বেচারি। কি অসহায় হয়ে পড়ে আছে, বাঁশের খুঁটির ভেতর দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সেইকির খারাপ লাগতে লাগল মেয়েটার জন্য। জ্যান্ত কবর হয়ে আছে অথচ কিছু করার নেই। সেইকির নিজেকে অনেক ক্ষমতাশীল মনে হতে লাগল। কোন কুকুর কিংবা বিড়াল ছানার দিকে তাকালেও ওর এরকম লাগে।
“আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?” সেইকি দাঁড়িয়ে বলল। ওর কথাগুলো খুঁটির অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে মেয়েটার কাছে পৌঁছাল।
“কে…কে ওখানে?” সেইকি ওকে বলতে শুনল, কোন উত্তর দিল না। মেয়েটার গলা আরেকটু জোরে শোনা গেল। “তুমি আমাকে এখানে বন্দি করেছ তাই না? তারপর মাটির নিচে চাপা দিয়েছ।”
“তুমি জানো তোমাকে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে?” সেইকি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। মেয়েটা যদি মাত্র কফিনের মধ্যে জ্ঞান ফিরে পেয়ে থাকে তাহলে শুধু অন্ধকার, ছোট, বদ্ধ, একটা জায়গায় আটকে আছে ছাড়া তার কোনোভাবেই সেটা জানার কথা নয়।
মেয়েটা কয়েক মুহূর্ত কিছু বলল না। তারপর বলল, “আমি ঢাকনার উপর মাটি পড়ার শব্দ শুনেছি।”
“তুমি অজ্ঞান হয়ে থাকার ভান করেছিলে?”
সেইকি ভেবেছিল ঘুষি মারার পর থেকে মেয়েটা অজ্ঞান। জ্ঞান ফিরল কখন? ও মেয়েটাকে বাঁধার চেষ্টা করেনি। বাক্সে ঢোকানোর আগে যদি জ্ঞান ফিরে থাকত তাহলে নিশ্চয়ই পালানোর চেষ্টা করত?
“তোমার কি পা আহত হয়েছে? সে কারনে পালাওনি?” সেইকি জিজ্ঞেস করল। মেয়েটা কোন উত্তর দিল না। তার মানে ওর অনুমান সঠিক।
“আমাকে বের হতে দাও।” মেয়েটা রাগতস্বরে বলল।
ওর এই হঠাৎ রেগে যাওয়ায় সেইকি অবাক হলো। মেয়েটা কাঁদেনি কিংবা অনুনয় করেনি-সোজা আদেশ দিচ্ছে, মাটির নিচে সে মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু অনুভব করতে পারছে মেয়েটার মনোবল কতখানি শক্ত। কিন্তু যতই শক্ত থাক, আসলে সে অসহায়।
“না। আমি দুঃখিত যে সেটা সম্ভব হচ্ছে না, সেইকি মাথা নেড়ে বলল। “তোমাকে বের হতে দিলে তুমি সবাইকে বলে দেবে আমি তোমাকে নিয়ে কি করেছি। আমি সেটা হতে দিতে পারি না।”
“ক্-কে তুমি? কেন এসব করছ?” মেয়েটার প্রশ্নগুলো সেইকির বুকে এসে প্রতিধ্বনি তুলল।
কেন সে মেয়েটাকে কবর দিল? এই প্রশ্ন থেকে পালাবার কোন উপায় ও খুঁজে পেল না। প্রশ্নটা যেন ওকে কোন এক কানাগলির সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। কিন্তু দেয়ার মত কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে ও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে গেল না,
“তাতে কিছু আসে যায় না।”
“আমি কোথায়? পার্বত্য এলাকায়?”
“না। তুমি আছ আমার বাগানে, তোমার কবরে শুয়ে আছ।”
মেয়েটা চুপ করে গেল। সেইকি অন্ধকারে তার চেহারা কিরকম হতে পারে তা কল্পনা করার চেষ্টা করল।
“কবর? মজা করছ নাকি? আমি এখনো জীবিত আছি।”
“মৃত মানুষদের কবর দেয়ার মধ্যে কোন মজা নেই, সেইকি বলল, যেন এরচেয়ে কঠিন কোন সত্য থাকতে পারে না।
শুনে মনে হলো মেয়েটা কিছুক্ষনের জন্য কথা হারিয়ে ফেলল। তারপর গরগর করে উঠল, “আমাকে বের হতে না দিলে তুমি বিপদে পড়বে।”
“তোমার ধারণা কেউ তোমাকে উদ্ধার করতে আসবে?”
“আমি জানি একজন আমার খোঁজে আসবেই!” সে হঠাৎ গর্জে উঠল। তারপর ব্যথায় কাতরে উঠে আবার চুপ করে গেল। সেইকি ওর জোরে জোরে দম নেয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। হয়তো ওর বুকের রিবস এ ইঞ্জুরি হয়েছে, প্রতিবার কথা বলার সময় ব্যথা হচ্ছে। সেইকির মনে হলো মেয়েটার কথা-বার্তার মধ্যে অন্যরকম একটা বিশ্বাসের জোর রয়েছে।
“তুমি তোমার এই বন্ধুটিকে অনেক বিশ্বাস কর মনে হচ্ছে…কোন ছেলে নাকি?”
“হ্যাঁ,” সে বলল, কিন্তু আত্মবিশ্বাসের সুর থেকে পরিস্কার বোঝা ছিল ছেলেটি ওর বয়ফ্রেন্ড হবে।
“ছেলেটার নাম জানতে পারি?”
“নাম দিয়ে কি করবে?”
“সেফ কৌতূহল।”
এরপর খানিকক্ষণ নিরবতা। তারপর মেয়েটা ওকে ছেলেটার নাম বলল। সেইকি নামটা ওর স্মৃতিতে গেঁথে নিল, কিন্তু ওর সন্দেহ হতে লাগল মেয়েটা আসলেই সত্যি বলছে কিনা। ছেলেটার হয়তো কোন অস্তিত্বই নেই, কিন্তু সেটা পরীক্ষা করে দেখার কোন উপায় সেইকির হাতে নেই।
“একটা বাইনোকুলার কিনতে হবে।”
আকাশে ছোট ছোট মেঘ চাঁদের সামনে দিয়ে দ্রুত উড়ে যাচ্ছিল। কাল পরশু ঝড় বৃষ্টি হতে পারে।
“কেন কিনব জানো?” সেইকি প্রশ্ন করল। মেয়েটা চুপ করে থাকল। “দূর থেকে দেখব তোমাকে হারিয়ে সে কিভাবে বিলাপ করে।”
ও নিশ্চিত কথাগুলো মেয়েটার কানে ঠিকই পৌঁছেছে, তারপরেও সে কোন উত্তর দিল না। সেইকি আরও কিছু কথা বলল, মেয়েটার কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই হল না। সে শুধু সেখানে অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে রইল।
মেয়েটাকে ও খেপিয়ে দিয়েছে ধরে নিয়ে সেইকি বাগান ছেড়ে চলে এল। সকালে হয়তো মেয়েটার মুড বদলাবে।
সে গ্যারেজে গিয়ে গাড়ির পেছনের সিট পরিস্কার করল। মেয়েটার উপস্থিতির কোন চিহ্ন রাখা যাবে না। গাড়িতে ও সবসময় একটা ছোট বালিশ রাখে, মেয়েটাকে শোয়ানোর সময় বালিশটা মাথার নিচে দিয়েছিল। সেটা রক্ত সব শুষে নিয়েছিল যে কারনে সিটের উপর কোন দাগ পড়েনি। সেইকি বালিশটা বের করে নিল আর মেঝে থেকে সব লম্বা কালো চুল তুলে জড় করল।
পরিস্কার করা শেষ হয়ে গেলে ও বাইরে গিয়ে দেয়ালে ঝুলানো ঘড়িতে সময় দেখল। দুটোর বেশি বেজে গিয়েছে। সেইকি ওর রুমে গিয়ে মেঝেতে ফুটোন বিছিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের রাজ্যের প্রবেশ পথ খুঁজতে লাগল, মেয়েটাকে নিয়ে ওর চিন্তা আলাদা একটা ছোট অন্ধকার অংশে আটকে রাখল।