দোকানের দোতলা আর তিন তলায় তার বাসা।
নোটবুকটা যত্ন করে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর হেঁটে দরজা খুলল লোকটা।
ততক্ষণে মেঘ কেটে গিয়েছে, সূর্য মামা দ্বিগুণ প্রতাপে ফিরে এসেছে। অন্ধকার দোকান থেকে বেরিয়ে সাদা আলোয় আমার চোখ মনে হচ্ছিল ঝলসে যাচ্ছিল। লোকটা দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে বাইরের আলোর মধ্যে হারিয়ে গেল।
নিয়মিত কাস্টমার তরুণীটি উঠে রেজিস্টারের কাছে এল বিল দিতে। আশেপাশে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল দোকান মালিক কোথায় গেছে। আমি আলতো করে মাথা নাড়ালাম। জানি না।
***
দোতালায় যাওয়ার সিঁড়ি বাইরের দিকে। দোকান থেকে বের হয়ে সেদিকে যেতে হবে।
তিন তলায় হাত পা বাধা অবস্থায় মেঝেতে পড়েছিল মোরিনো। তখনো ওর পরনে মিজুগুশি নানামির মত পোশাক। দেখে মনে হল না আহত।
আমাকে দেখে মোরিনো চোখ সরু করে তাকাল। এটা ওর হাসার ভঙ্গি। মুখে একটা ভোয়ালে ঢোকানো ছিল যে কারনে কিছু বলতে পারল না।
আমি তোয়ালেটা সরালে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“কফি শপের মালিক ভান করেছিল যে ব্যথা পেয়েছে। আমাকে বলল কিছু জিনিস বহন করে দিতে পারব কিনা। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই..”
হাত-পায়ের দড়ি খোলা সহজ ছিল না। আমি ওকে ওখানেই ফেলে রেখে রুমের ভেতর চেক করলাম। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে লোকটা একাই বাস করে সেখানে।
ডেস্কের উপর একটা সাদা কাগজ রাখা ছিল। ছোট ছোট ক্রস চিহ্ন আঁকা।
শেষে এক সেট ছুরি পেলাম। সেগুলো কি কাজে ব্যবহৃত হত তা কল্পনা করার প্রয়োজন নেই, নোটবুকেই বিস্তারিত লেখা ছিল।
মোরিনো রাগি সুরে আমাকে ধমক দিল কেন ওর বাঁধন কেটে দিচ্ছি না।
আমি ছুরিগুলো থেকে একটা বেছে নিয়ে ওর দড়ি কাটলাম।
“আমাদের পালানো উচিত-ও টের পেয়ে যাবে।”
“না, পাবে না।”
সে আর ফিরে আসবে না এখানে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। হ্যাঁ, ছোট্ট একটা সম্ভাবনা আছে, সে ফিরে এসে আমাদের দুজনকে খুন করে ফেলতে পারে। কিন্তু কোনো বিচিত্র কারনে আমার মনে হচ্ছিল সে আর আসবে না।
কফি শপের কাউন্টারে বসে যখন আমরা কথা বলছিলাম তখন আমার মনে হয়েছে আমাদের দুজনের মধ্যে কোথাও যেন একটা মিল আছে। চুপচাপ দোকান থেকে বের হয়ে গিয়েছিল সে, কারন বুঝতে পেরেছিল আমি কাউকে কিছু বলব না।
খুনি ফিরে আসবে না এ কথা আমার মুখে শুনে মোরিনো একটু অবাক হয়েছিল। সে উঠে দাঁড়িয়ে পোশাক ঠিক করতে লাগল।
“আমি কোনরকমে তোমাকে একটা মেসেজ পাঠাতে পেরেছিলাম, কিন্তু সে বুঝে ফেলেছিল।”
ডেস্কের উপর ওর ফোনটা বন্ধ অবস্থায় রাখা ছিল। মিজুগুশি নানামির ব্যাগটাও সেখানে রাখা। হাজার হোক মোরিনো তো সেটা নিয়েই ঘুরছিল। খুনি কি টের পেয়েছিল যে চতুর্থ শিকারের ব্যাগ আর তৃতীয় শিকারের ব্যাগ একই ছিল? নাকি সে ওকে লক্ষ্যই করেছিল একইরকম ব্যাগের কারনে?
একটা পুরো দিন হাত পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকায় সিঁড়ির দিকে যেতে মোরিনোর বেশ কষ্ট হলো।
রুম ছেড়ে যাওয়ার আগে আমি স্মৃতি স্মারক হিসেবে ডেস্কের সাদা কাগজ আর ছুরির সেটটা সাথে নিয়ে গেলাম। পুলিশ যখন সব জানতে পারবে আর এখানে এসে রুম সার্চ করবে, তখন ছুরিগুলো না পাওয়া গেলে একটু সমস্যা হতে পারে। কিন্তু তাতে আমার কি?
নিচে নেমে কফি শপের ভেতরে তাকালাম আমি। হালকা মিউজিক চলছিল তখনো। কেউ ছিল না। দরজার সাইনটা ঘুরিয়ে ‘ক্লোজড করে দিলাম।
মোরিনো আমার পেছনে দাঁড়িয়ে তার হাত মালিশ করছিল। দড়ির দাগ ওর হাতে স্পষ্ট বসে গিয়েছে।
“জঘন্য অভিজ্ঞতা ছিল,” সে বলল। “এখানে আমি আর কখনো আসছি না।”
“লোকটা কিন্তু অতটা খারাপ ছিল না, ওর সাথে তোমার পরিচয় হলে ভালো হতো।”
মোরিনোর মুখ শুকিয়ে গেল। “কার সাথে পরিচয় হলে ভালো হত? ঐ ব্যাটা আমার সাথে এমন করলই বা কেন?”
সে তখনো বুঝতে পারেনি, দোকানের মালিকই সেই সিরিয়াল কিলার।
আমি মুখ নামিয়ে আমার হাতে ধরা ছোট ছোট ক্রস আঁকা সাদা কাগজটার দিকে তাকালাম।
২. কাটা হাত
কাটা হাত
প্রস্তাবনা
স্কুলের পর বাসায় যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলাম। তখন খেয়াল হলো কেউ একজন আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুরে দেখি, মোরিনো। পুরো ক্লাসরুম খালি।
“তুমি বাসায় যাওয়ার আগে কিছু কথা বলতে চাইছিলাম,” বলল সে। সারাদিন আমরা কোন কথা বলিনি। সুতরাং বলা যায় প্রায় চব্বিশ ঘন্টা পর ওর গলার আওয়াজ শুনলাম। “গতকালকে আমি একটা অদ্ভুত মুভি ভাড়া করে এনেছি..”
মুভিটা নিয়ে কারো সাথে আলাপ করার জন্য ও মারা যাচ্ছিল। আর পুরো ক্লাসে একমাত্র আমিই আছি যার সাথে ও কথা বলে এবং সে আমার সাথে শুধু তখনই কথা বলে যখন আমি একা থাকি, অন্যদের সাথে কথা বলি না যখন। যেজন্যে বাসায় যাওয়ার আগে ছাড়া আমার সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিল না।
রুমের বাইরে দাঁড়ানো কিছু মেয়ে আমাদেরকে খেয়াল করে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিল। ওদের দেখে আমি বুঝতে পারলাম, ওরা আমাদের নিয়ে কথা বলছে। প্রথম প্রথম, সবাই চিন্তা করত আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা কিনা। কিন্তু আমাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে আমাদেরকে অন্তরঙ্গ মনে হয় না। আমাদের সব কথাবার্তার সময় মুখের অভিব্যক্তিও থাকে ঠাণ্ডা। সুতরাং আমাদের সম্পর্কটা কি ধরনের তা আমাদের ক্লাসমেটদের কাছে একটা বিশাল রহস্যজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তাদের মূল আগ্রহ হলো, আর যাই হোক মোরিনো যে কারো সাথে কথা বলছে এইটাই বিশাল কিছু। ক্লাসের মধ্যে সে রীতিমত লুকিয়ে থাকে। স্কুল ছুটি, তো উধাও। ওর জীবন যাপন সাবমেরিনের মত, সারাক্ষণ সাগরের তলায় পড়ে থাকে।