কেউ একজন দোলনায় বসে আছে। অন্যদিকে মুখ করে আছে বলে সেইকি ওর কালো পোশাকের পেছন দিক ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছে না।
আশেপাশে আর কোন জন মানুষ দেখতে না পাওয়ায় সেইকি স্বস্তি বোধ করল। ওর দুশ্চিন্তা হচ্ছিল যে পুলিশ হয়তো সেখানে হাজির হয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সেরকম কিছু দেখা গেল না। ওর আসল ভয় ছিল ওর আগে অন্য কেউ ওর আইডি কার্ডটা খুঁজে পাবে।
সাইডওয়াকের মাঝে মাঝে কিছুদূর পর পর গাছ লাগানো। রাস্তায় কোন গাড়ি ছিল না। একদম সুনসান, খালি রাস্তা।
বাতাস বইলেই শুকনো পাতাগুলো ঝরে পড়ছিল। উড়ে কোথাও যাচ্ছে, সেফ বৃষ্টির মত সোজা খসে পড়ছে। আগেরদিন পাতা পরিস্কার করা হলেও আজকেই সাইডওয়াকের প্রায় পুরোটা আবার ঝরা পাতায় ঢেকে গিয়েছে। রাস্তার উপর পাতা কম ছিল, কারণ গাড়ি গেলে পাতাগুলো বাতাসে উড়ে যায়। অবশ্য একখানে শুকনো পাতাগুলো স্তূপ করে রাখা ছিল।
গতরাতে যেখানে গাড়ি থামিয়েছিল সেখানে সেইকি খুঁজে দেখল। পাওয়া গেল না। হত পাতার নিচে কোথাও অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। প্রচুর পাতা পড়ে ছিল সেখানে।
সেইকি হাঁটু গেড়ে বসে পাতা সরিয়ে খুঁজতে লাগল। পুরো সাইডওয়াক খোঁজার দরকার নেই, যেখানে ওর সাথে মেয়েটার ধস্তাধস্তি হয়েছিল সেটুকু জায়গা দেখলেই হবে। ওর মনে হচ্ছিল শিগগিরি আইডি কার্ডটা পাওয়া যাবে।
পাতাগুলো সরানোর সময় বাতাস এসে সেগুলোকে দূরে উড়িয়ে নিয়ে গেল। সেইকি সেদিকে চেয়ে মেয়েটার কথা ভাবতে লাগল।
বাক্সের ভেতরটা অন্ধকার। মেয়েটা যদি খুঁটির ফুটো দিয়ে তাকায় তাহলে একটা বিন্দুর মত আলো দেখতে পাবে। আর কোন আলো প্রবেশ করবে না। ঐ ছোট অন্ধকার বাক্সের ভেতর মেয়েটার শুয়ে শুয়ে নিজের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। অথচ সে দাবি করছে তার বয়ফ্রেন্ড তাকে একা মরতে দেবে না।
সেটা জেনে অবশ্য সেইকি কেঁপে উঠেছিল। ব্যাপারটা ওর মাথায় ঢুকছিল না, যে কারনে দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। মাটির নিচে একটা বাক্সে আটকা পড়ে থেকে কি করে তুমি কারো উপরে ভরসা করতে পার? কি করে আশা করতে পার কেউ তোমার সাথে অনন্তকাল সঙ্গ দেয়ার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবে?
গতকাল রাত পুরোটা সময় ওর মাথার ভেতর ঘোলাটে হয়ে ছিল। মাটির নিচে চাপা পড়া মেয়েটা কতখানি অসহায় হয়ে পড়ে আছে সেটা ভাবতেই ওর মনে আনন্দের ঢেউ জাগছিল। অনেকটা জিহ্বার উপর মধু ঢালার মত অনুভূতি। কিন্তু তারপর যখন এই কথাগুলো শুনল তখন মনে হল কেউ যেন এসে ওর গালে কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে।
মাথা ঘোরাচ্ছে, সেইকি হাঁটু গেড়ে শুকনো পাতাগুলোর উপর বসে পড়ল। দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছে, শুকনো পাতার স্তরগুলো দেখে ওর মনে হচ্ছিল যেন সাগরের বুকে জাগা ঢেউ। নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না, ফুসফুস যেন বাতাসের জন্য আকুলিবিকুলি করছে।
কবে থেকে সে এরকম জঘন্য সব কাজ করা শুরু করল যেন এগুলো ছেলের হাতের মোয়া?
একসময় তো সে একজন ভালো মানুষ, একজন সুনাগরিক ছিল। কঠোর পরিশ্রম করত, সবার সাথে ভালো ব্যবহার করত, দেখা হলে সবাইকে শুভেচ্ছা জানাত, হাঁটতে গিয়ে কারো সাথে দেখা হলে থেমে কিছুক্ষণ আলাপ করত।
প্রতিবার কাউকে মাটিচাপা দেয়ার চিন্তা মাথায় এলেই সে যুদ্ধ করে চিন্তাটাকে তাড়িয়ে দিত। নিজেকে বলত, এরকম অন্যায় কাজ কারোরই করা উচিত নয়। আর ওর শুধু বাগানে গর্ত খুঁড়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। ও একজন মানুষ। কাউকে জ্যান্ত কবর দেয়ার মত জঘন্য নারকিয় কোন কিছু ও কখনো করতে পারে না…
কিন্তু যখন সে কৌসুকিকে জ্যান্ত কবর দিল আর পরে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলল, তখন যেন ওর ভেতরের কলকজাগুলোর কোন গুরুত্বপূর্ণ একটা নষ্ট হয়ে গেল। ভয়াবহ হলেও, অসহায় মেয়েটার উপর কর্তৃত্ব ফলানোয় ওকে নতুন এক অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। এতদিন পর ওর নিজেকে জীবিত একজন মানুষ মনে হতে লাগল…কিন্তু এখনো কি ও নিজেকে মানুষ বলে দাবি করতে পারে?
মাখা ঘোরালেও সেইকি এক মুহূর্তের জন্যও পাতাগুলো সরিয়ে দেখার কাজে ক্ষান্ত দেয়নি, আইডি কার্ডটা খুঁজেই যাচ্ছিল। ওর মুখ থেকে ঘাম নাক বেয়ে টপ টপ করে শুকনো পাতাগুলোর উপর ঝরে পড়ছে।
হাজার খুঁজেও আইডি কার্ডটা কোথাও পাওয়া গেল না। মেয়েটার সাথে ধস্তাধস্তির জায়গাসহ আশেপাশে সব জায়গা খুঁজল, কোথাও নেই। সেইকি আবার প্যানিক করতে লাগল।
বাতাসে একটা খবরের কাগজ উড়ে এসে ওর পায়ে লাগল। ও উঠে দাঁড়িয়ে পা ঝাঁকিয়ে সেটা সরাল পা থেকে। সেই মুহূর্তে ওর খেয়াল হল কেউ একজন বেড়ায় মুখ লাগিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও আইডি কার্ডটা খোঁজায় এতটাই ব্যস্ত ছিল যে আগন্তুকের আগমন খেয়াল করেনি।
দূরের দোলনাটা খালি। ওখানে যে বসে ছিল সেই নিশ্চয়ই উঠে এসেছে।
বেড়ার ওপাশে যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে ছিল তাকে দেখে মনে হল হাইস্কুলের ছাত্র হবে। কালো ইউনিফর্ম পড়া, দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে সেইকির দিকে চেয়ে আছে। সেইকি অনুমান করল আজকে বোধহয় অর্ধদিবস স্কুল ছিল। স্কুলের পর ছেলেটা সম্ভবত এখানে এসেছে।
সেইকির সাথে ছেলেটার চোখাচোখি হলো, অস্বস্তিকর একটা নিরবতা। ছেলেটাই প্রথম কথা বলল, মাথা নিচে করে বো করে। “দুঃখিত, আমি শুধু,..ভাবছিলাম আপনি কি করছেন।”