কৌসুকির কবরের পাশে একটা গর্ত করা ছিল। গর্তটা হয়তো টের পেয়েছিল যে কিছু একটা হবে, তাই চাঁদের আলোয় অধীরভাবে অপেক্ষা করছিল। গর্ত থেকে তোলা মাটিতে একপাশে ছোটখাট একটা টিবি হয়ে আছে।
সেইকি টেনে কফিনটা ঘর থেকে বের করে সোজা গর্তের দিকে নিয়ে গেল। মেয়েসহ কফিনটা বেশ ভারি হয়ে আছে।
কফিনটা গর্তে ফেলে এক জোড়া বাঁশের খুঁটি কফিনের গর্তগুলোতে বসাল। তারপর মাটি ঢেলে গর্তটা ভরাট করে ফেলল। প্রথম দিকে শুকনো মাটি কফিনের কাঠের উপর পড়ে থপ থপ শব্দ সৃষ্টি করছিল, পরে কফিন ঢেকে গেলে শব্দ থেমে গেল। যতটা অনুমান করেছিল তার চেয়ে অনেক সময় লাগল গর্তটা ভরাট করতে। সেইকি ঘেমে পুরো গোসল হয়ে গিয়েছে। আর বাসায় ফেরার পর ও পোশাকও বদলায়নি, ওর ওয়ার্ক সুটের পা মাটি লেগে নোংরা হয়ে গেছে। কবরটা ভর্তি হয়ে যেতেই ও কোদাল দিয়ে মাটি সমান করে দিল।
কৌসুকিকে কবর দিয়েছিল গ্রীষ্মে, বাঁশের খুঁটিতে মর্নিং গ্লোরি ছড়িয়ে দিয়ে। কিন্তু বছরের এই সময়ে সেটা করা সম্ভব নয়। মর্নিং গ্লোরি মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফুল, শীত সহ্য করতে পারে না। দেয়ালের পাশের আগাছার মধ্যে খালি বাঁশ যেগুলো ছিল সেগুলো নিয়ে কারো কোন সন্দেহ হবে না, হলেও সে বলতে পারবে গ্রীষ্মের সময় মর্নিং গ্লোরির জন্য সেগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল।
কিন্তু নতুন ভরাট করা মাটির ক্ষেত্রে এই অজুহাত দেয়া যাবে না। তাই সে ফ্লাওয়ার বেড থেকে কিছু খড়কুটো তুলে এনে সেখানে বিছিয়ে দিল। কাজ শেষ করার পর জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছিল না যে এখানে কোন গর্ত খোঁড়া হয়েছিল।
সেইকি কোদাল সরিয়ে রেখে পোর্চে গিয়ে বসল। অনেকক্ষণ বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটাকে ওখানে জ্যান্ত কবর দেয়া হয়েছে।
পোর্চ আর দেয়ালের মাঝখানের জায়গাটাতেই শুধু কোন গাছ লাগানো ছিল না। শুধু কিছু ফ্লাওয়ার বেড, কিছু বাঁশের খুঁটি আর কাপড় শুকানোর জন্য দড়ি টাঙানো ছিল। কিন্তু পোর্চের অন্য পাশগুলোতে গাছগুলো ঘন হয়ে ছিল। রাতের অন্ধকারে কালো দেয়ালের মত লাগছিল দেখতে। যখন বাতাস বইছিল তখন ছায়াগুলো এদিক ওদিক সরে যাচ্ছিল। মেয়েটার আঁচড় লাগা জায়গাটা ডলতে লাগল সেইকি। ঘুষি মারার পর হাতের অবশ অবস্থাটা প্রায় নেই আর। নিজের মুখে হাত বোলাতে গিয়ে টের পেল ও হাসছে।
বাড়ির ভেতর গিয়ে সে মেয়েটার ব্যাগ চেক করে দেখল, ভেতরে এক ক্যান মরিচ পানির স্প্রে আর একটা স্টুডেন্ট আইডি আছে। আইডিতে সুন্দর চেহারার একটা মেয়ের ছবি।
ছবির নিচে গ্রেড, ক্লাস, সিট নাম্বার, আর নাম লেখা। মোরিনো ইয়োরু। সেইকি আবার পোর্চে গিয়ে দাঁড়াল, বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে নামটা উচ্চারণ করল সে।
যেই মানুষটাকে ও মাত্র কবর দিয়ে এসেছে তার একটা নাম ছিল-সাধারণ একটা ব্যাপার, ও উপলদ্ধি করল। মাটির নিচে পড়ে থাকা মেয়েটার বাবা-মা ছিল, তারা তাকে এই নাম দিয়েছিল আর আদর-যত্নে বড় করে তুলেছিল। আর সেইকি কিনা সেই ভালবাসার মানুষটিকে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলল।
একটা অদ্ভুত উন্মাদনা সেইকির মন ভরে তুলল, যেভাবে চিনি দেয়া পানি ধীরে ধীরে তুলোর বলের ভেতর প্রবেশ করে। মাটির উপরে থাকতে যে মেয়েটাকে ও ঘুষি মেরেছিল, সে ছিল আতঙ্কজনক। কিন্তু মাটির নিচে, চোখের আড়াল হতে সেইকি টের পেল ওর আতংক বদলে গিয়ে আনন্দে রূপ নিচ্ছে।
সে মুহূর্তে সেইকির কানে একটা আওয়াজ ভেসে এল, দূর্বল-বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে কোনমতে।
সেইকি আবার বাঁশের খুঁটিগুলোর দিকে তাকাল। চাঁদের ফ্যাকাসে আলোয় সেগুলোর ছায়া লম্বা হয়ে বাগান থেকে পোর্চ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, যেখানে সেইকি বসে আছে। চারটা খুঁটি অন্যগুলোর চেয়ে বেশি মোটা।
মোটা খুঁটিগুলোর দুটো থেকে ক্ষীণ শব্দটা আসছে। সেইকি উঠে দাঁড়িয়ে জুতো পরে সোজা সেদিকে গেল। হাঁটতে গিয়ে ওর মনে হচ্ছে ও বোধহয় কোন নড়াচড়া করছে না। ঘুমের ভেতর হাঁটার মত এক অবাস্তব দুনিয়ার ভেতর দিয়ে চলছে যেন। চাঁদের আলোয় বাগানে গাছগুলোর ছায়া যেন ওর দিকে চেয়ে আছে।
সে খড়কুটো পার হয়ে খুঁটিগুলোর কাছে পৌঁছাল, খুঁটিগুলো ওর বুক পর্যন্ত উঁচু। বুড়ো আঙুলের সমান চওড়া ফুটো দিয়ে ভেতরে তাকাল। ভেতরে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না, ওর শূন্য হৃদয়ের মত গহিন অন্ধকার। ভেতর থেকে মেয়েটার দূর্বল কাঁপাকাপা গলার শব্দ ভেসে আসছে। খুঁটি বেয়ে মাটির নিচে থেকে মাটির উপরে উঠে আসছে আর মাথায় পৌঁছাতেই বাতাস ছিনিয়ে নিচ্ছে, ধোঁয়ার মত।
একটা খুঁটিতে শব্দ অন্যটার চেয়ে বেশি ছিল। কফিনে দুটো খুঁটি লাগানো। একটা মুখের কাছে আরেকটা পায়ের দিকে। মুখের কাছেরটার খুঁটি দিয়ে অন্যটার চেয়ে ভালো শব্দ আসছে।
“হ্যালো?” দূর্বল গলায় মেয়েটা বলল। কেটে যাওয়া ঠোঁটের জন্য নিশ্চয়ই কথা উচ্চারণ করতে কষ্ট হচ্ছে। আমাকে বের হতে দাও…”
সেইকি হাঁটু গেড়ে বসল, হাতের তালু বাঁশের খুঁটির কাছের মাটিতে রাখা। কিছুক্ষণ আগে কবর দেয়া, যে কারনে মাটি নরম হয়ে আছে।
মেয়েটার গলা ওর হাতের নিচ থেকে ভেসে আসছে। ও বুঝতে পারছিল ওর কল্পনা কিন্তু তারপরেও ওর কাছে মাটিটা উষ্ণ মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কবর দেয়া মেয়েটার শরীরের উষ্ণতা ও টের পাচ্ছে উপর থেকে।