“প্লিজ…ওর মেসেজের বাকিটা আমাকে শুনতে দাও।”
আপুর কন্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম আমি, যদিও ছেলেটার হাতগুলো আমার কান ঢেকে রেখেছিল। আকাগির ব্যাপারে এসব জানতাম না আমি। আপুর অদ্ভুত ব্যবহারের রহস্যের গিট খুলতে শুরু হয়েছে।
ওর হাতের সন্ধিগুলো আমার গলার পাশে আঁট হয়ে আবার আলগা হচ্ছিল। যেন ভেতরের হাড় পরীক্ষা করে দেখছে। ঘাড় ভাঙার জন্য হাতগুলো পুরোপুরি তৈরি ছিল, মনে হচ্ছিল যেন একজন অ্যাথলেট স্বল্প পাল্লার দৌড়ের জন্য ওয়ার্ম আপ করছে।
আমার ঘাড়টা মনে হচ্ছিল সুন্দর একটা ফুলের ডাঁটির মত, না ভেঙে ফুলটা আলাদা করা যাবে না।
‘সত্যি কথাটা জানার পরও আমাদের মধ্যে কোন সমস্যা ছিল না। শুরু সেভাবে হলেও সত্যিকারের ভালবাসা আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। আমাকে ভালোবেসেছিল সে, আমার ভেতরে যা আছে সেটাকে…’
কিন্তু আমি নার্ভাস ছিলাম।
আমার বুক ব্যথা করছিল ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে।
“তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ,” ছেলেটা ফিসফিস করে বলল। ওর কণ্ঠ আমার ডান দিক থেকে এল। আমি ওর বুকের উঠানামা টের পাচ্ছিলাম। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে।
“আমার দ্বিতীয় শিকারের জন্য দু-জনকে বাছাই করেছিলাম। একজন হল কিটাযাওয়া নাটসুমি, আরেকজন আমার স্কুলের একটা মেয়ে।”
“মোরিনো? তোমাকে ওর সাথে হাঁটতে দেখেছি..”
ওর হাতের কারনে আমার কণ্ঠ চাপা পড়ে যাচ্ছে। বুক ধুকপুক করছে, শিরার মধ্যে দিয়ে রক্ত জোরে ছুটছে। গলার উপর হালকা চাপ, শিরার স্পন্দন-আমার মাথা গরম হয়ে উঠতে লাগল।
“কামিয়ামা ইটসুকি তোমাকে ওর নাম বলেছে, তাইনা? শেষে অবশ্য আমি তোমাকে বেছে নিয়েছি, কারনটা হয়তো তুমি যেটা বললে সে কারনেই।”
আমার মনে হলো, কথাগুলো ও আমাকে না বলে নিজেকেই শোনাচ্ছে। হয়তো ও নিজের কর্মকাণ্ড নিজেই বুঝতে পারছে না। অদ্ভুত হলেও, আমার কাছে মনে হল আমরা বন্ধুর মত।
‘আমিও আকাগিকে কখনো জানাইনি…যে সে তোমাকে দেখেছিল, আমাকে নয়। আমি ওকে বলতে পারিনি আসলে…’
আমি এতটা অন্ধ ছিলাম কি করে? আপুর ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। ছেলেটার হাতের বন্ধনে আটকা পড়ে, আপুর কণ্ঠ শুনতে শুনতে নিজের প্রতি লজ্জা হতে লাগল আমার।
আমার ধারণা ছিল আপুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস আছে, যেটা আমার নেই। ভেবেছিলাম সে অনেক মেধাবী, মিশুক-একজন শক্ত নারী, যাকে সবাই ভালবাসে। অথচ সত্য ছিল একদমই অন্যরকম…।
‘আমি তোমার মুখের দিকেও তাকাতে পারছিলাম না…আমরা অনেকটাই একইরকম ছিলাম। আমি আমার সব বিরক্তি তোমার উপর ঝেড়েছি। চুলের রঙ বদলেছি, তোমার থেকে ভিন্ন রকমের পোশাক পরাশুরু করেছি, যাতে তোমার সাথে মিল না থাকে…কারন আমি জানি আকাগির প্রতি তোমার অনুভূতি কিরকম…’
আমার বোন তার নিজের ভয় আর দুচিন্তার মধ্যে আটকা পড়ে নিরন্তর যুদ্ধ করে চলছিল। আমাকে আকাগির ব্যাপারে কিছু বলতে পারছিল না। এই গোপন ব্যাপারটা তার হৃদয়ের উপর বোঝার মত চেপে বসেছিল। আমার পকেটের লিপস্টিকটা…সে সেটা ব্যবহার করত আশেপাশের দুনিয়া থেকে নিজের ভয়কে আড়াল করার জন্য।
আফসোস! সে বেঁচে থাকা অবস্থায় যদি আমি সেটা লক্ষ্য করতাম। আমি যদি ব্যাপারটা জানতে পারতাম তাহলে তাকে বুকে জড়িয়ে জানাতাম নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
ছেলেটার হাতের চাপ বাড়ল। ওয়ার্ম আপ করা শেষ। শক্ত করে আমার মাথা ধরে আছে এখন। তার হাতের চাপে আমার মনে হচ্ছিল ভালবাসার বন্ধনে মৃত্যু ঘটতে চলছে যেন আমার।
আপুর কণ্ঠ যখন থামবে, জোরে চাপ দিয়ে আমার ঘাড়ে মোচড় দেয়া হবে। মাথা আর ঘাড়ে বিপরীত চাপ পড়ে আলাদা হয়ে যাবে। মৃত্যুর মুহূর্তটা নিয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম।
‘যদিও আমি আমার শেষ কথাগুলো এভাবে রেকর্ড করছি, আমার ইচ্ছা হচ্ছে…ইচ্ছা হচ্ছে যদি কথাগুলো তোমাকে আরো আগে বলা যেত…’
আমি টের পাচ্ছি আমার হৃদপিন্ড জোরে জোরে লাফাচ্ছে। সারা শরীরের রক্ত পাম্প করার শব্দ যেন আপুর কণ্ঠের মতই পরিস্কার শুনতে পাচ্ছি। ছেলেটার হৃদস্পন্দনও টের পাচ্ছি আমি।
বুকে কেমন যেন চাপ বোধ হচ্ছে, ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কাঁদি। ছেলেটার প্রতি আমার কোন রাগ বা ঘৃণা নেই, মৃত্যুর মত অনিবার্য কিছু মনে হচ্ছে ওকে।
আপুর স্বীকারোক্তি প্রায় শেষ। ছেলেটার হাতের চাপ আর আপুর কণ্ঠ থেকে সেটা বুঝতে পারছি আমি।
আমি খুশি যে টেপটা শুনতে পেরেছি।
“তুমি জানতে তুমি আমাকে খুন করবে…সেজন্য তুমি বাসায় এসেছিলে টেপগুলো নিতে, যাতে আমি আর না ফিরলে পুলিশ সেগুলো খুঁজে না পায়,” আমি বললাম। সাবধানে বললাম যাতে আপুর কন্ঠ মিস না হয়। খুন হওয়ার আগে আপু এই কথাগুলো আমাকে বলে গিয়েছে। আমার দায়িত্ব সবটুকু শোনা।
‘কিন্তু পেছনে ফিরে যাওয়ার কোন উপায় তো নেই। নাটসুমি…আমি তোমাকে আসলেই ভালোবাসতাম।
“নাটসুমি,” ছেলেটা বলল, গলার উপর চাপ সরে গেল। আমি এটা আশা করিনি, একটু অবাক হলাম। “আমি কখনো তোমার বাসায় যাইনি।”
ওর কথাগুলো প্রথমে বুঝতে পারলাম না। সে বলতে চাইছে সে টেপগুলো নেয়নি? প্রশ্নটা করার আগেই অপারেটিং চেম্বারে কারো ঢোকার শব্দ পেলাম।
ছেলেটার হাত শিথিল হলেও, তখনও সেগুলো আমাকে পেঁচিয়ে আছে, কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তৃতীয় ব্যক্তিটা কে? ওর হাত যথেষ্ট জোরালো থাকায় নড়তেও পাচ্ছি না। শুধু নতুন এক জোড়া পায়ের শব্দ পাচ্ছি।