চাঁদের আলোয়, মাটিতে কোদালের কোপ পড়া ছাড়া আর কোন শব্দ ছিল না। সেইকি ওর পুরো মনোযোগ কাজের মধ্যে ঢেলে দিয়েছিল। বনের কালো দেয়ালগুলো মনে হচ্ছিল চারপাশ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে কাজ কারবার দেখছে। রাতের ভ্যাপসা বাতাসে চিরহরিৎ গাছগুলো থেকে ভেসে আসা গন্ধ আরো জোরালো হয়ে নাকে এসে লাগছিল।
সেইকি অনুভব করছিল যে মাটি কেটে কোদাল ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। কোদাল টেনে তোলার সময় মাটির ভারও টের পাচ্ছিল। কিন্তু ওর মনে হচ্ছিল ও যেন কোন দুঃস্বপ্নের মধ্যে আটকা পরে গিয়েছে। সেই একই কাজ অনন্তকাল ধরে করে যাচ্ছে কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। একসময় ওর বিশ্বাস হচ্ছে না যে, ও আসলেই বাস্তব পৃথিবীতে অবস্থান করছে কিনা। সে হয়তো মনুষ্যরুপি কোন কিছু যা আঁধারের ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে কোনভাবে আর অনন্তকাল ধরে মাটি খুঁড়ে যাচ্ছে।
ওর হাত ব্যথা করতে লাগল। ও নিশ্চিত যে ওর হাতে মেয়েটার খামচে দেয়া দাগগুলো কোন অভিশাপ বয়ে এনেছে।
ওর পায়ের তলে আসলে কি মাটি চাপা দেয়া ছিল? যত গর্ত বড় হতে লাগল তত ওর আত্মবিশ্বাস কমতে লাগল। গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। প্রতি কোপে মাটি তোলার পর ওকে কাঁধ দিয়ে চোখ মুছতে হচ্ছিল দৃষ্টি পরিস্কার করার জন্য। যে জিনিসটা মটিতে কবর দেয়া হয়েছে সেটার কথা ভাবতেই ওর আতংক বোধ হচ্ছিল। ওর করা জঘন্য অপরাধ আসলে সেখানে শুয়ে আছে। ওর মনে হচ্ছিল সেটা কোন আয়নার মত কিছু একটা হবে, ওর ভেতরে লুকিয়ে থাকা অমানুষটার প্রতিফলন মাত্র।
সেইকির মনে হচ্ছিল ও অনন্তকাল ধরে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এক সময় কাজ শেষ হলো। যে কাঠের বাক্সটা ও বানিয়েছিল সেটা একসময় গর্তের ভেতর দেখা দিল। গর্তের চারপাশ তখন সাদা কুয়াশা আর মাটির ঘ্রাণ ঘিরে রেখেছে, চাঁদের ফ্যাকাসে আলোতে স্নানরত। ঢাকনাটা পেরেক দিয়ে আটকানো ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল না খোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ঢাকনার উপর বৃদ্ধাঙ্গুলির সমান দুটো গর্ত। বাক্সটা ওর আতংক বাড়িয়ে দিল। মনে হচ্ছিল যেন কোন ঠান্ডা অন্য জগতের থেকে আসা কোন বস্তু। ফোঁপাচ্ছে। সেইকি ক্রোবার দিয়ে ঢাকনাটা ভোলা শুরু করল।
প্রথম যে জিনিসটা ওর ইন্দ্রিয়তে ধরা পড়ল তা হল রক্তের গন্ধ। গন্ধটা এত জোরালো ছিল যে ওকে ধাক্কা দিয়ে পিছে সরিয়ে দিল। তারপর ও দেখল একটা ইউনিফর্ম পরা মেয়ে শুয়ে আছে। পিঠ নিচে রেখে হাত দুটো বুকের উপর রাখা। মুখটা একদিকে বাঁকানো, আর পুরো বাক্স গাঢ় একধরনের তরলে ডুবে আছে।
রক্ত! মেয়েটার গলা থেকে বের হওয়া রক্ত। ওর হাতে একটা মেকানিক্যাল পেন্সিল ধরা। ঠিক যেমনটা সে বলেছিল, পেন্সিল গলায় ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
রক্ত নিশ্চয়ই ফোয়ারার মত ছিটকে বেরিয়ে ঢাকনায় লেগেছে। সেইকি গর্ত থেকে সরে গিয়ে নিজের গালে চড় লাগাল। বাগানের দেয়াল ধরে কাঁপতে লাগল। হাটুগুলো আর ওর শরীরের ভার বহন করতে পারছে না, বসে বমি করে ফেলল ও। সারাদিন কিছু না খাওয়ায় এসিড রস ছাড়া আর কিছুই বের হল না পেট থেকে।
“আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন, মেয়েটা মোরিনো ইয়োরু নয়..”
কথাগুলো কানে আসতেই সেইকি ভয়ে কেঁপে উঠল। প্রথমে ও ভেবেছিল কথাগুলো ওর নিজের মাথা থেকে এসেছে কিন্তু কথাগুলো আসলে বলেছিল সকালে যে ছেলেটার সাথে ওর দেখা হয়েছিল।
“সেইকি, আপনি সেফ ওকে মোরিনো ভেবেছিলেন।”
কারো পায়ের শব্দ সেইকির কানে এল। সেইকি মুখ উঁচু করে দেখতে পেল কুয়াশার ভেতর থেকে একটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো পেছন দিকে থাকায় অবয়বের চেহারা দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু তারপরেও সেইকি নিশ্চিত ছিল অবয়বটা ঐ ছেলেটা ছাড়া আর কেউ নয়।
দূর থেকে আরেকজনের পায়ের শব্দ আসতে শোনা গেল। চিরহরিৎ গাছগুলোর আড়ালে আরো কেউ একজন ছিল। তারা দুজন সেইকিকে পাশ কাটিয়ে কবরটার দিকে গেল। অন্য ছেলেটিও একই বয়সেরই হবে খালি একটু লম্বা আর গাট্টাগোট্টা ধরনের। সেইকি চাঁদের আলোতে ছেলেটার মুখ দেখলেও চিনতে পারল না।
কি হচ্ছে এখানে? সেইকি কিছু বুঝতে পারছিল না। এটা কি বাস্তব নাকি ও কোন স্বপ্ন দেখছে? নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব ছিল না সেইকির পক্ষে। সেইকি দেখল লম্বা ছেলেটা মাথা ঝাঁকাল আর কাঁদতে লাগল।
“ও আমাদের ক্লাসমেট। যে মেয়েটাকে আপনি কবর দিয়েছিলেন সে ছিল ওর গার্লফ্রেন্ড। ওর নাম…।”
ছেলেটা যে নাম বলল সেটা সেইকি আগেই শুনেছিল।
“ওহ…তাহলে ও হলো সেই ছেলে…”
মেয়েটা যে ছেলের নাম বলেছিল।
ছেলেটা গর্তে নেমে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। সেইকি খালি ওর পিঠ দেখতে পাচ্ছিল। ছেলেটা মেয়েটার নাম ধরে ডাকছিল। সেইকি দেখল ওর পিঠ কাঁপছে, সম্ভবত মেয়েটার কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছিল ছেলেটা।
মেয়েটার সাথে কথা বলছিল সে। প্রথমে আস্তে আস্তে, যেন মনে হচ্ছিল মেয়েটা ওর সাথে মজা করছে-কিন্তু পরে যখন দেখল মেয়েটা একদমই উত্তর দিচ্ছে না, ওর গলার স্বরও পাল্লা দিয়ে জোরালো হতে লাগল।
“যে মেয়েটাকে দেখলেন ওর চেহারায় কোন তিল ছিল?” সকালের ছেলেটা জিজ্ঞেস করল। সেইকি মাথা নাড়ল।
“সকালে যখন আপনি বললেন একটা মেয়েকে আপনি প্রতিদিন রাস্তায় দেখেন কিন্তু আজকে দেখেননি…মেয়েটার চোখের নিচে একটা তিল আছে। তখনই আমি আপনাকে সন্দেহ করি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আপনি মোরিনো আর এই মেয়েটার মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছেন।”