জানালাটা খুলে দিয়ে ঘরের ভেতরে ঠান্ডা বাতাস ঢুকতে দিলাম, গন্ধটা বেরিয়ে যাক। জানালা ঠান্ডায় ঘেমে ঘোলাটে হয়ে ছিল, বাগানের ভেতর কুয়াশা।
জানালার বাইরে দেখলাম আমার বোন দাঁড়িয়ে আছে। সোয়েটার আর স্কার্ফ দিয়ে নিজেকে পুরো মুড়িয়ে ফেলেছে।
জানালা খোলার সময় আমাদের চোখাচোখি হলে ও হাত নাড়াল। কুকুরটা ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ওটার কলারের সাথে লাগানো একটা রশির আরেক মাথা আমার বোনের হাতে ধরা।
“আমি ওকে বের করতে পারছি না। উঠোনের উপর কিছু একটা ওর পুরো মনোযোগ টেনে ধরে রেখেছে, কুকুরটাকে দেখিয়ে বলল সে। কুকুরটা আমাদের উঠোনের দেয়াল আর পাশের বাসার দরজার মাঝের মাটি শুঁকতে শুঁকতে থাবা মারছিল। যেন খুঁড়ে দেখতে চায়।
“আহহা আমাদের হাতে সময় নেই! চল বের হই!” ও রশি ধরে টানতে লাগল কুকুরটাকে। হেঁটে আসার পর স্কুলের জন্য তৈরি হতে হবে ওকে। কুকুরটা মনে হলো ওর কথা বুঝতে পেরেছে। ওর পিছু পিছু গেল। বাতাসে ওদের নিঃশ্বাস ধোঁয়ার মত দেখাচ্ছিল।
মা আমাকে বলল জানালাটা বন্ধ করতে। আমি জানালাটা লাগিয়ে বাগানে গেলাম। বাগানের সীমানায় একটা বড় পাথর ছিল, সেটা টেনে এনে কুকুরটা যে জায়গাটা খোঁড়ার চেষ্টা করছিল সেখানে রাখলাম। আশা করা যায় এরপর আর চেষ্টা করবে না। আমি চাই না ও সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি করুক। আর কয়েক মিনিট খুঁড়লেই একগাদা কাটা হাত বেরিয়ে পড়ত আমার বোনের সামনে। এই বছরের শুরুতে আমি সেগুলো ওখানে পুঁতে রেখেছিলাম। ওগুলো নিয়ে বাসায় ফেরার পর নিরাপদ কোথাও লুকিয়ে রাখা দরকার ছিল। আর আমার বোনের তো এসব অস্বাভাবিক জিনিস খুঁজে পাওয়ার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে, আবারো সেই প্রমাণ পাওয়া গেল।
ভেতরে গিয়ে খবরের কাগজের বাকিটা পড়লাম। মা জানতে চাইল ইন্টারেস্টিং কোন খবর আছে কিনা, আমি মাথা নাড়লাম। কিটাযাওয়া হিরোকো সম্পর্কে নতুন কিছু নেই খবরে।
সাত সপ্তাহ আগে আমাদের এলাকার কাছেই একটা পরিত্যক্ত বিল্ডিঙে কিটাযাওয়া হিরোকোর লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। পরিত্যক্ত বিল্ডিংটা এককালে একটা হাসপাতাল ছিল। জায়গাটা শহরের সীমানার মধ্যে হলেও আশেপাশে কোন কিছু ছিল না। জায়গাটা ছিল সিটি সেন্টারের পরে পাহাড়ি এলাকার দিকে একটা নুড়ি বিছানো পথের শেষ মাথায়। মরচে ধরা চেইন লিঙ্ক বেড়া দিয়ে পুরো জায়গাটা ঘেরা ছিল। বিল্ডিংটা ভেঙে না ফেলে কেন ফেলে রাখা হয়েছিল কে জানে। বছরের পর বছর পরিত্যক্ত থাকায় বিল্ডিঙের আশেপাশে মরা ঘাস ছাড়া আর কিছু ছিল না।
এলিমেন্টারি স্কুলের তিনটা বাচ্চা বিল্ডিংটা ঘুরে দেখতে গিয়ে কিটাযাওয়া হিরোকোর লাশ খুঁজে পায়। তিনজনকেই এখন কাউন্সেলিং নিতে হচ্ছে।
লাশটা খুঁজে পাওয়ার পর সমস্ত টিভি চ্যানেল আর খবরের কাগজ কেসটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে। কিন্তু এখন তাদের আগ্রহে ভাটা পড়েছে। খবর কমতে কমতে প্রায় নাই হয়ে যাচ্ছে। ফলে তদন্তের অগ্রগতি কতদুর তা জানার এখন আর উপায় নেই।
খবরের আর্টিকেলগুলোতে মেয়েটার একটা ছবি আর কিভাবে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল সেই গল্প ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমি আর্টিকেলগুলো পত্রিকা থেকে কেটে জমিয়ে রেখেছি।
ছবিটা তোলা হয়েছিল যখন সে জীবিত ছিল তখন। হাসিখুশি একটা মেয়ে, সাদা দাঁতগুলো ঝলমল করছে, কালো লম্বা চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। এই ছবিটা ছাড়া আর কোন ছবি দেখানো হয়নি কোথাও।
পুলিশ কি জানতে পেরেছে কে মেয়েটাকে খুন করেছে?
সেদিন সন্ধ্যায় যখন ক্লাস শেষ হলো, ততক্ষণে বাইরে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। ফুরোসেন্ট লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, জানালায় আলো
প্রতিফলিত হয়ে আয়নার মত দেখাচ্ছে। ক্লাস শেষে শিক্ষার্থীরা সবাই দৌড়ে রুম থেকে বের হলো। জানালার দিকে তাকিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, ছেলেমেয়েদের স্রোতের মধ্যে একটা অবয়ব অনড় বসে আছে। মেয়েটার কালো চুলগুলো লম্বা আর সোজা। ত্বকের রঙ এতটাই ফ্যাকাসে যে দেখে মনে হয় বরফের তৈরি। মেয়েটার নাম মোরিনো ইয়োরু।
ক্লাসে শুধু আমরা দু-জন রয়ে গেলাম।
“তুমি কি কিছু বলতে চাও?” আমি জানতে চাইলাম। লাঞ্চের পর আমার কানে ফিসফিস করে বলেছিল ক্লাসের পরে থাকতে।
“লাশের একটা ছবি পেয়েছি।”
সবার জীবন যার যার মত করে চলে। আপনি যদি একশজন মানুষকে বেছে নেন, তাহলে এক ধরনের জীবনধারা পাবেন। আর সবাই নিজেদেরটা বাদে অন্যদের জীবনধারা বুঝে উঠতে সমস্যায় পড়ে।
মোরিনো আর আমার জীবনধারাও অন্যরকম। সাধারণের চেয়ে আলাদা। মৃতদেহের ছবি আদান-প্রদান করা এই জীবনধারার সাধারণ একটা অংশ।
ও ওর ব্যাগের থেকে লেটার সাইজের একটা কাগজ বের করল। কাগজটার উপর চকচকে একটা ব্যাপার ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল সাধারণ কোন কাগজ নয়, ছবি প্রিন্টের জন্য এই কাগজ ব্যবহার করা হয়।
ছবিতে একটা খোলা কংক্রিট রুম দেখা যাচ্ছে। প্রথম যা আমার চোখে পড়ল তা হলো সবকিছু কেমন যেন লাল হয়ে আছে।
ছবির মাঝামাঝি একটা টেবিল রাখা, ওটার উপরের অংশও লাল। আশেপাশের মেঝেও লাল। সিলিং এবং দেয়ালও…উজ্জ্বল লাল নয়, একটু গাঢ় ধরনের লাল, আলো জ্বালালে রুমের কোনায় যেরকম অন্ধকার হয় অনেকটা সেরকম।