এক মুহূর্তের জন্য ও চুপ করে থাকল। তারপর ওর ঠোঁট আস্তে করা খুলে গেল আর শব্দগুলো বেরিয়ে এল : “হ্যাঁ, আমি ওকে খুন করেছি।”
ওর মৃদু কণ্ঠে বলা কথাগুলো মিলিয়ে গেল আমার কানে, রেস্টুরেন্টের ভেতরের হাউকাউয়ে মিলিয়ে গেল সেটা।
৩
আমার সামনে বসল ছেলেটা, যেখানে এতক্ষন ইটসকি বসে ছিল। আমি নড়তে পারছিলামনা, মনে হচ্ছিল সারা শরীর অসাড় হয়ে গিয়েছে। আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অবশ্য যদি নড়াচড়া করতেও পারতাম তাহলেও ছেলেটাকে বসতে বাধা দিতাম না। কিংবা উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতাম না।
“আমি ওকে খুন করেছি।” ছেলেটার কথাগুলো আমার মনে প্রতিধ্বনি তুলছে। আমি জানতাম এই সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আমার মন আমার কান যা শুনেছে তার সাথে একমত হতে চাইছে না। ব্যাপারটা অনেকটা টবের গাছে, অতিরিক্ত পানি ঢালার মত-ছেলেটার কথাগুলো আমার খুলি আর মগজের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু এর বেশিরভাগই মেনে নিতে অক্ষম ছিলাম।
ও আমার দিকে তাকিয়ে মাথা খানিকটা সামনে বাড়িয়ে দিল, মুখ নড়ছে। মনে হচ্ছিল জানতে চাইছে আমি ঠিক আছি কিনা। আমি কথাগুলো
ওর ঠোঁটে নড়তে দেখছিলাম কিন্তু কিছু শুনতে পারছিলাম না। ও টেবিল ঘুরে এসে আমার কাঁধ স্পর্শ করার চেষ্টা করল। ওর স্পর্শ পেয়ে আমার অসাড়তা ভাঙল।
“আমাকে ছোঁবে না?”
আমি বুথের মধ্যে পিছিয়ে গেলাম, ওর থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে যেতে চাইছিলাম। ইচ্ছাকৃত ক্রিয়া ছিল না, বরং সহজাত প্রবৃত্তি থেকে দেয়ালের দিকে সরে গেলাম।
রেস্টুরেন্টের আলো আর শব্দ হঠাৎ করে আমার কাছে ফিরে এল। মিউজিক কিংবা কাস্টমারদের হাউকাউ কখনোই বন্ধ হয়নি, সে আমার চোখে কানে ওগুলো পৌঁছাচ্ছিল না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল সময় যেন থেমে গিয়ে আবার শুরু হলো।
আমি বুঝতে পারিনি যে কথাগুলো জোরে বলে উঠেছিলাম। পাশের টেবিলের পরিবারটা শুনতে পেয়েছিল। পুরুষ এবং নারী দু-জনেই আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে চোখ পড়তেই তারা বিব্রত বোধ করে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের আলাপে ফিরে গেল।
“তুমি ঠিক আছ, নাটসুমি?” ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, ওর হাত ফিরিয়ে নিয়েছে। সিটে হেলান দিয়ে প্রশ্নটা করেছে সে। আমি আমার আগের জায়গায় ফিরে গিয়ে মাথা নাড়লাম।
“না।” আমার বুক ব্যথা করছিল। কাঁদছিলাম না, কিন্তু কথার মধ্যে কান্নার সুর ছিল। “কিছুই ঠিক নেই..”
আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে যেন। বুঝতে পারছিলাম না ছেলেটাকে আমার ভয় পাওয়া উচিত নাকি ওর উপর রাগ করা উচিত। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছিলাম আমার বিপরীতে বসে থাকা ছেলেটাকে কিছু করা আমার ক্ষমতার বাইরে।
আমি নিজের উপর যতই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি না কেন, সে ছিল পুরোপুরি শান্ত। আর সে ওখানে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে লক্ষ্য করছে। মনে হচ্ছে আমি কোন মানুষ নই, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রাখা কোন পোকামাকড়।
“নাটসুমি, আমি চাই না তুমি চিৎকার কর,” অনুভূতিহীন সুরে ছেলেটা বলল, যেন ওর হৃদয় বলতে কিছু নেই। টেবিলের এপাশ থেকে আমি বুঝতে পারছিলাম সে খুবই ভয়ঙ্কর একজন মানুষ।
“কেন তুমি ওকে খুন করলে..?”
এই ছেলে ইটসুকির মত কখনো হাসে না, কিংবা অপ্রত্যাশিত কিছু সামনে পড়লে অবাক হয় না। ও ছিল ডালপালা কেটে ফেলা, পাতা বিহীন একটা গাছের মত, ননতম জিনিসগুলো ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। জানি শুনতে অদ্ভুত লাগছে কিন্তু আমার কাছে ওকে এরকমই মনে হয়েছিল।
“আমি জানি না কেন হিরোকোকে খুন করেছি, সত্যি জানি না, সে আস্তে আস্তে বলল। “কিন্তু কোন কারন ছিল না। ওর মৃত্যুই আমার সাথে কোনভাবে যুক্ত ছিল।”
“তোমার সাথে?”
কয়েক মুহূর্ত সে কিছু বলল না, মনে হলো কোন চিন্তায় ডুবে গিয়েছে। কিন্তু আমার থেকে চোখ সরায়নি একবারের জন্যও। অবশেষে কিছু না বলে মুখ দিয়ে ইশারা করে পাশের টেবিলে পরিবারটিকে দেখাল।
“কিছুক্ষণ আগে তুমি ওদের দেখছিলে তাই না?” বাচ্চা মেয়ে দুটো একজন আরেকজনের সাথে খুনসুটি করছে।
“তুমি তোমার অতীত দেখতে পাচ্ছিলে তাই না? ভাবছিলে তোমার আর হিরোকোর সাথে ঐ মেয়ে দুটোর কত মিল? ওদের দেখে তোমার নিজের ছোটবেলার সুখ স্মৃতিগুলো মনে পড়ছিল, আর তুমি এমনভাবে ওদের দিকে তাকিয়ে ছিলে যেন মূল্যবান কোন সম্পদের দিকে তাকিয়ে আছ।”
“চুপ কর…”
আমি দুহাতে কান চাপা দিতে চাইলাম যেন ওর গলা শুনতে না হয়। মনে হচ্ছে যেন সে আমার মনের পাহাড়ে নোংরা জুতো পড়ে হাঁটাহাঁটি করছে।
“আমার নিজেরও বোন আছে। অনেক বছর আগে আমরাও নিশ্চয়ই এভাবে ডিনারে যেতাম, ঐ পরিবারটার মত। যদিও আমার এরকম কোন স্মৃতি নেই কিন্তু নিশ্চয়ই এরকম কিছু হয়েছিল। শুনে অবাক লাগছে না তোমার কাছে?”
ওর প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণের সাথে পাল্লা দিয়ে আমার হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগল। মনে হচ্ছে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছি, প্রতি মুহূর্তে গড়িয়ে পড়ার গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
“ছোট মেয়েটাকে দেখ-মনোযোগ দিয়ে দেখ। সাবধানে, তুমি যে দেখছ সেটা যেন খেয়াল না করে,” ছেলেটা নিচু গলায় বলল।
আমি ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে কাছের সিটে বসা ছোট মেয়েটার দিকে তাকালাম। বুথে বসে সে নিষ্পাপ চোখগুলো দিয়ে দূরে কোথাও তাকিয়ে আছে। ওর হাতগুলো শক্ত করে মায়ের পোশাক ধরে আছে। আমি মেয়েটাকে না চিনলেও, নাম না জানলেও, ভালবেসে ফেললাম।