেটা চলে যাক কিন্তু সেটা বললে অদ্ভুত দেখাবে। হয়তো ও উত্তর না দিয়ে নিজের কাজ করলে দেখবে ছেলেটা চলে গিয়েছে।

“আপনি কি আশেপাশেই থাকেন?” সেইকি উত্তর না দেয়ায় ছেলেটা প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ,”

“আপনার নামটা জানতে পারি কি?”

কোন চিন্তা না করেই ও ছেলেটাকে সত্যি নাম বলে দিল।

“সেইকি? কিছু না মনে করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি? প্রশ্নটা একটু অদ্ভুত, তবে..”

“অদ্ভুত প্রশ্ন?”

“আমি আপনার বেশি সময় নেব না। কালকে রাতের চিৎকারটার ব্যাপারে,..আপনি কি কিছু জানেন?”

সেইকির মনে হলো কেউ খপ করে ওর হৃদপিণ্ড চেপে ধরেছে।

“চিৎকার..? কিসের চিৎকার..?”

“গতকাল রাত্রে নয়টার দিকে কাউকে এখানে চিৎকার দিতে শোনা গিয়েছে। আশেপাশে থাকে এমন একজন আমাকে জানাল। কিন্তু মনে হচ্ছে আপনার বাসা এখান থেকে দূরে, বোধহয় শুনতে পাননি সেজন্য।” সেইকির প্রতিক্রিয়া দেখে ছেলেটা বলল।

সেইকি মাথা ঝাঁকাল, ছেলেটার বক্তব্যর সাথে একমত পোষণ করে।

“আসলে হয়েছে কি, আমার একজন ক্লাসমেট গতরাতে বাড়ি ফেরেনি। আজকে অর্ধদিবস স্কুল ছিল অথচ সে স্কুলেও আসেনি।”

সেইকি চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারল না। ছেলেটা ওর চেয়ে অন্তত দশ বছরের ছোট হবে, কিন্তু ওর চোখগুলো ভীতিকর লাগছিল সেইকির কাছে। সে টের পেল পোশাকের নিচে প্রচুর ঘামছে। ছেলেটা মেয়েটার কথা বলছে..

“আমার ক্লাসমেট এই রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করে প্রতিদিন, তাই আমি ভাবছিলাম গত রাতের চিল্কারের সাথে ওর কোন সম্পর্ক আছে কিনা..”

অবশ্যই আছে। সেইকি মেয়েটাকে জ্যান্ত কবর দিয়েছে। মেয়েটা কি তোমার ভালো বন্ধু?”

“আমার তো তাই ধারণা,” ছেলেটা একই সুরে উত্তর দিল। এই ছেলের কথাই কি মেয়েটা বলেছিল?

যেভাবে ছেলেটা উত্তর দিল তাতে তো মনে হচ্ছে, না। ছেলেটার ভাবসাব খুবই শান্ত, এমনভাবে মেয়েটার কথা বলছে যেন অপরিচিত কোন মানুষ। বিশ্বাস করা কঠিন যে তাদের মধ্যে গভীর কোন সম্পর্ক আছে।

“তো তোমার নিখোঁজ ক্লাসমেটের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা হচ্ছে বলে এখানে এসেছ?”

“আরে নাহ। ঘুরতে এসেছি বলতে পারেন।”

“ঘুরতে মানে..?”

“পুলিশ স্টেশনে শহরের একটা ম্যাপ টাঙ্গানো থাকে, লাল দাগ দেয়া।”

“যেসব জায়গায় ভয়াবহ এক্সিডেন্ট হয়?”

“হ্যাঁ, আপনি জানেন সেটার কথা? আমি ভেবেছি আমি ছাড়া কেউ জিনিসটা কখনো খেয়াল করেনি। আমার শখ হলো লাল দাগ দেয়া জায়গাগুলোর প্রত্যেকটায় ঘুরতে যাওয়া। যেখানে মানুষগুলো মারা গিয়েছিল, যেখানে ওদের জীবনের ইতি ঘটেছিল সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা, পায়ের নিচে রাস্তার পিচ অনুভব করা…এখানে আসার কারণও একই। সেই শখ। ভয়াবহ ঘটনা ঘটা জায়গাগুলো দেখতে যেতে আমার ভালো লাগে। আর আমার এমনও মনে হয়, যদি ভাগ্য ভালো থাকে তাহলে হয়তো সেই জায়গায় ঘটনাটা ঘটার দৃশ্য আবার দেখতে পাব।”

ছেলেটা পকেট থেকে হাত বের করে চেইন লিঙ্ক বেড়াটা ধরল। বেড়াটা কেঁপে উঠল, ধাতব ঝাঁকির শব্দ হলো। ছেলেটা সোজাসুজি সেইকির চোখে তাকিয়ে আছে।

কথাগুলো সেইকির হৃদস্পন্দন প্রায় থামিয়ে দিচ্ছিল। সে কি এই কারনে ওকে এসব কথা বলল কারণ ও মেয়েটাকে কিডন্যাপ করেছে তা জানে বলে? সেইকি চিন্তাটা বাতল করে দিল। প্রশ্নই আসে না।

কিন্তু ওর বুক ধুকপুকানি কমলো না, দুশ্চিন্তা দূর হলো না।

পাখির চিৎকারের শব্দে সেইকি উপরের দিকে তাকাল। একটা নিঃসঙ্গ কাক উড়ে যাচ্ছে ঠান্ডা ধূসর আকাশের ভেতর দিয়ে। কালো ঠেটিটা সোজা সেইকির দিকে তাক করা।

দাঁড়াও দাঁড়াও। সেইকির মাথায় একটা চিন্তা এল।

হতে পারে ছেলেটা ওর আইডি কার্ডটা খুঁজে পেয়েছে–আর মেয়েটার চিৎকারের সাথে সেটার সম্পর্ক অনুমান করে নিয়েছে। আর ধরে নিয়েছে কালপ্রিটটা আইডিটার জন্য এখানে আসবেই…

আর এখন সেটা লুকিয়ে রেখে ছেলেটা ওকে পরীক্ষা করছে। আসলেই কি এরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে?

“তো আমার এই নিখোঁজ ক্লাসমেট…আপনার কি ধারণা সে কোথায় থাকতে পারে?” ছেলেটা প্রশ্ন করল। আবারো সে ঠান্ডা চোখে সেইকির প্রতিক্রিয়ার উপর নজর রাখছে।

সেইকির ইচ্ছে করছিল ছুটে দৌড় দিতে। ছেলেটা বেড়ার ওপাশে আছে। ওকে ধরতে হলে, পার্কের ঢোকার গেট পর্যন্ত পুরোটা ঘুরে আসতে হবে ওকে। ততক্ষণে ও পালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে…ছেলেটা যদি সত্যি ওর আইডি কার্ড হাতে পেয়ে থাকে তাহলে পুলিশের কাছে গিয়ে সেইকির সন্দেহজনক ব্যবহার খুলে বললেই..

“আপনি কি কিছু জানেন নাকি এ ব্যাপারে?”

“না কিছু জানি না আমি।”

“ওহ আচ্ছা, আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো কিছু জানবেন।”

“কেন এরকম মনে হলো?…”

“হয়তো একটু বেশিই চিন্তা করছিলাম। কারণ আপনি বললেন আপনি চিৎকার শুনতে পাননি।”

“তো কি হয়েছে..?”

“ব্যাপারটা মিলল না। আমি শুধু চিল্কারের কথা বলেছি। কিন্তু যখন নিখোঁজ ক্লাসমেটের কথা বললাম, আপনি জানতে চাইলেন মেয়েটা আমার ভালো বন্ধু কিনা। মেয়েটা’, আমি একবারও বলিনি আমার ক্লাসমেট মেয়ে নাকি ছেলে। আপনি কী করে জানলেন, সে একজন মেয়ে?”

‘কারণ আছে। প্রতিদিন সকালে আমি এখান দিয়ে হাইস্কুলে পরে একটা মেয়েকে যেতে দেখি। আজকে দেখিনি। সেজন্য বললাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম তুমি তার কথা বলছ।”

ছেলেটা মাথা ঝাঁকাল। “একটা শুকনা মেয়ে, লম্বা চুল?”

“হ্যাঁ-ফ্যাকাসে ত্বক, বাম চোখের নিচে একটা তিল আছে, সেইকি মেয়েটার আইডি কার্ডে দেখা ছবিটা মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু আর কতক্ষন ওর এই কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে? বোঝাই যাচ্ছে ছেলেটা ওকে সন্দেহ করেছে। সেইকির অস্বস্তিবোধ আরও বেড়ে গেল। মনে হচ্ছিল কেউ একজন হাত দিয়ে ওর গলা পেঁচিয়ে ধরে ধীরে ধীরে চাপ বাড়াচ্ছে।

“আপনি ঠিক আছেন? আপনাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে।”

“গরমে কাহিল হয়ে পড়েছি।”

“দাঁড়ান, আমি আসছি।”

ছেলেটা বেড়া ছেড়ে হেঁটে পার্কের গেটের দিকে গেল। দোলনার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওর স্কুল ব্যাগ তুলে নিল কাঁধে। পার্ক থেকে বেরিয়ে সেইকির দিকে আসতে লাগল, চেহারা দেখে মনে হচ্ছে ওর অসুস্থতা নিয়ে চিন্তিত।

সেইকি ওর দুশ্চিন্তা থেকে সৃষ্ট ঘাম ফ্র থেকে মুছে ফেলল।

“গতকাল থেকে…শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে।”

“এরকম অবস্থায় আমার সাথে কথা বলার জন্য জোর করায় আমি ক্ষমা চাইছি। বলেছিলাম আপনার বেশি সময় নেব না, কিন্তু নিয়ে ফেলেছি…হয়তো আপনার কোথাও গিয়ে একটু বিশ্রাম নেয়া উচিত।”

“হ্যাঁ…” সেইকি এক মুহূর্ত চিন্তা করার ভান করল, তারপর জানা উত্তরটাই বলল। “আমার বাসাই মনে হয় সবচেয়ে কাছে হবে।”

সেইকি পরিকল্পনা করল কয়েক কদম হেঁটে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাওয়ার ভান করবে। ছেলেটা দৌড়ে আসবে ওকে ধরতে। সেইকি সেই সুযোগ নিয়ে ছেলেটাকে বলবে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে সাহায্য করতে। তারপর ছেলেটাকে খুন করে আস্তে ধীরে পকেট-টকেট চেক করে দেখা যাবে। কিন্তু অভিনয় করার কোন প্রয়োজন পড়ল না।

“আপনাকে সুস্থ দেখাচ্ছে না-আমি কি আপনাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিব?” ভ্রু কুঁচকে বলল ছেলেটা। তাহলে তো ভালোই হলো।

“ধন্যবাদ, খুব ভালো হয়। ওদিকে যেতে হবে…”

তারা একসাথে হাঁটতে লাগল। সেইকি মাঝে মাঝে কেঁপে উঠল। ওর আসলেই খারাপ লাগছিল তাই অসুস্থ অভিনয় করতে একটুও সমস্যা হল না।

হাঁটতে হাঁটতে সেইকি অনুমান করার চেষ্টা করল ছেলেটা কে হতে পারে। হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, আর এখন একসাথে হাঁটছে। বাসায় পৌঁছানোর পর সেইকি কি করবে? কিভাবে ছেলেটাকে খুন করবে?

সেইকির আবারো মাথা ঘোরাতে লাগল। সেই সাথে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে ছেলেটাকে অন্য শিকারগুলোর মত খুন করার পরিকল্পনা করতে শুরু করল।

ওর মনের ভেতরের একটা অংশ অনুনয় করতে লাগল এরকম ভয়ঙ্কর কাজ না করার জন্য। কিন্তু ছেলেটা যদি ওর আইডি কার্ডটা পেয়ে থাকে আর ওর সাথে মেয়েটার সম্পর্ক অনুমান করে থাকে তাহলে সেইকির সামনে আর কোন পথ খোলা নেই ওকে খুন করা ছাড়া। অন্যথায় সারা দুনিয়া ওর কৃতকর্মের কথা জেনে যাবে।

ওর অফিসের লোকজন যখন জানবে আসল সেইকি একজন পশু, তখন কি ভাববে? যেই লোক নিজের বাগান থেকে ফুল নিয়ে আসত অফিস সাজানোর জন্য সেই মানুষ তলে তলে একজন খুনি? একজন পশু যে কিনা থুথুরও যোগ্য নয়? এই খবর পেয়ে কি তাদের মন খারাপ হবে? তারা কি রাগান্বিত হবে? ওদের কথাবার্তা যেন সেইকির কানে ভোলো করতে লাগল, লজ্জায় সেইকি মুখ তুলে তাকাতে পারছিল না, লজ্জার শিখাগুলো যেন জ্বলে উঠে ওকে গ্রাস করে নিতে চাইছিল।

এরকম কোন কিছু সে কিছুতেই হতে দিতে পারে না। ছেলেটাকে মরতেই হবে। সেইকি চোখগুলো চেপে বন্ধ করে রাখল, নিজেকে বার বার এই কথাটা বলতে লাগল, কান্না আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করল।

অল্প সময়েই ওরা বাড়ির কাছে পৌঁছে গেল। রাস্তায় আসতে আসতে ওরা কি কথা বলেছিল তা সেইকির মনে নেই, জরুরি কিছু ছিল না মনে

“সুন্দর বাড়ি,” ছেলেটা সামনে তাকিয়ে বলল।

“হ্যাঁ কিন্তু পুরোনো। আসো ভেতরে আসো।”

গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল ওরা। গাড়ি আসা যাওয়ার সুবিধার্থে গেটটা সবসময় ভোলাই থাকে। ছেলেটা ড্রাইভওয়েতে থেমে গেল, বাড়ির পাশের গ্যারেজটার দিকে চেয়ে আছে। গ্যারেজের দরজাগুলোও খোলা, আর একটা কালো গাড়ি ওদের দিকে মুখ করে আছে। সেইকি গাড়িটার পেছনের সিট থেকে মেয়েটার সব চিহ্ন পরিস্কার করে ফেলেছিল। কোথাও কোন রক্ত নেই, কোন চুল নেই, একদম কিছু নেই। তারপর গ্যারেজের দরজা খোেলা রেখে গিয়েছিল।

“আপনার কি একটাই গাড়ি? আপনি কি পুরো বাড়িতে একাই থাকেন নাকি?”

“হ্যাঁ।”

ছেলেটা বাগানের উপর চোখ বুলাল।

“অনেক গাছ তো?”

“গাছ লাগানো আমার শখ। এটা আমার ব্যক্তিগত ছোট বন।”

তারপর ওর অনুমতি নিয়ে ছেলেটা বাগানের দিকে গেল। সেইকিও পেছন পেছন গেল।

মেঘলা আকাশের নিচে সেইকির জন্মানো সবকিছু গাঢ় সবুজ দেখাচ্ছিল। ছেলেটা এক সারি চিরহরিৎ গাছ পার হলো, মনে হলো মুগ্ধ। “বাগানটা বেশ বড়।”

চিরহরিৎ গাছের সারির পর বাগানের খোলা জায়গা যেটা বাড়ির দক্ষিণ দিকের অংশ, পোর্চ আর দেয়ালের মাঝামাঝি অবস্থিত। অনেকগুলো ফ্লাওয়ার বেড পাথর দিয়ে ফ্রেম করা ছিল, কিন্তু ভেতরে খালি। চারা নেই, শুধু শুকনো মাটি।

দেয়ালের কাছে কিছু বাঁশের খুঁটি পোঁতা, যেখানে মর্নিং গ্লোরি লাগানো হয়েছিল, এখন খালি খড়কুটো পরে আছে। আর সেগুলোর নিচে…

“এখানে কোন গাছ নেই?”

“পোর্চ থেকে দেখার জন্য খালি রাখা,”

…সেগুলোর নিচে আছে মেয়েটা…আর কৌসুকির অবশিষ্টাংশ যদি কিছু থেকে থাকে।

বাঁশের খুঁটিগুলো দেয়ালের সাথে সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে, নড়ছে না। ছেলেটা ওগুলোর দিকে তেমন একটা মনোযোগও দেয়নি, ভেবেছে বাগানেরই অংশ। কিন্তু মেয়েটা যদি নিচ থেকে খুঁটি ধরে নাড়ায়? ছেলেটা হয়তো অবাক হয়ে কি হচ্ছে তা দেখতে যাবে।

তার আগেই সেইকির ব্যাপারটা থামাতে হবে। সে ছেলেটাকে বলল পোর্চে বসতে।

“আমি চা বানিয়ে আনি,” বলে সেইকি পোর্চে উঠে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।

“কে জানে মোরিনো কোথায় উধাও হল..” ছেলেটা বিড়বিড় করে বলছে ও শুনতে পেল। সেইকি জমে গিয়ে ছেলেটার দিকে পেছন থেকে তাকাল।

“আমি বোঝাতে পারব না ব্যাপারটা, কিন্তু ওর ভেতর কি যেন একটা আছে…কিভাবে যেন সবসময় অদ্ভুত মানুষদের আকর্ষণ করে,” ছেলেটা সেইকির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল। ব্যাপারটা নিশ্চিত যে কথাগুলো বিড়বিড়িয়ে বললেও ছেলেটা চাইছিল সে শুনতে পাক। ওর ঐ চারপাশের ‘কি যেন’ এর কারনে অস্বাভাবিক লোকজন ওর পিছু নেয়।”

“এক মিনিট-আমি চা নিয়ে আসছি,” সেইকি ছেলেটাকে বলে চলে এল। ও নিশ্চিত না ছেলেটা ইচ্ছা করেই বিষয়টা তুলে আনল কিনা, তবে ওর কথার সুরে নিশ্চিত একটা অশুভ ব্যাপার লুকিয়ে ছিল।

কিচেনে গিয়ে চায়ের জন্য পানি গরম করতে করতে সেইকি ড্রয়ারে রাখা কিচেন নাইফগুলোর দিকে তাকাল। খুন করার জন্য আর কোন অস্ত্র ওর মাথায় আসছে না।

গ্যাস স্টোভের নীলচে আগুনে কেটলির পানি গরম হতে শুরু করল। একটা ট্রে তে কাপ আর টিপট নিল। ছুরিটা সেগুলোর পাশে রাখল। ছুরিটার ব্লেডের ধাতব উজ্জ্বলতায় ও কল্পনা করার চেষ্টা করল যে ছুরিটা ও পোর্চে বসে থাকা ছেলেটার পিঠে বসিয়ে দিচ্ছে।

সিঙ্কের কোনায় ভর দিয়ে সেইকি ভারসাম্য ঠিক রাখল, নাহলে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে মনে হচ্ছিল। মেয়েটাকে কবর দেয়ার পর যে আনন্দ হয়েছিল তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ওর মনে। বরং ওর মনে হচ্ছিল যেন কোন ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখছে। যা কিছু সে দেখছে, যা কিছু স্পর্শ করছে সবকিছু পচে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার আসলে সে নিজেই। কৌসুকিকে খুন করেছে ও, মেয়েটাকেও জ্যান্ত কবর দিয়েছে। এখন এই ছেলেটাকেও কুপিয়ে হত্যা করতে চলেছে। মেয়েটার তার বয়ফ্রেন্ডের উপর বিশ্বাসের সাথে তুলনা করলে ওর নিজের হৃদয়ের অবস্থা করুণ। ওর দুঃস্বপ্নের শুরু হয়েছে আসলে কৌসুকিকে খুন করার পর থেকেই।

কিংবা হয়তো ও এই দুঃস্বপ্নে জড়িয়ে গিয়েছে জন্ম নেয়ার পর থেকেই। যে মুহূর্তে ও ওর জীবন পেয়েছে, তখনই হয়তো ওর আত্মা কোনভাবে খুন করার লিপ্সায় আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

পানি ফুটে গিয়েছে, কেটলির মুখ দিয়ে বাষ্প বের হচ্ছে। সেইকি চুলা বন্ধ করতে গিয়ে উপলদ্ধি করল..

কৌসুকি…

বাস্প বেড়ে গেল, কেটলির ভেতর উন্মত্ত হয়ে পানি ফুটছে।

কৌসুকির চেহারা কেমন ছিল দেখতে..?

সেইকি কিছুতেই ওর চেহারা মনে করতে পারছিল না। বাচ্চা ছেলেটাকে ও খুন করেছে। ওর সাথে কতবার পার্কে খেলেছে, কিন্তু কিছু মনে পড়ছে না। যেন লাশ মাটির সাথে মিশে যাওয়ায় ওর স্মৃতিও হারিয়ে গিয়েছে সাথে সাথে।

সেইকির সমস্যাটা কোথায় আসলে? উত্তরটা ওর জানা নেই। ওর কিছু অংশ ছিল একজন ভালো মানুষের, যে কিনা সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে। আর কিছু অংশ ছিল দানবের, যে জীবন্ত মানুষ কবর দিয়ে মজা পায়। এই দুই অংশ নিজদের মধ্যে যুদ্ধ করে মাল্টিপল পারসোনালিটির মত। অথচ তারা ভিন্ন ভিন্ন মানুষ নয়-তারা একসাথে যুক্ত, একই মানুষ।

কিন্তু সে ক্ষেত্রে ও আসলে কোন মানুষটা। কোন মানুষটা ও ভাবত ও ছিল? ও আর নিজেকে বিশ্বাস করতে পারে না এখন। তাহলে ও কিসে বিশ্বাস করবে?

ট্রে থেকে ছুরিটা হাতে নিল সেইকি। হাত কাঁপছে ওর…

স্টোভটা নিভিয়ে পটটা ভরল ও। তারপর পোর্চে বসে থাকা ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল।

সেইকি নিঃশব্দে হাটে। কোনায় পৌঁছুতে ও পোর্চে বসা ছেলেটার পিঠ দেখতে পেল, বাগানের দিকে মুখ দিয়ে বসে আছে। ছেলেটার কানে সেল ফোন ধরা। সে কি পুলিশকে ফোন করছে? এক মুহূর্তের জন্য সেইকি আতংকিত হয়ে পড়ল।

নিঃশব্দে সামনে এগুলো ও।

ছেলেটার ফোনে কথা বলা ওর কানে আসছিল। কথা বলার ভঙ্গি থেকে ও বুঝতে পারল, পুলিশ নয় কোন বন্ধুর সাথে কথা বলছে সে।

ছেলেটার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে পায়ের নিচের তক্তা ক্যাচকোচ করে উঠল।

ছেলেটা ঘুরে তাকিয়ে ফোন কেটে দিল। “সেইকি, এত সময় লাগল যে! আপনাকে আরো অসুস্থ দেখাচ্ছে এখন..”

সেইকি ছেলেটার পাশে ট্রেটা নামিয়ে রাখল। “হ্যাঁ, আসলে…আমার বেশ মাথা ঘোরাচ্ছে..” কাপে চা ঢালল।

মনের ভেতরে বাস করা দানবটাকে দমিয়ে রাখতে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। কাপটা ছেলেটার হাতে দিয়ে ও মনস্থির করতে লাগল।

ছুরিটা সে কিচেনে রেখে এসেছে। কৌসুকির চেহারা যখন ও আর মনে করতে পারল না তখন বুঝল ওর আর কিছু করার নেই। দুঃস্বপ্ন থেকে পালিয়ে যাওয়ার এটাই একমাত্র উপায় ওর সামনে।

কাপটার ফ্যাকাসে সবুজ তরল থেকে সাদা ধোঁয়া উঠছিল। ছেলেটা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, তারপর চুমুক না দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখল।

“সেইকি, সুখবর আছে,” ছেলেটা জোরে শ্বাস ফেলল, ওকে দেখে মনে হলো স্বস্তি বোধ করছে। “মোরিনো কালকে নিখোঁজ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু একটু আগে সে বাড়ি ফিরে এসেছে।”

দেয়ালের ঘড়ি মাঝরাতের জানান দিল যখন, সেইকি তখন নিজের রুমে আলো নিভিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিল। ওর সারা শরীর কাঁপছিল। সূর্যাস্তের আগে থেকেই এরকম অবস্থা। এখন আর ও বলতে পারবে না গরম লাগছে নাকি ঠান্ডা লাগছে…অথবা জীবিত আছে নাকি মরে গেছে।

ঘড়ির বড় কাটা শব্দ করে আরেক ঘর এগুলো। সেই মুহূর্তে জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঠিক জায়গায় গিয়ে পড়ল। সাদা আলোয় সবকিছু চকচক করছে। আলো চোখে পড়তেই অবশেষে মনস্থির করে উঠে পড়ল সেইকি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গ্যারেজে ঢুকে কোদাল নিল। আর একটা ক্রোবার, কফিনের ঢাকনা খোলার জন্য। তারপর বাগানে গেল।

পৃথিবী আঁধারে পুরোপুরি নিমজ্জিত না হওয়া পর্যন্ত ও অপেক্ষা করছিল। দিনের বেলা হলে ওর ভয় ছিল কেউ হয়তো দেয়ালের ওপাশ থেকে দেখে ফেলবে ও কি করছে। কিন্তু যতই ও অপেক্ষা করছিল রাতের জন্য ততই ওর কল্পনা ওকে কাবু করে ফেলেছে, পাগল বানিয়ে ফেলেছে ওকে। ভয়ে কাবু হয়ে ও প্রায় জ্ঞান হারাতে বসেছে, কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই ছয় ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছিল।

চিরহরিৎ গাছগুলো পার হয়ে ও খোলা জায়গাটায় হাজির হলো। দেয়ালের সাথে বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকিয়ে পা বাড়াল সামনে। হাতের পেছন দিকটা ব্যথা করছে, ঠিক যেখানে গত রাতে মেয়েটা আঁচড় দিয়েছিল।

সেইকি বুক সমান বাঁশের খুঁটিগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল, খুঁটিগুলো মেয়েটার কফিনের সাথে সংযুক্ত। সেইকির হাত এত ব্যথা করছিল মনে হচ্ছিল কেটে রক্ত বের হচ্ছে।

ও কোদাল দিয়ে কুপিয়ে গর্ত খুঁড়তে শুরু করল।

অন্ধকারে কাজ করছিল, কেউ যাতে টের না পায়। আর সারাদিন আকাশ জুড়ে মেঘ থাকলেও, রাতে আকাশ একদম পরিস্কার। ঠিক গত রাতের মতই চারপাশ চাঁদের ফ্যাকাসে আলোতে স্নান করছে। রাস্তা থেকে কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না, আর ও নিজেও নিরবে কাজ করে যেতে লাগল। একমাত্র শব্দ আসছিল মাটির উপর কোপ পড়া ওর কোদাল থেকে। ওর তখনও মাথা ঝিমঝিম করছে। জ্বর হলে শরীর যেমন দূর্বল লাগে সেরকম লাগছে। গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে ও মনে করার চেষ্টা করল ছেলেটা পোর্চে বসে কী বলেছিল।

“শুনে মনে হলো ওর উপর দিয়ে কঠিন সময় গিয়েছে, কিন্তু এখন ও ঠিক আছে, নিরাপদে আছে। মাত্রই ফোনে কথা বললাম। ওর বাসায় যাচ্ছি এখন-আমাকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”

চা ঠান্ডা হওয়ার আগেই ছেলেটা কথাগুলো বলে উঠে বো করে তারপর বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো।

সেইকি প্রায় পলক না ফেলে ছেলেটার কথা শুনল, কথাগুলোর অর্থ ওর মগজে প্রবেশ করছিল না। কি বলছে এসব? কোনভাবেই মেয়েটার পক্ষে মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।

ছেলেটা বেরিয়ে যাওয়ার আগে সেইকির এরকম ধাঁধায় পড়া চেহারা খেয়াল করল না।

সেইকি পোর্চ থেকে নেমে জুতো পড়ে ওর পিছু পিছু গেল।

“মেয়েটা…মেয়েটা বাসায় ফিরে এসেছে..?”

অবশ্যই মিথ্যা কথা হবে। কিন্তু প্রশ্নটা না করে ও পারল না।

“হ্যাঁ। কথা শুনে মনে হলো এখনো শকের মধ্যে আছে। চিন্তা করবেন না, আশা করছি সে তাড়াতাড়িই ধকল কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।”

ছেলেটা গেট দিয়ে বের হয়ে পার্কের দিকে এগিয়ে গেল।

সেইকি গেট পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেল। গেটে হাত রেখে ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করতে করতে ছেলেটার চলে যাওয়া দেখল।

ছেলেটা চৌরাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে মোড় নেয়ার সময় কাকে যেন হাত নাড়ল। সেইকির ওখান থেকে দেখা যাচ্ছিল না অন্য মানুষটিকে। পরের মুহূর্তেই মানুষটি রাস্তার কোনা থেকে এসে ছেলেটির পাশে দাঁড়াল। লম্বা চুলের মেয়েটিকে এক নজর দেখেই সেইকি চিনে ফেলল।

চিনে ফেললেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না ও। হা করে মেয়েটার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকল-সুন্দর চেহারা, ফ্যাকাসে রঙের তৃক। এই মেয়েকে সে গতকাল নিজ হাতে জ্যান্ত কবর দিয়েছে। ছেলেটার সাথে কথা বলছিল মোরিনো।

সেইকি কি স্বপ্ন দেখছে? ওর এত মাথা ঘোরাচ্ছে যে আশেপাশের বাড়িঘর, টেলিফোনের খাম্বা সব নড়তে লাগল। রাস্তা আর দেয়ালগুলো পুকুরের পানিতে সৃষ্ট ঢেউয়ের মত নড়াচড়া করছে…

ও বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকাল, যেখানে মেয়েটাকে কবর দিয়েছে। সেখানে দৌড়ে গেল এবার। যে মুহূর্তে সেইকি ওদের থেকে চোখ ফেরাল, ছেলেটা ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে আছে কিন্তু সেইকির মাথায় তখন একমাত্র চিন্তা কবরটাকে নিয়ে।

মেয়েটাকে যেখানে কবর দিয়েছে সেখানে গিয়ে বাঁশের খুঁটি দিয়ে কথা বলল সেইকি। কোন উত্তর পেল না। নিচ থেকে কোন শব্দ এল ভেতর দিয়ে খালি গাঢ় অন্ধকার দেখা যাচ্ছিল।

মেয়েটা নিশ্চয়ই পালিয়েছে।

না, সেইকি এই ধারনাটা বাতিল করে দিল। কবরের মাটি এদিক ওদিক হয়নি। তাহলে…তাহলে সে কাকে কবর দিয়েছে..?

বাঁশের খুঁটি দিয়ে সে কয়েকবার ডাকল, অন্ধকার নেমে আসা পর্যন্ত। কিন্তু মেয়েটা একবারও উত্তর দিল না। অনেক মাথা ঘামিয়েও সেইকি এই রহস্যের কোন অর্থ বের করতে পারল না। এক পর্যায়ে গিয়ে ও সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে রাত গম্ভীর হওয়ার পর ঢাকনা খুলে দেখছে।

চাঁদের আলোয়, মাটিতে কোদালের কোপ পড়া ছাড়া আর কোন শব্দ ছিল না। সেইকি ওর পুরো মনোযোগ কাজের মধ্যে ঢেলে দিয়েছিল। বনের কালো দেয়ালগুলো মনে হচ্ছিল চারপাশ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে কাজ কারবার দেখছে। রাতের ভ্যাপসা বাতাসে চিরহরিৎ গাছগুলো থেকে ভেসে আসা গন্ধ আরো জোরালো হয়ে নাকে এসে লাগছিল।

সেইকি অনুভব করছিল যে মাটি কেটে কোদাল ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। কোদাল টেনে তোলার সময় মাটির ভারও টের পাচ্ছিল। কিন্তু ওর মনে হচ্ছিল ও যেন কোন দুঃস্বপ্নের মধ্যে আটকা পরে গিয়েছে। সেই একই কাজ অনন্তকাল ধরে করে যাচ্ছে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। একসময় ওর বিশ্বাস হচ্ছে না যে, ও আসলেই বাস্তব পৃথিবীতে অবস্থান করছে কিনা। সে হয়তো মনুষ্যরুপি কোন কিছু যা আঁধারের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে কোনভাবে আর অনন্তকাল ধরে মাটি খুঁড়ে যাচ্ছে।

ওর হাত ব্যথা করতে লাগল। ও নিশ্চিত যে ওর হাতে মেয়েটার খামচে দেয়া দাগগুলো কোন অভিশাপ বয়ে এনেছে।

ওর পায়ের তলে আসলে কি মাটি চাপা দেয়া ছিল? যত গর্ত বড় হতে লাগল তত ওর আত্মবিশ্বাস কমতে লাগল। গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। প্রতি কোপে মাটি তোলার পর ওকে কাঁধ দিয়ে চোখ মুছতে হচ্ছিল দৃষ্টি পরিস্কার করার জন্য। যে জিনিসটা মটিতে কবর দেয়া হয়েছে সেটার কথা ভাবতেই ওর আতংক বোধ হচ্ছিল। ওর করা জঘন্য অপরাধ আসলে সেখানে শুয়ে আছে। ওর মনে হচ্ছিল সেটা কোন আয়নার মত কিছু একটা হবে, ওর ভেতরে লুকিয়ে থাকা অমানুষটার প্রতিফলন মাত্র।

সেইকির মনে হচ্ছিল ও অনন্তকাল ধরে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এক সময় কাজ শেষ হলো। যে কাঠের বাক্সটা ও বানিয়েছিল সেটা একসময় গর্তের ভেতর দেখা দিল। গর্তের চারপাশ তখন সাদা কুয়াশা আর মাটির ঘ্রাণ ঘিরে রেখেছে, চাঁদের ফ্যাকাসে আলোতে স্নানরত। ঢাকনাটা পেরেক দিয়ে আটকানো ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল না খোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকনার উপর বৃদ্ধাঙ্গুলির সমান দুটো গর্ত। বাক্সটা ওর আতংক বাড়িয়ে দিল। মনে হচ্ছিল যেন কোন ঠান্ডা অন্য জগতের থেকে আসা কোন বস্তু। ফোঁপাচ্ছে। সেইকি ক্রোবার দিয়ে ঢাকনাটা ভোলা শুরু করল।

প্রথম যে জিনিসটা ওর ইন্দ্রিয়তে ধরা পড়ল তা হল রক্তের গন্ধ। গন্ধটা এত জোরালো ছিল যে ওকে ধাক্কা দিয়ে পিছে সরিয়ে দিল। তারপর ও দেখল একটা ইউনিফর্ম পরা মেয়ে শুয়ে আছে। পিঠ নিচে রেখে হাত দুটো বুকের উপর রাখা। মুখটা একদিকে বাঁকানো, আর পুরো বাক্স গাঢ় একধরনের তরলে ডুবে আছে।

রক্ত! মেয়েটার গলা থেকে বের হওয়া রক্ত। ওর হাতে একটা মেকানিক্যাল পেন্সিল ধরা। ঠিক যেমনটা সে বলেছিল, পেন্সিল গলায় ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

রক্ত নিশ্চয়ই ফোয়ারার মত ছিটকে বেরিয়ে ঢাকনায় লেগেছে। সেইকি গর্ত থেকে সরে গিয়ে নিজের গালে চড় লাগাল। বাগানের দেয়াল ধরে কাঁপতে লাগল। হাটুগুলো আর ওর শরীরের ভার বহন করতে পারছে না, বসে বমি করে ফেলল ও। সারাদিন কিছু না খাওয়ায় এসিড রস ছাড়া আর কিছুই বের হল না পেট থেকে।

“আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন, মেয়েটা মোরিনো ইয়োরু নয়..”

কথাগুলো কানে আসতেই সেইকি ভয়ে কেঁপে উঠল। প্রথমে ও ভেবেছিল কথাগুলো ওর নিজের মাথা থেকে এসেছে কিন্তু কথাগুলো আসলে বলেছিল সকালে যে ছেলেটার সাথে ওর দেখা হয়েছিল।

“সেইকি, আপনি সেফ ওকে মোরিনো ভেবেছিলেন।”

কারো পায়ের শব্দ সেইকির কানে এল। সেইকি মুখ উঁচু করে দেখতে পেল কুয়াশার ভেতর থেকে একটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো পেছন দিকে থাকায় অবয়বের চেহারা দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু তারপরেও সেইকি নিশ্চিত ছিল অবয়বটা ঐ ছেলেটা ছাড়া আর কেউ নয়।

দূর থেকে আরেকজনের পায়ের শব্দ আসতে শোনা গেল। চিরহরিৎ গাছগুলোর আড়ালে আরো কেউ একজন ছিল। তারা দুজন সেইকিকে পাশ কাটিয়ে কবরটার দিকে গেল। অন্য ছেলেটিও একই বয়সেরই হবে খালি একটু লম্বা আর গাট্টাগোট্টা ধরনের। সেইকি চাঁদের আলোতে ছেলেটার মুখ দেখলেও চিনতে পারল না।

কি হচ্ছে এখানে? সেইকি কিছু বুঝতে পারছিল না। এটা কি বাস্তব নাকি ও কোন স্বপ্ন দেখছে? নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব ছিল না সেইকির পক্ষে। সেইকি দেখল লম্বা ছেলেটা মাথা ঝাঁকাল আর কাঁদতে লাগল।

“ও আমাদের ক্লাসমেট। যে মেয়েটাকে আপনি কবর দিয়েছিলেন সে ছিল ওর গার্লফ্রেন্ড। ওর নাম…।”

ছেলেটা যে নাম বলল সেটা সেইকি আগেই শুনেছিল।

“ওহ…তাহলে ও হলো সেই ছেলে…”

মেয়েটা যে ছেলের নাম বলেছিল।

ছেলেটা গর্তে নেমে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। সেইকি খালি ওর পিঠ দেখতে পাচ্ছিল। ছেলেটা মেয়েটার নাম ধরে ডাকছিল। সেইকি দেখল ওর পিঠ কাঁপছে, সম্ভবত মেয়েটার কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছিল ছেলেটা।

মেয়েটার সাথে কথা বলছিল সে। প্রথমে আস্তে আস্তে, যেন মনে হচ্ছিল মেয়েটা ওর সাথে মজা করছে-কিন্তু পরে যখন দেখল মেয়েটা একদমই উত্তর দিচ্ছে না, ওর গলার স্বরও পাল্লা দিয়ে জোরালো হতে লাগল।

“যে মেয়েটাকে দেখলেন ওর চেহারায় কোন তিল ছিল?” সকালের ছেলেটা জিজ্ঞেস করল। সেইকি মাথা নাড়ল।

“সকালে যখন আপনি বললেন একটা মেয়েকে আপনি প্রতিদিন রাস্তায় দেখেন কিন্তু আজকে দেখেননি…মেয়েটার চোখের নিচে একটা তিল আছে। তখনই আমি আপনাকে সন্দেহ করি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি মোরিনো আর এই মেয়েটার মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছেন।”

“কিন্তু মেয়েটার ব্যাগে একটা আইডি কার্ড ছিল..”

“মোরিনো ওর কার্ডটা হারিয়ে ফেলেছিল। আর এই মেয়েটা কার্ডটা পেয়ে মোরিনোকে ফেরত দিতে যাচ্ছিল। মোরিনো আজকে সকালে স্কুলে আমাকে বলেছে সেটা। সেজন্যই আমি বুঝেছি যে আপনি ছবি দেখে তিলের কথা জেনেছেন। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো ওকে গাড়ি চাপা দিয়েছেন, চেহারা বোঝার উপায় ছিল না তাই ছবি দেখে আন্দাজ করে নিয়েছেন তিলটার কথা।”

সেইকি নিজের হাত দুটোর দিকে তাকাল। যখন ও মেয়েটাকে গাড়িতে ঢোকাচ্ছিল তখন মার খেয়ে মেয়েটার চেহারার অবস্থা এমনিতেও ভয়াবহ ছিল। আর কফিনে ঢুকানোর সময় ও ভালো করে মেয়েটার দিকে তাকায়নি। ধরেই নিয়েছিল আইডি কার্ডের মেয়েটা আর এই মেয়েটা একই মেয়ে।

ধীরে ধীরে সেইকি ও ওর ভুলের পরিধি অনুভব করতে শুরু করল। ঐদিন সকালে মেয়েটা কেন পাগলের মত হাসছিল? এখন সেইকি বুঝতে পারছে মেয়েটা হাসছিল কারণ ও মেয়েটাকে আরেকজনের নামে ডেকেছিল। সেইকির ভুল ধরতে পেরে সে হাসছিল।

সেইকি গর্তের দিকে তাকাল। মেয়েটার পাশে বয়ফ্রেন্ডটা বসে আছে। সেইকি ওদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না। ওদের প্রেমের গভীরতা সম্পর্কে ওর কোন ধারণা ছিল না। কিন্তু ওর সাথে মেয়েটার যেটুকু কথা হয়েছিল তা থেকে কিছুটা আঁচ করেছিল। ঐ ছোট অন্ধকার জায়গাটায় চাপা পড়লেও মেয়েটা কখনো সেইকির কাছে হার মানেনি। মেয়েটার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ছেলেটা ওকে উদ্ধার করতে আসবে।

ছেলেটা ওর পাশে বসে আছে এখন। আর কোন কথা বলছে না, চুপ করে কফিনের দিকে তাকিয়ে আছে।

“সেইকি, আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি মেয়েটাকে আপনার বাড়িতে কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন কিন্তু তখন আমার কোন ধারণা ছিল না কোথায় লুকিয়েছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে আপনি দেখলেন মোরিনো বেঁচে আছে, ঘোরাফেরা করছে, আপনার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বাগানের দিকে তাকালেন। তারপর সেখানে ছুটে গেলেন। তখন আমি আন্দাজ করে নিলাম যে আপনি ওকে বাগানে কোথাও মাটি চাপা দিয়েছেন।”

ছেলেটা মোরিনো ইয়োরুকে ইচ্ছা করেই ওর সেলফোন থেকে ফোন করেছিল, সেইকির কি প্রতিক্রিয়া হয় তা দেখার জন্য। আর প্রতিক্রিয়া দেখেই সে বাগানের ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিল।

“তুমি…”

সেইকি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও কথা হারিয়ে ফেলল। কে এই ছেলে? ক্লাসমেটের জন্য প্রতিশোধ নিতে আসা কেউ? কিন্তু ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গিতে কোন রাগের চিহ্ন ছিল না, ছিল না

সেইকির অপরাধের প্রতি কোন ধিক্কার। একদম শান্ত, নরম গলায় কথাগুলো সে সেইকিকে বলছিল।

এই ছেলের সাথে দেখা না হলে হয়তো ওর অপরাধ কোনদিন ধরা পড়ত না। কেন এই ছেলে এসবের সাথে জড়িয়ে পড়ল?

তখন ওর আইডি কার্ডের কথা মনে পড়ল। আইডি কার্ড খুঁজতে গিয়েই ছেলেটার সাথে দেখা।

“আমার আইডি কার্ড…ওটার কি হল?” সেইকি জিজ্ঞেস করল।

ছেলেটা মাথা নাড়ল। “ও, আপনি তাহলে আইডি কার্ড খুঁজছিলেন সেখানে?”

ছেলেটা ওর আইডি কার্ড দেখেনি।

“তোমার কাছে না থাকলে ওটা কোথায় গেল..?”

“শেষ কখন দেখেছেন সেটা?”

“অফিসে, আমার জ্যাকেটের পকেটে.” তারপর হয়তো…সে মুহূর্তে আরেকটা আইডিয়া ওর মাথায় এল।

“তুমি একটু ওর জামাকাপড় পরীক্ষা করে দেখবে.. সেইকি মেয়েটার দিকে আঙুল তুলে ইশারা করল। কবরটার কাছে যাওয়ার কোন ইচ্ছা ওর নেই। “হয়তো ওর কাছেই আছে আইডি কার্ডটা।”

গাড়ির ভেতর ও মেয়েটাকে ওর জ্যাকেট দিয়ে ঢেকে রেখেছিল, আর মেয়েটার যদি আগেই জ্ঞান ফিরে থাকে…

ছেলেটা সেইকির পাশ থেকে সরে গিয়ে নিশ্চুপ বয়ফ্রেন্ত্রে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর বুকে মেয়েটার পকেটগুলো হাতড়ে দেখল।

“এই যে এখানে,” সে সোজা হয়ে বলল, হাতে আইডি কার্ডটা। আর এই যে ওর নিজের আইডি কার্ড। স্কার্টের পকেটে ছিল।”

কার্ড দুটো সে সেইকির হাতে দিল।

তার মানে সারাটা সময় আইডি কার্ডটা মেয়েটার কাছে ছিল। সে হয়তো আইডি কার্ডটা নিয়েছিল ওর পরিচয় জানতে। পরে বাক্সের ভেতর নিজের সাথে রেখেছিল কোনদিন লাশ পাওয়া গেলে যাতে খুনিকে চিহ্নিত করা যায়। ওর এইসব কাজই সেইকির জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে এনেছিল।

মেয়েটা মাটির তলে থেকেও ওকে খেলায় হারিয়ে দিয়েছে। যে মুহূর্তে ও তাকে কবর দিয়েছে সেই মুহূর্তেই নিজের অজান্তে ফাঁদে পা দিয়েছে।

“সেইকি, আপনি..” ছেলেটা ওর আইডি কার্ডের দিকে তাকিয়ে আছে।

সেইকি বুঝতে পারছিল ছেলেটা কি ভাবছে। সেইকি হাঁটুর সাথে মাথা লাগিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল।

“হ..হ্যাঁ,”

ও চায়নি কেউ ব্যাপারটা জানুক।

সেইকি মুখ তুলে ছেলেটার দিকে তাকাতে পারছিল না। ছেলেটার দৃষ্টি ওর শরীরে যন্ত্রণা সৃষ্টি করছিল। লজ্জায় ওর মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল।

ছেলেটা দেখে ফেলেছে যে আইডি কার্ডটায় বিভাগীয় পুলিশ ডিপাটমেন্টের নাম সোনালি অক্ষরে লেখা। সেই সাথে সেইকির ছবি আর র‍্যাঙ্কও লেখা।

এরকম হওয়ার কথা ছিল না। সেইকি অনেক পরিশ্রমী ছিল, লোকজন ওকে বিশ্বাস করত। ও যখন টহল দিত তখন সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ করত। কৌসুকির বাবা-মা ওকে নিজেদের সন্তানের মত বিশ্বাস করতেন। একটা সময় ছিল যখন ও বিশ্বাস করত ওর মত দয়ালু মানুষের এ পেশায় আসা উচিত। আর এখন ও আইনের সাথে বেঈমানি করেছে, নিজের অবস্থানের সাথে বেঈমানি করেছে, নিজের দাদির সাথে করেছে যে কিনা ওকে লক্ষ্মী ছেলে বলত। এই দুনিয়ার সবকিছুর সাথে ও বেঈইমানি করেছে।

“প্লিজ…আমি জানি…দয়া করে আর কিছু বোল না..” ও অনুনয় করল। ওর হাঁটু মাটিতে নামানো, মুখ নিচু করে আছে। সেইকি টের পেল ছেলেটা ওর দিকে এগিয়ে আসছে।

“তাকান আমার দিকে, ছেলেটা বলল।

ইতস্তত করে সেইকি ওর দিকে তাকাল। ছেলেটা আইডি কার্ডটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে রেখেছে।

সেইকি মাথা বো করে কার্ডটা হাতে নিল। উঠে দাঁড়ানোর কোন ক্ষমতা ওর ছিল না।

“সেইকি, আমার কিছু প্রশ্ন ছিল। যখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আপনি মোরিনো আর মেয়েটার মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছেন তখন আমার ধারণা ছিল আপনি হয়তো একটা এক্সিডেন্ট ঘটিয়ে ফেলেছেন। যে কারনে আপনি মেয়েটা কেমন দেখতে তা বুঝতে পারেননি। পুরো ব্যাপারটার এরকমই একটা ব্যাখ্যা হতে পারে বলে আমার মনে হয়েছিল।”

সেইকি আইডি কার্ডটা শক্ত করে চেপে ধরে ছেলেটার কথা শুনছিল।

“কিন্তু কোথাও কোন রক্তের দাগ নেই, না পার্কের ওখানে, না মাটিতে, না আপনার গাড়িতে। আর এখন মেয়েটাকে পরীক্ষা করে বুঝলাম আঘাত পেলেও, দুএকটা হার ভাঙলেও, একমাত্র ইঞ্জুরি আসলে গলার কাছে ক্ষতটা। যেটা দেখে মনে হচ্ছে আত্মহত্যা। তার মানে এক্সিডেন্টে ওকে খুন করে এখানে এনে মাটি চাপা দেননি আপনি।”

সেইকি মাথা ঝাঁকাল। ছেলেটা এসে ওর হাঁটুতে হাত রাখল। “তাহলে কেন কবর দিয়েছেন ওকে?”

ছেলেটার কথা শুনে মনে হচ্ছিল না মেয়েটার মৃত্যুর জন্য সেইকিকে দায়ি করছে, সে সেফ জানতে চাইছিল। সেইকি প্রশ্নটার কোন সহজ উত্তর খুঁজে পেল না বলার জন্য। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে মাথা নাড়ল। “জানি না। আমি ওকে কবর দিয়েছি কারণ আমার ইচ্ছা হয়েছিল।”

যা সত্যি তাই ও উত্তরে বলল।

কেন ও কৌসুকিকে খুন করেছিল? কেন ওকে ভুতে পেয়েছিল যে জ্যান্ত মানুষ ধরে ধরে কবর দিতে হবে?

কোন কারণ নেই এর পেছনে। সেইকি এই দু-জনকে কবর দিয়েছিল কারণ ওর জন্মই হয়েছিল যেন এই কাজ করার জন্য।

“আমি ওদের দুজনকে কবর দিয়েছি কারণ আমার ইচ্ছা হয়েছিল।” ও আবার বলল। ওর বুক ব্যথা করছিল। এই উত্তর কোন মানুষের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। ওর হাত কাঁপছিল, আইডি কার্ডটা হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল। “আমি..”

কিভাবে ও বেঁচে থাকবে? ওর সত্যিকারের সত্ত্বার অস্তিত্ব জেনে যাওয়ার পর? কি ভয়াবহ জঘন্য একটা সত্য। ওর সামনে আর কি করার আছে এরপর?

কেন এরকম একটা হৃদয় নিয়ে ওকে জন্ম গ্রহণ করতে হল? কেন ও অন্য মানুষদের মত সাধারণ কেউ হতে পারল না? ওর মনের ভেতর প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগছিল, আর হৃদয় ভেসে যাচ্ছিল দুঃখ কষ্টে।

একজন সাধারণ মানুষের মতই তো সে বাঁচতে চেয়েছিল, খুন থেকে কোন আনন্দ পাওয়ার জন্য নয়। সে কখনো চায়নি মানুষজনকে জ্যান্ত কবর দিয়ে আনন্দ পেতে, মাঝরাতে গর্ত খুঁড়ে নিজেকে শান্ত করতে…সে শুধু কারো কোন ক্ষতি না করে বাঁচতে চেয়েছে।

বেশি কিছু তো চায়নি। অল্পতেই ও খুশি ছিল। ওর চাওয়া ছিল একটা সাধারণ জীবনের-যেমন ওর ইস্ত্রি করা শার্ট পরা কলিগের মত, কিংবা বাচ্চাদের ছবি ডেস্কে রাখা ওর বসের মত। ওরকম সৌভাগ্যবান হলে কত ভালোই না হত?

সেইকির গাল বেয়ে অশ্রু নেমে এল। সে ওখানেই হাঁটু মুড়ে বসে থাকল, অশ্রুগুলো ওর গাল বেয়ে নেমে মাটিতে হারিয়ে গেল। তার কোন ধারণা ছিল না এরপর আর কি করার আছে। পুরো দুনিয়া অন্ধকারে ঢেকে গেল, তার মনে হচ্ছিল অদৃশ্য এক কফিনে আটকা পড়ে গিয়েছে সে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল ওর।

***

কিছুক্ষনের জন্য ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। হুঁশ ফেরার পর সেইকি দেখল ও পোর্চে বসে আছে। চারপাশে তখনো অন্ধকার, কিন্তু পাখির ডাক শুনে বোঝা যাচ্ছিল ভোরের সময় হয়ে এসেছে।

ঘরের বাতি জ্বলছে, আর কেউ সেখানে হাঁটাহাঁটি করছে। সেইকির শরীরে কোন শক্তি ছিল না যে উঠে গিয়ে দেখে। ওর হাতগুলো তখনো কাঁপছিল।

ও মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, একসময় ছেলেটা এসে হাজির এল।

ওদের মধ্যে চোখাচোখি হলে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল এখন ভালো বোধ করছে কিনা। জানা গেল ছেলেটাই ওকে পোর্চে নিয়ে এসেছে।

“আমার মনে হয় স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছে।”

“আপনি অনেক কান্নাকাটি করেছেন এতক্ষন।”

সেইকি নিজের গালে হাত দিয়ে দেখল তখনো ভেজা।

“আশা করছি আমি যে অনুমতি ছাড়া বাড়ির ভেতরে গিয়েছিলাম সেজন্য আপনি রাগ করেননি,” ছেলেটা বলল।

সেইকি আবার বাগানের দিকে তাকাল। ও যে গর্ত খুঁড়েছিল তার কোন চিহ্নও নেই। চারটা খুঁটি আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে। এক সেকেন্ডের জন্য ওর মনে হল ঘটনাগুলো ওর কল্পনা ছিল।

“ঐ বাঁশের খুঁটিগুলো কফিনের সাথে লাগানো হয়েছিল যাতে ভেতরের মানুষটা নিঃশ্বাস নিতে পারে, তাইনা?” ছেলেটা সেইকিকে জিজ্ঞেস করল। জানা গেল ছেলেটা গর্তটা আবার ভরাট করে ফেলেছে। কিন্তু কেন? আর সাথে সাথে পুলিশ ডাকেনি কেন?

মেয়েটার বয়ফ্রেন্ডটাকে আশেপাশে দেখা গেল না। সে কি বাড়ির ভেতরে? ঘুমাচ্ছে? নাকি সেইকির মত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে?

মেয়েটা বিশ্বাস করত ওর বয়ফ্রেন্ড ঠিকই ওকে খুঁজে বের করবে আর ওকে একা ফেলে যাবে না। সেইকি ওদের ভালবাসার স্বপ্ন ভাঙার মূল্য কখনোই পরিশোধ করতে পারবে না।

সেইকি ঘুরে বাড়ির ভেতর তাকাল।

ছেলেটা ওর সেল ফোন দিয়ে কাউকে ফোন করছিল।

“আমি রাস্তায় তোমার আইডি কার্ডটা খুঁজে পেয়েছি,” ছেলেটা ফোনে বলল। বোঝা গেল ও আসল মোরিনো ইয়োরুর সাথে কথা বলছিল।

ছেলেটার কথা শেষ হতেই লাইন কেটে গেল। ফোন হাতে বিড়বিড় করতে করতে বলল, “তাইতো, একটু বেশি সকালেই ফোন করে ফেলেছি।” মোরিনো জানেও না ওর হারানো আইডি কার্ডের কারনে সেইকির জীবনে কি তোলপাড় হয়ে গিয়েছে।

তে শুরু করেছে। পোর্চে বসে পুবে তাকিয়ে সেইকি চিরহরিৎ গাছগুলোর সারি দেখতে পাচ্ছিল। গাছগুলোর কালো ছায়ার পেছনে আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। সাদা কুয়াশা ইতিমধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে।

ছেলেটা এসে সেইকির বাম দিকে বসল।

দু-জনে অনেকক্ষণ বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে চেয়ে থাকল। যে কোদাল দিয়ে গর্ত ভরাট করা হয়েছে তা ছেলেটার পাশে মাটিতে ফেলে রাখা ছিল।

সূর্য গাছগুলো ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেলে আলো এসে ওদের মুখে পড়ল। আলোর উজ্জলতায় কিছুক্ষনের জন্য সেইকির মনে হল অন্ধ হয়ে গিয়েছে। ছেলেটার শরীরে আলো পড়লেও, মুখ ছায়ার ভেতর ছিল। ফলে চোখগুলো আরো ওর স্মৃতিতে গেঁথে গেছে।

ছেলেটার চোখগুলোতে কোন অনুভুতির ছোঁয়া ছিল না। একদম শূন্য। ওগুলো দেখতে ছিল একদম সেইকির চোখের মত যখন ও শিকার খুঁজতে যাওয়ার আগে রিয়ারভিউ মিররে নিজের চেহারা দেখেছিল। চোখগুলো জুড়ে গভীর অন্ধকার।

সেইকি টের পেল ওর অনুভূতিগুলো নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছে, অশ্রু শেষ, মাথাও আর ঝিমঝিম করছে না।

“আমার..” সেইকি বলল।

ছেলেটা ওর দিকে ঘুরল, মনোযোগ দিল ওর দিকে।

“আমার মনে হয় পুলিশকে আমার সব কিছু জানানো উচিত, যা যা করেছি আমি,” কথাগুলো ওর ঠোঁটগুলো থেকে যেন গড়িয়ে পড়ল। সব টেনশন কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। আবার ওর চোখ দিয়ে অশ্রু বেয়ে পড়তে লাগল। এবার আর কষ্টের অশ্রু নয়, সূর্যের আলোতে সেগুলো চকচক করছে।

ওর জীবন হয়তো এখানেই শেষ। অনেকেই হয়তো ওকে ঘৃণা করবে এখন, তাদের দৃষ্টি ওর দেহে তীরের মত গিয়ে বিধবে। কিন্তু ওর আর কিছু আসে যায় না। ও ওর সমস্ত পাপের স্বীকারোক্তি করবে আর শাস্তির জন্য অপেক্ষা করবে-একজন মানুষ হিসেবে ওর যা করা উচিত।

“আমি আনন্দিত…আমি আনন্দিত যে এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।”

কত অসংখ্যবার সে নিজের ভেতরের মনুষ্যত্বের অভাবের কারনে কষ্ট পেয়েছে? কত অসংখ্যবার সে নিজের সত্তার জন্য, ওর ঘৃণ্য আকাথাগুলোর জন্য নিজেকে অভিশাপ দিয়েছে? কিন্তু এখন অবশেষে ওর অবশিষ্ট মনুষ্যত্ব যা রয়েছে তা জয়ী হয়েছে।

“আমি জানি আমার পাপ এতে মাফ হয়ে যাবে না, কিন্তু নিজের কাছে ভালো লাগছে যে আমি সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছি।”

ছেলেটা ওর মুখ খুলল। “আপনি জেলে যেতে চাইলে আমি কোন বাধা দেব না, কিন্তু সেইকি, আপনি কি আরো ছয় মাস অপেক্ষা করতে পারবেন?”

সেইকি কারণ জানতে চাইলে ছেলেটা উঠে দাঁড়াল।

“আমি এখন বাসায় যাচ্ছি। সেইকি, দয়া করে ছয় মাস অপেক্ষা করুন। ছয় মাস না পারলে অন্তত এক মাস পরে পুলিশের কাছে যান। যদি আপনি আসলেই অতটা অনুতাপ বোধ করে থাকেন, তাহলে পুলিশকে গিয়ে বলুন আপনি কী কী করেছেন।”

তারপর সেইকিকে প্রতিজ্ঞা করাল ছেলেটা আর ইয়োৰু সম্পর্কে মোরিনো পুলিশের কাছে যেন কিছু না বলে।

“মনে রাখবেন, সে এরকমই চেয়েছিল। এ নিয়ে নিজেকে অপরাধি মনে করার কোন কারণ নেই। আপনি যদি ওকে উদ্ধার করতে চান তাহলেও সে বাধা দেবে। কিন্তু আপনার সবাইকে জানাতে হবে আপনি কী করেছেন। আমি কোন সূত্র রাখিনি। আপনি যদি কাউকে আমার কথা বলেনও, কেউ বিশ্বাস করবে না আমি এখানে ছিলাম।”

ছেলেটা ওর জুতো পরে পোর্চ থেকে নেমে গেল।

সেইকি ওর শেষের কথাগুলো কিছু বুঝতে পারল না। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ছেলেটা নিরবে কোন বিদায় না জানিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেটা চিরহরিৎ গাছগুলোর মধ্য দিয়ে উধাও হয়ে গেল, পেছনে ফেলে গেল সকাল, বাগান আর সেইকিকে।

সে মহর্তে সেইকি ওর কথাগুলো উপলদ্ধি করতে পারল, ছেলেটা যদি একা বাড়ি ফিরতে থাকে তাহলে বয়ফ্রেন্ডটা কি এখানেই কোথাও রয়ে গিয়েছে?

সেইকি উঠে দাঁড়াল।

ওর মনে একটা সন্দেহ জেগেছে।

কাঁপা কাঁপা পায়ে ও খালি পায়ে বাগানে নামল। ওর নিঃশ্বাস সকালের ঠান্ডা বাতাসে ধোঁয়ার মত আকার নিচ্ছিল।

বাগানের শেষ মাথার বাঁশের খুঁটিগুলো নিখুঁতভাবে সোজা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কফিনটা আবার খুঁটিগুলোর নিচে কবর দেয়া হয়েছে।

সবচেয়ে কাছের খুঁটিতে সেইকি কান পাতল।

ভেতর থেকে হালকা একটা স্বর ভেসে আসছে, কফিনের দেয়ালে যেন প্রতিধ্বনি তুলছে সেটা। কফিনের ভেতর একজন পুরুষ কণ্ঠ, ফোঁপানোর কারনে একটু আঁটকে যাচ্ছে তার শব্দ। মেয়েটার নাম বার বার প্রতিধ্বনি তুলছে সেই কণ্ঠ।

৬. কণ্ঠ

কণ্ঠ

প্রস্তাবনা

ইদানিং আমার বোন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়েই কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে যায়। নভেম্বরের শেষ, তাই বেশ ঠান্ডা পড়েছে। দরজা খুললে সকালের ঠান্ডা বাতাস ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে।

সেদিন সকালে সে বরাবরের মত বাইরে যাওয়ার জন্য ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে দরজার দিকে যাচ্ছিল। আমি টেবিলে বসে নাস্তা খেতে খেতে খবরের কাগজের ‘শোক সংবাদ’ পড়ছি।

মা একটু আগেই ঘরের কোনায় একটা কেরোসিন হিটার জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। যে কারনে তেলের গন্ধে সারা ঘর ভাসছে। গন্ধে মনে হচ্ছিল মাথার ব্রেইনসেল মরে যাচ্ছে। আর সেই মুহূর্তেই একটা আর্টিকেল পড়ল আমার চোখে। হিটার থেকে বের হওয়া কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ায় এক শিশুর মৃত্যু।

জানালাটা খুলে দিয়ে ঘরের ভেতরে ঠান্ডা বাতাস ঢুকতে দিলাম, গন্ধটা বেরিয়ে যাক। জানালা ঠান্ডায় ঘেমে ঘোলাটে হয়ে ছিল, বাগানের ভেতর কুয়াশা।

জানালার বাইরে দেখলাম আমার বোন দাঁড়িয়ে আছে। সোয়েটার আর স্কার্ফ দিয়ে নিজেকে পুরো মুড়িয়ে ফেলেছে।

জানালা খোলার সময় আমাদের চোখাচোখি হলে ও হাত নাড়াল। কুকুরটা ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ওটার কলারের সাথে লাগানো একটা রশির আরেক মাথা আমার বোনের হাতে ধরা।

“আমি ওকে বের করতে পারছি না। উঠোনের উপর কিছু একটা ওর পুরো মনোযোগ টেনে ধরে রেখেছে, কুকুরটাকে দেখিয়ে বলল সে। কুকুরটা আমাদের উঠোনের দেয়াল আর পাশের বাসার দরজার মাঝের মাটি শুঁকতে শুঁকতে থাবা মারছিল। যেন খুঁড়ে দেখতে চায়।

“আহহা আমাদের হাতে সময় নেই! চল বের হই!” ও রশি ধরে টানতে লাগল কুকুরটাকে। হেঁটে আসার পর স্কুলের জন্য তৈরি হতে হবে ওকে। কুকুরটা মনে হলো ওর কথা বুঝতে পেরেছে। ওর পিছু পিছু গেল। বাতাসে ওদের নিঃশ্বাস ধোঁয়ার মত দেখাচ্ছিল।

মা আমাকে বলল জানালাটা বন্ধ করতে। আমি জানালাটা লাগিয়ে বাগানে গেলাম। বাগানের সীমানায় একটা বড় পাথর ছিল, সেটা টেনে এনে কুকুরটা যে জায়গাটা খোঁড়ার চেষ্টা করছিল সেখানে রাখলাম। আশা করা যায় এরপর আর চেষ্টা করবে না। আমি চাই না ও সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি করুক। আর কয়েক মিনিট খুঁড়লেই একগাদা কাটা হাত বেরিয়ে পড়ত আমার বোনের সামনে। এই বছরের শুরুতে আমি সেগুলো ওখানে পুঁতে রেখেছিলাম। ওগুলো নিয়ে বাসায় ফেরার পর নিরাপদ কোথাও লুকিয়ে রাখা দরকার ছিল। আর আমার বোনের তো এসব অস্বাভাবিক জিনিস খুঁজে পাওয়ার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে, আবারো সেই প্রমাণ পাওয়া গেল।

ভেতরে গিয়ে খবরের কাগজের বাকিটা পড়লাম। মা জানতে চাইল ইন্টারেস্টিং কোন খবর আছে কিনা, আমি মাথা নাড়লাম। কিটাযাওয়া হিরোকো সম্পর্কে নতুন কিছু নেই খবরে।

সাত সপ্তাহ আগে আমাদের এলাকার কাছেই একটা পরিত্যক্ত বিল্ডিঙে কিটাযাওয়া হিরোকোর লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। পরিত্যক্ত বিল্ডিংটা এককালে একটা হাসপাতাল ছিল। জায়গাটা শহরের সীমানার মধ্যে হলেও আশেপাশে কোন কিছু ছিল না। জায়গাটা ছিল সিটি সেন্টারের পরে পাহাড়ি এলাকার দিকে একটা নুড়ি বিছানো পথের শেষ মাথায়। মরচে ধরা চেইন লিঙ্ক বেড়া দিয়ে পুরো জায়গাটা ঘেরা ছিল। বিল্ডিংটা ভেঙে না ফেলে কেন ফেলে রাখা হয়েছিল কে জানে। বছরের পর বছর পরিত্যক্ত থাকায় বিল্ডিঙের আশেপাশে মরা ঘাস ছাড়া আর কিছু ছিল না।

এলিমেন্টারি স্কুলের তিনটা বাচ্চা বিল্ডিংটা ঘুরে দেখতে গিয়ে কিটাযাওয়া হিরোকোর লাশ খুঁজে পায়। তিনজনকেই এখন কাউন্সেলিং নিতে হচ্ছে।

লাশটা খুঁজে পাওয়ার পর সমস্ত টিভি চ্যানেল আর খবরের কাগজ কেসটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে। কিন্তু এখন তাদের আগ্রহে ভাটা পড়েছে। খবর কমতে কমতে প্রায় নাই হয়ে যাচ্ছে। ফলে তদন্তের অগ্রগতি কতদুর তা জানার এখন আর উপায় নেই।

খবরের আর্টিকেলগুলোতে মেয়েটার একটা ছবি আর কিভাবে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল সেই গল্প ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমি আর্টিকেলগুলো পত্রিকা থেকে কেটে জমিয়ে রেখেছি।

ছবিটা তোলা হয়েছিল যখন সে জীবিত ছিল তখন। হাসিখুশি একটা মেয়ে, সাদা দাঁতগুলো ঝলমল করছে, কালো লম্বা চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। এই ছবিটা ছাড়া আর কোন ছবি দেখানো হয়নি কোথাও।

পুলিশ কি জানতে পেরেছে কে মেয়েটাকে খুন করেছে?

সেদিন সন্ধ্যায় যখন ক্লাস শেষ হলো, ততক্ষণে বাইরে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। ফুরোসেন্ট লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, জানালায় আলো

প্রতিফলিত হয়ে আয়নার মত দেখাচ্ছে। ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা সবাই দৌড়ে রুম থেকে বের হলো। জানালার দিকে তাকিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, ছেলেমেয়েদের স্রোতের মধ্যে একটা অবয়ব অনড় বসে আছে। মেয়েটার কালো চুলগুলো লম্বা আর সোজা। ত্বকের রঙ এতটাই ফ্যাকাসে যে দেখে মনে হয় বরফের তৈরি। মেয়েটার নাম মোরিনো ইয়োরু।

ক্লাসে শুধু আমরা দু-জন রয়ে গেলাম।

“তুমি কি কিছু বলতে চাও?” আমি জানতে চাইলাম। লাঞ্চের পর আমার কানে ফিসফিস করে বলেছিল ক্লাসের পরে থাকতে।

“লাশের একটা ছবি পেয়েছি।”

সবার জীবন যার যার মত করে চলে। আপনি যদি একশজন মানুষকে বেছে নেন, তাহলে এক ধরনের জীবনধারা পাবেন। আর সবাই নিজেদেরটা বাদে অন্যদের জীবনধারা বুঝে উঠতে সমস্যায় পড়ে।

মোরিনো আর আমার জীবনধারাও অন্যরকম। সাধারণের চেয়ে আলাদা। মৃতদেহের ছবি আদান-প্রদান করা এই জীবনধারার সাধারণ একটা অংশ।

ও ওর ব্যাগের থেকে লেটার সাইজের একটা কাগজ বের করল। কাগজটার উপর চকচকে একটা ব্যাপার ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল সাধারণ কোন কাগজ নয়, ছবি প্রিন্টের জন্য এই কাগজ ব্যবহার করা হয়।

ছবিতে একটা খোলা কংক্রিট রুম দেখা যাচ্ছে। প্রথম যা আমার চোখে পড়ল তা হলো সবকিছু কেমন যেন লাল হয়ে আছে।

ছবির মাঝামাঝি একটা টেবিল রাখা, ওটার উপরের অংশও লাল। আশেপাশের মেঝেও লাল। সিলিং এবং দেয়ালও…উজ্জ্বল লাল নয়, একটু গাঢ় ধরনের লাল, আলো জ্বালালে রুমের কোনায় যেরকম অন্ধকার হয় অনেকটা সেরকম।

মেয়েটাকে টেবিলের উপর রাখা ছিল।

“কিটাওয়া হিরোকো?” আমি জানতে চাইলাম।

মোরিনোর ভ্রূ কিছুটা উঁচু হলো। না খেয়াল করলে বোঝা যেত না। এভাবে সে অবাক হওয়া প্রকাশ করে।

“তুমি ধরতে পেরেছ তাহলে!”

“ইন্টারনেটে পেয়েছে এটা?।”

“একজন দিয়েছে আমাকে। পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে মেয়েটার খবরের আর্টিকেলগুলো কাটছিলাম তখন একজন এসে দিয়েছে। হ্যাঁ ঐ মেয়েটারই ছবি এটা, কিন্তু তোমার জায়গায় আমি হলে অনুমান করতে পারতাম না।”

মোরিনো ইয়োরু দেখতে সুন্দরি। তাই অন্য স্কুলের ছেলেরাও এসে গায়ে পড়ে ওর সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করে। আমাদের স্কুলের কেউ ওর ধারে কাছে যায় না, সবাই ভালো করেই জানে এসবে ওর কোন আগ্রহ নেই।

যাই হোক, কেউ একজন ওকে লাইব্রেরিতে বসে এইসব অস্বাভাবিক খবর সংগ্রহ করতে দেখেছে আর সেটাকে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে।

সে আমার হাত থেকে ছবিটা নিয়ে চোখের কাছে নিয়ে ভালো করে দেখল। “তুমি কি করে এক দেখাতেই বুঝলে এটা ওর ছবি?”

“ছবিতে মেয়েটাকে…মানুষ হিসেবে বুঝতে পারার অবস্থা নেই।” মোরিনো বিড়বিড় করে এরকম কিছু বলল, আমি অনুমান করে নিলাম।

“ছবিতে কিটাযাওয়া হিরোকোর মাথাটা টেবিলের উপর রাখা। চুলের স্টাইল আর গঠন দেখে আমি অনুমান করে নিয়েছি ছবিটা ওর।”

“ওহ্, আচ্ছা,” সে বলল।

ছবিটা যে দিয়েছে তার সম্পর্কে জানতে চাইলাম, কিন্তু মোরিনো কোন উত্তর দিল না।

বাসায় গেলে ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখতে হবে।

জানালার দিকে তাকালাম, অন্ধকার ছাড়া বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। অনন্ত গভীর আঁধার। ক্লাসরুমের ভেতরটা সাদা আলোয় উজ্জ্বল হয়েছিল। জানালার প্রতিফলনে বেঞ্চগুলোকে বাইরের আঁধারে ভাসমান মনে হচ্ছিল।

“পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে-যারা খুন করে আর যারা খুনের শিকার হয়।”

“হঠাৎ এই কথা? কি বলতে চাইছ?”

ব্যাপারটা পরিস্কার যে কিছু মানুষ অন্য মানুষদের খুন করে কোনরকম কোন কারণ ছাড়াই। আমি জানি না এর পেছনে তাদের বেড়ে ওঠার কোন কারণ কাছে কিনা, নাকি তারা জন্ম থেকেই এরকম। সমস্যা হলো, এই লোকগুলো তাদের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখে, সাধারণ মানুষের ভেতর সাধারন মানুষের মতই বসবাস করে। তারা এমনভাবে লুকিয়ে থাকে যে অন্য মানুষের সাথে তাদের কোন পার্থক্য চোখে পড়ে না।

কিন্তু একদিন, তাদের সামনে খুন করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকে না। সাধারণ জীবন থেকে বেরিয়ে শিকার ধরতে যেতে হয়।

আমি নিজেও এরকম একজন মানুষ।

আমি অনেক খুনির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি। ঐ চোখগুলোকে মাঝেমাঝে মানুষের চোখ বলে মনে হয় না, অন্য কিছু মনে হয়। পার্থক্যটা খুবই সামান্য, চোখে না পড়ার মতই, কিন্তু তাদের চোখের ভেতরে কোথাও থেকে অপার্থিব কিছু একটা বিচ্ছুরিত হয়।

যেমন বলা যায়, যখন কোন সাধারন মানুষ আমার সাথে কথা বলে তখন তারা বিশ্বাস করে যে আমি একজন মানুষ আর একজন মানুষের মতই আচরণ করে।

কিন্তু খুনিদের সাথে আমার সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা ভিন্ন রকমের। আমি যখন তাদের চোখের দিকে তাকিয়েছি, আমার মনে হয়েছে তারা যেন আমাকে একটা বস্তু হিসেবে দেখছে, একজন জীবিত মানুষ হিসেবে নয়।

“তো…”

আমি মোরিনোর প্রতিফলনের দিকে তাকালাম।

“তুমি নিশ্চয়ই ওকে খুন করনি, নাকি করেছ..?” ছবির মেয়েটার চুল রঙ করা আর কোঁকড়ানো-খবরের কাগজের ছবিটার সাথে কোন মিল নেই। তাহলে তুমি কিভাবে জানলে এটা কিটাযাওয়া হিরোকোর ছবি?”

মোরিনোর কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হলো ওর মাথা আজকে ভালোই কাজ করছে।

ওর চোখে খুনিদের চোখে দেখা অপার্থিব বিচ্ছুরণের কোন চিহ্ন নেই। ও মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখে। মনে হয় না ও কখনো কোন মানুষকে খুন করতে পারবে। অন্য মানুষের তুলনায় ওর আগ্রহ হয়তো একটু অন্যরকম, কিন্তু তারপরেও ও একজন স্বাভাবিক মানুষ।

মোরিনো আর আমার মধ্যে অনেক কিছুতে মিল থাকলেও এই ব্যাপারটায় পার্থক্য আছে। খুবই মৌলিক পার্থক্য, মনুষ্যত্ব আর…অন্য কিছুর পার্থক্য।

সে একজন মানুষ, যেই পক্ষ সবসময় শিকার হয়। আমি ঐ পক্ষের নই।

“আরেকটা ছবি আছে, ওর চুলের স্টাইল বদলানোর পর তোলা। মেয়েটার পরিবারের অনুমতি ছাড়া ছবিটা ছাড়া হয়েছিল, যে কারনে খুব বেশি লোক দেখেনি। ঐ ছবিটা দেখে আমি মিলটা ধরতে পেরেছি।”

“ও আচ্ছা, সে আমার অজুহাত গ্রহণ করল।

আমি বাসায় গিয়ে আমার রুমের কম্পিউটার অন করলাম। কিটাযাওয়া হিরোকোর লাশের ছবি ইন্টারনেটের সবখানে খুঁজলাম। রুমের বাতাস বাসি

আর ভারি হয়ে উঠল। আমি কিছুই খুঁজে পেলাম না।

বুককেসের পেছনে লুকানো ছুরিগুলো বের করলাম। ব্লেডের উপর আমার চেহারার প্রতিফলন দেখছি। বাইরের বাতাসের শব্দ কানে আসছে। শুনে মনে হচ্ছিল ছুরিগুলো দিয়ে খুন করা মানুষগুলোর আর্তনাদের শব্দ।

কেন জানি মনে হয় ছুরিগুলোর নিজস্ব কোন শক্তি রয়েছে আর তার আমাকে ডাকছে। কিংবা হতে পারে আমার মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা গোপন বাসনা ছুরির চকচকে ব্লেডে প্রতিফলিত হচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে অন্ধকারে ফুটে থাকা শহরের আলো দেখা গেল। উপরে ফ্যাকাসে রঙা আকাশ।

আমার হাতে ধরা ছুরি থেকে একটা শব্দ ভেসে এল যা ছুরি হওয়ার কথা নয়। মনে হচ্ছিল যেন ছুরিটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠার শব্দ পাচ্ছিলাম।

মোরিনোকে মিথ্যে বলেছি আমি। কিটাওয়া হিরোকোর নতুন হেয়ারস্টাইলের কোন ছবি কোথাও ছাড়া হয়নি।

মাঝেমাঝে আমার পরিবারের লোকজন কিছুদিনের জন্য বাসায় থাকে না। বাবা হয়তো কোন বিজনেস ট্রিপে যায়। কিংবা মা তার কোন বন্ধুর সাথে কোথাও ঘুরতে যায়। এরকম সময়ে বাসাটাকে অদ্ভুত রকমের খালি খালি লাগে। চারজন যখন বাসায় একসাথে থাকি তখন কিন্তু এরকম লাগে না। আমি যখন ফিল্ড ট্রিপে বাইরে গিয়েছিলাম তখন আমার বাবা-মা, বোনেরও এরকম অনুভূতি হয়েছিল। কেমন যেন কি জানি একটা নেই ধরনের অনুভূতি। যখন পরিবারের সদস্য আবার বাসায় ফিরে আসে তখন সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যায়। বাসার সাইজটা আমাদের জন্য ঠিক ছিল, আরামদায়ক কিন্তু ছোট। যে কারনে প্রতিবার টিভির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আপর ছড়িয়ে রাখা পায়ের সাথে হোঁচট খেতে হতো।

আমরা চারজন ছিলাম…কিন্তু এখন যখন আপু আর কখনো ফিরে আসছে না, টেবিলে সবাই একসাথে বসলে সবসময় একটা অতিরিক্ত চেয়ার রাখা হয়।

কেউ জানে না কেন আমার বোন খুন হয়েছে। আমার বড় বোন, কিটীযাওয়া হিরোকো, সাত সপ্তাহ আগে খুন হয়েছে। ওর সাথে আমাদের শেষ দেখা হওয়ার বারো ঘন্টা পর ওকে খুন করা হয়েছিল। আর লাশটা পাওয়া গিয়েছিল শহরের শেষ মাথার এক পরিত্যক্ত হাসপাতালে।

ঐ হাসপাতালের ভেতরে আমার কখনো যাওয়া হয়নি। কিন্তু একবার বাইরে থেকে দেখেছিলাম, আপুর লাশ পাওয়া যাওয়ার পর। শীতল একটা জায়গা, মরা ঘাস ছাড়া আর কিছু নেই। মাটিতে নুড়ি বেছানো, বাতাসে বালি উড়ে আমার জুতো সাদা হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালটা বিশাল ছিল, পরিত্যাক্ত একটা কংক্রিটের দালান, যেন একটা গুবরে পোকা। জানালার সব কাঁচ ভাঙা, ভেতরটা অন্ধকার।

আমার বোনের লাশ পাওয়ার পর সেখানে গিয়েছিলাম। যে কারনে প্রবেশপথ আটকানো ছিল টেপ দিয়ে। ভেতরে যাওয়া আসা করছিল।

কিছু বাচ্চাকাচ্চা সেখানে লাশটা খুঁজে পেয়েছিল। পুলিশ কাউকে কোন তথ্য দেয়নি, তবে যে রুমে ওকে পাওয়া যায় সেটা ছিল একটা অপারেটিং চেম্বার।

লাশের দেহ এতটাই ক্ষগ্রিস্ত হয়েছিল যে পরিচয় জানার কোন উপায় ছিল না। ব্যাগটা কাছাকাছি পাওয়া যাওয়ার পর পুলিশ আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। আমার মা ফোনটা ধরেছিল।

সময়টা ছিল দুপুরের কাছাকাছি, আপুকে শেষ দেখার পর একদিনও পার হয়নি তখনও। যে কারনে আমার মা প্রথমে ভেবে নিয়েছিলেন কেউ ফোনে তার সাথে শয়তানি করছে।

কিন্তু লাশটা নিশ্চিতভাবে আমার বোনেরই ছিল। আমরা যারা ওর কাছাকাছি মানুষ-বাবা, মা, আমি, আমার বোনের বয়ফ্রেন্ড আকাগি, আমরা ওকে সনাক্ত করিনি। মেডিক্যাল চার্ট আর জটিল ফরেনসিক টেস্ট থেকে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।

ও কিভাবে খুন হয়েছিল কিংবা কি অবস্থায় ওকে পাওয়া গিয়েছিল সে ব্যাপারে পুলিশ তেমন কোন তথ্য প্রকাশ করেনি। সবাই শুধু এটুকুই জানত যে ওকে গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করা হয়েছিল তারপর কোন ধরনের চুরি দিয়ে কাটা হয়েছিল। এইটুকু তথ্যই হৈচৈ ফেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু আসল ঘটনা এরচেয়ে অনেক বিভৎস ছিল।

পুলিশের ধারণা সত্য প্রকাশ পেলে সমাজের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, যে কারনে তারা সবকিছু গোপন রেখেছিল। এমন কি যেসব বাচ্চাকাচ্চা লাশটা খুঁজে পেয়েছিল তাদেরকেও মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল।

আমার বাবা-মা দাবি করেছিলেন তাদেরকে লাশ দেখাতে হবে। পুলিশ তা চায়নি। লাশের যে অবস্থা ছিল তা কাউকে দেখানো সম্ভব ছিল না। তারা বলেছিল না দেখলেই বরং আমাদের জন্য ভালো হবে।

যখন আমার বোন জীবিত ছিল আমার বাবা-মা তখন তাকে খুব ভালোবাসত বলে আমার মনে হয়নি। ওদের ভেতর সম্পর্কটা ছিল খুবই সাধারণ ধরনের-টিভি কমার্শিয়াল নিয়ে কথা বলা, খবরের কাগজ কোথায় গেল সেই নিয়ে কথা চালাচালি…ইত্যাদি। আমরা এরকম ধরনের পরিবার। তারা কখনো বাইরের লোকের কাছে মেয়েকে নিয়ে বড়াই করেনি, তারা ওকে কতখানি ভালবাসত তা আমি জানতামও না। অন্তত মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর তাদের কান্না না দেখা পর্যন্ত।

“দয়া করে ওকে দেখতে দিন!” আমার বাবা মরিয়া হয়ে অনুনয় করলেন। তার মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল, ক্ষিপ্ততার লক্ষণ। যখন পুলিশ আর ডাক্তার বুঝতে পারল কোনভাবেই আমার বাবা-মা কে আটকানো যাবে না, তখন লাশ যেখানে রাখা ছিল সেখানে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের ঢুকতে দিতে বাধ্য হলো।

তাদেরকে হলের ডাবল দরজা দি য়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলাম। আমি নিজে প্রচণ্ড আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম, বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে কেউ সাহস করে লাশটা দেখতে চাইতে পারে।

একজন ডাক্তার আর ডিটেক্টিভের কথাবার্তা শুনে ফেলেছিলাম। তারা টের পায়নি যে আমি সিঁড়ির ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছি।

ডিটেক্টিভটা বলছিল সবগুলো টুকরো সংগ্রহ করতে তাদের কত সময় লেগেছিল।

মেঝেতে আমার জুতো লেগে শব্দ হওয়ায় সে ঘুরে দাঁড়ায় আর আমাকে দেখে ফেলে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে ধরে।

টুকরো। আমার বোনের শরীরের টুকরো। আমি দাঁড়িয়ে থেকে তথ্যগুলো হজম করার চেষ্টা করছিলাম।

বাবা-মা যখন মর্গ থেকে বেরিয়ে এলেন আমি লাশের ব্যাপারে তাদের কাছে জানতে চাই, কিন্তু তারা পুরোপুরি বাবা হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ একটু আগেও তারা অঝোরে কাঁদছিলেন। কিন্তু রুম থেকে বের হওয়ার পর তারা আর একবারের জন্য কাঁদেননি। মনে হচ্ছিল তারা যেন তাদের সকল অনুভূতি ঐ রুমটায় রেখে এসেছেন। তাদের চেহারাগুলো অদ্ভুত রকমের হলদেটে দেখাচ্ছিল, যেন অনুভূতিশূন্য কোন মুখোশ পড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

পুলিশ মৃতদেহ সম্পর্কে কিছু জানায়নি যে, কারনে তথ্যের অভাবে খবরের কাগজের আগ্রহও শিগগিরি নিচের দিকে পড়তে শুরু করে। খুনের সাত সপ্তাহ পর পুলিশ এবং প্রেস উভয়ই আমাদের বাসায় আসা থামিয়ে দেয়।

***

আমার বোন ছিল আমার চেয়ে দু-বছরের বড়। যখন খুন হয় তখন বয়স ছিল মাত্র বিশ।

ফিফথ গ্রেডে পড়ার সময় আপু জুনিয়র হাই শুরু করেছে মাত্র। নতুন ইউনিফর্ম পরা শুরু করেছে। আমি যখন এইটথ গ্রেডে উঠলাম, সে তখন হাই-স্কুলে তার সামনে উন্মুক্ত নতুন পৃথিবী নিয়ে কথা বলছে। আমি সবসময় দেখতে পাচ্ছিলাম দু-বছর পর আমার সামনে কি অপেক্ষা করছে। আমার বোন ছিল একটা জাহাজের মত, যা কিনা গভীর সমুদ্রে আগে আগে পথ দেখিয়ে যেত।

যদিও আমাদের বয়সের পার্থক্য ছিল দুই বছরের কিন্তু আমাদের উচ্চতা ছিল প্রায় একই রকম, আর লোকজন বলত আমরা দুজন দেখতে নাকি একই রকম। যখন আমরা দুজনেই ছোট বাচ্চা ছিলাম, একবার নিউ ইয়ার্সে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম, তখন যাদের সাথে দেখা হয়েছিল সবাই একই কথা বলেছিল আমাদের।

“মোটেও কোন মিল নেই!” আপু বলল। ওকে আমার মতই হতবুদ্ধি দেখাচ্ছিল।

আমরা যতদূর জানতাম, আমাদের দুজনের চেহারা ছিল একদম আলাদা। তাহলে মিলটা কোথায়? এই চিন্তা সবসময় আমাকে ধাঁধাঁয় ফেলত। কিন্তু তারপরেও সেই ট্রিপে, আমি যখন বাড়ির এক পাশে অন্য বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে খেলছিলাম, একজন আন্টি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দারুন অবাক হয়েছিলেন। বলছিলেন আমাকে নাকি মাত্র অন্য জায়গায় খেলতে দেখে এসেছেন!

যখন আমরা ছোট ছিলাম, আমার আর আপুর মধ্যে অনেক খাতির ছিল। আমরা সবসময় একসাথে খেলাধুলা করতাম। সে আমার হাত ধরে আমাকে তার বন্ধুদের বাসায় নিয়ে যেত।

সেই ব্যাপারগুলো কিভাবে বদলে গেল? আমি কবে আমার বোনের সাথে শেষ কথা বলেছি কিংবা হাসাহাসি করেছি তা মনেও করতে পারি না আর।

কয়েক বছর আগে আমাদের মধ্যে ছোট একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। স্পষ্ট কিছু ছিল না, তাই আমাদের আশেপাশের কেউ ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। এমনকি দূরত্ব বলার মত বড় কিছুও ছিল না। কিন্তু আপু যখন আমার সাথে কথা বলত, ওকে দেখে মনে হত কিছুটা বিরক্ত।

একবার, আমি লিভিং রুমের সোফায় বসে ছিলাম। আঙুল তুলে যে ম্যাগাজিনটা পড়ছিলাম সেটা দেখিয়ে মাত্র পড়া ইন্টারেস্টিং একটা আর্টিকেলের কথা বলছিলাম। এইটুকুই করেছিলাম শুধু। কিন্তু আপু ম্যাগাজিনের দিকে তাকাল, তারপর ওর মুখ শুকিয়ে গেল। কি জানি অস্পষ্ট কিছু বলল তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমার মনে হলো ও আমার উপর বিরক্ত আর সেটা লুকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম না।

হয়তো আমি না বুঝে কিছু একটা করেছিলাম যে কারনে সে বিরক্ত হয়েছিল, কিংবা সে হয়তো অন্য কিছুতে মগ্ন ছিল আর আমি কথা বলে বাধা সৃষ্টি করেছিলাম। এসব বুঝ দিয়ে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে, এসবের পেছনে আসল কোন কারণ নেই। ওর বিরক্তি হয়তো আমার কল্পনা হয়ে থাকতে পারে কিন্তু শুধু সে সময়ই এরকম ব্যাপার ঘটেনি।

যেমন, আরেকদিন, স্কুল থেকে বাসায় আসার পর। আপু ওর এক বন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলছিল। কর্ডলেস রিসিভারে হাসাহাসি করছিল। আমি সোফায় বসে চুপচাপ টিভি দেখছিলাম, ওর কথাবার্তায় কোন ঝামেলা সৃষ্টি করিনি।

এক সময় ওর কথা শেষ হলো। রুম হঠাৎ করে একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমরা দুজন মুখোমুখি আলাদা আলাদা সোফায় বসে নিরবে টিভি দেখছিলাম। আমি ওকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওর চেহারায় এমন কিছু একটা ছিল, যে কারনে ইতস্তত করছিলাম। এক মুহূর্তে আগেও সে ফোনে অনেক মজা করছিল, আর এখন আমার সাথে একা এক রুমে মুখ গোমড়া করে আছে। সেই উষ্ণতা ওর মধ্যে থেকে উধাও হয়ে গেছে, আর আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অদৃশ্য একটা দেয়াল।

আমি যদি নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম তাহলে সে আমাকে থামিয়ে দিত। ওকে ক্ষিপ্ত দেখাত। আমাদের মধ্যে কোন কথা হলে ওর উত্তর হত চাঁছাছোলা ধরনের। যেন যত দ্রুত সম্ভব কথাবার্তা শেষ করার চেষ্টায় আছে। মায়ের সাথে কথাবার্তার চেয়েও দ্রুত।

আমার কোন ধারণা ছিল না কারণটা কী, যে কারনে আরো ভীত ছিলাম আমি। কিছু না বললেও আমার শরীর কিভাবে যেন আপুর মেজাজ টের পেত। আমি ওর আশেপাশে থাকতে সাহস করতাম না। ধীরে ধীরে ওর সামনে থাকা বা এক রুমে থাকা আমার উপর অনেক চাপ সৃষ্টি করত। সারাক্ষণ টেনশনে থাকতাম।

“নাটসুমি, তোমার এইটা আর পড়া ঠিক হচ্ছে না,” ছয় মাস আগে হঠাৎ আপু আমাকে বলল, যখন আমি বুকস্টোরে যাচ্ছিলাম কিছু গাইড বই কিনতে। সে আমার সাদা উলের কার্ডিগানের দিকে ইঙ্গিত করে কথাটা বলেছিল। ভালো করে দেখলে কিছু উল উঠে থাকা দেখা যায়। অনেক ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল কার্ডিগানটা।

“কিন্তু এটা আমার পছন্দ,” আমি বললাম।

“খুব ভাল,” ও মুখ ঝামটা দিয়ে আমার দিক থেকে ঘুরে বসল, যেন ওর কিছু আসে যায় না। আমার মনে হচ্ছিল দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে আসছে আমার চারপাশে।

আমরা দুই বোনের হয়তো, লোকজন যেমন বলে, চেহারায় মিল থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের পছন্দ-অপছন্দ আর ব্যক্তিতু একদম দুই মেরুতে।

আমার বোন ছিল মিশুক। সারাক্ষণ হাসিখুশি। বয়ফ্রেন্ড ছিল। ওর বন্ধুরাও ওকে পছন্দ করত। বাসায় ফোন আসলে ওর ছাড়া আর কারো হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। অস্থির ধরনের, অনেক রকম কাজের সাথে যুক্ত, বাসায় অলস বসে থাকা ওর জন্য দুর্লভ একটা ব্যাপার। এমনকি আমার চোখে মনে হত ওর থেকে উজ্জ্বল দ্যুতি বের হচ্ছে সবসময়।

অন্যদিকে, আমি আমার পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করছি। সারাদিন কেটে যায় ডেস্কে বসে। মনে হয় যেন কত বছর আমি আমার পেন্সিলের টোকার শব্দ ছাড়া কিছু শুনিনি। কোনভাবে ফ্রি টাইম বের করতে পারলে ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ি।

জুনিয়র হাই শুরু করার পর থেকে আপু বাসার বাইরে বেশি সময় কাটাতে লাগল। এমন সব জায়গায় যেতে লাগল যেখানে আমি কখনো যাইনি। এমন সব মানুষের সাথে সময় কাটাতে লাগল যাদের কখনো দেখিনি। ঘন্টার পর ঘন্টা আমি একা বাসায় থাকতে লাগলাম পড়াশোনা করে। শুধুমাত্র আমাকে সে টেনে বের না করলে বাসা থেকে বের হতাম না। কিন্তু এই বদলটা ছিল স্বাভাবিক, আর যতদূর মনে হয় আমি তখনো আমার সুন্দরি, হাসিখুশি, মিশুক বোনটাকে ভালোবাসতাম।

আমি প্রায়ই আপুর বাইরে ঘুরে বেরোনোর সাথে আমার বাসায় পাথরের মত বসে থাকার তুলনা করতাম। তার মানে এই না যে, আমি হীনমন্যতায় ভুগতাম, আমার বোনের জন্য আমি গর্ব বোধ করতাম আসলে।

যাইহোক, সে সম্ভবত আমাকে নিয়ে বিব্রতবোধ করত। আমি উপলদ্ধি না করলেও আমার জীবনধারা নিয়ে ওর হয়তো কোন সমস্যা ছিল।

ও ভালো মানুষ ছিল। যদিও ও আমার উপর ওর অসন্তুষ্টি সরাসরি কখনো প্রকাশ করেনি কিন্তু আমি নিশ্চিত ও সবসময় চেষ্টা করত যাতে সেটা প্রকাশ না পায়। ও কখনো আমাকে বলেনি, ও আমাকে অপছন্দ করে, ও শুধু ওর বিরক্তি ঢেকে রাখার চেষ্টা করত। যে কারনে আমার ব্যাপারটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল।

হয়তো আমি যেরকম ভাবতাম সেরকমভাবে আমার বোন কখনোই আমাকে ভালবাসত না..

আমার ধারণা সত্য কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় ছিল না আমার কাছে, কিন্তু এই একটা মাত্র ব্যাখ্যাই ছিল যা আমি কল্পনা করতে পারি।

কেন? এই একটা প্রশ্ন করলেই হতো, কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ও যখন জীবিত ছিল তখন কেন আমি সাহস করে প্রশ্নটা করতে পারিনি? হয়তো উত্তরটা জানলে কষ্ট হতে পারত কিন্তু তারপরেও তো সেটা এখনের এই অবস্থার চেয়ে ভালো হত?

আমার বোনের এখন উত্তর দেয়ার সব ক্ষমতা হারিয়ে গেছে আর আমি আমার প্রশ্ন নিয়ে পড়ে আছি। প্রতিবার যখন ওর কথা ভাবি, প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

আপু না থাকায়, বাসাও স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। যেন রাতের পর ভোর কখন আসবে সেই অপেক্ষা চলছে, কিন্তু আসছে না। ব্যাপারটা এতটাই অন্যরকম যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় একই জায়গা মাত্র দু-মাস আগেই একদম অন্যরকম ছিল।

বাবা-মাও বোনের মৃতদেহ দেখার পর থেকে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছেন। তাদের চেহারা অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ সময়ই তারা সেফ চুপচাপ বসে টিভি দেখেন। টিভিতে যদি কোন কমেডি শো চলে তাহলেও তারা এক বিন্দু হাসেন না। শুধুই তাকিয়ে থাকেন। প্রতিবার তাদের দিকে তাকালে আমার মনে হয় তারা হয়তো তাদের বাকি জীবন এরকমই থেকে যাবেন।

তাদের চেহারা মনে হত সেইসব মানুষের চেহারার মত যারা বোঝার চাপে অন্য কিছু অনুভব করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

আমার মা এখনো রান্না করেন। অভ্যাস থেকে করেন, রোবটের মত দৈনন্দিন কাজ করে যান।

কিন্তু যখন ঘরের কোনায় ধুলোবালি চোখে পড়ে তখন কান্না পায় আমার। তাদের জন্য কষ্ট হয়। আপু যখন বেঁচে ছিল তখন মা সবকিছু ঝেড়ে মুছে পরিস্কার রাখতেন। আর এখন সবকিছুর উপর ধুলোর স্তর জমে গিয়েছে। তাদের চোখেও পরছে না কিছু। তারা সম্ভবত চিন্তা করছেন তাদের মেয়ে ছোটবেলায় কিভাবে হাসত, কিভাবে তাকে প্রথম কোলে নিয়েছিল। সেই ওজনটা অনুভব করার চেষ্টা করছেন।

আর সেই নিস্তব্ধ বাড়িতে আমার উপস্থিতি কারো চোখে পড়ে না। বাবাকে যদি কিছু বলি তাহলে উনি অস্পষ্টভাবে মাথা নাড়ান খালি। অন্যদের চোখে হয়তো আমাকেও আমার বাবা-মায়ের মতই দেখায়। আমার বন্ধুরা বলেছে আমিও নাকি আর আগের মত হাসি না।

রাতের বেলা মাঝেমাঝে আপুর রুমে গিয়ে ওর চেয়ারে বসে থাকি আর নানান কিছু ভাবি। আমার রুমের পাশেই ওর রুম। ও বেঁচে থাকার সময়ে যদি আমি না বলে ওর রুমে ঢুকতাম তাহলে ও ভীষণ ক্ষেপে যেত।

এখন কেউ রুমটা ব্যবহার করে না বোঝা যায়। ডেস্কে হাত রাখলে ধুলো হাতে লাগে।

ও যখন বেঁচে ছিল আর এই চেয়ারে বসত, তখন কি নিয়ে ভাবত? আমি ওর চেয়ারে বুকের সাথে হাঁটু ভাঁজ করে বসে, আশেপাশের ফার্নিচারগুলোর দিকে তাকালাম। পর্দাগুলো সরানো ছিল, জানালার বাইরে রাতের অন্ধকার।

জানালায় আমি আমার মুখের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিলাম, এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল চেহারাটা আমার না, আপুর। পরে বুঝলাম প্রতিফলন দেখছি। আমরা হয়তো একইরকম দেখতে, নইলে এরকম ভুল মনে হবে কেন।

সেলফের উপর একটা আয়না ছিল। ওটার দিকে হাত বাড়ালাম নিজের চেহারাটা খুঁটিয়ে দেখার জন্য। আয়নার পাশে ছোট একটা সিলিন্ডারের মত জিনিস ছিল, দেখতে লিপস্টিকের মত। আয়না না নিয়ে ওটা হাতে নিলাম।

জিনিসটা ছিল লাল। রক্তের মত লাল। বিভিন্ন ধরনের পিঙ্ক কালারের আরো লিপস্টিক ছিল সেখানে। কিন্তু লালটাই আমাকে আকর্ষণ করছিল।

আয়নার দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। নিজের একটা লিপস্টিক থাকাটাই আমাদের মধ্যে বড় পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। লিপস্টিকটা মুঠোয় শক্ত করে চেপে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।

আমি জানি না বাকি জীবন আমি কী করে বেঁচে থাকব। আর সেই সময়েই, নভেম্বরের শেষের দিকে এক সন্ধ্যায় আমি আবার আমার বোনের কণ্ঠ শুনতে পেলাম।

দিনটা ছিল নভেম্বরের ৩০ তারিখ। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে আমি একটা বড় বুকস্টোরে গিয়েছিলাম। কলেজ ভর্তি পরীক্ষার উপর একটা বই কেনা দরকার ছিল। যদিও কলেজে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই আমার আর নেই। আপু যখন বেঁচে ছিল তখন অনেক কিছু ছিল যা আমার জানতে, শিখতে ইচ্ছা করত। এখন আর ইচ্ছা করে না। পড়াশোনা করি শুধুমাত্র আর কিছু করার নেই সেজন্য।

আমার যে বই দরকার ছিল সেগুলো ছিল দোকানের পেছনের দিকের সেলফে। সেখানে গিয়ে একদম উপরের সেলফের বাম পাশ থেকে বইয়ের নামগুলো দেখছিলাম। সেলফের ডান পাশে এসে পরের সেলফটায় খুঁজতে লাগলাম বইটা।

পাওয়া গেল না। নিচু হয়ে নিচের সেলফটায় খুঁজতে লাগলাম ডান থেকে বামে। হঠাৎ এক জোড়া কালো জুতো সরে যেতে দেখলাম। সেলফের সারিতে হারিয়ে গেল।

আমার মনে হল কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নার্ভাস লাগছিল আমার। আবার সেলফের বই দেখতে লাগলাম।

এমন সময় কেউ একজন আমার পিছে এসে দাঁড়াল। ফ্লুরোসেন্ট লাইটের আলোয় আমার যে অস্পষ্ট ছায়া সেলফটার উপর পড়ছিল, সেটা বেড়ে গেল।

কোন পায়ের শব্দ আমার কানে আসেনি, অথচ তারপরেও কেউ একজন আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। যথেষ্ট কাছে। চাইলেই ছুঁতে পারবে এতটা কাছে। আমি তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।

আমি জানতাম সে আমাকে জাপটে ধরবে। এই দোকানে এইরকম কাহিনী আগে হয়েছে শুনেছিলাম। কিন্তু আমার গলা থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। আমার পা দুটোও বেঈমানি করছিল। আমি এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে ঘুরে দেখার সাহসও পাচ্ছিলাম না। আমার পুরো শরীর পাথরের মথ শক্ত হয়ে গিয়েছিল।

“কিছু মনে করবেন না, এমন সময় কেউ একজন আমার ডানদিক থেকে বলে উঠল। একটা অল্প বয়স্ক ছেলের গলা। “আপনি মনে হয় মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া ধরনের লোক। ঐ যে সিলিঙের সাথে লাগানো আয়নাটা দেখতে পাচ্ছেন? ঐ আয়নাতে আপনাকে খেয়াল করেছি। ভালো,ভালো, খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। কিন্তু আমাকে একটু এদিক দিয়ে ওদিকে যেতে হবে। কিছু মনে না করলে একটু সরে দাঁড়াবেন?”

তৃতীয় কেউ একজন এসেছে এই ব্যাপারটা জাদুর মত কাজ করল, আমি আবার নড়াচড়া করতে সক্ষম হলাম। আমি ঘুরে দেখি কালো ইউনিফর্ম পরাএকটা ছেলে দুটো সেলফের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।

আমার পেছনে দাঁড়ানো লোকটা দ্রুত সরে গেল। ছেলেটার থেকে দৌড়ে পালাল। আমি খালি তার পেছন দিকটা দেখতে পেলাম। দেখে মনে হল স্যুট জ্যাকেট পরাসাধারণ একজন লোকের মত। সে এত আজবভাবে দৌড়ে পালিয়ে গেল যে আমার ভয় সাথে সাথে উবে গেল।

“ধন্যবাদ,” ছেলেটাকে বললাম।

ছেলেটা আমার চেয়ে লম্বা ছিল, আর শুকনো। কিন্তু ওর মধ্যে কিছু একটা ছিল যে কারনে ওকে দেখে দূর্বল মনে হচ্ছিল না। কালো ইউনিফর্মটা চিনতে পারলাম আমি, ঐ স্কুলের একটা ছেলেকে আমি চিনতাম।

“ধন্যবাদের কোন প্রয়োজন নেই, আমি আসলে আপনাকে সাহায্য করতে আসিনি,” সে সাদামাটাভাবে বলল, অভিব্যক্তির কোন চিহ্ন নেই চেহারায়।

“তুমি বলতে চাইছ তুমি শুধুই এদিক দিয়ে যেতে চাইছিলে?”

“আসলে তোমার সাথে কথা বলতে এসেছিলাম। তুমি কিটাযাওয়া নাটসুমি, তাইনা? তুমি দেখতে অনেকটাই তোমার বোনের মত। এক দেখাতেই চিনে ফেলেছি।”

এ ধরনের কথার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম, কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছু বলার আগেই ছেলেটা আবার কথা বলে উঠল।

‘হিরোকো মারা যাওয়ার আগে ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তোমার কথা সে আমাকে বলেছিল…।”

“এক মিনিট দাঁড়াও…কে তুমি?” এইটুকুই খালি আমি বলতে পেরেছিলাম।

ছেলেটা যদিও আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। এর বদলে ইউনিফর্মের পকেট থেকে সে একটা সাধারণ বাদামি রঙের খাম বের করল। যেরকম খাম সবজায়গায় পাওয়া যায়। খামের ভেতরে কিছু একটা ছিল, ফুলে ছিল।

“এটা তোমার জন্য,” খামটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল সে। হতভম্ব অবস্থায় খামটা হাতে নিলাম। খুলে ভেতরে দেখলাম। একটা স্বচ্ছ খাপের ভেতর ক্যাসেট টেপ দেখা গেল।

“দুঃখিত, কিন্তু তুমি ভেতরের জিনিসটা নিয়ে খামটা কি আমাকে ফেরত দিতে পারবে?” তার কথা মত আমি তাই করলাম। টেপটা বের করে খালি খামটা ফেরত দিয়ে দিলাম। সে সেটা ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল।

সাধারণ একটা ক্যাসেট টেপ। যে কোন দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। উপরে একটা স্টিকার লাগানো। “কণ্ঠ ১: কিটাযাওয়া হিরোকো।” লেখাটা হাতে লেখা না, প্রিন্ট করা।

“এটা কি? এখানে আমার বোনের নাম লেখা কেন?”

“সেটা শুনলে বুঝতে পারবে। কিটাযাওয়া হিরোকো যখন বেঁচে ছিল তখন এটা আমাকে দিয়েছিল। আমি চাইছিলাম জিনিসটা তোমাকে শোনাতে, তাই রেখে দিয়েছিলাম। আরো দুটো টেপ আছে। পরে দেব। অবশ্য যদি তুমি কাউকে আমার কথা বল তাহলে সেটা আর কখনো হবে না।”

ছেলেটা চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।

“দাঁড়াও..” আমি বললাম, ওর পেছন পেছন যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। আমার পাগুলো নড়ছিল না। একদম জমে গিয়েছিল। ঐ লোকটা যখন পিছে এসে দাঁড়িয়েছিল তখনের মত। আমি জানি না কেন আমার এরকম হয়েছিল, ছেলেটা তো আমাকে হুমকিও দেয়নি…উল্টো আমাকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু তারপরেও আমার সারা শরীর ভেঙে পড়েছিল। আমি পুরো ঘেমে গিয়েছিলাম।

এক মুহূর্ত পর ছেলেটা সেলফের কোনা থেকে ঘুরে আমার দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেল। আমি ক্যাসেটটা হাতে নিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকলাম।

ট্রেনে চড়ে বাসায় ফেরার সময়, সিটে বসে টেপটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গিয়েছিল, বাইরেটা অন্ধকারে ঢাকা। জানালাগুলোতে গাঢ় অন্ধকার, যেন কয়লা ঘষা হয়েছে। বাইরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল যেন ট্রেন নড়ছে না। শীতের কারনে সূর্য তখন তাড়াতাড়ি অস্ত যাচ্ছিল। আপু যখন খুন হয়েছিল তখন হয়তো বাইরে একটু আলো ছিল।

কে ছিল ছেলেটা? হাই স্কুল ইউনিফর্ম পড়া, তার মানে আমার বয়সি হবে। কিংবা আমার চেয়ে এক-দুই বছরের ছোট। সে দাবি করছিল সে আমার বোনকে চেনে। কিন্তু আপু কখনো এরকম কারো কথা আমাকে বলেনি।

যদি মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে তাদের দেখা হয়ে থাকে তাহলে সে সময় পায়নি ছেলেটার কথা বলার।

ছেলেটা বলেছে আপু ওকে টেপটা দিয়েছে। সে কি বলতে চেয়েছে আমার বোন চেয়েছিল আমি টেপটা শুনি? আর কষ্ঠ ১ : কিটাযাওয়া হিরোকো’ লেখাটার মানে কি?

ট্রেনের গতি কমে এলে অভ্যাসবশত আমার শরীর নড়ে উঠল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ট্রেন থেকে নেমে গেলাম।

স্টেশনের কাছে লোকজনের ভিড় থাকলেও যে মুহূর্তে আবাসিক এলাকায় পা রাখলাম, কোন জন-প্রাণী দেখা গেল না। খালি পিচঢালা রাস্তা এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারে মিশে গিয়েছে। ঠাণ্ডা বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে আমি বাসার দিকে হেঁটে চললাম। রাস্তার ধারের বাড়িগুলো থেকেই যা একমাত্র আলো আসছিল। ওগুলোর প্রত্যেকটায় একটা করে পরিবার আছে, ডিনার টেবিলে বসা, নিজেদের মত জীবন চলে যাচ্ছে তাদের-এই তথ্যটা হঠাৎ করে আমার কাছে চমকপ্রদ মনে হলো।

আমাদের বাড়ির জানালাগুলো অবশ্য অন্ধকার ছিল। এর মানে এই না যে কেউ বাসায় ছিল না। সামনের দরজা খুলে আমি লিভিং রুমে ঢুকলাম, বাবা-মাকে জানালাম আমি বাসায় ফিরেছি।

তারা সোফায় বসে টিভি দেখছিল। কোন কথা নেই। বাতি জ্বালানোর ইচ্ছাও হয়নি তাদের। টিভির স্ক্রিন ছিল রুমের আলোর একমাত্র উৎস। আমি সুইচ টিপে আলো জ্বালালে তারা আমার দিকে ঘুরে প্রাণহীন সুরে আমাকে স্বাগতম জানালেন।

“তোমরা আবারো দরজা লক করতে ভুলে গিয়েছ,” আমি বললাম। উত্তরে আমার মা টিভির দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালেন খালি। তার মধ্যে জীবনের কোন চিহ্ন নেই। কোন কিছুতে তার যেন আর কিছু আসে যায় না।

তারা আসলে টিভির কিছুই দেখছিলেন না। টিভিতে দেখানো কোন কিছুই তাদের চোখ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। আমি তাদের পিঠের ভাঁজ পড়া পোশাকের দিকে একবার তাকিয়ে উপর তলায় আমার রুমে গেলাম।

ব্যাগটা বিছানার উপর ফেলে, ইউনিফর্ম না বদলেই টেপটা আমার স্টেরিওতে ঢোকালাম। স্টেরিওটা ছোট ধরনের ছিল, নীলচে রুপালি রঙের, সেলফের দ্বিতীয় তাকে রাখা ছিল। আমি ওটার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।

আপুর চেহারা আমার চোখে ভাসল-খুনের আগে সে যেভাবে আমার দিকে বিরক্ত চেহারায় তাকাত, সেই চেহারা নয়। যখন আমরা আরো ছোট ছিলাম, হাত ধরে একসাথে হাঁটতাম তখন সে যেভাবে আমার দিকে তাকাত সেই চেহারা।

প্লে বাটনে চাপ দিলাম। যান্ত্রিক শব্দ করে মোটরগুলো ঘুরতে লাগল। আমি স্পিকারগুলোর দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।

প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছুই ছিল না, সেফ নিরবতা। তার পর একটা হিস ধরনের শব্দ, বাতাসের মত। আমার হৃদপিণ্ড দ্রুত চলছিল, নার্ভাস লাগছিল।

আমি যেটাকে বাতাসের শব্দ ভেবেছিলাম সেটা তা নয়, কেউ একজন মাইক্রোফোনের সামনে নিঃশ্বাস ফেলছিল আসলে।

নাটসুমি…

হঠাৎ আমি আপুর কণ্ঠ শুনতে পেলাম। ওর গলা দূর্বল শোনাচ্ছিল। ক্লান্ত। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কণ্ঠটা ওরই। ছেলেটা মিথ্যে বলেনি। আমার বোন সত্যি সত্যি আমার জন্য একটা টেপ রেখে গিয়েছে।

‘নাটসুমি, জানি না তুমি কখনো এটা শুনতে পারবে কিনা? এই মুহূর্তে আমি আমার সামনে রাখা একটা মাইক্রোফোনে কথা বলছি। কিন্তু জানি না এই মেসেজ কোনদিন তোমার কাছে পৌঁছাবে কিনা…’

কখন, কোথায় সে এটা রেকর্ড করেছিল? ওর গলা এত পাতলা শোনাচ্ছিল যে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিল। সে আস্তে আস্তে কথা বলছিল, থেমে থেমে, যেন কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। শব্দগুলোর মধ্যে দীর্ঘ বিরতি, আর কেমন যেন মরিয়া ভাব। কিন্তু এসব কিছুর কারনে ব্যাপারটা আরো সত্যি মনে হচ্ছিল। কোন স্ক্রিপ্ট করা বক্তব্য না, বরং নিজের চিন্তাকে শব্দে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

‘শোন, তোমাকে একটা মেসেজ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে আমাকে বলা হয়েছে মাইক্রোফোনে আমি যা খুশি বলতে পারব, যা খুশি…কিন্তু শুধুমাত্র একজন মানুষকে। আর আমি সাথে সাথে তোমার কথা চিন্তা করেছি-আমি উপলদ্ধি করেছি তোমাকে কিছু কথা বলা আমার জন্য কতখানি জরুরি। জানি অদ্ভুত শোনাচ্ছে কিন্তু তোমার সাথে আমার কথা বলা দরকার, আকাগির সাথে নয়…’

সে মাইক্রোফোনটা আমার মুখের দিকে ধরে রেখেছে…ওর সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব না, সে দেবে না বলতে। আমি দুঃখিত। সে কথা দিয়েছে মেসেজটা তোমাকে পাঠাবে। সে দেখতে চায় আমার কথাগুলো

শুনে তোমার প্রতিক্রিয়া কি হয়। আমার কাছে ব্যাপারটা আনন্দ লাভের জন্য জঘন্য উপায় মনে হলেও আমার কথাগুলো যদি তোমার কাছে পৌঁছায় তাহলে বাকি কোন কিছুতেই আমার কিছু আসে যায় না…

আমি নড়তে পারছিলাম না। একটা ভয়াবহ সন্দেহ আমার মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল। একটা কণ্ঠ আমার মাথার ভেতর প্রতিধ্বনি তুলছিল, আমাকে সাবধান করছিল টেপের বাকিটা যেন না শুনি। দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করছিল আমার জন্য, আর আমি যদি মেসেজটা শুনি তাহলে ফিরে যাওয়ার আর কোন রাস্তা খোলা থাকবে না আমার সামনে। এই ব্যাপারে আমি এতটাই নিশ্চিত ছিলাম যে এর মুখোমুখি হতে পারছিলাম না, নিঃশ্বাস ফোপানির মত করে বেরিয়ে এল আমার বুক থেকে।

টেপটা বন্ধ করতে পারব না আমি। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আপুর কণ্ঠ শুনতে লাগলাম।

‘নাটসুমি, আমি এখন একটা অন্ধকার রুমে। নড়াচড়া করতে পারছি না। চারদিকে কংক্রিট…আর অনেক ঠান্ডা…একটা টেবিলের উপর আমি…’

আমি হাত তুলে আমার মুখ চাপা দিলাম, বেরিয়ে আসতে চাওয়া চিৎকারটা ঠেকাতে চাইছিলাম। আমি জানি সে কোথায় ছিল, কোথায় সে

মাইক্রোফোনে কথা বলছিল।

আপু কাঁদছিল কথা বলার সময়।

‘এই জায়গাটা…পুরনো কোন বাতিল বিল্ডিং…’

ওর মলিন কণ্ঠের কষ্টপূর্ণ একটা প্রতিধ্বনি শীতল, অন্ধকার কংক্রিটের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল। ওর কষ্ট আমার বুক ছিদ্র করে ফেলছিল।

অবচেতন মনে আমি টেপ ডেক স্পিকারগুলোর উপর কাঁপা কাঁপা হাতে আঙুল বোলালাম, যেন আপুর কণ্ঠ স্পর্শ করতে চাইছিলাম।

‘আমি দুঃখিত, নাটসুমি।

ওর কথাগুলো আমার আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে মিশে গেল। আঙুলে স্পিকার থেকে বের হওয়া কম্পন টের পেলাম, মনে হলো যেন ওর কণ্ঠের একটা অংশ ছিল সেটা। আপুর নিঃশ্বাসের শব্দও হারিয়ে গেল। টেপটা শেষ।

আমি টেপটা ঘুরিয়ে অন্য পাশটা চালালাম কিন্তু সে অংশটা খালি ছিল।

কোন সন্দেহ নেই, টেপটা আপু খুন হওয়ার আগের মুহূর্তে রেকর্ড করা হয়েছিল। বুক স্টোরে টেপটা নেয়ার কথা মনে পড়ল আমার। ছেলেটা একটা খামে টেপটা আমাকে দিয়েছিল, আর খামটা ফেরত নিয়ে নিয়েছিল।

সে টেপটা স্পর্শ করেনি। টেপে ওর কোন ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই। সেইকি আপুর সামনে মাইক্রোফোন ধরে ছিল? সেইকি আপুকে খুন করেছে?

আমার উচিত টেপটা পুলিশের হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু সেটা করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। ছেলেটা যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল পুলিশকে জানালে বাকি টেপগুলো আর পাওয়া যাবে না।

মেসেজে আরো কথা ছিল। আর সেই কথাগুলো আমি শুনতে চাই।

***

টেপটা শোনার পরপরই আমি আমার স্কুল ফাঁকি দিয়ে ম**** হাই স্কুলের সামনে গেলাম।

ম**** হাই স্কুল ছিল একটা সরকারি স্কুল। আমার স্কুল থেকে দুই স্টেশন পরে। স্কুলের গেটটা ব্যস্ত রাস্তার দিকে মুখ করা আর চারপাশ সুন্দর করে ছাঁটা গাঢ় সবুজ ঝোঁপের বেড়া দিয়ে ঘেরা। দেখে মনে হচ্ছে সবুজ দেয়াল। বেড়ার উপর দিয়ে স্কুলের সাদা ছাদ চোখে পড়ছে।

স্কুলের গেটের কাছাকাছি রাস্তার অপর পাশে একটা দোকান, সেখানে ম্যাগাজিন র‍্যাকের কাছে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে স্কুলের উপর নজর রাখছিলাম আমি। প্রায় এক ঘন্টার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার ভান করলাম। স্কুল ছুটি হলে শিক্ষার্থীরা বের হতে শুরু করল। সূর্য তখন প্রায় অস্ত যাচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা প্রায় সবাই গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে আমার সামনে দিয়েই যাচ্ছে। কারণ স্টেশন এই পাড়ে ছিল। ফুটপাথও চওড়া। আমি সবার চেহারা দেখছিলাম একজন একজন করে।

ওদের দেখতে দেখতে আমার বোনের কথাগুলো মনে পড়ছিল।

আমি অনেকবার, বার বার টেপটা বাজিয়ে শুনেছি, প্রতিবারই একইভাবে ধাক্কা খেয়েছি। ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে আমার। বিছানায় শুয়ে খালি সিলিঙের দিকে তাকিয়ে থাকি, চিন্তা করি। কিন্তু চিন্তাগুলো কোথাও গিয়ে পৌঁছাতে পারে না।

আমার কেমন যেন হতবিহ্বল লাগছে, না ঘুমাতে পারার কারনে হয়তো? ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে ওলটাতে আড়চোখে ক্লার্কের দিকে তাকালাম। এতক্ষন এখানে দাঁড়িয়ে আছি সে জন্য রেগে যাচ্ছি কিনা। হয়তো সন্দেহ করছে। আমার ভয় হচ্ছিল সে আমাকে কিছু বলে কিনা।

জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে পেলাম পাঁচটা ছেলের একটা দল যাচ্ছে, হাসতে হাসতে কথা বলছে। ওদের একজনের সাথে আমার চোখাচোখি হলো।

সে দাঁড়িয়ে গেল, অবাক হয়েছে, তারপর সাথে বন্ধুদের কিছু একটা বলল। কাঁচের ভেতর দিয়ে আমি কথাগুলো শুনতে পাইনি, সম্ভবত বলল ওকে ছাড়া এগিয়ে যেতে ধরনের কিছু। তারা ছেলেটাকে রেখে চলে গেল।

আমি ওকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।

ছেলেটা দোকানের দরজা খুলে ছুটে আমার দিকে এল। “কিটাযাওয়া? তুমি এখানে কি করছ?”

ওর নাম কামিয়ামা ইটসুকি। জুনিয়র হাই থেকে আমি ওকে চিনি। ও স্কুলের বাস্কেট বল টিমের মেম্বার ছিল, আমি ছিলাম টিমের ম্যানেজার। কুকুরছানার মত কিউট চেহারা করে রাখত ও সবসময়। সদা হাস্যজ্জল। ও আমার চেয়ে অনেক লম্বা হলেও যেভাবে আমার দিকে দৌড়ে এল তাতে ছোট কুকুর ছানার মতই লাগল আমার কাছে।

“বোল না যে তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছ?”

ওকে আসতে দেখে আমি এতটাই নিশ্চিন্তবোধ করছিলাম যে প্রায় কেঁদেই ফেলছিলাম। হঠাৎ উপলদ্ধি করলাম কতখানি আতংকে ছিলাম আমি।

“ফালতু কথা বোল না, ভুলব কেন? অনেকদিন হয়েছে অবশ্য..”

আমার বোনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কথা ভাবলাম আমি। চারদিকে আত্মীয়স্বজন আর আপুর কলেজের বন্ধুরা। ইটসুকি আমার দিকে ছুটে এসেছিল। আমরা দু-জন আমাদের হাই স্কুল ইউনিফর্ম পড়ে ছিলাম। ও পুরোটা সময় আমাকে সঙ্গ দিয়েছিল, মন ভালো করার চেষ্টা করছিল, আমার পাশে ছিল। ব্যাপারটা আমার কাছে অনেক ছিল।

ওর ইউনিফর্মর ক্রেস্টটা আমার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। সেজন্য আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ছেলেটা আমাকে টেপ টা দিয়েছিল সে যে ম*** হাই স্কুলের ছাত্র। ছেলেটার নাম যেহেতু আমার জানা নেই সুতরাং একমাত্র স্কুল দিয়েই আমি ওকে খুঁজে পেতে পারি।

“তোমাকে এখানে দেখে খানিকটা অবাক হয়েছি। কারো জন্য অপেক্ষা করছ নাকি?”

আমি ওকে বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না যে আমি গেটের দিকে তাকিয়ে আছি, আমার বোনের সম্ভাব্য খুনি কখন বের হবে সেজন্য অপেক্ষা করছি। সুতরাং মাথা নাড়লাম। আমি জানি না আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছিল কিন্তু ও সিরিয়াস হয়ে গেল।

“কোন সমস্যা হয়েছে?” ইটসুকি প্রশ্ন করল, ওকে চিন্তিত শোনাল। “নাকি এখনো তোমার বোনের ব্যাপারে,.” ও আমার আর আপুর মধ্যের সমস্যার কথা জানত। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে আমি ওকে সব জানিয়েছিলাম।

অন্তেস্টিক্রিয়ায়ায় রাখা আপুর ছবিটা মারা যাওয়ার অল্প কিছুদিন আগেই তোলা হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই আমাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে

ছিল। আপুকে খুব সুন্দর লাগছিল ছবিটায়। সেটা দেখে আমার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল।

“না আপুর ব্যাপারে না।”

“কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত তুমি? তুমি বলেছিলে আপুর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলে,.”

“হ্যাঁ, কিন্তু…বাদ দাও ব্যাপারটা। আমি দুঃখিত তোমাকে ঐদিন এসব কথা জোর করে শুনিয়েছি।”

ইটসুকি সমবেদনার চোখে আমার দিকে তাকাল। “পুলিশ কি কিছু জানতে পেরেছে কে খুন করেছে?”

আমি ওর দিকে তাকালাম।

“তোমাকে অন্যরকম লাগছে।”

ওর সহজাত প্রবৃত্তি বেশ ভালো দেখা যাচ্ছে। আমি মাথা নারলাম। “পুলিশ এখনো কিছু..”

“হুম,” ও জোরে শ্বাস ফেলল।

সেই মূহর্তে যার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তাকে দেখা গেল। ইটসকির সাথে কথা বলার সময় সূর্য ডুবছিল, যে কারনে বাইরে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। কিন্তু তারপরেও ছেলেটা যখন রাস্তা পার হচ্ছিল তখন জানালা থেকে আমি ওর চেহারা পরিস্কার দেখতে পেলাম।

যদিও আমি নিশ্চিত না ছেলেটা আসলেই আপুকে খুন করেছে কিনা, কিন্তু যে মুহূর্তে ওকে দেখলাম সাথে সাথে একরাশ ভয় এসে আমাকে গ্রাস করল। মনে হল যেন হঠাৎ আমি এক দলা অন্ধকারের মধ্যে ডুবে গিয়েছি।

তারা ম্যাগাজিন র‍্যাকের সামনের জানালা দিয়ে হেঁটে গেল। ইটসুকি আমার দৃষ্টি লক্ষ্য করে বাইরে তাকাল, কি কারনে আমি হঠাৎ চুপ করে গেলাম বুঝতে চাইল।

“মোরিনো,” সে বলল।

“ছেলেটার নাম মোরিনো?”

“না, মেয়েটার নাম। সবাই চেনে ওকে। একজন টিচার ওর গায়ে হাত দিতে গিয়েছিল। ও পিটিয়ে লোকটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল।”

ইটসুকির মত ওরাও সেকেন্ড ইয়ারের শিক্ষার্থী।

“তুমি কি ছেলেটার নাম জান?” আমি ব্যগ্রভাবে জানতে চাইলাম।

ইটসুকি একটু ভাবল। “উমম, হ্যাঁ, ছেলেটার নাম হল..”

ও একটা নাম বলল, আমি আমার মগজে ভালোমত গেঁথে নিলাম যেন কখনো ভুলে না যাই।

হাতের ম্যাগাজিনটা নামিয়ে রেখে দোকান থেকে বের হলাম। ঠান্ডা বাতাস আমাকে ঘিরে ফেলল।

দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওদের পেছন দিকটা দেখতে পাচ্ছিলাম। স্টেশনের দিকে এগোচ্ছিল ওরা।

মেয়েটা মনে হয় টের পেয়েছিল কেউ ওদের দেখছে, কারন সে ঘুরে আমার দিকে তাকাল। আমাকে কয়েক মুহূর্ত দেখে আবার সামনে ঘুরে গেল।

দোকানের দরজা খুলে ইটসুকি বেরিয়ে এল। “ছেলেটার সাথে আমি গত বছর একসাথে ক্লাস করেছিলাম।”

“কেমন ধরনের ছেলে?”

ইটসুকি এক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল। “জানি না…সাধারণ ধরনের?”

আমি ইতস্তত করছিলাম। আমি কি ছেলেটার পিছু পিছু যাব? কিন্তু আমার সাথে ইটসুকি আছে, আর ছেলেটার সাথে মোরিনো মেয়েটা আছে। এরকম সময়ে আপুর টেপ নিয়ে কিছু জানতে চাওয়া ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। সুতরাং আইডিয়াটা বাদ দিলাম।

“কোন সমস্যা?”

আমি মাথা নাড়লাম। দুজনে একসাথে হাঁটতে লাগলাম স্টেশনের দিকে। যেদিকে ওরা গিয়েছে। ওদেরকে অবশ্য তখন আর দেখা যাচ্ছে না।

রাস্তার ধারের দোকানগুলোর নিয়ন সাইন আর সারি সারি করে রাখা ভেন্ডিং মেশিনগুলো থেকে আসা উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ছিল। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর শীতকালের অন্ধকার যেন অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ঘন মনে হচ্ছে। ভেন্ডিং মেশিনের আলোরই শুধু কোন পরিবর্তন নেই।

হাঁটতে হাঁটতে ইটসুকি আর আমি আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করলাম। আমি শুধু ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে প্যাচাল পাড়লাম, কারন একমাত্র এই বিষয় নিয়ে কথা বলাই নিরাপদ মনে হলো আমার কাছে। ও অবশ্য ওর স্কুল, বন্ধু-বান্ধবি, বেড়াতে যাওয়া সবকিছু নিয়েই মজার মজার গল্প শোনাল।

সেরকম আহামরি কোন গল্প না, একজন হাই স্কুলের ছাত্র অহরহ যে ধরনের গল্প করে থাকে সেসব আর কি। কিন্তু গল্পগুলো আমাকে শান্ত করতে সাহায্য করল। হয়তো ইটসুকি আমার টেনশন বুঝতে পেরে মন ভালো করানোর চেষ্টা করছে।

গাড়িগুলো সাঁ সাঁ করে আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল। ওগুলোর জ্বালানো হেডলাইট আমাদের মুখের উপর আলো ফেলছে। “ওখানে বসে কথা বলতে চাও?” ইটসুকি স্টেশনের সামনের একটা ফ্যামিলি রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে বলল।

রেস্টুরেন্টের ভেতর ডিনার করতে আসা লোকজনের হাউকাউ। একজন ওয়েট্রেস আমাদেরকে পেছন দিকের একটা বুথে নিয়ে গেল। দেয়াল আর পার্টিশনগুলোতে রুপালি আল্পনা করা, আলো পড়ে ঝকমক করছে।

“তোমার বাবা-মা কেমন আছেন?” ইটসুকি জানতে চাইল।

“ভালো না, তারা বাসা ছেড়ে কোথাও যায় না।”

আমি ওকে বললাম আপু মারা যাওয়ার পর বাসার কি অবস্থা। ঘরের কোনায় ধুলো, টিভি চালানো কিন্তু লাইট নেভানো, কিভাবে তারা দরজা লক করতে ভুলে যায়।

“তার মানে তারা এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি…?”

“হ্যাঁ, বিশেষ করে আপুর লাশ দেখার পর..”

সে মাথা দোলাল। আমি ওকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় বলেছিলাম, আপুর লাশের অবস্থা আসলে পত্রিকায় যা বলা হয়েছে তারচেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় ছিল।

“জানি না তাদের কোন উন্নতি হবে কিনা?” বিড়বিড় করে বললাম, বাবা-মায়ের শূন্য চেহারার কথা চিন্তা করে। তাদের দেখে মনে হয় জীবনের স্ফুলিঙ্গ তাদের ভেতর থেকে আজীবনের জন্য হারিয়ে গিয়েছে।

“আকাগির কি অবস্থা?”

“অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর সে কয়েকবার এসেছিল, কিন্তু ইদানিং…”

আকাগি, আমার বোনের বয়ফ্রেন্ড…আপুর খুনের ঘটনায় বিধ্বস্তদের একজন সে। আপুর সাথে এক কলেজেই পড়ত। যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম না, আমি ভেবেছিলাম ওখানেই ওদের দেখা হয়েছে। আপু ওকে সাথে করে বাসায় নিয়ে আসত, আমার সাথে কয়েকবার কথা হয়েছিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় ও আমার বাবা-মায়ের পাশে ছিল, সান্ত্বনা দিচ্ছিল।

“হয়তো হিরোকোর খুনের জন্য আমিই দায়ি, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর ও বলেছিল। “ওর খুনের আগেরদিন আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল, আমার রুম থেকে ছুটে বের হয়ে গিয়েছিল, তারপর,.”

পরের দিন, আপুর লাশ ঐ পরিত্যক্ত হাসপাতালে পাওয়া যায়।

আকাগিই শেষ ব্যক্তি যে আপুকে জীবিত দেখেছে।

ওরা যদি ঝগড়া না করত, তাহলে আপুর সাথে খুনির হয়তো দেখা হত না। খুনও হতে হত না আপু। আকাগি নিজের মুখ ঢেকে এরকম কিছু কথা আমাকে বলেছিল।

“আমাকে এখন যেতে হবে,” ইটসুকি বলল। ওর ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছে।

“আমি আরো কিছুক্ষণ থাকব।”

“ঠিক আছে, কিন্তু..” সে এক পা গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। “তোমার যদি কোন কিছু নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করে, তাহলে অবশ্যই আমাকে ফোন দিও।”

ওকে ধন্যবাদ জানালাম। ও চলে গেলে, একা বসে কফি খেতে খেতে পাশের টেবিলের পরিবারকে দেখতে লাগলাম। সরাসরি তাকাইনি, আড়চোখে দেখছিলাম।

অল্পবয়সি স্বামী-স্ত্রী, সাথে দুটো মেয়ে বাচ্চা।

আমাদের পরিবারের মত মনে হলো আমার কাছে। ছোট বাচ্চাটা বেশি ছোট, কথা বলতে শেখেনি। মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে রেখেছে। চারপাশের সবকিছু বড় বড় চোখ করে দেখছে। আড়চোখে তাকানোর সময় পিচ্চিটার সাথে আমার চোখাচোখি হলো।

আপুর কথা মনে পড়তে লাগল।

আমরা যখন ছোট ছিলাম, দু-জনে একসাথে হাঁটতে গিয়েছিলাম। সম্ভবত বসন্তের কোন উষ্ণ দিন ছিল। আমি তখন মাত্রই এলিমেন্টারি স্কুল শুরু করেছি।

আমরা দুজন একসাথে পাহাড়-টিলায় চড়তাম, বাড়ির পর বাড়ি পেরিয়ে যেতাম। পাহাড়ের চূড়ায় একটা বন ছিল। সেখান থেকে আমরা নিচে পাহাড়ের ছায়ায় থাকা শহর দেখতাম-যতদূর চোখ যায় ঘোট ঘোট বাড়িঘর।

উপরে তাকালে আকাশে একটা লম্বা সাদা ডানাওয়ালা একটা পাখি দেখা যেত। একটা বড় নদী শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। আমার অনুমান ছিল পাখিটা ওখানেই কোথাও থাকে। পাখিটা প্রায় নড়াচড়া করছিলই না। স্রেফ বাতাসে ভর দিয়ে ভেসে ছিল। বিরক্ত না হয়ে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতাম।

আপু আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, ওর দাঁতগুলো ঝকমক করে উঠল। হাসলে ওর শ্বদন্তগুলো বেরিয়ে থাকত। এমন কি বড় দাঁত উঠার পরেও। আমরা অনেক সময় ভ্যাম্পায়ার ভ্যাম্পায়ার খেলতাম। কতদিন আমি আপুকে হাসতে দেখিনি! কতদিন আমি ওর শ্বদন্তগুলো দেখিনি! কতদিন!

ও যখন চুল রঙ করালো, আমি ভাবছিলাম আমিও করাবো কিনা।

“তুমি কোরনা, তোমাকে বাজে দেখাবে,” আপু বলেছিল। আমি এরকম পরামর্শ মেনে নিতে পারছিলাম না। ওর কথার সুরে কেমন জানি। একটা ধার ছিল। আমার গায়ে বিধেছিল।

প্রতিবার সে ওরকম কিছু করলে, আমার মনে হত সে আমাকে চায় না বা কিছু। কেন ও খুন হল? যে ওকে খুন করার মত ঘৃণা করতে পারে কেউ তা আমার কোনভাবে বিশ্বাস হয় না। আর খুন হওয়ার আগে সে আমাকে কি বলতে চেয়েছিল?

আমার টেবিলের উপর একটা ছায়া পড়ল। মুখ তুলে দেখি কালো ইউনিফর্ম পরাএকটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দোকানের সামনে দিয়ে মোরিনোর সাথে যে ছেলেটা হেঁটে যাচ্ছিল।

“কিটাযাওয়া, তুমি আমার স্কুল থেকে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলে।”

যতটা অবাক হওয়া উচিত ততটা অবাক হতে পারলাম না আমি। আমার মনে হয়েছিল এরকম পরিস্থিতিতে এরকম কিছু হওয়াটাই স্বাভাবিক। উঠে দাঁড়ালাম না। আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, “তুমি আমার বোনকে খুন করেছ?”

এক মুহূর্তের জন্য ও চুপ করে থাকল। তারপর ওর ঠোঁট আস্তে করা খুলে গেল আর শব্দগুলো বেরিয়ে এল : “হ্যাঁ, আমি ওকে খুন করেছি।”

ওর মৃদু কণ্ঠে বলা কথাগুলো মিলিয়ে গেল আমার কানে, রেস্টুরেন্টের ভেতরের হাউকাউয়ে মিলিয়ে গেল সেটা।

আমার সামনে বসল ছেলেটা, যেখানে এতক্ষন ইটসকি বসে ছিল। আমি নড়তে পারছিলামনা, মনে হচ্ছিল সারা শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছে। আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অবশ্য যদি নড়াচড়া করতেও পারতাম তাহলেও ছেলেটাকে বসতে বাধা দিতাম না। কিংবা উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতাম না।

“আমি ওকে খুন করেছি।” ছেলেটার কথাগুলো আমার মনে প্রতিধ্বনি তুলছে। আমি জানতাম এই সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আমার মন আমার কান যা শুনেছে তার সাথে একমত হতে চাইছে না। ব্যাপারটা অনেকটা টবের গাছে, অতিরিক্ত পানি ঢালার মত-ছেলেটার কথাগুলো আমার খুলি আর মগজের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু এর বেশিরভাগই মেনে নিতে অক্ষম ছিলাম।

ও আমার দিকে তাকিয়ে মাথা খানিকটা সামনে বাড়িয়ে দিল, মুখ নড়ছে। মনে হচ্ছিল জানতে চাইছে আমি ঠিক আছি কিনা। আমি কথাগুলো

ওর ঠোঁটে নড়তে দেখছিলাম কিন্তু কিছু শুনতে পারছিলাম না। ও টেবিল ঘুরে এসে আমার কাঁধ স্পর্শ করার চেষ্টা করল। ওর স্পর্শ পেয়ে আমার অসাড়তা ভাঙল।

“আমাকে ছোঁবে না?”

আমি বুথের মধ্যে পিছিয়ে গেলাম, ওর থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে যেতে চাইছিলাম। ইচ্ছাকৃত ক্রিয়া ছিল না, বরং সহজাত প্রবৃত্তি থেকে দেয়ালের দিকে সরে গেলাম।

রেস্টুরেন্টের আলো আর শব্দ হঠাৎ করে আমার কাছে ফিরে এল। মিউজিক কিংবা কাস্টমারদের হাউকাউ কখনোই বন্ধ হয়নি, সে আমার চোখে কানে ওগুলো পৌঁছাচ্ছিল না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল সময় যেন থেমে গিয়ে আবার শুরু হলো।

আমি বুঝতে পারিনি যে কথাগুলো জোরে বলে উঠেছিলাম। পাশের টেবিলের পরিবারটা শুনতে পেয়েছিল। পুরুষ এবং নারী দু-জনেই আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে চোখ পড়তেই তারা বিব্রত বোধ করে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের আলাপে ফিরে গেল।

“তুমি ঠিক আছ, নাটসুমি?” ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, ওর হাত ফিরিয়ে নিয়েছে। সিটে হেলান দিয়ে প্রশ্নটা করেছে সে। আমি আমার আগের জায়গায় ফিরে গিয়ে মাথা নাড়লাম।

“না।” আমার বুক ব্যথা করছিল। কাঁদছিলাম না, কিন্তু কথার মধ্যে কান্নার সুর ছিল। “কিছুই ঠিক নেই..”

আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে যেন। বুঝতে পারছিলাম না ছেলেটাকে আমার ভয় পাওয়া উচিত নাকি ওর উপর রাগ করা উচিত। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছিলাম আমার বিপরীতে বসে থাকা ছেলেটাকে কিছু করা আমার ক্ষমতার বাইরে।

আমি নিজের উপর যতই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি না কেন, সে ছিল পুরোপুরি শান্ত। আর সে ওখানে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে লক্ষ্য করছে। মনে হচ্ছে আমি কোন মানুষ নই, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রাখা কোন পোকামাকড়।

“নাটসুমি, আমি চাই না তুমি চিৎকার কর,” অনুভূতিহীন সুরে ছেলেটা বলল, যেন ওর হৃদয় বলতে কিছু নেই। টেবিলের এপাশ থেকে আমি বুঝতে পারছিলাম সে খুবই ভয়ঙ্কর একজন মানুষ।

“কেন তুমি ওকে খুন করলে..?”

এই ছেলে ইটসুকির মত কখনো হাসে না, কিংবা অপ্রত্যাশিত কিছু সামনে পড়লে অবাক হয় না। ও ছিল ডালপালা কেটে ফেলা, পাতা বিহীন একটা গাছের মত, ননতম জিনিসগুলো ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। জানি শুনতে অদ্ভুত লাগছে কিন্তু আমার কাছে ওকে এরকমই মনে হয়েছিল।

“আমি জানি না কেন হিরোকোকে খুন করেছি, সত্যি জানি না, সে আস্তে আস্তে বলল। “কিন্তু কোন কারন ছিল না। ওর মৃত্যুই আমার সাথে কোনভাবে যুক্ত ছিল।”

“তোমার সাথে?”

কয়েক মুহূর্ত সে কিছু বলল না, মনে হলো কোন চিন্তায় ডুবে গিয়েছে। কিন্তু আমার থেকে চোখ সরায়নি একবারের জন্যও। অবশেষে কিছু না বলে মুখ দিয়ে ইশারা করে পাশের টেবিলে পরিবারটিকে দেখাল।

“কিছুক্ষণ আগে তুমি ওদের দেখছিলে তাই না?” বাচ্চা মেয়ে দুটো একজন আরেকজনের সাথে খুনসুটি করছে।

“তুমি তোমার অতীত দেখতে পাচ্ছিলে তাই না? ভাবছিলে তোমার আর হিরোকোর সাথে ঐ মেয়ে দুটোর কত মিল? ওদের দেখে তোমার নিজের ছোটবেলার সুখ স্মৃতিগুলো মনে পড়ছিল, আর তুমি এমনভাবে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলে যেন মূল্যবান কোন সম্পদের দিকে তাকিয়ে আছ।”

“চুপ কর…”

আমি দুহাতে কান চাপা দিতে চাইলাম যেন ওর গলা শুনতে না হয়। মনে হচ্ছে যেন সে আমার মনের পাহাড়ে নোংরা জুতো পড়ে হাঁটাহাঁটি করছে।

“আমার নিজেরও বোন আছে। অনেক বছর আগে আমরাও নিশ্চয়ই এভাবে ডিনারে যেতাম, ঐ পরিবারটার মত। যদিও আমার এরকম কোন স্মৃতি নেই কিন্তু নিশ্চয়ই এরকম কিছু হয়েছিল। শুনে অবাক লাগছে না তোমার কাছে?”

ওর প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণের সাথে পাল্লা দিয়ে আমার হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগল। মনে হচ্ছে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছি, প্রতি মুহূর্তে গড়িয়ে পড়ার গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

“ছোট মেয়েটাকে দেখ-মনোযোগ দিয়ে দেখ। সাবধানে, তুমি যে দেখছ সেটা যেন খেয়াল না করে,” ছেলেটা নিচু গলায় বলল।

আমি ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে কাছের সিটে বসা ছোট মেয়েটার দিকে তাকালাম। বুথে বসে সে নিষ্পাপ চোখগুলো দিয়ে দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে। ওর হাতগুলো শক্ত করে মায়ের পোশাক ধরে আছে। আমি মেয়েটাকে না চিনলেও, নাম না জানলেও, ভালবেসে ফেললাম।

“নাটসুমি, তোমার কি মনে হয় আজ থেকে দশ বছর পরে ঐ মেয়েটা কাউকে খুন করতে পারবে?”

আমার বুকটা মনে হলো জমে গেল। বাধা দিয়ে কিছু একটা বলতে ছেলেটার দিকে ফিরলাম কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। সে তার মত বলে চলল।

“মেয়েটা হয়তো ওর বাবা-মাকে খুন করবে। কিংবা ওর বোনকে। অসম্ভব কিছুই নয়। সে হয়তো এখনই এই নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে। হয়তো সে শুধু ছেলেমানুষির অভিনয় করছে। হয়তো সে আসলে চাইছে হ্যামবার্গারের প্লেটে রাখা ছুরিটা তুলে নিয়ে ওর মায়ের গলায় পোচ দিতে।”

“প্লিজ…আর না, থামো। তুমি একজন অসুস্থ মানুষ।” আমি মাথা নিচু করলাম। হাত দিয়ে শক্ত করে কান চেপে আছি। ওর বলা কথাগুলোর সাথে যুদ্ধ করছিলাম। ওর প্রত্যেকটা শব্দ আমাকে আঘাত করছে, নিদারুন কষ্ট সৃষ্টি করছে। মনে হচ্ছে আমার গালে কষে চড় বসাচ্ছে।

“নাটসুমি, আমার দিকে তাকাও…আমি মজা করছি। বাচ্চাটা খুব সম্ভব কাউকে কখনো খুন করবে না। এতক্ষন আমি যা বললাম, তা স্রেফ আমার নিজের বর্ণনা।”

আমি চোখ তুলে ওর দিকে তাকালাম। ওকে ঘোলা দেখাচ্ছিল-আমার চোখ ভর্তি পানির জন্য।

“জন্ম থেকেই আমি এমন। আমি যখন ঐ মেয়েটার মত ছোট ছিলাম তখন ব্যাপারটা বুঝতাম না, কিন্তু এলিমেন্টারি স্কুলে উঠার পর বুঝতে পারলাম আমি অন্যদের থেকে আলাদা।”

“কি…কি বলছ ত-তুমি?” আমি তোতলাচ্ছিলাম।

ওকে একটুও বিরক্ত দেখাল না, ব্যাখ্যা করে শোনাল। “বলছি যে আমার নিয়তিতে লেখা ছিল একদিন খুন করতে হবে। আমার অন্তত তাই মনে হয় আর কি। যেমন ধর একজন ভ্যাম্পায়ারের সামনে মানুষের রক্ত পান করা ছাড়া কোন উপায় খোলা নেই। আমারও খুন করা ছাড়া কোন উপায় নেই। জনের সাথে সাথেই আমার নিয়তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমার বাবা-মা আমার উপর কোন অত্যাচার করেননি কিংবা কোন মানসিক নির্যাতনও করেননি। আমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কোন খুনিও নেই। আমি একদম সাধারণ একটা পরিবারে বড় হয়েছি। কিন্তু যেখানে অন্য সাধারণ ছেলেমেয়েরা তাদের কল্পিত বন্ধু আর প্রাণীর সাথে খেলাধুলা করে সেখানে আমি সময় কাটাতাম কল্পিত মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থেকে।”

“তুমি আসলে কি?!” আমি ওকে আর একজন মানুষ হিসেবে দেখতে পারছিলাম না। ও আরো ভয়ঙ্কর কিছু, অনেক অনেক ভয়ঙ্কর।

এক মুহূর্তের জন্য ও চুপ ছিল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “আমি জানি না। আমি অনেকবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি কেন আমার কাউকে খুন করতে হবে, কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পাইনি। আর আমাকে এটা গোপনও রাখতে হয়েছে, অভিনয় করতে হয়েছে যে আমি একদম সাধারণ গোছের কেউ। খুব সাবধানে ছিলাম যাতে কেউ আমার ভেতরের সত্যি রূপটা দেখতে না পায়।

“তোমার পরিবারও টের পায়নি?”

সে মাথা নাড়ল। “আমার পরিবার আমাকে জানে একজন সাধারণ, নরমাল ছেলে হিসেবে। আমি খুবই সাবধানতার সাথে নিজের এই অবস্থান সৃষ্টি করেছি।”

“ত্‌-তোমার পুরো জীবন…তাহলে একদম মূ-মিথ্যে?”

“কিংবা বলা যায় আমার কাছে বাকি সবকিছু মিথ্যে।” ওর কথার অর্থ বুঝিনি।

সে আরো ব্যাখ্যা করল, “আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, আমার পরিবারের সাথে যেসব কথা হয় কিংবা অন্য লোকদের যে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ দেখি তার সব সত্যি। আমার ধারণা ছিল কোথাও কোন স্ক্রিপ্ট থাকে, যেটা দেখে সবাই কথা বলে-এমনকি আমি যখন ছোট ছিলাম তখন একবার পুরো বাড়ি এরকম স্ক্রিপ্টের জন্য খুঁজে দেখেছিলাম। আমি অন্যদের মত একই কথাগুলো পড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও কোন স্ক্রিপ্ট ছিল না। একমাত্র যেটা আমার কাছে সত্যি মনে হয়েছিল তা হলো মৃত্যু।”

“সে কারনে আমি মানুষের মৃত্যু দেখতে চাই।” আমি ওর মুখ থেকে কথাগুলো বের হতে দেখলাম।

“সেজন্য আমার বোনকে..?”

“সেই রাতে, আমি বাইরে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। তোমার বোনকে একটা ভেন্ডিং মেশিনের সামনে বসে থাকতে দেখি। কাঁদছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম সে ঠিক আছে কিনা। ও একটু হেসে ধন্যবাদ জানাল।

ওর শ্বদন্তগুলো ঝকমক করে উঠেছিল।”

ছেলেটা জানাল ও খুনটা করেছিল কারন শ্বদন্তগুলো ওর ভালো লেগেছিল। ওর মতে ব্যাপারটা ছিল একটু অন্যরকম ভালবাসার মত।

ওর কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হলো আমাকে রেস্টুরেন্টের বুথের ভেতর বেঁধে রাখা হয়েছে। টেবিলের উপর রাখা ওর হাতগুলোর দিকে তাকালাম আমি-সাদা হাতগুলো কালো ইউনিফরমের স্লিভগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছে, আঙুলগুলো সরু ধরনের। কিন্তু সাত সপ্তাহ আগে ঐ একই হাতগুলো আমার বোনকে খুন করেছিল।

“কারন তোমার ওর শ্বদন্তগুলো ভালো লেগেছিল?”

ছেলেটা মাথা ঝাঁকাল। তারপর ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করল।

“আমি ওগুলো রেজিনে ঢুকিয়ে রেখেছি, ভাবলাম তুমি হয়তো দেখতে চাইবে।”

সে বস্তুটা টেবিলের উপর রাখল। একটা স্বচ্ছ চারকোনা ব্লক। ভেতরে বিশটা ছোট ছোট সাদা জিনিস সারি করে রাখা। দুটো বাঁকানো সারি, একটা আরেকটার উপর রাখা।

“ওগুলো পুরো রুমে ছড়িয়ে ছিল, সবগুলো খুঁজে বের করতে বেশ সময় লেগেছে।”

রেজিনে রাখা দাঁতগুলো দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো শূন্যে ঝুলে আছে। অদৃশ্য কোন মানুষের দাঁত, প্রত্যেকটা তার ঠিক জায়গায় অবস্থান করছে।

আমি শ্বাদস্তগুলো দেখতে পেলাম।

বাচ্চাদের হাসির শব্দ আমার কানে এল। চকমকে আল্পনাগুলো রেস্টুরেন্টের আলোয় ঝলমল করে উঠল।

অদ্ভুত ব্যাপার যে আমি ভয় পেলাম না, সেফ দুঃখ বোধ করছি। কেউ আমাকে বলেনি যে ওর দাঁতগুলো পাওয়া যায়নি।

ব্লকটা তুলে আবার ব্যাগে ভরে একটা খাম বের করল সে।

“ওগুলোর কথা বাদ দাও, এই নাও দ্বিতীয় টেপট।” খামটা খুলে উপুড় করল, একটা ক্যাসেট বের হয়ে টেবিলের উপর পড়ল।

“কণ্ঠ ২: কিটাযাওয়া হিরোকো, ক্যাসেটের লেবেলে লেখা।

“আর একটা টেপ আছে।”

“আমাকে শুনতে দাও।”

“দ্বিতীয়টা শেষ কর আগে, তারপর দেখা যাবে।”

সে চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ আমি উঠার শক্তি পেলাম না। টেপটা টেবিলের উপর রেখে আমি রেজিনে রাখা আপুর দাঁতগুলোর কথা ভাবছিলাম।

কফিতে চুমুক দিয়ে দেখি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। পাশের টেবিলের মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে কেচাপ লেগে আছে। সুন্দর চোখগুলো দিয়ে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কাঁপতে থাকা হাতের কারনে কফির কাপে যে শব্দ হচ্ছিল তা নিশ্চয়ই ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

রেস্টুরেন্ট থেকে ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময় আমি গুটিসুটি মেরে সিটের উপর শুয়ে পড়লাম। আমাকে নিশ্চয়ই দেখতে ভয়াবহ লাগছিল, একজন মধ্যবয়স্ক নোক বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল তুচ্ছ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। আমার ভয় হচ্ছিল অন্য যাত্রিরা কিংবা কন্ডাক্টর হয়তো আমার পকেটে রাখা টেপটার কথা টের পেয়ে যাবে, ছেলেটার সাথে আমার কথোপকথন জেনে যাবে, আমাকে এসব নিয়ে প্রশ্ন করবে।

ট্রেন থেকে নামার পর আমি অন্ধকার আবাসিক এলাকার রাস্তায় দৌড়াতে লাগলাম। বাসায় পৌঁছে দেখি ভেতরে বাতি জ্বলছে। এখন তো আমার বাবা-মা বলতেও পারবেন না কখন সূর্য ডোবে আর কখন আলো জ্বালাতে হবে।

মাত্র দরজাটা খুলতে যাব এমন সময় সেটা ভেতর থেকে খুলে গেল আর কেউ একজন বেরিয়ে এল। আকাগি। সে আমাকে দরজার বাইরে দেখে চমকে লাফিয়ে উঠল।

“ওহ! নাটসুমি, দূর্বল একটা হাসি দিল আকাগি।

“তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগল।”

“বাসায় যাচ্ছি এখন, দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তাই..”

মাঝেমাঝে ক্লাসের পর বাসার সামনে এলে আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে গল্প করি। আকাগি বেশ লম্বা একটা ছেলে। এই দূরত্ব থেকে ওর মুখের দিকে তাকালে ঘাড় কাত করে উপরে তাকাতে হবে।– ও প্রচুর বই পড়ে। বইয়ের ভারে ওর বাসার দ্বিতীয়তলা যেকোন সময় ভেঙে পড়ার মত অবস্থায় আছে। আমরা সবসময় বই নিয়ে আলাপ করতাম। কিন্তু আজকে আমার মুড নেই, তাই একজন আরেকজনকে শুভেচ্ছা জানালাম খালি। ওকে ধন্যবাদ দিলাম আপুর কথা মনে রাখার জন্য।

আমরা যখন কথা বলছিলাম তখনো আমার মাথায় খালি টেপটা ঘুরছিল। আমার উচিত ওকে আপুর কথাগুলো শোনানো, কিন্তু কিছু বললাম না।

“তাহলে, নাটসুমি, পরে দেখা হবে…বাই।”

আকাগি হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। আমি চুপচাপ ওর চলে যাওয়া দেখলাম, নিজের পরিবর্তন দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি।

আগে যখন আমরা কথা বলতাম তখন এক মুহূর্ত শান্ত হয়ে থাকতে পারতাম না। বুক ধুকপুক করত, বিশ্রাম দিত না। প্রতিবার সে যখন আপুর দিকে তাকাত আমার মন বিমর্ষ হয়ে যেত।

ওর অনেক কিছুই আমি পছন্দ করতাম, কিন্তু আমার হৃদয় এখন নিস্তব্ধ, শীতল কোন পাথরের টুকরোর মত।

ঘাড় ডলতে ডলতে আমি উপলদ্ধি করলাম আকাগিকে এমনকি বিদায়ও জানাইনি। অথচ আগে নিজে থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে হাত নেড়ে আবার দেখা হবে!” বলতাম।

আমাদের মধ্যেকার সংযোগ ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছিল। আপুর মৃত্যুর পর ও আবার একজন অপরিচিত মানুষে পরিণত হচ্ছে। আপু না থাকলে ওর সাথে আমার কখনো হয়তো পরিচয় হত না, সেজন্য ব্যাপারটা হয়তো স্বাভাবিক।

আকাগি হয়তো চাইছেনা সম্পর্কটা হারিয়ে যাক। সেটা চাইলে সে কখনো এখানে আর আসত না।

ভেতরে গেলাম। লিভিং রুম ঠান্ডায় জমে আছে মনে হলো। বাবা-মা কোটাটসু (ভারি কম্বল, ভেতরে কাঠের টেবিল থাকে) এর ভেতর ঢুকে আছে। আমি ওদের বললাম আকাগির সাথে দরজায় দেখা হয়েছে। তারা কোন উত্তর দিল না। আমি টের পেলাম আমার মুড আরো খারাপ হচ্ছে।

উপরে গিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লক করলাম। পকেট থেকে টেপটা বের করে স্টেরিওতে ঢুকিয়ে আগের টেপটা বের করে তেবিলে রাখলাম। তারপর প্লে বাটনে চাপ দিলাম আমি।

টেপ ঘোরার শব্দ কানে এল। চেয়ারে বসে স্টেরিওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

টের পেলাম, পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছে, যখন আমরা দুজনেই এলিমেন্টারি স্কুলে পড়তাম। আমরা নিজেদের কণ্ঠ রেকর্ড করতাম। টেপে নিজের কণ্ঠ কিরকম অদ্ভুত শোনায় সেটা আবিস্কার করে অবাক হতাম। তারপর বাবা-মা এলে সবাই একসাথে গান গেয়ে রেকর্ড করতাম। ছেলেমানুষি সব গান কিন্তু আমাদের খুব মজা লাগত। বাইরে ড্রাইভিংয়ে গেলে বাবা ঐ টেপটা চালাত। আপু জুনিয়র হাইতে ওঠার পর বাবা টেপটা চালালে ও না না করে চিৎকার করত। মা ওর কান্ড দেখে সব সময় জোরে জোরে হাসত।

কী সুন্দর দিন ছিল তখন…

নাটসুমি…

‘বাবা-মাকে বোল, আর আকাগিকেও…সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ। এত সব ঝামেলা করার জন্য আমি দুঃখিত…নাকি তারা তোমার সাথে বসে এই টেপ শুনছে? আমার পক্ষে সেটা জানা সম্ভব না আর…

ও…ও এর পর আমাকে খুন করবে, প্রথমে ভেবেছিলাম ও মজা করছে..

নাটসুমি…আমি একা অন্ধকারে পড়েছিলাম এতক্ষন, চোখ-মুখ বাধা ছিল,..এক মিনিট আগেও..

যখন এটা বুঝতে পারলাম যে…কান্নাকাটি আর চিৎকার করা অর্থহীন…তখন…তখন আমার অনুশোচনা হচ্ছিল..

আমি ক্ষমা চাই…সেজন্য তোমাকে এই মেসেজ দিয়ে যাচ্ছি। উপলদ্ধি করার জন্য আমার এরকম অবস্থায় পড়তে হলো ভেবে নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে …

আমি অনেকবার অনেক কিছু বলেছি তোমাকে আঘাত করার জন্য, কিংবা হতভম্ব করার জন্য…তোমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাত সেজন্য…

আমি দুঃখিত…তোমার কোন দোষ ছিল না। আমি স্রেফ নিজের উপর রেগে ছিলাম…কারনটা জানলে তুমিও আমাকে ঘৃণা করবে…

কিন্তু কথাটা যদি না বলেই মারা যাই তাহলে সত্যিটা তুমি আর কখনই জানতে পারবে না…কথাটা আমাকে বলতেই হবে।’

টেপটা নিরব হয়ে গেল।

আর তারপর…আপুর কণ্ঠ না, ছেলেটার পরিচিত কণ্ঠ শোনা গেল..

কিটাযাওয়া নাটসুমি। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ। রাত এগারোটায়। একা ঐ পরিত্যাক্ত হাসপাতালটায় আসবে। যেখানে হিরোকো মারা গিয়েছিল। জায়গাটা তো চেনো, নাকি? যে রুমে ওর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল সে রুমে আসবে। সেখানে আমি তোমাকে শেষ টেপটা দেব।

ওর কথাগুলোর পরে টেপটায় আর কিছু ছিল না।

***

টেপটা যেদিন শুনলাম, তার দুইদিন পর ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ছিল। এর মধ্যে আমি পুলিশের কাছে যাইনি। তার বদলে প্রতিদিন যা যা করি তাই করলাম–স্কুলে গেলাম, পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করলাম।

ক্লাসের পর হলে এক বন্ধু আমাকে থামাল।

“নাটসুমি, আগামি রবিবার চল কোথাও ঘুরতে যাই।”

আপুর মৃত্যুর পর আমি একবারও হাসিনি দেখে ও সম্ভবত দুশ্চিন্তা করছিল। মাঝে মাঝেই সে আমার মন ভালো করার চেষ্টা করে।

“ঠিক আছে…কিন্তু শেষে যদি যেতে না পারি তাহলে সেজন্য সরি।”

“তোমার আর কোন প্ল্যান আছে নাকি?” সে জানতে চাইল।

কোন প্ল্যান ছিল না। কিন্তু সে রাতে জীবিত বাসায় ফিরে আসতে পারার সম্ভাবনাও কম। আমি ঠিক করেছি ছেলেটার বলা কথামতই কাজ করব। মেসেজটা শোনার পরপরই আমি সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলি।

যদি ঐ পরিত্যাক্ত হাসপাতালটায় যাই, তাহলে আপুর মেসেজের বাকি অংশটা শুনতে পারব। এর বিনিময়ে হয়তো আমার জীবনটা যাবে। জানি না সে কেন আমাকে খুন করতে চায়, কিন্তু খুন না করে ছেড়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই বললেই চলে।

“না কোন প্ল্যান নেই কিন্তু..” আমি বললাম, হঠাৎ ইচ্ছা হচ্ছিল ওকে জড়িয়ে ধরি। ওর জীবনটা কি রকম হবে? কিছুদিন আগেও তো আমরা স্রেফ সাধারণ মানুষ ছিলাম। হাই তুলতে তুলতে সকালে স্কুলে আসতাম। সারাদিন ব্ল্যাকবোর্ড থেকে লেখা নোটবুকে কপি করতাম। প্রতিদিন একই জিনিস ঘটত। দিনগুলো ছিল সাধারণ, কিন্তু জীবন ছিল আনন্দের।

কিন্তু এখন আমার সামনে যে জীবন রয়েছে সেটা আমি আর বিশ্বাস করতে পারি না। সুখি জীবন পেতে গিয়ে মৃত্যু নিয়ে অনেকটা সময় ব্যয় করা হয়ে গিয়েছে। আমার বন্ধুর জীবনে এখনো ভবিষ্যৎ আছে। আর যখন আমি চিন্তা করি যে ওকে আর দেখতে পাব না…খুব পছন্দ করি ওকে।

“কাল দেখা হবে,” হাত নাড়তে নাড়তে বললাম।

স্কুল থেকে বের হতেই ডিসেম্বরের ঠান্ডা বাতাস এসে মুখে ঝাপ্টা মারল।

সূর্য পুরোপুরি ডুবে না গেলেও আকাশ মেঘলা ছিল, যে কারনে ভালোই অন্ধকার। গায়ের কোট ভালো টেনে চেকে হাঁটা শুরু করলাম।

স্কুল গেটের কাছে আসতে ফোন বাজল। ইটসুকি।

“এখন? স্কুল মাত্র শেষ হলো। গেট দিয়ে বের হচ্ছি এখন।”

গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ওর সাথে কথা বলছিলাম। শো শো করে গাড়ি যাচ্ছিল। ট্রাফিক আর বাতাসের শব্দে কথা বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল।

“কী বললে? শুনতে পাচ্ছি না,” আমি জোরে বললাম। “ও আচ্ছা, ধন্যবাদ…না আমি ঠিক আছি…”

এটাই হয়তো ওর সাথে আমার হওয়া শেষ কথা। চিন্তাটা মাথায় আসতেই আমার কান্না পেল। ইটসুকিকে সেই জুনিয়র হাই থেকে চিনি। সে আমার কাছে ছোট ভাইয়ের মত।

“আরেকটু জোরে বলতে পারবে?” আমি চোখ বন্ধ করলাম, যেন তাহলে ওর কথাগুলো ভালভাবে শোনা যাবে। আমি বলছি যে আমি ঠিক আছে…দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। কি? না, আমি কাঁদছি না…” এক মুহূর্ত পর আমাদের কথাবার্তা থেমে গেল।

হাত ঘড়িতে সময় দেখলাম ট্রেনের জন্য। পাঁচটার বেশি বাজে। স্টেশনের দিকের রাস্তায় সূর্য ডুবতে শুরু করে দিয়েছে। বাইরে অন্ধকার। ছেলেটার সাথে দেখা করার আগে আমার হাতে আর ছয় ঘন্টা সময় আছে।

জানি না কেন, কিন্তু আমি ভয়ে কাঁপছিলাম না। আমার মন শান্ত ছিল। চোখ বন্ধ করে বসে ট্রেনের চলাচল অনুভব করলাম। আসন্ন বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করে আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন থেমে গিয়েছিল। রেস্টুরেন্টে আপুর দাঁতগুলো দেখার পর সব চেতনা যেন বিনাশ হয়ে গিয়েছে। কোন কিছু আর সত্যি মনে হচ্ছে না, সবকিছু কেমন অবাস্তব লাগছে। “ ছেলেটার সাথে হাতাহাতি করার কথা আমি কখনো চিন্তাও করিনি। কোন অস্ত্রপাতি ছাড়াই, কাউকে জানানো ছাড়াই আমি হাসপাতালে যাব। আমার আগ্রহ শুধু আমার বোনের কণ্ঠস্বর শোনা নিয়ে। আর কোন কিছুর আমার প্রয়োজন নেই। ছেলেটা যদি আমার কোন ক্ষতি করে, করুক।

আমার বাবা-মা আবারো ঘর লক করতে ভুলে গিয়েছিল। আমি ভেতরে ঢুকে জানালাম যে বাসায় ফিরেছি।

মা তাতামি রুমে ছিল, জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখছিল। আমি যখন কথা বললাম তার সাথে তখন দূর্বলভাবে হাসল। দেখে মনে হচ্ছিল হালকা ধাক্কা দিলেই ডিগবাজি খেয়ে পড়বে।

বাবা ছিল লিভিং রুমে। কোটাটসুর নিচে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। আমরা যখন ছোট ছিলাম, আমি আর আপু বাবার হাত ধরে ঝুলতাম। কত বছর আগের ঘটনা সেটা?

“বাবা, আমি বাসায় ফিরেছি,” হাঁটু গেড়ে তার পাশে বসলাম। তিনি কোন উত্তর দিলেন না। ভাবলাম ঘুমাচ্ছেন, উঠে দাঁড়ালাম চলে যাওয়ার জন্য।

“নাটসুমি,” তিনি বললেন। “আমি দুঃখিত…আমরা তোমার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছি।”

“কি বলছ এসব?” একই কথা আজকে বন্ধুদেরও বলেছি।

“লোকজন সবসময় বলে তুমি দেখতে হিরোকোর মত। কিন্তু আমি কখনো বুঝতে পারিনি সেটা কতখানি। হিরোকো যখন বেঁচে ছিল তখন কখনো খেয়াল করিনি, কিন্তু এখন…এখন মনে হয় তারা ঠিকই বলত।”

বাবা মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকালেন। মাঝে মাঝে নাকি তিনি আপুর সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলেন। উনার চোখগুলো অর্ধেকটা মায়া আর অর্ধেকটা শোকে ডুবে ছিল।

“কিন্তু, নাটসুমি…তুমি কি মাত্র স্কুল থেকে এলে?”

আমি মাথা ঝাঁকালাম। বাবাকে অবাক দেখাল।

“আমার মনে হল কারো উপর তলায় যাওয়ার শব্দ শুনলাম…”

“মা হয়তো?”

“সে তো আমার সাথে এখানে ছিল।”

ডোরবেল না বাজিয়ে পায়ের শব্দ পাওয়ায় তারা ধরে নিয়েছিলেন আমি এসেছি।

আমি উপরে গেলাম। টেপগুলো নেই।

ছেলেটা মনে হয় এসেছিল ওগুলো নিতে। কাজটা ওর জন্য একদমই কঠিন হয়নি।

আমি যদি সে রাতে বাসায় না ফিরি, পুলিশ টেপগুলো আমার রুমে পেলে ওকে ধরে ফেলত। ছেলেটা সেরকম কিছু ঘটার সুযোগ রাখেনি।

এর অর্থ হল সে আমাকে ছেড়ে দেয়ার কোন পরিকল্পনা রাখছে না।

আমার মনে হলো শরীর থেকে সমস্ত শক্তি গলে বেরিয়ে যাচ্ছে। ধুপ করে চেয়ারের উপর বসে পড়লাম।

গত দুই দিন ভেবেছি আমাকে খুন করা হতে পারে। এখন আমি নিশ্চিত।

আমি যদি টেপে বলা কথাগুলো অনুযায়ি হাসপাতালে যাই, আমাকে খুন করা হবে।

মৃত্যু কি? ছেলেটা বলেছিল মৃত্যুই একমাত্র সত্যি ব্যাপার। ও মানুষের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা পেতে চায়, যেভাবে ভ্যাম্পায়ার রক্তের স্বাদ গ্রহণ করে।

জানি না কতক্ষন চেয়ারে অনড় হয়ে বসে ছিলাম। নিরবতা আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছিল। আমি কল্পনা করছিলাম ছেলেটা আপুকে কিভাবে খুন করছে। একসময় আপুর জায়গায় আমার চেহারা চলে এল। কিন্তু যতটা ভেবেছিলাম ততটা ধাক্কা খেলাম না।

জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য দেখেছি আমি আগে। আমি ছিলাম জীবিত। আমার বোন, বাবা-মা, সবাই জীবিত ছিল। ব্যাপারটা স্পষ্ট ছিল। এখন সেই পার্থক্যটা ঘোলাটে হয়ে এসেছে। যেন সাদা আর কালো মিশে গিয়ে ধূসর একটা রঙ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আপুর লাশ দেখার পর থেকে বাবা-মা একইরকম হয়ে গিয়েছে, এক পা মৃতদের এলাকায়, জমে আছে।

কিন্তু আমার বোন…আপু নিশ্চিতভাবে মৃত। আমার কাছে তার কণ্ঠ তখনো জীবিত। ঐ টেপগুলোর মধ্যে সে বেঁচে আছে, এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে, এখনো চিন্তা করছে, এখনো কথা বলার চেষ্টা করছে…এখনো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমি আর জানি না জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে কী। কিন্তু এটুকু জানি, আমি তার উপর দাঁড়িয়ে আছি।

“নাটসুমি,” মা নিচ থেকে ডাকল। “ডিনার তৈরি!”

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলতে চাইলাম, “আসছি!” যদি না যাই তাহলে শুধু তারা রয়ে যাবে।

আপুর মৃত্যুর পর আমরা সবাই কেমন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছি। কিন্তু তারপরেও আমরা চেষ্টা করি একসাথে খাওয়া দাওয়া করার। অতিরিক্ত একটা চেয়ার রাখা থাকে যদিও। কিন্তু ডিনার হলো একমাত্র জিনিস যেটা কিনা এখনো আমাদেরকে পরিবার হিসেবে একসাথে আটকে রেখেছে।

আজকে, অবশ্য আমি উঠতে গিয়ে থেমে গেলাম।

“নাটসুমি?” মা আবার ডাকল। উত্তর দেইনি দেখে অবাক। আপার মনে পড়ল বাবা কিভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল যদি তাদের সাথে খেতে যাই তাহলে আর হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হবে না। আমি যদি ফিরে না আসি তাহলে তারা কিভাবে বেঁচে থাকবে? ভালোবাসা, কিংবা বলা উচিত করুণা-আমাকে এখানে আটকে রাখবে।

“ডিনার তৈরি!” মা আবার ডাকল।

ডেস্কের উপরে সিলিন্ডারটায় চোখ পড়ল। চোখ সরাতে পারছিলাম না।

জিনিসটা একটা রক্তলাল লিপস্টিক, আপুর রুম থেকে এনেছিলাম।

চোখ বন্ধ করে মনস্থির করলাম। চেয়ারে বসা অবস্থায় বললাম “আমার খিদে নেই।”

দরজা লাগানো ছিল। মায়ের চেহারা দেখতে পাইনি, কিন্তু উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম। সিঁড়ির নিচ থেকে দাঁড়িয়ে আমার দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন।

অপরাধবোধ এসে আমার হৃদয়ে বিদ্ধ করল। বুক ব্যথা করতে লাগল। মা যখন দেখল তার মেয়ে নিচে আসছে না, তার কাঁধ ঝুলে পড়ল, নিরবে সিঁড়ির কাছ থেকে সরে গেলেন। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম যেন দৃশ্যটা।

চেয়ারে বসে আমি তাদের কাছে বার বার ক্ষমা চাইতে লাগলাম। কিন্তু তারপরেও সিদ্ধান্ত বদলালাম না। আমি একজন জঘন্য সন্তান। আমাকে হাসপাতালটায় যেতেই হবে, তাদেরকে এখানে একা ফেলে।

সে রাতে পরে আমি কোট পড়ে তৈরি হলাম। খেলনা খরগোেশটা হাতে নিলাম। যখন ছোট ছিলাম তখন খরগোশটাকে অনেক ভালবাসতাম। নরম তুলতুলে ভাবটা ভালো লাগত, আদর করে চুল আঁচড়ে দিতাম। আমার একদম ছোটবেলা থেকে খরগোশটা আমার রুমে ছিল। এখন এটাকে বিদায় জানানোর পালা। আপুর লিপস্টিকটা কোটের পকেটে নিলাম। সাথে নিয়ে যাচ্ছি যাতে আমার মন বদল না হয়।

একটা ফ্ল্যাশলাইট নিলাম সাথে। তারপর চুপ করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম যাতে বাবা-মা টের না পায়। তারা ডাক দিলে আমি আর বের হতে পারব না। কেউ ডাকল না।

পরিত্যক্ত হাসপাতালটায় যেতে সাইকেলে বিশ মিনিটের মত লাগবে। ছোট একটা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে গেলাম, কোন স্ট্রিট ল্যাম্প ছিল না। চারপাশে অন্ধকার। শুধু আমার লাল সাইকেলের আলো অন্ধকার ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে।

আপু আর আমি দু-জনেই সাইকেলটা ভাগাভাগি করে চালাতাম। আমাদের মধ্যেই কেউ একজন পড়ে গিয়ে বাস্কেটটা বাঁকিয়ে ফেলেছিল। আমার যেহেতু মনে নেই, সুতরাং দোষটা সম্ভবত আপুরই ছিল। লাল সাইকেলটা দেখে আমার লিটল রেড রাইডিং হুডের কথা মনে হতো। মনে হত আমি সেই ছোট মেয়েটা, নানির বাড়িতে যাচ্ছি যেখানে একটা নেকড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

আকাশটা বরং আশেপাশের সবকিছুর চেয়ে কম অন্ধকার ছিল। মাটি আর আকাশের মধ্যের পার্থক্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। পাকা রাস্তাটা সোজা পর্বতমালার দিকে চলে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরেই নুড়ি বিছানো পথটা শুরু হলো। সেখানে সাইকেল থেকে নেমে হাঁটতে লাগলাম। যতক্ষণ না বেড়া দেয়া জায়গাটা চোখে পড়ল। বাইরে সাইনবোর্ড লাগানো “বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।”

বেড়া পেরিয়ে অনেকটা ভেতরে হাসপাতালটা। ফ্ল্যাশলাইটের আলো এতদুর যাচ্ছিল না।

লাইট নিভিয়ে দিতেই অন্ধকার এসে সবকিছু গ্রাস করল। আশেপাশে কোন বাড়ি কিংবা দোকান নেই। দুরেও কোন আলো দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে খালি শুকনো ঘাস। বাতাস না থাকায় ঘাস দুলছে না, কোন শব্দও হচ্ছে না। অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধতা।

বেড়ার সাথে সাইকেলটা রেখে শুধু ফ্ল্যাশ-লাইটটা নিয়ে সামনে এগুলাম। পায়ের নিচে নুড়ির চমচ শব্দ হচ্ছিল। নিঃশ্বাস বেরিয়ে ঠাণ্ডায় সাদা ধোঁয়া তৈরি করে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। বেড়ার সাথেই রাস্তামুখি একটা দরজা আছে, ধাক্কা দিতে সহজেই খুলে গেল ওটা। ভেতরে পা ফেললাম আমি।

যে রাতে আপু খুন হলো, কিভাবে সে এখানে এসেছিল? আমার মত হেঁটে হেঁটে গেট দিয়ে ঢুকেছিল? হয়তো ছেলেটা ছুরি ঠেকিয়ে জোর করে ওকে এখানে এনেছিল। নাকি ও অজ্ঞান ছিল তখন? ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল? হাসপাতালে ঢাকার রাস্তাটা ওর জন্য একমুখী পথ ছিল, ওর চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার পথ।

এই জায়গাটা কি একসময় পার্কিং লট ছিল? যথেষ্ট বড় একটা জায়গা। ফ্ল্যাশলাইটের লম্বা আলো শুকনো মাটি আর নুড়ি বেছানো পথের উপর পড়ছে। দূরে সাদা একটা বিশাল কংক্রিটের বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। দোতলা। রাতের আকাশে মাথা উঁচু করে রেখেছে। বিল্ডিংটা একসময় একটা হাসপাতাল থাকলেও এখন শুধু কাঠামোটাই পড়ে আছে। ডাইনোসরের ফসিলের মত। শুধু হাড়গুলো।

প্রবেশ পথ দিয়ে ভেতরে গেলাম। আগে এখানে হয়তো কাঁচের দরজা ছিল। এখন চারকোনা হা করা একটা মুখ। লবিতে আলো ফেললাম। বেঞ্চগুলোকে আর চেনা যায় না। এখানে সেখানে কংক্রিটের টুকরো পড়ে আছে। গোলাকার আলো দেয়ালের উপর পড়লে সেখানে স্প্রে পেইন্ট দিয়ে আঁকা গ্রাফিতি দেখা গেল।

আমি ছোট ছোট নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। দম হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সিলিংটা নেমে এসে চাপা দেবে আমাকে। লাইট লাগানোর অংশগুলো দেখা যাচ্ছে। নিচে ভাঙা ফ্লুরোসেন্ট লাইট পড়ে আছে। খেয়াল না করে একটার উপর পাড়া দিয়ে ফেলেছিলাম। কাঁচের গুড়ো কুড়মুড় শব্দ করে উঠল।

হলওয়েটা অন্ধকারে দিয়ে মিলিয়ে গিয়েছে। আপুকে যেখানে পাওয়া গিয়েছিল সেদিকে যাচ্ছি। রুমটা ঠিক কোথায় তা জানি না কিন্তু একটা সাধারণ ধারণা আছে আমার। নিচালার পেছন দিকে কোথাও হবে।

রুমটা একসময় অপারেটিং চেম্বার ছিল। সাইন দেয়া ছিল কোনদিকে যেতে হবে। আমার পায়ের শব্দ দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে। বাতাসে কম্পন সৃষ্টি করছে শীতের ঠাণ্ডা।

হলের শেষ মাথায় গিয়ে রুমটা খুঁজে পেলাম এক সময়। দরজা বলে কিছু নেই। চারকোনা একটা গর্ত দাঁড়িয়ে আছে দরজার জায়গায়। ভেতরে

আরেকটা খালি দরজার মত গর্ত। তারপর একটা খোলা জায়গা।

রুমের মধ্যে আলো বোলালাম। জায়গাটা এত ঠাণ্ডা আর নিঃসঙ্গ যে বুকে কাঁপুনি ওঠে। এত নিরব যে একটা পাথর গড়ালেও প্রতিধ্বনি শোনা যাবে। আমার মনে হচ্ছে যেন কোন নিঃসঙ্গ আত্মার নিচু গলায় কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

হাত দেওয়ার জন্য লম্বা সরু কিছু সিঙ্ক ছিল রুমের এক কোনায়। আরো কিছু ছোট দরজা ছিল পাশের ছোট রুমগুলোতে যাওয়ার জন্য। সেগুলোর পর অপারেটিং চেম্বার। ছোট রুম। সব মিলিয়ে তিনটা। প্রত্যেকটায় ঢুকে দেখলাম।

কেউ নেই সেখানে। ছোট রুমগুলো পনের ফিটের মত চওড়া। প্রথম দুটো একদম ফাঁকা। কিন্তু তৃতীয়টায়, সবচেয়ে দূরেরটায়, দরজা খুলে ঢুকতেই জমে গেলাম। অশুভ কিছু একটা সেখানে অনুভব করছি আমি।

এই রুমটা অন্যগুলোর চেয়ে অন্ধকার। অনেক বেশি অন্ধকার। দেয়াল আর সিলিং কালো রঙের। যেন আগুনে পুড়ে গিয়েছে।

রুমে ঢুকে নিশ্চিত হলাম কেউ সেখানে নেই। দরজাটায় সুইং লাগানো আছে, ছেড়ে দিলে নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যায়। দেয়ালের সাথে এক সারি সিলিন্ডার রাখা, ওগুলো শিকল দিয়ে বাধা যাতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রুমের মাঝখানে একটা জং পড়া ধাতব বিছানা-একটা অপারেটিং টেবিল।

তখন আমি খেয়াল করলাম সিলিং আর দেয়ালগুলো পোড়া নয়। কালো দাগটা শুরু হয়েছে টেবিল থেকে, পায়ের নিচের মেঝে ছাড়িয়ে রুমের দেয়াল হয়ে দরজার নিচ পর্যন্ত।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি গিয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালাম। খালি হাতটা দিয়ে মুখ চেপে চিৎকার আটকানোর চেষ্টা করলাম। কালো দাগটা আমার বোনের রক্তের।

অন্ধকারে আমি যেন প্রায় ওকে দেখতে পাচ্ছি। আমার বোনের শরীরের অংশ, মৃতদেহের টুকরোগুলো। পুলিশ সেগুলো পরিস্কার করছে।

‘নাটসুমি…

জানি না তুমি কখনো এটা শুনতে পাবে কিনা?

হঠাৎ আমি আপুর কন্ঠ শুনতে পেলাম। পাশ থেকে আসছে। প্রথম টেপটায় কথাগুলো ছিল। আমি দরজার দিকে আলো ফেললাম। গোল আলোয় দরজাটা বন্ধ হতে দেখলাম, যেন মাত্রই কেউ ভেতরে ঢুকেছে।

“কিটাওয়া নাটসুমি।” ছেলেটার গলা ভেসে এল অপারেটিং টেবিলের অন্য পাশ থেকে। পুরো জায়গাটা হঠাৎ যেন জ্বলে উঠল, আমি অন্ধ হয়ে গেলাম।

আলোতে ছেলেটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, ইউনিফর্ম পরা নেই। কিন্তু পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো পোশাক। ওর হাতের লাইটটা আমার ফ্ল্যাশলাইটের চেয়ে অনেক শক্তিশালী ছিল। অন্য হাতে একটা ছোট টেপ প্লেয়ার ধরে রেখেছে। সেখান থেকে আসছে আপুর গলার শব্দ।

‘সে কথা দিয়েছে মেসেজটা তোমাকে পাঠাবে সে। সে দেখতে চায় আমার কথাগুলো শুনে তোমার প্রতিক্রিয়া কি হয়…’।

আমার বোন বলে চলল। ওর নিঃশ্বাসের শব্দ কংক্রিটের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল। আমি অপারেটিং টেবিলটার দিকে তাকালাম, যেখানে রক্তের দাগ সবচেয়ে গাঢ়। পুরো রুম জুড়ে কালো ছায়া ফেলেছে।

“হিরোকো এই টেবিলে শুয়ে টেপটা রেকর্ড করেছিল।”

ছেলেটা লাইট আর টেপ প্লেয়ারটা এক কোনায় রেখে টেবিলের দিকে এগোল। কালো দাগটার উপর হাত বোলাল সে, যেন আদর করছে।

“কেন আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে?” প্রশ্ন করলাম আমি। আমার গলা কাঁপছে।

অপারেটিং টেবিলটা একসময় কালো লেদারে মোড়া ছিল। কিন্তু এখন সেটার অল্পই অবশিষ্ট রয়েছে। লেদার ছিঁড়ে ধাতব অংশ বেরিয়ে এসেছে। কালো দাগ পুরোটা ঢেকে ফেলেছে। ছেলেটা হালকাভাবে সেখানে আঙুল বুলিয়ে গেল। আঙুলের স্পর্শে শুকনো রক্তে সৃষ্টি হওয়া মৃদু শব্দ শুনে আমার লোম দাঁড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন ছেলেটা আমাকেই স্পর্শ করছে।

“হিরোকো যেমন বলল, আমার কৌতূহল হচ্ছে টেপটা শুনে তোমার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়।”

আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই ছেলেটা অপারেটিং টেবিলের উপর দুবার টোকা দিল। ওর দৃষ্টি পরিস্কার বলছিল সে আমাকে কি করতে দেখতে চাইছে।

দেয়ালে ঠেস দিয়ে আমি আস্তে করে মাথা নাড়লাম। যদি ছেলেটার দিকে এগোই তাহলে মরতে হবে। আমার বোনের মত আমাকেও খুন করা হবে। কিন্তু ভয়ের কারনে মাথা নাড়িনি আমি।

অপারেটিং টেবিলের পাশে চুপচাপ দাঁড়ানো ছেলেটার উপর আলো পড়ায় মনে হচ্ছিল যেন অন্ধকারে ভাসছে সে। ওর পেছন থেকে আলো এমনভাবে ওর কাঠামোটা আলোকিত করে তুলেছিল যেন স্বর্গীয় কিছু দাঁড়িয়ে আছে। আমার ভয় কমে গেছে, মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুর সাথে বোঝাপড়া করা অর্থহীন, অযৌক্তিক আর হাস্যকর।

‘আমি অনেকবার অনেক কিছু বলেছি তোমাকে আঘাত করার জন্য, কিংবা হতভম্ব করার জন্য…’

“নাটসুমি, এদিকে আস, ছেলেটা বলল।

সে আমাকে বলছিল অপারেটিং টেবিলে এসে উঠতে। মাত্র তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল ও।

যদি দ্রুত নড়াচড়া করে তাহলে সহজেই আমাকে ধরে ফেলতে পারবে। জোর করে শোয়াতে পারবে। কিন্তু সে নড়ল না। অপেক্ষা করছিল। তার কাছে যাওয়ার জন্য।

তার কথা অনুযায়ি আমার পাগুলো চলল। আমার ভেতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে-যেন ওর কথা আমাকে শুনতেই হবে। যখন আমি সেটা বুঝলাম, শরীর কেঁপে উঠল আমার।

নিজের ইচ্ছায় আমি ওর কাছে যাচ্ছি? জোর করে দেয়ালের সাথে লেগে থাকলাম। ছেলেটার দিকে তাকালাম।

সে বুঝিয়ে বলল, “নাটসুমি, তুমি ইতিমধ্যে জানো কিন্তু।”

“কি জানি?” আমি না বুঝতে পেরে প্রশ্ন করলাম।

“এই যে, আমি তোমাকে খুন করতে যাচ্ছি। তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ আমাকে খুন করতে দেবে।”

আমার বোনের কণ্ঠ কাঁপছে। আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে ছেলেটা, পলক পড়ছে না ওর চোখে। ওর দৃষ্টি এত সূচালো যেন আমার মাথা ভেদ করে সব দেখতে পাচ্ছে।

“তুমি মৃত্যুর প্রতি আকর্ষিত…নিজের ইচ্ছায় তুমি এখানে এসেছ।”

“কথাটা মোটেও সত্যি নয়,” আমি জোর গলায় বললাম।

ছেলেটা চোখ সরু করে আস্তে আস্তে বলল, “আমার বিশ্বাস মৃত্যু হলো, ধ্বংস’। মৃত্যুর সময় দুনিয়ার সাথে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। প্রিয়জনের সাথে যত সম্পর্ক সব ধ্বংস হয়ে যায়। তারা কখনো আর সূর্য দেখতে পাবে না, বাতাস অনুভব করতে পারবে না, আঁধার কিংবা নিরবতা টের পাবে না। আনন্দ, দুঃখ-সবকিছুর সাথে সব রকম সংযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। নাটসুমি, আমি জানি তুমি কিসের ভেতর দিয়ে গেছ, যখন তুমি এখানে এসেছিলে।”

দু-হাতে আমার মাথা চেপে ধরলাম আমি। ফ্ল্যাশলাইটটা মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। বাবা-মায়ের কথা মনে হলো আমার। ইটসুকি, আমার বন্ধুরা, আকাগি।

“এখানে আসা নিশ্চয়ই তোমার জন্য কঠিন ছিল কিন্তু তুমি মন শক্ত করেই এখানে এসেছ। তুমি জানো তুমি না ফিরলে তোমার বাবা-মা কত কষ্ট পাবেন, তারপরেও তুমি এসেছ। সব সম্পর্ক ধ্বংস করে, নিরবে সবাইকে বিদায় জানিয়ে, এখানে এসেছ একজন মৃত ব্যক্তির কণ্ঠ শুনতে।”

ছেলেটার কথাগুলো একদম জায়গামত গিয়ে আমাকে আঘাত করল। শব্দহীন কিছু একটা আমার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল। চিৎকার আর গোঙানির মাঝামাঝি কোন কিছু। হাত দুটো দিয়ে শক্ত করে মাথা চেপে রাখলাম।

‘নাটসুমি, যে কারনে আমি তোমার উপর কঠোর হয়েছিলাম তার আসলে কোন গুরুত্ব ছিল না। ব্যাপারটা ছিল আকাগির কারনে।’

এমন এক বাবা-মাকে আমি ফেলে এসেছি যারা কিনা ইতিমধ্যে তাদের এক মেয়েকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছে। অপরাধবোধ আমাকে দাবানলের মত ঘিরে ধরল।

“দ্বিতীয় টেপটা পাওয়ার পর তোমার হাতে দু-দিন সময় ছিল। সে সময়ের মধ্যে তুমি যার যার সাথে দেখা হয়েছে সবাইকে বিদায় জানিয়েছ-তোমার জীবনের সাথে জড়িত সবাইকে এবং সবকিছুকে বিদায় জানিয়েছ। সোজা মৃত্যুর দিকে হেঁটে গিয়েছ।”

অবশেষে আমি উপলদ্ধি করলাম-এই ছেলের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমি যা যা করেছি তা হল স্লো-মোশন সুইসাইড। বাবা-মাকে না জানিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি, ফিরে যাওয়ার শেষ সুযোগটাও ছুঁড়ে ফেলেছি। এই দুনিয়ার সাথে আমার সম্পর্কের সবচেয়ে ভারি বন্ধনটাকে ভেঙে এখানে এসেছি..

‘আকাগির সাথে কিভাবে আমার পরিচয় হয়েছে তা তোমাকে কখনো বলিনি…’

“আমি..”

আমি আমার হাত নামিয়ে নিলাম, আশেপাশে তাকালাম। ঠান্ডা কংক্রিটের রুমটা শূন্য অন্ধকারে ডুবে আছে। আর কিছুই এখানে নেই একমাত্র রক্ত মাখা অপারেটিং টেবিল আর ছেলেটা ছাড়া…একটা খুবই নিঃসঙ্গ স্থান।

আমার পা নড়ল। দেয়াল থেকে সরে এসে অপারেটিং টেবিলের দিকে এগুলাম।

নিজের ইচ্ছায় জীবনের সবকিছু থেকে আমি সরে এসেছি। আপুর কণ্ঠ ছাড়া আর কিছুই আমার কাছে কোন মূল্য বহন করে না। নিজেকে কি আমি আসলে এই মুহূর্তে জীবিত দাবি করতে পারি? আমার দেহ হয়তো কাজ করছে কিন্তু ইতিমধ্যে তো আমি মৃত্যুর দেশের অর্ধেক পথ পেরিয়ে গিয়েছি।

‘সে রাস্তায় এসে আমার সাথে কথা বলেছিল। পরে আমি জানতে পেরেছি আমরা একই কলেজে পড়ি।

টেবিলের অন্যপাশে ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি এখন। সে একটা পেশিও নড়ায়নি এখনো, শুধু কথা দিয়ে আমার সব দ্বিধা বের করে নিচ্ছে।

সে এখন আমার অনেক কাছে দাঁড়িয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লম্বা হওয়ার কারনে দৃষ্টি খানিকটা নিচের দিকে।

“হিরোকো এই টেপটা যখন রেকর্ড করছিল তখন আমি তোমার কথা জানতে পারি। তারপর থেকেই আমি অপেক্ষা করছিলাম তোমার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য, সে ফিসফিস করে বলল। “তুমি আসলেই দেখতে ওর মত।”

আমার বোনের কণ্ঠ রুমের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলে নিস্তব্ধ বিল্ডিঙের মধ্যে হারিয়ে গেল। “আমি জানি তুমি কেন আমাকে টেপটা দিয়েছিলে, কেন তুমি এখানে এনেছ,” আমি বললাম।

ছেলেটাকে দেখতে কুচক্রীর মত লাগল।

“মজা করার জন্য তুমি এসব করছ না, তাই না? সস্তা ধূলের আশায় নয়। রেস্টুরেন্টে একটা কথা বলেছিলে তুমি। সব মানুষের সবকিছু তোমার কাছে স্ক্রিপ্ট করা মনে হয়, নকল মনে হয়…শুধু মৃত্যুকে মনে হয় আসল।”

‘আমরা ডেট করা শুরু করলে আকাগি বলেছিল সে আমাকে প্রায়ই বুকস্টোরে দেখত। আর তখন সে আমার প্রতি আগ্রহি হয়ে ওঠে। আমাকে সবসময় সাদা উলের জ্যাকেট পড়তে দেখত সে, ঐতিহাসিক উপন্যাসের সেলফের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে…’

এই ছেলেটা মানুষ খুন করেছে। অথচ এই নিয়ে ওর কোন অপরাধবোধ নেই। আমি জানি ওর প্রতি আমার কোন সমবেদনা অনুভব করা ঠিক নয়, কিন্তু তারপরেও…ছেলেটার জন্য আমার খানিকটা খারাপ লাগছিল।

“তুমি দেখতে চেয়েছিলে আমি আমার বোনের সাথে সম্পর্ক ঠিক করতে চাই কিনা, সেটা তার মৃত্যুর পরে হলেও। ব্যাপারটা তুমি বুঝতে চাইছিলে কারন এই অনুভূতিগুলো বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই।”

বেশ একটা লম্বা সময় সে অনুভূতিহীন দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। কোন কথা বলল না। শুধু আপুর কণ্ঠ রুমের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলছিল। আমি জানি না সে কী ভাবছিল, জানার ক্ষমতা আমার নেই।

‘বুঝতে পেরেছ ব্যাপারটা? আকাগি আসলে প্রথমে তোমাকে দেখেছিল।

অবশেষে ছেলেটা ওর হাত দুটো অপারেটিং টেবিলের উপর রাখল। “নাটসুমি, এখানে বস।”

কোন ভয় অনুভূত হলো না আমার। ছেলেটার দিকে পিঠ দিয়ে আপুর রক্তে মাখা টেবিলটার উপর বসলাম। ছেলেটার উপস্থিতি টের পাচ্ছি আমার পেছনে।

শীতল টেবিলটা থেকে ঠান্ডা আমার জিন্সের প্যান্ট দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। আর একটু পরেই মরে যাব কিন্তু তারপরেও অদ্ভুত এক শাস্তি বোধ করছি, শান্ত সাগরের মত।

টেবিলের কোনা ধরে ছিলাম। আপুর শুকনো রক্তের স্পর্শ পাচ্ছিলাম। নড়তে পারছিলাম না। কিংবা বলা যায় নড়াচড়া করার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না, তাই নড়তে পারিনি। আঙুলের তলে সবকিছু কেমন ঠান্ডা আর শক্ত হয়ে ছিল।

লাইটটা আমার পেছনে থাকায় সামনে দেয়ালে আমাদের ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম। ছেলেটার শরীরের ছায়া আমার ছায়া অর্ধেক ঢেকে দিয়েছিল, একটু এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে।

‘আমরা সবসময় একইরকম পোশাক পরতাম, যে কারনে সবাই বলত আমরা দেখতে একইরকম,..আকাগি ভুল করে আমাকে প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছিল, ভেবেছিল তুমি…

ছেলেটার ছায়া নড়ে উঠল। হাত তুলল, ছায়া আমার ছায়ার উপর বেড়ে গেল।

ওর হাত দিয়ে আমার দৃষ্টি ঢেকে দিল, কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না আর। অন্ধকারে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম আমি। পেছন থেকে আসা হাত দুটোর একটা আমার ঘাড় পেঁচিয়ে ছিল, আরেকটা আমার মুখ। সে যদি জোরে চাপ দেয় তাহলে মুহূর্তের মধ্যে আমার ঘাড় ভেঙে যাবে। আমি নিজের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা টের পাচ্ছি। ছেলেটার বুক আমার পিঠে লেগে ছিল। কাপড়ের ভেতর দিয়ে ওর উষ্ণতা ভেদ করে আসছে।

“প্লিজ…ওর মেসেজের বাকিটা আমাকে শুনতে দাও।”

আপুর কন্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম আমি, যদিও ছেলেটার হাতগুলো আমার কান ঢেকে রেখেছিল। আকাগির ব্যাপারে এসব জানতাম না আমি। আপুর অদ্ভুত ব্যবহারের রহস্যের গিট খুলতে শুরু হয়েছে।

ওর হাতের সন্ধিগুলো আমার গলার পাশে আঁট হয়ে আবার আলগা হচ্ছিল। যেন ভেতরের হাড় পরীক্ষা করে দেখছে। ঘাড় ভাঙার জন্য হাতগুলো পুরোপুরি তৈরি ছিল, মনে হচ্ছিল যেন একজন অ্যাথলেট স্বল্প পাল্লার দৌড়ের জন্য ওয়ার্ম আপ করছে।

আমার ঘাড়টা মনে হচ্ছিল সুন্দর একটা ফুলের ডাঁটির মত, না ভেঙে ফুলটা আলাদা করা যাবে না।

‘সত্যি কথাটা জানার পরও আমাদের মধ্যে কোন সমস্যা ছিল না। শুরু সেভাবে হলেও সত্যিকারের ভালবাসা আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। আমাকে ভালোবেসেছিল সে, আমার ভেতরে যা আছে সেটাকে…’

কিন্তু আমি নার্ভাস ছিলাম।

আমার বুক ব্যথা করছিল ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে।

“তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ,” ছেলেটা ফিসফিস করে বলল। ওর কণ্ঠ আমার ডান দিক থেকে এল। আমি ওর বুকের উঠানামা টের পাচ্ছিলাম। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে।

“আমার দ্বিতীয় শিকারের জন্য দু-জনকে বাছাই করেছিলাম। একজন হল কিটাযাওয়া নাটসুমি, আরেকজন আমার স্কুলের একটা মেয়ে।”

“মোরিনো? তোমাকে ওর সাথে হাঁটতে দেখেছি..”

ওর হাতের কারনে আমার কণ্ঠ চাপা পড়ে যাচ্ছে। বুক ধুকপুক করছে, শিরার মধ্যে দিয়ে রক্ত জোরে ছুটছে। গলার উপর হালকা চাপ, শিরার স্পন্দন-আমার মাথা গরম হয়ে উঠতে লাগল।

“কামিয়ামা ইটসুকি তোমাকে ওর নাম বলেছে, তাইনা? শেষে অবশ্য আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি, কারনটা হয়তো তুমি যেটা বললে সে কারনেই।”

আমার মনে হলো, কথাগুলো ও আমাকে না বলে নিজেকেই শোনাচ্ছে। হয়তো ও নিজের কর্মকাণ্ড নিজেই বুঝতে পারছে না। অদ্ভুত হলেও, আমার কাছে মনে হল আমরা বন্ধুর মত।

‘আমিও আকাগিকে কখনো জানাইনি…যে সে তোমাকে দেখেছিল, আমাকে নয়। আমি ওকে বলতে পারিনি আসলে…’

আমি এতটা অন্ধ ছিলাম কি করে? আপুর ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। ছেলেটার হাতের বন্ধনে আটকা পড়ে, আপুর কণ্ঠ শুনতে শুনতে নিজের প্রতি লজ্জা হতে লাগল আমার।

আমার ধারণা ছিল আপুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস আছে, যেটা আমার নেই। ভেবেছিলাম সে অনেক মেধাবী, মিশুক-একজন শক্ত নারী, যাকে সবাই ভালবাসে। অথচ সত্য ছিল একদমই অন্যরকম…।

‘আমি তোমার মুখের দিকেও তাকাতে পারছিলাম না…আমরা অনেকটাই একইরকম ছিলাম। আমি আমার সব বিরক্তি তোমার উপর ঝেড়েছি। চুলের রঙ বদলেছি, তোমার থেকে ভিন্ন রকমের পোশাক পরাশুরু করেছি, যাতে তোমার সাথে মিল না থাকে…কারন আমি জানি আকাগির প্রতি তোমার অনুভূতি কিরকম…’

আমার বোন তার নিজের ভয় আর দুচিন্তার মধ্যে আটকা পড়ে নিরন্তর যুদ্ধ করে চলছিল। আমাকে আকাগির ব্যাপারে কিছু বলতে পারছিল না। এই গোপন ব্যাপারটা তার হৃদয়ের উপর বোঝার মত চেপে বসেছিল। আমার পকেটের লিপস্টিকটা…সে সেটা ব্যবহার করত আশেপাশের দুনিয়া থেকে নিজের ভয়কে আড়াল করার জন্য।

আফসোস! সে বেঁচে থাকা অবস্থায় যদি আমি সেটা লক্ষ্য করতাম। আমি যদি ব্যাপারটা জানতে পারতাম তাহলে তাকে বুকে জড়িয়ে জানাতাম নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

ছেলেটার হাতের চাপ বাড়ল। ওয়ার্ম আপ করা শেষ। শক্ত করে আমার মাথা ধরে আছে এখন। তার হাতের চাপে আমার মনে হচ্ছিল ভালবাসার বন্ধনে মৃত্যু ঘটতে চলছে যেন আমার।

আপুর কণ্ঠ যখন থামবে, জোরে চাপ দিয়ে আমার ঘাড়ে মোচড় দেয়া হবে। মাথা আর ঘাড়ে বিপরীত চাপ পড়ে আলাদা হয়ে যাবে। মৃত্যুর মুহূর্তটা নিয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম।

‘যদিও আমি আমার শেষ কথাগুলো এভাবে রেকর্ড করছি, আমার ইচ্ছা হচ্ছে…ইচ্ছা হচ্ছে যদি কথাগুলো তোমাকে আরো আগে বলা যেত…’

আমি টের পাচ্ছি আমার হৃদপিন্ড জোরে জোরে লাফাচ্ছে। সারা শরীরের রক্ত পাম্প করার শব্দ যেন আপুর কণ্ঠের মতই পরিস্কার শুনতে পাচ্ছি। ছেলেটার হৃদস্পন্দনও টের পাচ্ছি আমি।

বুকে কেমন যেন চাপ বোধ হচ্ছে, ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কাঁদি। ছেলেটার প্রতি আমার কোন রাগ বা ঘৃণা নেই, মৃত্যুর মত অনিবার্য কিছু মনে হচ্ছে ওকে।

আপুর স্বীকারোক্তি প্রায় শেষ। ছেলেটার হাতের চাপ আর আপুর কণ্ঠ থেকে সেটা বুঝতে পারছি আমি।

আমি খুশি যে টেপটা শুনতে পেরেছি।

“তুমি জানতে তুমি আমাকে খুন করবে…সেজন্য তুমি বাসায় এসেছিলে টেপগুলো নিতে, যাতে আমি আর না ফিরলে পুলিশ সেগুলো খুঁজে না পায়,” আমি বললাম। সাবধানে বললাম যাতে আপুর কন্ঠ মিস না হয়। খুন হওয়ার আগে আপু এই কথাগুলো আমাকে বলে গিয়েছে। আমার দায়িত্ব সবটুকু শোনা।

‘কিন্তু পেছনে ফিরে যাওয়ার কোন উপায় তো নেই। নাটসুমি…আমি তোমাকে আসলেই ভালোবাসতাম।

“নাটসুমি,” ছেলেটা বলল, গলার উপর চাপ সরে গেল। আমি এটা আশা করিনি, একটু অবাক হলাম। “আমি কখনো তোমার বাসায় যাইনি।”

ওর কথাগুলো প্রথমে বুঝতে পারলাম না। সে বলতে চাইছে সে টেপগুলো নেয়নি? প্রশ্নটা করার আগেই অপারেটিং চেম্বারে কারো ঢোকার শব্দ পেলাম।

ছেলেটার হাত শিথিল হলেও, তখনও সেগুলো আমাকে পেঁচিয়ে আছে, কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তৃতীয় ব্যক্তিটা কে? ওর হাত যথেষ্ট জোরালো থাকায় নড়তেও পাচ্ছি না। শুধু নতুন এক জোড়া পায়ের শব্দ পাচ্ছি।

“কে..?” আমি ঢোক গিলোম।

পায়ের শব্দটা দরজার কাছ থেকে এসে অপারেটিং টেবিলের কাছে থামল।

ছেলেটা আস্তে করে আমার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিল। আবার দেখতে পাচ্ছিলাম, সামনের দেয়ালে তিনটা ছায়া তখন।

‘আমি তোমাকে আঘাত করার জন্য অনেক কিছু বলেছি…কিন্তু তোমার কোন দোষ ছিল না…’

আমি না, ছেলেটাও না, তৃতীয় ছায়াটা নড়ে উঠল। স্টপ বাটনে চাপ দিতে শুনলাম, আপুর কণ্ঠ থেমে গেল। রুমের ভেতর আবার নিরবতা নেমে এল।

টেবিল বসেই আমি মাথা ঘুরালাম। ছেলেটা আমার পিছে দাঁড়িয়ে, ওর পিঠ আমার দিকে ফেরানো, রুমের অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ওর পেছনে, দেয়ালের কাছে ইটসুকি দাঁড়ানো।

ইটসুকি টেপ ডেক থেকে আঙুল সরিয়ে বলল, “আমি টেপগুলো নিয়েছি, নাটসুমি।”

আমি ভেবেছিলাম আর কখনো ওর কণ্ঠ শুনতে পাব না। সে এখানে কেন? নাকি পুরোটা আমার কল্পনায় ঘটছে? না, সে বাস্তবেই সেখানে আছে। আলোতে ছায়া পড়ছিল ওর। কোন কল্পনা নয়।

“হাসপাতালটা অনেক বড় হওয়ার কারনে, খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েছিলাম। হিরোকোর কণ্ঠ শুনতে না পেলে হয়তো তোমাদের খুঁজে পেতাম না।”

সেদিন সন্ধ্যায় ওর ফোন মনে পড়ল আমার। আমি ওকে বলেছিলাম আমি স্কুলের বাইরে। সে হয়তো তখন আমার রুমে ছিল আর নিশ্চিত হচ্ছিল যে আমি হঠাৎ এসে হাজির হব না সেখানে।

রেস্টুরেন্টে বসা অবস্থায় আমি ওকে বলেছিলাম যে বাবা-মা দরজা লক করতে ভুলে যায়।

সেকারনে ও সহজেই বাসায় ঢুকতে পেরেছিল। তারপর আপুর নাম লেখা টেপগুলো দেখতে পেয়ে অবাক হয়। ওর এখানে আসার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয় টেপে এই জায়গার কথা আর সময় দেয়া ছিল।

“কামিয়ামা যে! অনেকদিন দেখা হয়নি আমাদের,” ছেলেটা বলল, ওর এক হাত আমার বাম কাঁধে রাখা। হাতের তালু গরম। তারপর অপারেটিং টেবিল থেকে সরে গেল। ইটসুকির মুখোমুখি হলো। আমি নড়তে পারছি না। নিথর বসে ইটসুকির দিকে চেয়ে রইলাম।

“হ্যালো,” ইটসুকি বলল। ছেলেটার নাম ধরে ডাকল, একবারের জন্যও চোখ সরাল না। ওকে দেখে মনে হচ্ছে আমি যে এখানে আছে সেটা ইটসুকি ভুলে গিয়েছে।

তারা চুপচাপ একজন আরেকজনের দিকে চেয়ে থাকল, রুমের দুই মাথায় দু-জন দাঁড়িয়ে থেকে। অপারেটিং চেম্বারের ভেতর শব্দহীন টানটান উত্তেজনা। নিরবতা যেন আমার কানে আঘাত করছিল।

আপুর কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছা করছিল আমার। টেবিলে বসে থেকে আমি ইটসুকির পায়ের দিকে তাকালাম।

প্লেয়ারে তখনো টেপটা ঢোকানো ছিল।

আমি টেবিলের কোণা চেপে আমার আঙুলে সংকেত পাঠালাম, যেন তারা নড়াচড়া করে। কিন্তু সেগুলো অবশ হয়ে ছিল।

“তুমি ওকে উদ্ধার করতে এসেছ?” ছেলেটা জানতে চাইল। ওর কণ্ঠস্বরে নিরবতা ভেঙে গেল। কিন্তু তাতে উত্তেজনা মনে হলো আরো বেড়ে গেল।

আমি আবার আমার পেশিগুলোকে বললাম নড়াচড়া করতে, কিন্তু আমার হাত-পা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেল। বুক দ্রুত লাফালেও শরীরের বাকি অংশ মনে হচ্ছিল ড্রাগ দিয়ে অবশ করে রাখা হয়েছে।

চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিলাম আর প্রার্থনা করলাম।

প্লিজ, নড়াচড়া কর, টেপ প্লেয়ারটার কাছে হেঁটে যেতে দাও আমাকে…আমার আঙুলগুলো কাঁপতে লাগল।

“আমি কি কোন কিছুতে বাধা দিলাম?” ইটসুকির কণ্ঠ।

এখন যেহেতু আমার আঙুল কাঁপছে, সেটা একটা চেইন রিয়্যাকশনের মত সৃষ্টি করল। হাত আর পাও জেগে উঠল। কিন্তু পেশিগুলো টানটান হয়ে ছিল। নড়ছিল কিন্তু জোর পাচ্ছিলাম না। তারপরেও আমি টেবিল থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ে যেতে পারলাম। যে টেবিলে আপু খুন হয়েছিল সেখান থেকে সরতে পেরে আমার নিজেকে জীবিত মনে হতে লাগল।

আমার পা এমনভাবে কাঁপছে যে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব না। আমি হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে লাগলাম। ফ্লোরের ধুলোয় মাখামাখি হয়ে গেলাম। অপারেটিং টেবিলে ঘুরে ইটসুকির পায়ের কাছে টেপ ডেকটা রাখা। ইটসুকি আর ছেলেটা তখনো কথা বলছিল, কিন্তু সেসব আমার কানে ঢুকছিল না। পোকার মত ঘষে ঘষে আমি এগুতে লাগলাম, টেপ ছাড়া আর কোন কিছুর চিন্তা আমার মাথায় নেই।

এক টুকরো কংক্রিটের উপর হাতের চাপ পড়ে সেটা হাতে ঢুকে গেল, কিন্তু পাত্তা দিলাম না। ছেলেটা বলেছিল মৃত্যু হল ধ্বংস। সে বলেছিল

আমি সবকিছু পেছনে ফেলে এসেছি, বেছে নিয়েছি মৃত্যু।

কিন্তু আমি এখনও মারা যাইনি। এখনো জীবন পুরোপুরি ছুঁড়ে ফেলিনি। এই পরিত্যাক্ত বিল্ডিঙে আমি এসেছি কিছু পাওয়ার জন্য। জীবনের বদলে যা চেয়েছি।

টেপ ডেকটার কাছাকাছি যেতে আপুর কথা মনে হচ্ছে।

টেপ ডেকের পাশে রাখা আলো আমাকে অন্ধ করে দিচ্ছে যেন। ইটসুকির পা নড়ল, আলোর সামনে এল। ওর ছায়া আমাকে পাশ কাটিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল। আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম না।

অবশেষে একসময় টেপ ডেকটা স্পর্শ করতে পারার মত কাছে পৌঁছাতে পারলাম। হাত দিয়ে বুকের কাছে টেনে নিয়ে প্লে বাটনে চাপ দিলাম। আঙুল কাঁপছেল আমার।

প্লেয়ারটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠল, ক্যাসেটের টেপ আবার ঘুরতে শুরু করল। স্পিকার দিয়ে আপুর কণ্ঠ আবার বেরিয়ে এল। বাতাসে নয়, আমার হাতের নিচ থেকে ওর গলার কাঁপুনি বেরিয়ে এল।

‘নাটসুমি, আমি সবসময় তোমাকে নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। প্রতিবার যখন তোমাকে উদ্দেশ্য করে খারাপ কিছু বলে ফেলেছি, সে নিয়ে আফসোস করেছি…তোমাকে বার বার কষ্ট দেয়ার জন্য আমি দুঃখিত…’

গত কয়েকবছর আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আর ছিল না। আমরা ছিলাম দু-জন অপরিচিত মানুষ যারা কিনা এক ছাদের তলায় বাস করছিল। আমি ভেবেছিলাম আপু আমাকে ঘৃণা করত।

“হয়তো এরকম মেসেজ দেয়াটা পুরো ব্যাপারটাকে আরো খারাপ করে তুলবে…আমি জানি এরকমই হবে। কিন্তু তারপরেও আমি খুশি এই ভেবে যে আমি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পেয়েছি…মারা যাওয়ার আগে হলেও…আমি বলতে চাইছি, আমার কথা চিন্তা করে তোমার মুখে যদি হাসি না আসে, তাহলে তার চেয়ে খারাপ কিছু আর হতে পারে না আমার জন্য…’

আমি টেপ ডেকটা জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে ফ্লোরে শুয়ে থাকলাম। মাির প্রিয় বোনের কষ্ঠ শুনছি। মনে হচ্ছে আমার প্রিয় বোনটা আমার কাছে ফিরে এসেছে।

‘এখানে শুয়ে আমার মনে পড়ছে, ছোট থাকতে আমরা একসাথে কি কি করতাম…’

আমি চোখ বন্ধ করে শুনছি।

‘পাহাড়ের উপর একটা বড় বন ছিল…’

আমার মনে আছে, যখন ছোট ছিলাম তখন আমরা কি কি দেখেছিলাম।

অন্ধকার, ঠান্ডা কংক্রিটের দেয়াল…সব কোথায় মিলিয়ে গেল, আমি দাঁড়িয়ে আছি নুড়ি বেছান পথের উপর, মাথার উপর সূর্য।

গার্ডরেইল, পোস্টগুলো-সব অনেক বড় বড় ছিল। আমি বাচ্চাদের ছোট জুতো পরে ছিলাম। পাহাড়টা অনেক খাড়া দেখাচ্ছিল। একদিকে ঘরবাড়ি, আরেকদিকে গার্ড রেইল। নিচে শহরের সুন্দর দৃশ্য।

‘তোমার মনে আছে আমরা হাত ধরাধরি করে হেঁটেছিলাম?

আমি পরিচিত একটা বাচ্চার কণ্ঠ শুনতে পেরে ঘুরে দাঁড়ালাম। আপু দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

ও আমার চেয়ে বেশি লম্বা ছিল না, আর সবাই বলত আমাদের দেখতে একইরকম লাগত।

আপু এসে আমার হাত ধরল। পাহাড়ের চূড়ার দিকে আঙুল তুলে প্রস্তাব করল সেখানে যাওয়ার জন্য।

আমি খুবই উত্তেজিত ছিলাম। আমি ওর হাত ধরে দৌড়াচ্ছিলাম। উষ্ণ সূর্যালোক আমাদের পেছনে ছোট ছায়া ফেলেছিল। সেগুলোও আমাদের সাথে ছুটছিল। পাহাড়ের চূড়ার লম্বা গাছগুলোর দিকে দৌড়ে যাওয়ার সময় কংক্রিটের উপর আমাদের স্নিকারগুলো ক্যাচকোচ শব্দ করছিল।

পাহাড়ের উপরে গিয়ে আমরা বনের ভেতর ঢুকেছিলাম। ঠান্ডা বাতাসে আমাদের ঘাম শুকিয়ে গেল। বনের ভেতর দিয়ে আমরা হেঁটে গেলাম। একসময় একটা খোলা জায়গা পাওয়া গেল যেখান থেকে নিচে দূরের শহরের চমৎকার দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। আমরা হাত ধরে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম।

ওর নরম উষ্ণ হাতের স্পর্শ পাচ্ছিলাম। ও আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, সুন্দর শ্বান্তগুলো চকচক করে উঠল হাসির সাথে।

শহরের উপরে অনেক উঁচুতে একটা পাখি উড়ে যাচ্ছিল।

একটা সাদা পাখি, ডানাগুলো ছড়িয়ে উড়ছিল। আমি ভেবেছিলাম পাখিটা নিশ্চয়ই বড় নদীটার কোথাও থাকে। যেই নদীটা শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছে। পাখিটার ডানাগুলো একদমই নড়ছিল না। অসীম নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল শুধু।

‘নাটসুমি, আমি মরতে যাচ্ছি, কিন্তু তুমি তো এখনো জীবিত। তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমাকে কথা দাও, তুমি আবার হাসবে-না হাসলে তোমাকে আমি ক্ষমা করব না। গুডবাই

ওর কণ্ঠ মিলিয়ে গেল, আর শোনা গেল না। ওর নিঃশ্বাসের শব্দও টেপ থেকে হারিয়ে গেল। স্পিকারগুলো থেমে গেল। আপুর স্বীকারোক্তি সমাপ্ত হয়েছে। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ভেতর দিয়ে আমি তখনো ক্যাসেটটাকে নিরবে ঘুরতে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার গাল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু ডেকটার উপর গিয়ে পড়ল।

নিরবে আমি ফিস ফিস করে বললাম, “আমি দুঃখিত…কিন্তু তোমাকে ধন্যবাদ।”

জায়গাটা অন্ধকার আর খুবই নিরব। পরিত্যাক্ত হাসপাতালের ভেতর ফিরে এসেছি আমি। এক মুহূর্ত আগেও আমি আপুর সাথে ঐ পাহাড়টার উপরে ছিলাম।

কতক্ষন ধরে আমি এখানে পড়ে পড়ে কাঁদছি?

রুমের ভেতর শুধু আমি, টেবিল আর লাইটটা। ছেলেদের কাউকে দেখা গেল না।

ফ্লোরের উপর আলোটা একটা অংশ আলোকিত করে রেখেছে। চোখ পিটপিট করে আমি টের পেলাম ফ্লোরটা ভেজা। ফ্লোরে এক পুকুর রক্ত জমে আছে। শুকনো রক্ত না, টাটকা রক্ত। আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম রক্তটা যেন ইটসুকির না হয়।

উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম, টেপ ডেকটা তখনো বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছি। প্রথমে পাগুলো অত্যন্ত দূর্বল লাগছিল। অনেক সময় নিয়ে কোন রকম পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হলাম।

রুম থেকে বেরিয়ে অসংলগ্নভাবে হাঁটছিলাম। ইটসুকির নাম ধরে ডাকলাম। আমার কণ্ঠ দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

হাসপাতালের প্রবেশ পথের কাছে দাঁড়িয়ে ইটসুকির জন্য অপেক্ষা করলাম। ঠান্ডা বাতাস কাপড় ভেদ করে ঢুকছে। আমি কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকারে বসে ছিলাম। একসময় সূর্য উঠল। ইটসুকি কিংবা অন্য ছেলেটার কোন চিহ্ন দেখা গেল না।

উপসংহার

“আরে তেমন কোন ব্যাপার না, কুকুরের সাথে খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম,” সিঁড়ি থেকে নামার সময় মোরিনোকে বললাম। এক হাতে ব্যাগ ধরে আছি।

ডিসেম্বরের ৪ তারিখ। স্কুলের পর কথা বলতে বলতে ক্লাস থেকে বের হচ্ছিলাম আমরা। মোরিনো আমার গলার লাল দাগটার দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল।

“তাই? কোন সন্দেহ নেই যে সে তোমাকে খুন করতে চাইছিল।”

“কুকুরটা?”

“আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।” সে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘোষণা দিল।

সত্যি বলতে আগের রাতে পরিত্যাক্ত হাসপাতালে আমি আহত হয়েছিলাম।

শরীরের কয়েক জায়গায় রক্ত জমে কালো দাগ পড়েছে কিন্তু ইউনিফর্মের নিচে ঢাকা পড়ায় সেগুলো দেখা যাচ্ছে না।

“যাই হোক, গতকালকে কিটাওয়া হিরোকোর খুনের তথ্য নিয়ে আমি একটা স্ট্র্যাপবুক বানাচ্ছিলাম..”

লাইব্রেরিতে দেখা হওয়া লোকটার কাছ থেকে মোরিনো বেশ ভালো পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করেছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম লোকটা কে, মোরিনো উত্তর দেয়নি। আমি ঠিক করলাম ওকে ফলো করে নিজেই জেনে। নেব, কিন্তু এখন আর দরকার আছে মনে হয় না।

“শেষ করেছ?”

“প্রায় শেষ। এখন খালি দরকার খুনির একটা ইন্টারভিউ নেয়া। তাহলেই কাজ শেষ।”

বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে স্কুলের গেটের দিকে যাওয়ার সময় মোরিনো বলছিল পুলিশ যতটুকু জানিয়েছে কেসটা তারচেয়ে কত বেশি বিভৎস ছিল।

সময় হয়ে গেছে সূর্য অস্ত যাওয়ার, ঠান্ডা বাতাস বইছে। স্কুল বিল্ডিং থেকে গেট পর্যন্ত চওড়া রাস্তা, দু-পাশে গাছের সারি। অল্প কিছু শিক্ষার্থী আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করছে। বাতাসে একটা সাদা প্লাস্টিক ব্যাগ উড়ে গেল।

আমরা গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হলাম। রাস্তার সাথের দোকানটায় কিটাযাওয়া নাটসুমি দাঁড়িয়ে ছিল। ম্যাগাজিন র‍্যাকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। আমাদের মধ্যে চোখাচোখি হলো।

আমি দোকানের সামনে থামলাম। মোরিনোও আমার সাথে থামল।

দোকানের ভেতর কিটাযাওয়া নাটসুমি হাতের বইটা নামিয়ে রাখল। এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরায়নি আমার থেকে। তারপর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

দোকানের সামনে একটা পার্কিং লট, অল্প কয়েকটা গাড়ি রাখার মত বড়।

নাটসুমি এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়াল। দোকানের ফ্লুরোসেন্ট লাইটের স্নান আলো আমাদের উপর এসে পড়ছে।

গত রাতে আমি একজনকে খুন করেছি, যখন নাটসুমি টেপ রেকর্ডার নিয়ে মাটিতে পড়ে ছিল।

ছুরিটা শরীরের ঢোকার সময় ভোঁতা একটা শব্দ হয়েছিল, তারপর সে নিথর হয়ে গেল।

এরপর নাটসুমির সাথে আর দেখা না করেই আমি বাসায় ফিরে গিয়েছিলাম। ইচ্ছা করছিল না ওর সামনে পড়তে। আমাদের লড়াই ওর চোখে পড়েনি। সেজন্য ফ্লোরের রক্তটা কার ছিল সেটা জানার ওর কোন উপায় ছিল না, অন্তত স্কুলের সামনে এসে দেখা ছাড়া।

আমি ওকে কিছু বলার আগেই মোরিনো কথা বলে উঠল। সে এতক্ষন নাটসুমির দিকে তাকিয়ে ছিল।

“তুমি কি…কিটাযাওয়া নাটসুমি?”

“হ্যাঁ,”

“আমিও তাই ভেবেছি। তুমি দেখতে খবরের কাগজে ছাপা হওয়া তোমার বোনের মতই।

“ওর চুল রঙ করে বদলে ফেলার আগের ছবিটার কথা বলছ?”

“হ্যাঁ, খুনের তদন্ত করা আমার শখ। তাই তোমার বোনের ছবি দেখা হয়েছে। তোমার কোন ছবি খুঁজে পাইনি অবশ্য। কিছুদিন আগে যখন তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম তখনই মনে হয়েছিল কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছিলাম না।”

“তুমি ওর খুনের তদন্ত করছিলে?” নাটসুমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। আমার দিকে তাকাল সাহায্যের জন্য।

“ওর মনে হয় তথ্য সংগ্রহের একটা উৎস আছে, আমাকে বলেনি সেটা কে।” আমি বুঝিয়ে বললাম। নাটসুমি বুঝতে পারল না ওর কি বলা উচিত।

মোরিনো আমার দিকে তাকাল। ওর চেহারা বরাবরের মতই অভিব্যক্তিহীন। কিন্তু গলা শুনে উৎসাহ টের পাওয়া যাচ্ছিল। “তুমি কি করে কিটাওয়াকে চেন?”

উত্তর না দিয়ে আমি পকেট থেকে কিছু খুচরা কয়েন বের করলাম আর মোরিনোর হাতে দিলাম। সে এক মুহূর্ত কয়েনগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল কি করবে সেগুলো দিয়ে। আমি দ্রভাবে বললাম যে আধ মাইলের মত সামনে একটা ভেন্ডিং মেশিন আছে, সেখান থেকে আমাদের জন্য ডিঙ্ক কিনে আনতে।

“আমি জানি আমাদের সামনেই একটা দোকান আছে কিন্তু ভেন্ডিং মেশিন থেকে কিনে আনলেই ভালো হয়। তুমি যাতে আমার কথা শুনতে না পাও সেজন্য অবশ্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করছি না।”

মোরিনো একবার আমার দিকে আরেকবার নাটসুমির দিকে তাকাল। ইতস্তত করছে। তারপর মনস্থির করে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভেন্ডিং মেশিনের দিকে এগিয়ে গেল।

“মেয়েটা কিছু জানে না, তাই না? খুনি যে ওকে টার্গেট করেছিল?” কিটাযাওয়া বিড়বিড় করল।

আমি মাথা ঝাঁকালাম।

এক মুহূর্তের জন্য আমরা দুজনেই মোরিনোর হেঁটে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কালো পোশাকের কারনে ও অন্ধকারে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

“সেদিন সে আমাকে হিরোকোর ছবি দেখিয়েছিল।”

“ওর মৃতদেহের?”

“হ্যাঁ। কেউ একজন ওকে ছবিটা দিয়েছিল। যে ছবি কোখাও ছাড়া হয়নি। নিশ্চিতভাবে মুখটা হিরোকোর ছিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যে ছবিটা রাখা হয়েছিল সেটার মত হেয়ারস্টাইল,

“তারপর, তুমি যখন দেখলে..”

“আমি বুঝতে পেরেছিলাম, জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে যে খুনি নিজে ছবিটা তুলেছে। ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল আমার…কিন্তু যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে হিরোকোর খুনি ওর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে আর ও হয়তো তার পরবর্তি শিকার।”

“তুমি অর্ধেক সঠিক ছিলে, কিন্তু খুনি ওর বদলে আমাকে বেছে নিল।”

“আমি যখন তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম তখন বুঝলাম সে তখনো নিজের শেষ চাল চালেনি। তুমি খুবই অদ্ভুত আচরণ করছিলে। যে কারনে আমি ভাবছিলাম সে তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছে কিনা।”

“হ্যাঁ…সে সেটাই করেছিল। যে কারনে তুমি আমার রুমে ঢুকেছিলে…সূত্র খুঁজতে।”

“তুমি আমাকে কখনোই সত্যিটা বলনি।”

দোকান থেকে আসা আলো নুড়ি পাথরের উপর আমাদের লম্বা ছায়া ফেলেছে। মনে হচ্ছে ছায়ার পুতুল। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা দোলাচ্ছে নাটসুমি।

“কিন্তু, ইটসুকি, আমি কখনো ভাবতেও পারিনি তোমার অনুভূতি এত কম।”

“তোমার মতই কম।”

“আমি দুশ্চিন্তা করছিলাম গত রাতে…তুমি সেফ উধাও হয়ে গেলে। সকালে তোমাকে ফোন করলাম, ফোন যাচ্ছিল না।”

“ও আমার ফোনটা ভেঙে ফেলেছিল।”

কিটাযাওয়া হিরোকোর খুনি আর আমি এক ক্লাসে ছিলাম এক সময়। ওকে ভালো করে চিনতাম না। যদি কখনো একসাথে একটুও সময় কাটাতাম তাহলে নিশ্চয়ই ওর মধ্যের অস্বাভাবিক ব্যাপার আমার চোখে পড়ত।

“কী করেছ…ওকে নিয়ে পরে?”

আমি ছেলেটার লাশ হাসপাতালের পেছনের ঘাসের নিচে চাপা দিয়েছি। ওর সব নিষ্ঠুরতা কেড়ে নিয়েছে আমার রুপালি ছুরি। অন্তত এভাবেই আমি পুরো ব্যাপারটা দেখি। ছুরিটা যখন ওর শরীরের গভীরে ঢুকে গিয়েছিল, ও গুঙিয়ে উঠেছিল। মুখ থেকে রক্ত ছিটকে বেরিয়েছিল। ছুরি ধরা হাতটা মনে হচ্ছিল অনেকদিনের পিপাসা মিটিয়ে নিচ্ছে।

“ও দৌড়ে পালায়। আমি পিছু নিয়েছিলাম, কিন্তু ধরতে পারিনি…”

সে নিজের রক্তের পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন কোন অর্থ ধরতে পেরেছে, যেন এটা সম্ভাব্য আরেকটা উত্তর ছিল।

হাঁটু গেড়ে বসে ও সহজভাবে নিজের মৃত্যু গ্রহন করে নেয়, যেভাবে কিটাযাওয়া হিরোকোর মৃত্যু গ্রহণ করেছিল। আমার দিকে তাকিয়ে ছুরিটার প্রশংসা করে, তারপর নিথর হয়ে যায়।

“ওহ, আমাদের কি পুলিশকে জানানো উচিত তাহলে?”

“তুমি যদি চাও। আমি কোন ঝামেলা চাই না। সুতরাং তুমি জানালে আমার কথা বাদ দিয়ে জানিও। হাজার হোক তোমার ঘরে চুরি করে ঢুকেছিলাম।”

রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি দূরে কিছু একটা নড়ছে। মোরিনো। ফিরে আসছে।

“সকালে বাসায় পৌঁছানোর পর দেখি বাবা পাগলের মত করছে।” নাটসুমি পার্কিং এর বাম্পারে লাথি দিতে দিতে বলল। হাসছে। সে সাইকেল চালিয়ে বাসায় ফিরে গিয়েছিল। বাসায় ফেরার আগেই ওর বাবা মা টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে ও বাসায় নেই। তারা আতংকিত হয়ে পড়েন। সে যখন ক্লান্ত চেহারা নিয়ে দরজা খুলে ঢুকল, তারা ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরেন।

“মা আমাকে দেখে কান্নায় ফেটে পড়েন। আপুর ঘটনার পর এটা হওয়াই স্বাভাবিক। বাসায় ফিরে আমার মনে হচ্ছিল আমি বেঁচে আছি, আমার বাবা-মাও বেঁচে আছেন। আমরা চিন্তা করছি আগামি বছর অন্য কোথাও বাসা নেব। এখান থেকে দূরে কোথাও চলে যাব।”

সে মাথা তুলে রাস্তার দিকে তাকাল। দোকান থেকে আসা আলোতে ওর কাঠামো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

“তোমার সাথে আর দেখা হবে না।”

ড্রিঙ্কস হাতে নিয়ে মোরিনো একটু দূরে একটা টেলিফোনের খাম্বায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদেরকে দেখছিল। রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ির বাতাসে ওর চুল দুলছে। দেখতে ছোট ম্যাচ গার্লের মত লাগছে ওকে।

“শেষ হয়নি?” মোরিনো জিজ্ঞেস করল। “আর একটু,” আমি বললাম। বিড়বিড় করে কী জানি বলে অন্যদিকে ঘুরে তাকাল সে। ওখান থেকে আমাদের কথা শুনতে পাবে না। আমি ওর শুকনো কাঁধের দিকে তাকালাম।

“মোরিনো কি…” কিটাওয়া নাটসুমি বলা শুরু করল, আমার দৃষ্টি খেয়াল করে।

“কি?”

“কিছু না, ভুলে যাও…সে হয়তো আমাদের নিয়ে ভুল ভাবছে। তুমি কি ওকে জানাবে কি ঘটেছে?”

“দরকার না পড়লে না। আমার কোন ইচ্ছা নেই।”

“তাহলে সে জানতে পারছে না, তুমি ওকে রক্ষা করেছ। ইটসুকি, তুমি কি ওখানে গিয়েছিলে আমাকে রক্ষা করতে? নাকি ওর কাছে পৌঁছানোর আগেই আগুন থামাতে গিয়েছিলে?” নাটসুমি সোজাসুজি আমার চোখের দিকে তাকাল।

“ঠিক বলেছি তাই না? তুমি ওকে ভালোবাসো?”

প্রেম-ভালবাসার মত কিছু নয়…এক ধরনের ঘোর বলা যেতে পারে। কিন্তু সেটা আমি মুখে উচ্চারণ করলাম না।

কিটাযাওয়া নাটসুমি অন্যদিকে তাকাল, ডান হাত দিয়ে বাম কাঁধ ধরে আছে।

“কাঁধ ব্যথা করছে?”

সে মলিনভাবে হেসে সায় দিল।

“ঘোরার আগে ও এখানে হাত রেখেছিল।”

“ও?”

“বাদ দাও। আর কতক্ষন মোরিনোকে দাঁড় করিয়ে রাখবে?”

মোরিনো তখনো টেলিফোনের খাম্বার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওকে ডাক দিয়ে জানালাম যে আমাদের কথা শেষ।

মোরিনো আস্তে ধীরে আমাদের কাছে এল। ওর হাতে একটা ট্রিাসের ক্যান। আমি ইশারায় দেখালাম আমরা তো মানুষ তিনজন এখানে। সে বলল অপেক্ষা করতে করতে দুই ক্যান সে খেয়ে ফেলেছে। চেহারা দেখে অবশ্য বরাবরের মত বোঝার উপায় নেই ওর মেজাজ কতখানি খিঁচড়ে আছে।

আমরা তিনজন একসাথে গল্প করতে করতে হেঁটে স্টেশনের দিকে গেলাম। পড়াশোনা, কলেজ ভর্তি পরীক্ষা-এগুলো নিয়ে কথা হচ্ছিল, গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। আমি আমার অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিটাওয়াকেও হাসিখুশিই দেখাচ্ছিল। বেশ কয়েকবার হাসল।

মোরিনো কয়েক কদম পেছনে ছিল। আমি মাঝে মাঝে ফিরে ওকে দেখছিলাম। ওর এক হাতে ব্যাগ, আরেক হাতে সোডা ক্যান ধরে। যেন বুঝতে পারছে না ক্যানটা নিয়ে কী করবে। পায়ের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। সে। লম্বা চুলগুলো সামনে ঝুলে মুখ ঢেকে রেখেছে। কোন কথা বলছে না। আমাদের গল্পের মধ্যে ঢোকার কোন চেষ্টাও করল না। ওর দিকে তাকালেও আমি ভান করলাম কিছু খেয়াল করিনি, সব স্বাভাবিক আছে।

স্টেশনের সামনে খালি জায়গাটায় যখন আমরা পৌঁছলাম, ততক্ষণে পুরোপুরি সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। কিন্তু আশেপাশে প্রচুর দোকান থাকায়, আর সেগুলো থেকে উজ্জ্বল আলো আসার কারনে অন্ধকার তেমন একটা ছিল না।

স্কুল-অফিস ছুটি হয়ে যাওয়ায় স্টেশন ভর্তি মানুষ ছিল, সবাই বাসায় ফিরছে। বিশাল স্টেশনটার প্রথম তলায় চারকোনা একটা প্রবেশ পথ ছিল, অনেকটা টানেলের মত। লোকজন এমনভাবে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। সেখান থেকে, মনে হচ্ছে স্টেশনটা নিঃশ্বাস টেনে ভেতর নিচ্ছে আবার ছাড়ছে।

প্রবেশ পথের কাছে কিটাযাওয়া নাটসুমিকে আমি বিদায় জানালাম। সে হাত নেড়ে তারপর টিকেট মেশিনগুলোর দিকে চলে গেল। এমনভাবে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেল যেরকম সাইন্স ফিকশন মুভিতে স্পেসশিপ শত্রু বহরে সাঁ করে ঢুকে যায়।

মোরিনো আর আমি দেয়াল ঘেঁসে দাঁড়ালাম যাতে লোকজনের চলাচলে বাধা না হয়। আমাদের দুজনের কারোরই ভিড়, চেঁচামেচি পছন্দ না। এসব জায়গায় বেশিক্ষণ থাকলে মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়।

“কিটাযাওয়া নাটসুমির সাথে ওর বোনের মিল দেখে অবাক হয়েছ না?” আমি বললাম।

তারচেয়েও যেটা জরুরি সেটা হলো, মানুষ বুঝে তোমার কথা বলার ভঙ্গি বদলে যাওয়া। সমস্যা হয় না?” মোরিনো তার হাত দুটো ভাঁজ করে আছে। ডান হাতে ধরা সোডা ক্যানটা বাম হাতের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছিল। আমি নিশ্চিত ওর শরীরের তাপে সোড়া এখন গরম হয়ে গিয়েছে।

মোরিনো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কিটাযাওয়া নাটসুমির দিকে তাকাল। “তুমি কি করে এত স্বাভাবিকভাবে হাসতে পারো আমি বুঝি না।”

“আনন্দিত হওয়ার কারনে আমি হাসি না।”

কথাবার্তা যাই হোক না কেন তা থেকে আমার কোন আনন্দ হয় না। সবসময় মনে হয় আমি যেন কোন গভীর অন্ধকার গর্তের তলায় দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু সাথে সাথে অবচেতনভাবে অভিনয় চালিয়ে যাই, সাবধান থাকি যেন কেউ সেটা ধরতে না পারে।

“আর সেও খুব একটা হাসে না, আমার সাথে কথা বলার সময় খালি একটু হাসল, কিন্তু ইদানিং কিছুদিন ওর অবস্থা এরকম ছিল না।”

মোরিনো ভুরু কুচকাল। “মেয়েটা হাসে না? আমার কাছে তো ওকে বেশ হাসিখুশি মনে হলো।”

আমি মোরিনোকে কিটাযাওয়া নাটসুমির সাথে ওর বোনের সম্পর্কের একটা সাধারণ বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করলাম। দুই বোনের মধ্যে চেহারায় মিল থাকলেও, ওদের মধ্যে বেশ লম্বা সময় ধরে একটা অপ্রীতিকর অবস্থা চলছিল। নাটসুমির ধারণা ছিল ওর বোন ওকে ঘৃণা করে, যে কারনে ও হাসতে ভুলে গিয়েছিল।

মোরিনো চুপচাপ শুনল, কিছু বলল না।

“আমি কিটাওয়া হিরোকোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে গিয়েছিলাম, বুঝতেই পারছ কি কারনে। ও আমাকে ওদের এই সমস্যা সম্পর্কে আমাকে তখন বলেছিল। কিন্তু এরপর একদিন ও একটা টেপ পেল যেটায় হিরোকোর কণ্ঠ রেকর্ড করা ছিল..”

বোনের মুখোমুখি হওয়ার একটা সুযোগ ওর সামনে এল যদিও ও ভেবেছিল আবার ওদের দেখা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

আমি ওকে গত রাতের ঘটনা, কিংবা খুনির কথা কিছুই বললাম না। বললে ঝামেলা বাড়তে পারে। আমি শুধু ওকে সংক্ষেপে জানালাম টেপের কথাগুলো শুনে কিভাবে কিটাযাওয়া নাটসুমির মধ্যে পরিবর্তন এসেছে।

আমার মনে পড়ল ও কিভাবে টেপ রেকর্ডারটা জড়িয়ে ধরে ফ্লোরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিল।

আমি তখন ছুরি হাতে দাঁড়িয়ে ছেলেটার কাপড়ে রক্ত মুছছিলাম। টেপের বর্ণনা থেকে ছোটবেলায় ওরা কিভাবে একসাথে খেলাধুলা করত তা কল্পনা করতে আমার কোন কষ্টই হয়নি।

আমি যখন এগুলো মোরিনোকে বলে শেষ করলাম, ও তখনো দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হাত দুটো তখনো ভাঁজ করা। দৃষ্টি নিচের দিকে। মনে হচ্ছে গভীর কোন চিন্তায় ডুবে গিয়েছে। চোখগুলো আধ বোজা। মাথার উপর থেকে উজ্জ্বল আলো চোখের পাতার উপর পড়ায় চোখের নিচে ছায়া পড়েছে।

“এসবের কোন কিছুই আমার স্ট্র্যাপবুকে নেই,” সে বলল, এতটা আস্তে যে আমি প্রায় শুনতেই পারিনি। সে মাথা তুলে টিকেট মেশিনের লাইনে দাঁড়ানো কিটাযাওয়া নাটসুমির দিকে তাকাল।

লাইন সামনে এগুলে নাটসুমি মেশিনে কয়েন ফেলল। একটা বাটনে চাপ দিয়ে কাছাকাছি এক স্টেশনের টিকেট নিল। তারপর ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেল। মানুষের স্রোতের মধ্যে মাঝে মাঝে এক ঝলক দেখা যাচ্ছে।

মোরিনো হাতে ধরা ক্যানটার দিকে তাকাল। তারপর দেয়াল থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এক মুহূর্ত পর ওর লম্বা কালো চুলও ওকে ফলো করল। ওর হাঁটা দেখে মনে হচ্ছিল শান্ত নদীর পানির মত, হঠাৎ নিস্তব্ধে আবার বইতে শুরু করেছে।

আমার বুঝতে মুহূর্তখানেক লাগল যে ও হাঁটতে শুরু করেছে। কি করতে চাইছে বুঝতে না পেরে আমি খালি তাকিয়ে থাকলাম। ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হওয়ার আগ পর্যন্ত ওকে ফলো করিনি।

মোরিনোর দৃষ্টি কিটাযাওয়া নাটসুমির উপর বিদ্ধ হয়ে ছিল, যে ইতিমধ্যে টিকেট কিনে প্লাটফর্ম গেটের দিকে এগুচ্ছে।

মোরিনো ইয়োরু নিশিতে পাওয়া মানুষের মত ওর পিছু পিছু যেতে লাগল। ভিড়ের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস না থাকায় এদিক ওদিক লোকজনের ধাক্কা খাচ্ছিল। স্যুট পরা নারীপুরুষের ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে এসে আবার জোর সামনে এগুচ্ছে। এর আগে আমি কখনো কাউকে ভিড়ের মধ্যে এত যুদ্ধ করতে দেখিনি। ওর কাছে পৌঁছে যেতে আমার কোন সমস্যাই হলো না।

অন্যদিকে কিটাযাওয়া নাটসুমি ঘিঞ্জি গেটগুলো পার হয়ে গিয়েছে। অল্প কিছু গেটের সামনে বিশাল একদল লোক জমা হয়ে তাদের সময় আসার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদের মাথা আর পিঠের জন্য আমরা কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। নাটসুমিকে চোখে পরছিল না। সে মোরিনোকে খেয়াল না করে স্টেশনের ভেতর ঢুকে গিয়েছিল।

মোরিনো আবার একজনের সাথে ধাক্কা খেল, মধ্যবয়স্ক বিশালদেহী এক লোক। মনে হল যেন কোন ভারি ট্রাকের সাথে একটা ট্রাইসাইকেলের সংঘর্ষ হলো। ও ধাক্কা খেয়ে আমার উপর এসে পড়ল। ওর মাথা আমার চোয়ালে লেগে চোখে অন্ধকার দেখলাম। গত কয়েক মাসে এত কিছু হলেও এরকম ক্ষতি আমার আর হয়নি। মোরিনো অবশ্য সেটা খেয়াল করেছে মনে হল না। ওর মনোযোগ ছিল কিটাযাওয়া নাটসুমি যেদিকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সেদিকে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জোরে চিৎকার করে ডাকল,

“নাটসুমি!”

এর আগে কখনো আমি ওকে জোরে কথা বলতে শুনিনি। এত জোরে তো প্রশ্নই আসে না। ওর শুকনো শরীরের ভেতর কোথাও মনে হলো একটা অ্যাম্পলিফায়ার বসানো আছে। আশেপাশের ভিড়ের শব্দ মুহূর্তের জন্য নিরব হয়ে গেল। কিছু লোকজন থেমে গিয়ে ওর দিকে তাকাচ্ছিল।

মোরিনো আবার হাঁটা শুরু করল। যারা যারা ওর চিৎকার শুনেছে তারা স্বরে গিয়ে ওকে জায়গা করে দিল। আমিও পিছে পিছে গেলাম।

“মোরিনো?” কিটাযাওয়া নাটসুমির গলা শোনা গেল। মানুষের ভিড় থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল ওকে। গেটের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে নিশ্চয়ই মোরিনোর গলা শুনে ফিরে এসেছে। অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমাদের মাঝে একটা বন্ধ গেট। মোরিনো একটা গেট আটকে রাখায় দ্রুত আমাদের আশেপাশে ভিড় জমে গেল। যদিও মারিনো সেটা খেয়াল করল বলে মনে হলো না।

“নাটসুমি, এটা তোমার জন্য,” মোরিনো ক্যানটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল।

“ধ-ধন্যবাদ,” কিটাযাওয়া নাটসুমি ইতস্তত করে ক্যানটা নিল।

“একটু আগের বাজে মেজাজের কারনে আমি দুঃখিত। তোমার সাথে আমার আরো কথা বলা উচিত ছিল। আমি শুনেছি তোমার বোনের সাথে তোমার সম্পর্ক ঠিক হয়ে গিয়েছে।”

গেট দিয়ে যেতে না পেরে অনেক লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। স্টেশন অ্যাটেন্ডেন্টরা সমস্যা বুঝতে পেরে ভিড় ঠেলে আমাদের দিকে আসার চেষ্টা করছিল। আমি মোরিনোর হাত ধরে টানলাম। ওকে ওখান থেকে সরিয়ে আনতে চাইলাম, কিন্তু ও বাধা দিল, সেখান থেকে নড়ল না।

“আমার সাথেও আমার বোনের সমস্যা ছিল, যখন…কিন্তু ফলাফল ভালো হয়নি…যাই হোক আমি শুধু তোমাকে অভিনন্দন জানাতে চাইছিলাম, এই আরকি।”

এরপর আমি ওকে সেখান থেকে টেনে বের করে আনতে পারলাম। ওর শরীর একদম হালকা ছিল, যেন কোন ওজনই নেই। লোকজনের সোত আমাদের পাশ কাটিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল, কিটাযাওয়া নাটসুমি সেই সোতে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার আগে আমি ওকে হাসতে দেখলাম, মোরিনোকে ধন্যবাদ জানিয়ে।

মোরিনো আমার পিছু পিছু আসতে লাগল, ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ওর ব্যাগটা কোথাও হারিয়ে ফেলেছে।

আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যাগটা খুঁজে পেলাম। একটু আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা সেখানে দেয়ালে ঠেশ দিয়ে রাখা।

আমি ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে বিদেশী নারীর ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভিড়ের মধ্যে ওকে টেনে আনা কষ্টকর ছিল অবশ্য। শক্ত করে হাত ধরে ছিলাম যেন আলাদা না হয়ে যাই। ও মাটির দিকে তাকিয়ে আছে, কোনদিকে যাচ্ছে তা নিয়ে ওর কোন হুঁশ নেই। ওর ঠোঁটগুলো কাঁপছে, যেন কিছু বিড়বিড় করছে সে। ভিড়ের শব্দের কারনে শুনতে পাচ্ছি না আমি।

ভিড় ঠেলে ওর ব্যাগ রাখা জায়গাটায় পৌঁছানোর পর শুনলাম ও বলছে, “আমার মনে হয় তুমি আমার ঠিক বিপরীত, কামিয়ামা,” সে এক কথাই বার বার ফিসফিস করে বলছিল। আমাকে বাসায় যাওয়ার জন্য ট্রেন নিতে হবে। আর ওকে এখান থেকে একা একা হেঁটে বাসায় যেতে হবে। ওর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল না সেটা পারবে।

“প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার মতই। তোমাকে দেখে আমার বোনের কথা মনে পড়ত। কিন্তু তুমি তা নও। আমাদের মধ্যে কোন মিল নেই।”

মোরিনোর ব্যাগটা ছিল একটা সাধারণ ধরনের কালো ব্যাগ। আমি ওটা তুলে ওর হাতে দিলাম। এক সেকেন্ড পরে সেটা আবার নিচে পড়ে গেল।

ব্যাগটা আবার তুলে ওর হাতে পেঁচিয়ে দিলাম। কিন্তু কোন কাজ হল, মনে হচ্ছিল ও ব্যাগ বহন করার জন্য খুব বেশি ক্লান্ত। ওর আঙুলগুলো ব্যাগের ওজন বহন করতে পারছে না। আঙুলের ফাঁক গলে ব্যাগটা খসে পড়ল।

“মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তুমি উপরে উপরে হাসছ কিন্তু তোমার ভেতরটা শূন্য। শুনতে খারাপ লাগলে আমি দুঃখিত, কামিয়ামা। কিন্তু আমার তাই মনে হয় যখন তোমাকে অন্যদের সামনে হাসিখুশি অবস্থায় দেখি। আর মাঝে মাঝে তোমার জন্য আমার সত্যি সত্যি দুঃখ হয়।”

আমার দিকে না তাকিয়ে মোরিনো কথাগুলো বলে যাচ্ছে। ওর গলা কাঁপছে, মনে হচ্ছে যেন একটা ছোট বাচ্চা যেকোন মুহূর্তে কান্নায় ভেঙে পড়বে।

“কিন্তু আমি একদম উল্টো ধরনের।”

মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল, চোখে চোখ রাখল। আমি ওর চেয়ে লম্বা হওয়ার কারনে এটুকু দূরত্বের মধ্যেও ওকে উপরের দিকে তাকাতে হলো। ওর অভিব্যক্তি বরাবরের মতই শূন্য ছিল। কিন্তু চোখগুলো ঈষৎ লাল হয়ে ছিল, ভেজা দেখাচ্ছিল।

“আমি জানি,” আমি বললাম।

একটা দীর্ঘ মুহূর্ত ও নড়াচড়া না করে চুপ করে থাকল। তারপর মাথা নামিয়ে নড় করে বলল, “তাহলে ঠিক আছে। এভাবে বকবক করার জন্য আমি দুঃখিত।”

আমি ওর ব্যাগটা এগিয়ে দিলাম, ও সেটা এমনভাবে হাতে নিল যেন কিছুই হয়নি। এবার আর সেটা খসে পড়ল না।

আমাদের ডান-বাম দিয়ে যাওয়া আসা করা লোকজনের দিকে তাকাল। আমি বুঝতে পারছিলাম না ও কী দেখছে, কারন লোকজনের ভিড় ছাড়া আর কিছু ছিল না।

তারপর আস্তে করে বলল, “আমি আসলেই নাটসুমির জন্য আনন্দিত। খানিকটা হিংসাও হচ্ছে।”

মোরিনো আবার আগের মোরিনোতে ফিরে এসেছে, আমার সাহায্যের আর ওর দরকার নেই।

এরপর আমরা দুজন দুজনার থেকে বিপরীত দিকে হেঁটে চলে গেলাম, একজন আরেকজনকে কোন রকম কোন বিদায় না জানিয়েই।

Exit mobile version