আমার বোন ছিল মিশুক। সারাক্ষণ হাসিখুশি। বয়ফ্রেন্ড ছিল। ওর বন্ধুরাও ওকে পছন্দ করত। বাসায় ফোন আসলে ওর ছাড়া আর কারো হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল। অস্থির ধরনের, অনেক রকম কাজের সাথে যুক্ত, বাসায় অলস বসে থাকা ওর জন্য দুর্লভ একটা ব্যাপার। এমনকি আমার চোখে মনে হত ওর থেকে উজ্জ্বল দ্যুতি বের হচ্ছে সবসময়।
অন্যদিকে, আমি আমার পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করছি। সারাদিন কেটে যায় ডেস্কে বসে। মনে হয় যেন কত বছর আমি আমার পেন্সিলের টোকার শব্দ ছাড়া কিছু শুনিনি। কোনভাবে ফ্রি টাইম বের করতে পারলে ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ি।
জুনিয়র হাই শুরু করার পর থেকে আপু বাসার বাইরে বেশি সময় কাটাতে লাগল। এমন সব জায়গায় যেতে লাগল যেখানে আমি কখনো যাইনি। এমন সব মানুষের সাথে সময় কাটাতে লাগল যাদের কখনো দেখিনি। ঘন্টার পর ঘন্টা আমি একা বাসায় থাকতে লাগলাম পড়াশোনা করে। শুধুমাত্র আমাকে সে টেনে বের না করলে বাসা থেকে বের হতাম না। কিন্তু এই বদলটা ছিল স্বাভাবিক, আর যতদূর মনে হয় আমি তখনো আমার সুন্দরি, হাসিখুশি, মিশুক বোনটাকে ভালোবাসতাম।
আমি প্রায়ই আপুর বাইরে ঘুরে বেরোনোর সাথে আমার বাসায় পাথরের মত বসে থাকার তুলনা করতাম। তার মানে এই না যে, আমি হীনমন্যতায় ভুগতাম, আমার বোনের জন্য আমি গর্ব বোধ করতাম আসলে।
যাইহোক, সে সম্ভবত আমাকে নিয়ে বিব্রতবোধ করত। আমি উপলদ্ধি না করলেও আমার জীবনধারা নিয়ে ওর হয়তো কোন সমস্যা ছিল।
ও ভালো মানুষ ছিল। যদিও ও আমার উপর ওর অসন্তুষ্টি সরাসরি কখনো প্রকাশ করেনি কিন্তু আমি নিশ্চিত ও সবসময় চেষ্টা করত যাতে সেটা প্রকাশ না পায়। ও কখনো আমাকে বলেনি, ও আমাকে অপছন্দ করে, ও শুধু ওর বিরক্তি ঢেকে রাখার চেষ্টা করত। যে কারনে আমার ব্যাপারটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল।
হয়তো আমি যেরকম ভাবতাম সেরকমভাবে আমার বোন কখনোই আমাকে ভালবাসত না..
আমার ধারণা সত্য কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় ছিল না আমার কাছে, কিন্তু এই একটা মাত্র ব্যাখ্যাই ছিল যা আমি কল্পনা করতে পারি।
কেন? এই একটা প্রশ্ন করলেই হতো, কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ও যখন জীবিত ছিল তখন কেন আমি সাহস করে প্রশ্নটা করতে পারিনি? হয়তো উত্তরটা জানলে কষ্ট হতে পারত কিন্তু তারপরেও তো সেটা এখনের এই অবস্থার চেয়ে ভালো হত?
আমার বোনের এখন উত্তর দেয়ার সব ক্ষমতা হারিয়ে গেছে আর আমি আমার প্রশ্ন নিয়ে পড়ে আছি। প্রতিবার যখন ওর কথা ভাবি, প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
আপু না থাকায়, বাসাও স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। যেন রাতের পর ভোর কখন আসবে সেই অপেক্ষা চলছে, কিন্তু আসছে না। ব্যাপারটা এতটাই অন্যরকম যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় একই জায়গা মাত্র দু-মাস আগেই একদম অন্যরকম ছিল।
বাবা-মাও বোনের মৃতদেহ দেখার পর থেকে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছেন। তাদের চেহারা অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ সময়ই তারা সেফ চুপচাপ বসে টিভি দেখেন। টিভিতে যদি কোন কমেডি শো চলে তাহলেও তারা এক বিন্দু হাসেন না। শুধুই তাকিয়ে থাকেন। প্রতিবার তাদের দিকে তাকালে আমার মনে হয় তারা হয়তো তাদের বাকি জীবন এরকমই থেকে যাবেন।
তাদের চেহারা মনে হত সেইসব মানুষের চেহারার মত যারা বোঝার চাপে অন্য কিছু অনুভব করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
আমার মা এখনো রান্না করেন। অভ্যাস থেকে করেন, রোবটের মত দৈনন্দিন কাজ করে যান।
কিন্তু যখন ঘরের কোনায় ধুলোবালি চোখে পড়ে তখন কান্না পায় আমার। তাদের জন্য কষ্ট হয়। আপু যখন বেঁচে ছিল তখন মা সবকিছু ঝেড়ে মুছে পরিস্কার রাখতেন। আর এখন সবকিছুর উপর ধুলোর স্তর জমে গিয়েছে। তাদের চোখেও পরছে না কিছু। তারা সম্ভবত চিন্তা করছেন তাদের মেয়ে ছোটবেলায় কিভাবে হাসত, কিভাবে তাকে প্রথম কোলে নিয়েছিল। সেই ওজনটা অনুভব করার চেষ্টা করছেন।
আর সেই নিস্তব্ধ বাড়িতে আমার উপস্থিতি কারো চোখে পড়ে না। বাবাকে যদি কিছু বলি তাহলে উনি অস্পষ্টভাবে মাথা নাড়ান খালি। অন্যদের চোখে হয়তো আমাকেও আমার বাবা-মায়ের মতই দেখায়। আমার বন্ধুরা বলেছে আমিও নাকি আর আগের মত হাসি না।
রাতের বেলা মাঝেমাঝে আপুর রুমে গিয়ে ওর চেয়ারে বসে থাকি আর নানান কিছু ভাবি। আমার রুমের পাশেই ওর রুম। ও বেঁচে থাকার সময়ে যদি আমি না বলে ওর রুমে ঢুকতাম তাহলে ও ভীষণ ক্ষেপে যেত।
এখন কেউ রুমটা ব্যবহার করে না বোঝা যায়। ডেস্কে হাত রাখলে ধুলো হাতে লাগে।
ও যখন বেঁচে ছিল আর এই চেয়ারে বসত, তখন কি নিয়ে ভাবত? আমি ওর চেয়ারে বুকের সাথে হাঁটু ভাঁজ করে বসে, আশেপাশের ফার্নিচারগুলোর দিকে তাকালাম। পর্দাগুলো সরানো ছিল, জানালার বাইরে রাতের অন্ধকার।
জানালায় আমি আমার মুখের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিলাম, এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল চেহারাটা আমার না, আপুর। পরে বুঝলাম প্রতিফলন দেখছি। আমরা হয়তো একইরকম দেখতে, নইলে এরকম ভুল মনে হবে কেন।
সেলফের উপর একটা আয়না ছিল। ওটার দিকে হাত বাড়ালাম নিজের চেহারাটা খুঁটিয়ে দেখার জন্য। আয়নার পাশে ছোট একটা সিলিন্ডারের মত জিনিস ছিল, দেখতে লিপস্টিকের মত। আয়না না নিয়ে ওটা হাতে নিলাম।