মোরিনো অন্যদিকে তাকাল তারপর বই পড়ায় ফিরে গেল। আমি ওর পাশে বসে পড়লাম। ওর গলার অংশবিশেষ দেখতে পাচ্ছিলাম খালি। ও আমাকে উপেক্ষা করে বই পড়ার চেষ্টা করছিল।
আমি উঁকি দিয়ে বইয়ের নামটা দেখার চেষ্টা করলাম। পৃষ্ঠার কোণায় লেখা, “চ্যাপ্টার তিনঃ তুমি একা নও…কিভাবে পজিটিভ জীবন যাপন করা যায়।” দেখে ধাক্কা খেলাম।
মোরিনোর মাথা তখনো নিচু করা। আমাকে বলল, “আমি ভেবেছিলাম বইটা পড়তে গেলে ঘুম পাবে।”
তারপর লম্বা একটা নিরবতা। একসময় সে মুখ তুলল। “তোমাকে ইয়র কথা বলার জন্য আমার আফসোস হচ্ছে। তুমি যদি যেতেই চাও, তাহলে একলা যেতে হবে।”
বাড়িটা আর ছাউনিটা তখনো আছে। ওর নানা-নানি তখনো সেখানে বসবাস করে। কৃষিকাজ করে।
আমি জানতে চাইলাম কেন সে যেতে চায় না। সে বলল ঘুম না হওয়ার কারনে সে খুবই ক্লান্ত।
পরদিন শনিবার, স্কুল ছুটি। তাই আমি ঠিক করলাম সেদিনই গ্রামে যাব। মোরিনো আমাকে ঠিকানা আর যাওয়ার রাস্তা বাতলে দিল। দেখে মনে হচ্ছিল দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আশা যাবে। মোরিনো আমার নোটবুকে একটা ম্যাপ একে দিয়েছিল।
“কথা নাই বার্তা নাই একজন স্কুল ছাত্র যদি হঠাৎ সেখানে হাজির হয় তাহলে সবাই অবাক হবে।” আমি বললাম। সে মাথা ঝাঁকাল। বলল ফোন করে নানা-নানিকে জানিয়ে রাখবে। তাদেরকে বলা হলো গ্রামের প্রকৃতির ছবি তুলতে আমি সেখানে যাচ্ছি।
“আর কিছু?” মোরিনো বরাবরের মত অনুভূতিহীন সুরে বলল।
আমি ওর আঁকা ম্যাপের দিকে তাকালাম। “তোমার ম্যাপ দেখলেই আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়।” বলে আমি উলটো ঘুরে চলে আসলাম। লাইব্রেরির দরজায় পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো রাস্তা আমার পিঠে ওর দৃষ্টি অনুভব করতে পারছিলাম। মনে হচ্ছিল ও কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু কথাগুলো গলা পর্যন্ত এসে আটকে গিয়েছে।
ধূসর মেঘ, একঝাঁক কালো পাখি নিচু দিয়ে উড়ে গেল। আমি নোটবুকে আঁকা মোরিনোর ম্যাপটার দিকে তাকালাম। ম্যাপের বক্তব্য অনুসারে রাস্তাটা কিন্ডারগার্টেনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার কথা। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল পৃথিবীর কোন বাবা-মা কিভাবে তাদের সন্তানদের এরকম একটা স্কুলে পাঠাতে পারেন।
অর্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করতে করতে আমি মোরিনোদের পুরনো খামার বাড়ির দিকে এগুলাম। বাড়ির নাম্বার আর ল্যান্ডমার্ক জানা ছিল, সুতরাং ম্যাপ না বুঝলেও খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না বলেই আমার ধারণা।
হাঁটতে হাঁটতে বাসস্টপের বেঞ্চে বসে মোরিনোর বলা কাহিনী আবার চিন্তা করলাম, এক নিষ্ঠুর মেয়ে আর তার যমজ বোনের কাহিনী।
ইয়ুকে দড়িতে ঝোলা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।
কিন্তু মোরিনোর গল্পে একটা অংশ ছিল যার কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না–যে অংশে সে তার বোনের মৃত দেহ খুঁজে পায়।
ইয়োরু ছাউনির দরজা খুলে দৃশ্যটা দেখে চিৎকার দেয়। তারপর দৌড়ে তার নানিকে গিয়ে জানায় যে ইয়ু মৃত।
মোরিনো কি করে দৃশ্যটা দেখার সাথে সাথে জানল যে ইয়ু মৃত? তারা তো সবসময় মৃত সাজার ভান করত আর লোকজনকে চমকে দিত তাই না? তাহলে সে কেন ভাবেনি যে ওর বোন স্রেফ অভিনয় করছে?
হতে পারে যে সাধারণ মৃতদেহ হয়তো দেখতে অভিনয়ের চেয়ে অনেক আলাদা, অনেক ভয়ঙ্কর কিছু…কিন্তু ব্যাপারটা হল যে সে কখনো ভাবেনি যে এটা অভিনয়, সে সাথে সাথে দৌড়ে তার নানিকে বলতে গিয়েছিল…ব্যাপারটা আমার কাছে গোলমেলে লাগছে।
আমি ম্যাপ আর রাস্তা অবার মিলিয়ে দেখলাম। সামনে দিয়ে গভীর একটা পাহাড়ি নদী চলে গিয়েছে। ম্যাপ অনুযায়ি এখানে একটা ড্রাই ক্লিনার থাকার কথা। কাপড় চোপড় তো পরিস্কার করার পর আর শুকাতে পারবে না, আমি ভাবলাম।
ব্রিজ পার হওয়ার সময় আকাশের দিকে তাকালাম। মেঘগুলো নিচু হয়ে পর্বত চূড়ার কাছে ঝুলে আছে। আশেপাশের গাছগুলোকে অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে।
আরো কিছুক্ষণ হাটার পর আমি মোরিনোদের খামার বাড়ি খুঁজে পেলাম। পর্বত ঘেঁসে পুরোনো একটা বিল্ডিং। মস জাতীয় আগাছায় ঢেকে আছে ছাদটা, যে রকমটা মোরিনো বলেছিল। আশেপাশে গাছপালা আর ক্ষেত ছাড়া কিছু নেই, রাতে নিশ্চয়ই কালিঘোলা অন্ধকারে ঢেকে যায় সবকিছু। কোন গেট কিংবা দেয়াল নেই, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি হঠাৎ আবিস্কার করলাম ওদের উঠোনে পৌঁছে গিয়েছি।
সামনের দরজার দিকে যাওয়ার সময় বামদিকের ছাউনিটা চোখে পড়ল। এই ছাউনিতেই নিশ্চয় ইয়ুর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল? ছাউনির দেয়াল শুষ্ক সাদা কাঠ দিয়ে তৈরি। উপরে নীল রঙের তারপুলিন দেয়া, প্লাস্টিকের তার দিয়ে বাঁধা। অনেক পুরনো, একদিকে কাত হয়ে আছে।
সামনের দরজাটা কাঠ আর কাঁচ দিয়ে তৈরি, খোলা ছিল। আমি ডোরবেল বাজালাম। পেছন থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকল।
ঘুরে তাকিয়ে দেখি একজন বুড়ি মহিলা নিড়ানি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।
তার পিঠ বাঁকানো, পরনে ঢোলা ওয়ার্ক ট্রাউজার, গলায় একটা গামছা পেঁচানো। আমি ধরে নিলাম বুড়ি নিশ্চয়ই মোরিনোর নানি হবেন।
“ইয়োক গত রাতে ফোন করেছিল। আমি তো দুশ্চিন্তা শুরু করে দিয়েছিলাম যে তুমি বোধহয় আসছ না।” তিনি বললেন। তার ঝুলে যাওয়া কুঁচকানো মুখের সাথে মোরিনোর চেহারার কোন মিল পেলাম না। মোরিনোর চেহারা দেখলে মনে হয় ইতিমধ্যে মৃত, ওর নানির রোদে পোড়া চেহারার কিছুই ওর মধ্যে নেই।