মেয়েটাকে টেবিলের উপর রাখা ছিল।
“কিটাওয়া হিরোকো?” আমি জানতে চাইলাম।
মোরিনোর ভ্রূ কিছুটা উঁচু হলো। না খেয়াল করলে বোঝা যেত না। এভাবে সে অবাক হওয়া প্রকাশ করে।
“তুমি ধরতে পেরেছ তাহলে!”
“ইন্টারনেটে পেয়েছে এটা?।”
“একজন দিয়েছে আমাকে। পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে মেয়েটার খবরের আর্টিকেলগুলো কাটছিলাম তখন একজন এসে দিয়েছে। হ্যাঁ ঐ মেয়েটারই ছবি এটা, কিন্তু তোমার জায়গায় আমি হলে অনুমান করতে পারতাম না।”
মোরিনো ইয়োরু দেখতে সুন্দরি। তাই অন্য স্কুলের ছেলেরাও এসে গায়ে পড়ে ওর সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করে। আমাদের স্কুলের কেউ ওর ধারে কাছে যায় না, সবাই ভালো করেই জানে এসবে ওর কোন আগ্রহ নেই।
যাই হোক, কেউ একজন ওকে লাইব্রেরিতে বসে এইসব অস্বাভাবিক খবর সংগ্রহ করতে দেখেছে আর সেটাকে সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে।
সে আমার হাত থেকে ছবিটা নিয়ে চোখের কাছে নিয়ে ভালো করে দেখল। “তুমি কি করে এক দেখাতেই বুঝলে এটা ওর ছবি?”
“ছবিতে মেয়েটাকে…মানুষ হিসেবে বুঝতে পারার অবস্থা নেই।” মোরিনো বিড়বিড় করে এরকম কিছু বলল, আমি অনুমান করে নিলাম।
“ছবিতে কিটাযাওয়া হিরোকোর মাথাটা টেবিলের উপর রাখা। চুলের স্টাইল আর গঠন দেখে আমি অনুমান করে নিয়েছি ছবিটা ওর।”
“ওহ্, আচ্ছা,” সে বলল।
ছবিটা যে দিয়েছে তার সম্পর্কে জানতে চাইলাম, কিন্তু মোরিনো কোন উত্তর দিল না।
বাসায় গেলে ইন্টারনেটে সার্চ করে দেখতে হবে।
জানালার দিকে তাকালাম, অন্ধকার ছাড়া বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। অনন্ত গভীর আঁধার। ক্লাসরুমের ভেতরটা সাদা আলোয় উজ্জ্বল হয়েছিল। জানালার প্রতিফলনে বেঞ্চগুলোকে বাইরের আঁধারে ভাসমান মনে হচ্ছিল।
“পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে-যারা খুন করে আর যারা খুনের শিকার হয়।”
“হঠাৎ এই কথা? কি বলতে চাইছ?”
ব্যাপারটা পরিস্কার যে কিছু মানুষ অন্য মানুষদের খুন করে কোনরকম কোন কারণ ছাড়াই। আমি জানি না এর পেছনে তাদের বেড়ে ওঠার কোন কারণ কাছে কিনা, নাকি তারা জন্ম থেকেই এরকম। সমস্যা হলো, এই লোকগুলো তাদের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখে, সাধারণ মানুষের ভেতর সাধারন মানুষের মতই বসবাস করে। তারা এমনভাবে লুকিয়ে থাকে যে অন্য মানুষের সাথে তাদের কোন পার্থক্য চোখে পড়ে না।
কিন্তু একদিন, তাদের সামনে খুন করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকে না। সাধারণ জীবন থেকে বেরিয়ে শিকার ধরতে যেতে হয়।
আমি নিজেও এরকম একজন মানুষ।
আমি অনেক খুনির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি। ঐ চোখগুলোকে মাঝেমাঝে মানুষের চোখ বলে মনে হয় না, অন্য কিছু মনে হয়। পার্থক্যটা খুবই সামান্য, চোখে না পড়ার মতই, কিন্তু তাদের চোখের ভেতরে কোথাও থেকে অপার্থিব কিছু একটা বিচ্ছুরিত হয়।
যেমন বলা যায়, যখন কোন সাধারন মানুষ আমার সাথে কথা বলে তখন তারা বিশ্বাস করে যে আমি একজন মানুষ আর একজন মানুষের মতই আচরণ করে।
কিন্তু খুনিদের সাথে আমার সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা ভিন্ন রকমের। আমি যখন তাদের চোখের দিকে তাকিয়েছি, আমার মনে হয়েছে তারা যেন আমাকে একটা বস্তু হিসেবে দেখছে, একজন জীবিত মানুষ হিসেবে নয়।
“তো…”
আমি মোরিনোর প্রতিফলনের দিকে তাকালাম।
“তুমি নিশ্চয়ই ওকে খুন করনি, নাকি করেছ..?” ছবির মেয়েটার চুল রঙ করা আর কোঁকড়ানো-খবরের কাগজের ছবিটার সাথে কোন মিল নেই। তাহলে তুমি কিভাবে জানলে এটা কিটাযাওয়া হিরোকোর ছবি?”
মোরিনোর কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হলো ওর মাথা আজকে ভালোই কাজ করছে।
ওর চোখে খুনিদের চোখে দেখা অপার্থিব বিচ্ছুরণের কোন চিহ্ন নেই। ও মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখে। মনে হয় না ও কখনো কোন মানুষকে খুন করতে পারবে। অন্য মানুষের তুলনায় ওর আগ্রহ হয়তো একটু অন্যরকম, কিন্তু তারপরেও ও একজন স্বাভাবিক মানুষ।
মোরিনো আর আমার মধ্যে অনেক কিছুতে মিল থাকলেও এই ব্যাপারটায় পার্থক্য আছে। খুবই মৌলিক পার্থক্য, মনুষ্যত্ব আর…অন্য কিছুর পার্থক্য।
সে একজন মানুষ, যেই পক্ষ সবসময় শিকার হয়। আমি ঐ পক্ষের নই।
“আরেকটা ছবি আছে, ওর চুলের স্টাইল বদলানোর পর তোলা। মেয়েটার পরিবারের অনুমতি ছাড়া ছবিটা ছাড়া হয়েছিল, যে কারনে খুব বেশি লোক দেখেনি। ঐ ছবিটা দেখে আমি মিলটা ধরতে পেরেছি।”
“ও আচ্ছা, সে আমার অজুহাত গ্রহণ করল।
আমি বাসায় গিয়ে আমার রুমের কম্পিউটার অন করলাম। কিটাযাওয়া হিরোকোর লাশের ছবি ইন্টারনেটের সবখানে খুঁজলাম। রুমের বাতাস বাসি
আর ভারি হয়ে উঠল। আমি কিছুই খুঁজে পেলাম না।
বুককেসের পেছনে লুকানো ছুরিগুলো বের করলাম। ব্লেডের উপর আমার চেহারার প্রতিফলন দেখছি। বাইরের বাতাসের শব্দ কানে আসছে। শুনে মনে হচ্ছিল ছুরিগুলো দিয়ে খুন করা মানুষগুলোর আর্তনাদের শব্দ।
কেন জানি মনে হয় ছুরিগুলোর নিজস্ব কোন শক্তি রয়েছে আর তার আমাকে ডাকছে। কিংবা হতে পারে আমার মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা গোপন বাসনা ছুরির চকচকে ব্লেডে প্রতিফলিত হচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে অন্ধকারে ফুটে থাকা শহরের আলো দেখা গেল। উপরে ফ্যাকাসে রঙা আকাশ।
আমার হাতে ধরা ছুরি থেকে একটা শব্দ ভেসে এল যা ছুরি হওয়ার কথা নয়। মনে হচ্ছিল যেন ছুরিটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠার শব্দ পাচ্ছিলাম।