বাবা ছিল লিভিং রুমে। কোটাটসুর নিচে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। আমরা যখন ছোট ছিলাম, আমি আর আপু বাবার হাত ধরে ঝুলতাম। কত বছর আগের ঘটনা সেটা?
“বাবা, আমি বাসায় ফিরেছি,” হাঁটু গেড়ে তার পাশে বসলাম। তিনি কোন উত্তর দিলেন না। ভাবলাম ঘুমাচ্ছেন, উঠে দাঁড়ালাম চলে যাওয়ার জন্য।
“নাটসুমি,” তিনি বললেন। “আমি দুঃখিত…আমরা তোমার দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছি।”
“কি বলছ এসব?” একই কথা আজকে বন্ধুদেরও বলেছি।
“লোকজন সবসময় বলে তুমি দেখতে হিরোকোর মত। কিন্তু আমি কখনো বুঝতে পারিনি সেটা কতখানি। হিরোকো যখন বেঁচে ছিল তখন কখনো খেয়াল করিনি, কিন্তু এখন…এখন মনে হয় তারা ঠিকই বলত।”
বাবা মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকালেন। মাঝে মাঝে নাকি তিনি আপুর সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলেন। উনার চোখগুলো অর্ধেকটা মায়া আর অর্ধেকটা শোকে ডুবে ছিল।
“কিন্তু, নাটসুমি…তুমি কি মাত্র স্কুল থেকে এলে?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম। বাবাকে অবাক দেখাল।
“আমার মনে হল কারো উপর তলায় যাওয়ার শব্দ শুনলাম…”
“মা হয়তো?”
“সে তো আমার সাথে এখানে ছিল।”
ডোরবেল না বাজিয়ে পায়ের শব্দ পাওয়ায় তারা ধরে নিয়েছিলেন আমি এসেছি।
আমি উপরে গেলাম। টেপগুলো নেই।
ছেলেটা মনে হয় এসেছিল ওগুলো নিতে। কাজটা ওর জন্য একদমই কঠিন হয়নি।
আমি যদি সে রাতে বাসায় না ফিরি, পুলিশ টেপগুলো আমার রুমে পেলে ওকে ধরে ফেলত। ছেলেটা সেরকম কিছু ঘটার সুযোগ রাখেনি।
এর অর্থ হল সে আমাকে ছেড়ে দেয়ার কোন পরিকল্পনা রাখছে না।
আমার মনে হলো শরীর থেকে সমস্ত শক্তি গলে বেরিয়ে যাচ্ছে। ধুপ করে চেয়ারের উপর বসে পড়লাম।
গত দুই দিন ভেবেছি আমাকে খুন করা হতে পারে। এখন আমি নিশ্চিত।
আমি যদি টেপে বলা কথাগুলো অনুযায়ি হাসপাতালে যাই, আমাকে খুন করা হবে।
মৃত্যু কি? ছেলেটা বলেছিল মৃত্যুই একমাত্র সত্যি ব্যাপার। ও মানুষের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা পেতে চায়, যেভাবে ভ্যাম্পায়ার রক্তের স্বাদ গ্রহণ করে।
জানি না কতক্ষন চেয়ারে অনড় হয়ে বসে ছিলাম। নিরবতা আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছিল। আমি কল্পনা করছিলাম ছেলেটা আপুকে কিভাবে খুন করছে। একসময় আপুর জায়গায় আমার চেহারা চলে এল। কিন্তু যতটা ভেবেছিলাম ততটা ধাক্কা খেলাম না।
জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য দেখেছি আমি আগে। আমি ছিলাম জীবিত। আমার বোন, বাবা-মা, সবাই জীবিত ছিল। ব্যাপারটা স্পষ্ট ছিল। এখন সেই পার্থক্যটা ঘোলাটে হয়ে এসেছে। যেন সাদা আর কালো মিশে গিয়ে ধূসর একটা রঙ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আপুর লাশ দেখার পর থেকে বাবা-মা একইরকম হয়ে গিয়েছে, এক পা মৃতদের এলাকায়, জমে আছে।
কিন্তু আমার বোন…আপু নিশ্চিতভাবে মৃত। আমার কাছে তার কণ্ঠ তখনো জীবিত। ঐ টেপগুলোর মধ্যে সে বেঁচে আছে, এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে, এখনো চিন্তা করছে, এখনো কথা বলার চেষ্টা করছে…এখনো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমি আর জানি না জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে কী। কিন্তু এটুকু জানি, আমি তার উপর দাঁড়িয়ে আছি।
“নাটসুমি,” মা নিচ থেকে ডাকল। “ডিনার তৈরি!”
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলতে চাইলাম, “আসছি!” যদি না যাই তাহলে শুধু তারা রয়ে যাবে।
আপুর মৃত্যুর পর আমরা সবাই কেমন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছি। কিন্তু তারপরেও আমরা চেষ্টা করি একসাথে খাওয়া দাওয়া করার। অতিরিক্ত একটা চেয়ার রাখা থাকে যদিও। কিন্তু ডিনার হলো একমাত্র জিনিস যেটা কিনা এখনো আমাদেরকে পরিবার হিসেবে একসাথে আটকে রেখেছে।
আজকে, অবশ্য আমি উঠতে গিয়ে থেমে গেলাম।
“নাটসুমি?” মা আবার ডাকল। উত্তর দেইনি দেখে অবাক। আপার মনে পড়ল বাবা কিভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমার মনে হচ্ছিল যদি তাদের সাথে খেতে যাই তাহলে আর হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব হবে না। আমি যদি ফিরে না আসি তাহলে তারা কিভাবে বেঁচে থাকবে? ভালোবাসা, কিংবা বলা উচিত করুণা-আমাকে এখানে আটকে রাখবে।
“ডিনার তৈরি!” মা আবার ডাকল।
ডেস্কের উপরে সিলিন্ডারটায় চোখ পড়ল। চোখ সরাতে পারছিলাম না।
জিনিসটা একটা রক্তলাল লিপস্টিক, আপুর রুম থেকে এনেছিলাম।
চোখ বন্ধ করে মনস্থির করলাম। চেয়ারে বসা অবস্থায় বললাম “আমার খিদে নেই।”
দরজা লাগানো ছিল। মায়ের চেহারা দেখতে পাইনি, কিন্তু উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম। সিঁড়ির নিচ থেকে দাঁড়িয়ে আমার দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন।
অপরাধবোধ এসে আমার হৃদয়ে বিদ্ধ করল। বুক ব্যথা করতে লাগল। মা যখন দেখল তার মেয়ে নিচে আসছে না, তার কাঁধ ঝুলে পড়ল, নিরবে সিঁড়ির কাছ থেকে সরে গেলেন। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম যেন দৃশ্যটা।
চেয়ারে বসে আমি তাদের কাছে বার বার ক্ষমা চাইতে লাগলাম। কিন্তু তারপরেও সিদ্ধান্ত বদলালাম না। আমি একজন জঘন্য সন্তান। আমাকে হাসপাতালটায় যেতেই হবে, তাদেরকে এখানে একা ফেলে।
৪
সে রাতে পরে আমি কোট পড়ে তৈরি হলাম। খেলনা খরগোেশটা হাতে নিলাম। যখন ছোট ছিলাম তখন খরগোশটাকে অনেক ভালবাসতাম। নরম তুলতুলে ভাবটা ভালো লাগত, আদর করে চুল আঁচড়ে দিতাম। আমার একদম ছোটবেলা থেকে খরগোশটা আমার রুমে ছিল। এখন এটাকে বিদায় জানানোর পালা। আপুর লিপস্টিকটা কোটের পকেটে নিলাম। সাথে নিয়ে যাচ্ছি যাতে আমার মন বদল না হয়।