“এখানে কোন গাছ নেই?”
“পোর্চ থেকে দেখার জন্য খালি রাখা,”
…সেগুলোর নিচে আছে মেয়েটা…আর কৌসুকির অবশিষ্টাংশ যদি কিছু থেকে থাকে।
বাঁশের খুঁটিগুলো দেয়ালের সাথে সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে, নড়ছে না। ছেলেটা ওগুলোর দিকে তেমন একটা মনোযোগও দেয়নি, ভেবেছে বাগানেরই অংশ। কিন্তু মেয়েটা যদি নিচ থেকে খুঁটি ধরে নাড়ায়? ছেলেটা হয়তো অবাক হয়ে কি হচ্ছে তা দেখতে যাবে।
তার আগেই সেইকির ব্যাপারটা থামাতে হবে। সে ছেলেটাকে বলল পোর্চে বসতে।
“আমি চা বানিয়ে আনি,” বলে সেইকি পোর্চে উঠে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।
“কে জানে মোরিনো কোথায় উধাও হল..” ছেলেটা বিড়বিড় করে বলছে ও শুনতে পেল। সেইকি জমে গিয়ে ছেলেটার দিকে পেছন থেকে তাকাল।
“আমি বোঝাতে পারব না ব্যাপারটা, কিন্তু ওর ভেতর কি যেন একটা আছে…কিভাবে যেন সবসময় অদ্ভুত মানুষদের আকর্ষণ করে,” ছেলেটা সেইকির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল। ব্যাপারটা নিশ্চিত যে কথাগুলো বিড়বিড়িয়ে বললেও ছেলেটা চাইছিল সে শুনতে পাক। ওর ঐ চারপাশের ‘কি যেন’ এর কারনে অস্বাভাবিক লোকজন ওর পিছু নেয়।”
“এক মিনিট-আমি চা নিয়ে আসছি,” সেইকি ছেলেটাকে বলে চলে এল। ও নিশ্চিত না ছেলেটা ইচ্ছা করেই বিষয়টা তুলে আনল কিনা, তবে ওর কথার সুরে নিশ্চিত একটা অশুভ ব্যাপার লুকিয়ে ছিল।
কিচেনে গিয়ে চায়ের জন্য পানি গরম করতে করতে সেইকি ড্রয়ারে রাখা কিচেন নাইফগুলোর দিকে তাকাল। খুন করার জন্য আর কোন অস্ত্র ওর মাথায় আসছে না।
গ্যাস স্টোভের নীলচে আগুনে কেটলির পানি গরম হতে শুরু করল। একটা ট্রে তে কাপ আর টিপট নিল। ছুরিটা সেগুলোর পাশে রাখল। ছুরিটার ব্লেডের ধাতব উজ্জ্বলতায় ও কল্পনা করার চেষ্টা করল যে ছুরিটা ও পোর্চে বসে থাকা ছেলেটার পিঠে বসিয়ে দিচ্ছে।
সিঙ্কের কোনায় ভর দিয়ে সেইকি ভারসাম্য ঠিক রাখল, নাহলে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে মনে হচ্ছিল। মেয়েটাকে কবর দেয়ার পর যে আনন্দ হয়েছিল তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ওর মনে। বরং ওর মনে হচ্ছিল যেন কোন ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখছে। যা কিছু সে দেখছে, যা কিছু স্পর্শ করছে সবকিছু পচে দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার আসলে সে নিজেই। কৌসুকিকে খুন করেছে ও, মেয়েটাকেও জ্যান্ত কবর দিয়েছে। এখন এই ছেলেটাকেও কুপিয়ে হত্যা করতে চলেছে। মেয়েটার তার বয়ফ্রেন্ডের উপর বিশ্বাসের সাথে তুলনা করলে ওর নিজের হৃদয়ের অবস্থা করুণ। ওর দুঃস্বপ্নের শুরু হয়েছে আসলে কৌসুকিকে খুন করার পর থেকেই।
কিংবা হয়তো ও এই দুঃস্বপ্নে জড়িয়ে গিয়েছে জন্ম নেয়ার পর থেকেই। যে মুহূর্তে ও ওর জীবন পেয়েছে, তখনই হয়তো ওর আত্মা কোনভাবে খুন করার লিপ্সায় আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
পানি ফুটে গিয়েছে, কেটলির মুখ দিয়ে বাষ্প বের হচ্ছে। সেইকি চুলা বন্ধ করতে গিয়ে উপলদ্ধি করল..
কৌসুকি…
বাস্প বেড়ে গেল, কেটলির ভেতর উন্মত্ত হয়ে পানি ফুটছে।
কৌসুকির চেহারা কেমন ছিল দেখতে..?
সেইকি কিছুতেই ওর চেহারা মনে করতে পারছিল না। বাচ্চা ছেলেটাকে ও খুন করেছে। ওর সাথে কতবার পার্কে খেলেছে, কিন্তু কিছু মনে পড়ছে না। যেন লাশ মাটির সাথে মিশে যাওয়ায় ওর স্মৃতিও হারিয়ে গিয়েছে সাথে সাথে।
সেইকির সমস্যাটা কোথায় আসলে? উত্তরটা ওর জানা নেই। ওর কিছু অংশ ছিল একজন ভালো মানুষের, যে কিনা সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে। আর কিছু অংশ ছিল দানবের, যে জীবন্ত মানুষ কবর দিয়ে মজা পায়। এই দুই অংশ নিজদের মধ্যে যুদ্ধ করে মাল্টিপল পারসোনালিটির মত। অথচ তারা ভিন্ন ভিন্ন মানুষ নয়-তারা একসাথে যুক্ত, একই মানুষ।
কিন্তু সে ক্ষেত্রে ও আসলে কোন মানুষটা। কোন মানুষটা ও ভাবত ও ছিল? ও আর নিজেকে বিশ্বাস করতে পারে না এখন। তাহলে ও কিসে বিশ্বাস করবে?
ট্রে থেকে ছুরিটা হাতে নিল সেইকি। হাত কাঁপছে ওর…
স্টোভটা নিভিয়ে পটটা ভরল ও। তারপর পোর্চে বসে থাকা ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল।
সেইকি নিঃশব্দে হাটে। কোনায় পৌঁছুতে ও পোর্চে বসা ছেলেটার পিঠ দেখতে পেল, বাগানের দিকে মুখ দিয়ে বসে আছে। ছেলেটার কানে সেল ফোন ধরা। সে কি পুলিশকে ফোন করছে? এক মুহূর্তের জন্য সেইকি আতংকিত হয়ে পড়ল।
নিঃশব্দে সামনে এগুলো ও।
ছেলেটার ফোনে কথা বলা ওর কানে আসছিল। কথা বলার ভঙ্গি থেকে ও বুঝতে পারল, পুলিশ নয় কোন বন্ধুর সাথে কথা বলছে সে।
ছেলেটার পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে পায়ের নিচের তক্তা ক্যাচকোচ করে উঠল।
ছেলেটা ঘুরে তাকিয়ে ফোন কেটে দিল। “সেইকি, এত সময় লাগল যে! আপনাকে আরো অসুস্থ দেখাচ্ছে এখন..”
সেইকি ছেলেটার পাশে ট্রেটা নামিয়ে রাখল। “হ্যাঁ, আসলে…আমার বেশ মাথা ঘোরাচ্ছে..” কাপে চা ঢালল।
মনের ভেতরে বাস করা দানবটাকে দমিয়ে রাখতে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। কাপটা ছেলেটার হাতে দিয়ে ও মনস্থির করতে লাগল।
ছুরিটা সে কিচেনে রেখে এসেছে। কৌসুকির চেহারা যখন ও আর মনে করতে পারল না তখন বুঝল ওর আর কিছু করার নেই। দুঃস্বপ্ন থেকে পালিয়ে যাওয়ার এটাই একমাত্র উপায় ওর সামনে।
কাপটার ফ্যাকাসে সবুজ তরল থেকে সাদা ধোঁয়া উঠছিল। ছেলেটা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, তারপর চুমুক না দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখল।