যখন এটা বুঝতে পারলাম যে…কান্নাকাটি আর চিৎকার করা অর্থহীন…তখন…তখন আমার অনুশোচনা হচ্ছিল..
আমি ক্ষমা চাই…সেজন্য তোমাকে এই মেসেজ দিয়ে যাচ্ছি। উপলদ্ধি করার জন্য আমার এরকম অবস্থায় পড়তে হলো ভেবে নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে …
আমি অনেকবার অনেক কিছু বলেছি তোমাকে আঘাত করার জন্য, কিংবা হতভম্ব করার জন্য…তোমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাত সেজন্য…
আমি দুঃখিত…তোমার কোন দোষ ছিল না। আমি স্রেফ নিজের উপর রেগে ছিলাম…কারনটা জানলে তুমিও আমাকে ঘৃণা করবে…
কিন্তু কথাটা যদি না বলেই মারা যাই তাহলে সত্যিটা তুমি আর কখনই জানতে পারবে না…কথাটা আমাকে বলতেই হবে।’
টেপটা নিরব হয়ে গেল।
আর তারপর…আপুর কণ্ঠ না, ছেলেটার পরিচিত কণ্ঠ শোনা গেল..
কিটাযাওয়া নাটসুমি। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ। রাত এগারোটায়। একা ঐ পরিত্যাক্ত হাসপাতালটায় আসবে। যেখানে হিরোকো মারা গিয়েছিল। জায়গাটা তো চেনো, নাকি? যে রুমে ওর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল সে রুমে আসবে। সেখানে আমি তোমাকে শেষ টেপটা দেব।
ওর কথাগুলোর পরে টেপটায় আর কিছু ছিল না।
***
টেপটা যেদিন শুনলাম, তার দুইদিন পর ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ছিল। এর মধ্যে আমি পুলিশের কাছে যাইনি। তার বদলে প্রতিদিন যা যা করি তাই করলাম–স্কুলে গেলাম, পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করলাম।
ক্লাসের পর হলে এক বন্ধু আমাকে থামাল।
“নাটসুমি, আগামি রবিবার চল কোথাও ঘুরতে যাই।”
আপুর মৃত্যুর পর আমি একবারও হাসিনি দেখে ও সম্ভবত দুশ্চিন্তা করছিল। মাঝে মাঝেই সে আমার মন ভালো করার চেষ্টা করে।
“ঠিক আছে…কিন্তু শেষে যদি যেতে না পারি তাহলে সেজন্য সরি।”
“তোমার আর কোন প্ল্যান আছে নাকি?” সে জানতে চাইল।
কোন প্ল্যান ছিল না। কিন্তু সে রাতে জীবিত বাসায় ফিরে আসতে পারার সম্ভাবনাও কম। আমি ঠিক করেছি ছেলেটার বলা কথামতই কাজ করব। মেসেজটা শোনার পরপরই আমি সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলি।
যদি ঐ পরিত্যাক্ত হাসপাতালটায় যাই, তাহলে আপুর মেসেজের বাকি অংশটা শুনতে পারব। এর বিনিময়ে হয়তো আমার জীবনটা যাবে। জানি না সে কেন আমাকে খুন করতে চায়, কিন্তু খুন না করে ছেড়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই বললেই চলে।
“না কোন প্ল্যান নেই কিন্তু..” আমি বললাম, হঠাৎ ইচ্ছা হচ্ছিল ওকে জড়িয়ে ধরি। ওর জীবনটা কি রকম হবে? কিছুদিন আগেও তো আমরা স্রেফ সাধারণ মানুষ ছিলাম। হাই তুলতে তুলতে সকালে স্কুলে আসতাম। সারাদিন ব্ল্যাকবোর্ড থেকে লেখা নোটবুকে কপি করতাম। প্রতিদিন একই জিনিস ঘটত। দিনগুলো ছিল সাধারণ, কিন্তু জীবন ছিল আনন্দের।
কিন্তু এখন আমার সামনে যে জীবন রয়েছে সেটা আমি আর বিশ্বাস করতে পারি না। সুখি জীবন পেতে গিয়ে মৃত্যু নিয়ে অনেকটা সময় ব্যয় করা হয়ে গিয়েছে। আমার বন্ধুর জীবনে এখনো ভবিষ্যৎ আছে। আর যখন আমি চিন্তা করি যে ওকে আর দেখতে পাব না…খুব পছন্দ করি ওকে।
“কাল দেখা হবে,” হাত নাড়তে নাড়তে বললাম।
স্কুল থেকে বের হতেই ডিসেম্বরের ঠান্ডা বাতাস এসে মুখে ঝাপ্টা মারল।
সূর্য পুরোপুরি ডুবে না গেলেও আকাশ মেঘলা ছিল, যে কারনে ভালোই অন্ধকার। গায়ের কোট ভালো টেনে চেকে হাঁটা শুরু করলাম।
স্কুল গেটের কাছে আসতে ফোন বাজল। ইটসুকি।
“এখন? স্কুল মাত্র শেষ হলো। গেট দিয়ে বের হচ্ছি এখন।”
গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ওর সাথে কথা বলছিলাম। শো শো করে গাড়ি যাচ্ছিল। ট্রাফিক আর বাতাসের শব্দে কথা বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল।
“কী বললে? শুনতে পাচ্ছি না,” আমি জোরে বললাম। “ও আচ্ছা, ধন্যবাদ…না আমি ঠিক আছি…”
এটাই হয়তো ওর সাথে আমার হওয়া শেষ কথা। চিন্তাটা মাথায় আসতেই আমার কান্না পেল। ইটসুকিকে সেই জুনিয়র হাই থেকে চিনি। সে আমার কাছে ছোট ভাইয়ের মত।
“আরেকটু জোরে বলতে পারবে?” আমি চোখ বন্ধ করলাম, যেন তাহলে ওর কথাগুলো ভালভাবে শোনা যাবে। আমি বলছি যে আমি ঠিক আছে…দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। কি? না, আমি কাঁদছি না…” এক মুহূর্ত পর আমাদের কথাবার্তা থেমে গেল।
হাত ঘড়িতে সময় দেখলাম ট্রেনের জন্য। পাঁচটার বেশি বাজে। স্টেশনের দিকের রাস্তায় সূর্য ডুবতে শুরু করে দিয়েছে। বাইরে অন্ধকার। ছেলেটার সাথে দেখা করার আগে আমার হাতে আর ছয় ঘন্টা সময় আছে।
জানি না কেন, কিন্তু আমি ভয়ে কাঁপছিলাম না। আমার মন শান্ত ছিল। চোখ বন্ধ করে বসে ট্রেনের চলাচল অনুভব করলাম। আসন্ন বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করে আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন থেমে গিয়েছিল। রেস্টুরেন্টে আপুর দাঁতগুলো দেখার পর সব চেতনা যেন বিনাশ হয়ে গিয়েছে। কোন কিছু আর সত্যি মনে হচ্ছে না, সবকিছু কেমন অবাস্তব লাগছে। “ ছেলেটার সাথে হাতাহাতি করার কথা আমি কখনো চিন্তাও করিনি। কোন অস্ত্রপাতি ছাড়াই, কাউকে জানানো ছাড়াই আমি হাসপাতালে যাব। আমার আগ্রহ শুধু আমার বোনের কণ্ঠস্বর শোনা নিয়ে। আর কোন কিছুর আমার প্রয়োজন নেই। ছেলেটা যদি আমার কোন ক্ষতি করে, করুক।
আমার বাবা-মা আবারো ঘর লক করতে ভুলে গিয়েছিল। আমি ভেতরে ঢুকে জানালাম যে বাসায় ফিরেছি।
মা তাতামি রুমে ছিল, জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখছিল। আমি যখন কথা বললাম তার সাথে তখন দূর্বলভাবে হাসল। দেখে মনে হচ্ছিল হালকা ধাক্কা দিলেই ডিগবাজি খেয়ে পড়বে।