ইয়োরু আর ইয়ু একই জিনিস এঁকেছিল, কিন্তু তারপরেও ওদের আঁকার মধ্যে কিছু পার্থক্য ছিল। ইয়ুর আঁকা ছবিতে, দুই মেয়েই জুতো পড়েছিল। কিন্তু ইয়োরুর ছবিতে দুই মেয়েরই পুরো পা রঙ করা ছিল। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম ইয়ু বোধহয় ডিটেইলিং বেশি করেছে, কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত বদলেছি।
আমার মনে হতে লাগল ইয়োরুই আসলে ঠিক মত এঁকেছে, তার স্মৃতি থেকে। ইয়ুর ছবিতে সূর্য ছিল, কিন্তু ইয়োরুর ছবিতে ছিল ধূসর ব্যাকগ্রাউন্ড-আরেকটা সূত্র। বাস স্টপে বসে সেদিন মোরিনো আমাকে তাদের আত্মহত্যা খেলার কথা যখন বলেছিল, তখন বলেছিল দিনটা ছিল বৃষ্টির দিন। ব্যাপারটা এমন না যে ইয়োৰু জুতো আঁকতে ভুলে গিয়েছিল-আসলে তারা দুজনেই খালি পায়ে ছিল।
“তুমি নিজেই বাস স্টপে বলেছিলে যে তুমি মৃত্যু সম্পর্কে ইয়ুর চেয়ে বেশি জানো, তুমি ওর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর ছিলে। তুমি ইয়োরু হিসেবে বলেছিলে কথাটা, তার মানে একজন শিশু হলেও ইয়োৰু নিশ্চয়ই এই অদ্ভুত নিয়ম জানত যে লোকজন আত্মহত্যা করার আগে তাদের জুতো খুলে নেয়।”
যমজ দু-জন যখন আত্মহত্যা আত্মহত্যা খেলেছিল তখন নিশ্চয়ই তাদের জুতো খুলে পাশে রেখে দিয়েছিল। ইয়োরু জানত তাই তোমাকে তাই করতে বলেছিল। ওর জ্ঞান ওর ড্রয়িঙে প্রতিফলিত হয়েছিল।
কিন্তু ইয়ুর ক্ষেত্রে তা হয়নি। খেলার সময় ইয়ু জুতো খুললেও পরে ভুলে গিয়েছিল। কারণ ও এই অদ্ভুত নিয়মের কথা জানত না। যে কারনে ওর ড্রয়িঙে জুতো পরে আত্মহত্যা আঁকা ছিল।
অথচ ছাউনির লাশটা খালি পায়ে ছিল। ইয়ু যদি খেলতে খেলতে দুর্ঘটনাবশত আত্মহত্যা করে ফেলে তাহলে তার পায়ে জুতো থাকার কথা।
ইয়ু চুপ করে শুনছিল, তারপর ওর ঠোঁটজোড়া অল্প খানিকটা ফাঁকা হলো কথা বলার জন্য। আমার কালো জুতো পরা বোন মারা গিয়েছিল। হয়তো আমি ওকে একটু আধটু ঘৃণা করতাম ঠিকই। কিন্তু তোমার অনুমান পুরোপুরি সঠিক নয়।” ওর স্বর একদম শান্ত ছিল। “তুমি ওর বুকে জড়ানো দড়িটা দেখনি তাই না? আমি কাটিনি, ওটা নিজেই ছিঁড়ে গিয়েছিল।”
সেদিন দুপুরে, ওর বড় বোন ইয়োরু প্রস্তাব দিল তারা আত্মহত্যা করার ভান করে সবাইকে চমকে দেবে।
ইয়ু রাজি হলো। তারা যেই ছাউনিতে কাজ শুরু করল তখনই বৃষ্টি শুরু হলো।
কুকুরটা তখনো বেঁচে ছিল। অবাক হয়ে ওদের কাজ কারবার দেখছিল।
“আমার বোন বাক্সগুলো জড়ো করল, বিম থেকে দড়ি লাগাল। আমি নিচে ছিলাম, খেয়াল রাখছিলাম বাক্সগুলো যাতে নড়াচড়া করে পড়ে না যায়।”
বৃষ্টিতে মেঝে নরম হওয়ার আগেই ইয়োৰু বাক্সগুলোর উপরে ছিল, তাই মাটিতে ওর পায়ের কোন ছাপ ছিল না।
ইয়োৰু একা আত্মহত্যার ভান করবে, আর ইয়ুর কাজ ছিল কাউকে সেখানে দেখাতে নিয়ে যাওয়া। ওদের প্রস্তুতি চলছিল, ইয়োরু দুটো দড়িই জায়গামত বেঁধে ফেলল।
“তারপর আমার বোন লাফ দিল।
ইয়োরু লাথি দিয়ে বাক্সগুলো সরিয়ে দিয়ে পড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য দেখে মনে হচ্ছিল যে ও গলা থেকেই ঝুলছে, যদিও ও আসলে বুকের সাথে লাগানো দড়ি থেকে ঝুলছিল।
সে নিচে ইয়ুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিল। “লোকজনকে বোকা বানানোর সময় ও সবসময় একটু মুচকি দিয়ে হাসত। বাসার কারো সাথে কথা বলার সময় কোন অভিব্যক্তি দেখাত না, শুধু কাউকে বোকা বানানোর সময় মনে হত ও আনন্দ পেত।”
কিন্তু এক মুহূর্ত পর ওর বুকের দড়িটা ছিঁড়ে গেল।
“আমি কিছুই করিনি। দড়িটা আমার বোনের ভার সহ্য করার মত শক্ত ছিল না। সিলিঙের কাছ থেকে ছিঁড়ে গিয়েছিল। তুমি যদি দড়িটা দেখতে তাহলে ঠিকভাবে অনুমানটা করতে পারতে। ওটা এত উঁচুতে ছিঁড়েছিল যেখানে আমার পক্ষে কাটা সম্ভব ছিল না।”
ইয়োরু এক মুহূর্ত সেখানে ঝুলে থাকল।
“আমি দ্রুত সাহায্য করতে চেষ্টা করলাম। আমি আমার হাত দিয়ে ওর শরীর জড়িয়ে ওকে উঁচু করে ধরার চেষ্টা করলাম। ওকে শূন্যে ধরে রেখেছিলাম, চেষ্টা করছিলাম যেন ঝুলে না পড়ে।”
ছাউনির ভেতর একটা মেয়ে সিলিং থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে, আরেকজন হুবহু একইরকম দেখতে একটা মেয়ে তাকে ধরে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। ঝুলন্ত মেয়েটা ধস্তাধস্তি করছিল, ওর পা বাতাসে লাখি ছুঁড়ছিল। পাশে বাঁধা কুকুরটা ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করছিল। মেয়েটার সংগ্রাম আর কুকুরের চিৎকার একসাথে ছোট ঘরটায় কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সময় অনন্তকালের জন্য এক জায়গায় এসে থেমে গিয়েছে।
“আমি আমার বোনকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করেছিলাম। আমার গায়ে তেমন একটা শক্তি ছিল না কিন্তু তারপরেও আমি ওকে তুলে ধরে রেখেছিলাম। ও চিৎকার করছিল, ওর লাথি ছুটে এসে আমার গায়ে লাগছিল।”
মোরিনো ওর চেয়ারে বাঁকা হয়ে বসল। রুমের অন্যপাশের দেয়ালের দিকে তাকিয়েছিল, যেন সেদিনের সব দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। স্মৃতিগুলো ওর কাছে এখন দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।
ইয়ু ছেড়ে দিলে ওর বোন পড়ে যাবে আর গলায় দড়ি শক্ত করে বসে যাবে।
ইয়োরুর চোখ আতংকে বেরিয়ে আসছিল, বোনকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করছিল-কিন্তু ওর চিৎকারে কোন উৎসাহ ছিল না।
“ও বলছিল, ‘ভাল করে ধর, শক্ত করে ধর গাধা কোথাকার..” মোরিনো চোখ চেপে বন্ধ করে ছিল, আবেগ আটকানোর চেষ্টা করছিল। “এটা যখন আমার কানে গেল আমি ওকে ছেড়ে দিলাম, আর বাঁচানোর চেষ্টা করলাম না।”