যদি মোরিনোর নানি ছাউনির ভেতর ইয়োরুর পায়ের ছাপ দেখে থাকেন তাহলে আমাকে যে গল্প শোনানো হয়েছে তা পুরোপুরি মিথ্যা। যদি ইয়োরুর পায়ের ছাপ ছাউনির ভেতর দেখা গিয়ে থাকে তার অর্থ ও আগেই সেখানে গিয়েছিল আর মৃতদেহ তখন আবিস্কার করেছিল।
“আপনি যখন ইয়ুকে পেলেন, তখন কি মেঝেতে কোন পায়ের ছাপ ছিল?”
যদিও আমার মনে হচ্ছিল না মোরিনোর নানি এরকম সূক্ষ্ম কোন কিছু মনে রাখবেন কিন্তু তারপরেও জিজ্ঞেস করার জন্য করলাম।
“হ্যাঁ, ইয়ুর পায়ের ছাপ ছিল,” মোরিনোর নানি বললেন। যে বাক্সর উপর ইয়ু দাঁড়িয়েছিল সেটা উলটে একদিকে পড়েছিল। নানি যখন সেটা ঠিক করতে গেলেন তখন ছোট পায়ের ছাপ দেখেছিলেন মেঝেতে।
যাক ভালো,আমি ভাবলাম। মাটিতে ইয়ুর পায়ের ছাপ পাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।
“আপনি দেখেই বুঝতে পারলেন যে ওগুলো ইয়ুর পায়ের ছাপ?”
“মেয়ে দুটো দেখতে একই রকম, তাই আমরা ওদের আলাদা রকমের জুতো পরাতাম। ইয়োরু পড়ত কালো জুতো, ইয়ু পরত সাদা জুতো। ওদের জুতোর সোলও ভিন্ন ছিল, আর মেঝেতে যে ছাপ ছিল তা যে ইয়ুর জুতোর ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।”
ইয়ুর আঁকা ছবিটা মনে পড়ল আমার। এখন রঙহীন জুতোর অর্থ বুঝতে পারলাম। তার মানে ওগুলো ইয়ুর জুতো ছিল। ইয়ু সিলিং থেকে ঝুলছিল। ওর পা ছিল খালি, ওর সাদা জুতোগুলো মেঝেতে রাখা ছিল। অন্য অনেক আত্মহত্যাকারীদের মত জুতোগুলো পাশে গুছিয়ে রাখা ছিল।
“ইয়োরুর পায়ের কোন ছাপ ছিল না?” আমি জানতে চাইলাম, সেফ নিশ্চিত হওয়ার জন্য।
মোরিনোর নানি মাথা নাড়লেন, আমি নিজেকেই লাখি লাগালাম মনে মনে, কেন প্রশ্নটা করতে গেলাম। ইয়োর মৃতদেহ দেখার সময় ভেতরে ঢোকেনি। ওর পায়ের ছাপ না পাওয়া যাওয়ারই কথা। ছাউনিতে একজনেরই পায়ের ছাপ থাকার কথা।
“ইয়ুর বুকে বাঁধা দড়িটা কি এখনো আছে?”
মোরিনোর নানি মাথা নাড়লেন। দেখে মনে হলো তার মনে নেই। “যাইহোক, তোমার মনে হয় আজকে রাতে এখানে থেকে যাওয়াই ভালো হবে, বাইরে অনেক বৃষ্টি হচ্ছে।”
আমি একটু চিন্তা করে রাজি হয়ে গেলাম।
ছাউনি থেকে বেরিয়ে আমরা বাড়িতে ফিরে গেলাম। মোরিনোর নানি আমাকে কয়েকটা জায়গার কথা বললেন যেখানে ভোলার জন্য ভালো ছবি পাওয়া যাবে।
“আসা করছি কালকে আবহাওয়া ভালো থাকবে,” তিনি বললেন।
জুতো খোলার সময় জুতার বাক্সের উপর রাখা জিনিসগুলোর মধ্যে ছোট একটা প্লাস্টিকের খেলনা আমার নজর কাড়ল। হাতে নিয়ে দেখলাম। একটা ছোট ফ্লাওয়ার ব্ৰচ। চকলেটের প্যাকেটে উপহার হিসেবে যেমন থাকে, সস্তা রঙ আর ডিজাইনের।
যমজ দু-জনের কার ছিল এটা? জিনিসটা দেখে আমার আবার মনে হলো ওরা যখন ছোট ছিল তখন এখানে থাকত।
ব্রুচটা হাতে নিয়ে হলওয়ের দিকে তাকালাম। মোরিনোর নানি ততক্ষণে লিভিং রুমে চলে গিয়েছেন। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম।
মনে মনে কল্পনা করছিলাম পুতুলের মত দেখতে দুটো যমজ বাচ্চা মেয়ে হলওয়ে দিয়ে হেঁটে আমার দিকে আসছে। ফিসফিস করে একজন আরেকজনের কানে কিছু বলছে, কি করে মৃত সাজা যায় সে নিয়ে নতুন কোন পরিকল্পনা করছে। আমার কল্পনায় ওরা হলের শেষ মাথায় গিয়ে বাঁকে হারিয়ে গেল। জুতো খুলে রেখে আমি তাদের ফলো করার চেষ্টা করলাম। যে বাঁকে তারা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল সেখানে গেলাম, অবশ্যই কেউ ছিল না সেখানে নিরব একটা অন্ধকার জায়গা, করিডোরের মলিন আলো জায়গাটা আলোকিত করতে পারেনি।
৪
সোমবারে মোরিনো পাশ থেকে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। সে নিশ্চয়ই কৌতূহলবোধ করছিল, গ্রামে গিয়ে আমি কি কি করলাম তা জানতে চাইছিল। কিন্তু পুরো দিন আমি ওর দৃষ্টি উপেক্ষা করে গেলাম, ভান করলাম যেন খেয়ালই করিনি।
সেদিন শেষ ক্লাসের পর সব ছাত্রছাত্রি চলে না যাওয়া পর্যন্ত ওর সাথে কথা বললাম না। কয়েকজন আমাকে তাদের সাথে বাসায় যেতে বলেছিল, কিন্তু পাত্তা দেইনি-তার মানে এই না যে আমি কোন উত্তর দেইনি। আমার মন কোন কিছু চিন্তা না করেই বিশ্বাসযোগ্য অজুহাত তৈরি করতে সক্ষম। আমার কোন ধারণা নেই কি অজুহাত বানিয়েছিলাম, ওগুলো নিজে নিজে তৈরি হয়ে তাদের কাছে পৌঁছে যায়, আমাকে স্পর্শ করে না।
অবশেষে আমার ক্লাসমেটদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল, রুমের বাইরের হলে নিরবতা নেমে এল। ক্লাসে শুধু আমি আর মোরিনো ছিলাম। সে ওর সিটে কাত হয়ে বসেছিল, জাহাজ ডুবতে থাকলে যেমন দেখায়। আর পাশ থেকে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।
ধীরে-সুস্থে ওর সিটের দিকে গেলাম। জানালা থেকে তিন সারি দুরে সে বসে ছিল, পেছন থেকেও তিন সারি।
“শুনলাম তুমি নাকি গ্রামে রাতটা কাটিয়েছ। নানি ফোন করে বলল আমাকে।” ঘুমন্ত সুরে বলল মোরিনো। ওর চোখের নিচের দাগগুলোর অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে।
“উনি ভালো রাঁধুনি।”
আমি ওর সামনের সিটে বসলাম, জানালার পাশের সারিতে। বাইরে তখনো আলো ছিল। আকাশের রঙ খানিকটা হলদেটে বর্ণ ধারন করেছে। দূরে স্পোর্টস টিমের হৈচৈ এর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। রুমের আলো নেভানো ছিল, আলো যা ছিল তার পুরোটাই জানালা দিয়ে আসছে।
“তুমি এক সময় যে বাড়িতে থাকতে সেখানের কিছু কাহিনী শুনলাম।”
“যেমন?”
“যেমন তুমি আর তোমার বোন ছোট থাকতে যেসব মজা করতে। তারপর ইয়োরুকে যত বকা দেয়া হোক সে কখনোই কাঁদত না, কিন্তু ইয়ু সাথে সাথে কেঁদে ফেলত, বোনের পেছনে গিয়ে লুকাত।”