সে মাইক্রোফোনটা আমার মুখের দিকে ধরে রেখেছে…ওর সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব না, সে দেবে না বলতে। আমি দুঃখিত। সে কথা দিয়েছে মেসেজটা তোমাকে পাঠাবে। সে দেখতে চায় আমার কথাগুলো
শুনে তোমার প্রতিক্রিয়া কি হয়। আমার কাছে ব্যাপারটা আনন্দ লাভের জন্য জঘন্য উপায় মনে হলেও আমার কথাগুলো যদি তোমার কাছে পৌঁছায় তাহলে বাকি কোন কিছুতেই আমার কিছু আসে যায় না…
আমি নড়তে পারছিলাম না। একটা ভয়াবহ সন্দেহ আমার মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল। একটা কণ্ঠ আমার মাথার ভেতর প্রতিধ্বনি তুলছিল, আমাকে সাবধান করছিল টেপের বাকিটা যেন না শুনি। দুঃস্বপ্ন অপেক্ষা করছিল আমার জন্য, আর আমি যদি মেসেজটা শুনি তাহলে ফিরে যাওয়ার আর কোন রাস্তা খোলা থাকবে না আমার সামনে। এই ব্যাপারে আমি এতটাই নিশ্চিত ছিলাম যে এর মুখোমুখি হতে পারছিলাম না, নিঃশ্বাস ফোপানির মত করে বেরিয়ে এল আমার বুক থেকে।
টেপটা বন্ধ করতে পারব না আমি। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আপুর কণ্ঠ শুনতে লাগলাম।
‘নাটসুমি, আমি এখন একটা অন্ধকার রুমে। নড়াচড়া করতে পারছি না। চারদিকে কংক্রিট…আর অনেক ঠান্ডা…একটা টেবিলের উপর আমি…’
আমি হাত তুলে আমার মুখ চাপা দিলাম, বেরিয়ে আসতে চাওয়া চিৎকারটা ঠেকাতে চাইছিলাম। আমি জানি সে কোথায় ছিল, কোথায় সে
মাইক্রোফোনে কথা বলছিল।
আপু কাঁদছিল কথা বলার সময়।
‘এই জায়গাটা…পুরনো কোন বাতিল বিল্ডিং…’
ওর মলিন কণ্ঠের কষ্টপূর্ণ একটা প্রতিধ্বনি শীতল, অন্ধকার কংক্রিটের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলল। ওর কষ্ট আমার বুক ছিদ্র করে ফেলছিল।
অবচেতন মনে আমি টেপ ডেক স্পিকারগুলোর উপর কাঁপা কাঁপা হাতে আঙুল বোলালাম, যেন আপুর কণ্ঠ স্পর্শ করতে চাইছিলাম।
‘আমি দুঃখিত, নাটসুমি।
ওর কথাগুলো আমার আঙুলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে মিশে গেল। আঙুলে স্পিকার থেকে বের হওয়া কম্পন টের পেলাম, মনে হলো যেন ওর কণ্ঠের একটা অংশ ছিল সেটা। আপুর নিঃশ্বাসের শব্দও হারিয়ে গেল। টেপটা শেষ।
আমি টেপটা ঘুরিয়ে অন্য পাশটা চালালাম কিন্তু সে অংশটা খালি ছিল।
কোন সন্দেহ নেই, টেপটা আপু খুন হওয়ার আগের মুহূর্তে রেকর্ড করা হয়েছিল। বুক স্টোরে টেপটা নেয়ার কথা মনে পড়ল আমার। ছেলেটা একটা খামে টেপটা আমাকে দিয়েছিল, আর খামটা ফেরত নিয়ে নিয়েছিল।
সে টেপটা স্পর্শ করেনি। টেপে ওর কোন ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেই। সেইকি আপুর সামনে মাইক্রোফোন ধরে ছিল? সেইকি আপুকে খুন করেছে?
আমার উচিত টেপটা পুলিশের হাতে তুলে দেয়া। কিন্তু সেটা করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। ছেলেটা যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল পুলিশকে জানালে বাকি টেপগুলো আর পাওয়া যাবে না।
মেসেজে আরো কথা ছিল। আর সেই কথাগুলো আমি শুনতে চাই।
***
টেপটা শোনার পরপরই আমি আমার স্কুল ফাঁকি দিয়ে ম**** হাই স্কুলের সামনে গেলাম।
ম**** হাই স্কুল ছিল একটা সরকারি স্কুল। আমার স্কুল থেকে দুই স্টেশন পরে। স্কুলের গেটটা ব্যস্ত রাস্তার দিকে মুখ করা আর চারপাশ সুন্দর করে ছাঁটা গাঢ় সবুজ ঝোঁপের বেড়া দিয়ে ঘেরা। দেখে মনে হচ্ছে সবুজ দেয়াল। বেড়ার উপর দিয়ে স্কুলের সাদা ছাদ চোখে পড়ছে।
স্কুলের গেটের কাছাকাছি রাস্তার অপর পাশে একটা দোকান, সেখানে ম্যাগাজিন র্যাকের কাছে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে স্কুলের উপর নজর রাখছিলাম আমি। প্রায় এক ঘন্টার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার ভান করলাম। স্কুল ছুটি হলে শিক্ষার্থীরা বের হতে শুরু করল। সূর্য তখন প্রায় অস্ত যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা প্রায় সবাই গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে আমার সামনে দিয়েই যাচ্ছে। কারণ স্টেশন এই পাড়ে ছিল। ফুটপাথও চওড়া। আমি সবার চেহারা দেখছিলাম একজন একজন করে।
ওদের দেখতে দেখতে আমার বোনের কথাগুলো মনে পড়ছিল।
আমি অনেকবার, বার বার টেপটা বাজিয়ে শুনেছি, প্রতিবারই একইভাবে ধাক্কা খেয়েছি। ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে আমার। বিছানায় শুয়ে খালি সিলিঙের দিকে তাকিয়ে থাকি, চিন্তা করি। কিন্তু চিন্তাগুলো কোথাও গিয়ে পৌঁছাতে পারে না।
আমার কেমন যেন হতবিহ্বল লাগছে, না ঘুমাতে পারার কারনে হয়তো? ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে ওলটাতে আড়চোখে ক্লার্কের দিকে তাকালাম। এতক্ষন এখানে দাঁড়িয়ে আছি সে জন্য রেগে যাচ্ছি কিনা। হয়তো সন্দেহ করছে। আমার ভয় হচ্ছিল সে আমাকে কিছু বলে কিনা।
জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে পেলাম পাঁচটা ছেলের একটা দল যাচ্ছে, হাসতে হাসতে কথা বলছে। ওদের একজনের সাথে আমার চোখাচোখি হলো।
সে দাঁড়িয়ে গেল, অবাক হয়েছে, তারপর সাথে বন্ধুদের কিছু একটা বলল। কাঁচের ভেতর দিয়ে আমি কথাগুলো শুনতে পাইনি, সম্ভবত বলল ওকে ছাড়া এগিয়ে যেতে ধরনের কিছু। তারা ছেলেটাকে রেখে চলে গেল।
আমি ওকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।
ছেলেটা দোকানের দরজা খুলে ছুটে আমার দিকে এল। “কিটাযাওয়া? তুমি এখানে কি করছ?”
ওর নাম কামিয়ামা ইটসুকি। জুনিয়র হাই থেকে আমি ওকে চিনি। ও স্কুলের বাস্কেট বল টিমের মেম্বার ছিল, আমি ছিলাম টিমের ম্যানেজার। কুকুরছানার মত কিউট চেহারা করে রাখত ও সবসময়। সদা হাস্যজ্জল। ও আমার চেয়ে অনেক লম্বা হলেও যেভাবে আমার দিকে দৌড়ে এল তাতে ছোট কুকুর ছানার মতই লাগল আমার কাছে।