জিনিসটা ছিল লাল। রক্তের মত লাল। বিভিন্ন ধরনের পিঙ্ক কালারের আরো লিপস্টিক ছিল সেখানে। কিন্তু লালটাই আমাকে আকর্ষণ করছিল।
আয়নার দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। নিজের একটা লিপস্টিক থাকাটাই আমাদের মধ্যে বড় পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। লিপস্টিকটা মুঠোয় শক্ত করে চেপে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।
আমি জানি না বাকি জীবন আমি কী করে বেঁচে থাকব। আর সেই সময়েই, নভেম্বরের শেষের দিকে এক সন্ধ্যায় আমি আবার আমার বোনের কণ্ঠ শুনতে পেলাম।
২
দিনটা ছিল নভেম্বরের ৩০ তারিখ। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে আমি একটা বড় বুকস্টোরে গিয়েছিলাম। কলেজ ভর্তি পরীক্ষার উপর একটা বই কেনা দরকার ছিল। যদিও কলেজে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই আমার আর নেই। আপু যখন বেঁচে ছিল তখন অনেক কিছু ছিল যা আমার জানতে, শিখতে ইচ্ছা করত। এখন আর ইচ্ছা করে না। পড়াশোনা করি শুধুমাত্র আর কিছু করার নেই সেজন্য।
আমার যে বই দরকার ছিল সেগুলো ছিল দোকানের পেছনের দিকের সেলফে। সেখানে গিয়ে একদম উপরের সেলফের বাম পাশ থেকে বইয়ের নামগুলো দেখছিলাম। সেলফের ডান পাশে এসে পরের সেলফটায় খুঁজতে লাগলাম বইটা।
পাওয়া গেল না। নিচু হয়ে নিচের সেলফটায় খুঁজতে লাগলাম ডান থেকে বামে। হঠাৎ এক জোড়া কালো জুতো সরে যেতে দেখলাম। সেলফের সারিতে হারিয়ে গেল।
আমার মনে হল কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নার্ভাস লাগছিল আমার। আবার সেলফের বই দেখতে লাগলাম।
এমন সময় কেউ একজন আমার পিছে এসে দাঁড়াল। ফ্লুরোসেন্ট লাইটের আলোয় আমার যে অস্পষ্ট ছায়া সেলফটার উপর পড়ছিল, সেটা বেড়ে গেল।
কোন পায়ের শব্দ আমার কানে আসেনি, অথচ তারপরেও কেউ একজন আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। যথেষ্ট কাছে। চাইলেই ছুঁতে পারবে এতটা কাছে। আমি তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।
আমি জানতাম সে আমাকে জাপটে ধরবে। এই দোকানে এইরকম কাহিনী আগে হয়েছে শুনেছিলাম। কিন্তু আমার গলা থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছিল না। আমার পা দুটোও বেঈমানি করছিল। আমি এতটাই ভয় পেয়েছিলাম যে ঘুরে দেখার সাহসও পাচ্ছিলাম না। আমার পুরো শরীর পাথরের মথ শক্ত হয়ে গিয়েছিল।
“কিছু মনে করবেন না, এমন সময় কেউ একজন আমার ডানদিক থেকে বলে উঠল। একটা অল্প বয়স্ক ছেলের গলা। “আপনি মনে হয় মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া ধরনের লোক। ঐ যে সিলিঙের সাথে লাগানো আয়নাটা দেখতে পাচ্ছেন? ঐ আয়নাতে আপনাকে খেয়াল করেছি। ভালো,ভালো, খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। কিন্তু আমাকে একটু এদিক দিয়ে ওদিকে যেতে হবে। কিছু মনে না করলে একটু সরে দাঁড়াবেন?”
তৃতীয় কেউ একজন এসেছে এই ব্যাপারটা জাদুর মত কাজ করল, আমি আবার নড়াচড়া করতে সক্ষম হলাম। আমি ঘুরে দেখি কালো ইউনিফর্ম পরাএকটা ছেলে দুটো সেলফের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার পেছনে দাঁড়ানো লোকটা দ্রুত সরে গেল। ছেলেটার থেকে দৌড়ে পালাল। আমি খালি তার পেছন দিকটা দেখতে পেলাম। দেখে মনে হল স্যুট জ্যাকেট পরাসাধারণ একজন লোকের মত। সে এত আজবভাবে দৌড়ে পালিয়ে গেল যে আমার ভয় সাথে সাথে উবে গেল।
“ধন্যবাদ,” ছেলেটাকে বললাম।
ছেলেটা আমার চেয়ে লম্বা ছিল, আর শুকনো। কিন্তু ওর মধ্যে কিছু একটা ছিল যে কারনে ওকে দেখে দূর্বল মনে হচ্ছিল না। কালো ইউনিফর্মটা চিনতে পারলাম আমি, ঐ স্কুলের একটা ছেলেকে আমি চিনতাম।
“ধন্যবাদের কোন প্রয়োজন নেই, আমি আসলে আপনাকে সাহায্য করতে আসিনি,” সে সাদামাটাভাবে বলল, অভিব্যক্তির কোন চিহ্ন নেই চেহারায়।
“তুমি বলতে চাইছ তুমি শুধুই এদিক দিয়ে যেতে চাইছিলে?”
“আসলে তোমার সাথে কথা বলতে এসেছিলাম। তুমি কিটাযাওয়া নাটসুমি, তাইনা? তুমি দেখতে অনেকটাই তোমার বোনের মত। এক দেখাতেই চিনে ফেলেছি।”
এ ধরনের কথার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম, কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছু বলার আগেই ছেলেটা আবার কথা বলে উঠল।
‘হিরোকো মারা যাওয়ার আগে ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। তোমার কথা সে আমাকে বলেছিল…।”
“এক মিনিট দাঁড়াও…কে তুমি?” এইটুকুই খালি আমি বলতে পেরেছিলাম।
ছেলেটা যদিও আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। এর বদলে ইউনিফর্মের পকেট থেকে সে একটা সাধারণ বাদামি রঙের খাম বের করল। যেরকম খাম সবজায়গায় পাওয়া যায়। খামের ভেতরে কিছু একটা ছিল, ফুলে ছিল।
“এটা তোমার জন্য,” খামটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল সে। হতভম্ব অবস্থায় খামটা হাতে নিলাম। খুলে ভেতরে দেখলাম। একটা স্বচ্ছ খাপের ভেতর ক্যাসেট টেপ দেখা গেল।
“দুঃখিত, কিন্তু তুমি ভেতরের জিনিসটা নিয়ে খামটা কি আমাকে ফেরত দিতে পারবে?” তার কথা মত আমি তাই করলাম। টেপটা বের করে খালি খামটা ফেরত দিয়ে দিলাম। সে সেটা ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল।
সাধারণ একটা ক্যাসেট টেপ। যে কোন দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। উপরে একটা স্টিকার লাগানো। “কণ্ঠ ১: কিটাযাওয়া হিরোকো।” লেখাটা হাতে লেখা না, প্রিন্ট করা।
“এটা কি? এখানে আমার বোনের নাম লেখা কেন?”
“সেটা শুনলে বুঝতে পারবে। কিটাযাওয়া হিরোকো যখন বেঁচে ছিল তখন এটা আমাকে দিয়েছিল। আমি চাইছিলাম জিনিসটা তোমাকে শোনাতে, তাই রেখে দিয়েছিলাম। আরো দুটো টেপ আছে। পরে দেব। অবশ্য যদি তুমি কাউকে আমার কথা বল তাহলে সেটা আর কখনো হবে না।”