***
পরদিন যখন সেইকির ঘুম ভাঙল তখন প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছে। দিনটা ছিল শনিবার। ও যেখানে কাজ করে সেখানে ছুটির দিন বলে আলাদা কিছু নেই যে কারনে ওকে প্রায়ই শনি-রবিবারে অফিস যেতে হয়। কিন্তু এই সপ্তাহে ভাগ্য ভালো বলা যেতে পারে, শনিবার ছুটি ছিল ওর।
জানালা খুলে বাইরে তাকাল। যখন ও ঘোট ছিল তখন এখান থেকে শহর পর্যন্ত দেখা যেত। কিন্তু এখন গাছের জন্য কিছু দেখা যায় না আর। গাছের উপর দিয়ে ধূসর আকাশ দেখা যাচ্ছে। একটা ঠান্ডা বাতাসের ঝাপ্টা এসে গাছগুলোকে নাড়িয়ে সেইকির গাল ছুঁয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
মেয়েটার ব্যাপারটা কি আসল নাকি স্বপ্ন ছিল সেটা ভাবতে ভাবতে সেইকি নিচ তলায় গিয়ে পোর্চে দাঁড়াল। দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ও নিশ্চিত হল ঘটনাটা আসলেই ঘটেছে।
সোজা দাঁড়িয়ে থাকা চিকন বাঁশের খুঁটিগুলোর মাঝে চারটা মোটা খুঁটি দাঁড়িয়েছিল। চারটা মানে দুটো কফিন। গত রাতে সে একটা মেয়েকে কবর দিয়েছে, কৌসুকির কবরের পাশে। নিশ্চিত হতে পেরে ওর দুশ্চিন্তা দূর। হলো।
পার্কের ওখানে কি হয়েছিল, যেখানে ও মেয়েটাকে গাড়ির ভেতর ঢোকানোর চেষ্টা করছিল?
মেয়েটা চিৎকার করেছিল। কেউ কি সেটার রিপোর্ট করেছে নাকি? মেয়েটার বাবা-মা কি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পুলিশকে খবর দিয়েছে? পুলিশ হয়তো এই দুই তথ্য একসাথে করে আন্দাজ করতে পারবে যে মেয়েটা পার্কের পাশের রাস্তা থেকে কিডন্যাপড় হয়েছে।
সেইকি স্যান্ডেলে পা গলিয়ে বাগানে নামল। ওর খিদে পেয়েছে, কিন্তু কিছু খাওয়ার আগে মেয়েটার সাথে একটু গল্প করে নিতে চায়। এরকম অস্বাভাবিক ঘটনায় সে সাধারনত কিছু মুখে তুলতে পারে না। কিন্তু কোন বিচিত্র কারনে ওর প্রচন্ড ক্ষুধা বোধ হচ্ছিল আর নিজেকে জীবিত মনে হচ্ছিল।
বাঁশের খুঁটির কাছে দাঁড়িয়ে ও প্রথমে কথা না বলে কিছু শোনা যায় কিনা সেটা খেয়াল করল। কোন শব্দ কানে এল না। সুতরাং সেইকি বলল, “সকাল হয়েছে, তুমি কি জেগে আছ?”
আগের রাতে মেয়েটা কোন উত্তর দেয়নি। সকালেও উত্তর দেবে কিনা সেই নিয়ে সেইকির দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু পর মুহূর্তেই ও উত্তর পেল।
“আমি জানি এখন সকাল। ভেতরে অন্ধকার হলেও..”
বাঁশের খুঁটির ভেতর থেকে গলার শব্দ খানিকটা কেঁপে কেঁপে আসছিল। বাঁশের গোঁড়ার মাটি নড়ে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই মেয়েটা খুঁটির ঐ মাথা নাড়াচাড়া করেছে, যে কারনে হয়তো কফিনের গর্ত থেকে খুঁটিটা সরে গিয়েছে বা কিছু।
“আমার মুখের কাছে একটা খুঁটি লেগে আছে। আমি নড়তে গিয়ে টের পেলাম। এটা দিয়েই কি নিঃশ্বাস নিচ্ছি? ভেতর দিয়ে তাকিয়ে দূরে সাদা আলো দেখতে পেলোম-তার মানে তাহলে সকাল?”
খুঁটিগুলো জোড়া লাগানো ছিল না, সেফ কফিনের গর্ত দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেইকি যদি সেগুলো তুলে ফেলতে চায় তাহলে সহজেই তুলে ফেলতে পারবে। আবার মেয়েটা যদি অন্য অংশটা নাড়ায় তাহলে বাইরেও খুঁটিটা নড়তে থাকবে।
“খুঁটিটা ছেড়ে দাও। ওগুলো নড়ার কথা না। কেউ দেখলে সন্দেহ করতে পারে। তুমি যদি ওগুলো আরেকবার নড়াও তাহলে আমি ওগুলো উঠিয়ে ফেলব। দম নিতে পারবে না তখন।”
খুঁটিগুলো নড়াচড়া বন্ধ করে দিল।
“তোমার নাম কি?” মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।
“সেইকি। আর তোমার নাম তো মোরিনো তাইনা?”
অনেকক্ষণ কোন উত্তর এল না। তারপর মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, কথায় মনে হচ্ছিল ঘৃণা ঝরে পড়ছে। “সেইকি, আমি জানি না কেন তুমি আমাকে এখানে আটকে রেখেছ, কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। আমাকে বের হতে দাও নাহলে কালো পাখির দুর্ভাগ্য ভোমার ঘাড়ে চড়ে বসবে।”
মেয়েটা তো ওকে কোন ভয় পাচ্ছেই না বরং উল্টো ওর উপর অভিশাপ দিচ্ছে। সে কি তার অবস্থান ঠিকমত বুঝতে পারছে? সেইকি অনুভব করল ও রেগে যাচ্ছে।
“মাটির নিচ থেকে তুমি কি করবে আমার? আমি তোমাকে যেকোন মুহূর্তে পানিতে চুবিয়ে মারতে পারি।”
“চুবিয়ে..?”
সেইকি যথাসম্ভব বিস্তারিতভাবে মেয়েটাকে জানানোর চেষ্টা করল কিভাবে কফিনে পানি ঢুকিয়ে মেয়েটাকে সে মেরে ফেলতে পারে। মেয়েটাকে পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিতে চাইল যে ওর বাঁচার কোন আশা নেই। মেয়েটার মনোবল ভেঙে ফেলতে চাইল।
মেয়েটা তার দুর্ভাগ্যর কালো বাক্স থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারছিল। কিংবা হয়তো রাগ কন্ট্রোল করতে পারছিল না। যেটাই হোক না কেন ওর গলা কাঁপছিল। “তুমি আমাকে খুন করার আগে আমি নিজেই আমার জীবন শেষ করে দেব। তুমি আমার পকেট চেক করতে ভুলে গিয়েছ-বিশাল ভুল করেছ। আমি নিশ্চিত তুমি জানো না তুমি কতখানি উদাসীন। আমার পকেটে একটা মেকানিক্যাল পেন্সিল আছে। আমি সেটা আমার জগুলার ভেইনে ঢুকিয়ে দিব।”
“তুমি হয়তো ভাবছ খুন হওয়ার আগে আত্মহত্যা করলে তোমার সম্মান বাঁচবে, কিন্তু সেটা সত্যি নয়। সবই আসলে এক। তুমি আত্মহত্যা করলেও তোমার শরীর এখানেই পচে গলে মাটির সাথে মিশে যাবে। কেউ জানতেও পারবে না। তুমি একাই থেকে যাবে, মাটির নিচে চাপা থাকবে অনন্তকালে জন্য।”
“না থাকব না। আমাকে অনন্তকালের জন্য লুকানো যাবে না। কেউ না কেউ আমাকে খুঁজে বের করবেই। আর পুলিশ এত গাধা না, তোমাকে তারা একদিন ঠিকই ধরে ফেলবে। আজকে তোক আর কয়েক বছর পরে হোক, ধরা তোমাকে পড়তেই হবে। এটা আমি নিশ্চিত জানি। আর আরেকটা ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত-আমি একা মরব না।”