মোরিনোকে মিথ্যে বলেছি আমি। কিটাওয়া হিরোকোর নতুন হেয়ারস্টাইলের কোন ছবি কোথাও ছাড়া হয়নি।
১
মাঝেমাঝে আমার পরিবারের লোকজন কিছুদিনের জন্য বাসায় থাকে না। বাবা হয়তো কোন বিজনেস ট্রিপে যায়। কিংবা মা তার কোন বন্ধুর সাথে কোথাও ঘুরতে যায়। এরকম সময়ে বাসাটাকে অদ্ভুত রকমের খালি খালি লাগে। চারজন যখন বাসায় একসাথে থাকি তখন কিন্তু এরকম লাগে না। আমি যখন ফিল্ড ট্রিপে বাইরে গিয়েছিলাম তখন আমার বাবা-মা, বোনেরও এরকম অনুভূতি হয়েছিল। কেমন যেন কি জানি একটা নেই ধরনের অনুভূতি। যখন পরিবারের সদস্য আবার বাসায় ফিরে আসে তখন সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যায়। বাসার সাইজটা আমাদের জন্য ঠিক ছিল, আরামদায়ক কিন্তু ছোট। যে কারনে প্রতিবার টিভির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আপর ছড়িয়ে রাখা পায়ের সাথে হোঁচট খেতে হতো।
আমরা চারজন ছিলাম…কিন্তু এখন যখন আপু আর কখনো ফিরে আসছে না, টেবিলে সবাই একসাথে বসলে সবসময় একটা অতিরিক্ত চেয়ার রাখা হয়।
কেউ জানে না কেন আমার বোন খুন হয়েছে। আমার বড় বোন, কিটীযাওয়া হিরোকো, সাত সপ্তাহ আগে খুন হয়েছে। ওর সাথে আমাদের শেষ দেখা হওয়ার বারো ঘন্টা পর ওকে খুন করা হয়েছিল। আর লাশটা পাওয়া গিয়েছিল শহরের শেষ মাথার এক পরিত্যক্ত হাসপাতালে।
ঐ হাসপাতালের ভেতরে আমার কখনো যাওয়া হয়নি। কিন্তু একবার বাইরে থেকে দেখেছিলাম, আপুর লাশ পাওয়া যাওয়ার পর। শীতল একটা জায়গা, মরা ঘাস ছাড়া আর কিছু নেই। মাটিতে নুড়ি বেছানো, বাতাসে বালি উড়ে আমার জুতো সাদা হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালটা বিশাল ছিল, পরিত্যাক্ত একটা কংক্রিটের দালান, যেন একটা গুবরে পোকা। জানালার সব কাঁচ ভাঙা, ভেতরটা অন্ধকার।
আমার বোনের লাশ পাওয়ার পর সেখানে গিয়েছিলাম। যে কারনে প্রবেশপথ আটকানো ছিল টেপ দিয়ে। ভেতরে যাওয়া আসা করছিল।
কিছু বাচ্চাকাচ্চা সেখানে লাশটা খুঁজে পেয়েছিল। পুলিশ কাউকে কোন তথ্য দেয়নি, তবে যে রুমে ওকে পাওয়া যায় সেটা ছিল একটা অপারেটিং চেম্বার।
লাশের দেহ এতটাই ক্ষগ্রিস্ত হয়েছিল যে পরিচয় জানার কোন উপায় ছিল না। ব্যাগটা কাছাকাছি পাওয়া যাওয়ার পর পুলিশ আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। আমার মা ফোনটা ধরেছিল।
সময়টা ছিল দুপুরের কাছাকাছি, আপুকে শেষ দেখার পর একদিনও পার হয়নি তখনও। যে কারনে আমার মা প্রথমে ভেবে নিয়েছিলেন কেউ ফোনে তার সাথে শয়তানি করছে।
কিন্তু লাশটা নিশ্চিতভাবে আমার বোনেরই ছিল। আমরা যারা ওর কাছাকাছি মানুষ-বাবা, মা, আমি, আমার বোনের বয়ফ্রেন্ড আকাগি, আমরা ওকে সনাক্ত করিনি। মেডিক্যাল চার্ট আর জটিল ফরেনসিক টেস্ট থেকে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।
ও কিভাবে খুন হয়েছিল কিংবা কি অবস্থায় ওকে পাওয়া গিয়েছিল সে ব্যাপারে পুলিশ তেমন কোন তথ্য প্রকাশ করেনি। সবাই শুধু এটুকুই জানত যে ওকে গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করা হয়েছিল তারপর কোন ধরনের চুরি দিয়ে কাটা হয়েছিল। এইটুকু তথ্যই হৈচৈ ফেলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু আসল ঘটনা এরচেয়ে অনেক বিভৎস ছিল।
পুলিশের ধারণা সত্য প্রকাশ পেলে সমাজের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, যে কারনে তারা সবকিছু গোপন রেখেছিল। এমন কি যেসব বাচ্চাকাচ্চা লাশটা খুঁজে পেয়েছিল তাদেরকেও মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল।
আমার বাবা-মা দাবি করেছিলেন তাদেরকে লাশ দেখাতে হবে। পুলিশ তা চায়নি। লাশের যে অবস্থা ছিল তা কাউকে দেখানো সম্ভব ছিল না। তারা বলেছিল না দেখলেই বরং আমাদের জন্য ভালো হবে।
যখন আমার বোন জীবিত ছিল আমার বাবা-মা তখন তাকে খুব ভালোবাসত বলে আমার মনে হয়নি। ওদের ভেতর সম্পর্কটা ছিল খুবই সাধারণ ধরনের-টিভি কমার্শিয়াল নিয়ে কথা বলা, খবরের কাগজ কোথায় গেল সেই নিয়ে কথা চালাচালি…ইত্যাদি। আমরা এরকম ধরনের পরিবার। তারা কখনো বাইরের লোকের কাছে মেয়েকে নিয়ে বড়াই করেনি, তারা ওকে কতখানি ভালবাসত তা আমি জানতামও না। অন্তত মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর তাদের কান্না না দেখা পর্যন্ত।
“দয়া করে ওকে দেখতে দিন!” আমার বাবা মরিয়া হয়ে অনুনয় করলেন। তার মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল, ক্ষিপ্ততার লক্ষণ। যখন পুলিশ আর ডাক্তার বুঝতে পারল কোনভাবেই আমার বাবা-মা কে আটকানো যাবে না, তখন লাশ যেখানে রাখা ছিল সেখানে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের ঢুকতে দিতে বাধ্য হলো।
তাদেরকে হলের ডাবল দরজা দি য়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলাম। আমি নিজে প্রচণ্ড আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম, বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে কেউ সাহস করে লাশটা দেখতে চাইতে পারে।
একজন ডাক্তার আর ডিটেক্টিভের কথাবার্তা শুনে ফেলেছিলাম। তারা টের পায়নি যে আমি সিঁড়ির ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছি।
ডিটেক্টিভটা বলছিল সবগুলো টুকরো সংগ্রহ করতে তাদের কত সময় লেগেছিল।
মেঝেতে আমার জুতো লেগে শব্দ হওয়ায় সে ঘুরে দাঁড়ায় আর আমাকে দেখে ফেলে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে ধরে।
টুকরো। আমার বোনের শরীরের টুকরো। আমি দাঁড়িয়ে থেকে তথ্যগুলো হজম করার চেষ্টা করছিলাম।
বাবা-মা যখন মর্গ থেকে বেরিয়ে এলেন আমি লাশের ব্যাপারে তাদের কাছে জানতে চাই, কিন্তু তারা পুরোপুরি বাবা হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ একটু আগেও তারা অঝোরে কাঁদছিলেন। কিন্তু রুম থেকে বের হওয়ার পর তারা আর একবারের জন্য কাঁদেননি। মনে হচ্ছিল তারা যেন তাদের সকল অনুভূতি ঐ রুমটায় রেখে এসেছেন। তাদের চেহারাগুলো অদ্ভুত রকমের হলদেটে দেখাচ্ছিল, যেন অনুভূতিশূন্য কোন মুখোশ পড়িয়ে দেয়া হয়েছে।