একটা ফ্ল্যাশলাইট নিলাম সাথে। তারপর চুপ করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম যাতে বাবা-মা টের না পায়। তারা ডাক দিলে আমি আর বের হতে পারব না। কেউ ডাকল না।
পরিত্যক্ত হাসপাতালটায় যেতে সাইকেলে বিশ মিনিটের মত লাগবে। ছোট একটা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে গেলাম, কোন স্ট্রিট ল্যাম্প ছিল না। চারপাশে অন্ধকার। শুধু আমার লাল সাইকেলের আলো অন্ধকার ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে।
আপু আর আমি দু-জনেই সাইকেলটা ভাগাভাগি করে চালাতাম। আমাদের মধ্যেই কেউ একজন পড়ে গিয়ে বাস্কেটটা বাঁকিয়ে ফেলেছিল। আমার যেহেতু মনে নেই, সুতরাং দোষটা সম্ভবত আপুরই ছিল। লাল সাইকেলটা দেখে আমার লিটল রেড রাইডিং হুডের কথা মনে হতো। মনে হত আমি সেই ছোট মেয়েটা, নানির বাড়িতে যাচ্ছি যেখানে একটা নেকড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আকাশটা বরং আশেপাশের সবকিছুর চেয়ে কম অন্ধকার ছিল। মাটি আর আকাশের মধ্যের পার্থক্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। পাকা রাস্তাটা সোজা পর্বতমালার দিকে চলে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরেই নুড়ি বিছানো পথটা শুরু হলো। সেখানে সাইকেল থেকে নেমে হাঁটতে লাগলাম। যতক্ষণ না বেড়া দেয়া জায়গাটা চোখে পড়ল। বাইরে সাইনবোর্ড লাগানো “বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।”
বেড়া পেরিয়ে অনেকটা ভেতরে হাসপাতালটা। ফ্ল্যাশলাইটের আলো এতদুর যাচ্ছিল না।
লাইট নিভিয়ে দিতেই অন্ধকার এসে সবকিছু গ্রাস করল। আশেপাশে কোন বাড়ি কিংবা দোকান নেই। দুরেও কোন আলো দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে খালি শুকনো ঘাস। বাতাস না থাকায় ঘাস দুলছে না, কোন শব্দও হচ্ছে না। অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধতা।
বেড়ার সাথে সাইকেলটা রেখে শুধু ফ্ল্যাশ-লাইটটা নিয়ে সামনে এগুলাম। পায়ের নিচে নুড়ির চমচ শব্দ হচ্ছিল। নিঃশ্বাস বেরিয়ে ঠাণ্ডায় সাদা ধোঁয়া তৈরি করে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। বেড়ার সাথেই রাস্তামুখি একটা দরজা আছে, ধাক্কা দিতে সহজেই খুলে গেল ওটা। ভেতরে পা ফেললাম আমি।
যে রাতে আপু খুন হলো, কিভাবে সে এখানে এসেছিল? আমার মত হেঁটে হেঁটে গেট দিয়ে ঢুকেছিল? হয়তো ছেলেটা ছুরি ঠেকিয়ে জোর করে ওকে এখানে এনেছিল। নাকি ও অজ্ঞান ছিল তখন? ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল? হাসপাতালে ঢাকার রাস্তাটা ওর জন্য একমুখী পথ ছিল, ওর চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার পথ।
এই জায়গাটা কি একসময় পার্কিং লট ছিল? যথেষ্ট বড় একটা জায়গা। ফ্ল্যাশলাইটের লম্বা আলো শুকনো মাটি আর নুড়ি বেছানো পথের উপর পড়ছে। দূরে সাদা একটা বিশাল কংক্রিটের বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। দোতলা। রাতের আকাশে মাথা উঁচু করে রেখেছে। বিল্ডিংটা একসময় একটা হাসপাতাল থাকলেও এখন শুধু কাঠামোটাই পড়ে আছে। ডাইনোসরের ফসিলের মত। শুধু হাড়গুলো।
প্রবেশ পথ দিয়ে ভেতরে গেলাম। আগে এখানে হয়তো কাঁচের দরজা ছিল। এখন চারকোনা হা করা একটা মুখ। লবিতে আলো ফেললাম। বেঞ্চগুলোকে আর চেনা যায় না। এখানে সেখানে কংক্রিটের টুকরো পড়ে আছে। গোলাকার আলো দেয়ালের উপর পড়লে সেখানে স্প্রে পেইন্ট দিয়ে আঁকা গ্রাফিতি দেখা গেল।
আমি ছোট ছোট নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। দম হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সিলিংটা নেমে এসে চাপা দেবে আমাকে। লাইট লাগানোর অংশগুলো দেখা যাচ্ছে। নিচে ভাঙা ফ্লুরোসেন্ট লাইট পড়ে আছে। খেয়াল না করে একটার উপর পাড়া দিয়ে ফেলেছিলাম। কাঁচের গুড়ো কুড়মুড় শব্দ করে উঠল।
হলওয়েটা অন্ধকারে দিয়ে মিলিয়ে গিয়েছে। আপুকে যেখানে পাওয়া গিয়েছিল সেদিকে যাচ্ছি। রুমটা ঠিক কোথায় তা জানি না কিন্তু একটা সাধারণ ধারণা আছে আমার। নিচালার পেছন দিকে কোথাও হবে।
রুমটা একসময় অপারেটিং চেম্বার ছিল। সাইন দেয়া ছিল কোনদিকে যেতে হবে। আমার পায়ের শব্দ দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে। বাতাসে কম্পন সৃষ্টি করছে শীতের ঠাণ্ডা।
হলের শেষ মাথায় গিয়ে রুমটা খুঁজে পেলাম এক সময়। দরজা বলে কিছু নেই। চারকোনা একটা গর্ত দাঁড়িয়ে আছে দরজার জায়গায়। ভেতরে
আরেকটা খালি দরজার মত গর্ত। তারপর একটা খোলা জায়গা।
রুমের মধ্যে আলো বোলালাম। জায়গাটা এত ঠাণ্ডা আর নিঃসঙ্গ যে বুকে কাঁপুনি ওঠে। এত নিরব যে একটা পাথর গড়ালেও প্রতিধ্বনি শোনা যাবে। আমার মনে হচ্ছে যেন কোন নিঃসঙ্গ আত্মার নিচু গলায় কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
হাত দেওয়ার জন্য লম্বা সরু কিছু সিঙ্ক ছিল রুমের এক কোনায়। আরো কিছু ছোট দরজা ছিল পাশের ছোট রুমগুলোতে যাওয়ার জন্য। সেগুলোর পর অপারেটিং চেম্বার। ছোট রুম। সব মিলিয়ে তিনটা। প্রত্যেকটায় ঢুকে দেখলাম।
কেউ নেই সেখানে। ছোট রুমগুলো পনের ফিটের মত চওড়া। প্রথম দুটো একদম ফাঁকা। কিন্তু তৃতীয়টায়, সবচেয়ে দূরেরটায়, দরজা খুলে ঢুকতেই জমে গেলাম। অশুভ কিছু একটা সেখানে অনুভব করছি আমি।
এই রুমটা অন্যগুলোর চেয়ে অন্ধকার। অনেক বেশি অন্ধকার। দেয়াল আর সিলিং কালো রঙের। যেন আগুনে পুড়ে গিয়েছে।
রুমে ঢুকে নিশ্চিত হলাম কেউ সেখানে নেই। দরজাটায় সুইং লাগানো আছে, ছেড়ে দিলে নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যায়। দেয়ালের সাথে এক সারি সিলিন্ডার রাখা, ওগুলো শিকল দিয়ে বাধা যাতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রুমের মাঝখানে একটা জং পড়া ধাতব বিছানা-একটা অপারেটিং টেবিল।