“বোল না যে তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছ?”
ওকে আসতে দেখে আমি এতটাই নিশ্চিন্তবোধ করছিলাম যে প্রায় কেঁদেই ফেলছিলাম। হঠাৎ উপলদ্ধি করলাম কতখানি আতংকে ছিলাম আমি।
“ফালতু কথা বোল না, ভুলব কেন? অনেকদিন হয়েছে অবশ্য..”
আমার বোনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কথা ভাবলাম আমি। চারদিকে আত্মীয়স্বজন আর আপুর কলেজের বন্ধুরা। ইটসুকি আমার দিকে ছুটে এসেছিল। আমরা দু-জন আমাদের হাই স্কুল ইউনিফর্ম পড়ে ছিলাম। ও পুরোটা সময় আমাকে সঙ্গ দিয়েছিল, মন ভালো করার চেষ্টা করছিল, আমার পাশে ছিল। ব্যাপারটা আমার কাছে অনেক ছিল।
ওর ইউনিফর্মর ক্রেস্টটা আমার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল। সেজন্য আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ছেলেটা আমাকে টেপ টা দিয়েছিল সে যে ম*** হাই স্কুলের ছাত্র। ছেলেটার নাম যেহেতু আমার জানা নেই সুতরাং একমাত্র স্কুল দিয়েই আমি ওকে খুঁজে পেতে পারি।
“তোমাকে এখানে দেখে খানিকটা অবাক হয়েছি। কারো জন্য অপেক্ষা করছ নাকি?”
আমি ওকে বলতে চেয়েও বলতে পারলাম না যে আমি গেটের দিকে তাকিয়ে আছি, আমার বোনের সম্ভাব্য খুনি কখন বের হবে সেজন্য অপেক্ষা করছি। সুতরাং মাথা নাড়লাম। আমি জানি না আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছিল কিন্তু ও সিরিয়াস হয়ে গেল।
“কোন সমস্যা হয়েছে?” ইটসুকি প্রশ্ন করল, ওকে চিন্তিত শোনাল। “নাকি এখনো তোমার বোনের ব্যাপারে,.” ও আমার আর আপুর মধ্যের সমস্যার কথা জানত। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে আমি ওকে সব জানিয়েছিলাম।
অন্তেস্টিক্রিয়ায়ায় রাখা আপুর ছবিটা মারা যাওয়ার অল্প কিছুদিন আগেই তোলা হয়েছিল। কিন্তু তার আগেই আমাদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে
ছিল। আপুকে খুব সুন্দর লাগছিল ছবিটায়। সেটা দেখে আমার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল।
“না আপুর ব্যাপারে না।”
“কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত তুমি? তুমি বলেছিলে আপুর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলে,.”
“হ্যাঁ, কিন্তু…বাদ দাও ব্যাপারটা। আমি দুঃখিত তোমাকে ঐদিন এসব কথা জোর করে শুনিয়েছি।”
ইটসুকি সমবেদনার চোখে আমার দিকে তাকাল। “পুলিশ কি কিছু জানতে পেরেছে কে খুন করেছে?”
আমি ওর দিকে তাকালাম।
“তোমাকে অন্যরকম লাগছে।”
ওর সহজাত প্রবৃত্তি বেশ ভালো দেখা যাচ্ছে। আমি মাথা নারলাম। “পুলিশ এখনো কিছু..”
“হুম,” ও জোরে শ্বাস ফেলল।
সেই মূহর্তে যার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তাকে দেখা গেল। ইটসকির সাথে কথা বলার সময় সূর্য ডুবছিল, যে কারনে বাইরে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। কিন্তু তারপরেও ছেলেটা যখন রাস্তা পার হচ্ছিল তখন জানালা থেকে আমি ওর চেহারা পরিস্কার দেখতে পেলাম।
যদিও আমি নিশ্চিত না ছেলেটা আসলেই আপুকে খুন করেছে কিনা, কিন্তু যে মুহূর্তে ওকে দেখলাম সাথে সাথে একরাশ ভয় এসে আমাকে গ্রাস করল। মনে হল যেন হঠাৎ আমি এক দলা অন্ধকারের মধ্যে ডুবে গিয়েছি।
তারা ম্যাগাজিন র্যাকের সামনের জানালা দিয়ে হেঁটে গেল। ইটসুকি আমার দৃষ্টি লক্ষ্য করে বাইরে তাকাল, কি কারনে আমি হঠাৎ চুপ করে গেলাম বুঝতে চাইল।
“মোরিনো,” সে বলল।
“ছেলেটার নাম মোরিনো?”
“না, মেয়েটার নাম। সবাই চেনে ওকে। একজন টিচার ওর গায়ে হাত দিতে গিয়েছিল। ও পিটিয়ে লোকটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল।”
ইটসুকির মত ওরাও সেকেন্ড ইয়ারের শিক্ষার্থী।
“তুমি কি ছেলেটার নাম জান?” আমি ব্যগ্রভাবে জানতে চাইলাম।
ইটসুকি একটু ভাবল। “উমম, হ্যাঁ, ছেলেটার নাম হল..”
ও একটা নাম বলল, আমি আমার মগজে ভালোমত গেঁথে নিলাম যেন কখনো ভুলে না যাই।
হাতের ম্যাগাজিনটা নামিয়ে রেখে দোকান থেকে বের হলাম। ঠান্ডা বাতাস আমাকে ঘিরে ফেলল।
দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওদের পেছন দিকটা দেখতে পাচ্ছিলাম। স্টেশনের দিকে এগোচ্ছিল ওরা।
মেয়েটা মনে হয় টের পেয়েছিল কেউ ওদের দেখছে, কারন সে ঘুরে আমার দিকে তাকাল। আমাকে কয়েক মুহূর্ত দেখে আবার সামনে ঘুরে গেল।
দোকানের দরজা খুলে ইটসুকি বেরিয়ে এল। “ছেলেটার সাথে আমি গত বছর একসাথে ক্লাস করেছিলাম।”
“কেমন ধরনের ছেলে?”
ইটসুকি এক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল। “জানি না…সাধারণ ধরনের?”
আমি ইতস্তত করছিলাম। আমি কি ছেলেটার পিছু পিছু যাব? কিন্তু আমার সাথে ইটসুকি আছে, আর ছেলেটার সাথে মোরিনো মেয়েটা আছে। এরকম সময়ে আপুর টেপ নিয়ে কিছু জানতে চাওয়া ঠিক হবে বলে মনে হচ্ছে না। সুতরাং আইডিয়াটা বাদ দিলাম।
“কোন সমস্যা?”
আমি মাথা নাড়লাম। দুজনে একসাথে হাঁটতে লাগলাম স্টেশনের দিকে। যেদিকে ওরা গিয়েছে। ওদেরকে অবশ্য তখন আর দেখা যাচ্ছে না।
রাস্তার ধারের দোকানগুলোর নিয়ন সাইন আর সারি সারি করে রাখা ভেন্ডিং মেশিনগুলো থেকে আসা উজ্জ্বল আলো চোখে পড়ছিল। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর শীতকালের অন্ধকার যেন অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ঘন মনে হচ্ছে। ভেন্ডিং মেশিনের আলোরই শুধু কোন পরিবর্তন নেই।
হাঁটতে হাঁটতে ইটসুকি আর আমি আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করলাম। আমি শুধু ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে প্যাচাল পাড়লাম, কারন একমাত্র এই বিষয় নিয়ে কথা বলাই নিরাপদ মনে হলো আমার কাছে। ও অবশ্য ওর স্কুল, বন্ধু-বান্ধবি, বেড়াতে যাওয়া সবকিছু নিয়েই মজার মজার গল্প শোনাল।