“ইয়ু মারা গিয়েছিল গ্রীষ্মের ছুটির সময়। আমরা তখন সেকেন্ড গ্রেডে পড়তাম। সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল একটা সকাল ছিল। কিন্তু শিগগিরি আকাশ কালো হয়ে গেল। আর দুপুরের দিকে শুরু হল বৃষ্টি..”
দুপুরের কিছু পর ওদের মা শপিঙে গেলেন। বাবা বাসায় ছিলেন না। নানা-নানিও বাইরে। শুধু যমজ দুই বোন বাসায় একা।
প্রথমে কুয়াশার মত ঝিরঝির বৃষ্টি ছিল। টুপটাপ ফোঁটা পড়ছিল জানালায়। আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়তে লাগল।
“সাড়ে বারোটার দিকে আমি দেখলাম ইয়ু ছাউনির দিকে যাচ্ছে। আমাকে কিছু বলেনি, তাই আমি ধরে নিলাম সে হয়তো একা কিছু সময় কাটাতে চাইছে। আমিও আর ওর পিছু পিছু গেলাম না।”
ইয়োরু একা বসে বই পড়তে লাগল।
প্রায় ঘন্টা খানেক পর, সে সামনের দরজা খোলার শব্দ পেল। গিয়ে। দেখে ওর নানি ফিরেছেন, হাতে এক ব্যাগ নাশপাতি।
ওর নানি ছাতি বন্ধ করতে করতে বললেন, “পাশের বাসা থেকে এগুলো দিয়েছে। তোমাকে একটা ছিলে দেব?”
“আমি বললাম, ইয়ুকে ডেকে আনি। নানিকে দরজার ওখানে রেখে দৌড়ে ছাউনিতে গেলাম।”
ইয়োক ছাউনির দরজা খুলল-আর দৃশ্যটা দেখল। সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল।
“ইয়ু সিলিং থেকে ঝুলছিল। গলায় দড়ি পেঁচানো ছিল। আমি সামনের দরজায় ফিরে গেলাম, যেখানে নানি নাশপাতি হাতে দাঁড়ানো ছিলেন। আমাকে ভয়ে কাঁপতে দেখে অবাক হলেন।”
সে নানিকে বলল ইয়ু বেঁচে নেই।
ইয়ু নিজের গলায় ফাঁস নিয়েছে। আত্মহত্যা ছিল না, অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। শুধু যে ওর গলায় দড়ি ছিল তা নয়, ওর বগলের নিচে বুকে দ্বিতীয় আরেকটা দড়ি বাঁধা ছিল-একটা খসখসে ভারি দড়ি, খামারে যে ধরনের দড়ি ব্যবহার করা হয়। একদিক ওর বুকে বাঁধা ছিল, আরেক দিক লেজের মত ঝুলছিল। গলার দড়িটাও একই ধরনেরই ছিল। পুরোটাই একটা দড়ি ছিল কিন্তু ছিঁড়ে গিয়েছিল।
“আমার বোনের মরার কোন ইচ্ছা ছিল না। ও চেয়েছিল বুকের দড়িটা দিয়ে ঝুলবে আর আত্মহত্যার ভান করে সবাইকে ভয় দেখাবে। কিন্তু যে
মুহূর্তে ও লাফ দিয়েছিল, ওজন নিতে না পেরে দড়িটা ছিঁড়ে যায়।”
খুব কম লোকজনের মধ্যে ইয়ুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। আর এই গল্পের শেষ এখানেই।
আমার একটা প্রশ্ন ছিল কিন্তু জিজ্ঞেস করলাম না। মোরিনোর ক্লান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস শুনলাম।
সূর্য ততক্ষণে পুরোপুরি ডুবে গেছে। রাস্তার ধারের বাতিগুলো জ্বলছিল। বাসস্টপের সাথের বাতির আলোয় বাসের শিডিউল জ্বলজ্বল করছিল। আমরা বাস-স্টপের উজ্জ্বল সাদা আলোর মধ্যে বেঞ্চে বসে রইলাম।
দূরে এক জোড়া হেড লাইট দেখা যাচ্ছে। সাথের চারকোনা ছায়ার পেছনে নিশ্চয়ই একটা বাস আছে। কিছুক্ষণ পরেই ইঞ্জিনের শব্দ কানে এল। আর বাসটা আমাদের সামনে এসে থামল।
মোরিনো উঠে খোলা দরজা দিয়ে বাসে ঢুকে গেল। আমিও বেঞ্চ ছেড়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম।
কেউ কাউকে গুডবাই বললাম না আমরা। একজন আরেকজনের দিকে তাকালামও না।
৩
দিনটা ছিল শনিবার। মোরিনো ইয়োৰু ওর বোনের মৃত্যুর কাহিনী বলার দু দিন পর। আকাশে মেঘ করেছিল।
স্কুল ছিল না বলে আমি বেশ সকালে উঠে ট্রেনে চড়লাম। ট্রেনটা আমাকে নিয়ে গেল শহরের বাইরে, গ্রাম এলাকার দিকে যেখানে লোকজন কম। যতদূর যেতে থাকলাম ট্রেনের যাত্রি তত কমতে লাগল। ট্রেনে একসময় আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম। মেঘের কারনে সূর্য নেই। গাঢ় সবুজ ক্ষেতগুলো শাঁ করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।
একদম জনমানবহীন ক্ষেত খামারের কাছে এক স্টেশনে পৌঁছে আমি ট্রেন থেকে নামলাম। স্টেশনের বাইরে একটা বাস দাঁড়িয়ে ছিল। সেটায় চড়ে কিছুদূর গেলাম, যতক্ষণ না উঁচু এলাকা শুরু হলো আর গাছপালাও ঘন হতে শুরু করেছে। উপর থেকে আমরা নিচের গ্রাম দেখতে পাচ্ছিলাম। রাস্তাটা তেমন একটা চওড়া ছিল না। কোনভাবে একটা বাস যাওয়ার মত জায়গা ছিল। রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ, বাসের জানালায় টোকা দিচ্ছিল।
বনের মাঝে এক স্টপে গিয়ে বাস থেকে নামলাম। রাস্তায় আর কোন যানবাহন ছিল না। শিডিউল দেখলাম। এক ঘন্টা পর একটা বাস আছে শুধু। সন্ধ্যায় কোন বাস নেই। তার মানে এক ঘন্টা পরের বাসেই আমাকে চড়তে হবে। চারপাশে গাছপালা ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিছুদূর হাঁটার পর কয়েকটা বাড়ি দেখতে পেলাম।
এই বাড়িতে মোরিনের জন্ম হয়েছিল, এখানেই সে তার ছোটবেলা কাটিয়েছে।
আমি বাড়ির সামনে থেমে একবার চারপাশ ভালো করে দেখলাম। রোদ থাকলে হেমন্তকালে পুরো এলাকা লাল দেখানোর কথা। কিন্তু মেঘের জন্য সবকিছু কেমন ম্যাড়মেড়ে দেখাচ্ছিল।
বাড়িটার দিকে এগুনোর সময় গতকাল স্কুলে মোরিনোর সাথে হওয়া আলাপের কথা মনে করলাম।
শুক্রবার লাঞ্চের সময়, লাইব্রেরি প্রায় জনশূন্য ছিল। দেয়াল ধরে বইয়ের সেলফ লাগানো। বাকি অংশে ডেস্ক আর চেয়ার রাখা পড়াশোনা করার জন্য। রুমের সবচেয়ে নির্জন কোনায় মোরিনো বসেছিল। ওর সাথে গিয়ে কথা বললাম।
“গ্রামে তুমি যে বাড়িতে থাকতে সেটা আমি দেখতে চাই।”
সে বই পড়ছিল। মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“তুমি কি ভুলে গিয়েছ নাকি যে লোকজন যেসব জায়গায় মারা যায় সেসব জায়গা পরিদর্শন করতে আমার ভালো লাগে?”