আমি মাথা বো করে বললাম কয়েকটা ভালো ছবি তোলা হলেই আমি চলে যাব। কিন্তু মোরিনোর নানি আমার কথা উপেক্ষা করে আমাকে ধাক্কিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন।
দরজা দিয়ে ঢুকতেই শু বক্স রাখা। উপরে কিছু জিনিস রাখা যা দেখে মনে হল সুভিনর ধরনের কিছু হবে। তারপর হলওয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছে। এয়ার ফ্রেসনার আর অপরিচিত মানুষের গন্ধ ভেসে আছে বাতাসে।
“তোমার নিশ্চয়ই ক্ষুধা পেয়েছে?”
“তেমন একটা না।”
উনি আমার কথা পাত্তা দিলেন না, ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে ডিশ ভর্তি খাবার সামনে এনে রাখলেন। মোরিনোর নান এলেন একটু পর। লম্বা, সাদা চুল ওয়ালা এক বুড়ো।
উনাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো আমাকে মোরিনোর বয়ফ্রেন্ড ধরে নিয়েছেন।
“তোমাকে তো একদিন ইয়োরুকে বিয়ে করতে হবে,” আমি খাব না বলাতে, নানা মাথা ঝাঁকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ছাউনিটা দেখে বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই বাসের কাছে পৌঁছাতে পারব কিনা ভাবছিলাম।
কিচেন কেবিনেটের এক পাশে একটা ছবি ছিল। ছবিতে পুতুলের মত দেখতে দুটো বাচ্চা মেয়ে। দু-জনেরই লম্বা কালো চুল। দু-জনেই সোজা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে, মুখে কোন হাসি নেই। দু-জনেরই পরনে কালো পোশাক। একজন আরেকজনের হাত ধরে রেখেছে। দেখে মনে হচ্ছে সামনের উঠানে ভোলা, কারণ ওদের পেছনে বাড়িটার সামনের দরজা দেখা যাচ্ছে।
“ইয়োরু আর ইয়ু,” আমার দৃষ্টি খেয়াল করে নানি বললেন। “তুমি কি ওর যমজ বোনের কথা শুনেছ?”
আমি মাথা ঝাঁকালাম।
“এটা ওদের ছয় বছর বয়সের সময়ে ভোলা, নানা বললেন। দু জনের কেউই ছবিটা সম্পর্কে আর কিছু বললেন না।
খাওয়ার পর বাড়ির প্রার্থনা বেদীর সামনে যেতে দেয়া হলো আমাকে। আমি জানতাম সামনে এগুতে হলে আমাকে এসব ভদ্রতা দেখানো ছাড়া উপায় নেই।
প্রার্থনা বেদীর সামনে রাখা ইয়ুর ছবি দেখে আমার মনে হল ওর মৃত্যু হয়তো ওর নানা-নানির কাছে মাত্র গতকালকের কোন ঘটনা মনে হয়। যদিও ঘটনাটা ঘটেছে নয় বছর আগে। আমার কিংবা মোরিনোর কাছে নয় বছর হল আমাদের অর্ধেক জীবনের চেয়েও বেশি–কিন্তু ওর নানা-নানির বয়সের কাছে নয় বছর কোন বছরই নয় হয়তো।
হাত জোর করে শ্রদ্ধা জানানোর পর মোরিনোর নানা-নানি আমাকে লিভিং রুমে নিয়ে বসালেন আর তাদের নাতনি স্কুলে কিরকম করছে সে ব্যাপারে জানতে চাইলেন। আমি উত্তর শুরু করার আগেই তারা নিজেরাই মোরিনো ছোটবেলায় কিরকম ছিল সে নিয়ে গল্প জুড়ে দিলেন। আমি ধরে নিলাম আমার বক্তব্য নিয়ে তাদের আসলে কোন আগ্রহ নেই।
“ওই তাই তো, ওর এলিমেন্টারি স্কুলে আঁকা কিছু ছবি আমাদের কাছে আছে!” নানি আনন্দে লাফিয়ে উঠে উধাও হয়ে গেলেন কোথাও।
নানা তার স্ত্রী যাওয়ার পর ক্ষমা প্রার্থনার সুরে আমাকে বললেন “ইদানিং আমার স্ত্রীর মাথায় অল্প একটু সমস্যা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে আমার।”
উত্তরে আমি শুধু মাথা ঝাঁকালাম। কিছু বলার চেয়ে মাথা ঝাঁকানোই আমার কাছে সঠিক প্রতিক্রিয়া হবে বলে মনে হলো।
“আসলে ইয়োরু কখনো ওর কোন বন্ধুকে বাসায় নিয়ে আসেনি, বুঝেছ? তাই তুমি আসছ শুনে ওর নানি আজকে একটু বেশিই উত্তেজিত।”
মোরিনোর নানি একটা কাগজের ব্যাগ নিয়ে ফিরে এলেন। ব্যাগের ভেতর থেকে এক গাদা পুরোনো ড্রয়িং পেপার বের হলো, মোরিনো ওর এলিমেন্টারি স্কুলে থাকার সময়ে রং আর ক্রেয়ন দিয়ে ওগুলো এঁকেছিল। মোরিনোর ম্যাপ আঁকা দেখে আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, এখন নিশ্চিত হওয়া গেল ওর মধ্যে আর্টের মেধা বলতে কিছু নেই।
কাগজগুলোর পিছে নাম আর গ্রেড লেখা ছিল।
এর মধ্যে কয়েকটা ইয়ুর আঁকা ছিল। দু-জনের ড্রইংই একসাথে রাখা ছিল। ইয়োরুর ড্রয়িং ছিল একদম ফার্স্ট গ্রেড থেকে সিক্সথ গ্রেড পর্যন্ত। কিন্তু ইয়ুরগুলো খালি ফার্স্ট আর সেকেন্ড গ্রেডের। ব্যাপারটা যেন বাস্তবতাকেই স্পষ্ট করে তুলছিল যে ইয়ু নামের মেয়েটা আর নেই।
আমি দু-জনের সেকেন্ড গ্রেডের ড্রয়িং পাশাপাশি রেখে তুলনা করলাম।
“কারো পক্ষে আসলে বলা মুশকিল ওরা কি আঁকতে চাইছিল, তাইনা?” নানি উজ্জ্বল মুখ করে বললেন। যমজ দু-জনের আঁকার ক্ষমতার মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। কিন্তু দু-জনেই একই বিষয় নিয়ে এঁকেছে আর একইরকম ড্রয়িং করেছে।
দুটো ছবিতেই বাড়ির একটা অংশ দেখা যাচ্ছে আর মাঝের অংশে লম্বা চুলের দু-জন মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে মেয়ে দুটো আসলে ওরাই।
“খোদাই জানেন ওরা কি করছে,” নানি বললেন।
“বাড়ির ভেতর দাঁড়িয়ে আছে?” নানা উত্তর দিলেন।
“তাই তো মনে হচ্ছে, নানি উত্তর শুনে হাসলেন।
আমি কিছু বললাম না, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম ওরা কি এঁকেছে। মেয়ে দুজনেরই গলার উপর লাল দাগ টানা যেটা সিলিঙের সাথে লাগানো। তারা ছাউনিতে আত্মহত্যা আত্মহত্যা খেলার ছবি এঁকেছিল।
“ওরা এই ছবিগুলো গ্রীষ্মের ছুটিতে এঁকেছিল, স্কুলের হোমওয়ার্ক ছিল। ছুটির পর ইয়ুর ড্রয়িংটা স্কুলে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু…ইয়ু মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে আঁকা এটা।” পুরনো স্মৃতি মনে করে নানি মলিনভাবে হাসলেন।
দুটো ছবির মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য ছিল না। ইয়ুর আঁকা ছবিটায় ডিটেইলিং একটু ভালো ছিল। ওরটায় লাল দাগ ছাদের বিমের সাথে লাগানো ছিল, আর বাক্সগুলো একটার উপর একটা সাজানো ছিল। বাড়ির উপরে আকাশে সূর্য ছিল। আর মেয়েদের জুতাগুলো পাশে রাখা ছিল।