সেরকম আহামরি কোন গল্প না, একজন হাই স্কুলের ছাত্র অহরহ যে ধরনের গল্প করে থাকে সেসব আর কি। কিন্তু গল্পগুলো আমাকে শান্ত করতে সাহায্য করল। হয়তো ইটসুকি আমার টেনশন বুঝতে পেরে মন ভালো করানোর চেষ্টা করছে।
গাড়িগুলো সাঁ সাঁ করে আমাদের পাশ কাটিয়ে গেল। ওগুলোর জ্বালানো হেডলাইট আমাদের মুখের উপর আলো ফেলছে। “ওখানে বসে কথা বলতে চাও?” ইটসুকি স্টেশনের সামনের একটা ফ্যামিলি রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে বলল।
রেস্টুরেন্টের ভেতর ডিনার করতে আসা লোকজনের হাউকাউ। একজন ওয়েট্রেস আমাদেরকে পেছন দিকের একটা বুথে নিয়ে গেল। দেয়াল আর পার্টিশনগুলোতে রুপালি আল্পনা করা, আলো পড়ে ঝকমক করছে।
“তোমার বাবা-মা কেমন আছেন?” ইটসুকি জানতে চাইল।
“ভালো না, তারা বাসা ছেড়ে কোথাও যায় না।”
আমি ওকে বললাম আপু মারা যাওয়ার পর বাসার কি অবস্থা। ঘরের কোনায় ধুলো, টিভি চালানো কিন্তু লাইট নেভানো, কিভাবে তারা দরজা লক করতে ভুলে যায়।
“তার মানে তারা এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি…?”
“হ্যাঁ, বিশেষ করে আপুর লাশ দেখার পর..”
সে মাথা দোলাল। আমি ওকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় বলেছিলাম, আপুর লাশের অবস্থা আসলে পত্রিকায় যা বলা হয়েছে তারচেয়ে অনেক খারাপ অবস্থায় ছিল।
“জানি না তাদের কোন উন্নতি হবে কিনা?” বিড়বিড় করে বললাম, বাবা-মায়ের শূন্য চেহারার কথা চিন্তা করে। তাদের দেখে মনে হয় জীবনের স্ফুলিঙ্গ তাদের ভেতর থেকে আজীবনের জন্য হারিয়ে গিয়েছে।
“আকাগির কি অবস্থা?”
“অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর সে কয়েকবার এসেছিল, কিন্তু ইদানিং…”
আকাগি, আমার বোনের বয়ফ্রেন্ড…আপুর খুনের ঘটনায় বিধ্বস্তদের একজন সে। আপুর সাথে এক কলেজেই পড়ত। যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম না, আমি ভেবেছিলাম ওখানেই ওদের দেখা হয়েছে। আপু ওকে সাথে করে বাসায় নিয়ে আসত, আমার সাথে কয়েকবার কথা হয়েছিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় ও আমার বাবা-মায়ের পাশে ছিল, সান্ত্বনা দিচ্ছিল।
“হয়তো হিরোকোর খুনের জন্য আমিই দায়ি, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর ও বলেছিল। “ওর খুনের আগেরদিন আমাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল, আমার রুম থেকে ছুটে বের হয়ে গিয়েছিল, তারপর,.”
পরের দিন, আপুর লাশ ঐ পরিত্যক্ত হাসপাতালে পাওয়া যায়।
আকাগিই শেষ ব্যক্তি যে আপুকে জীবিত দেখেছে।
ওরা যদি ঝগড়া না করত, তাহলে আপুর সাথে খুনির হয়তো দেখা হত না। খুনও হতে হত না আপু। আকাগি নিজের মুখ ঢেকে এরকম কিছু কথা আমাকে বলেছিল।
“আমাকে এখন যেতে হবে,” ইটসুকি বলল। ওর ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছে।
“আমি আরো কিছুক্ষণ থাকব।”
“ঠিক আছে, কিন্তু..” সে এক পা গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। “তোমার যদি কোন কিছু নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করে, তাহলে অবশ্যই আমাকে ফোন দিও।”
ওকে ধন্যবাদ জানালাম। ও চলে গেলে, একা বসে কফি খেতে খেতে পাশের টেবিলের পরিবারকে দেখতে লাগলাম। সরাসরি তাকাইনি, আড়চোখে দেখছিলাম।
অল্পবয়সি স্বামী-স্ত্রী, সাথে দুটো মেয়ে বাচ্চা।
আমাদের পরিবারের মত মনে হলো আমার কাছে। ছোট বাচ্চাটা বেশি ছোট, কথা বলতে শেখেনি। মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে রেখেছে। চারপাশের সবকিছু বড় বড় চোখ করে দেখছে। আড়চোখে তাকানোর সময় পিচ্চিটার সাথে আমার চোখাচোখি হলো।
আপুর কথা মনে পড়তে লাগল।
আমরা যখন ছোট ছিলাম, দু-জনে একসাথে হাঁটতে গিয়েছিলাম। সম্ভবত বসন্তের কোন উষ্ণ দিন ছিল। আমি তখন মাত্রই এলিমেন্টারি স্কুল শুরু করেছি।
আমরা দুজন একসাথে পাহাড়-টিলায় চড়তাম, বাড়ির পর বাড়ি পেরিয়ে যেতাম। পাহাড়ের চূড়ায় একটা বন ছিল। সেখান থেকে আমরা নিচে পাহাড়ের ছায়ায় থাকা শহর দেখতাম-যতদূর চোখ যায় ঘোট ঘোট বাড়িঘর।
উপরে তাকালে আকাশে একটা লম্বা সাদা ডানাওয়ালা একটা পাখি দেখা যেত। একটা বড় নদী শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। আমার অনুমান ছিল পাখিটা ওখানেই কোথাও থাকে। পাখিটা প্রায় নড়াচড়া করছিলই না। স্রেফ বাতাসে ভর দিয়ে ভেসে ছিল। বিরক্ত না হয়ে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতাম।
আপু আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, ওর দাঁতগুলো ঝকমক করে উঠল। হাসলে ওর শ্বদন্তগুলো বেরিয়ে থাকত। এমন কি বড় দাঁত উঠার পরেও। আমরা অনেক সময় ভ্যাম্পায়ার ভ্যাম্পায়ার খেলতাম। কতদিন আমি আপুকে হাসতে দেখিনি! কতদিন আমি ওর শ্বদন্তগুলো দেখিনি! কতদিন!
ও যখন চুল রঙ করালো, আমি ভাবছিলাম আমিও করাবো কিনা।
“তুমি কোরনা, তোমাকে বাজে দেখাবে,” আপু বলেছিল। আমি এরকম পরামর্শ মেনে নিতে পারছিলাম না। ওর কথার সুরে কেমন জানি। একটা ধার ছিল। আমার গায়ে বিধেছিল।
প্রতিবার সে ওরকম কিছু করলে, আমার মনে হত সে আমাকে চায় না বা কিছু। কেন ও খুন হল? যে ওকে খুন করার মত ঘৃণা করতে পারে কেউ তা আমার কোনভাবে বিশ্বাস হয় না। আর খুন হওয়ার আগে সে আমাকে কি বলতে চেয়েছিল?
আমার টেবিলের উপর একটা ছায়া পড়ল। মুখ তুলে দেখি কালো ইউনিফর্ম পরাএকটা ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দোকানের সামনে দিয়ে মোরিনোর সাথে যে ছেলেটা হেঁটে যাচ্ছিল।
“কিটাযাওয়া, তুমি আমার স্কুল থেকে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলে।”
যতটা অবাক হওয়া উচিত ততটা অবাক হতে পারলাম না আমি। আমার মনে হয়েছিল এরকম পরিস্থিতিতে এরকম কিছু হওয়াটাই স্বাভাবিক। উঠে দাঁড়ালাম না। আমি শুধু ওর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, “তুমি আমার বোনকে খুন করেছ?”