ছেলেটার কথাগুলো একদম জায়গামত গিয়ে আমাকে আঘাত করল। শব্দহীন কিছু একটা আমার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এল। চিৎকার আর গোঙানির মাঝামাঝি কোন কিছু। হাত দুটো দিয়ে শক্ত করে মাথা চেপে রাখলাম।
‘নাটসুমি, যে কারনে আমি তোমার উপর কঠোর হয়েছিলাম তার আসলে কোন গুরুত্ব ছিল না। ব্যাপারটা ছিল আকাগির কারনে।’
এমন এক বাবা-মাকে আমি ফেলে এসেছি যারা কিনা ইতিমধ্যে তাদের এক মেয়েকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছে। অপরাধবোধ আমাকে দাবানলের মত ঘিরে ধরল।
“দ্বিতীয় টেপটা পাওয়ার পর তোমার হাতে দু-দিন সময় ছিল। সে সময়ের মধ্যে তুমি যার যার সাথে দেখা হয়েছে সবাইকে বিদায় জানিয়েছ-তোমার জীবনের সাথে জড়িত সবাইকে এবং সবকিছুকে বিদায় জানিয়েছ। সোজা মৃত্যুর দিকে হেঁটে গিয়েছ।”
অবশেষে আমি উপলদ্ধি করলাম-এই ছেলের সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমি যা যা করেছি তা হল স্লো-মোশন সুইসাইড। বাবা-মাকে না জানিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি, ফিরে যাওয়ার শেষ সুযোগটাও ছুঁড়ে ফেলেছি। এই দুনিয়ার সাথে আমার সম্পর্কের সবচেয়ে ভারি বন্ধনটাকে ভেঙে এখানে এসেছি..
‘আকাগির সাথে কিভাবে আমার পরিচয় হয়েছে তা তোমাকে কখনো বলিনি…’
“আমি..”
আমি আমার হাত নামিয়ে নিলাম, আশেপাশে তাকালাম। ঠান্ডা কংক্রিটের রুমটা শূন্য অন্ধকারে ডুবে আছে। আর কিছুই এখানে নেই একমাত্র রক্ত মাখা অপারেটিং টেবিল আর ছেলেটা ছাড়া…একটা খুবই নিঃসঙ্গ স্থান।
আমার পা নড়ল। দেয়াল থেকে সরে এসে অপারেটিং টেবিলের দিকে এগুলাম।
নিজের ইচ্ছায় জীবনের সবকিছু থেকে আমি সরে এসেছি। আপুর কণ্ঠ ছাড়া আর কিছুই আমার কাছে কোন মূল্য বহন করে না। নিজেকে কি আমি আসলে এই মুহূর্তে জীবিত দাবি করতে পারি? আমার দেহ হয়তো কাজ করছে কিন্তু ইতিমধ্যে তো আমি মৃত্যুর দেশের অর্ধেক পথ পেরিয়ে গিয়েছি।
‘সে রাস্তায় এসে আমার সাথে কথা বলেছিল। পরে আমি জানতে পেরেছি আমরা একই কলেজে পড়ি।
টেবিলের অন্যপাশে ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি এখন। সে একটা পেশিও নড়ায়নি এখনো, শুধু কথা দিয়ে আমার সব দ্বিধা বের করে নিচ্ছে।
সে এখন আমার অনেক কাছে দাঁড়িয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লম্বা হওয়ার কারনে দৃষ্টি খানিকটা নিচের দিকে।
“হিরোকো এই টেপটা যখন রেকর্ড করছিল তখন আমি তোমার কথা জানতে পারি। তারপর থেকেই আমি অপেক্ষা করছিলাম তোমার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য, সে ফিসফিস করে বলল। “তুমি আসলেই দেখতে ওর মত।”
আমার বোনের কণ্ঠ রুমের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলে নিস্তব্ধ বিল্ডিঙের মধ্যে হারিয়ে গেল। “আমি জানি তুমি কেন আমাকে টেপটা দিয়েছিলে, কেন তুমি এখানে এনেছ,” আমি বললাম।
ছেলেটাকে দেখতে কুচক্রীর মত লাগল।
“মজা করার জন্য তুমি এসব করছ না, তাই না? সস্তা ধূলের আশায় নয়। রেস্টুরেন্টে একটা কথা বলেছিলে তুমি। সব মানুষের সবকিছু তোমার কাছে স্ক্রিপ্ট করা মনে হয়, নকল মনে হয়…শুধু মৃত্যুকে মনে হয় আসল।”
‘আমরা ডেট করা শুরু করলে আকাগি বলেছিল সে আমাকে প্রায়ই বুকস্টোরে দেখত। আর তখন সে আমার প্রতি আগ্রহি হয়ে ওঠে। আমাকে সবসময় সাদা উলের জ্যাকেট পড়তে দেখত সে, ঐতিহাসিক উপন্যাসের সেলফের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে…’
এই ছেলেটা মানুষ খুন করেছে। অথচ এই নিয়ে ওর কোন অপরাধবোধ নেই। আমি জানি ওর প্রতি আমার কোন সমবেদনা অনুভব করা ঠিক নয়, কিন্তু তারপরেও…ছেলেটার জন্য আমার খানিকটা খারাপ লাগছিল।
“তুমি দেখতে চেয়েছিলে আমি আমার বোনের সাথে সম্পর্ক ঠিক করতে চাই কিনা, সেটা তার মৃত্যুর পরে হলেও। ব্যাপারটা তুমি বুঝতে চাইছিলে কারন এই অনুভূতিগুলো বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই।”
বেশ একটা লম্বা সময় সে অনুভূতিহীন দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। কোন কথা বলল না। শুধু আপুর কণ্ঠ রুমের মধ্যে প্রতিধ্বনি তুলছিল। আমি জানি না সে কী ভাবছিল, জানার ক্ষমতা আমার নেই।
‘বুঝতে পেরেছ ব্যাপারটা? আকাগি আসলে প্রথমে তোমাকে দেখেছিল।
অবশেষে ছেলেটা ওর হাত দুটো অপারেটিং টেবিলের উপর রাখল। “নাটসুমি, এখানে বস।”
কোন ভয় অনুভূত হলো না আমার। ছেলেটার দিকে পিঠ দিয়ে আপুর রক্তে মাখা টেবিলটার উপর বসলাম। ছেলেটার উপস্থিতি টের পাচ্ছি আমার পেছনে।
শীতল টেবিলটা থেকে ঠান্ডা আমার জিন্সের প্যান্ট দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিল। আর একটু পরেই মরে যাব কিন্তু তারপরেও অদ্ভুত এক শাস্তি বোধ করছি, শান্ত সাগরের মত।
টেবিলের কোনা ধরে ছিলাম। আপুর শুকনো রক্তের স্পর্শ পাচ্ছিলাম। নড়তে পারছিলাম না। কিংবা বলা যায় নড়াচড়া করার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না, তাই নড়তে পারিনি। আঙুলের তলে সবকিছু কেমন ঠান্ডা আর শক্ত হয়ে ছিল।
লাইটটা আমার পেছনে থাকায় সামনে দেয়ালে আমাদের ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম। ছেলেটার শরীরের ছায়া আমার ছায়া অর্ধেক ঢেকে দিয়েছিল, একটু এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সে।
‘আমরা সবসময় একইরকম পোশাক পরতাম, যে কারনে সবাই বলত আমরা দেখতে একইরকম,..আকাগি ভুল করে আমাকে প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছিল, ভেবেছিল তুমি…
ছেলেটার ছায়া নড়ে উঠল। হাত তুলল, ছায়া আমার ছায়ার উপর বেড়ে গেল।
ওর হাত দিয়ে আমার দৃষ্টি ঢেকে দিল, কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না আর। অন্ধকারে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম আমি। পেছন থেকে আসা হাত দুটোর একটা আমার ঘাড় পেঁচিয়ে ছিল, আরেকটা আমার মুখ। সে যদি জোরে চাপ দেয় তাহলে মুহূর্তের মধ্যে আমার ঘাড় ভেঙে যাবে। আমি নিজের নিঃশ্বাসের উষ্ণতা টের পাচ্ছি। ছেলেটার বুক আমার পিঠে লেগে ছিল। কাপড়ের ভেতর দিয়ে ওর উষ্ণতা ভেদ করে আসছে।