তখন আমি খেয়াল করলাম সিলিং আর দেয়ালগুলো পোড়া নয়। কালো দাগটা শুরু হয়েছে টেবিল থেকে, পায়ের নিচের মেঝে ছাড়িয়ে রুমের দেয়াল হয়ে দরজার নিচ পর্যন্ত।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি গিয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালাম। খালি হাতটা দিয়ে মুখ চেপে চিৎকার আটকানোর চেষ্টা করলাম। কালো দাগটা আমার বোনের রক্তের।
অন্ধকারে আমি যেন প্রায় ওকে দেখতে পাচ্ছি। আমার বোনের শরীরের অংশ, মৃতদেহের টুকরোগুলো। পুলিশ সেগুলো পরিস্কার করছে।
‘নাটসুমি…
জানি না তুমি কখনো এটা শুনতে পাবে কিনা?
হঠাৎ আমি আপুর কন্ঠ শুনতে পেলাম। পাশ থেকে আসছে। প্রথম টেপটায় কথাগুলো ছিল। আমি দরজার দিকে আলো ফেললাম। গোল আলোয় দরজাটা বন্ধ হতে দেখলাম, যেন মাত্রই কেউ ভেতরে ঢুকেছে।
“কিটাওয়া নাটসুমি।” ছেলেটার গলা ভেসে এল অপারেটিং টেবিলের অন্য পাশ থেকে। পুরো জায়গাটা হঠাৎ যেন জ্বলে উঠল, আমি অন্ধ হয়ে গেলাম।
আলোতে ছেলেটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, ইউনিফর্ম পরা নেই। কিন্তু পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো পোশাক। ওর হাতের লাইটটা আমার ফ্ল্যাশলাইটের চেয়ে অনেক শক্তিশালী ছিল। অন্য হাতে একটা ছোট টেপ প্লেয়ার ধরে রেখেছে। সেখান থেকে আসছে আপুর গলার শব্দ।
‘সে কথা দিয়েছে মেসেজটা তোমাকে পাঠাবে সে। সে দেখতে চায় আমার কথাগুলো শুনে তোমার প্রতিক্রিয়া কি হয়…’।
আমার বোন বলে চলল। ওর নিঃশ্বাসের শব্দ কংক্রিটের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল। আমি অপারেটিং টেবিলটার দিকে তাকালাম, যেখানে রক্তের দাগ সবচেয়ে গাঢ়। পুরো রুম জুড়ে কালো ছায়া ফেলেছে।
“হিরোকো এই টেবিলে শুয়ে টেপটা রেকর্ড করেছিল।”
ছেলেটা লাইট আর টেপ প্লেয়ারটা এক কোনায় রেখে টেবিলের দিকে এগোল। কালো দাগটার উপর হাত বোলাল সে, যেন আদর করছে।
“কেন আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে?” প্রশ্ন করলাম আমি। আমার গলা কাঁপছে।
অপারেটিং টেবিলটা একসময় কালো লেদারে মোড়া ছিল। কিন্তু এখন সেটার অল্পই অবশিষ্ট রয়েছে। লেদার ছিঁড়ে ধাতব অংশ বেরিয়ে এসেছে। কালো দাগ পুরোটা ঢেকে ফেলেছে। ছেলেটা হালকাভাবে সেখানে আঙুল বুলিয়ে গেল। আঙুলের স্পর্শে শুকনো রক্তে সৃষ্টি হওয়া মৃদু শব্দ শুনে আমার লোম দাঁড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন ছেলেটা আমাকেই স্পর্শ করছে।
“হিরোকো যেমন বলল, আমার কৌতূহল হচ্ছে টেপটা শুনে তোমার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়।”
আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই ছেলেটা অপারেটিং টেবিলের উপর দুবার টোকা দিল। ওর দৃষ্টি পরিস্কার বলছিল সে আমাকে কি করতে দেখতে চাইছে।
দেয়ালে ঠেস দিয়ে আমি আস্তে করে মাথা নাড়লাম। যদি ছেলেটার দিকে এগোই তাহলে মরতে হবে। আমার বোনের মত আমাকেও খুন করা হবে। কিন্তু ভয়ের কারনে মাথা নাড়িনি আমি।
অপারেটিং টেবিলের পাশে চুপচাপ দাঁড়ানো ছেলেটার উপর আলো পড়ায় মনে হচ্ছিল যেন অন্ধকারে ভাসছে সে। ওর পেছন থেকে আলো এমনভাবে ওর কাঠামোটা আলোকিত করে তুলেছিল যেন স্বর্গীয় কিছু দাঁড়িয়ে আছে। আমার ভয় কমে গেছে, মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুর সাথে বোঝাপড়া করা অর্থহীন, অযৌক্তিক আর হাস্যকর।
‘আমি অনেকবার অনেক কিছু বলেছি তোমাকে আঘাত করার জন্য, কিংবা হতভম্ব করার জন্য…’
“নাটসুমি, এদিকে আস, ছেলেটা বলল।
সে আমাকে বলছিল অপারেটিং টেবিলে এসে উঠতে। মাত্র তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিল ও।
যদি দ্রুত নড়াচড়া করে তাহলে সহজেই আমাকে ধরে ফেলতে পারবে। জোর করে শোয়াতে পারবে। কিন্তু সে নড়ল না। অপেক্ষা করছিল। তার কাছে যাওয়ার জন্য।
তার কথা অনুযায়ি আমার পাগুলো চলল। আমার ভেতরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে-যেন ওর কথা আমাকে শুনতেই হবে। যখন আমি সেটা বুঝলাম, শরীর কেঁপে উঠল আমার।
নিজের ইচ্ছায় আমি ওর কাছে যাচ্ছি? জোর করে দেয়ালের সাথে লেগে থাকলাম। ছেলেটার দিকে তাকালাম।
সে বুঝিয়ে বলল, “নাটসুমি, তুমি ইতিমধ্যে জানো কিন্তু।”
“কি জানি?” আমি না বুঝতে পেরে প্রশ্ন করলাম।
“এই যে, আমি তোমাকে খুন করতে যাচ্ছি। তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ আমাকে খুন করতে দেবে।”
আমার বোনের কণ্ঠ কাঁপছে। আমার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে ছেলেটা, পলক পড়ছে না ওর চোখে। ওর দৃষ্টি এত সূচালো যেন আমার মাথা ভেদ করে সব দেখতে পাচ্ছে।
“তুমি মৃত্যুর প্রতি আকর্ষিত…নিজের ইচ্ছায় তুমি এখানে এসেছ।”
“কথাটা মোটেও সত্যি নয়,” আমি জোর গলায় বললাম।
ছেলেটা চোখ সরু করে আস্তে আস্তে বলল, “আমার বিশ্বাস মৃত্যু হলো, ধ্বংস’। মৃত্যুর সময় দুনিয়ার সাথে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। প্রিয়জনের সাথে যত সম্পর্ক সব ধ্বংস হয়ে যায়। তারা কখনো আর সূর্য দেখতে পাবে না, বাতাস অনুভব করতে পারবে না, আঁধার কিংবা নিরবতা টের পাবে না। আনন্দ, দুঃখ-সবকিছুর সাথে সব রকম সংযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। নাটসুমি, আমি জানি তুমি কিসের ভেতর দিয়ে গেছ, যখন তুমি এখানে এসেছিলে।”
দু-হাতে আমার মাথা চেপে ধরলাম আমি। ফ্ল্যাশলাইটটা মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। বাবা-মায়ের কথা মনে হলো আমার। ইটসুকি, আমার বন্ধুরা, আকাগি।
“এখানে আসা নিশ্চয়ই তোমার জন্য কঠিন ছিল কিন্তু তুমি মন শক্ত করেই এখানে এসেছ। তুমি জানো তুমি না ফিরলে তোমার বাবা-মা কত কষ্ট পাবেন, তারপরেও তুমি এসেছ। সব সম্পর্ক ধ্বংস করে, নিরবে সবাইকে বিদায় জানিয়ে, এখানে এসেছ একজন মৃত ব্যক্তির কণ্ঠ শুনতে।”