“সেইকি, সুখবর আছে,” ছেলেটা জোরে শ্বাস ফেলল, ওকে দেখে মনে হলো স্বস্তি বোধ করছে। “মোরিনো কালকে নিখোঁজ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু একটু আগে সে বাড়ি ফিরে এসেছে।”
৪
দেয়ালের ঘড়ি মাঝরাতের জানান দিল যখন, সেইকি তখন নিজের রুমে আলো নিভিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিল। ওর সারা শরীর কাঁপছিল। সূর্যাস্তের আগে থেকেই এরকম অবস্থা। এখন আর ও বলতে পারবে না গরম লাগছে নাকি ঠান্ডা লাগছে…অথবা জীবিত আছে নাকি মরে গেছে।
ঘড়ির বড় কাটা শব্দ করে আরেক ঘর এগুলো। সেই মুহূর্তে জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঠিক জায়গায় গিয়ে পড়ল। সাদা আলোয় সবকিছু চকচক করছে। আলো চোখে পড়তেই অবশেষে মনস্থির করে উঠে পড়ল সেইকি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গ্যারেজে ঢুকে কোদাল নিল। আর একটা ক্রোবার, কফিনের ঢাকনা খোলার জন্য। তারপর বাগানে গেল।
পৃথিবী আঁধারে পুরোপুরি নিমজ্জিত না হওয়া পর্যন্ত ও অপেক্ষা করছিল। দিনের বেলা হলে ওর ভয় ছিল কেউ হয়তো দেয়ালের ওপাশ থেকে দেখে ফেলবে ও কি করছে। কিন্তু যতই ও অপেক্ষা করছিল রাতের জন্য ততই ওর কল্পনা ওকে কাবু করে ফেলেছে, পাগল বানিয়ে ফেলেছে ওকে। ভয়ে কাবু হয়ে ও প্রায় জ্ঞান হারাতে বসেছে, কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই ছয় ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছিল।
চিরহরিৎ গাছগুলো পার হয়ে ও খোলা জায়গাটায় হাজির হলো। দেয়ালের সাথে বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকিয়ে পা বাড়াল সামনে। হাতের পেছন দিকটা ব্যথা করছে, ঠিক যেখানে গত রাতে মেয়েটা আঁচড় দিয়েছিল।
সেইকি বুক সমান বাঁশের খুঁটিগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল, খুঁটিগুলো মেয়েটার কফিনের সাথে সংযুক্ত। সেইকির হাত এত ব্যথা করছিল মনে হচ্ছিল কেটে রক্ত বের হচ্ছে।
ও কোদাল দিয়ে কুপিয়ে গর্ত খুঁড়তে শুরু করল।
অন্ধকারে কাজ করছিল, কেউ যাতে টের না পায়। আর সারাদিন আকাশ জুড়ে মেঘ থাকলেও, রাতে আকাশ একদম পরিস্কার। ঠিক গত রাতের মতই চারপাশ চাঁদের ফ্যাকাসে আলোতে স্নান করছে। রাস্তা থেকে কোন শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না, আর ও নিজেও নিরবে কাজ করে যেতে লাগল। একমাত্র শব্দ আসছিল মাটির উপর কোপ পড়া ওর কোদাল থেকে। ওর তখনও মাথা ঝিমঝিম করছে। জ্বর হলে শরীর যেমন দূর্বল লাগে সেরকম লাগছে। গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে ও মনে করার চেষ্টা করল ছেলেটা পোর্চে বসে কী বলেছিল।
“শুনে মনে হলো ওর উপর দিয়ে কঠিন সময় গিয়েছে, কিন্তু এখন ও ঠিক আছে, নিরাপদে আছে। মাত্রই ফোনে কথা বললাম। ওর বাসায় যাচ্ছি এখন-আমাকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
চা ঠান্ডা হওয়ার আগেই ছেলেটা কথাগুলো বলে উঠে বো করে তারপর বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো।
সেইকি প্রায় পলক না ফেলে ছেলেটার কথা শুনল, কথাগুলোর অর্থ ওর মগজে প্রবেশ করছিল না। কি বলছে এসব? কোনভাবেই মেয়েটার পক্ষে মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।
ছেলেটা বেরিয়ে যাওয়ার আগে সেইকির এরকম ধাঁধায় পড়া চেহারা খেয়াল করল না।
সেইকি পোর্চ থেকে নেমে জুতো পড়ে ওর পিছু পিছু গেল।
“মেয়েটা…মেয়েটা বাসায় ফিরে এসেছে..?”
অবশ্যই মিথ্যা কথা হবে। কিন্তু প্রশ্নটা না করে ও পারল না।
“হ্যাঁ। কথা শুনে মনে হলো এখনো শকের মধ্যে আছে। চিন্তা করবেন না, আশা করছি সে তাড়াতাড়িই ধকল কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে।”
ছেলেটা গেট দিয়ে বের হয়ে পার্কের দিকে এগিয়ে গেল।
সেইকি গেট পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেল। গেটে হাত রেখে ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করতে করতে ছেলেটার চলে যাওয়া দেখল।
ছেলেটা চৌরাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে মোড় নেয়ার সময় কাকে যেন হাত নাড়ল। সেইকির ওখান থেকে দেখা যাচ্ছিল না অন্য মানুষটিকে। পরের মুহূর্তেই মানুষটি রাস্তার কোনা থেকে এসে ছেলেটির পাশে দাঁড়াল। লম্বা চুলের মেয়েটিকে এক নজর দেখেই সেইকি চিনে ফেলল।
চিনে ফেললেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না ও। হা করে মেয়েটার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকল-সুন্দর চেহারা, ফ্যাকাসে রঙের তৃক। এই মেয়েকে সে গতকাল নিজ হাতে জ্যান্ত কবর দিয়েছে। ছেলেটার সাথে কথা বলছিল মোরিনো।
সেইকি কি স্বপ্ন দেখছে? ওর এত মাথা ঘোরাচ্ছে যে আশেপাশের বাড়িঘর, টেলিফোনের খাম্বা সব নড়তে লাগল। রাস্তা আর দেয়ালগুলো পুকুরের পানিতে সৃষ্ট ঢেউয়ের মত নড়াচড়া করছে…
ও বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকাল, যেখানে মেয়েটাকে কবর দিয়েছে। সেখানে দৌড়ে গেল এবার। যে মুহূর্তে সেইকি ওদের থেকে চোখ ফেরাল, ছেলেটা ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে আছে কিন্তু সেইকির মাথায় তখন একমাত্র চিন্তা কবরটাকে নিয়ে।
মেয়েটাকে যেখানে কবর দিয়েছে সেখানে গিয়ে বাঁশের খুঁটি দিয়ে কথা বলল সেইকি। কোন উত্তর পেল না। নিচ থেকে কোন শব্দ এল ভেতর দিয়ে খালি গাঢ় অন্ধকার দেখা যাচ্ছিল।
মেয়েটা নিশ্চয়ই পালিয়েছে।
না, সেইকি এই ধারনাটা বাতিল করে দিল। কবরের মাটি এদিক ওদিক হয়নি। তাহলে…তাহলে সে কাকে কবর দিয়েছে..?
বাঁশের খুঁটি দিয়ে সে কয়েকবার ডাকল, অন্ধকার নেমে আসা পর্যন্ত। কিন্তু মেয়েটা একবারও উত্তর দিল না। অনেক মাথা ঘামিয়েও সেইকি এই রহস্যের কোন অর্থ বের করতে পারল না। এক পর্যায়ে গিয়ে ও সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে রাত গম্ভীর হওয়ার পর ঢাকনা খুলে দেখছে।