“নাটসুমি, তোমার কি মনে হয় আজ থেকে দশ বছর পরে ঐ মেয়েটা কাউকে খুন করতে পারবে?”
আমার বুকটা মনে হলো জমে গেল। বাধা দিয়ে কিছু একটা বলতে ছেলেটার দিকে ফিরলাম কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। সে তার মত বলে চলল।
“মেয়েটা হয়তো ওর বাবা-মাকে খুন করবে। কিংবা ওর বোনকে। অসম্ভব কিছুই নয়। সে হয়তো এখনই এই নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে। হয়তো সে শুধু ছেলেমানুষির অভিনয় করছে। হয়তো সে আসলে চাইছে হ্যামবার্গারের প্লেটে রাখা ছুরিটা তুলে নিয়ে ওর মায়ের গলায় পোচ দিতে।”
“প্লিজ…আর না, থামো। তুমি একজন অসুস্থ মানুষ।” আমি মাথা নিচু করলাম। হাত দিয়ে শক্ত করে কান চেপে আছি। ওর বলা কথাগুলোর সাথে যুদ্ধ করছিলাম। ওর প্রত্যেকটা শব্দ আমাকে আঘাত করছে, নিদারুন কষ্ট সৃষ্টি করছে। মনে হচ্ছে আমার গালে কষে চড় বসাচ্ছে।
“নাটসুমি, আমার দিকে তাকাও…আমি মজা করছি। বাচ্চাটা খুব সম্ভব কাউকে কখনো খুন করবে না। এতক্ষন আমি যা বললাম, তা স্রেফ আমার নিজের বর্ণনা।”
আমি চোখ তুলে ওর দিকে তাকালাম। ওকে ঘোলা দেখাচ্ছিল-আমার চোখ ভর্তি পানির জন্য।
“জন্ম থেকেই আমি এমন। আমি যখন ঐ মেয়েটার মত ছোট ছিলাম তখন ব্যাপারটা বুঝতাম না, কিন্তু এলিমেন্টারি স্কুলে উঠার পর বুঝতে পারলাম আমি অন্যদের থেকে আলাদা।”
“কি…কি বলছ ত-তুমি?” আমি তোতলাচ্ছিলাম।
ওকে একটুও বিরক্ত দেখাল না, ব্যাখ্যা করে শোনাল। “বলছি যে আমার নিয়তিতে লেখা ছিল একদিন খুন করতে হবে। আমার অন্তত তাই মনে হয় আর কি। যেমন ধর একজন ভ্যাম্পায়ারের সামনে মানুষের রক্ত পান করা ছাড়া কোন উপায় খোলা নেই। আমারও খুন করা ছাড়া কোন উপায় নেই। জনের সাথে সাথেই আমার নিয়তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমার বাবা-মা আমার উপর কোন অত্যাচার করেননি কিংবা কোন মানসিক নির্যাতনও করেননি। আমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কোন খুনিও নেই। আমি একদম সাধারণ একটা পরিবারে বড় হয়েছি। কিন্তু যেখানে অন্য সাধারণ ছেলেমেয়েরা তাদের কল্পিত বন্ধু আর প্রাণীর সাথে খেলাধুলা করে সেখানে আমি সময় কাটাতাম কল্পিত মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে থেকে।”
“তুমি আসলে কি?!” আমি ওকে আর একজন মানুষ হিসেবে দেখতে পারছিলাম না। ও আরো ভয়ঙ্কর কিছু, অনেক অনেক ভয়ঙ্কর।
এক মুহূর্তের জন্য ও চুপ ছিল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “আমি জানি না। আমি অনেকবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি কেন আমার কাউকে খুন করতে হবে, কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পাইনি। আর আমাকে এটা গোপনও রাখতে হয়েছে, অভিনয় করতে হয়েছে যে আমি একদম সাধারণ গোছের কেউ। খুব সাবধানে ছিলাম যাতে কেউ আমার ভেতরের সত্যি রূপটা দেখতে না পায়।
“তোমার পরিবারও টের পায়নি?”
সে মাথা নাড়ল। “আমার পরিবার আমাকে জানে একজন সাধারণ, নরমাল ছেলে হিসেবে। আমি খুবই সাবধানতার সাথে নিজের এই অবস্থান সৃষ্টি করেছি।”
“ত্-তোমার পুরো জীবন…তাহলে একদম মূ-মিথ্যে?”
“কিংবা বলা যায় আমার কাছে বাকি সবকিছু মিথ্যে।” ওর কথার অর্থ বুঝিনি।
সে আরো ব্যাখ্যা করল, “আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, আমার পরিবারের সাথে যেসব কথা হয় কিংবা অন্য লোকদের যে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ দেখি তার সব সত্যি। আমার ধারণা ছিল কোথাও কোন স্ক্রিপ্ট থাকে, যেটা দেখে সবাই কথা বলে-এমনকি আমি যখন ছোট ছিলাম তখন একবার পুরো বাড়ি এরকম স্ক্রিপ্টের জন্য খুঁজে দেখেছিলাম। আমি অন্যদের মত একই কথাগুলো পড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও কোন স্ক্রিপ্ট ছিল না। একমাত্র যেটা আমার কাছে সত্যি মনে হয়েছিল তা হলো মৃত্যু।”
“সে কারনে আমি মানুষের মৃত্যু দেখতে চাই।” আমি ওর মুখ থেকে কথাগুলো বের হতে দেখলাম।
“সেজন্য আমার বোনকে..?”
“সেই রাতে, আমি বাইরে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। তোমার বোনকে একটা ভেন্ডিং মেশিনের সামনে বসে থাকতে দেখি। কাঁদছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম সে ঠিক আছে কিনা। ও একটু হেসে ধন্যবাদ জানাল।
ওর শ্বদন্তগুলো ঝকমক করে উঠেছিল।”
ছেলেটা জানাল ও খুনটা করেছিল কারন শ্বদন্তগুলো ওর ভালো লেগেছিল। ওর মতে ব্যাপারটা ছিল একটু অন্যরকম ভালবাসার মত।
ওর কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হলো আমাকে রেস্টুরেন্টের বুথের ভেতর বেঁধে রাখা হয়েছে। টেবিলের উপর রাখা ওর হাতগুলোর দিকে তাকালাম আমি-সাদা হাতগুলো কালো ইউনিফরমের স্লিভগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছে, আঙুলগুলো সরু ধরনের। কিন্তু সাত সপ্তাহ আগে ঐ একই হাতগুলো আমার বোনকে খুন করেছিল।
“কারন তোমার ওর শ্বদন্তগুলো ভালো লেগেছিল?”
ছেলেটা মাথা ঝাঁকাল। তারপর ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করল।
“আমি ওগুলো রেজিনে ঢুকিয়ে রেখেছি, ভাবলাম তুমি হয়তো দেখতে চাইবে।”
সে বস্তুটা টেবিলের উপর রাখল। একটা স্বচ্ছ চারকোনা ব্লক। ভেতরে বিশটা ছোট ছোট সাদা জিনিস সারি করে রাখা। দুটো বাঁকানো সারি, একটা আরেকটার উপর রাখা।
“ওগুলো পুরো রুমে ছড়িয়ে ছিল, সবগুলো খুঁজে বের করতে বেশ সময় লেগেছে।”
রেজিনে রাখা দাঁতগুলো দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো শূন্যে ঝুলে আছে। অদৃশ্য কোন মানুষের দাঁত, প্রত্যেকটা তার ঠিক জায়গায় অবস্থান করছে।
আমি শ্বাদস্তগুলো দেখতে পেলাম।
বাচ্চাদের হাসির শব্দ আমার কানে এল। চকমকে আল্পনাগুলো রেস্টুরেন্টের আলোয় ঝলমল করে উঠল।