ছেলেটার কথা শেষ হতেই লাইন কেটে গেল। ফোন হাতে বিড়বিড় করতে করতে বলল, “তাইতো, একটু বেশি সকালেই ফোন করে ফেলেছি।” মোরিনো জানেও না ওর হারানো আইডি কার্ডের কারনে সেইকির জীবনে কি তোলপাড় হয়ে গিয়েছে।
তে শুরু করেছে। পোর্চে বসে পুবে তাকিয়ে সেইকি চিরহরিৎ গাছগুলোর সারি দেখতে পাচ্ছিল। গাছগুলোর কালো ছায়ার পেছনে আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। সাদা কুয়াশা ইতিমধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে।
ছেলেটা এসে সেইকির বাম দিকে বসল।
দু-জনে অনেকক্ষণ বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে চেয়ে থাকল। যে কোদাল দিয়ে গর্ত ভরাট করা হয়েছে তা ছেলেটার পাশে মাটিতে ফেলে রাখা ছিল।
সূর্য গাছগুলো ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেলে আলো এসে ওদের মুখে পড়ল। আলোর উজ্জলতায় কিছুক্ষনের জন্য সেইকির মনে হল অন্ধ হয়ে গিয়েছে। ছেলেটার শরীরে আলো পড়লেও, মুখ ছায়ার ভেতর ছিল। ফলে চোখগুলো আরো ওর স্মৃতিতে গেঁথে গেছে।
ছেলেটার চোখগুলোতে কোন অনুভুতির ছোঁয়া ছিল না। একদম শূন্য। ওগুলো দেখতে ছিল একদম সেইকির চোখের মত যখন ও শিকার খুঁজতে যাওয়ার আগে রিয়ারভিউ মিররে নিজের চেহারা দেখেছিল। চোখগুলো জুড়ে গভীর অন্ধকার।
সেইকি টের পেল ওর অনুভূতিগুলো নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছে, অশ্রু শেষ, মাথাও আর ঝিমঝিম করছে না।
“আমার..” সেইকি বলল।
ছেলেটা ওর দিকে ঘুরল, মনোযোগ দিল ওর দিকে।
“আমার মনে হয় পুলিশকে আমার সব কিছু জানানো উচিত, যা যা করেছি আমি,” কথাগুলো ওর ঠোঁটগুলো থেকে যেন গড়িয়ে পড়ল। সব টেনশন কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। আবার ওর চোখ দিয়ে অশ্রু বেয়ে পড়তে লাগল। এবার আর কষ্টের অশ্রু নয়, সূর্যের আলোতে সেগুলো চকচক করছে।
ওর জীবন হয়তো এখানেই শেষ। অনেকেই হয়তো ওকে ঘৃণা করবে এখন, তাদের দৃষ্টি ওর দেহে তীরের মত গিয়ে বিধবে। কিন্তু ওর আর কিছু আসে যায় না। ও ওর সমস্ত পাপের স্বীকারোক্তি করবে আর শাস্তির জন্য অপেক্ষা করবে-একজন মানুষ হিসেবে ওর যা করা উচিত।
“আমি আনন্দিত…আমি আনন্দিত যে এই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।”
কত অসংখ্যবার সে নিজের ভেতরের মনুষ্যত্বের অভাবের কারনে কষ্ট পেয়েছে? কত অসংখ্যবার সে নিজের সত্তার জন্য, ওর ঘৃণ্য আকাথাগুলোর জন্য নিজেকে অভিশাপ দিয়েছে? কিন্তু এখন অবশেষে ওর অবশিষ্ট মনুষ্যত্ব যা রয়েছে তা জয়ী হয়েছে।
“আমি জানি আমার পাপ এতে মাফ হয়ে যাবে না, কিন্তু নিজের কাছে ভালো লাগছে যে আমি সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছি।”
ছেলেটা ওর মুখ খুলল। “আপনি জেলে যেতে চাইলে আমি কোন বাধা দেব না, কিন্তু সেইকি, আপনি কি আরো ছয় মাস অপেক্ষা করতে পারবেন?”
সেইকি কারণ জানতে চাইলে ছেলেটা উঠে দাঁড়াল।
“আমি এখন বাসায় যাচ্ছি। সেইকি, দয়া করে ছয় মাস অপেক্ষা করুন। ছয় মাস না পারলে অন্তত এক মাস পরে পুলিশের কাছে যান। যদি আপনি আসলেই অতটা অনুতাপ বোধ করে থাকেন, তাহলে পুলিশকে গিয়ে বলুন আপনি কী কী করেছেন।”
তারপর সেইকিকে প্রতিজ্ঞা করাল ছেলেটা আর ইয়োৰু সম্পর্কে মোরিনো পুলিশের কাছে যেন কিছু না বলে।
“মনে রাখবেন, সে এরকমই চেয়েছিল। এ নিয়ে নিজেকে অপরাধি মনে করার কোন কারণ নেই। আপনি যদি ওকে উদ্ধার করতে চান তাহলেও সে বাধা দেবে। কিন্তু আপনার সবাইকে জানাতে হবে আপনি কী করেছেন। আমি কোন সূত্র রাখিনি। আপনি যদি কাউকে আমার কথা বলেনও, কেউ বিশ্বাস করবে না আমি এখানে ছিলাম।”
ছেলেটা ওর জুতো পরে পোর্চ থেকে নেমে গেল।
সেইকি ওর শেষের কথাগুলো কিছু বুঝতে পারল না। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ছেলেটা নিরবে কোন বিদায় না জানিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেটা চিরহরিৎ গাছগুলোর মধ্য দিয়ে উধাও হয়ে গেল, পেছনে ফেলে গেল সকাল, বাগান আর সেইকিকে।
সে মহর্তে সেইকি ওর কথাগুলো উপলদ্ধি করতে পারল, ছেলেটা যদি একা বাড়ি ফিরতে থাকে তাহলে বয়ফ্রেন্ডটা কি এখানেই কোথাও রয়ে গিয়েছে?
সেইকি উঠে দাঁড়াল।
ওর মনে একটা সন্দেহ জেগেছে।
কাঁপা কাঁপা পায়ে ও খালি পায়ে বাগানে নামল। ওর নিঃশ্বাস সকালের ঠান্ডা বাতাসে ধোঁয়ার মত আকার নিচ্ছিল।
বাগানের শেষ মাথার বাঁশের খুঁটিগুলো নিখুঁতভাবে সোজা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কফিনটা আবার খুঁটিগুলোর নিচে কবর দেয়া হয়েছে।
সবচেয়ে কাছের খুঁটিতে সেইকি কান পাতল।
ভেতর থেকে হালকা একটা স্বর ভেসে আসছে, কফিনের দেয়ালে যেন প্রতিধ্বনি তুলছে সেটা। কফিনের ভেতর একজন পুরুষ কণ্ঠ, ফোঁপানোর কারনে একটু আঁটকে যাচ্ছে তার শব্দ। মেয়েটার নাম বার বার প্রতিধ্বনি তুলছে সেই কণ্ঠ।
৬. কণ্ঠ
কণ্ঠ
প্রস্তাবনা
ইদানিং আমার বোন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়েই কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে যায়। নভেম্বরের শেষ, তাই বেশ ঠান্ডা পড়েছে। দরজা খুললে সকালের ঠান্ডা বাতাস ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে।
সেদিন সকালে সে বরাবরের মত বাইরে যাওয়ার জন্য ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে দরজার দিকে যাচ্ছিল। আমি টেবিলে বসে নাস্তা খেতে খেতে খবরের কাগজের ‘শোক সংবাদ’ পড়ছি।
মা একটু আগেই ঘরের কোনায় একটা কেরোসিন হিটার জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। যে কারনে তেলের গন্ধে সারা ঘর ভাসছে। গন্ধে মনে হচ্ছিল মাথার ব্রেইনসেল মরে যাচ্ছে। আর সেই মুহূর্তেই একটা আর্টিকেল পড়ল আমার চোখে। হিটার থেকে বের হওয়া কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ায় এক শিশুর মৃত্যু।