পুলিশ মৃতদেহ সম্পর্কে কিছু জানায়নি যে, কারনে তথ্যের অভাবে খবরের কাগজের আগ্রহও শিগগিরি নিচের দিকে পড়তে শুরু করে। খুনের সাত সপ্তাহ পর পুলিশ এবং প্রেস উভয়ই আমাদের বাসায় আসা থামিয়ে দেয়।
***
আমার বোন ছিল আমার চেয়ে দু-বছরের বড়। যখন খুন হয় তখন বয়স ছিল মাত্র বিশ।
ফিফথ গ্রেডে পড়ার সময় আপু জুনিয়র হাই শুরু করেছে মাত্র। নতুন ইউনিফর্ম পরা শুরু করেছে। আমি যখন এইটথ গ্রেডে উঠলাম, সে তখন হাই-স্কুলে তার সামনে উন্মুক্ত নতুন পৃথিবী নিয়ে কথা বলছে। আমি সবসময় দেখতে পাচ্ছিলাম দু-বছর পর আমার সামনে কি অপেক্ষা করছে। আমার বোন ছিল একটা জাহাজের মত, যা কিনা গভীর সমুদ্রে আগে আগে পথ দেখিয়ে যেত।
যদিও আমাদের বয়সের পার্থক্য ছিল দুই বছরের কিন্তু আমাদের উচ্চতা ছিল প্রায় একই রকম, আর লোকজন বলত আমরা দুজন দেখতে নাকি একই রকম। যখন আমরা দুজনেই ছোট বাচ্চা ছিলাম, একবার নিউ ইয়ার্সে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম, তখন যাদের সাথে দেখা হয়েছিল সবাই একই কথা বলেছিল আমাদের।
“মোটেও কোন মিল নেই!” আপু বলল। ওকে আমার মতই হতবুদ্ধি দেখাচ্ছিল।
আমরা যতদূর জানতাম, আমাদের দুজনের চেহারা ছিল একদম আলাদা। তাহলে মিলটা কোথায়? এই চিন্তা সবসময় আমাকে ধাঁধাঁয় ফেলত। কিন্তু তারপরেও সেই ট্রিপে, আমি যখন বাড়ির এক পাশে অন্য বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে খেলছিলাম, একজন আন্টি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দারুন অবাক হয়েছিলেন। বলছিলেন আমাকে নাকি মাত্র অন্য জায়গায় খেলতে দেখে এসেছেন!
যখন আমরা ছোট ছিলাম, আমার আর আপুর মধ্যে অনেক খাতির ছিল। আমরা সবসময় একসাথে খেলাধুলা করতাম। সে আমার হাত ধরে আমাকে তার বন্ধুদের বাসায় নিয়ে যেত।
সেই ব্যাপারগুলো কিভাবে বদলে গেল? আমি কবে আমার বোনের সাথে শেষ কথা বলেছি কিংবা হাসাহাসি করেছি তা মনেও করতে পারি না আর।
কয়েক বছর আগে আমাদের মধ্যে ছোট একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। স্পষ্ট কিছু ছিল না, তাই আমাদের আশেপাশের কেউ ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। এমনকি দূরত্ব বলার মত বড় কিছুও ছিল না। কিন্তু আপু যখন আমার সাথে কথা বলত, ওকে দেখে মনে হত কিছুটা বিরক্ত।
একবার, আমি লিভিং রুমের সোফায় বসে ছিলাম। আঙুল তুলে যে ম্যাগাজিনটা পড়ছিলাম সেটা দেখিয়ে মাত্র পড়া ইন্টারেস্টিং একটা আর্টিকেলের কথা বলছিলাম। এইটুকুই করেছিলাম শুধু। কিন্তু আপু ম্যাগাজিনের দিকে তাকাল, তারপর ওর মুখ শুকিয়ে গেল। কি জানি অস্পষ্ট কিছু বলল তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমার মনে হলো ও আমার উপর বিরক্ত আর সেটা লুকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম না।
হয়তো আমি না বুঝে কিছু একটা করেছিলাম যে কারনে সে বিরক্ত হয়েছিল, কিংবা সে হয়তো অন্য কিছুতে মগ্ন ছিল আর আমি কথা বলে বাধা সৃষ্টি করেছিলাম। এসব বুঝ দিয়ে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে, এসবের পেছনে আসল কোন কারণ নেই। ওর বিরক্তি হয়তো আমার কল্পনা হয়ে থাকতে পারে কিন্তু শুধু সে সময়ই এরকম ব্যাপার ঘটেনি।
যেমন, আরেকদিন, স্কুল থেকে বাসায় আসার পর। আপু ওর এক বন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলছিল। কর্ডলেস রিসিভারে হাসাহাসি করছিল। আমি সোফায় বসে চুপচাপ টিভি দেখছিলাম, ওর কথাবার্তায় কোন ঝামেলা সৃষ্টি করিনি।
এক সময় ওর কথা শেষ হলো। রুম হঠাৎ করে একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমরা দুজন মুখোমুখি আলাদা আলাদা সোফায় বসে নিরবে টিভি দেখছিলাম। আমি ওকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওর চেহারায় এমন কিছু একটা ছিল, যে কারনে ইতস্তত করছিলাম। এক মুহূর্তে আগেও সে ফোনে অনেক মজা করছিল, আর এখন আমার সাথে একা এক রুমে মুখ গোমড়া করে আছে। সেই উষ্ণতা ওর মধ্যে থেকে উধাও হয়ে গেছে, আর আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অদৃশ্য একটা দেয়াল।
আমি যদি নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম তাহলে সে আমাকে থামিয়ে দিত। ওকে ক্ষিপ্ত দেখাত। আমাদের মধ্যে কোন কথা হলে ওর উত্তর হত চাঁছাছোলা ধরনের। যেন যত দ্রুত সম্ভব কথাবার্তা শেষ করার চেষ্টায় আছে। মায়ের সাথে কথাবার্তার চেয়েও দ্রুত।
আমার কোন ধারণা ছিল না কারণটা কী, যে কারনে আরো ভীত ছিলাম আমি। কিছু না বললেও আমার শরীর কিভাবে যেন আপুর মেজাজ টের পেত। আমি ওর আশেপাশে থাকতে সাহস করতাম না। ধীরে ধীরে ওর সামনে থাকা বা এক রুমে থাকা আমার উপর অনেক চাপ সৃষ্টি করত। সারাক্ষণ টেনশনে থাকতাম।
“নাটসুমি, তোমার এইটা আর পড়া ঠিক হচ্ছে না,” ছয় মাস আগে হঠাৎ আপু আমাকে বলল, যখন আমি বুকস্টোরে যাচ্ছিলাম কিছু গাইড বই কিনতে। সে আমার সাদা উলের কার্ডিগানের দিকে ইঙ্গিত করে কথাটা বলেছিল। ভালো করে দেখলে কিছু উল উঠে থাকা দেখা যায়। অনেক ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল কার্ডিগানটা।
“কিন্তু এটা আমার পছন্দ,” আমি বললাম।
“খুব ভাল,” ও মুখ ঝামটা দিয়ে আমার দিক থেকে ঘুরে বসল, যেন ওর কিছু আসে যায় না। আমার মনে হচ্ছিল দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে আসছে আমার চারপাশে।
আমরা দুই বোনের হয়তো, লোকজন যেমন বলে, চেহারায় মিল থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের পছন্দ-অপছন্দ আর ব্যক্তিতু একদম দুই মেরুতে।