ছেলেটা চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।
“দাঁড়াও..” আমি বললাম, ওর পেছন পেছন যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। আমার পাগুলো নড়ছিল না। একদম জমে গিয়েছিল। ঐ লোকটা যখন পিছে এসে দাঁড়িয়েছিল তখনের মত। আমি জানি না কেন আমার এরকম হয়েছিল, ছেলেটা তো আমাকে হুমকিও দেয়নি…উল্টো আমাকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু তারপরেও আমার সারা শরীর ভেঙে পড়েছিল। আমি পুরো ঘেমে গিয়েছিলাম।
এক মুহূর্ত পর ছেলেটা সেলফের কোনা থেকে ঘুরে আমার দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেল। আমি ক্যাসেটটা হাতে নিয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকলাম।
ট্রেনে চড়ে বাসায় ফেরার সময়, সিটে বসে টেপটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ততক্ষণে সূর্য ডুবে গিয়েছিল, বাইরেটা অন্ধকারে ঢাকা। জানালাগুলোতে গাঢ় অন্ধকার, যেন কয়লা ঘষা হয়েছে। বাইরের কিছু দেখা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল যেন ট্রেন নড়ছে না। শীতের কারনে সূর্য তখন তাড়াতাড়ি অস্ত যাচ্ছিল। আপু যখন খুন হয়েছিল তখন হয়তো বাইরে একটু আলো ছিল।
কে ছিল ছেলেটা? হাই স্কুল ইউনিফর্ম পড়া, তার মানে আমার বয়সি হবে। কিংবা আমার চেয়ে এক-দুই বছরের ছোট। সে দাবি করছিল সে আমার বোনকে চেনে। কিন্তু আপু কখনো এরকম কারো কথা আমাকে বলেনি।
যদি মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে তাদের দেখা হয়ে থাকে তাহলে সে সময় পায়নি ছেলেটার কথা বলার।
ছেলেটা বলেছে আপু ওকে টেপটা দিয়েছে। সে কি বলতে চেয়েছে আমার বোন চেয়েছিল আমি টেপটা শুনি? আর কষ্ঠ ১ : কিটাযাওয়া হিরোকো’ লেখাটার মানে কি?
ট্রেনের গতি কমে এলে অভ্যাসবশত আমার শরীর নড়ে উঠল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে ট্রেন থেকে নেমে গেলাম।
স্টেশনের কাছে লোকজনের ভিড় থাকলেও যে মুহূর্তে আবাসিক এলাকায় পা রাখলাম, কোন জন-প্রাণী দেখা গেল না। খালি পিচঢালা রাস্তা এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারে মিশে গিয়েছে। ঠাণ্ডা বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে আমি বাসার দিকে হেঁটে চললাম। রাস্তার ধারের বাড়িগুলো থেকেই যা একমাত্র আলো আসছিল। ওগুলোর প্রত্যেকটায় একটা করে পরিবার আছে, ডিনার টেবিলে বসা, নিজেদের মত জীবন চলে যাচ্ছে তাদের-এই তথ্যটা হঠাৎ করে আমার কাছে চমকপ্রদ মনে হলো।
আমাদের বাড়ির জানালাগুলো অবশ্য অন্ধকার ছিল। এর মানে এই না যে কেউ বাসায় ছিল না। সামনের দরজা খুলে আমি লিভিং রুমে ঢুকলাম, বাবা-মাকে জানালাম আমি বাসায় ফিরেছি।
তারা সোফায় বসে টিভি দেখছিল। কোন কথা নেই। বাতি জ্বালানোর ইচ্ছাও হয়নি তাদের। টিভির স্ক্রিন ছিল রুমের আলোর একমাত্র উৎস। আমি সুইচ টিপে আলো জ্বালালে তারা আমার দিকে ঘুরে প্রাণহীন সুরে আমাকে স্বাগতম জানালেন।
“তোমরা আবারো দরজা লক করতে ভুলে গিয়েছ,” আমি বললাম। উত্তরে আমার মা টিভির দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালেন খালি। তার মধ্যে জীবনের কোন চিহ্ন নেই। কোন কিছুতে তার যেন আর কিছু আসে যায় না।
তারা আসলে টিভির কিছুই দেখছিলেন না। টিভিতে দেখানো কোন কিছুই তাদের চোখ পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। আমি তাদের পিঠের ভাঁজ পড়া পোশাকের দিকে একবার তাকিয়ে উপর তলায় আমার রুমে গেলাম।
ব্যাগটা বিছানার উপর ফেলে, ইউনিফর্ম না বদলেই টেপটা আমার স্টেরিওতে ঢোকালাম। স্টেরিওটা ছোট ধরনের ছিল, নীলচে রুপালি রঙের, সেলফের দ্বিতীয় তাকে রাখা ছিল। আমি ওটার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম।
আপুর চেহারা আমার চোখে ভাসল-খুনের আগে সে যেভাবে আমার দিকে বিরক্ত চেহারায় তাকাত, সেই চেহারা নয়। যখন আমরা আরো ছোট ছিলাম, হাত ধরে একসাথে হাঁটতাম তখন সে যেভাবে আমার দিকে তাকাত সেই চেহারা।
প্লে বাটনে চাপ দিলাম। যান্ত্রিক শব্দ করে মোটরগুলো ঘুরতে লাগল। আমি স্পিকারগুলোর দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছুই ছিল না, সেফ নিরবতা। তার পর একটা হিস ধরনের শব্দ, বাতাসের মত। আমার হৃদপিণ্ড দ্রুত চলছিল, নার্ভাস লাগছিল।
আমি যেটাকে বাতাসের শব্দ ভেবেছিলাম সেটা তা নয়, কেউ একজন মাইক্রোফোনের সামনে নিঃশ্বাস ফেলছিল আসলে।
নাটসুমি…
হঠাৎ আমি আপুর কণ্ঠ শুনতে পেলাম। ওর গলা দূর্বল শোনাচ্ছিল। ক্লান্ত। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কণ্ঠটা ওরই। ছেলেটা মিথ্যে বলেনি। আমার বোন সত্যি সত্যি আমার জন্য একটা টেপ রেখে গিয়েছে।
‘নাটসুমি, জানি না তুমি কখনো এটা শুনতে পারবে কিনা? এই মুহূর্তে আমি আমার সামনে রাখা একটা মাইক্রোফোনে কথা বলছি। কিন্তু জানি না এই মেসেজ কোনদিন তোমার কাছে পৌঁছাবে কিনা…’
কখন, কোথায় সে এটা রেকর্ড করেছিল? ওর গলা এত পাতলা শোনাচ্ছিল যে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিল। সে আস্তে আস্তে কথা বলছিল, থেমে থেমে, যেন কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। শব্দগুলোর মধ্যে দীর্ঘ বিরতি, আর কেমন যেন মরিয়া ভাব। কিন্তু এসব কিছুর কারনে ব্যাপারটা আরো সত্যি মনে হচ্ছিল। কোন স্ক্রিপ্ট করা বক্তব্য না, বরং নিজের চিন্তাকে শব্দে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
‘শোন, তোমাকে একটা মেসেজ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে আমাকে বলা হয়েছে মাইক্রোফোনে আমি যা খুশি বলতে পারব, যা খুশি…কিন্তু শুধুমাত্র একজন মানুষকে। আর আমি সাথে সাথে তোমার কথা চিন্তা করেছি-আমি উপলদ্ধি করেছি তোমাকে কিছু কথা বলা আমার জন্য কতখানি জরুরি। জানি অদ্ভুত শোনাচ্ছে কিন্তু তোমার সাথে আমার কথা বলা দরকার, আকাগির সাথে নয়…’