আর ইয়োরুর ছবিতে এইসব ডিটেইলিং কিছু ছিল না, খুব সাধারনভাবে রং করা। পুরো পা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত রং করা, জুতার জন্য আলাদা কোন রং করা হয়নি! ব্যাকগ্রাউন্ড পুরোটা ছাই রং করা।
ইয়ুর ছবির জুতাগুলো আমার মনোযোগ কাড়ল। একটা মেয়ের জুতা কালো, আরেকজনটায় কোন রঙ নেই। এর অর্থ কি হতে পারে আমি নিশ্চিত ছিলাম না কিন্তু নোট করে রাখা প্রয়োজন মনে করলাম।
ছবিগুলো টেবিলের উপর রেখে দিলাম।
“আমার মনে হয় ছবিগুলো তুলে ফেলা উচিত,” বলে আমার ক্যামেরা নিয়ে বাইরে গেলাম।
দরজা খুলতেই বাইরে সবকিছু সাদা দেখাল। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল কুয়াশা, কিন্তু আসলে ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিল। এমন বৃষ্টি যেটায় ছাতা ব্যবহার করার কোন মানে হয় না। সুতরাং আমি চারপাশে ঘুরে ইচ্ছামত ছবি তুলে নিলাম। কিছুক্ষণ পর জোরে বৃষ্টি শুরু হলো।
আমি ভাব করলাম যেন হঠাৎ কোনভাবে ছাউনির সামনে পড়ে গিয়েছি।
ছাউনির দরজা কাঠের তৈরি ছিল। বন্ধ ছিল কিন্তু হাতল ধরে টান দিতে খুলে গেল। ভেতরে অন্ধকার, প্রথমে কিছু দেখা যাচ্ছিল না।
দরজা দিয়ে যতটুকু আলো ঢুকছিল তাতে হালকাভাবে কিছু দেখা গেল। ভেতরে শুকনো গাছের গন্ধ।
ছাউনিটা ছিল প্রায় সাড়ে ছয় ফুটের মত উঁচু আর দশ বাই তের ফুট সাইজের। মেঝে কাদা দিয়ে নোংরা হয়ে ছিল।
আধ ভাঙা সিলিঙের নিচে একটা বিল দেয়া। অনেকগুলো ফুটো ছিল, নিল তারপুলিন দেখা যাচ্ছে। একটা বাতি ঝুলে আছে।
মোরিনোর কাহিনী অনুযায়ি এখানে একটা কুকুর রাখা হতো। এখন আর নেই যেহেতু তার মানে হয়তো বেঁচে নেই। দরজার পাশে ছোট করে আরেকটা গর্ত কাটা, সম্ভবত কুকুরটার জন্যই। কুকুরটাকে নিশ্চয়ই ওটার আশেপাশেই কোথাও বেঁধে রাখা হতো।
আমি ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরটা ঠান্ডা আর খানিকটা ভ্যাপসা।
একসময় ইয়ু এখানে ছিল, সিলিঙের বিম থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছিল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল মৃত মেয়েটা এখনো সেখানে ঝুলছে।
দরজার পাশেই একটা সুইচ ছিল। সুইচ চাপতেই বাতি জ্বলে উঠল। খুবই কম পাওয়ারের বাতি, খুব অল্পই আলোকিত হলো।
ইয়োর বলা কাহিনী মনে পড়ল আমার-দুইটা বাক্স মেঝেতে রেখে ওরা উপরে উঠে দাঁড়িয়েছিল, গলায় দড়ি দিয়ে ঝাঁপ দেয়ার জন্য তৈরি…এখানে রাখা কুকুরটার খাবারে ব্লিচ মিশিয়ে দেয়া।
ইয়ুর মারা যাওয়া নিয়ে ইয়োরুর কাহিনীর উপর আমার সন্দেহ হচ্ছিল।
ইয়োৰু ছাউনির দরজা খোলার আগেই জানত ওর বোন মৃত। ও শুধু অভিনয় করেছিল যে ঐ মুহূর্তে সে সেটা আবিস্কার করেছে।
কেন সে ওরকম করতে গেল? সে কি লুকাতে চাইছিল? ব্যাপারটা নিয়ে আমি যতই চিন্তা করছিলাম ততই মনে হচ্ছিল ওর বোনের মৃত্যুর পেছনে নিশ্চয়ই ওর কোন হাত আছে।
“আমরা এখানেই ইয়ুকে খুঁজে পেয়েছিলাম।”
ঘুরে দেখি দরজার কাছে মোরিনোর নানি দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি সিলিঙের দিকে।
“আমি শুনেছি সবাইকে চমকে দিতে গিয়ে ও মারা গিয়েছিল।”
উনি যেখানে তাকিয়ে ছিলেন সেদিকে তাকালাম। ওখানেই নিশ্চয়ই ইয়ুকে পাওয়া গিয়েছিল।
বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। উঠোনে ছিটকে পড়ার শব্দ শুনতে পারছিলাম। কিন্তু ছাউনির ভেতর বাইরের সব শব্দ যেন মিইয়ে গিয়েছিল। এমন কি তারপুলিনের উপর পড়া বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দও।
ছাদের ফুটো দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরছিল, ঝড়ে যেটা ভেঙে গিয়েছিল কিন্তু ঠিক করা হয়নি। তাতে কোন সমস্যা হয়নি কারণ ছাউনির ভেতর তেমন কিছু ছিল না।
ছাউনির এক পাশে দেয়ালে ঠেশ দিয়ে নারানি, কোদাল, কাস্তে ইত্যাদি রাখা ছিল। পাশে কাঁচি আর মোটা দড়ি রাখা।
কুকুরের দরজার পাশে অনেকরকমের দড়ি রাখা ছিল, যদিও কুকুর আর নেই। দড়িগুলো বিভিন্ন রঙের ছিল কিন্তু লাল রঙের একটা দড়ি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
“আমার সবকিছু একদম পরিস্কার মনে আছে,” মোরিনোর নানি আস্তে করে বললেন। আমি প্রতিবেশির বাসা থেকে এসে ছাতা ঠিক করে রাখছিলাম। ইয়োরু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল..”
ইয়োক ওর কাহিনী যেরকম বলেছিল তার সাথে ওর নানির কাহিনীর কোন পার্থক্য নেই। ইয়োরু নাশপাতির ব্যাগ দেখে ওর বোনকে ডাকতে ছুটে গেল। তারপর ছাউনির দরজা খুলে চিৎকার করল। পুরো গল্পে একটা মাত্র জিনিস আমার মনে খটকা লাগাচ্ছিল, সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার আগেই পায়ের নিচে অদ্ভুত কিছু একটা অনুভব করলাম।
পা মাটির সাথে আটকে যাচ্ছিল। মাটির মেঝে, ছাদের ফুটো দিয়ে আসা বৃষ্টিতে ভিজে নরম আর আঠালো হয়ে গিয়েছিল।
পা তুলতেই মাটিতে আমার জুতোর ছাপ দেখা গেল।
ইয়ু যেদিন মারা গেল সেদিনও বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিনও ছাউনির মেঝের অবস্থা নিশ্চয়ই এরকমই ছিল। কিন্তু আমার পায়ের ছাপ তেমন একটা গভীর ছিল না, আর যমজেরা তত বাচ্চা ছিল। ওদের ওজন আমার চেয়ে অনেক কম ছিল। ওদের কি এরকম পায়ের ছাপ পড়েছিল?
খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকালাম, কঠিন বৃষ্টি হচ্ছে। আজকের চেয়ে ঐদিন যদি বেশি বৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে মেঝেও অনেক ভেজা থাকার কথা, আর মেয়েদের পায়ের ছাপ পড়ার কথা।
ইয়ুর মারা যাওয়ার দিন দুপুরের দিকে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বৃষ্টি শুরু হওয়ার একটু পরই ইয়ু ছাউনিতে গিয়েছিল। আর ইয়োরু বলেছিল ও বাড়ির ভেতরই ছিল। মৃতদেহ খুঁজে পাওয়ার সময় ইয়োৰু দরজার কাছে ছিল।