চোখগুলো উপড়ে এনে দু-হাতের তালুর উপর রাখা। চোখের কোটরগুলো কাদা দিয়ে ভরাট করা হয়েছে, মুখ ভরাট করা হয়েছে পচা গলা পাতা দিয়ে। পেট থেকে বের করা নাড়ি ভুড়ি পেছনের গাছের সাথে রাখা। মাটিতে পড়ে থাকা রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটার কাপড় চোপড়গুলো ফেলে রাখা ছিল কাছেই।
আমরা হা করে সেখানে দাঁড়িয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমাদের দুজনের কারোরই কিছু বলার মত অবস্থা ছিল না, স্রেফ নিভাবে তাকিয়ে ছিলাম লাশটার দিকে।
***
পরেরদিন মোরিনো আমার সেল ফোনে মেসেজ পাঠালো : “নোটবুকটা ফেরত দাও।”
ওর মেসেজ সবসময়ই এরকম ঘোট আর সোজা ভাষার, কখনোই দরকারের অতিরিক্ত কোন কথা থাকে না। একইভাবে ওর ফোনের সাথে অন্য মেয়েদের মত আজাইরা কোন চাবির রিং কিংবা স্ট্রাপও লাগানো থাকে না।
নোটবুকটা আমি বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। মিজুগুশি নানামির ওখান থেকে ফেরার পর মোরিনোকে ফেরত দেয়া হয়নি।
ফেরার পথে ট্রেনে মোরিনো দূরে তাকিয়ে ছিল, তখনো শক কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
ফিরে আসার আগে ও মাটি থেকে মিজুশি নানামির জামা কাপড় আর জিনিসপত্র তুলে নিজের ব্যাগে ভরে নিয়ে আসে। জামা কাপড়গুলো কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু মেয়েটার হ্যাট আর ব্যাগ, ব্যাগের ভেতরের জিনিসপত্র ছুঁয়েও দেখা হয়নি।
ব্যাগের ভেতর ছিল মেয়েটার মেকআপ, ওয়ালেট আর রুমাল। ফেরার পথে ট্রেনে আমরা সব বের করে হাতিয়ে দেখেছি।
ওয়ালেটের ভেতরের স্টুডেন্ট আইডি দেখে আমরা জানতে পারলাম মিজুগুশি নানামি আমাদের পাশের বিভাগের একটা হাই স্কুলের ছাত্রি ছিল। ব্যাগের ভেতর একটা ছোট বুক ছিল ‘পুরিকুরা রাখার জন্য। পুরিকুরার ছবিগুলোতে আর আইডি কার্ড থেকে আমরা বুঝতে পারছিলাম জীবিতকালে মেয়েটা কতখানি প্রাণবন্ত ছিল।
মেসেজ পাওয়ার পর আমি দুপুর বেলায় স্টেশনের কাছের ম্যাকডনাল্ডে গিয়ে মোরিনোর সাথে দেখা করলাম।
মোরিনো ওর স্বভাবসুলভ কালো পোশাক পরেনি। প্রথমে ওকে চিনতেই পারিনি আমি। ও যে হ্যাটটা পরেছিল সেটা আমরা মিজুগুশি নানামির লাশের কাছে পেয়েছিলাম। সুতরাং আমি অনুমান করলাম ও হয়তো মৃত মেয়েটার মত জামাকাপড় পরে সাজগোজ করেছে।
ওর চুল আর মেকআপ পুরোপুরি মিজুগুশি নানামির পুরিকুরাতে পাওয়া ছবির মত। মেয়েটার জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল, তাই ও শপিঙে গিয়ে একইরকম দেখতে জামাকাপড় কিনেছে।
নোটবুক ফেরত দিতে গিয়ে মনে হলো ও মজায় আছে। ব্যাপারটা উপভোগ করছে।
“আমাদের কি মিজুগুশি নানামির পরিবারকে জানানো উচিত ওর লাশ বনের মধ্যে পড়ে আছে?” বললাম তাকে।
মোরিনো এক মুহূর্ত চিন্তা করে মাথা নাড়ল, “দরকার নেই, পুলিশ একসময় ঠিকই খুঁজে পাবে।” মৃত্যুর আগে মিজুগুশি নানামি যেরকম পোশাক পরা ছিল ঠিক একইভাবে মোরিনো সাজুগুজু করেছে।
মিজুগুশি নানামির পরিবার কি করছে এখন? ওর নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনার কি তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আছে? ওর কি কোন বয়ফ্রেন্ড ছিল? ওর গেড কি রকম ছিল?
মোরিনোকে একটু অন্যরকম লাগছে। ও যেভাবে কথা বলছে, বা নড়াচড়া করছে, সেসব ওর অন্য সময়ের ব্যবহারের চেয়ে ভিন্ন। ওর ব্যাংগস কোথায় রেখেছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিল। আমাদের উল্টোদিকের বুথে বসে থাকা কপোত-কপোতির দিকে ইশারা করল। এসব মোরিনো আগে কখনো করেনি।
টেবিলের উপর কনুই দিয়ে বসে আছে। হাসিখুশি দেখাচ্ছে ওকে। ওর পাশে মিজুগুশি নানামির ব্যাগটা রাখা। ব্যাগের সাথে একটা চাবির রিং লাগানো, যেটায় একটা অ্যানিমে ক্যারেক্টার ঝুলছে।
“তুমি আরও কিছুদিন এরকম সাজগোজ করে চলবে নাকি?”
“হ্যাঁ, তাই ভাবছি…মজার না ব্যাপারটা?”
মোরিনোর জন্য ব্যাপারটা অন্য একজন হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু ও যেভাবে হাসছিল কিংবা আয়নায় তাকিয়ে ভুরু পরীক্ষা করছিল, কোন হাই স্কুলে পড়া সাধারণ গোছের মেয়ে হুবহু ওরকম করে
-মনে হচ্ছিল মিজুগুশি নানামি কোনভাবে ওর ভেতর ঢুকে পড়েছে।
ম্যাকডোনাল্ড থেকে বের হওয়ার পর, মোরিনো এমনভাবে আমার হাত ধরল যেন ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। এমনকি আমি না বলা পর্যন্ত ও নিজেও তা টের পায়নি। মিজুগুশি নানামি এখন মৃত, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল আমার হাত ধরেছিল মিজুগুশি নানামিই, মোরিনো নয়।
স্টেশনের কাছে গিয়ে যার যার পথে আলাদা হয়ে গেলাম আমরা।
বাসায় ফিরে টিভি চালালাম। সিরিয়াল কিলিং নিয়ে খবর দেখাচ্ছে। প্রথম দু-জন শিকারের উপর। সেই একই তথ্য আবারো বলা হচ্ছে। আগেও হাজারবার বলা হয়েছে। নতুন কিছু নেই খবরে। মিজুগুশি নানামির কোন উল্লেখ নেই।
ভিক্টিমদের পরিবার আর আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবদের ছবি দেখানো হলো। তাদেরকে দুঃখি দুঃখি দেখাচ্ছে। স্ক্রিন ভরাট করার জন্য ভিক্টিমদের ছবি বড় করে দেখানো হচ্ছে।
মোরিনোর কথা ভেবে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল-এরকম অনুভূতি আমার আগে কখনো হয়নি। মাথা ঝাঁকি দিয়ে চিন্তাটা সরাতে চাইলাম।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে ভিক্টিমদের দুজনেরই মিজুগুশি নানামির মতই চুল আর পোশাক। এর মানে হলো, মোরিনো নিজেও এখন খুনির ‘পছন্দের ধরন’-এর মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।
৩
ম্যাকডোনাল্ডস এ দেখা করার তিনদিন পর এক বিকেলে আমার ফোন বেজে উঠল। টোন শুনে বুঝলাম কারো কাছ থেকে মেসেজ এসেছে…মোরিনোর থেকে।