অদ্ভুত ব্যাপার যে আমি ভয় পেলাম না, সেফ দুঃখ বোধ করছি। কেউ আমাকে বলেনি যে ওর দাঁতগুলো পাওয়া যায়নি।
ব্লকটা তুলে আবার ব্যাগে ভরে একটা খাম বের করল সে।
“ওগুলোর কথা বাদ দাও, এই নাও দ্বিতীয় টেপট।” খামটা খুলে উপুড় করল, একটা ক্যাসেট বের হয়ে টেবিলের উপর পড়ল।
“কণ্ঠ ২: কিটাযাওয়া হিরোকো, ক্যাসেটের লেবেলে লেখা।
“আর একটা টেপ আছে।”
“আমাকে শুনতে দাও।”
“দ্বিতীয়টা শেষ কর আগে, তারপর দেখা যাবে।”
সে চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ আমি উঠার শক্তি পেলাম না। টেপটা টেবিলের উপর রেখে আমি রেজিনে রাখা আপুর দাঁতগুলোর কথা ভাবছিলাম।
কফিতে চুমুক দিয়ে দেখি ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। পাশের টেবিলের মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে কেচাপ লেগে আছে। সুন্দর চোখগুলো দিয়ে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কাঁপতে থাকা হাতের কারনে কফির কাপে যে শব্দ হচ্ছিল তা নিশ্চয়ই ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
রেস্টুরেন্ট থেকে ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময় আমি গুটিসুটি মেরে সিটের উপর শুয়ে পড়লাম। আমাকে নিশ্চয়ই দেখতে ভয়াবহ লাগছিল, একজন মধ্যবয়স্ক নোক বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল তুচ্ছ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। আমার ভয় হচ্ছিল অন্য যাত্রিরা কিংবা কন্ডাক্টর হয়তো আমার পকেটে রাখা টেপটার কথা টের পেয়ে যাবে, ছেলেটার সাথে আমার কথোপকথন জেনে যাবে, আমাকে এসব নিয়ে প্রশ্ন করবে।
ট্রেন থেকে নামার পর আমি অন্ধকার আবাসিক এলাকার রাস্তায় দৌড়াতে লাগলাম। বাসায় পৌঁছে দেখি ভেতরে বাতি জ্বলছে। এখন তো আমার বাবা-মা বলতেও পারবেন না কখন সূর্য ডোবে আর কখন আলো জ্বালাতে হবে।
মাত্র দরজাটা খুলতে যাব এমন সময় সেটা ভেতর থেকে খুলে গেল আর কেউ একজন বেরিয়ে এল। আকাগি। সে আমাকে দরজার বাইরে দেখে চমকে লাফিয়ে উঠল।
“ওহ! নাটসুমি, দূর্বল একটা হাসি দিল আকাগি।
“তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগল।”
“বাসায় যাচ্ছি এখন, দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তাই..”
মাঝেমাঝে ক্লাসের পর বাসার সামনে এলে আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে গল্প করি। আকাগি বেশ লম্বা একটা ছেলে। এই দূরত্ব থেকে ওর মুখের দিকে তাকালে ঘাড় কাত করে উপরে তাকাতে হবে।– ও প্রচুর বই পড়ে। বইয়ের ভারে ওর বাসার দ্বিতীয়তলা যেকোন সময় ভেঙে পড়ার মত অবস্থায় আছে। আমরা সবসময় বই নিয়ে আলাপ করতাম। কিন্তু আজকে আমার মুড নেই, তাই একজন আরেকজনকে শুভেচ্ছা জানালাম খালি। ওকে ধন্যবাদ দিলাম আপুর কথা মনে রাখার জন্য।
আমরা যখন কথা বলছিলাম তখনো আমার মাথায় খালি টেপটা ঘুরছিল। আমার উচিত ওকে আপুর কথাগুলো শোনানো, কিন্তু কিছু বললাম না।
“তাহলে, নাটসুমি, পরে দেখা হবে…বাই।”
আকাগি হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে গেল। আমি চুপচাপ ওর চলে যাওয়া দেখলাম, নিজের পরিবর্তন দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি।
আগে যখন আমরা কথা বলতাম তখন এক মুহূর্ত শান্ত হয়ে থাকতে পারতাম না। বুক ধুকপুক করত, বিশ্রাম দিত না। প্রতিবার সে যখন আপুর দিকে তাকাত আমার মন বিমর্ষ হয়ে যেত।
ওর অনেক কিছুই আমি পছন্দ করতাম, কিন্তু আমার হৃদয় এখন নিস্তব্ধ, শীতল কোন পাথরের টুকরোর মত।
ঘাড় ডলতে ডলতে আমি উপলদ্ধি করলাম আকাগিকে এমনকি বিদায়ও জানাইনি। অথচ আগে নিজে থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে হাত নেড়ে আবার দেখা হবে!” বলতাম।
আমাদের মধ্যেকার সংযোগ ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছিল। আপুর মৃত্যুর পর ও আবার একজন অপরিচিত মানুষে পরিণত হচ্ছে। আপু না থাকলে ওর সাথে আমার কখনো হয়তো পরিচয় হত না, সেজন্য ব্যাপারটা হয়তো স্বাভাবিক।
আকাগি হয়তো চাইছেনা সম্পর্কটা হারিয়ে যাক। সেটা চাইলে সে কখনো এখানে আর আসত না।
ভেতরে গেলাম। লিভিং রুম ঠান্ডায় জমে আছে মনে হলো। বাবা-মা কোটাটসু (ভারি কম্বল, ভেতরে কাঠের টেবিল থাকে) এর ভেতর ঢুকে আছে। আমি ওদের বললাম আকাগির সাথে দরজায় দেখা হয়েছে। তারা কোন উত্তর দিল না। আমি টের পেলাম আমার মুড আরো খারাপ হচ্ছে।
উপরে গিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লক করলাম। পকেট থেকে টেপটা বের করে স্টেরিওতে ঢুকিয়ে আগের টেপটা বের করে তেবিলে রাখলাম। তারপর প্লে বাটনে চাপ দিলাম আমি।
টেপ ঘোরার শব্দ কানে এল। চেয়ারে বসে স্টেরিওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
টের পেলাম, পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছে, যখন আমরা দুজনেই এলিমেন্টারি স্কুলে পড়তাম। আমরা নিজেদের কণ্ঠ রেকর্ড করতাম। টেপে নিজের কণ্ঠ কিরকম অদ্ভুত শোনায় সেটা আবিস্কার করে অবাক হতাম। তারপর বাবা-মা এলে সবাই একসাথে গান গেয়ে রেকর্ড করতাম। ছেলেমানুষি সব গান কিন্তু আমাদের খুব মজা লাগত। বাইরে ড্রাইভিংয়ে গেলে বাবা ঐ টেপটা চালাত। আপু জুনিয়র হাইতে ওঠার পর বাবা টেপটা চালালে ও না না করে চিৎকার করত। মা ওর কান্ড দেখে সব সময় জোরে জোরে হাসত।
কী সুন্দর দিন ছিল তখন…
নাটসুমি…
‘বাবা-মাকে বোল, আর আকাগিকেও…সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ। এত সব ঝামেলা করার জন্য আমি দুঃখিত…নাকি তারা তোমার সাথে বসে এই টেপ শুনছে? আমার পক্ষে সেটা জানা সম্ভব না আর…
ও…ও এর পর আমাকে খুন করবে, প্রথমে ভেবেছিলাম ও মজা করছে..
নাটসুমি…আমি একা অন্ধকারে পড়েছিলাম এতক্ষন, চোখ-মুখ বাধা ছিল,..এক মিনিট আগেও..